তাই? বিস্ময় প্রকাশ করল র্যাঁবেয়া।
বিকেল পাঁচটা। নিচে নামছিল রিও। শহরতলিতে রোগী দেখতে যাবে। সিঁড়িতে দেখা হলো অল্পবয়স্ক এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। বলিষ্ঠ শরীর। বিশাল মুখ। রোমশ জ, কোঁচকানো। নাম জাঁ তারিউ। সিঁড়িতে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে একটা ইঁদুর, সেদিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছে তারিউ। রিওকে শুভসন্ধ্যা জানিয়ে, ও বলল, ইঁদুরগুলো দলে দলে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে মরছে।
হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন, সায় দিল রিও।
কপালে পড়ে থাকা চুলগুলোকে উল্টিয়ে বার কয়েক আঙুল
চালাল তারিউ। বারবার ইঁদুরটার দিকে তাকাচ্ছে ও। ততক্ষণে : নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে ওটার। রিও-র দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, এ নিয়ে অবশ্য দারোয়ানেরই মাথাব্যথা হওয়া উচিত।
সিঁড়ির মাথায় মিশেল-এর সঙ্গে দেখা হলো রি-ওর। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। লালচে চেহারাটা কেমন শুকনো, মলিন।
রিও বলল, মিশেল, সিঁড়িতে একটা ইঁদুর মরে পড়ে আছে।
হ্যাঁ। জানি, বলে চলল মিশেল, মাঝে মাঝে দুতিনটিকেও একসঙ্গে মরতে দেখছি। সব বাড়িতেই এক অবস্থা। হঠাৎ ওকে মনে হলো উদ্বিগ্ন, হতাশ। অন্যমনস্কভাবে গলা চুলকাল ও।
মিশেল, তোমার শরীর ভাল তো? জানতে চাইল রিও।.
অসুখ-বিসুখ হয়তো করেনি, তবে শরীরটা ভাল লাগছে না। বোধহয়, মরা ইঁদুর দেখতে দেখতে আমার মনের ওপর চাপ পড়েছে।
পরের দিন। এপ্রিল ১৮। সকাল। স্টেশন থেকে মাকে নিয়ে ফিরল রিও। মিশেলকে দেখে ওর মনে হলো লোকটা আগের চেয়ে অসুস্থ, মনমরা। এ সময় ওর চোখে পড়ল, সিঁড়ির নিচ থেকে চিলেকোঠা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মরা ইঁদুর। আসার সময় রাস্তার ডাস্টবিনগুলোতেও একই দৃশ্য দেখেছে ও।
বাড়িতে ঢুকেই মিউনিসিপ্যাল অফিসে টেলিফোন করল রিও। কীট-পতঙ্গ ধ্বংস করার দফতরটির কর্মকর্তার সঙ্গে আগের থেকেই পরিচয় আছে ওর। রিও জানতে চাইল, ইঁদুর মরার খবর আপনি জানেন?
ভদ্রলোক বলল, হ্যাঁ। জানি। বন্দরের কাছে পঞ্চাশটার মত মরা ইঁদুর দেখা গেছে। আমি ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছি। এরপর সে জানতে চাইল, আচ্ছা, ব্যাপারটা কি আশঙ্কাজনক?
এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিভাগের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
আপনি যদি তাই মনে করেন তাহলে আমি কর্তৃপক্ষকে বলে, একটা নির্দেশ জারি করার ব্যবস্থা নিতে পারি।
এক্ষুণি করিয়ে নিন, জোর দিয়ে বলল রিও।
কিছুক্ষণ পর ওর বাসার ঝি খবর দিল, ওর স্বামী যে কারখানায় কাজ করে সেখানে কয়েকশো ইঁদুর মরতে দেখা গেছে।
১৮ এপ্রিলের পর থেকে শহরে আরম্ভ হলো উদ্বেগ। রোজ মানুষের চোখে পড়তে লাগল কলকারখানা আর গুদামে মরে পড়ে আছে অসংখ্য ইঁদুর, আর নয়তো মৃত্যু যন্ত্রণায় ধুকছে।
রোগী দেখার জন্যে রিওকে ঘুরতে হয় শহরতলিতে, উপকণ্ঠে, কেন্দ্রস্থলে, অপরিচিত অলিগলি আর বড় রাস্তায়। সব জায়গায় মরা ইঁদুর দেখতে পেল সে। অগণিত মরা ইঁদুর। কোথাও নর্দমায়, কোথাও-বা ডাস্টবিনে।।
জরুরী সভা ডাকলেন পৌর কর্তৃপক্ষ। নির্দেশ দেয়া হলো জনস্বাস্থ্য বিভাগকে: প্রতিদিন সকালে, শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মরা ইঁদুর কুড়িয়ে একখানে জড়ো করতে হবে। সেখান থেকে দুটো ভ্যান ওগুলোকে নিয়ে যাবে শহরের শেষ সীমানায়। ওখানে পোড়ানো হবে মরা ইঁদুগুলোকে।
কিন্তু অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে লাগল। বেড়ে চলল রাস্তায় পড়ে থাকা মরা ইঁদুরের সংখ্যা। আর সেই সাথে বেড়ে চলল ভ্যান দুটোর বোঝ। তিনদিন পর, বাড়ির ভেতর থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসতে শুরু করল ইঁদুর। বাইরের আলোয় এসে প্রকাশ্যে মরতে লাগল, ওরা। তবু, শেষ হলো না ওদের বংশ। তারপরের দিন, সিঁড়িকোঠা, মাটির নিচে ভাড়ার ঘর, নর্দমা সব জায়গা থেকে সারিবদ্ধভাবে আলোয় বেরিয়ে এল ইঁদুরের পাল। প্রচণ্ড বেগে দুলছে ওদের শরীর। কেমন একটা অসহায় অবস্থা। এরপর হঠাৎ লেজের ওপর ভর করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল সবাই। কিন্তু তা আর পারল না। এর আগেই কাত হয়ে পড়ে মরে গেল।
রাতের বেলায়, বাড়ির দরজা, অলিগলি সবখান থেকে ভেসে এল মৃত্যুযন্ত্রণাকাতর কিচমিচ শব্দ। সকালে দেখা গেল, নর্দমা ভরে আছে সারি সারি মরা ইঁদুরে। প্রত্যেকটির মুখ সরু। আর এর চারপাশে তাজা লাল রক্তের ছোপ, মনে হয় যেন লাল একটা ফুল। কোনটাতে পচন ধরেছে, ফুলে উঠেছে শরীর; কোনটা সিটকে শক্ত হয়ে আছে, কিন্তু গোঁফ জোড়া এখনও চোখা, খাড়া হয়ে আছে।
কর্মব্যস্ত শহরের কেন্দ্রস্থলেও দেখা গেল ইঁদুর। কোথাও সিঁড়িতে, কোথাও বাড়ির পিছনে। কোন কোনটা দলছুট হয়ে ঢুকে পড়ে সরকারি অফিসে, স্কুলে, খেলার মাঠে, কাফের বারান্দায়।
শুধু সূর্য ওঠার সময় কিছুক্ষণ দেখা যায় না ওদের। সে সময় দৈনন্দিন আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ চলে। এরপর, আবার আরম্ভ হয় ওদের বের হওয়া। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তেই থাকে। এভাবেই যায় সারাদিন। রাতে, রাস্তায় হাঁটলে পায়ের তলায় অনুভূত হয় বিজাতীয় একটি স্পর্শ। একটি ক্ষুদ্র গোলাকার প্রাণীদেহের উষ্ণ কোমল স্পর্শ।
২৫ এপ্রিল। বেতারে ঘোষণা করা হলো, এ কদিনে ছহাজার দুশো একান্নটা মরা ইঁদুর পাওয়া গেছে। এই অকল্পনীয় সংখ্যার কথা শুনে শহরবাসী দারুণ একটা আঘাত অনুভব করল স্নায়ুতে। ২৮ এপিল বেতার থেকে ঘোষণা করা হলো, প্রায় আট হাজারের মত মরা ইঁদুর পাওয়া গেছে। একটা অজানা ত্রাস ছড়িয়ে পড়ল শহরবাসীর মনে। সবাই পালাতে চাইল উপকূল অঞ্চলে। ঠিক পরের দিন সকালে বেতারে বলা হলো, ইঁদুর মরা কমতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকদিন পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল শহরবাসী।