.
৪.০২
রিও-র কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এতদিন টানা কাজ করে গেছে র্যাঁবেয়া। সেপ্টেম্বরের শুরুতে একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্যে, ছুটি নিল ও। সেদিন দুপুরে গনজালেস এবং সেই দুই যুবকের সঙ্গে হাইস্কুলের মাঠে দেখা করার কথা ওর। ঠিক সময়ে এসে হাজির হলো গনজালেস। ওরা গল্প করতে করতে দেখল যুবক দুজনও হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।
ওরা বলল, গেল সপ্তাহে কোন সুবিধে করতে পারিনি। এ সপ্তাহে আমাদের ডিউটি নেই। আপনাকে আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
র্যাঁবেয়া স্বীকার করল, আসলেই এ-ধরনের কাজে ধৈর্যের দরকার।
গনজালেস প্রস্তাব দিল, সামনের সোমবারে আমাদের সবার দেখা হওয়া উচিত। এরপর র্যাঁবেয়াকে বলল, আপনার এখন লুই-মার্সেল-এর বাসায় গিয়ে থাকাটাই ভাল। ঠিক আছে, আমরা দুজনে না হয় একটা দিন ঠিক করে নেব। কোন কারণে আমি যদি আসতে না পারি, আপনি সোজা ওদের বাসায় চলে যাবেন। ঠিকানাটা আমি দিয়ে দেব আপনাকে।
যুবকদের একজন গনজালেসকে বলল, আপনি এক্ষুণি আপনার বন্ধুকে নিয়ে আমাদের বাসায় এলে সবচেয়ে ভাল হয়। তাহলে খুব সহজেই আমাদের বাসাটা খুঁজে বের করতে পারবেন। আপনাদের আপত্তি না থাকলে, দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা আমাদের ওখানেই হবে।
গনজালেস রাজি হলো ওদের প্রস্তাবে। চারজনই হাঁটতে লাগল বন্দরের দিকে।
ডকইয়ার্ডের একেবারে শেষে মার্সেল আর লই-এর বাসা। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে যে রাস্তাটা তার সামনেই একটা ফটক। আর এর সামান্য দূরে বাসাটা। ছোট। স্পেনে যেমন ছোট ছোট বাড়ি দেখা যায় তেমনি। জানালার শার্সিগুলোয় উজ্জ্বল রঙের পলিশ। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার, আসবাবপত্র নেই। লুই আর মার্সেল-এর মা, হাসিখুশি চেহারার এক বৃদ্ধা স্প্যানিশ মহিলা, খাবার এনে রাখল ওদের সামনে। তাঁর মুখের চারপাশে বয়সের ভঁজ। খাবারের বেশির ভাগই ভাত। ভাত দেখে বিস্মিত হলো গনজালেস, কেননা কিছুদিন থেকে শহরে চাল পাওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
র্যাঁবেয়া খন ভাবছে সামনের সপ্তাহটার কথা। পরে, ওরা বলল ওকে দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।
সেই দুই সপ্তাহ চোখকান বন্ধ করে উদয়াস্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেল র্যাঁবেয়া। বিছানায় গেল অনেক রাতে। কোন কোন রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ল। এক রাতে, বার থেকে বেরিয়ে র্যাঁবেয়ার মনে হলো ওর পুরষাঙ্গটা কেমন যেন ফোলা ফোলা লাগছে। হাত নাড়ার সময় বগলে অনুভব করল ব্যথা। এবার তাহলে আমার পালা, ভাবল ও। মন বলল, এক্ষুণি পালাতে হবে। ছুটে শহরের বাইরে যাব। সেখানে দাঁড়াব একটা পার্কে। সেখান থেকে সমুদ্র চোখে না পড়ক, আকাশটাকে তো অনেক বড় করে দেখা যাবে। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করব প্রেমিকার নাম ধরে। যেন আমার গলার স্বর শহরের দেয়াল পেরিয়ে বাইরে গিয়ে পৌঁছায়, র্যাঁবেয়ার তখন এরকমই ইচ্ছে হলো। কিন্তু বাসায় ফিরে দেখল প্লেগের কোন লক্ষণই নেই ওর শরীরে। সত্যিই মাতাল হয়ে গেছিলাম, রিও-র কাছে পরে স্বীকার করল ও।
এক রাতে রিও-র কাছে বিদায় নিতে গেল র্যাঁবেয়া। রিও বলল, আজ সকালে মঁসিয়ে, অথন আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। বললেন, আমি আপনাকে চিনি কিনা? আমি বললাম, চিনি। তিনি তখন বললেন, আমি যদি সত্যিই আপনার বন্ধু হয়ে থাকি তাহলে যেন আপনাকে সাবধান করে দিই, চোরাচালানকারীদের সাথে অত মেলামেশা না করতে।
কি বলতে চান উনি?
আমার মনে হয়, পালাবার কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে আপনাকে।
অনেক ধন্যবাদ, রিও-র হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল র্যাঁবেয়া।, দরজায় পৌঁছে ঘুরে দাঁড়াল ও। রিও দেখল, প্লেগ দেখা দেয়ার পর থেকে আজ এই প্রথম প্রাণ খুলে হাসছে র্যাঁবেয়া।
কিন্তু আপনি আমার যাওয়াটা বন্ধ করছেন না কেন, বলুন তো? সেটা তো সহজেই করতে পারেন।
স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল রিও। তারপর হেসে বলল, আমি নিজেও হয়তো ব্যক্তিগত সুখের কথাটাই চিন্তা করতে শুরু করেছি।
রবিবারে র্যাঁবেয়া উঠল মার্সেল এবং লুইদের ছোট্ট বাসায় গিয়ে। ওকে থাকতে দেয়া হলো বসার ঘরে। দুই পাহারাদার সাবধান করে দিল, ও যেন বাইরে বেশি ঘোরাফেরা না করে। দুপুর বেলা ওরা কেউ খেতে এল না। বেশির ভাগ সময় ওকে কাটাতে হলো একাকী। মাঝেমাঝে দেখা হলো ওদের মা-র সঙ্গে। ভদ্রমহিলা কথা একটু কম বলেন। একবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ফিরে যাবার পর তোমার প্রেমিকার শরীরে প্লেগের জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে, এটা ভেবে তোমার ভয় হয় না?
ওরকম বিপদের সম্ভাবনা খুব কম। আর, অন্যদিকে আমি যদি এখানে থেকে যাই, ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে আর দেখা হওয়ার কোন আশাই থাকবে না।
বৃদ্ধা একটু হাসলেন। তোমার প্রেমিকা তোমাকে ভালবাসে?
খুব।
সুন্দরী?
আমার চোখে।
বুঝলাম, মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধা। সেইজন্যেই তুমি ফিরে যেতে চাইছ।
প্রতিদিন সকালে গির্জায় যাওয়া বৃদ্ধার অভ্যাস। একদিন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?
না।
বুঝলাম, মন্তব্য করলেন তিনি, তোমার ফিরে যাওয়াই উচিত। জীবনে তোমার পাবার মত কিছু তো আর নেই।
সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরল মার্সেল আর লুই। র্যাঁবেয়াকে উৎসাহিত করবার মত কিছু বলতে পারল না ওরা। কেবল এটুকু বলল, পালাবার উপযুক্ত সময় এখনও আসেনি। রাতে, খাবার পর, কিছুক্ষণ গিটার বাজাল মার্সেল। এরপর ওরা তিনজনে মদ খেতে লাগল একসঙ্গে। পুরো সময়টাই আপন চিন্তায় ডুবে রইল র্যাঁবেয়া।