কটার্ড গা থেকে কোট খুলে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে, বারকয়েক জোরে জোরে ঘা দিল টেবিলে। খুলে গেল পিছনের দরজাটা। বেরিয়ে এল গলাবন্দ নীল অ্যাপ্রন পরা এক লোক। বেঁটে। প্রায় চিৎকার করে কার্ডকে অভিবাদন জানাল ও। লাথি মেরে মোরগটাকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় নিজে এসে দাঁড়াল। ওর গলার জলদগম্ভীর আওয়াজে চাপা পড়ে গেল মোরগটার কঁক কঁ শব্দ। মদের ফরমাশ দিয়ে কটার্ড জানতে চাইল, গ্রাসিয়া কোথায়? বামন জানাল, গত কয়েকদিন থেকে গ্রাসিয়াকে কাফেতে দেখা যায়নি।
আজ সন্ধ্যায় আসবে?
কী করে বলি। সে কি তার সব গোপন কথা আমাকে জানায়। আপনিই তো ভাল জানেন কখন আসবে বা আসবে না।
না, তা নয়। আমি আমার এই বন্ধুর সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
বামন ওদের পাশে বসে ভেজা হাত দুটো পরনের অ্যাপ্রনে মুছল।
এই ভদ্রলোকও আপনার মত ব্যবসা করে?
হ্যাঁ। সংক্ষেপে জবাব দিল কার্ড।
দেখা যাক। সন্ধ্যার দিকে একবার আসুন। ছেলেটাকে দিয়ে। ওকে না হয় খবর পাঠাব।
কাফে থেকে বেরিয়ে র্যাঁবেয়া কটার্ড-এর কাছে জানতে চাইল, লোকটা কিসের ব্যবসার কথা বলছিল?
চোরাচালানের কথা। ফটকের পাহারাদারকে ফাঁকি দিয়ে কিছু জিনিস ওরা শহরের ভেতর পাচার করে। এতে প্রচুর টাকা।
বুঝলাম। তাহলে কোর্ট-কাছারিতে নিশ্চয় ওদের অনেক জানাশোনা লোক আছে।
ঠিক ধরেছেন।
সন্ধ্যার দিকে কাফেতে ফিরে ওরা দেখল সামিয়ানা গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। খাঁচার ভেতর চেঁচাচ্ছে তোতা পাখিটা। লোকজনের ভিড় জমে উঠেছে টেবিলগুলোর চারপাশে। কিন্তু কারও গায়েই শার্ট ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ছে না। কটার্ডকে দেখেই একজন উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। ওর শার্টের বোতাম সব ভোলা। বুকের প্রায়। সবটাই দেখা যাচ্ছে, লাল ইটের মত রঙ। মার্থায় শোলার টুপি। রোদে পোড়া মুখটা তামাটে রঙের। চোখ দুটো ছোট, রঙ কালো। দাঁতগুলো সাদা ঝকমকে। আঙুলে তিনটি আংটি। নাকটা বেশ মোটা। মুখটা ভরাট। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। এরই নাম গ্রাসিয়া।
বাহ, র্যাঁবেয়ার উপস্থিতি উপেক্ষা করে কটার্ডকে বলল গ্রাসিয়া, চলুন, দুএক গ্লাস টানা যাক।
ওরা নীরবে বসে মদ্যপান করল। চলুন, একটু বাইরে হাঁটি, প্রস্তাব করল গ্রাসিয়া।
তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে বন্দরের দিকে এগোল। গ্রাসিয়া জানতে চাইল, কাজটা কী ধরনের? কটার্ড বলল, র্যাঁবেয়া শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে চায়। সিগারেট টানতে টানতে আগে আগে হাঁটছে গ্রাসিয়া। র্যাঁবেয়া সম্পর্কে ও কিছু প্রশ্ন করল।
কেন, পালাতে চান কেন?
ওর স্ত্রী ফ্রান্সে থাকে।
কী করেন ভদ্রলোক?
