অর্থাৎ, গোটা ব্যাপারটাই সম্পন্ন হয়ে যায় অত্যন্ত দ্রুতোর সঙ্গে অথচ প্রায় ঝুঁকিহীনভাবে। স্বাভাবিকভাবেই, এরকম বিদ্যুৎগতিতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সেরে ফেলার ব্যবস্থা চালু হওয়ায় শুরুতে মৃত ব্যক্তির পরিবারের অনেকেই ক্ষুব্ধ হলো মনে মনে। কিন্তু এটাও ঠিক প্লেগের মত ভয়াবহ একটা সঙ্কট মোকাবিলায় তুচ্ছ ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দিলে চলে না, এবং সেজন্যেই জলাঞ্জলি দেয়া হলো আর সব মানবিক অনুভূতিকে। এর ফলে শহরবাসীদের কারও কারও মনোবলও ভেঙে পড়ল। তবে সৌভাগ্যক্রমে, ঠিক সে-সময়ে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় সবার নজর পড়ল গিয়ে আশু সমস্যার দিকে। বিভিন্ন রকমের ফরম পূরণ করা, কোথায় কোন জিনিস পাওয়া যাবে তা খুঁজে দেখা, প্রতিদিন দোকানের সামনে লাইন দেয়া-এইসব কাজে এত সময় নষ্ট হতে লাগল যে, এরপরে আশেপাশে, কে কোথায় কিভাবে মরছে বা নিজেদেরও একদিন কিভাবে মরতে হবে–এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার মত অবসরই আর পেল না কেউ।
যতই দিন যেতে লাগল, দুস্প্রাপ্য হয়ে উঠতে লাগল কফিন, কাফনের কাপড় আর গোরস্থানে কবর দেয়ার জায়গা। এবার, অগত্যা, ঠিক করা হলো, একগর্তে যত বেশি সম্ভব লাশকে দাফন করা হবে।
রিও-র হাসপাতালে কফিনের মজুত নেমে এল পাঁচে। সেগুলো যখন ভর্তি হয়ে গেল, একসঙ্গে তুলে দেয়া হলো অ্যাম্বুলেন্সে। কবরস্থানে পৌঁছার পর লাশগুলো বের করা হলো বাক্স থেকে, তারপর স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো কাছেরই একটা চালাঘরে। আরও কিছু লাশ আসার পর একসঙ্গে কবর দেয়া হবে, সে-পর্যন্ত এখানেই থাকবে এগুলো। এরপর শূন্য কফিনগুলোয় জীবাণুনাশক ওষুধ ছিটিয়ে আবার সেগুলো ফেরত পাঠানো হলো হাসপাতালে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নিয়মকানুনেও রদবদল করা হলো কিছু। কবরস্থানের পিছনের একটা খোলা জায়গায় দুটো প্রকাণ্ড গর্ত খোঁড়া হয়েছিল। এর চারপাশে আছে গাছের সারি। একটা গর্ত রাখা হলো পুরুষদের জন্যে, অন্যটা মেয়েদের। কিছু জায়গায় সমস্যা দেখা দেয়ায় এখন থেকে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে নিক্ষেপ করা। হতে লাগল ওই গর্ত দুটোয়। এবং মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-পরিজন যাতে মনোকষ্ট না পায় সেজন্যে আইন জারি করা হলো, কবর দেয়ার সময় কর্তৃপক্ষীয় লোকজন ছাড়া অন্য কেউ ওখানে উপস্থিত থাকতে পারবে না। আত্মীয়স্বজন শুধুমাত্র কবরখানার ফটক পর্যন্ত যেতে পারবে।
তবে, স্ত্রী পুরুষকে আলাদাভাবে শনাক্ত করার ব্যবস্থা বলবৎ রইল এখনও, এবং কর্তৃপক্ষও ব্যাপারটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেন। প্রতিটা গর্তের তলায় চুন ছিটিয়ে একটা পুরু আস্তরণ তৈরি করা। হলো, সেখান থেকে সব সময় ধোঁয়া ওঠে। অনেকগুলো লাশ একসঙ্গে গর্তে নামানোর পর তাদের ওপর ছিটিয়ে দেয়া হয় আর এক প্রস্থ চুন আর এর ওপরে সামান্য মাটি, তবে কখনোই ইঞ্চি কয়েকের বেশি পুরু নয় যাতে পরে আরও লাশ এলে সেগুলোকে এর ওপর শোয়ানো যায়। পরদিন, আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে মৃত ব্যক্তিদের জন্যে যে রেজিস্টার আছে সেটা সই করিয়ে নেয়া হয়-যাতে মানুষ এবং অন্য কিছু, ধরা যাক, কুকুরের মধ্যে। পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। মানুষের মৃত্যু খাতায় লিপিবদ্ধ করা। হত।
কাজকর্মের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক লোকের প্রয়োজন হয়ে পড়ল, অথচ রিওকে সাহায্য করার মত মানুষের তখন ভীষণ অভাব দেখা দিয়েছে। গোরখোদক, স্ট্রেচার বাহক, এবং এই ধরনের ছোটখাট কাজের জন্যে অন্যান্য যেসব সরকারি কর্মচারি থাকে, প্রথম তারা, এবং পরে স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। যত কঠোর সাবধানতাই অবলম্বন করা। হোক না কেন, দুদিন আগে বা পরে, ছোঁয়াচে ঠিকই তার থাবা, বসাল।
অবশ্য মহামারী আরও ভয়াবহ রূপ নেয়ার ফলে রোগ যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন লোক পাওয়াটা একটু সহজ হলো। শহরের অর্থনৈতিক জীবনে বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় অনেকেই বেকার হয়ে পড়ল। ফলে, ভয়ের চেয়ে দারিদ্রই এখন থেকে অধিকতর শক্তিশালী তাড়না হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল, এবং বিশেষ করে, মুর্দা দাফনের কাজে ঝুঁকি থাকায়, মজুরি বেশি দেয়া হয় বলে, এ ধরনের তুচ্ছ কাজের লোকের সমাগম গেল বেড়ে।
অগাস্ট মাস পর্যন্ত মৃতদের কবরস্থানে নেয়ার জন্যে মানুষের কোন অভাব হলো না। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য চেহারায়। এরপর মৃত্যুর হার হঠাৎ ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গেল, এবং এ অবস্থাই বজায় রইল। ছোট কবরস্থানটায় এত লাশের জায়গা দেয়া এবার সত্যিই সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। কবরস্থানের চারপাশের দেয়ালগুলো ভেঙে আশেপাশের জমিতেও কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো, কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হলো না।
এই সমস্যা সমাধানের জন্যে শুধুমাত্র রাতের বেলায় কবর দেয়া চালু হলো। এর ফলে সম্ভব হলো দাফনের শিষ্টাচারগুলোকে কমিয়ে ফেলা। এবার নিয়ম হলো, সবগুলো মৃতুদেহকে ঠেসে তুলে দেয়া হবে একটা অ্যাম্বুলেন্সে। রাতে ঘোরাফেরা যাদের অভ্যাস, হামেশাই পরিচিত একটা দৃশ্য চোখে পড়তে লাগল তাদের। সাদা অ্যাম্বুলেন্স বোঝার ভারে এগিয়ে চলেছে টলতে টলতে। আশেপাশের রাস্তায় শোনা যায় তাদের একঘেয়ে ঢং ঢং আওয়াজ! গোরস্থানে পৌঁছানোর পর, মৃতুদেহগুলোকে কোনরকমে গর্তের মধ্যে ঢেলে দেয়া হয়। গর্তের নিচে সেগুলো ঠিকমত পাশাপাশি পড়ল কিনা সেটা দেখার অবকাশও তখন থাকে না কারও। তারপর কোদালে কোদালে চুন ছিটানো হয় লাশগুলোর ওপর, সঙ্গে সঙ্গে মৃত মুখগুলো ঝলসে বিকৃত হয়ে যায়। এরপর ওদের ওপর ছড়িয়ে দেয়া হয় মাটি। অনেক সময় লাশগুলো ঠিকমত ঢাকাও পড়ে না। কিন্তু যতই দিন যেতে লাগল ততই ভরাট হতে থাকল অগণিত কবর। ফলে দেখা দিল আর এক সমস্যা।