আগেই কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছিল প্লেগের সঙ্গে নিউমোনিয়া। এবার তার সংক্রমণ সারা শহরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এইসব রোগী যখন কাশে তখন তাদের কফের সঙ্গে উঠে আসে রক্ত। আর রোগীরা মারাও যায় খুব তাড়াতাড়ি। সাধারণ প্লেগের চেয়ে এটাকে অনেক বেশি ছোঁয়াচে বলে মনে হলো। তাই স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবাণুমুক্ত কাপড়ের মুখোশ পরতে আরম্ভ করল।
খাদ্য-সংকটও ওদিকে ভয়াবহ রূপ নিল। যেসব খাবার দোকানে পাওয়া যায় না মুনাফাখখারদের কাছ থেকে সেগুলো চড়া দামে কিনতে হয় এখন। এর ফলে গরিব মানুষেরা চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। ওরা কাছের শহর আর গ্রামগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিল যেখানে অনেক সস্তায় পাওয়া যায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল ওইসব জায়গায় যাওয়ার অনুমতি এখন কর্তৃপক্ষের দেয়া উচিত। একটা শ্লোগানে ছেয়ে গেল শহরের সব দেয়াল। খাবার আর মুক্ত বাতাস চাই। এর কিছুদিন পর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বেরুতে লাগল।
কর্তৃপক্ষ খবরের কাগজগুলোকে নির্দেশ দিলেন যেভাবেই হোক আশার কথা প্রচার করতে হবে। সাংবাদিকরা অত্যন্ত নৈপুণ্যের · সঙ্গে তাদের কর্তব্য পালন করলেন। এসময়কার রোজকার কাগজেই লেখা হতে লাগল। শহরের অধিবাসীরা সাহস এবং ধৈর্যের চমৎকার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু যে শহরের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, যে শহরকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হচ্ছে নিজের ওপর, সেখানে সে-মুহূর্তে কোনকিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। সাংবাদিকরা যাই বলে চেঁচান না কেন, শহরের সত্যিকারের খবর জানতে তারিউ ঘুরতে লাগল ক্যাম্পে ক্যাম্পে।
স্টেডিয়ামে যে ক্যাম্পটা খোলা হয়েছিল র্যাঁবেয়াকে সঙ্গে নিয়ে একদিন সেটা দেখতে গেল তারিউ। শহরের এক প্রান্তে স্টেডিয়াম। এক পাশে বিরাট এক রাস্তা, অপর পাশে মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত পোড়ো জমি। স্টেডিয়ামের চারপাশে উঁচু কংক্রিটের দেয়াল। চারটে ফটকে সবসময় পাহারা দিচ্ছে চারজন সান্ত্রী। কংক্রিটের উঁচু দেয়ালগুলো ক্যাম্পের বিচ্ছিন্ন মানুষকে বাইরে চলমান মানুষদের উৎসুক দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রেখেছে। ভেতরে আটকা পড়া মানুষরা সারাদিন ধরে বাইরে যেসব মোটর গাড়ি চলাচল করে তার শব্দ শুনতে পায়, আর ওই শব্দের কম-বেশি হওয়া থেকে অনুমান করে নেয় শহরের লোকজন কখন কাজ থেকে ঘরে ফিরছে আর কখনোই বা তারা তাদের কর্মস্থলে যাচ্ছে। এ থেকে তারা অনুমান করে নেয় বাইরের জীবন ঠিক আগের মতই চলছে।
তারিউ এবং র্যাঁবেয়া গেল রোববারের বিকেলে। ওদের সঙ্গে ছিল গনজালেস। র্যাঁবেয়া তখনও পর্যন্ত ওর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছে। র্যাঁবেয়া ওকে প্রস্তাব দিয়েছিল ক্যাম্প দেখাশোনার কাজে সাহায্য করতে। গনজালেস শুধু রোববারে কাজ করতে রাজি নয়। সেদিন ওরা গনজালেসকে সঙ্গে নিল ক্যাম্প কমান্ডারের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিতে।
স্টেডিয়ামে ঢুকে ওরা দেখল চারপাশ লোকে লোকারণ্য। মাঠে কয়েকশো ছোট ঘোট লাল তাঁবু। ভেতরে কম্বল, বিছানা আর কাপড়চোপড়ের বান্ডিল। ক্যাম্পের নিয়ম হচ্ছে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে নিজের নিজের তাঁবুতে ঢুকতে হবে। তারিউ, র্যাঁবেয়া আর গনজালেস যখন গেল তখন কেউ বসে আছে তাঁবুর সামনে, স্ট্যান্ডের ওপর; কেউবা পায়চারি করছে মাঠে। তবে সবার দৃষ্টিই উদাস, হতাশায় ভরা।
সারাদিন ধরে ওরা করে কী? র্যাঁবেয়াকে প্রশ্ন করল তারিউ।
কী আর করবে? করার মত কিছুই তো নেই, উত্তর দিল র্যাঁবেয়া। এরপর বলল, প্রথম যখন ওদেরকে এনে এখানে ঢোকানো হয় তখন ওরা এত হৈ-চৈ করত যে কোন কথা শোনা যেত না। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে সবাই কেমন যেন নির্বাক হয়ে উঠছে।
মনে মনে ওদের এই নীরবতার কারণ খোঁজার চেষ্টা করল তারিউ। কিছু দৃশ্য ভেসে উঠল ওর কল্পনায়। ওর এই সব চিন্তা ভাবনাকে ডাইরিতে লিখেও রাখে ও। লেখে: বিভিন্ন তাঁবুর ভেতর ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে অসুস্থ মানুষগুলোকে। তাদের চারপাশে সারাক্ষণ ভনভন করছে মাছি। গা চুলকাচ্ছে সবাই। প্রথম দিকে ওরা একে অপরকে শোনাত নিজের শঙ্কা বা ক্রোধের কথা। তখন অনেক সহৃদয় শ্রোতা পাওয়া যেত। কিন্তু ক্যাম্পে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার ফলে কারও অভাব-অভিযোগ শোনার মত। শ্রোতা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াল। তাই ওরা হয়ে পড়ল নির্বাক। শুধু তাই নয়, সবার প্রতি অবিশ্বাস জন্মাল ওদের। এখন এখানে দাঁড়ালে মনে হয়, মাথার ওপর ধূসর আকাশ থেকে শিশির কণার মত অবিশ্বাস ঝরে পড়ছে লাল রঙের তাঁবুগুলোর ওপর। কিন্তু সবচেয়ে যা বেদনাদায়ক তা হচ্ছে ওদের কথা ওদের আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবরা ভুলে গেছে, এবং ওরা সেটা অনুভব করে।
ওদেরকে দেখে ক্যাম্পের ম্যানেজার কাছে এসে বলল, মঁসিয়ে অথন আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। গনজালেসকে ওখানে রেখে তারিউ এবং ব্লাবৈয়াকে ভদ্রলোক নিয়ে গেল বড় চত্বরটার কাছে। সেখানে তখন একাই বসে ছিলেন মঁসিয়ে অথন। ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। পোশাক আগের মতই ফিটফাট। শুধু চুল আঁচড়াননি, আর জুতোর ফিতা খোলা। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল অকে, চোখ পর্যন্ত তুলতে চাইছিলেন না। বললেন, আপনাদের দেখে খুব খুশি হয়েছিল। ডাক্তার রিও আমার পরিবারের জন্যে অনেক করেছেন। তাকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।