পরের দিন, হোটেলে নিজের ঘরে ফিরছে র্যাঁবেয়া। সিঁড়িতে দেখা হয়ে গেল তারিউ-এর সঙ্গে। আমার সঙ্গে যাবেন? ডাক্তার রিও-র কাছে যাচ্ছি, বলল তারিউ।
একটু ইতস্তত করল র্যাঁবেয়া। যাওয়াটা কি উচিত হবে। আমার কেবলই মনে হয় ওকে নিশ্চয় খুব বিরক্ত করছি।
আপনি উতলা হবেন না। আপনার অনেক কথা শুনেছি ওর কাছে।
কিছুক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করল র্যাঁবেয়া। তারপর বলল, তার চেয়ে এক, কাজ করুন না বরং। রাতের খাওয়ার পর আমার। এখানে দুজনেই চলে আসুন। একসঙ্গে গলা ভেজানোনা যাবে।
সেটা নির্ভর করছে ডাক্তার রিও-র ওপর। দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে বলল তারিউ। আর প্লেগের ওপর তো বটেই।
রাত এগারোটায় হোটেলের ছোট্ট বারে ঢুকল রিও এবং তারিউ। প্রায় তিরিশজনের মত লোক তখন বসেছিল ওখানে, চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে কথা বলছে সবাই। আর বাইরে প্লেগ আক্রান্ত থমথমে শহর। কিছুটা থতমত খেয়ে গেল ওরা দুজন। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ঢোকার পথে। কিন্তু যখন দেখল বারে মদ বিক্রি হচ্ছে তখন হৈ-চৈ-এর কারণ বোধগম্য হলো।
এক কোণে একটা টুলের ওপর বসে আছে র্যাঁবেয়া। ওদের। দেখেই ইশারা করল। আর পাশে দাঁড়ানো যে লোকটা হৈ-চৈ করছিল তাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে সরাল ওদেরকে এগোনোর পথ করে দেয়ার জন্যে।
কড়া কিছু টানতে আপত্তি নেই তো, প্রস্তাব দিল ও।
না, সাড়া দিল তারিউ।
মদের ঝাঁঝাল গন্ধ শুঁকল রিও। চারদিকের চিৎকারে কারও কথা শোনা যাচ্ছে না। র্যাঁবেয়াকে দেখে মনে হচ্ছে মদ খাওয়া নিয়েই মগ্ন হয়ে আছে ও। বারের বাইরের অবশিষ্ট জায়গাটুকুতে দুখানা টেবিল পাতা। একটায় বসে আছে একজন নৌবাহিনীর অফিসার, দুপাশে দুজন যুবতী। সামনে বসা-লালচে-মুখো মোটাসোটা এক ভদ্রলোককে টাইফয়েড যেবার কায়রোতে মহামারীর আকারে দেখা দিয়েছিল সে-গল্প শোনাচ্ছিল অফিসার। অন্য টেবিলটায় রয়েছে একদল যুবক। ঠিক ওদের মাথার ওপরেই লাউডস্পীকার থেকে ভেসে আসছে একঘেয়ে সঙ্গীতের গর্জন। তাই ওদের কথা শোনা যাচ্ছে না।
কিছু হলো? একটু চেঁচিয়ে র্যাঁবেয়াকে জিজ্ঞেস করল রিও।
সম্ভবত এই সপ্তাহের মধ্যে কিছু একটা হয়ে যাবে।
বড়ই দুঃখের কথা, চিৎকার করে উঠল তারিউ।
কেন? আপনি অমন ভাবছেন কেন?
না। না। এমনি, বলল রিও, ওর ধারণা আপনি থাকলে আমাদের অনেক সাহায্য হত। কিন্তু আমি আপনার অবস্থা বুঝি।
আর এক দফা মদ নিল ওরা। এবারের খরচটা তারিউ-এর।
টুল থেকে নেমে পড়ল র্যাঁবেয়া। এই প্রথম তারিউ-এর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জানতে চাইল, কীভাবে আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারি?
