আমার এখন একমাত্র আগ্রহ, মানুষ কীভাবে মহাপুরুষ হয় তা জানা, নির্বিকার কণ্ঠে বলল তারিউ।
কিন্তু তুমি তো ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করো না।
হ্যাঁ। আর সমস্যাটা সেখানেই। আজকে, আমাদের জীবনের একমাত্র সমস্যা এটাই।
ওরা কতকগুলো কণ্ঠের কোলাহল শুনতে পেল, আর সেই সঙ্গে একটা বন্দুকের গুলির আওয়াজ। কিছুক্ষণ পর আবার শুনতে পেল কুদ্ধ জনতার চিৎকার।
ফটকের সামনে নিশ্চয় গোলমাল বেধেছে, বলল তারিউ।
তাই মনে হচ্ছে। তবে এতক্ষণে থেমে গেছে বোধহয়, বলল রিও।
এসব গোলমাল কোনদিনই থামবে না, বরং বাড়বে; এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম।
হয়তো তাই। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু আমি সত্যিকারের সহানুভূতি অনুভব করি পরাজিত মানুষের জন্যে, মহাপুরুষদের জন্যে নয়। বীরত্বের কোন মূল্য আমার হৃদয়ের কাছে নেই। আমি একজন সাধারণ মানুষ এটাতেই আমি সবচেয়ে আগ্রহী।
হ্যাঁ, আমাদের দুজনের লক্ষ্যই হয়তো এক, কেবল পার্থক্য, আপনার মত কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার নেই। দ্য প্লেগ
রিও ভাবল তারিউ হয়তো ঠাট্টা করছে। ও হাসতে হাসতে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু অস্পষ্ট আলোয় দেখল ওর মুখে লেগে : আছে বিষাদ আর আন্তরিকতার ছাপ।
কি ভাবছেন, বলল তারিউ, বন্ধুত্বের খাতিরে আমাদের এখন, কী করা উচিত?
আপনি যা চান তাই করব।
চলুন, একটু সাঁতার কেটে আসি। এমন নিষ্পাপ আনন্দ মহাপুরুষরাও উপভোগ করতে পারে। আপনার কী মনে হয়? _ আবার হাসল রিও। তখনও কথা শেষ হয়নি তারিউ-এর, বলল, পরিচয়পত্র সঙ্গেই আছে, বাইরের জেটি পর্যন্ত যেতে অসুবিধে হবে না। দিন রাত এই প্লেগের মধ্যে বসে থেকে শুধু প্লেগের কথা চিন্তা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। যারা প্লেগের শিকার তাদের বাঁচানোর জন্যে আমরা অবশ্যই সংগ্রাম করব, কিন্তু এর বাইরে আর কিছু ভাবতে না পারলে এ সংগ্রাম তো অর্থহীন।
ঠিক বলেছেন। চলুন, যাই।
কয়েক মিনিট পরে ওদের গাড়ি থামল ফটকের সামনে। পাহারাদারকে দেখাল পরিচয়পত্র। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে ওগুলো ফেরত দিল ওদের হাতে।
ফটকের বাইরে অনেকটা খোলা জায়গা, সেখানে অনেকগুলো। বড় বড় পিপা ছড়ানো। সেটা পেরিয়ে এগিয়ে চলল ওরা। বাতাস মদ আর মাছের আঁশটে গন্ধে ভারি। একটু পরে ওদের নাকে ভেসে এল আইডিন এবং সামুদ্রিক আগাছার গন্ধ। বুঝতে পারল সমুদ্রের ধারে পৌঁছে গেছে ওরা। এমন সময় শুনতে পেল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বড় বড় উপলখণ্ডের গায়ে।
জেটির ওপর উঠতেই ওরা দেখতে পেল সামনে বিস্তৃত সমুদ্র, ধীরে ধীরে আন্দোলিত হচ্ছে। একটা পাথরের ওপর বসল দুজনা। মন্থর গতিতে উঠছে আর নামছে শান্ত ঢেউ, চিকচিক করছে আলোর প্রতিফলনে; কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যাচ্ছে, এরপর ভেঙে চুরমার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে। সামনে দিগন্তব্যাপী, ঘন অন্ধকার। হাতের তালুতে ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের স্পর্শ অনুভব করল রিও। হঠাৎ এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠল ওর মন। তারিউ-এর। দিকে চোখ ফিরিয়ে ওর মুখেও একই প্রশান্তির ছাপ দেখতে পেল
কাপড়চোপড় খুলে ফেলল ওরা। প্রথমে কঁপ দিল রিও। ডোবার সময় পানি মনে হলো ঠাণ্ডা, কিন্তু ভেসে ওঠার পর অত, ঠাণ্ডা লাগল না। কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর রাতের সমুদ্রকে বেশ উষ্ণই মনে হলো ওর। পিছনে পানি উছলে ওঠার শব্দ শুনল ও। অনুমান করল, ঝাঁপ দিয়েছে তারিউ। চিত হয়ে মরার মত পানির ওপর শুয়ে থাকল ও। মাথার ওপর বিশাল আকাশ, চাঁদ আর অসংখ্য তারায় ঝলমল করছে। তারিউ-এর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল ও।
আবার উপুড় হলো রিও। পাশাপাশি সাঁতার কাটতে কাটতে এগিয়ে চলল দুই বন্ধু। তারিউ ওর চেয়ে অনেক ভাল সাঁতারু। একই তালে পা পড়ছে দুজনের। বাইরের পৃথিবী থেকে এখন ওরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। শহরের দূষিত পরিবেশ আর প্লেগের ছোঁয়া থেকে অনেক দুরে।
প্রথমে থামল রিও। আবার জেটির দিকে ধীরে ধীরে ফিরতে আরম্ভ করল ওরা। এক জায়গায় এসে হঠাৎ বরফের মত হিম স্রোতের মাঝখানে পড়ে গেল দুজনে। ফাঁদে পড়ে শক্তি চাড়া দিয়ে উঠল ওদের; জোরে জোরে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল ওরা। জেটিতে উঠে কাপড়চোপড় পরে নিয়ে ফিরে চলল শহরে! আবার তুলে নিতে হবে কাজের দায়িত্ব।
.
৪.০৭
সাত সারাটা ডিসেম্বর মাসই ধকধক করে জ্বলল প্লেগের আগুন। শহরের বাইরে লাশ পোড়ানোর শ্মশানটাকে দিনরাত তার খোরাক জুগিয়ে চলল প্লেগ, আর শত শত মানুষকে রোগাক্রান্ত অবস্থায় গৃহহারা করে পাঠাল ক্যাম্পে ক্যাম্পে { ঝাঁকি খেতে খেতে, অথচ নির্ভুলভাবে নিজের পথ চলায় কোন বিরতি দিল না প্লেগ। কর্তৃপক্ষ আশা করেছিলেন শীত শুরু হলে প্লেগের এই একটানা গতিতে কিছুটা বাধা আসবে, এই আশায় আশায় শেষ হয়ে গেল শীতের প্রথম ঝলক, কিন্তু প্লেগের দাপাদাপি একটুও কমল না।
শহরে খোলা হলো আর একটা হাসপাতাল। অবস্থা এমন দাঁড়াল, রিও রোগী ছাড়া আর কারও সঙ্গেই কথা বলার সুযোগ পায় না। নিউমোনিয়া-প্লেগের সংখ্যা বাড়ার ফলে রোগীদের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করল ও। এখন সব ব্যাপারেই ও যা করতে চায় সেগুলোকে ওরা মেনে নেয়। আগে, আক্রান্ত হবার সময় কেমন যেন নেতিয়ে পড়ত, আর নয়তো একটা উন্মত্ত ভাব দেখাত। এখন ওরা নিজেরাই ওর কাছে জানতে চায় কী করলে ওদের উপকার হবে। সবসময় পানীয় কিছু খেতে চায়, শরীর গরম রাখার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলে; নাহলে ঝগড়া-ঝাটি করে; জেদাজেদি করে।