রিও বলল, প্রত্যেকেরই কামনা করা উচিত এর চেয়ে খারাপ কিছু ঘটবে না।
তারিউ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জানতে চাইল, আপনার কাজ-কর্ম কি এখন বেড়ে গেছে?
যা ভাবছেন ঠিক তার উল্টো। মারাত্মক ক্রিমিন্যাল কেসগুলো কমে এসেছে। আইন-কানুন মানুষ এখন অনেক ভালভাবে মেনে চলে।
চলে গেলেন অথন। গাড়িতে স্টার্ট দিল তারিউ। কিছুক্ষণ পর কটার্ড এবং র্যাঁবেয়া লক্ষ করল ওদের দিকে এগিয়ে আসছে গ্রাসিয়া। কাছে এসে বলল, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
চারপাশের ভিড়ের ভেতর মেয়েমানুষের সংখ্যাই বেশি। প্রত্যেকের হাতে পুটুলি। আশা করছে হয়তো জিনিসটা পৌঁছে দিতে পারবে অসুস্থ স্বজনের কাছে। ব্যারাকের ফটকে সশস্ত্র পাহারা। ব্যারাক আর ফটকের মাঝখানে একটা আঙিনার মত। সেখান থেকে কিছুক্ষণ পর পর শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত ভূতুড়ে চিৎকার। ভিড় জমানোলোকজন তখন উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ভেতরের রোগীদের ওয়ার্ডের দিকে।
ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওইসব দেখতে লাগল। খানিক, বাদে ওদের পিছনে এক কণ্ঠস্বর সুপ্রভাত বলতেই একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল তিনজনেই। এত গরমেও রাউল-এর পরনে কালো সুট, মাথায় ফেল্ট ক্যাপ। সুগঠিত দীর্ঘ দেহ ওর। চেহারাটা কেমন বিমর্ষ। ঠোঁটজোড়া না নড়িয়ে খুব দ্রুত আর পরিষ্কার ভাষায় বলল, চলুন, একটু সেন্টারের দিকে হাঁটা যাক। গ্রাসিয়া, তোমাকে আর দরকার নেই।
একটা সিগারেট ধরিয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে রইল গ্রাসিয়া। ওরা তিনজন হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। র্যাঁবেয়া আর কটার্ড দুপাশে, মাঝখানে রাউল।
গ্রাসিয়া আমাকে সব বলেছে, বলল রাউল, ব্যবস্থা একটা হতে পারে। কিন্তু আগেই বলছি, পুরো দশ হাজার লাগবে।
আমি রাজি, জানাল র্যাঁবেয়া।
ডকের কাছাকাছি একটা স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ আছে। কাল দুপুরে ওখানে আমরা খাব।
র্যাঁবেয়া বলল, বেশ। তাই হবে। এই প্রথম হাসল রাউল। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করল। ও চলে যাবার পর কটার্ড বলল, কাল দুপুরে আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারব না। একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আর তাছাড়া, আমাকে আপনার দরকারও হবে না।
.
হলুদ রঙের ছোট্ট একটা রাস্তা। ওই রাস্তা থেকে কিছুটা নিচে অন্ধকার ঘরে স্প্যানিশ রেস্তারাঁ। নিয়মিত খদ্দেররা অধিকাংশই স্প্যানিশ বংশোদ্ভুত, অন্তত ওদের চোখের রঙ তাই বলে। র্যাঁবেয়া রেস্তোরাঁয় ঢোকার পর সবাই ওর দিকে সকৌতূহলে তাকাল। রাউল ভেতর থেকে ইশারা করতেই ওর দিকে এগিয়ে গেল র্যাঁবেয়া। সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখ থেকে উড়ে গেল কৌতূহল। নিজের নিজের প্লেটের ওপর ঝুঁকে পড়ল ওরা। রাউল-এর পাশে আজ বসে আছে লম্বাটে, লিকলিকে চেহারার একজন। দাড়ি-গোঁফ বিশ্রীভাবে কামানো। কাঁধ অসম্ভব রকমের চওড়া। মুখটা ঘোড়ার মুখের মত লম্বা। মাথার চুল পাতলা। জামার হাতা কনুই অবধি গোটানো। হাত দুটোয় মাংস বলতে কিছু নেই। কান পুরু লোমে ঢাকা। পরিচয়ের পালা চুকে যাবার পর ধীরে ধীরে পরপর তিনবার মাথা নোয়াল লোকটা। ওর নাম অবশ্যি বলল না রাউল, লোকটার প্রসঙ্গ উঠলে ওকে আমাদের বন্ধু বলে উল্লেখ করল।
আমাদের এই বন্ধুর ধারণা ও হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। ও… বাঁবেয়া কী খাবে সে ফরমাশ নিতে টেবিলের সামনে এক ওয়েটার এসে দাঁড়াতেই আচমকা মাঝপথে থেমে গেল রাউল।
ও আমাদের অন্য দুইজন বন্ধুর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবে। ওরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবে ফটকের কয়েকজন পাহারাদারকে। তবে তার মানে এই না যে আপনি সাথে সাথে রওনা হতে পারবেন। কখন পালাতে পারবেন সেটা পাহারাদারেরাই ঠিক করে দেবে। ওদের কারও বাসায় আপনি কয়েক রাত থাকতে পারলে ব্যাপারটা আপনার জন্য সহজ হবে। ওদের বাসা ফটকের কাছেই। এখন আমাদের এই বন্ধুর কাজ হবে খুব তাড়াতাড়ি ওদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়া। এসব যখন শেষ হবে, তখন আপনি ওর সঙ্গে টাকা-পয়সা লেনদেনের ব্যাপারে পাকাপাকি কথা বলবেন।
ঘোড়ামুখো বন্ধু লোকটা, মুহূর্তের জন্যেও টম্যাটোর সালাদ চিবানো বন্ধ না করে, আবারও বার কয়েক তার ছুঁচলো মাথাটা ওপর-নিচে করল। তারপর যখন শেষ হলো খাওয়া তখন শুরু করল কথা। উচ্চারণে, স্প্যানিশ টান। পরের দিন সকাল আটটায় শহরের গির্জার বারান্দায় র্যাঁবেয়াকে দেখা করতে বলল ও।
তাহলে অন্তত আরও দুদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে, মন্তব্য করল র্যাঁবেয়া।
দেখুন, আপনি যা ভাবছেন ব্যাপারটা অত সহজ নয়। ওদেরও চারদিকে খোঁজ-খবর নিতে হবে, উত্তর দিল রাউল।
ঘোড়ামুখো বন্ধু আরেকবার আস্তে করে মাথা নেড়ে সমর্থন করল রাউলকে। কথা বলতে বলতে র্যাঁবেয়া জানল ঘোড়ামুখো লোকটা একজন উৎসাহী ফুটবল খেলোয়াড়। ও নিজেও একসময়। ফুটবল খেলোয়াড় ছিল, আর ফুটবলের প্রতি ওর আগ্রহও যথেষ্ট। খাওয়া শেষ হওয়ার পর দেখা গেল ওদের মধ্যে বেশ একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এবং অচিরেই ঘোড়ামুখো র্যাঁবেয়াকে ঠাট্টাচ্ছলে বুড়ো খোকা বলে ডাকতে আরম্ভ করল। বলল, ফুটবল মাঠে একমাত্র সেন্টার-হাফরাই খেলা দেখাবার সুযোগ পেয়ে থাকে।
র্যাঁবেয়া ওর মত সমর্থন করল, যদিও সে নিজে খেলেছে সেন্টার ফরওয়ার্ড পজিশনে। মোটামুটি একটা শান্ত পরিবেশের মধ্যেই এগুচ্ছিল ওদের কথাবার্তা, হঠাৎ বেজে উঠল রেডিও। কয়েকটা হালকা গান শেষ হবার পর ঘোষণা করা হলো, আগের দিন প্লেগে মারা গেছে দুশো সাত জন। রেস্তোরাঁর কেউই বিচলিত, হলো না খবরটা শুনে। একমাত্র ঘোড়ামুখো বন্ধুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাউল এবং র্যাঁবেয়াও উঠে পড়ল এই সঙ্গে।