যখন তৃতীয়বারের মত, এল উত্তাপের ঝাঁপটা, বিছনা থেকে শরীরটাকে উঁচুতে তুলে, হাত-পা গুটিয়ে ফেলল ছেলেটা, বিছানার ধারে গড়িয়ে পড়ল দেহ, মাথাটা বালিশের ওপর কয়েকবার এপাশ ওপাশ করার পর শরীর থেকে ফেলে দিল কম্বল, চোখের উত্তপ্ত মণি। দুটো ফেটে গড়িয়ে পড়ল পানি। ঘাম আর অশ্রুভেজা ছোট্ট মুখটার দুপাশে হাত বুলাতে লাগল তারিউ। ওয়ার্ডের বাকি নজন রোগীও তখন বালিশের ওপর মাথা নাড়ছে আর নিচু স্বরে গোঙাচ্ছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল গ্রাঁদ। ছেলেটার চোখ দুটি তখনও বন্ধ। কিন্তু শরীর আগের চেয়ে অনেক শান্ত। ছোট ছোট আঙুল দিয়ে খাটের কিনার ধরার চেষ্টা করল ও। এরপর হাঁটু চুলকাল। তারপর হঠাৎ করে পা গুটিয়ে ঊরু দুটো রাখল পেটের ওপর। সেই ভাবেই স্থির হয়ে থাকল কিছুক্ষশ, এবং এই প্রথম চোখ খুলল।
সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল রিও। ছেলেটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ছোট্ট মুখটা ভাবলেশহীন, যেন মাটির ধূসর মুখোশ পরে আছে। ধীরে ধীরে ওর ঠোঁট একটু ফাঁক হলো, তারপর থেকে সেই। ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল টানা চিৎকার। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রিও-র। তারিউ বাইরে তাকাল চোখ ফিরিয়ে। র্যাঁবেয়া এগিয়ে এসে দাঁড়াল ক্যাসেল-এর পাশে। ফাদার প্যানালু ছেলেটার কচি মুখখানার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলেন। মুখের চারপাশে ময়লা জমেছে। হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা শুরু করলেন তিনি, ঈশ্বর। এই ছোট শিশুটিকে তুমি রক্ষা করো…
ছেলেটা তেমনি চিৎকার করে চলল। ওয়ার্ডের অন্যান্য রোগীরাও অধৈর্য হয়ে উঠল এবার। তারাও শুরু করল আর্তনাদ। সমস্ত ওয়ার্ডে ঝড় বইতে লাগল আর্তনাদের।
ওই আর্তনাদে ঢাকা পড়ে গেল ফাদার প্যানালু-র প্রার্থনা। তখনও খাটের পাশে দাঁড়িয়ে রিও। অবসাদে, বিরক্তিতে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এক সময় চোখ খুলে দেখে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তারিউ। আর নয়, বাইরে যেতে চাই। এ দৃশ্য সহ্য করা যায় না, বলল রিও।
ঠিক এ-সময়ে ওয়ার্ডে থেমে গেল আর্তনাদ। রিও দেখল, ছেলেটার কাতরানিও ক্ষীণ হতে হতে স্তব্ধ হয়ে গেছে। পাশে এসে দাঁড়াল ক্যাসেল। বলল, সব শেষ। তখনও ছেলেটার মুখ খোলা আছে। ফাদার প্যানালুও পাশে এলেন; তারপর চলে গেলেন।
তারিউ ক্যাসেলকে বলল, আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে আপনাকে, তাই না?
ঠোঁটের ফাঁকে বাঁকা এক টুকরো হাসি ফুটল ক্যাসেল-এর। মাথাটা ঝকাল কিছুক্ষণ। হ্যাঁ। তাই তো দেখছি। তবে টিকা নেয়ার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে রোগের সাথে যুদ্ধ করার শক্তি পেয়েছিল ছেলেটা।
ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল রিও। দরজায় ফাদার প্যানালু-র সামনে পড়ে গেল। ওর চাহনি আর চলার গতি লক্ষ করে হাত বাড়িয়ে ওকে থামাতে গেলেন ফাদার। আসুন, ডাক্তার সাহেব… ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে পাদ্রির দিকে ঘুরে দাঁড়াল রিও। বলুন। কী বলার আছে আপনার? এই বাচ্চা ছেলেটা নিশ্চয় কোন পাপ করেনি। বলতে পারেন কী অপরাধ ছিল ওর?
ফাদারকে ঠেলে সরিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত বেরিয়ে গেল রিও। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল ছেলেদের খেলার মাঠের অপর পাশে। ছোট ছোট ডুমুর গাছের তলায় অনেকগুলো কাঠের বেঞ্চ রয়েছে ওখানে। দরদর করে ঘাম ঝরছে ওর শরীর থেকে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে অবসাদে। বেঞ্চে বসে চোখ-মুখের ঘাম মুছল রিও।
ডুমুর গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে আগুনের ফোয়ারার মত নেমে আসছে রোদ। চারপাশ কেমন গুমোট একটা ভাব। অবসন্ন শরীরটাকে বেঞ্চে এলিয়ে দিল ও। পাতার ফাঁকে দেখল রোদে পোড়া দূরের আকাশ। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এল ওর শ্বাস প্রশ্বাস।
পিছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ও। হঠাৎ এত রাগ করলেন কেন? যে দৃশ্য আপনার কাছে অসহ্য, সেটা আমার কাছেও অসহ্য।
ফাদার প্যানালু-র দিকে চোখ ফেরাল রিও। আমার তখনকার ব্যবহারের জন্যে আমি দুঃখিত। সবকিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার একটা দুর্বার ইচ্ছা মাঝে মাঝে পেয়ে বসে আমাকে।
সেটা আমি বুঝি। কিন্তু যা বুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়, না তাকে আমাদের ভালবাসার চেষ্টা করা উচিত।
ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসল রিও। অবসাদ কাটিয়ে বলল, আপনার কথা মেনে নিতে পারলাম না। যেখানে নিষ্পাপ শিশুদের কষ্টের শিকার হতে হয় সেখানে ভালবাসার প্রশ্ন ওঠে না।
ঈশ্বরের করুণা যে কী জিনিস এই মুহূর্তে আমি তা উপলব্ধি করেছি।
করুণা জিনিসটা যে কী তা জানার সৌভাগ্য আমার আজও হয়নি। তবে এগুলো নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভাল। আমরা এখন। একটা কিছুর জন্যে পাশাপাশি কাজ করছি। এ-কাজ ঈশ্বরের নিন্দা বা প্রার্থনার অনেক ঊর্ধ্বে।
আপনিও মানুষের আত্মার কল্যাণের জন্যে, মুক্তির জন্যে কাজ করছেন।
না। মানুষের দেহকে কীভাবে সুস্থ রাখা যায় আমার মাথাব্যথা সেটা নিয়েই।
আচ্ছা। তাহলে উঠি। পানিতে ছলছল করে উঠল ফাদারের চোখ।
দেখুন, আমার ব্যবহারের জন্যে আমি দুঃখিত। ক্ষমা করে দেবেন। এ-ধরনের ব্যবহার আর কখনও করব না।
তাতে কী। আপনার ভেতর বিশ্বাস তো জন্মাতে পারিনি এখনও।
তাতে কী আসে যায়? ফাদারের হাত ধরে রিও বলল, আসলে আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি মৃত্যু, ব্যাধি এগুলোকে। আমরা এর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছি। এ-কাজে কেউ আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না-স্বয়ং ঈশ্বরও নন।