আদালতের যে ছবিটা চিরদিনের জন্যে আমার মনে গেঁথে যায় তা হচ্ছে আসামির কাঠগড়ায় সেদিন যে আসামি দাঁড়িয়েছিল তাঁর চেহারা। মাথায় ধূসর চুল, বয়স তিরিশ। দেখে মনে হচ্ছিল ভীষণ। ভয় পেয়ে গেছে সে, এবং নিজের অপরাধ স্বীকার করার জন্যে ব্যর্থ হয়ে উঠেছে। আমি লোকটার অবস্থা দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল একটা হলদে পেঁচা, যে হঠাৎ করে প্রচুর আলোর মধ্যে এসে দিশেহারা হয়ে হারিয়ে ফেলেছে তার দৃষ্টিশক্তি। ডানহাতের একটা নখ বারে বারে কামড়াচ্ছিল সে।
হৃদয়ের গহিনের একটা খামচি অনুভব করেছিলাম আমি। আমার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সেই তুচ্ছ লোকটা। আশেপাশে কে কী বলছে কিছুই আমার কানে ঢুকছিল না। শুধু উপলব্ধি করছিলাম, চারপাশের সবাই ওই লোকটির প্রাণ নেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু একটা আদিম অনুভূতির প্রবল জোয়ার আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল অপরাধী ওই মানুষটার পাশে। _ লাল গাউন পরা আমার বাবা উঠে দাঁড়ালেন। তখন তিনি। সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। দয়ালু ব্যক্তিটি হারিয়ে গেছে তার ভেতর থেকে। দীর্ঘ এক একটা বাক্য বেরিয়ে আসছে তার মুখ দিয়ে। আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেবার জন্যে জুরিদের কাছে আবেদন জানালেন তিনি।
সেদিনের পর থেকে বাবার শখের সেই ট্রেনের সময়সূচিটা চোখে পড়লেই আমার সারা শরীরে বয়ে যেত ঘৃণার একটা স্রোত। আদালত, আইন, বিচার, মৃত্যুদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরী করা, এগুলো সম্পর্কে দারুণ একটা বিতৃষ্ণা জেগে উঠল আমার ভেতর। উপলব্ধি করলাম ওইসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় মাঝেমাঝে বাবাকেও উপস্থিত থাকতে হয়। সেই দিনগুলোতে খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন তিনি। আর এজন্যে রাতেই ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতেন।
তারপরে প্রায় এক বছরের মত ওই বাড়িতে ছিলাম আমি। হঠাৎ একদিন বাবা আমার কাছ থেকে অ্যালার্ম ঘড়িটা চাইলেন। বললেন, পরের দিন খুব ভোরে তাকে ঘুম থেকে জাগতে হবে। সে রাতে আমি একটুও ঘুমোতে পারিনি। পরের দিন বাবা বাসায়। ফেরার আগেই আমি ওখান থেকে পালিয়ে আসি।
বাইরে থাকার সময় হঠাৎ একদিন তার একটা চিঠি পেলাম। আমি দেখা করলাম। আমার পালিয়ে যাবার কোন কারণ না দেখিয়ে খুব শান্তভাবে বললাম, তিনি আমাকে ফিরে আসতে বাধ্য করলে আমি আত্মহত্যা করব। অনেক বক্তৃতা, অনেক উপদেশ দেয়ার পর শান্ত হলেন তিনি। এটুকু বুঝেছিলাম প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন বাবা। বেশ কিছুদিন পরপর আমি মাঝে মাঝে মা-র সঙ্গে দেখা করতাম। তখন বাবার সঙ্গেও দেখা হত। তাকে বেশ খুশি। খুশি দেখাত। বাবা মারা যাবার পর মাকে আমার কাছে নিয়ে। এসেছিলাম। তিনিও মারা গেছেন, নাহলে এখনও আমার সঙ্গেই থাকতেন।
আঠারো বছর বয়সে দারিদ্রের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। কিন্তু তখন এসব ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ ছিল না, আমার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল মৃত্যুদণ্ডাদেশ। আসামির কাঠগড়ায় সেই যে পেঁচাটাকে একদিন দেখেছিলাম, তারই সাথে বোঝাঁপড়া করতে চেয়েছিলাম জীবনে। আমার মনে হত চারপাশের সমস্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এই অন্যায় মৃত্যুদণ্ডাদেশের ওপর। আমি একটা রাজনৈতিক দলে যোগ দেই। আমার জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে এদের সঙ্গে। ইউরোপে এমন দেশ খুব কমই। আছে যার গণআন্দোলনে আমি অংশ নিইনি।
আমাদের দলও মাঝে মাঝে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিত। আমাদের বোঝানো হত যেখানে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বলে কিছুই থাকবে না তেমন পৃথিবীকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে এই ধরনের কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নিতেই হবে। কিন্তু আমার ভেতর এ নিয়ে সংশয় দানা বাঁধছিল। তারপর এল সেই দিনটা যেদিন আমার চোখের সামনে একজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরী করা হলো। ঘটনাটা ঘটেছিল। হাঙ্গেরিতে।
বধ্যভূমিতে লোকটিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বুকের যে। জায়গায় হৃৎপিণ্ড থাকে, সেই জায়গা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল, একসঙ্গে কয়েকজন। বুকের ওপর যে ছিদ্রটা হয়েছিল তাতে একটা হাত ঢুকতে পারত। এরপর থেকে কোনো রাতেই আমি ঠিকমত ঘুমোত পারিনি।
আমার মনে হত আমি নিজেও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্যে দায়ী। এ-ভাবে আমার জীবন হয়ে উঠল নিঃসঙ্গ। সবার মাঝে থাকলেও এই একাকিত্ব কাটত না।
আজও আমার ওই মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি। বছরের পর বছর ধরে মনে মনে আমি লজ্জা অনুভব করে আসছি। অনুভব করেছি, আমার যত সদিচ্ছাই থাক না কেন, প্রত্যক্ষভাবে না হলেও আমি নিজেও হত্যাকারীদের একজন। তাই ঠিক করেছি, মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে বা মৃত্যুতে সাহায্য করতে পারে এমন কোনকিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়াব না কখনও।
আমার এখনকার কর্তব্য, আপনার পাশে থেকে এই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। রিও, আমি খুব দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে পারি, এই পৃথিবীতে এমন কিছুই নেই আমাকে নতুন করে জানতে হবে-শিখতে হবে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর রিও প্রশ্ন করল, জীবনে শান্তি, পাওয়ার জন্যে মানুষের কোন পথ অনুসরণ করা উচিত, সে ব্যাপারে আপনার কোন ধারণা আছে?
হ্যাঁ, জবাব দিল তারিউ, সহানুভূতির পথ।
এতক্ষণ ধরে যে মৃদু বাতাস বইছিল সেটা এখন একটু জোরে বইতে শুরু করল। সমুদ্র থেকে একটা দমকা হাওয়া উঠে এসে আশেপাশের বাতাসকে লোনা গন্ধে ভরিয়ে তুলল। ওরা শুনতে পেল ছলাৎ ছলাৎ শব্দে সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে।