হোটেলের ম্যানেজারকেও হতাশাগ্রস্ত, বিষণ্ণ দেখায়। মহামারীর প্রথম দিকে যারা বাইরে থেকে এসে হোটেলে উঠেছিল, শহর ছেড়ে যাবার কোন উপায় নেই দেখে তাদের অনেকেই হোটেলে থেকে গিয়েছিল। কিন্তু ওরা যখন দেখছে প্লেগ কমার! কোন লক্ষণই নেই, তখন সবাই, একে একে, বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের বাসায় উঠে যাচ্ছে। যে দুএকজন হোটেলে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছে আমি তাদের একজন। আমার সঙ্গে দেখা হলেই ম্যানেজার বলেন, অতিথি ভদ্রলোকদের কাউকে তিনি অসুবিধায় ফেলতে চান না, নাহলে অনেক আগেই হোটেল বন্ধ করে দিতেন। তিনি প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, মহামারী কতদিন ধরে চলবে বলে আমার ধারণা? আমি বলি, লোকে বলে শীতে এসব রোগ আপনা থেকেই বিদায় নেয়। শুনে উনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। বলেন, কিন্তু আমাদের এখানে তো তেমন শীত পড়ে না।
কদিন অনুপস্থিতির পর হোটেলে আবার দেখা গেল প্যাঁচামুখো ভদ্রলোককে। সঙ্গে দম-দেয়া পুতুলের মত নড়াচড়া করছে ছেলেমেয়ে দুটি। কিন্তু ওর স্ত্রী আসেননি। শুনতে পেলাম তার মা প্লেগে আক্রান্ত, তাই তাঁর সেবাশুশ্রূষা নিয়ে তিনি ব্যস্ত। ম্যানেজার এই পরিবারটির হোটেলে আসাটাকে ভাল চোখে দেখেন না। বলেন, এই পরিবারের সবাইকে তিনি সন্দেহ করেন। কিন্তু মি. অথন তার এতদিনের অভ্যাস প্লেগের ভয়ে পরিত্যাগ করেননি। আগের মতই নিজের স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে বসেন খাবার টেবিলে। ছেলেমেয়ে দুটো বসে সামনে। উদাসীন কণ্ঠে তিনি ওদের আচার-আচরণ নিয়ে কথা বলেন, উপদেশ দেন। দারোয়ানও মি. অথনকে পছন্দ করে না। আমাকে ও প্রায়ই বলে, এই যে ফিটফাট ভদ্রলোকটাকে দেখছেন, মরবার সময়ও উনি অমনি সাজগোছ নিয়েই মরবেন, ভাবখানা এমন যেন জামাজুতো পরে তৈরি হয়েই আছেন, এখন শুধু ডাক এলেই হয়, আবার যে কেউ ওকে অন্য কাপড় পরাবে সে সুযোগ উনি দেবেন না।
একদিন ডাক্তার রিও-র সঙ্গে বেড়াতে গেলাম ওর হাঁপানি রোগীর বাসায়। আমাকে অভ্যর্থনা জানাবার সময় হাত দুটো কচলাতে শুরু করলেন ভদ্রলোক, এটাই তাঁর চিরদিনের অভ্যেস। বৃদ্ধ তখন তার বিছানায় শুয়ে ছিলেন, বরাবর যেমন থাকে তেমনি তাঁর সামনে রাখা ছিল দুটো মটরদানা ভর্তি পাত্র। আমাকে দেখে মৃন্তব্য করলেন, এই যে আরও একজন এসেছেন, পৃথিবীতে সবকিছুই উল্টে-পাল্টে গেছে দেখছি, এখন দেখছি রোগীর চেয়ে ডাক্তারের সংখ্যাই বেশি।
ওই বৃদ্ধ একজন ব্যবসায়ী। পঞ্চাশে পা দিয়ে তিনি অনুভব করলেন একজন মানুষের জীবনে যতটুকু পরিশ্রম করা প্রয়োজন ইতিমধ্যে তিনি তার সবটুকু সেরে ফেলেছেন। তারপর থেকে বিছানা নিয়েছেন তিনি।