সাংবাদিকর্তা।
এখনও? সাংবাদিকরা কিছু গোপন রাখতে পারে না।
আগেই বলেছি, উনি আমার বন্ধু।
হাঁটতে হাঁটতে জেটির কাছাকাছি এসে পড়ল ওরা। চারপাশে বেড়া, ঢোকার পথ বন্ধ। মোড় নিয়ে এবার ওরা এগিয়ে গেল একটা তাড়িখানার দিকে। মাছ ভাজার গন্ধ ভেসে আসছে ওখান থেকে।
যা হোক, বলল গ্রাসিয়া, এ-ব্যাপারে সরাসরি আমি সাহায্য করতে পারব না। রাউল এজন্যে উপযুক্ত লোক। কথা বলে দেখব। কাজটা কিন্তু সোজা নয়।
বেশ, আগ্রহ দেখাল কার্ড।
গ্রাসিয়া আর কিছু বলল না। তাড়িখানায় ঢোকার আগে থামল ও। এবং এই পথম সরাসরি সমোধন করল র্যাঁবেয়াকে।
পরশু বেলা এগারোটায় শহরের উপকণ্ঠে, কাস্টমস ব্যারাকের সামনে দেখা হবে, এই বলে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল গ্রাসিয়া, কিন্তু পরক্ষণে হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে এ-ভাবে বলল, মনে রাখবেন, কিছু মালকড়ি খরচ করতে হবে।
জানি, সম্মতি জানাল র্যাঁবেয়া।
দুদিন পর। শহর থেকে যে বড় রাস্তাটা বাইরে চলে গেছে সেই রাস্তায় দেখা গেল কার্ড আর র্যাঁবেয়াকে। পথের দুপাশে কোন গাছপালা নেই। কাস্টমস ব্যারাকের একটা অংশকে রূপান্তরিত করা হয়েছে হাসপাতালে। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু লোক, হয়তো রোগী দেখার অনুমতির জন্যে অপেক্ষা করছে।
আমি ঠিক বুঝছি না, আপনি বাইরে যেতে চাইছেন কেন? এখানে তো বেশ কৌতূহল জাগানোর মত ব্যাপার ঘটছে, বলল কটার্ড।
না, এ-সব ব্যাপারে আমার কোন কৌতূহল নেই, জানাল র্যাঁবেয়া।
অবশ্য থাকলে বিপদের ঝুঁকি আছে।
ঠিক তখুনি রিও-র গাড়ি এসে থামল ওদের পাশে। গাড়ি চালাচ্ছে তারিউ, ঘুম-ঘুম চোখে বসে আছে রিও। র্যাঁবেয়াকে শহরে পৌঁছে দিতে চাইল তারিউ।
ধন্যবাদ। এখানে একজনের সঙ্গে দেখা করব, বলল র্যাঁবেয়া।।
ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিও। সত্যিই, দেখা করব একজনের সঙ্গে, নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করল র্যাঁবেয়া।
ডাক্তার সাহেবও ব্যাপারটা জানেন নাকি? কটার্ড বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল।
আস্তে। ওই যে মাজিস্ট্রেট দাঁড়িয়ে আছে, কটার্ডকে বলল তারিউ।
নিমেষে বদলে গেল কটার্ড-এর চাহনি। দ্রুত পায়ে হেঁটে এলেন এম অথন। কাছে এসে টুপি নামালেন মাথা থেকে। সুপ্রভাত। জানাল তারিউ। ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমে অভিবাদন জানালেন গাড়ির ভেতরের দুজনকে, তারপর রাস্তায় দাঁড়ানো দুজনের দিকে ফিরে সামান্য একটু মাথা নোয়ালেন। এম অথন-এর সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল তারিউ। আকাশের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অথন। তারপর মন্তব্য করলেন, সত্যি, বড় দুঃসময় যাচ্ছে। মঁসিয়ে তারিউ, আপনার কাজ সত্যিই এক মহৎ দৃষ্টান্ত। আচ্ছা, ডাক্তার, মহামারী কি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে?