.
৪.০৪
রিও এবং ওর সহকর্মীদের সঙ্গে কাজে যোগ দেয়ার পর থেকে ফাদার প্যানালু-র বেশির ভাগ সময় কাটে হাসপাতালে হাসপাতালে, আর নয়তো এমন সব জায়গায়, যেখানে তাঁকে প্লেগের রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হয়। এর ফলে ঘন ঘন মৃত্যুর দেখা পাচ্ছেন তিনি। আর তাই প্রায়ই তার মনে হয় হয়তো যে কোন মুহূর্তে তাকেও এই রোগের শিকার হতে হবে, এবং মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনাও শুরু করেছেন তিনি। অবশ্য তার মানসিক প্রশান্তিতে যে ফাটল ধরেছে, এটা বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না। কিন্তু যেদিন চোখের সামনে মঁসিয়ে অথন-এর ছোট্ট ছেলেটাকে মারা যেতে দেখলেন, সেদিন থেকে তাঁর ভেতর একটি পরিবর্তনের জোয়ার আরম্ভ হলো। তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠল দুর্ভাবনা আর উদ্বেগের চিহ্ন।
একদিন রিওকে ফাদার বললেন, ডাক্তারদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া কি একজন ধর্মযাজকের উচিত? এই শিরোনামে আমি একটা ছোট নিবন্ধ লিখছি। খুব তাড়াতাড়ি একটা ধর্মীয়সভা ডেকে বক্তৃতা দেব। আশা করি আপনিও আসবেন।
ফাদার প্যানালু-র দ্বিতীয় ধর্মীয়সভায় আগের চেয়ে অনেক কম .. মানুষ এল তাঁর বক্তৃতা শুনতে। আগের বারের তুলনায় তিনভাগের একভাগ মানুষ এল সেদিন। কেননা ইতিমধ্যে ধর্মের প্রতি শহরবাসীদের আকর্ষণ অনেক কমে এসেছে; তারা সাধারণ ধর্মীয় আচর-আচরণের বদলে ঝুঁকে পড়েছে উদ্ভট কুসংস্কারের দিকে।
আগের বারের তুলনায় অনেক শান্ত গলায়, অনেক ভেবেচিন্তে বক্তৃতা আরম্ভ করলেন ফাদার। কয়েকবার আটকে গেল কথা। এবার আর আপনারা না বলে আমরা বলে সম্বোধন করলেন তিনি।
বললেন, হয় স্রষ্টাকে ঘৃণা করতে হবে, আর নইলে তাকে ভালবাসতে হবে। কিন্তু ঘৃণা করার সাহস আমাদের কারও আছে কী? আরও বললেন, ডাক্তারের কাছ থেকে ধর্মযাজকদের সাহায্য গ্রহণ করা উচিত নয়।
এই বক্তৃতার কয়েকদিন পরেই ফাদার প্যানালুকে গির্জায় তাঁর থাকার ঘরটা ছেড়ে দিতে হলো। প্লেগের জন্যে তখন অনেক বাসস্থানই জবরদখল করা হয়েছে। ফাদারকে থাকতে দেয়া হলো ধার্মিক এক বৃদ্ধামহিলার বাসায়।
এখানে আসার পর থেকেই দুর্বল বোধ করতে শুরু করলেন তিনি। দৈহিক এবং মানসিক, দুদিক থেকেই। এক সন্ধ্যায়, সেন্ট। ওডালিয়ার ভবিষ্যদ্বাণীর গুণাগুণ নিয়ে খুব উৎসাহের সঙ্গে, আলোচনা করছিলেন ভদ্রমহিলা, সে-সময় ফাদার কিছুটা অধৈর্যের ভাব দেখালেন। এতে ভদ্রমহিলা তার ওপর কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়ে পড়লেন।
এরপর থেকে প্রতি সন্ধ্যায় নিজের শোবার ঘরে যাওয়ার সময় ফাদার দেখতে পান ড্রয়িংরুমের চেয়ারে তাঁর দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন ভদ্রমহিলা। এবং নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে মহিলা বললেন, আপনার জন্যে শুভরাত্রি কামনা করি, ফাদার।
এক সন্ধ্যায় ফাদার তার হাতের কবজি, বগল, এবং কপালে প্রচণ্ড তাপ অনুভব করলেন। পরের দিন সকালে ভদ্রমহিলা দেখলেন, ফাদার তাঁর ঘর থেকে বেরুচ্ছেন না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর কিছুটা ইতস্তত করে দরজায় টোকা দিলেন তিনি। ভেতরে ঢুকে দেখলেন, তখনও বিছানায় শুয়ে আছেন ফাদার। শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে, এবং ভীষণ উত্তেজিত মনে হচ্ছে তাঁকে। ভদ্রমহিলা খুব বিনীতভাবে ফাদারকে বললেন, একজন ডাক্তারকে আসতে বলি। কিন্তু তার প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন তিনি। ফাদারের এই আচরণ ভদ্রমহিলার কাছে অভদ্রতা বলে মনে হলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘর ছেড়ে চলে এলেন তিনি। বেলা একটু বাড়লে ফাদার বাসার পরিচারিকাকে দিয়ে ভদ্রমহিলাকে ডেকে আনলেন। তাঁর অশোভন আচরণের জন্যে ভদ্রমহিলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, তিনি বললেন, সত্যি, আমাকে প্লেগ ধরেনি। সে-রকম কোন লক্ষণই আমার শরীরে নেই। ভদ্রমহিলা বললেন, প্লেগের ভয়ে আমি ডাক্তার ডাকতে চাইনি। নিজেকে নিয়ে আমার কোন ভয় নেই। কিন্তু আপনি যতক্ষণ আমার বাসায় আছেন ততক্ষণ আপনার ভালমন্দ দেখা আমার কর্তব্য। ফাদার, এতে কোন সাড়া দিলেন না। ভদ্রমহিলা তখন তার কাছে ডাক্তার ডেকে পাঠানোর অনুমতি চাইলেন। ফাদার প্রথমে তাকে বেশি উদ্বিগ্ন হতে বারণ করলেন, পরে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করলেন। ভদ্রমহিলা এ থেকে যতটুকু বুঝলেন তাতে তার মনে হলো ডাক্তার দেখানো ফাদার ধর্মীয় নীতি বিরোধী কাজ বলে মনে করেন। তিনি অনুমান করলেন জ্বরের কারণে ফাদারের মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। তিনি তাঁকে এক কাপ চা এনে দিলেন।
তারপর প্রতি দুঘণ্টা পর পর ফাদার প্যানালুকে দেখে আসতে লাগলেন মহিলা। সারাটা দিন একটা অস্থিরতার মধ্যে কাটালেন ফাদার। কখনও গায়ের ওপর থেকে কম্বল ছুঁড়ে ফেলে দেন, কিছুক্ষণ পর আবার তুলে নেন; কপালে হাত বুলাতে থাকেন ঘন ঘন। কপাল ঘামে ভিজে গিয়েছে তাঁর। থেকে থেকে বিছানার ওপরে বসে খুব জোরে জোরে কেশে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। মনে হয় ফুসফুসের ভেতর শক্ত কোন জিনিস তাঁর শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করছে। প্রতিবারই ব্যর্থ চেষ্টার পর আবার তিনি এলিয়ে পড়েন বালিশের ওপর। ফাদার বিরক্ত হতে পারেন, এই ভয়ে ডাক্তার ডাকলেন না ভদ্রমহিলা।
বিকেলের দিকে ফাদারের সঙ্গে আর একবার কথা বলার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু কতগুলো অসংলগ্ন শব্দ ছাড়া ফাদারের মুখ। দিয়ে কিছুই বেরুল না। ডাক্তার আনার কথাটাও আর একবার। তুললেন ভদ্রমহিলা। শুনে বিছানার ওপর উঠে বসলেন ফাদার এবং দৃঢ় কণ্ঠে আপত্তি জানালেন। সবকিছু ভেবে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন ভদ্রমহিলা। অবশ্য এখানেই তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করলেন না, ঠিক করলেন রাতেও ফাদারকে কয়েকবার দেখে। যাবেন। রাত এগারোটার দিকে তিনি ফাদারকে এক কাপ সুপ, দিলেন এবং এরপর থেকেই ক্লান্ত বোধ করতে লাগলেন এবং সোফায় গা এলিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।