হাত ধরে ওকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে চলল রিও। গ্রাঁদও কোন বাধা দিল না। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল, ডাক্তার, সবাই জানে, আমি খুব শান্ত আর সাধারণ মানুষ। কিন্তু এটা প্রমাণ করার জন্যে কী কঠিন চেষ্টাই না করতে হয়েছে আমাকে। অথচ আজ, সেই চেষ্টাটুকু করার ক্ষমতাও আমার আর নেই।
অকস্মাৎ থমকে দাঁড়াল গ্রাঁদ। থরথর করে কাঁপছে ওর শরীর। জ্বর এলে যেমন হয় তেমনি জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো। ওর একটা হাত মুঠোর ভেতর নিয়ে রিও-র মনে হলো প্রচণ্ড জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গ্রাঁদ-এর শরীর।
এক্ষুণি আপনাকে বাসায় ফিরতে হবে, বলল রিও। কিন্তু দৌড়াতে আরম্ভ করল গ্রাঁদ। কয়েক পা দৌড়ে থমকে দাঁড়াল ও দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে একবার এপাশে একবার ওপাশে দুলতে লাগল। তারপর একটা চক্কর খেয়ে পড়ে গেল ওখানেই। দুচোখ দিয়ে তখনও গড়িয়ে পড়েছে অশ্রু। চোখে-মুখে জমেছে ময়লা। পথচারীদের কেউ কেউ থেমে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে দৃশ্যটা, তারপর আগের মতই এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে, কাছে আসার সাহস করল না কেউ। রিও এসে ওকে তুলে নিয়ে গেল গাড়িতে।
বিছানায় শুয়ে আছে গ্রাঁদ। শ্বাস নিতে পারছে না, ফুসফুস বন্ধ হয়ে আসছে। চিন্তায় পড়ে গেল রিও। বাড়িতে কোন লোকজন নেই। তাই ওকে হাসপাতালে নেয়ার দরকার নেই। তারিউ সাথে থাকলে ওরা দুজনেই ওর দেখাশোনা করতে পারবে।
বালিশের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে গ্রাঁদ-এর মাথাটা। দুই গালে একটা ধূসর সবুজাভা। চোখ দুটো ঘোলাটে, দৃষ্টিহীন। একটা ভাঙা পুরনো কাঠের বাক্স দিয়ে আগুনের ব্যবস্থা করছে তারিউ। সেই দিকে তাকিয়ে আছে গ্রাঁদ। আমার অবস্থা বোধহয় খুব খারাপ, বিড়বিড় করে বলল ও। কথা বলার সময় ফুসফুস দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ বের হচ্ছে। ওকে কথা বলতে নিষেধ করল রিও। যাওয়ার সময় কথা দিল খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে ও। একটু ফাঁক হলো গ্রাঁদ এর ঠোঁট দুটো। এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল সেই ফাঁকে। ডাক্তার, টুপি খুলে অভিবাদন জানাচ্ছি, আবার যেন সুস্থ হয়ে উঠতে পারি, কথাগুলো শেষ করতে না করতেই আবার নেতিয়ে পড়ল গ্রাঁদ।
কয়েক ঘণ্টা পর ওরা ফিরে এসে দেখে বিছানায় হেলান দিয়ে উঠে বসেছে গ্রাঁদ। আগের চেয়ে ওকে অনেক শান্ত মনে হচ্ছে। টেবিলের ড্রয়ার থেকে ওর লেখার পাণ্ডুলিপিটা বের করার জন্যে ওদের অনুরোধ করল ও।
তারিউ পাণ্ডুলিপিটা ওর হাতে দিতেই ও ওটাকে নিজের বুকের ওপর চেপে ধরল। তারপর রিও-র হাতে দিয়ে ইশারায় ওকে অনুরোধ করল পড়তে। পঞ্চাশ পৃষ্ঠার মত পাণ্ডুলিপিটা। বেশির ভাগ পাতায় একই কথাকে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। মে মাস, এক অশ্বারোহিণী মহিলা, বল্গনা অ্যাভিন, এ-কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে; বিভিন্ন ভাবে তাদের সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়াও আছে অনেক নোট, ব্যাখ্যা। শেষ পাতার নিচে অত্যন্ত পরিষ্কার করে লেখা প্রিয়তমা জেনি, আজ বড়দিন…আর…। পাতার ওপরে লেখা ওর সেই প্রিয় বাক্যটির সর্বশেষ সংশোধিত রূপ। পড়ে দেখুন না, বলল গ্রাঁদ। রিও পড়ল: মে মাসের এক সুন্দর প্রভাতে ক্ষীণাঙ্গী তন্বী এক অশ্বারোহিণীকে বল্গনা অ্যাভিন ধরে উজ্জ্বল পাটল রঙের এক মাদি ঘোড়ায় চেপে অনেকেই যেতে দেখে থাকতে। পারেন। তার চারপাশে পুষ্পের…
এরকমই লেখা আছে, না? জ্বরে কাঁপছে গ্রাঁদ-এর স্বর। রিও ওর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল। বিছানায় ছটফট করতে লাগল গ্রাঁদ। হ্যাঁ। আমি জানি আপনি কী ভাবছেন এখন। সুন্দর শব্দটা ঠিক হয়নি। তাই… রিও খুব শক্ত করে চেপে ধরল ওর হাত দুটো।
থাক, ডাক্তার, থাক। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর সময় কোথায়…, প্রচণ্ড বেগে ওঠানামা করতে আরম্ভ করল ওর বুক। তারপর চিৎকার করে উঠল ও, পুড়িয়ে ফেলুন ওটাকে, পুড়িয়ে ফেলুন।
ইতস্তত করতে লাগল রিও। কিন্তু গ্রাঁদ ওর যন্ত্রণাকাতর গলা দিয়ে অত্যন্ত জোরে জোরে পুনরাবৃত্তি করতে লাগল কথাগুলো। চুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আগুনের মধ্যে পাণ্ডুলিপিটা ছুঁড়ে মারল রিও। দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। আলোয় ভরে গেল ঘর। ওদের দিকে পিঠ ফিরে শুয়ে পড়ল গ্রাঁদ। দেয়ালে ঠেকল ওর মুখ। সিরাম দেয়া হলো ওকে। রাতটাও টিকবে কিনা সন্দেহ, তারিউ-এর কানে কানে বলল রিও। রাতে, ওখানেই থেকে গেল তারিউ।
সারারাত গ্রাঁদ-এর আসন্ন মৃত্যুর চিন্তায় ছটফট করল রিও। কিন্তু সকালে গিয়ে দেখে বিছানায় বসে আছে ও, গল্প করছে। তারিউ-এর সঙ্গে। জ্বর নেই। নেতিয়ে পড়ার ভাবটা ছাড়া রোগের অন্য কোন লক্ষণও নেই।
দেখুন, ডাক্তার, গ্রাঁদ বলল, আবার শুরু করব লেখাটা।
রিও তাকাল তারিউ-এর দিকে। ওকে তখন কুরেকুরে খাচ্ছে সন্দেহ। অপেক্ষা করে দেখা যাক কী দাঁড়ায়, বলল তারিউ।
দুপুরের পরেও অবস্থার পরিবর্তন হলো না। সন্ধ্যার পর গ্রাঁদকে সম্পূর্ণরূপে বিপদমুক্ত মনে হলো। এ ঘটনায় অভিভূত হয়ে পড়ল রিও। কিন্তু আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। এর কয়েকদিন পর প্লেগ আক্রান্ত, এক মেয়েকে নিয়ে আসা হলো হাসপাতালে। পরীক্ষা করে ও দেখল বাঁচার কোন আশাই নেই মেয়েটার। মুমূর্ষ রোগীর ওয়ার্ডে পাঠানো হলো ওকে। মেয়েটা প্রলাপ বকছিল, এবং নিউমোনিয়া-প্লেগের সব লক্ষণই ছিল ওর মধ্যে। কিন্তু পরের দিন সকালে ওর জ্বর নেমে গেল। দুপুরেও তাপ বাড়ল না। পরের দিন সকালে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে আরম্ভ করল ও। পরের সপ্তাহে এ-ধরনের আরও চারটা কেস দেখতে পেল রিও।