সেদিন দুপুরে গ্যারেজে গাড়ি ঢোকাচ্ছে রিও, এমন সময় সে দেখল, একজন পাদ্রির কাঁধে ভর দিয়ে কোনরকমে ওর দিকে হেঁটে আসছে মিশেল। সামনে ঢলে পড়েছে মাথা। হাত পা কেমন বাঁকা বাঁকা দেখাচ্ছে। দম দেয়া পুতুলের মত ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোচ্ছে। পাদ্রির নাম ফাদার প্যানালু। ওরা কাছে না আসা পর্যন্ত গাড়িতেই বসে রইল রিও। কাছে আসতেই ও দেখল, মিশেল-এর চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। নিশ্বাসের সাথে ওর নাক দিয়ে বেরিয়ে আসছে বিশ্রী একটা শব্দ।
বহু কষ্টে মিশেল বলল, আমার চোখমুখ কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল। তাই হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম। এমন সময় শরীরের সব জায়গায় ব্যথা অনুভব করলাম। ঘাড়ে, দুই বগলে আর পুরুষাঙ্গে।
রিও হাত বুলিয়ে দেখল, ওর ঘাড়টা গিঁট পড়ার মত শক্ত, বেশ ফুলে উঠেছে। ও বলল, মিশেল, তুমি বাসায় গিয়ে শুয়ে থাকো। আমি বিকেলে তোমাকে দেখতে আসব।
মিশেল চলে যাওয়ার পর, রিও ফাদারের কাছে জানতে চাইল, ফাদার, ইঁদুর মরা সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
আমার তো মনে হয় মহামারী শুরু হয়েছে। চশমার বড় বড় কাঁচের আড়ালে জ্বলজ্বল করে উঠল ফাদার প্যানালুর চোখ।
বাড়ি ফিরে স্বাস্থ্যনিবাস থেকে পাঠানো স্ত্রীর টেলিগ্রামে চোখ বুলাচ্ছে রিও, হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। ভদ্রলোক ওর একজন পুরনো, রোগী। নাম জোসেপ গ্রাঁদ। মিউনিসিপ্যাল অফিসের কেরানি। আর্থিক অবস্থা ভাল না। তাই চিকিৎসার জন্যে রিও কোন ফি নেয় না ওর কাছ থেকে।
ডাক্তার সাহেব, আমার এক প্রতিবেশীর হঠাৎ এক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আপনাকে এক্ষুণি প্রয়োজন। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগল ভদ্রলোক।
কয়েক মিনিট পর, শহরের প্রান্তে, একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছুল রিও। নোংরা সিঁড়ি, দুর্গন্ধে ভরা। অর্ধেক পথ ওপরে উঠে ও দেখল, ওকে নেয়ার জন্যে খুব দ্রুত নেমে আসছে গ্রাঁদ। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স লোকটার। বেশ লম্বা। হাঁটার সময় সামনে ঝুঁকে পড়ে শরীর। কাঁধ সরু। হাত-পা লিকলিকে। গোঁফ হলুদ, বিবর্ণ।
ডাক্তার সাহেব, ওর অবস্থা এখন একটু ভাল। প্রথমে দেখে ভেবেছিলাম, হয়তো ওকে আর ফেরাতে পারব না, কথাগুলো বলে কয়েকবার নাক ঝাড়ল গ্রাঁদ।
তিনতলায় পৌঁছে রিও দেখল বাঁ দিকের একটা দরজায় লাল চক দিয়ে লেখা: ভেতরে আসুন। গলায় দড়ি দিয়েছি।
ঘরের ভেতর ঢুকল ওরা। মাঝখানে একটা চেয়ার কাত হয়ে। পড়ে আছে। ছাদের হুক থেকে ঝুলছে দড়ি। খাবার টেবিলটা এক কোণে সরানো।
ডাক্তার সাহেব, আমি তখন বাইরে যাচ্ছিলাম। এই ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম ভেতর থেকে কেমন একটা চাপা গোঙানির শব্দ আসছে। এমন সময় ওই লেখাগুলোর ওপর আমার চোখ পড়ল। ঠিক তখুনি শুনতে পেলাম, ভেতর থেকে কে যেন আর্তনাদ করে উঠল। শুনে রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। যাক, সময় থাকতে ওকে নামাতে পেরেছি। না হলে, মাথা চুলকাতে লাগল গ্রাঁদ।
দরজা ঠেলে পাশের, কামরায় ঢুকল ওরা। ঘরটা পরিষ্কার ঝকঝকে। আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। একটা খাটের ওপর শুয়ে আছে একজন লোক। মনে হয় অসুস্থ। ঘন ঘন শ্বাস টানছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাল. সে। চোখ রক্তবর্ণ। রিও-র মনে হলো লোকটার শ্বাস-প্রশ্বাসে ইঁদুরের কিচমিচ শব্দ শুনতে পাচ্ছে ও। ওর শরীরের কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। ওকে অভয় দিয়ে রিও বলল, আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দুএকদিনের মধ্যেই সেরে উঠবেন।
অনেক ধন্যবাদ, ডাক্তার সাহেব। লোকটার গলার স্বর ক্ষীণ।
গ্রাঁদ-এর কাছে রিও জানতে চাইল, পুলিসে খবর দিয়েছেন?
