রিও একদিন অবাক হয়ে লক্ষ করল, সে নিজেও গ্রাঁদ-এর কাছে ওর স্ত্রী সম্পর্কে গল্প করছে। স্ত্রীর কাছ থেকে যেসব টেলিগ্রাম আসে, সেগুলোকে আদৌও বিশ্বাস করতে পারে না ও। তাই ঠিক করল টেলিগ্রাম পাঠিয়ে স্বাস্থ্যনিবাসে ডাক্তারের কাছ থেকে সত্যিকারের খবরটা নেবে। উত্তরে ওকে জানানো হলো, ওর স্ত্রীর শরীর ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা খারাপের দিকে গেছে, তবে তারা সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে। রিও গ্রাঁদকে বলল ও কাছে থাকলে স্ত্রীকে হয়তো অনেক সাহায্য করতে পারত। কথাগুলো বলেই হঠাৎ গুম মেরে গেল রিও। এরপর গ্রাঁদ অনেক প্রশ্ন করল ওকে, কিন্তু রিও সেগুলোকে এড়িয়ে গেল।
অন্যদের তুলনায় একমাত্র জ তারিউই যা কিছুটা ধাতস্থ ছিল তখনও। ওর এ-সময়কার ডাইরি পড়লে বোঝা যায় এখনও অনেক ব্যাপারে কৌতূহল আছে ওর, কিন্তু আগের মত সব ব্যাপারেই উৎসাহ আর নেই।
সবচেয়ে ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত মনে হয় ডাক্তার ক্যাসেলকে। একদিন রিও-র কাছে এসে ডাক্তার জানাল, সিরাম তৈরি করে ফেলেছে সে। ঠিক হলো, মঁসিয়ে অথন-এর ছোট ছেলেটার ওপর এই সিরাম প্রথম পরীক্ষা করা হবে। কেননা, ছেলেটার তখন জীবনের কোন আশাই আর নেই।
একদিন মৃত্যুর দৈনিক, পরিসংখ্যান নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ রিও তাকিয়ে দেখে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েছে ক্যাসেল। ওর এই অবস্থা দেখে ভীষণ দুঃখ পেল রিও। ক্যাসেল-এর চেহারায় আগে সবসময় ফুটে থাকত একটা তারুণ্যের আভাস। আর এখন ওর ঘুমন্ত মুখে দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা।
সারা শহরে তখন একটাই মানুষ আছে, যার ভেতর ক্লান্তি কিংবা হতাশা নেই। সে মানুষটি-কটার্ড। রিও এবং র্যাঁবেয়াকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে ও। কিন্তু কিছুটা জোর করেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তারিউ-এর সঙ্গে। সুযোগ পেলেই ওর সঙ্গে দেখা করে কটার্ড। তারিউ ওর ব্যাপারটা পুরোপুরি জানে, আর ও বেড়াতে এলে খাতির যত্ন করে। কটার্ডও ওর কাছে গেলে বেশ স্বস্তিবোধ করে। কটার্ড এবং প্লেগের সঙ্গে ওর সম্পর্ক, এই শিরোনামে তারিউ ওর ডাইরিতে কিছু মন্তব্য লিখে রেখেছে।
দেখে মনে হয় স্বাস্থ্য এবং লাবণ্যে ফেটে পড়ছে লোকটা। আচরণের ভেতর বেড়েছে অমায়িক ভাব। সেই সঙ্গে বেড়েছে হাসিঠাট্টা। চারপাশের ঘটনায় এতটুকু বিচলিত হয় না মানুষটা।
মাঝে মাঝে আমাকে বলে, অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকে, যাচ্ছে, তাই না? তবে ব্যাপার কী জানেন, আমরা এখন সবাই এক নৌকার যাত্রী।
একটা অদ্ভুত ধারণা মাথায় ঢুকেছে ওর। আমাকে বলে, যে লোক আগে থেকেই কোন কঠিন অসুখে ভুগছে কিংবা খুব মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে, তাকে খুব সহজে কোন রোগ কিংবা নতুন দুশ্চিন্তা আক্রমণ করে না।
আপনি কখনও একই সঙ্গে কোন লোককে দুটো কঠিন। অসুখে ভুগতে দেখেছেন? এমন কখনও হয় না। আপনার ক্যান্সার কিংবা রক্তবমি হলে প্লেগ বা টাইফয়েড আপনাকে ছোঁবে না। কোন ক্যান্সার রোগীকে মোটর চাপা পড়ে মরতে দেখেছেন?
