এতদিন প্লেগ তার শিকার খুঁজছে শহরতলির ঘিঞ্জি অঞ্চলে। কিন্তু এবার হামলা চালাল বাণিজ্যিক এলাকাগুলোয়, এবং সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে জাকিয়ে বসল। মানুষ বলল, বাতাস রোগের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেন, এইসব এলাকাকে শহরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে ফেলা হবে, হাতে গোনা কিছু লোককে ছাড়া কাউকে আর বাইরে যাবার অনুমতি দেয়া হবে না।
ঠিক এই সময় থেকে পশ্চিম ফটক সংলগ্ন অঞ্চলগুলোয় আগুন লাগাটা অসম্ভব রকম বেড়ে গেল। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল যে সব মানুষকে সংক্রমণ এলাকার বাইরে রাখা হয়েছিল তাদের কেউ কেউ সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিল, এবং তারাই এইসব আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটাচ্ছে। প্রিয়জন বিয়োগের শোকে এরা মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে। ভাবছে, আগুন জ্বালিয়ে প্লেগের জীবাণু মেরে ফেলা যাবে। শহরে ঝড় বইতে থাকায় এই আগুন মানুষের মনে এক ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ এই অপরাধের জন্যে কঠোর শাস্তির বিধান জারি করলেন। শেষে ওই অপ্রকৃতিস্থ লোকগুলো শান্ত হয়ে এল। অবশ্য ওরা যে হাজতবাসের ভয়ে এই কাজ ছাড়ল, তা নয়। জেলখানায়ও এখন মৃত্যুর হার অকস্মাৎ বেড়ে গিয়েছে, বস্তুত এই ভয়েই কেউ জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নিল না।
যেসব মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বাস করে-যেমন সৈনিক, কয়েদি, পাদ্রি এবং নান-প্লেগ প্রথমে তাদেরকেই আক্রমণ করে। জেলখানাগুলোয় সাধারণ কয়েদি মারা পড়ছে যে পরিমাণে, ওয়ার্ডাররাও পটল তুলছে সেইভাবে। প্লেগের কাছে ছোট-বড় কোনরকম ভেদাভেদ নেই। শহরে যে দুটো মঠ আছে, সেখান থেকে ধর্মযাজকদের সরিয়ে এনে ধার্মিক কিছু পরিবারের সঙ্গে সাময়িকভাবে তাদের থাকার বন্দোবস্ত করা হলো। ব্যারাক থেকেও কিছু সৈনিককে নিয়ে এসে রাখা হলো বিভিন্ন স্কুল এবং সরকারি অফিসে।
এইসব পরিবর্তন এবং একটানা ঝড়ো হাওয়ার কারণে কারও কারও মনে দেখা দিল দাঙ্গাবাজ মনোভাব। শহরের বিভিন্ন ফটকে প্রায়ই হামলা হতে লাগল। যারা আক্রমণ করে তাদের হাতে থাকে অস্ত্র। দুপক্ষের ভেতর রীতিমত গুলি বিনিময় হয়। তাই বাড়িয়ে দেয়া হলো গার্ডপোস্টের সংখ্যা। এর ফলে আস্তে আস্তে আক্রমণও থেমে গেল।
ফটকে আক্রমণ থেমে গেল বটে, কিন্তু কিছুদিন পর থেকে ছোট আকারে বল প্রয়োগের ঘটনা আরম্ভ হয়ে গেল। স্যানিটারি কর্তৃপক্ষ যে-সব বাড়ি সাময়িকভাবে বন্ধ করে রেখেছিলেন, সেসব বাড়িতে লুটতরাজ শুরু হলো। সাময়িক উত্তেজনার ঝোঁকে এইসব কাজে মেতে উঠল মানুষ। মাঝে মাঝে আজকাল হতবাক হয়ে যাবার মত দৃশ্য চোখে পড়ে। হয়তো একটি বাড়ি দাউদাউ আগুনে জ্বলছে, পাশে দাঁড়িয়ে শোকে দুঃখে মুহ্যমান মালিক তাকিয়ে আছেন আগুনের লেলিহান শিখার দিকে; এমন সময় কেউ সাময়িক উত্তেজনায় ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ে সেই জ্বলন্ত বাড়ির ভেতর। আশেপাশের অনেক দর্শক তখন সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পিছু নেয় লোকটার। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, অন্ধকার রাস্তা জুড়ে অসংখ্য মানুষ দাপাদাপি করছে; তাদের মাথার ওপর অথবা কাঁধে সংসারের আসবাবপত্র।
কর্তৃপক্ষ সামরিক আইন জারি করতে বাধ্য হলেন। একদিন লুণ্ঠনে ব্যস্ত দুজন লোককে দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করা হলো। রাত এগারোটা থেকে বলবৎ করা হয় সান্ধ্য-আইন। অন্ধকারে নিমজ্জিত ওরাওঁ শহরকে তখন মনে হয় একটা বিশাল কবরস্থান। চারদিকে কোথাও পায়ের শব্দ কিংবা কুকুরের ডাক শোনা যায় না। সবখানে কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। শহরের দীর্ঘ রাস্তা আর তার দুপাশের আধা-মলিন দেয়াল, মনে হয় যেন সামনের দিকে যেতে যেতে এক সময় হঠাৎ হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। মোড়ে মোড়ে যেসব জঁদরেল মহাপুরুষের প্রস্তর মূর্তি আছে, মনে হয় প্রাণহীন এই শহরে তারাই এখন একমাত্র। প্রতিনিধি।
এখন প্লেগে কারও মৃত্যু হওয়ার অর্থ, সঙ্গে সঙ্গে তার সাথে তার পরিবারের সবার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। লাশের পাশে আত্মীয়-স্বজনের আসা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সন্ধ্যায়, মারা গেলে সারারাত ধরে কেউ আর তার শিয়রে বসে থাকে না। নিঃসঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকে শব। আর রাতে মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তার দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। যারা পরিবারের সঙ্গে বাস করা অবস্থায় মারা যায়, সেসব পরিবারকে অন্যদের থেকে আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়। আর যেসব রোগী আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে দূরে মারা যায়, তাদের বেলায় পরিবারপরিজনদের লাশ দেখার সুযোগ দেয়া হয় নির্দিষ্ট একটা সময়ে-গোসল করানোর সময়। এই আনুষ্ঠানিকতাগুলো ঘটে, ধরে নেয়া যাক, রিও-র অস্থায়ী হাসপাতালে। যে-স্কুল ভবনকে এই হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়েছে, তার পিছনের দিকে বাইরে বের হবার একটা পথ আছে। কফিনে শোয়ানো লাশটা রাখা হয় বড় একটা গুদাম ঘরে। মৃত ব্যক্তির আপনজনেরা এসে দেখতে পায় আগেই পথের ধারে পেরেক মারা কফিন নামিয়ে রাখা হয়েছে। তারা সই দেন কতকগুলো সরকারি কাগজপত্রে। এরপর কফিনটাকে তুলে দেয়া হয় কোন শবযান বা অ্যাম্বুলেন্সে। অপেক্ষমাণ কোন ট্যাক্সিতে গিয়ে ঢোকে শোকাচ্ছন্ন পরিবারের লোকজন। শহরের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে পাশ কাটিয়ে অন্য একটা পথ ধরে কবরস্থানের দিকে ছুটে যায় শবযান। শহরের বাইরে যাবার ফটকে পৌঁছে থামে সবাই। একজন পুলিস অফিসার বাইরে যাবার অনুমতিপত্রের ওপর সীলমোহর লাগিয়ে দেন। কিছুক্ষণ চলার পর আবার থেমে পড়ে শবযান। এটাই কবরস্থান। আগেই কবর খুঁড়ে রাখা হয়। ওদের দেখে এগিয়ে আসেন একজন পাদ্রি। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় শবকে গির্জায়। নিয়ে যাবার চিরন্তন রীতি এখন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কফিন শবযান থেকে নামিয়ে কবরের পাশে রাখা হয়। দড়ি খুলে দিতেই সশব্দে গর্তে পড়ে যায় লাশ। কবরের ওপর মন্ত্রপূত পানি ছিটিয়ে দেন। ধর্মযাজক। শবযান আগেই চলে যায়। কবর ভরাট হতে না হতেই। ট্যাক্সিতে গিয়ে ওঠে আত্মীয়স্বজন। পনেরো মিনিটের ভেতর বাসায় ফিরে যায় সবাই।