এরপর সম্পূর্ণ নীরবে কাটল কয়েকটা মুহূর্ত। অনেক চেষ্টার পর মঁসিয়ে অথন অবশেষে বললেন, আশা করি জ্যাকুইসকে খুব কষ্ট পেতে হয়নি। তারিউ এই প্রথম মঁসিয়ে অথনকে তাঁর ছেলের নাম ধরে ডাকতে শুনল। এতেই ও বুঝল, মঁসিয়ে অথনও অনেক বদলে গেছেন।
তখন পশ্চিম দিগন্তে ডুবছে সূর্য। ভাঙা ভাঙা মেঘের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার শেষ কিরণ। হ্যাঁ, উত্তর দিল তারিউ, সত্যিই ও তেমন কষ্ট পায়নি। ওরা চলে আসার পরও সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন মঁসিয়ে অথন।
গনজালেস-এর কাছ থেকে বিদায় নিল ওরা। ওদের পৌঁছে দেবার জন্যে বেরিয়ে এল ক্যাম্প ম্যানেজার। এ-সময় ওরা শুনতে পেল কাছের স্ট্যান্ডগুলো থেকে ভেসে আসছে কর্কশ শব্দ। আগে যেসব মাইক থেকে খেলার ফলাফল ঘোষণা করা হত, পরিচয় করিয়ে দেয়া হত নতুন খেলোয়াড়দের, সেই মাইক থেকে এখন রাতের আহারের জন্যে সবাইকে নিজের নিজের তাঁবুতে ফেরার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এক পা দু পা করে ফিরে চলল ওরা। সবাই যখন ঢুকে গেল তাঁবুতে, ছোট ছোট দুটো ইলেকট্রিক ট্রাক, মোট বইবার কাজে যেমন দেখা যায় রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, ছড়ানো-ছিটানো তাঁবুগুলোর মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে যাত্রা শুরু করল নিজেদের। একেকটা তাঁবুর সামনে গিয়ে থামছে ওরা। আর বন্দী। মানুষ বাইরে এসে থালাসহ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ওপর পানে। ট্রাকের ওপর রাখা বড় বড় দুটো কড়াই থেকে লম্বা হাতায় করে। খাবার তুলে পরিবেশন করা হচ্ছে অপেক্ষমাণ থালায়। তারপর পরের তাবুর উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রাক।
দেখছি, বেশ দক্ষ তো, মন্তব্য করল তারিউ।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ম্যানেজারের মুখ। তাই না? এই ক্যাম্পে আমরা সবাই আসলে দক্ষতায় বিশ্বাস করি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মাথার ওপর পরিষ্কার আকাশ। কতকগুলো বাদুড় ক্যাম্পের ওপর ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। দেয়ালের বাইরে ঘেউ ঘেউ করছে একটা কুকুর। তাঁবুগুলোর সামনে থেকে ভেসে আসছে প্লেটের ওপর চামচ নাড়াচাড়ার শব্দ।
.
৪.০৬
ছয় শেষ হয়ে এল নভেম্বর মাস। সকালে এখন বেশ শীত শীত করে। কিন্তু সন্ধ্যায় আবার গরম হয়ে ওঠে বাতাস। এক সন্ধ্যায় তারিউ ঠিক করল ওর জীবনের সব কথা রিওকে শোনাবে। রাত দশটায় ও রিওকে বলল, চলুন; আপনার সেই হাঁপানি রোগীর বাসা থেকে ঘুরে আসি।
ওদের দেখে বক্তৃতা দিতে শুরু করল বুড়ো, শহরের লোকেরা আস্তে আস্তে অধৈর্য হয়ে উঠছে। চিরদিন সেই একই শ্রেণীর মানুষকে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়। অনির্দিষ্টকাল ধরে এই অবস্থা চলতে পারে না। এরপর হাত কচলাতে কচলাতে বলল, আবার হৈ-হুঁল্লোড়ের দিন ফিরে আসবে।
এমন সময় ছাদে পায়ের শব্দ শুনতে পেল ওরা। বুড়োর স্ত্রী বলল, পাশের বাসার মেয়েরা ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মহিলা আরও জানাল, ছাদ থেকে চারপাশের দৃশ্য খুব সুন্দর দেখায়।
যান না, ওপরে গিয়ে দেখে আসুন চারপাশে কী মজার দৃশ্য, স্ত্রীর কথা সমর্থন করল বুড়ো, কী চমৎকার বাতাস।
ওপরে উঠে কাউকে দেখতে পেল না ওরা। কেবল তিনটি চেয়ার আছে ওখানে। যতদূর চোখ যায় শুধু ছাদ আর ছাদ। সবচেয়ে দূরের ছাদটা ঠেকে আছে শহরের সবচেয়ে কাছের পাহাড়টির গায়ে। রাতের আবহাওয়ায় আকাশ তখন একেবারে পরিষ্কার, তারাগুলোকে মনে হচ্ছে রূপার পাত। বন্দরের লাইট হাউস থেকে ছড়িয়ে পড়েছে হলুদ আলো। চারদিকে অখণ্ড নীরবতা।
হ্যাঁ। সত্যিই চমৎকার, একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল রিও।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল তারিউ। একটুক্ষণ চুপ থাকার পর। ও বলল, হ্যাঁ। ঠিক। রিও-র পাশের চেয়ারটাতে বসল ও।
আচ্ছা, রিও, বলল তারিউ, আপনি কখনও জানার চেষ্টা করেছেন আমি কে? আপনাকে আমি বন্ধু ভাবতে পারি?
কেন নয়! আমরা তো বন্ধুই। শুধু সেটা জানানোর সময় এবং সুযোগ আমাদের ঘটেনি।
যাক। আশ্বস্ত হলাম। এই বন্ধুত্বের খাতিরে যদি আমরা ঘণ্টাখানেকের জন্যে ছুটি নিই?
হাসল রিও। বেশ। তাই হবে।
জীবন আরম্ভ করেছিলাম মোটামুটি ভাল ভাবেই। যে কাজে হাত দিতাম তাতেই সফল হতাম। মেয়েদের সাথে খুব সহজেই সম্পর্ক গড়ে উঠত, তেমনি ছাড়াছাড়িও হয়ে যেত খুব সহজে।
আপনার মত দারিদ্রের ভেতর আমাকে শৈশব কাটাতে হয়নি। আমার বাবা ছিলেন সরকারি উকিল। যেমন দয়ালু তেমনি সৎ :, প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। আর মা ছিলেন সরল, এবং কিছুটা লাজুক। অবশ্য আমার বাবা আদর্শ স্বামী ছিলেন না। কিন্তু তাহলে কি হবে, তাঁর আচরণ কখনোই শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যেত না। সব ব্যাপারেই তিনি মধ্যপথ অনুসরণ করতেন।
আমার বাবার একটা বিশেষত্ব ছিল। বিছানায়, তার হাতের পাশে সবসময় থাকত ট্রেনের সময়সূচি। যেসব প্রশ্নে স্টেশন মাস্টাররা রীতিমত মাথা চুলকায় সেগুলোর উত্তর বাবা চটপট দিয়ে দিতেন। প্রতি সন্ধ্যায় তিনি বসে পড়তেন তাঁর ওই জ্ঞান বাড়ানোর। সাধনায়, এ নিয়ে তাঁর এক ধরনের গর্ববোধও ছিল। বাবার এই অদ্ভুত শখ দেখে আমি ভীষণ মজা পেতাম। দুজনে মেতে উঠতাম রেল ভ্রমণের এক অদ্ভুত খেলায়। এভাবে আমাদের মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বয়স আমার তখন সতেরো, বাবা একদিন বলনে কোর্টে গিয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনতে হবে। তিনি হয়তো আশা করেছিলেন এতে আমি উকিল হিসেবে তাঁর নৈপুণ্য দেখার সুযোগ পাব, আর আদালতের জাঁকজমক, দেখে প্রভাবিত হব, এবং ওকালতিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করার উৎসাহ বোধ করব।