রেস্তোরাঁ থেকে বেরুবার পথে র্যাঁবেয়ার ডান হাত বন্ধু নিজের মুঠোয় নিয়ে বেশ জোরে ঝাঁকানি দিয়ে বলল, আমার নাম গনজালেস।
পরের দুটো দিন র্যাঁবেয়ার কাছে মনে হলো যেন অনন্তকাল। রিওকে খুঁজে বের করে সমস্ত ঘটনা শোনল ও। রিও তখন রোগী দেখার জন্যে বাইরে যাচ্ছিল; সে-ও চলল ওর সঙ্গে। এক রোগীর বাসায় পৌঁছুল ওরা।
তারিউ ঠিকমত পৌঁছলেই হয়, বলল রিও। ওকে তখন বেশ পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল।
মহামারী কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে? প্রশ্ন করল, র্যাঁবেয়া।
রিও বলল, ঠিক তা নয়, তবে পরিস্থিতি সামলানোর মত
যন্ত্রপাতি এবং লোকের বড় অভাব।
বাইরে থেকে ডাক্তার বা অ্যাসিস্টান্ট আসেনি?
এসেছে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অবস্থার অবনতি ঘটলে আমরা সামলাতে পারব না।
আমি কিন্তু সে-ভয়ে পালাতে চাইছি না। আমি কাপুরুষ নই। কিন্তু দীর্ঘদিন প্রেমিকাকে ছেড়ে থাকতে হবে, এটা কিছুতেই ভাবতে পারি না। অবশ্য আমি জানি না, জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণা কী।
রিও বলতে যাচ্ছিল ওর উপলব্ধিও অনেকটা এই রকমই, ঠিক এ-সময় এসে পড়ল তারিউ। ওর মুখে কেমন একটা উত্তেজনার ভাব।
ফাদার প্যানালুকে আমাদের কাজে যোগ দেয়ার কথা বলেছিলাম। উনি রাজি হয়েছেন।
বাহ। মুখে যাই বলুন, কাজের সময় তো বাস্তববাদী মনে হচ্ছে। আমি খুশি হয়েছি, বলল রিও।
মাফ করবেন, এবার আমি বিদায় নেব, বলল র্যাঁবেয়া।
.
বুধবার, অর্থাৎ যেদিন সাক্ষাতের কথা, আটটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই গির্জায় পৌঁছে গেল র্যাঁবেয়া। অন্যদিনের তুলনায় আজ বাতাস এখনও কিছুটা ঠাণ্ডা। আকাশে হালকা তুলোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ। ভেসে আসছে শিশিরের মৃদু গন্ধ।
গির্জার ঘড়িতে আটটা বাজল। শূন্য বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল র্যাঁবেয়া। ভেতর থেকে ভেসে আসছে ধূপের সুবাস। সঙ্গীতের সুর আস্তে আস্তে স্তিমিত হতে হতে একেবারে থেমে গেল। জনা দশেক লোক গির্জার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে শহরের দিকে হাঁটতে থাকল। অধৈর্য হয়ে উঠল র্যাঁবেয়া। আবার কিছু লোক সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল র্যাঁবেয়া, হঠাৎ ভাবল এখানে সিগারেট টানা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
আটটা দশে বেজে উঠল অর্গান। ভেতরে ঢুকল ও। প্রথমে আবছা আলোয় কিছুই ঠাহর করতে পারল না। সামনে একটা বেদী, তার ওপর একটা মূর্তি। হাঁটু-গেড়ে বসা মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে জমাট-বাঁধা অন্ধকারের কতকগুলো ছোপ।
বাইরে এসে র্যাঁবেয়া দেখে, সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে গনজালেস। ওকে দেখে বলল, এই যে, বুড়ো খোকা, আমি ভেবেছিলাম আপনি এতক্ষণে চলে গেছেন। অনেক দেরি করে ফেলেছি। এরপর দেরি হওয়ার কারণটা জানাল ও, আটটা বাজার দশ মিনিট আগে বাসা থেকে বেরিয়েছি। যেখানে ওদের সঙ্গে দেখা, করার কথা, সেখানে অপেক্ষা করেছি বিশ মিনিট। কিন্তু তবু পাত্তা পেলাম না কারও। নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। এই লাইনে কাজ করতে গেলে পদে পদে বিপদ।
পরের দিন, একই সময়ে ওয়ার মেমোরিয়ালের সামনে দেখা হবে বলে কথা দিল গনজালেস। দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুপিটা পিছনের দিকে ঠেলে দিল র্যাঁবেয়া।
ওয়ার মেমোরিয়াল জায়গাটা পাহাড়ের চূড়ার কাছে একটা পার্কের মত দেখতে।
ওখান থেকে সমুদ্র চোখে পড়ে। পরের দিনও ওরা আসার আগেই নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছুল বাঁবেয়া। সময় কাটানোর জন্যে পড়ল শহীদদের নামের তালিকা। কয়েক মিনিট পর দুজন লোক হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এল ওর দিকে। কেমন একটা নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে, তারপর পার্কের দেয়ালে হাত রেখে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখতে লাগল নিচের জনশূন্য বন্দর। দুটো লোকের পরনেই একই রকম ফতুয়া আর নীল প্যান্ট। দুজনের উচ্চতাও সমান। একটু সামনে এগিয়ে একটা পাথরের বেঞ্চিতে বসল র্যাঁবেয়া। এমন সময় ওর দিকে হেঁটে এল গনজালেস। এর মধ্যে নিশ্চয় আপনাদের আলাপ হয়ে গেছে। এবার তাহলে কাজের কথায় আসা যাক, বলল ও।
ওদের একজনের নাম মার্সেল, অন্যজনের লুই। একজন বলল, দুদিনের মধ্যেই পোর্টে আমাদের ডিউটি শুরু হবে। তখন পুরো সপ্তাহ আমরা ওখানেই থাকব। সে-সময় দেখব কোন রাতটায় সুবিধে হবে। কিন্তু বিপদ আছে একটা। আমাদের সঙ্গে আরও দুজন পাহারায় থাকবে, ওরা সৈনিক। যতদূর সম্ভব, ওদের এসবের বাইরে রাখা ভাল। কোন কোন দিন সন্ধ্যায় ওরা কাছের একটা গুঁড়িখানায় যায়। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা মারে। এ-সময়টায় আপনি যদি আমাদের বাসায় থাকেন তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়। আমাদের বাসা ফটক থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। তবে ঝটপট সবকিছু সেরে ফেলতে হবে। ফটকের সামনে আরও একটা পাহারা বসানোর কথাবার্তা চলছে।
সম্মতি জানাল র্যাঁবেয়া। পকেটের সবকটা সিগারেট ওদের দিয়ে দিল। ওদের ভেতর যে লোকটা এতক্ষণ কথা বলেনি সে গনজালেসকে জিজ্ঞেস করল, টাকা-পয়সার লেনদেন সম্পর্কে কথা হয়েছে?
না, এখনও হয়নি, বলল গনজালেস, তবে ওসব নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। উনি আমার বিশিষ্ট বন্ধু। টাকা পয়সা যা দেবার যাওয়ার সময় দেবেন। একদিন পর, রাতের খাওয়ার সময় সবাইকে স্প্যানিশ রোশায় আসতে বলল ও। এরপর র্যাঁবেয়াকে বলল, বুড়ো খোকা, চিন্তার কিছু নেই। প্রথম রাতে আমি আপনার সঙ্গে থাকব।