মৃত্যুর সংখ্যা যখন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কমতে আরম্ভ করল, তখন কটার্ড বেশ কয়েকবার বিভিন্ন অজুহাতে রিও-র সঙ্গে দেখা করে। ওর উদ্দেশ্য ছিল মহামারীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আসল খবর জানা। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে রিও ওকে আশার কথা শোনাতে লাগল। কিন্তু এ ধরনের উত্তর ভাল লাগত না ওর, এবং নানা রকমের বিরূপ মানসিক প্রতিক্রিয়াও হত। কখনও ক্রোধ প্রকাশ করত, কখনও ভেঙে পড়ত নিরাশায়। কটার্ড-এর এই অবস্থা দেখে একদিন ওকে করুণা দেখানোর জন্যে বাধ্য হয়ে রিও বলল, মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখে মনে হচ্ছে মহামারী দ্রুত গতিতে পিছু হটছে, তবু আমরা যে সত্যি সত্যি সঙ্কট পেরিয়ে এসেছি সে। কথা এখুনি নিশ্চিত করে বলা কঠিন। রিও-র এই মতামত সাধারণ মানুষের ভেতর ছড়িয়ে দেবার জন্যে উঠে-পড়ে লাগল কটার্ড। যে অঞ্চলে ও বাস করে সেখানকার দোকানদারকেও কটার্ড এগুলো শোনাল। তবু হতাশা কাটল না ওর। একদিন তারিউকে সে বলল, এবার যে-কোনদিন ফটক খুলে দেয়া হবে। তখন দেখবেন সবাই আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
জানুয়ারির প্রথম তিন সপ্তাহে খুব ঘন ঘন পরিবর্তন হলো কটার্ড-এর চালচলনে। কখনও কখনও প্রতিবেশী এবং পরিচিত মানুষদের ভেতর নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করল ও, সে সময় ওদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতে লাগল। আবার মাঝে মাঝে দিনের পর দিন সবাইকে এড়িয়ে চলল। এ সময়ে ও নিজের বাসায় আত্মগোপন করে রইল। তখন ওকে রেস্তোরাঁ, থিয়েটার হল, কাফে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। চুপচাপ বাসায় পড়ে থাকে; পাশের, একটা রেস্তোরাঁর সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিয়েছিল, তারাই ওকে সময়মত খাবার পৌঁছে দিত। টুকিটাকি কিছু কেনার দরকার পড়লে রাতের বেলায় বাইরে যেত ও। আর কেনাকাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে, যে-পথে লোকজনের চলাচল কম, আলোর ব্যবস্থা ভাল নয়, সেই পথ দিয়ে চুপি চুপি বাসায় ফিরে আসত। এই লুকিয়ে লুকিয়ে ফেরার পথে কয়েকবার তারিউ-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ওর। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তারিউ কিছু রূঢ় শব্দ ছাড়া অন্য কোন কথা বের করতে পারেনি ওর মুখ দিয়ে। কয়েকদিন যেতে না যেতে হঠাৎ করে আবার পাল্টে যেত ওর আচরণ। তখন সবার সঙ্গে মেলামেশা আরম্ভ করে ও। মেতে ওঠে প্লেগ নিয়ে আলোচনায়। জানতে চায় মানুষের মতামত। মিশে যায় রাস্তার জনসমুদ্রে।
পঁচিশ জানুয়ারি থেকে আবার আত্মগোপন করল কটা। এর দুদিন পরে হঠাৎ করে দেখা হলো তারিউ-এর সঙ্গে। একটা নির্জন গলিতে একা একা পায়চারি করছিল ও। কটার্ড তারিউকে ওর বাসায় যাবার প্রস্তাব দিল।
হাঁটতে হাঁটতে কটার্ড প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, সরকারি ইস্তেহারের অর্থ কি এই যে প্লেগের দ্রুত উপশম হচ্ছে; আপনার কি ধারণা?
এটা ঠিক যে সরকারি ইস্তেহার প্রচার করলেই প্লেগের উপশম হয় না। তবে এটাও ঠিক যদি তেমন কোন দুর্ঘটনা না ঘটে তাহলে প্লেগ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিদায় নেবে। বাইরের অবস্থা দেখে তাই মনে হচ্ছে, উত্তর দিল তারিউ।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। যদি তেমন কোন দুর্ঘটনা না ঘটে তাহলেই এমনটা হওয়া সম্ভব। কিন্তু দুর্ঘটনা, কিছু না কিছু তো ঘটবেই। তাই না?
সে কথা চিন্তা করেই কর্তৃপক্ষ ফটক আরও পনেরো দিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছেন। তবে সবকিছু যেভাবে এগুচ্ছে তাতে কর্তৃপক্ষকে এই ঘোষণা বাতিল করতে হবে।
সে রকম কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে। কিন্তু আমার বিশ্বাস শহরের ফটক আবার খুলে দেয়া হবে। এবং সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে, এই সম্ভাবনাই বেশি। ১. আপনার কথা না হয় মানলাম, কিন্তু সবকিছু আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে, একথায় আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
তারিউ হাসল। সিনেমাহলে নতুন ছবি আসবে।
কিন্তু কার্ড-এর মুখে কোন হাসি দেখা গেল না। প্রশ্ন করল, এত বড় দুর্ঘটনার পরও শহরের জীবনযাত্রার কোনরকম পরিবর্তন হবে না?
আমার ধারণা, প্লেগের ফলে শহরের অনেক কিছুই বদলে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে তা নাও হতে পারে। কেননা, মানুষ ভাবতে চাইবে যে কিছুই ঘটেনি, এবং সেভাবেই জীবন শুরু করবে তারা। অবশ্য এটাও ঠিক মানুষ সত্যি সত্যি সব ভুলতে পারে না। মানুষের মনে প্লেগের কিছু স্মৃতি থেকে যাবেই।
মানুষের মন নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। আমি জানতে চাই সরকার এবং শাসন ব্যবস্থার কথা। সেগুলোও কি আগের মত চলবে?
ওসব ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তবে আমার ব্যক্তিগত ধারণা এত বড় আকস্মিক দুর্ঘটনার পর শাসনযন্ত্রকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বেশ সময় লাগবে। তাছাড়া এখনকার অবস্থায় কিছু নতুন সমস্যা দেখা দেবে, সেগুলো সামলাবার জন্যে শাসন ব্যবস্থায় কিছু না কিছু রদবদল করতেই হবে।
এবার কটার্ডকে বেশ খুশি-খুশি মনে হলো। তারিউ-এর মন্তব্য ভাল লেগেছে ওর। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন। সবাইকে আবার নতুন করে জীবন আরম্ভ করতে হবে।
ইতিমধ্যে কটার্ড-এর বাসার কাছে পৌঁছে গিয়েছে ওরা। কটার্ডকে আগের চেয়ে অনেক উৎফুল্ল মনে হলো। মনে হলো। ভবিষ্যৎকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করার মত মনোবল ফিরে পেয়েছে। হয়তো কল্পনা করতে শুরু করেছে: অতীতকে সম্পূর্ণরূপে, মুছে ফেলে শহরে একেবারে নতুনভাবে জীবন শুরু হতে যাচ্ছে, সবকিছু নতুন ভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে।