পরের দিন ওরা গিয়ে দেখে দুই পাহারাদার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। একটা চিরকুটে লিখে রেখে গেছে, পরদিন দুপুর বেলা হাইস্কুলের মাঠে দেখা করবে।
র্যাঁবেয়া হোটেলে ফেরার পর ওর চেহারা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল তারিউ।
আপনার শরীর ভাল তো? প্রশ্ন না করে পারল না ও।
না, শরীর ঠিক আছে। কিন্তু কাজটা আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে, এটা ভেবেই মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। কাল রাতে আপনারা আসছেন তো?
রাতে রিও এবং তারিউ ঘরে ঢুকে দেখে বিছানায় শুয়ে আছে। র্যাঁবেয়া। ওদের দেখেই বিছানা ছেড়ে সামনের সাজানো গ্লাসগুলোয় মদ ঢালল ও।
গ্লাসে চুমুক দেবার আগে রিও জিজ্ঞেস করল, আপনার কতদূর এগুলো?
র্যাঁবেয়া বলল, সবকিছু প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। হয়তো দু-একদিনের মধ্যে শেষ পর্যায়ের দেখা-সাক্ষাৎ হবে। এরপর নিজের গ্লাসে চুমুক দিয়ে হতাশ কণ্ঠে মন্তব্য করল, হয়তো ঠিক সময়ে দেখা যাবে ওরা আসেনি।
এ কথা ভাবছেন কেন? একবার হয়েছে বলে এবারও অমন হবে, তার কোন মানে নেই।
তাহলে আপনি এখনও ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল র্যাঁবেয়া।
মানে?
প্লেগ। প্লেগের কথা বলছি।
আচ্ছা? চেঁচিয়ে উঠল রিও।
হ্যাঁ। আপনি এর চরিত্র এখনও বুঝতে পারেননি। এর অর্থ হচ্ছে, একই জিনিসের বারবার পুনরাবৃত্তি হওয়া। র্যাঁবেয়া উঠে ঘরের কোণে একটা ছোট গ্রামোফোন চালিয়ে দিল। এমন সময় বাইরে শোনা গেল গুলির আওয়াজ।
কুকুর মারা পড়ল, নাকি কেউ পালিয়ে যাচ্ছিল?
কয়েক মিনিট পর থেমে গেল রেকর্ড। জানালার নিচে, রাস্তায়। শোনা গেল অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেল আওয়াজটা।
কেমন বিরক্তিকর ওই রেকর্ড, মন্তব্য করল র্যাঁবেয়া, তবু আজ এই নিয়ে দশবার বাজালাম।
এত ভাল লাগে?
ভাল লাগার তো কথা নয়। কিন্তু আছে যে মাত্র একটাই।। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারিউ বলল, তাহলে ব্যাপার ওটাই।
একই জিনিস বারবার ঘটে।
রিওকে জিজ্ঞেস করল র্যাঁবেয়া, আপনাদের স্যানিটারি স্কোয়াড কেমন কাজ করছে?
আপাতত পাঁচটা দল কাজ করছে। আশা করছি শিগগিরই এদের সংখ্যা বাড়বে।
ডাক্তার, এসব নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। এখনও আমি কেন যোগ দিইনি, তার কারণ আছে। নিজের জীবনকে বিপন্ন করতে আমার ভয় নেই। আমি স্পেনের গৃহযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম।
কোন্ পক্ষে? প্রশ্ন করল তারিউ।
যে পক্ষকে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছিল। আমি মনে করি, মহৎ কিছু করার ক্ষমতা সব মানুষেরই আছে। কিন্তু মহৎ অনুভূতি যার নেই তাদের কাছে যেতে আমার মন সাড়া দেয় না।
কিন্তু আমার তো মনে হয় সবকিছুই হয়তো আমরা করতে পারি, মন্তব্য করল তারিউ।
না, এটা ঠিক নয়। মানুষ একটানা যেমন দুঃখভোগ করতে পারে না, তেমনি সুখভোগও করতে পারে না। এর অর্থ, সত্যিকারের মহৎ বা মূল্যবান কাজ করার ক্ষমতা মানুষের নেই।
র্যাঁবেয়া ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে এবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা, তারিউ, আপনি কী ভালবাসার জন্যে প্রাণ দিতে পারবেন?
বলা কঠিন। কিন্তু এ-মুহূর্তে পারব না।
তাহলে দেখুন। অথচ প্লেগের জন্যে প্রাণ দেবার সাহস আপনার আছে। কিন্তু আমি দেখতে চাই মানুষ শুধু ভালবাসার জন্যেই বাঁচবে কিংবা মরবে। এখন এতেই আমার আগ্রহ।
রিও উঠে বলল, আমরা এখন যা করছি সে-সবের ভেতর সত্যি কোন বীরত্ব নেই। অন্তত আমরা সেভাবে চিন্তা করি না। আমাদের এই কাজের পিছনে আছে একটি সাধারণ অনুভূতি, যার নাম শালীনতাবোধ।
কিন্তু শালীনতাবোধটা আসলে কী? র্যাঁবেয়ার গলার স্বর বেশ গম্ভীর মনে হলো এবার।
নিজের দায়িত্বটুকু যথাযথভাবে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা।
নিজের দায়িত্ব? কিন্তু হায়, আমি যদি জানতে পারতাম কোনটা। আমার নিজের দায়িত্ব। জানি না, ভালবাসাকে মানুষের জীবনে এতটা গুরুত্ব দিয়ে আমি ভুল করেছি কিনা!
না, না, তা ভাবছেন কেন? আপনি মোটেই ভুল করেননি।
আমার ধারণা এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আপনাদের দুজনের কারোরই সত্যিকারের হারাবার কিছু নেই। তাই এই পথে যেতে আপনাদের বাধাও নেই।
রিও গ্লাসের বাকি মদটুকু খেয়ে তারিউকে বলল, চলুন, আমাদের অনেক কাজ পড়ে রয়েছে।
ওকে অনুসরণ করল তারিউ। কিন্তু দরজায় পৌঁছে থেমে গেল। ও। ঘুরে র্যাঁবেয়াকে বলল, আপনি হয়তো জানেন না, রিও-র স্ত্রী এখন এক স্যানাটোরিয়ামে আছেন, চিকিৎসা চলছে ওর। এখান থেকে শখানেক মাইল দূরে ওই স্বাস্থ্যনিবাস।
হঠাৎ থ হয়ে গেল র্যাঁবেয়া। কী যেন বলতে চাইল, কিন্তু, ততক্ষণে ঘর ছেড়ে চলে গেছে তারিউ।
পরের দিন খুব সকালে রিওকে ফোন করল র্যাঁবেয়া, শহর ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। আপনারা রাজি?
এক মিনিটের মত কেটে গেল নীরবে। এরপর দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিল রিও, অবশ্যই, র্যাঁবেয়া। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
৩য় পর্ব : অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে
তৃতীয় পর্ব
অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে আশেপাশের সবকিছু এমনকি শহরের প্রতিটি মানুষের জীবনও গ্রাস করে ফেলল প্লেগ। একদিন উঠল প্রচণ্ড ঝড়, এবং প্লেগ-উপদ্রুত শহরের ওপর দিয়ে বয়ে চলল সেই ঝড়। ওরাওঁ-এর অধিবাসীরা ঝড়কে ভীষণ ভয় পায়, কেননা ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ঝড়ের গতিপথে বাধা দেয়ার মত প্রাকৃতিক কোন প্রতিবন্ধক নেই শহরে। গত কয়েক মাস ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় সবকিছুর ওপর ধুলোর একটা পুরু আস্তর জমে উঠেছিল। ঝড়ে সেগুলো হালকা মেঘের মত ওপরে উঠে উড়তে লাগল বাতাসের সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যে সমস্ত আকাশ ছেয়ে গেল ধুলার ধূসর মেঘে। মানুষের চারপাশে ঘুরতে লাগল অসংখ্য কাগজের টুকরো। এই দুই কারণে ক্রমেই জনশূন্য হয়ে পড়তে লাগল রাস্তাঘাট। কদাচিৎ কেউ বেরোলেও, রুমাল বা হাতে মুখ ঢাকা দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে তড়িঘড়ি হাঁটছে। রাত নামলে আগে যেমন চারদিকে মানুষের সমাগম হত, নিজেদের তারা। ডুবিয়ে দিত আনন্দ ফুর্তির ভেতর, এখন আর তেমন কিছু চোখে পড়ে না .এখন জনশূন্য রাস্তায় ঝড়ের একটানা ক্রুদ্ধ ফোঁসফোঁসানি ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। ঝড়ে আন্দোলিত বিক্ষুব্ধ সমুদ্র থেকে ভেসে আসে লবণাক্ত পানি আর পচা আগাছার গন্ধ। শহরটাকে মনে হয় অভিশপ্ত মানুষের বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ।