কর্তৃপক্ষ এবার সিদ্ধান্ত নিলেন পুরানো যত কবর আছে, খালি। করতে হবে। গলিত দেহাবশেষগুলোকে কবর থেকে তুলে পাঠানো হলো শ্মশানে। আর সেই থেকে, প্লেগে মরা লাশগুলোকে সরাসরি শ্মশানে পাঠানো হতে লাগল। সেখানে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয় ওদের। ওরাওঁ-এ একটাই শ্মশান আছে, শহরের পুব ফটকের বাইরে। শ্মশান ব্যবহারের সুবিধার্থে, পুব ফটকের গার্ডপোস্টটাকে আগের জায়গা থেকে খানিকটা তফাতে সরিয়ে নেয়া হলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল শ্মশানে পৌঁছানোর যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে।
এ-সময় এক মিউনিসিপ্যাল কর্মচারির মাথা থেকে অভিনব এক বুদ্ধি বের হলো, এবং এর ফলে কর্তৃপক্ষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সাগর-উপকূলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী ট্রাম লাইনটা এতদিন অকেজো অবস্থায় পড়েছিল; ওই কর্মচারি সেটাকে ব্যবহার করার পরামর্শ দিল। নয়া উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্যে প্রয়োজনীয় রদবদল করা হলো ট্রামগুলোকে। ছোট ছোট ট্রলির ভেতরটাও বদলে ফেলা হলো যথাসম্ভব। শ্মশানে যাওয়ার জন্যে নতুন একটা লাইনও খোলা হলো। এখন থেকে ট্রাম আর ট্রলির গন্তব্য হলো ওই শ্মশান।
সেবার গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং সারাটা শরঙ্কাল ধরে প্রতিদিন একই দৃশ্য চোখে পড়ল সকলের। সাগর-উপকূল থেকে খাড়া ওপরে উঠে গেছে যে-পাহাড়ের চূড়া আর তার চারপাশের ঘোরানো রাস্তা, সেই রাস্তা ধরে অবিরাম ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত সব ট্রাম, যাত্রীশূন্য অবস্থায়। কিন্তু অল্পকিছুদিনের মধ্যেই এই অঞ্চলের অধিবাসীরা ব্যাপারটা টের পেয়ে গেল। তখন থেকে কিছু কিছু লোক ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে লুকিয়ে থাকতে শুরু করল পাহাড়ের আশেপাশে। চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা থাকা সত্ত্বেও এটা বন্ধ করা সম্ভব হলো না। ট্রামগুলো যখন পাহাড়ের গা ঘেঁষে এগোয়, তখন ওরা আড়াল থেকে ট্রামের ওপর ছুঁড়ে দেয় গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। এ-ভাবে মৃতদেহ আর ফুলে ভর্তি ট্রামগুলো গ্রীষ্মের উত্তপ্ত অন্ধকারে একটানা ঝপঝপ শব্দ করতে করতে একটার পর একটা চলে যায় শ্মশানে।
এই বীভৎস দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রকৃতিও উন্মত্ত হয়ে উঠল। শহরের পুব আকাশে এবার দেখা দিল ধোঁয়াটে বিশ্রী গন্ধভরা তেলতেলে একটা আনত মেঘ। ডাক্তাররা বলল গন্ধটা বিশ্রী হলেও এই মেঘ স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষরা ধরে নিল ওই মেঘ সারাক্ষণ ওদের ভেতর রোগের জীবাণু ছড়াচ্ছে। ওরা কর্তৃপক্ষকে ভয় দেখাল, কেউই এ-অঞ্চলে থাকবে না। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ মেঘটাকে সরানোর নানারকম যন্ত্রপাতি বসাবার আয়োজন করলেন। এরপর দেখা গেল যখন জোরে বাতাস বয়, পুবদিক থেকে একটা আঠাল গন্ধ ভেসে আসে; আর শহরবাসীদের তখন মনে পড়ে যায় ওরা এখন নতুন এক পরিবেশে বাস করছে, যার নাম প্লেগ।
কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছিলেন পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে লাশগুলোকে সরাসরি সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হবে। এটা ভাবতেই রিও-র চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য: পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে বীভৎস চেহারার সব শব। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যাই ভাবুন, মৃত্যুর হার আর একটু বাড়লে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। হয়তো গাদা গাদা মানুষ মরে রাস্তায় পচতে শুরু করবে। অথবা হয়তো শহরের এমন দৃশ্যও চোখে পড়বে: মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ ঘৃণা কিংবা আশায় জীবিত মানুষদের জড়িয়ে ধরার জন্যে অধীর আগ্রহে ছুটছে।
৪র্থ পর্ব : শহরটা মহামারীর হাতে
চতুর্থ পর্ব
৪.০১
সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর মাসে ওরাওঁকে দেখে মনে হলো শহরটা মহামারীর হাতে এক অসহায় শিকার; উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে প্লেগের পায়ের সামনে। প্লেগের দয়া আর করুণাই এখন তার একমাত্র ভারসা। মানুষের কাছে সপ্তাহগুলো মনে হলো অনন্তকালের মত। দক্ষিণ দিক থেকে উড়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি; শূন্যে অনেক উঁচুতে উড়তে লাগল নিঃশব্দে, যেন, শহরবাসীদের ছাতের উপর ঘূর্ণায়মান প্লেগের সেই যে বিশাল শস্য মাড়াইয়ের দণ্ডের কথা বলেছিলেন ফাদার প্যানালু, সেই দণ্ডটি এই শহর সম্পর্কে সাবধান করে দিচ্ছে ওদের। অক্টোবরের শুরুতে এক প্রবল বর্ষণের ফলে রাস্তা ঘাট ধুয়ে মুছে ঝকঝক করতে লাগল আবার।
রিও এবং ওর বন্ধুরা এতদিনে এই প্রথম অনুভব করল ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে ওরা। রিও লক্ষ করল সব ব্যাপারে কেমন যেন উদাসীন হয়ে উঠেছে সবাই।
প্লেগের সংক্রমণ যাতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সুস্থ লোকদের আলাদা করে রাখার জন্যে কিছু কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। এ-রকম একটা কেন্দ্র দেখাশোনার ভার দেয়া হয়েছিল র্যাঁবেয়া-র ওপর। ও যে হোটেলে থাকে সেটাও এই উদ্দেশ্যে দখল করে নেয়া হয়েছিল।
দিনরাত কাজ করার পর এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ে সবাই, বাসায় ফিরে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাবার বা রেডিও শোনার ধৈর্যটুকুও কারও থাকে না। প্লেগ থেকে কেউ কেউ সেরে উঠছে, এ-ধরনের খবর শুনলে ওরা মানুষের সামনে কিছুটা আগ্রহ দেখানোর ভান করে বটে, কিন্তু মনে মনে এক আবেগহীন উদাসীনতার সঙ্গে গ্রহণ করে এইসব সংবাদ।
প্লেগের নানা রকম পরিসংখ্যান রাখার কাজ এখনও করে যাচ্ছে গ্রাঁদ। কিন্তু যে কেউ ওকে দেখলে বুঝতে পারে শরীর আর স্বাস্থ্য আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে ওর। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ভাবপ্রবণ হয়ে উঠেছে ও। রিও-র কাছে জেনিকে নিয়ে নানারকম গল্প করে। জানি না কোথায় আছে ও? খবরের কাগজের পাতা ওল্টাবার সময় আমার কথা কি মনে পড়ে?