মাথা নত করল.গ্রাঁদ। বলল, না, এখনও জানাইনি। ভাবলাম, প্রথমে ডাক্তারকে…। ওকে থামিয়ে রিও বলল, ঠিক আছে। দেখা যাক কী করা যায়।
ওদের কথাবার্তা শুনে আতঙ্ক দেখা দিল লোকটার মাঝে। সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় উঠে বসল সে। বলল, ডাক্তার সাহেব, আমি এখন ভাল আছি।
আপনি ভয় পাবেন না। এতে ভয় পাবার কিছু নেই। আইনের খাতিরে এটা করতেই হবে। তাছাড়া, পুলিসকে জানান, আমার কর্তব্য, ওকে বুঝিয়ে বলল রিও।
ওহ, কান্নায় ভেঙে পড়ল লোকটা।
গোঁফে হাত বোলাতে বোলাতে গ্রাঁদ বলল, মশিয়ে কটার্ড, শাস্তু হোন। আপনি যদি এর পরে উল্টোপাল্টা কিছু করেন, তখন সব দোষ পড়বে ডাক্তার সাহেবের ঘাড়ে, বুঝতে পারছেন।
কটার্ড-এর চোখ ভরে উঠল কান্নায়। বারবার বলল সে, বিশ্বাস করুন, এ ধরনের আর কিছু ঘটবে না। তখন পাগলামি চেপেছিল, আমার মাথায়। আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। : প্রেসক্রিপশন লিখে কটার্ড-এর হাতে দিল রিও। বলল, বেশ, আপনার অনুরোধ রাখব। আপাতত জানাব না কাউকে। দিন দুই পর আবার এসে দেখে যাব আপনাকে। কিন্তু আপনি আর ছেলেমানুষী করবেন না।
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রিও গ্রাঁদকে বলল, শুনুন, পুলিসে খবর দিতে আমি বাধ্য, তবে অফিসারকে অনুরোধ করব তিনি যেন তদন্তটা কয়েকদিন মুলতবি রাখেন। রাতে কারও থাকা দরকার। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই ওর?
কাউকে তো দেখছি না। আমিও ভাল চিনি না ওকে। অবশ্য আজ রাতটা থাকতে পারি, সৎ প্রতিবেশীর মত কথাটা বলল গ্রাঁদ।
নিচে নামার সময় নিজের অজান্তেই সিঁড়ির অন্ধকার কোণগুলোয় নজর বোলাল রিও। গ্রাঁদ-এর কাছে ও জানতে চাইল, আচ্ছা, আপনাদের অঞ্চলে ইঁদুর মরা কমেছে? |||||||||| সুস্পষ্ট করে কিছু বলতে পারল না গ্রাঁদ। ভাসা-ভাসা কিছু এ-ব্যাপারে সে শুনেছে বটে, কিন্তু গুজবে কান দেয়া ওর স্বভাব নয়। তাছাড়া, এমনিতেই ভীষণ ব্যস্ত লোক সে।