কেন, মদের গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে শান্ত গলায় বলল তারিউ, আপনি আমাদের যে কোন একটা স্যানিটারি স্কোয়াডের সঙ্গে কাজ আরম্ভ করতে পারেন।
একটা একগুঁয়েমি ভাব ফুটে উঠল র্যাঁবেয়ার চেহারায়। আবার টুলে উঠে বসল ও।
আপনার কি মনে হয়? স্কোয়াডগুলো ভাল কাজ করছে না?
মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জানতে চাইল তারিউ।
না, একথা বলার মত কোন কারণ দেখছি না আমি। র্যাঁবেয়া তার মদ শেষ করল।
রিও লক্ষ করল ওর হাত কাঁপছে। নিশ্চয় মাতাল হয়ে গেছে, র্যাঁবেয়া।
পরের দিন স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় পৌঁছে র্যাঁবেয়া দেখল, সামনের ফুটপাথের ওপর অনেক লোক চেয়ার পেতে বসে আছে। চারপাশে সোনালি আর সবুজ আলো ঝিকমিক করছে। ওদের অনেকের মুখ থেকেই ভেসে আসছে কড়া চুরুটের ঝাঁঝাল গন্ধ। ভিড় ঠেলে রেস্তোরাঁয় ঢুকল ও। ভেতরটা একেবারে খালি। সেদিন গনজালেস যে-টেবিলে বসেছিল সেদিকে এগিয়ে গেল র্যাঁবেয়া। পরিচারিকাকে জানাল, খাবারের ফরমাশ দিতে একটু দেরি হবে। ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা বাজে।
বাইরে যারা হাওয়া খাচ্ছিল ওদের মধ্যে থেকে দুএকজন করে, ভেতরে ঢুকতে শুরু করল। টেবিলে ঘুরে ঘুরে খাবার দিতে লাগল পরিচারিকা। আস্তে আস্তে কোলাহলে ভরে উঠল ঘরটা।
আটটা বাজল। একে একে জ্বলে উঠল ভেতরের সবগুলো আলো। ওর টেবিলের চারপাশের চেয়ার দখল করে বসল অপরিচিত একদল লোক। ডিনারের ফরমাশ দিল র্যাঁবেয়া।
সাড়ে আটটায় ওর খাওয়া শেষ হবার পরও গনজালেস বা সেই পাহারাদার দুজনের কেউ এল না। আস্তে আস্তে খালি হতে আরম্ভ করল রেস্তোরাঁ। নটায় একেবারে খালি হয়ে গেল। পরিচারিকা অদ্ভুতদৃষ্টিতে ওকে লক্ষ করছে। দেখে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ল র্যাঁবেয়া।
রাস্তার ও-পারে তখনও একটা কাফে খোলা ছিল। সেখানে ঢুকে এমন একটা জায়গা বেছে নিল ও, যেখান থেকে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁর দরজার ওপর ভালভাবে নজর রাখা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ এল না। রাত সাড়ে নটায় রাস্তায় বেরিয়ে নিজের হোটেলের দিকে ধীর পায়ে হাঁটা দিল র্যাঁবেয়া।
গনজালেস-এর ঠিকানা ও রাখেনি। লোকটাকে আবার কীভাবে খুঁজে বের করবে সেটাই এখন ওর চিন্তার বিষয়। হয়তো আবার গোড়া থেকেই সবকিছু শুরু করতে হবে।
ওর চারপাশ দিয়ে ছুটোছুটি করছে অ্যাম্বুলেন্স। একসময় হঠাৎ র্যাঁবেয়া সবিস্ময়ে অনুভব করল, ওর আর ওর প্রেমিকার মাঝখানে প্লেগ যে-দেয়াল তুলেছে, সেই দেয়ালের বাইরে যাবার সমস্ত পথ ওর জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। অকস্মাৎ প্রেমিকাকে দেখার এক প্রবল আকাক্ষা ওর হৃদয়ে প্রচণ্ড গতিতে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে শুরু হলো জ্বালা। দাবানলের মত শিরা-উপশিরা বেয়ে রক্ত প্রবাহের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। হোটেলের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল র্যাঁবেয়া।