তা ঠিক। কিন্তু শুধু নিজেকে নিয়েই সুখী হওয়া, কেবল নিজের সুখের কথাটাই চিন্তা করা সেটা নিশ্চয় লজ্জার।
এবার কথা বলল তারিউ। র্যাঁবেয়া যদি সত্যিই অন্যের দুঃখ দুর্দশায় পাশে এসে দাঁড়ায়, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি দেখতে পাবে নিজের সুখভোগের আর কোন অবকাশ নেই ওর।
ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। এতদিন আমি নিজেকে এই শহরে একজন বহিরাগত মনে করতাম। কিন্তু এই কদিনে উপলব্ধি করেছি আমি চাই বা না চাই, আমি এখানকারই একজন।
কেউ কোন কথা বলল না। সেদিন মাঝরাতে র্যাঁবেয়ার হাতে একটা ম্যাপ দিল রিও। পাশে দাঁড়িয়ে আছে তারিউ। শহরে যে অঞ্চলের ভার দেয়া হয়েছে র্যাঁবেয়াকে, ম্যাপটা সেখানকার।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তারিউ প্রশ্ন করল, আপনার সিদ্ধান্তের কথা ওদের জানিয়েছেন?
একটা চিরকুট পাঠিয়েছি। মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল র্যাঁবেয়া।
.
৪.০৩
ডাক্তার ক্যাসেল-এর তৈরি প্লেগের টিকা অক্টোবরের শেষে প্রথম। ব্যবহার করা হলো। এটাই এখন রিও-র শেষ অস্ত্র। ও জানে, এতে কাজ না হলে মহামারীর করুণার ওপর ছেড়ে দিতে হবে গোটা শহরটাকে।
যেদিন ক্যাসেল রিও-র সঙ্গে দেখা করল ঠিক তার আগের দিন মঁসিয়ে অথন-এর ছোট ছেলেটা প্লেগের খপ্পরে পড়ল। রিও ঘরে ঢুকে দেখল বাবা-মা দুজনেই ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলেটার তখন চরম অবস্থা। কোন দিকে তাকানোর বা অনুভব করার মত কোন শক্তি তখন ওর নেই। নিজের ইচ্ছেমত ওর শরীর পরীক্ষা করল রিও। কোন বাধা দিল না ছেলেটা। মাথা তুলে রিও দেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন মঁসিয়ে অথন। তার পিছনে মাদাম অথন, চেহারা রক্তশূন্য, মুখ চেপে ধরেছেন একটা রুমাল দিয়ে।
মনে হচ্ছে প্লেগে ধরেছে, আস্তে কথাগুলো বললেন মঁসিয়ে অথন। এত আস্তে যে শোনাই যায় না প্রায়।
হ্যাঁ। তাই মনে হচ্ছে, বলে ছেলেটার দিকে আবার তাকাল রিও। বিস্ফারিত হলো মাদাম অথন-এর চোখ দুটো। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না।
ডাক্তার আইন অনুযায়ী যা করার তা তো করতেই হবে, আগের চেয়েও ক্ষীণ স্বরে বললেন মঁসিয়ে অথন।
মাদামের দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা করল রিও হ্যাঁ। যা করার এক্ষুণি করছি। আপনার টেলিফোনটা ব্যবহার করতে চাই। যাবার আগে রিও মাদামকে বলল, দুঃখিত। আপনাকেও যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে নিতে হবে।
আতঙ্কে কুঁকড়ে গেলেন মাদাম অথন। মেঝের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাতে আঁকাতে বললেন, হ্যাঁ, বুঝেছি। এক্ষুণি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
বিদায় নেয়ার আগে ভাবাবেগের বশে ওদের কাছে জানতে চাইল রিও, ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন সাহায্যের দরকার আছে। আপনাদের?
না, ঢোক গিললেন ম্যাজিস্ট্রেট অথন। তবে আমার ছেলেটাকে একটু দেখবেন।
মাদাম অথনকে পাঠানো হলো র্যাঁবেয়া যে কোয়ারাইনটা দেখাশোনা করে সেটায়। মিউনিসিপ্যাল স্পোর্টস গ্রাউন্ডের ক্যাম্পে পাঠানো হলো মঁসিয়ে অথনকে। ছেলেটাকে রাখা হলো অস্থায়ী হাসপাতালের ওয়ার্ডে। বিশ ঘণ্টা পর রিও পরিষ্কার বুঝতে পারল ওকে আর বাঁচানো যাবে না। সংক্রমণ খুব দ্রুত ওর শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, অথচ ছেলেটার কোন প্রতিরোধ শক্তি নেই। সম্পূর্ণ ফুটে বেরুতে পারেনি, অথচ কঠিন যন্ত্রণাদায়ক, ছোট ছোট গুটিগুলো ওর অপুষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন বন্ধ করে ফেলছে।
রাতে খাওয়ার পর, ও আর ক্যাসেল ছেলেটার শরীরে টিকা দেয়া আরম্ভ করল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। সকালে আবার ওরা এল ছেলেটার পাশে।
আশ্চর্য। ওর হাত-পা নড়ছে। বিছানার ওপর এপাশ-ওপাশ করছে ছেলেটা। এসময় ওখানে ছিল ওরা তিনজন-রিও, ক্যাসেল, আর তারিউ। রাতের অন্ধকার কাটিয়ে দিনের আলোে ফুটতে লাগল। একে একে অন্যারাও এল ওখানে। প্রথমে এলেন ফাদার প্যানালু। গ্রাঁদ এল বেলা সাতটায়।
ছেলেটার চোখ তখন সম্পূর্ণ বন্ধ। দাঁতে দাঁত লেগে আছে। যন্ত্রণায় মুখ এমন ভাবে খিচাচ্ছে যে মনে হচ্ছে ভেংচি কাটছে। বালিশের ওপর মাথাটাকে বারে বারে এপাশে ওপাশে নাড়াচ্ছে ছেলেটা।
র্যাঁবেয়া যখন ঘরে ঢুকল তখন অন্ধকার কেটে গেছে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার পকেটে ওটা ঢুকিয়ে রাখল ও।
বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে যন্ত্রণাকাতর ছেলেটাকে দেখছিল রিও। হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠল রোগীর কচি শরীর। বেঁকে গেল কোমর। হাত-পা ছড়িয়ে পড়ল ইংরেজি এক্স-এর মত। সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় কম্বলের নিচে শুয়ে আছে ছেলেটা। শরীর থেকে ভেসে আসছে ঘাম আর উলের গন্ধ। দাঁতে দাঁত বসে গেল ওর। এরপর আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এল শরীর। হাত-পা গুটিয়ে নিল। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। চোখ বন্ধ। হঠাৎ জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল, ও।
তারিউ-এর দিকে তাকাল, রিও। চোখ নামিয়ে নিল তারিউ। গত মাসে অসংখ্য শিশুকে মরতে দেখেছে ওরা; মৃত্যু কাউকেই এতটুকু দয়া দেখায়নি, কিন্তু এভাবে পলে পলে কোন ছেলের মৃতু যন্ত্রণা লক্ষ করেনি।
ঠিক সেই সময় কুঁকড়ে উঠল ছেলেটার শরীর। মনে হলো, পেটে কিছু কামড়াচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল ও। অনেকক্ষণ ধরে কুঁকড়ে পড়ে রইল। এরপর খিচুনিতে থরথর করে কাঁপতে লাগল সমস্ত শরীর।
তারপর আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে গেল জ্বরের দমকা বেগ। ধীরে ধীরে উত্তাপও নেমে গেল শরীর থেকে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার সুযোগ পেল ও। অতি কষ্টে শ্বাস নিতে লাগল।