বুধবারে, বাসায় ফিরে মার্সেল বলল, কাল রাতে আপনাকে তৈরি থাকতে হবে। বেরুতে হবে মাঝরাতে। একটু এদিক-ওদিক করলে চলবে না। আমাদের সঙ্গে যে দুজন পাহারা দেয়, তাদের একজনকে প্লেগ ধরেছে। অন্যজনকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ফটক পাহারার সম্পূর্ণ ভার এখন আমাদের ওপর। কী কী করতে হবে সেগুলো কাল রাতেই জানাব।
নিশ্চয় খুশি হয়েছ, ব্লারেয়াকে বললেন বৃদ্ধা।
পরের দিন সকাল থেকেই অসহ্য গরম পড়তে শুরু করল। আবহাওয়া কেমন ভ্যাপসা। একটা ঘোমটার আড়ালে সারাক্ষণ মুখ ঢেকে রইল সূর্য। মৃত্যুর হারও সেদিন বেড়ে গেল অসম্ভব রকম।
মার্সেল আর লুই-এর দেখাদেখি র্যাঁবেয়াও তার জামাকাপড় খুলে ফেলল। তবু ওর বুক আর কাঁধের দুপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল ঘাম। পালিশ করা মেহগনি কাঠের মত চকচকে হয়ে উঠল ওদের সবার শরীর। খাঁচায় বন্দী হিংস্র প্রাণীর মত সারা ঘরে পায়চারি করে বেড়াল র্যাঁবেয়া।
বিকেল চারটায় ও বলল, আমি একটু বাইরে যাব।
মনে রাখবেন, বলল মার্সেল, ঠিক রাত বারোটার সময় আপনাকে হাজির থাকতে হবে।
র্যাঁবেয়া সোজা গেল রিও-র ফ্ল্যাটে। ওর মা বলল, শহরতলির হাসপাতালে ওকে পাওয়া যাবে।
হাসপাতালের ফটকের সামনে বেশ কিছু মানুষ, ঘোরাফেরা করছিল। কিন্তু কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না ভেতরে। তবু সবাই দাঁড়িয়ে আছে রোদ এবং গরমের মধ্যে। পুলিস সার্জেন্টকে র্যাঁবেয়া ওর প্রবেশপত্র দেখাল। সে ওকে তারিউ-এর অফিসে যেতে বলল।
এখনও যাননি? ওকে দেখে বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল অরিউ।
না। রিও-র সঙ্গে একটু কথা বলব।
ও এখন ওয়ার্ডে। কিন্তু দেখা না করলেই কী নয়; অন্য কাউকে দিয়ে আপনার কাজ হবে না?
কেন বলুন তো?
ও ভীষণ ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম দিতে চাই।
তরিউ-এর দিকে তাকিয়ে রইল র্যাঁবেয়া। আগের চেয়ে অনেক রোগা হয়ে গেছে। চোখে, শরীরে সবখানে ক্লান্তির ছাপ। ঝুলে পড়েছে চওড়া কাঁধ। দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকল ওয়ার্ডবয়। টেবিলের ওপর কয়েকটা ছোট কার্ড রেখে বলল, ছটি। বলেই বেরিয়ে গেল।
কার্ডগুলো টেবিলে বিছিয়ে তারিউ বলল, সুন্দর কার্ড, তাই না? অথচ এগুলোই হচ্ছে মৃত্যু।, গতরাতে কজন মারা গেছে তার হিসেব আছে এখানে।
কার্ড এবং টেবিলের ওপর ছাড়ানো অন্যান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে উঠে দাঁড়াল তারিউ। খুব তাড়াতাড়িই আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, না?
হ্যাঁ। আজ রাত বারোটায়।
খুব ভাল লাগছে। শুধু নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।
সত্যি বলছেন?
আমার যা বয়েস তাতে মিথ্যা বলার অনেক ঝামেলা।
তারিউ, মাফ চাইছি। কিন্তু রিও-র সঙ্গে একবার দেখা হওয়া দরকার।
জানি, রি-ওর মানবতাবোধ আমার চেয়ে অনেক বেশি। আচ্ছা, চলুন।
আমি কিন্তু সেরকম…, কথা শেষ করতে পারল না র্যাঁবেয়া।
তারিউ ওর দিকে তাকাল। আস্তে আস্তে ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাসিতে।
একটা সরু বারান্দা ধরে এগিয়ে চলল ওরা। দুপাশে হালকা সবুজ রঙের দেয়াল। একবারে শেষে, কাঁচের দরজা। ওপারে, ঘরের ভেতর নড়াচড়া করছে লোকজন। ওখানে যাবার আগে পাশের একটা ছোট কামরায় র্যাঁবেয়াকে নিয়ে ঢুকল তারিউ। আলমারি খুলে জীবাণুনাশক ঔষধ ভর্তি একটা পাত্র থেকে কাপড়ে জড়ানো দুটো তুলোর মুখোশ বের করল ও। একটা পরতে দিল র্যাঁবেয়াকে।
এরপর কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা। বিরাট ঘর। সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ। মাথার ওপর ঘুরছে পাখা। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বদ্ধ বাতাস। দুপাশে বিছানার সারি। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে যন্ত্রণাকাতর চিৎকার। কোনটা তীক্ষ্ণ, কোনটা চাপা; মনে হচ্ছে একঘেয়ে সুরে স্তোত্র পাঠ চলছে। নীরবে এক বিছানা থেকে আর এক বিছানায় রোগী দেখে বেড়াচ্ছে সাদা অ্যাপ্রন পরা। লোকজন।
সামনে একটা বিছানায় ঝুঁকে আছে রিও। যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে একটি মানুষ। ওর দুই পা টেনে ফাঁক করে ধরে রেখেছে দুজন নার্স। রোগীর কুচকি ছুরি দিয়ে চিরে দিচ্ছে রিও। মাথা তুলল ও। একজন সাহায্যকারী একটা ট্রে এগিয়ে ধরতেই হাতের যন্ত্রপাতিগুলো রাখল ওটায়। ব্যান্ডেজ করে দেয়া হলো রোগীকে।
কোন খবর? তারিউকে জিজ্ঞেস করল রিও।
ফাদার প্যানালু কোয়ারেনটাইন স্টেশনে র্যাঁবেয়ার জায়গায় কাজ করতে রাজি হয়েছেন। ডাক্তার ক্যাসেল বেশকিছু টিকা তৈরি করেছেন, টিকাগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
সুসংবাদ।
আর র্যাঁবেয়া এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে। ..
ঘুরে দাঁড়াল রিও। আপনি এখানে কেন? আপনার তো অন্য কোথাও থাকার কথা।
আজ মাঝ রাতেই ও চলে যাচ্ছে, বলল তারিউ।
আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে, বলল র্যাঁবেয়া।
আচ্ছা। এক্ষুণি আসছি। আপনি তারিউ-এর অফিসে অপেক্ষা করুন।
কয়েক মিনিট পর। গাড়ির পিছনের সীটে বসে আছে রিও, এবং র্যাঁবেয়া। স্টিয়ারিংয়ে তারিউ।
ডাক্তার, আমার হয়তো আর যাওয়া হলো না। আপনাদের সঙ্গেই থেকে গেলাম, বলল র্যাঁবেয়া।
কোন নড়াচড়া করল না তারিউ। অখণ্ড মনোযোগে গাড়ি চালাতে লাগল।
কিন্তু আপনার প্রেমিকা, তার কী হবে? অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন করল। রিও।
এই মুহূর্তে পালিয়ে গেলে ব্যাপারটা আমার জন্যে খুব লজ্জার হবে। আমাদের সম্পর্কও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এ-রকম চিন্তা করা ঠিক নয়। কেউ যদি নিজের সুখকেই জীবনের প্রধান জিনিস বলে মনে করে তাতে লজ্জা পাবার কিছু নেই।