ডিসেম্বরের শেষে রিও মঁসিয়ে অথন-এর কাছ থেকে একটা চিঠি পেল। তিনি লিখেছেন: তার ক্যাম্পে থাকার সময় শেষ হয়ে গেছে, তবু তাঁকে ক্যাম্পে রাখা হয়েছে, কারণ তার ক্যাম্পে আসার তারিখটা নিয়ে গোলমাল বেধেছে; মাদাম অথন ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাবার পর এ নিয়ে প্রিফেক্ট-এর অফিসে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে, তারা তাকে জানিয়েছে অফিসের কাজে কখনও ভুল হয় না; ব্যাপারটা সম্পর্কে খোঁজ-খবর, নেয়ার জন্যে রিওকে তিনি অনুরোধ করেন।
কয়েকদিন পর ওর সঙ্গে দেখা করতে এলেন মঁসিয়ে অথন। এর মধ্যেই অনেক রোগা হয়ে গেছেন ভদ্রলোক।
কিছু করার কথা চিন্তা করেছেন? জানতে চাইল রিও। নিশ্চয় অফিসে অনেক কাজ জমেছে।
ভাবছি কিছুদিন ছুটি নেব।
ঠিক বলেছেন। আপনার কিছুদিন বিশ্রাম নেয়া দরকার।
না। সেজন্যে নয়। আমি আবার ক্যাম্পে ফিরে যেতে চাই।
রিও ভাবল কথাটা ভুল শুনেছে ও। না বলে পারল না, এই তো কদিন আগে বেরিয়ে এলেন।
মাফ করবেন। কথাটা আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারিনি। শুনেছি কিছু কিছু সরকারি কর্মচারী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ক্যাম্পে কাজ করছে। আমি ওদের সাহায্য করতে চাই। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাই। তাছাড়া, কথাটা একটু অদ্ভুত শোনাবে, এতে আমি এই ভেবে সান্ত্বনা পাব যে ছেলেটার সঙ্গে আমার যোগাযোগ এখনও সম্পূর্ণ কেটে যায়নি।
রিও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মঁসিয়ে অথন-এর দিকে। আগের সেই ভাবলেশহীন কঠিন চাহনিতে সত্যিই কী কোন কোমল ভাব এসেছে? হ্যাঁ, সত্যিই তো, চোখ দুটো কেমন ভেজাভেজা, আগের সেই তীক্ষ্ণতা নেই।
হ্যাঁ। অবশ্যই, বলল রিও, আপনি যখন চাইছেন, আমি ব্যবস্থা করে দেব।
.
বড়দিনের পর্ব না আসা পর্যন্ত শহরের জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন এল না। র্যাঁবেয়া একদিন চুপি চুপি রিওকে বলল, সেই দুই পাহারাদার ছোকরার মাধ্যমে সে তার প্রেমিকার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে, এবং উত্তরও পেয়েছে; রিও-ও ইচ্ছে করলে গোপনে চিঠি পাঠাতে পারে। দীর্ঘ কয়েক মাস পর এই প্রথম চিঠি লিখতে বসল রিও। কিন্তু কাজটা বড় কঠিন আর পরিশ্রমের বলে মনে হলো ওর। বহুদিনের বিস্মৃত একটা ভাষাকে নানা কৌশলে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করল ও। শেষ পর্যন্ত চিঠিটা শেষ করতে পারল এবং পাঠিয়ে দিল গোপন পথে। তবে উত্তর আসতে দেরি হলো অনেক।
আগের মতই দিন দিন কেঁপে উঠছে কটার্ড। চোরাকারবার, থেকে প্রচুর পয়সা কামাচ্ছে ও। কিন্তু গ্রাঁদ বড়দিনের আয়োজনের সঙ্গে কিছুতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না।
অন্যান্য বছরের বড়দিনের উৎসবের সাথে এবারের বড়দিনের কোন মিল নেই। দোকানগুলো শূন্য, আলো নেই। মিষ্টির দোকানে চোখে পড়ে নকল চকলেট, আর নয়তো কালি ঠোঙ্গা। ট্রাম যাত্রীদের চোখমুখে ফুটে আছে উদাসীনতার ছাপ। এ-বছর শুধু। বড়লোকরাই এই উৎসব উদযাপন করল, তবে প্রকাশ্যে নয়। লজ্জায়, লুকিয়ে লুকিয়ে দোকানের পিছনে বসে অথবা নিজের ঘরের মধ্যে বসে মদ খেলো। গির্জায়, আনন্দগীতির চেয়ে প্রার্থনাই বেশি করে করা হলো।
এক সন্ধ্যায় হাসপাতালে কাজ করতে এল না গ্রাঁদ। এতে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল রিও। সকালে উঠেই ওর বাসায় গিয়ে হাজির হলো ও। কিন্তু গ্রাঁদকে খুঁজে পেল না কোথাও। ওকে খোঁজার জন্যে সবাইকে অনুরোধ করে এল রিও।
সন্ধ্যায়, র্যাঁবেয়া হাসপাতালে এসে বলল অনেক দূর থেকে এক মুহূর্তের জন্যে গ্রাঁদকে দেখতে পেয়েছিল ও; উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করছিল, চেহারাও কেমন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল; কিন্তু চোখে পড়তে না পড়তেই ভিড়ের ভেতর হারিয়ে যায় ও, অনেক চেষ্টা করেও র্যাঁবেয়া ওকে খুঁজে বের করতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বেরোল তারিউ এবং রিও।
ভীষণ ঠাণ্ডা বাতাস বইছে তখন। একটা কাঠের খেলনার; দোকানের সামনে গ্রাঁদকে দেখতে পেল রিও। আলমারির কাছে মুখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গ্রাঁদ, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। দেখেই ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল রিও-র হৃদয়। এই নীরব অশ্রুপাতের কারণ খুব সহজেই বুঝতে পারল ও।
মুহূর্তের মধ্যে বহুদিনের পরিচিত একটা দৃশ্য ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে। গল্পটা গ্রাঁদই ওকে বলেছিল। এক বড়দিনের উৎসবে সুন্দর পোশাক পরে একটা দোকানের কাঁচের আলমারির সামনে দাঁড়িয়েছিল গ্রাঁদ এবং জেনি। হঠাৎ আবেগের জোয়ারে। জেনি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কত সুখী আমি। রিও অনুভব করল, গ্রাঁদ-এর কানে বাজছে এখন জেনির সেই কণ্ঠ। গাঁদ। কী ভাবছে সেটাও অনুভব করতে পারল ও। মানুষের জীবনে এমন মুহূর্ত আসে যখন কাজের দায়িত্ব, কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা সবকিছুকে মনে হয় ক্লান্তিকর, বেদনাদায়ক বোঝ।
কাঁচের ওপর রিও-র প্রতিফলন দেখতে পেল গ্রাঁদ। তখনও নীরবে কাঁদছে ও। এবার ঘুরে দাঁড়াল, দোকানের সামনে হেলান : দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ওর জন্যে।
ডাক্তার, ডাক্তার…, আর কিছুই বলতে পারল না গ্রাঁদ। রিও-র মুখ দিয়েও কোন কথা বেরুতে চাইল না।
সবই বুঝতে পেরেছি। বুঝেছি আপনার দুঃখ কোথায়।
শুধু যদি একবার ওকে চিঠি লেখার সুযোগ পেতাম। শুধু একবার যদি ওকে জানাতে পারতাম…ও যেন সুখী হয়…মনের ভেতর কোন ক্ষোভ যেন পুষে না রাখে।