সামান্য একটা বাঁধা আয় তাঁর আছে, আর সেটাই সম্বল করে তিনি তার এতদিনের খরচপত্র চালিয়ে এসেছেন। এখন তাঁর বয়েস পঁচাত্তর। ঘড়ি একদম সহ্য করতে পারেন না। তাঁর মতে, ঘড়ি মূর্খদের প্রয়োজন, অথচ দামও অনেক। তিনি সময় হিসেব করেন। দুটো পাত্রে রাখা মটরদানার সাহায্যে। সকালে তাঁর সামনে দুটো পাত্র রাখা হয়; একটা মটরদানায় ভর্তি, অন্যটা খালি। ঘুম থেকে উঠেই তিনি ভর্তি পাত্রটা থেকে মটরদানা তুলে খালি পাটাতে রাখতে শুরু করেন। এইভাবে দুটো পাত্র আর মটরদানার সাহায্যে সময় নির্ণয় করেন তিনি। পরপর পনেরোবার ভরা শেষ হলে দুপুরের খাবার সময় হয় তার। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, স্রষ্টা বলে কেউ নেই বোধহয়, থাকলে পাদ্রিদের থাকার প্রয়োজন হত না।
শুধু ডাইরিই নয়, প্লেগ-আক্রান্ত জীবনযাত্রার এক দীর্ঘ রচনায় হাত দিয়েছিল জঁ তারিউ। ভূমিকায় লেখা আছে: মাতাল ছাড়া। এখন আর এই শহরে কাউকে হাসতে দেখা যায় না; আর হাসতে আরম্ভ করলে তাদের কোন মাত্ৰাজ্ঞান থাকে না।
একদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে ও লিখেছে: সকাল থেকে রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ নির্জন। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। সারারাত ধরে। প্লেগ তার শিকারের পালা শেষ করে নতুন করে শিকার ধরার আগে এই ফাঁকটুকুতে একটু বিশ্রাম নেয়। চারপাশের দোকানগুলোতে নোটিস ঝুলছে প্লেগের জন্যে বন্ধ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে শুয়ে আছে ভিক্ষুকের দল। ঘুমের ভেতর মানুষ যেমন হাঁটে, তেমনিভাবে খবরকাগজ হাতে এগিয়ে যাচ্ছে হকাররা। একটু পরে শুরু হলো ট্রাম চলাচল, অমনি সারা শহরে ঘুম থেকে জেগে উঠল প্লেগ। সংবাদপত্রের বড় বড় স্পষ্ট হরফে লেখা প্লেগের শিরোনামে সবাই পড়ল, আজ মৃতের সংখ্যা ১২৪।
এখন শহরে চলাচলের একমাত্র বাহন ট্রাম। ফুটবোর্ডের ওপর যেমন লোক দাঁড়িয়ে থাকে তেমনি ঝোলে হাতল ধরে। ট্রামগুলোর চলতে খুব কষ্ট হয়। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ট্রামের ভেতর প্যাসেঞ্জারেরা পরস্পরের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। উদ্দেশ্য, সংক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচানো। ট্রাম থেকে রাস্তায় নামার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকেই চেষ্টা করে এমন একটা জায়গায় দাঁড়াতে যেখানে তার সঙ্গে নিকটতম ব্যক্তিটির নিরাপদ একটি দূরত্ব বজায় থাকে।
প্রথম ট্রামগুলো চলে যাবার পর আস্তে আস্তে জেগে ওঠে শহর। সকালে যে দোকানগুলোতে ভিড় হয় খুলে যায় সেগুলোর দরজা। কাউন্টারে দেখা যায় অসংখ্য রকমের কার্ড! কোনটায় লেখা-কফির ব্যবস্থা নেই, কোটায়-চিনি সঙ্গে আনবেন।