দুপুরে ভরে যায় সমস্ত রেস্তোরাঁ। যারা বসবার জায়গা পায় না। তারা দাঁড়িয়ে থাকে দরজার সামনে, বাইরের সামিয়ানার তলায়। রেস্তোরাঁয় নোটিস ঝোলানো আছে এখানে প্লেট বাদে, অন্য সব জিনিস, কাঁটাচামচ এগুলো জীবাণুমুক্ত করার জন্যে নিয়মিত ধুইয়ে নেয়া হয়। তাই খাবার সময় দেখা যায় প্রত্যেকে নিজের প্লেট ঠিকমত দেখে শুনে মুছে নিচ্ছে।
সন্ধ্যায়, স্রোতের মত বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকে মানুষ। আর বকবক করতে থাকে। কেউ মেতে ওঠে যুক্তিতর্কে, কেউ তন্ময় হয়ে ডুবে যায় প্রেম বিনিময়ে। শহরের অধিবাসীরা উপলব্ধি করেছে এক কঠিন বিপদ তাদের সামনে অপেক্ষা করছে; তাই ওরা সন্ধ্যায় নিজেদের ডুবিয়ে দিতে চায় সম্পূর্ণ আনন্দ-ফুর্তির মধ্যে, বিকারগ্রস্ত উল্লাসে।
.
২.০৭
আঁ তারিউ-এর ডাইরিতে ডাক্তার রিও-র সঙ্গে ওর একটা সাক্ষাৎকারের উল্লেখ আছে। সাক্ষাৎকারটি নেয়ার জন্যে রিও-র বাসায় যায় সে। তারিউ পৌঁছবার ঠিক আগে রিও ওর মা-র মুখের দিকে তাকাল। খাবার ঘরের এক কোণে বসে আছেন ওর মা। চোখ দুটো পড়ে আছে বাইরে শূন্য রাস্তার ওপর। মহামারীর পর থেকে রাস্তার আলো তিনভাগের দুইভাগ কমানো হয়েছে।
প্লেগ না থামা পর্যন্ত রাস্তায় আলো এমনই থাকবে, না? জিজ্ঞেস করলেন মাদাম রিও।
হ্যাঁ, মা।
রিও দেখল ওর মা-র দৃষ্টি এসে পড়েছে ওর কপালের ওপর।
নিশ্চয় গত কয়েকদিনের অতিরিক্ত খাটুনি আর উৎকণ্ঠার ফলে ওর কপালে ক্লান্তির ছাপ দেখা দিয়েছে।
আজকের দিনটা কেমন গেল? জানতে চাইলেন মা।
আগের মতই।
ঠিকই বলেছে রিও। প্যারিস থেকে আনা নতুন সিরামগুলো আগের সিরামের মত কাজ দিচ্ছে না, ফলে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। রোগীর দেহের কেঁড়াগুলো সহজে ফাটতে চাইছে না। সুপারির মত শক্ত হয়ে উঠছে। এদিকে মহামারী নতুন রূপ নিচ্ছে। প্লেগ থেকে দেখা দিচ্ছে নিউমোনিয়া। ডাক্তারদের পরামর্শে প্রিফেক্ট কিছু নতুন আইন-কানুন প্রবর্তন করেছেন, কিন্তু অবস্থার তাতে কোন পরিবর্তন। হয়নি।
ছোটবেলায় মায়ের বাদামী কোমল চোখের দিকে তাকালে রিও একধরনের ভালবাসা অনুভব করত, আজও মায়ের দিকে চেয়ে ওর স্মৃতির সেই অনুভূতিটি জেগে উঠল।
মা, তুমি ভয় পাও না?
এই বয়সে আর ভয় পাবার কি আছে রে!
আমি ঠিকমত প্রায়ই বাসায় ফিরতে পারি না।
তুই ফিরে আসবি, এটা ভাবলে আমার অপেক্ষা করতে খারাপ লাগে না। আর কোন খবর আছে?
তোমার বউমা ওর শেষ টেলিগ্রামে লিখেছে সবকিছু ঠিকমত চলছে। জানো মা, আমি যাতে উদ্বিগ্ন হয়ে না পড়ি, সেজন্যেই ও অমন লেখে।
দরজায় বেল বেজে উঠল। দরজা খোলার জন্যে এগিয়ে গেল। রিও। তারিউকে একটা ধূসর রঙা প্রকাণ্ড ভালুকের মত দেখাচ্ছে। ওকে বসার জন্যে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল রিও।
তারিউ সরাসরি ওর বক্তব্য শুরু করল। বড়জোর পনেরো দিন কি একমাস, তারপর সবকিছু আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
আমারও তাই মনে হয়।
শুনছি বাধ্যতামূলকভাবে সবল দেহের সব মানুষকেই নাকি মহামারী প্রতিরোধের কাজে সাহায্য করতে হবে?
কর্তৃপক্ষ তাই ভাবছেন, কিন্তু লোকে ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখবে না।
তাহলে স্বেচ্ছাসেবকের আহ্বান জানাতে পারেন।
হয়েছে, কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি।
সেটা তো সরকারিভাবে করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের ও দায়িত্ব দেয়া উচিত।
কী করতে বলেন আপনি এই অবস্থায়?
যারা স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে চায়, এমন কিছুসংখ্যক মানুষকে নিয়ে কয়েকটা দল গড়ে তোলার একটা প্ল্যান তৈরি করেছি আমি। প্ল্যানটাকে যাতে কার্যকর করা যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে আপনাকে।
নিশ্চয়ই। কর্তৃপক্ষকে দিয়ে আপনার প্ল্যান অনুমোদন করিয়ে নেয়ার সমস্ত দায়িত্ব আমার। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চয় আপনার অজানা নেই, এই কাজে যারা সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে চায়, তাদের নিজেদের জীবন বিপন্ন হবারও কিছুটা আশঙ্কা রয়েছে তাতে। আপনি এই বিপদের সম্ভাবনা ভালভাবে চিন্তা করে দেখেছেন তো?
এই মুহূর্তে আমি শুধু এইটুকু জানিঃ শহরে বহুলোক অসুস্থ, তাদের চিকিৎসা এবং সেবার প্রয়োজন। আমি তাদের রক্ষা করার জন্যে সাধ্যমত চেষ্টা করছি। আমার জন্য এটুকুই কি যথেষ্ট নয়?
তারিউ কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টে চেয়ে রইল রিও-র মুখের দিকে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। রিও অনুসরণ করল ওকে।
রাস্তায় নেমে ওদের মনে হলো, অনেক রাত হয়েছে, এগারোটা বাজে বোধহয়। একটা অস্পষ্ট খসখসে শব্দ ছাড়া শহরের চারদিক শান্ত। দূরে, শোনা যাচ্ছে একটা অ্যাম্বুলেন্সের ঘণ্টার ক্ষীণ শব্দ। দুজনে গাড়িতে ঢুকল, এঞ্জিন স্টার্ট দিল রিও।
কাল একবার হাসপাতালে আসবেন। এই দুঃসাহসিক কাজে নামার আগে একটা ইনজেকশন দেব আপনাকে। মনে রাখবেন, আপনার মৃত্যুর আশঙ্কা তিন আর বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র এক।
প্রায় একশো বছর আগে প্লেগের আক্রমণে পারস্যের এক শহরে সমস্ত লোক নির্মূল হয়ে যায়, বেঁচেছিল শুধু একজন। ওই মানুষটির কাজ ছিল প্লেগে যারা মারা যেত তাদের গোসল এবং দাফন করা।
.
২.০৮
পরের দিন থেকেই কাজ শুরু করে দিল তারিউ। কিছু সংখ্যক লোককে নিয়ে গড়ে তুলল একটা স্যানিটারি দল। পরে, ওর পরিচালনায় আরও এই ধরনের অনেক দল গড়ে উঠল। এই স্কোয়াডগুলো শহরবাসীদের দুর্যোগ মোকাবিলায় সাহায্য করল, সেই সঙ্গে তাদের মনে এই উপলব্ধিও জাগাল, প্লেগকে পরাজিত করার জন্যে যা কিছু করা দরকার তার সবটাই নির্ভর করছে তাদের ওপর।