তাঁর ঘুম ভাঙল সকালে উঠেই প্রথমে ছুটে গেলেন তিনি ফাদারের ঘরে। তখনও বিছানায় শুয়ে আছেন ফাদার। আগের দিনের মত চেহারায় লালচে ভাবটা নেই। মরা মানুষের মত পাণ্ডুর দেখাচ্ছে তাঁকে। চোখ-মুখের ফোলা ফোলা ভাবটা এখনও আছে। বিছানার পাশের জ্বলন্ত ল্যাম্পটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। ভদ্রমহিলাকে ঘরে ঢুকতে দেখে তাঁর দিকে মুখ ফেরালেন। ভদ্রমহিলার মনে হলো সারারাত ধরে কে যেন ফাদারকে একটা মুগুর দিয়ে পিটিয়েছে। এখন তাঁর মুমূর্ষ অবস্থা।
কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রমহিলা।
ফাদার বললেন, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। ডাক্তার ডাকার দরকার নেই। আমাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে। পারেন। এটাই সরকারি নির্দেশ।
তাঁর উদাসীন কথা শুনে চমকে উঠলেন ভদ্রমহিলা। ভয়ে ছুটলেন টেলিফোন করতে।
দুপুর বেলা এল রিও। ফাদারের সমস্ত শরীর পরীক্ষা করে ও দেখল ফুসফুসের কিছু অসুবিধা ছাড়া প্লেগের কোন লক্ষণ নেই। ব্যাপারটায় অবাক হয়ে গেল ও।
রোগের কোন চিহ্ন আপনার শরীরে দেখতে পাচ্ছি না, ফাদারকে আশ্বাস দিয়ে বলল রিও। তবে নিশ্চিত করে কিছু বলা অসম্ভব। তাই আপনাকে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করতেই হবে।
অদ্ভুতভাবে হাসলেন ফাদার। হয়তো ভদ্রতা দেখালেন, কিন্তু কিছু বললেন না। টেলিফোন করার জন্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রিও। ফিরে এসে বলল, আমিও আপনার সঙ্গে থাকব।
অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আপনি তো জানেন, ধর্মযাজকের জন্যে বন্ধু বলে কিছু নেই। তাদেরকে নিঃশেষে আত্মসমর্পণ করতে হয় ঈশ্বরের কাছে।
মাথার ওপর একটা ক্রুশ ঝুলছিল। ওটাকে নামিয়ে তাঁর হাতে দেবার জন্যে রিওকে অনুরোধ করলেন ফাদার। ক্রুশটা হাতে নিয়েই তিনি একদৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর থেকে একটা কথাও আর বললেন না ফাদার। তাঁর চিকিৎসার জন্যে যা যা করা হলো সবকিছুই মেনে নিলেন। শুধু কুশটাকে এক মুহূর্তের জন্যেও হাতছাড়া করলেন না। কিন্তু তাঁর রোগটা কী সেটা কেউই বুঝতে পারল না। শরীরের তাপ ক্রমাগত বেড়েই চলল। আর বাড়তে লাগল কাশি। সন্ধ্যার দিকে কাশির সঙ্গে বেরিয়ে এল একটা লালচে পদার্থ। পরের দিন সকালে মারা গেলেন ফাদার প্যানালু। তখনও তার চোখ দুটো ছিল আগের মত শান্ত, নির্বিকার। মৃত্যুর কারণ হিসেবে তাঁর কার্ডে লেখা হলো: সন্দেহজনক রোগ।
ইতিমধ্যে আর একটা নতুন জিনিস চালু হলো শহরে। হঠাৎ করেই বেড়ে গেল বর্ষাতির ব্যবহার। রাস্তায় বেরুলে দেখা যায় রবারের তৈরি চকচকে পোশাক পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে শহরবাসীরা। কিছু দিন থেকে খবরের কাগজে প্রচার করা হচ্ছিল দুশো বছর আগে দক্ষিণ ইউরোপে প্লেগ-মহামারীর সময় সেখানকার ডাক্তাররা সংক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্যে তৈলাক্ত পোশাক ব্যবহার করত। এ-কারণেই বর্ষাতির ব্যবহার হঠাৎ করে বেড়ে গেল। এ সুযোগে দোকানদাররা পুরনো ফ্যাশনের বর্ষাতিও বাজারে ছাড়তে আরম্ভ করল।
.
৪.০৫
পাঁচ এ-বছর ‘অল সোলস ডে’তে কেউই কবরস্থানে মৃত আত্মীয়স্বজনের কবর দেখতে গেল না। অন্যান্য বছর এ-দিনটিতে দেখা যেত রাস্তায় ভাড়াটে ট্যাক্সিগুলো মৌ মৌ করছে চন্দ্রমল্লিকার হালকা সুবাসে; কবরে ফুল দেয়ার জন্যে সার বেঁধে, আত্মীয়স্বজনের কবরের দিকে এগিয়ে চলেছে মহিলারা। দীর্ঘদিন ধরে যেসব আত্মীয়স্বজন নিঃসঙ্গ পরিত্যক্ত অবস্থায় শুয়ে আছে কবরের অন্ধকারে, এইদিনে তাদের জন্যে শোক করে ওরা। কিন্তু প্লেগের বছরে মানুষ তাদের মৃতব্যক্তিদের স্মরণ করতে চাইল না। কেননা, এমনিতেই তাদের কথা বড় বেশি ভাবছে ওরা। দুঃখ আর বেদনার অশ্রু নিয়ে ওদের কাছে আবার যাবার তাই আর কোন প্রশ্ন আসে না। ওরা আর বিস্মৃত কেউ নয়, যার কাছে, বছরে একবার এসে নিজের দোষ স্থলন করে মানুষ। বরং অবাঞ্ছিত স্মৃতি ওরা, যাদের ভুলে যেতে চায় লোকে। বাস্তবিক এ কারণেই মৃতের দিনকে নীরবে অথচ ইচ্ছেকৃতভাবে উপেক্ষা করল সবাই। কেননা, কটার্ড এর ভাষায় এখন প্রতিটি দিন মৃতের দিন।
বেশ কিছুদিন সবাই যখন দেখল প্লেগে মৃত্যুর সংখ্যা খুব একটা বাড়ছে না, মৃতের সংখ্যার যে গ্রাফিক চার্টটি রোজ তৈরি করা হয় অনেকদিন সেটা ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর একটা মন্থরগতি এসেছে সেটায়, তখন আরও অনেকের মত ডাক্তার রিচার্ড-এর মনেও জাগল আশা।
একদিন সে মন্তব্য করল, আমার মনে হয় রোগের প্রকোপ আর বাড়বে না। আস্তে আস্তে এটা এখন কমতেই থাকবে। আর পুরো কৃতিত্ব ডাক্তার ক্যাসেল-এর বানানো সিরামের।
ডাক্তার ক্যাসেল ওর সঙ্গে একমত হতে পারল না। বলল, ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, ঠিক এ-রকম সময়েই একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে গেছে রোগের দাপট।
কর্তৃপক্ষ অনেকদিন থেকেই নানাভাবে চেষ্টা করছিলেন মানুষের মনোবল শক্ত রাখার। কিন্তু মৃতের সংখ্যা বাড়ার ফলে তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। এবার এই সুযোগে তারা ডাক্তার এবং স্বেচ্ছাসেবকদের একটা সভা ডাকার প্রস্তাব দিলেন যেখানে সবাই তাদের মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ পাবে। কিন্তু সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই আবার বেড়ে গেল প্লেগের আক্রমণ, আর ওদিকে হঠাৎ করে মারা গেল রিচার্ড। আবার হতাশায় ডুবে গেলেন কর্তৃপক্ষ। প্রিফেক্ট-এর অফিস ছাড়া শহরের আর সব সরকারি অফিস এবং ঘরবাড়িতে ভোলা হলো হাসপাতাল আর নয়তো ক্যাম্প।