অন্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে কাউকে একা একা থাকতে বাধ্য করাটাকে কটার্ড ঘৃণা করে। অবরুদ্ধ শহরে অনেক মানুষের সঙ্গে বাস করতে ও প্রস্তুত, কিন্তু জেলের ভেতর নিঃসঙ্গ দিন কাটাতে মোটেও রাজি নয়।
প্লেগ যেদিন থেকে শুরু হলো সেদিন থেকে ওর পিছনে ঘোরা বন্ধ করেছে পুলিস। সত্যি কথা বলতে কি, শহরে এখন পুলিস বলতে আলাদা কোন কিছু নেই। অতীত বা বর্তমান অপরাধ বলেও কিছু নেই। এখানে শুধু একদল অভিশপ্ত মানুষ ভবিষ্যতে কবে মুক্তি পাবে, এ-রকম একটা অনিশ্চিত আশায় বর্তমানের অভিশাপ বুয়ে বেড়াচ্ছে, পুলিসও আছে ওই দলে।
একদিন ও আমাকে বলল, মঁসিয়ে তারিউ, আপনি যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। যদি সত্যি সত্যি চান মানুষ একসঙ্গে বাস করুক, তাহলে তার একটাই মাত্র উপায় আছে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন মাঝে মাঝে প্লেগের আবির্ভাব হয়।
এক সন্ধ্যায় কটার্ড এবং তারিউ গেল অপেরা-হাউসে। তখন দেখানো হচ্ছে গ্লাক-এর অরফিয়স। কটার্ডই তারিউকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। সবচেয়ে দামী সীট দুটোতে বসেছে ওরা। একসারি থেকে অন্য সারির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সান্ধ্য পোশাক পরা দর্শকের দল। পরিচিত কেউ বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হতেই ওরা অত্যন্ত শোভনভাবে পরস্পরকে সালাম জানাচ্ছে। চারপাশ থেকে আলো এসে ছিটকে পড়ছে ওদের ওপর। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সবার মনে ফিরে এসেছে আত্মবিশ্বাস। অথচ একটু আগেও, ওরা যখন শহরের রাস্তায় হাঁটছিল তখন সবাইকে মনে হচ্ছিল হতাশাগ্রস্ত।
নাটক শেষ হতে উঠে দাঁড়াল দর্শকরা। হল ছেড়ে বাইরে যাবার জন্যে এগিয়ে চলল সবাই। প্রথমে ধীরে ধীরে নীরবে এগুলো, যেন প্রার্থনা শেষে গির্জা ছেড়ে বাইরে যাচ্ছে, কিংবা মৃতব্যক্তিকে শেষ বিদায় জানিয়ে চলে যাচ্ছে তার ঘর থেকে। তারপর দ্রুত হলো চলা। ফিসফিসানি রূপান্তরিত হলো হৈ-চৈ-এ। এরপর শুরু হলো হুড়োহুড়ি। ধাক্কাধাক্কি করে ওরা যখন বাইরে এসে রাস্তায় নামল, তখন সবারই দিশেহারা অবস্থা আশঙ্কায়, উত্তেজনায় তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল প্রত্যেকেই।
উঠল কটার্ড এবং তারিউও। কিন্তু মঞ্চের দিকে চোখ পড়তেই হতবাক হয়ে গেল ওরা, দেখল জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় দৃশ্য। দেখল, মূকাভিনেতার বেশে প্লেগ দাঁড়িয়ে আছে মঞ্চে; আর লাল কাপড়ে ঢাকা দর্শকদের চেয়ারের ওপর পড়ে আছে সৌখিন খেলনা, হাতপাখা, আর ঝালর লাগানো দামী দামী শাল।