বিশ্বাস এতটুকু টলল না মিশেল-এর। ঘরের ভেতর কোথাও তো আমি ইঁদুর দেখিনি। তাহলে বাইরে থেকে কেউ নিয়ে এসেছে। হবে কোন বখাটে ছোকরার কাজ।
সেদিনই সন্ধ্যার পর, নিজের ফ্ল্যাটে ওঠার পথে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চাবি হাতড়াচ্ছে রিও, এমন সময় দেখল প্রকাণ্ড একটা ইঁদুর তেড়ে আসছে ওর দিকে। টলমল করছিল ইঁদুরটা। শীরর সম্পূর্ণ ভেজা। মাঝপথে থামল ওটা। সামলে নিল নিজেকে। এগিয়ে এল কয়েক পা। আবার থামল। তারপর কিচকিচ করতে করতে পড়ে গেল, মেঝের ওপর। ফাঁক হয়ে গেল ইঁদুরটার মুখ, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল।
দ্রুত ওপরে উঠে এল রিও। ইঁদুরের রক্ত দেখে স্ত্রীর কথা মনে পড়ে গেল। এক বছর ধরে অসুস্থ ওর স্ত্রী। কাল, এক পাহাড়ী স্বাস্থ্যনিবাসে যাবে। ঘরে ঢুকে রিও দেখল স্ত্রী শুয়ে।
ওকে দেখে হাসি ফুটল মহিলার। জানো, আজ বেশ ভাল। লাগছে।
একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো। কাল সকাল এগারোটায় নার্স আসবে। তোমরা দুপুরের ট্রেনে যাচ্ছ, রিওর কথাগুলো উপদেশের মত শোনাল। স্ত্রীর ভেজা কাঁপালে ঠোঁট বুলাল ও। তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।
পরের দিন। এপ্রিল ১৭। সুকাল আটটা। কাজে যাচ্ছিল রিও। দারোয়ান মিশেল ওর কোটে ফুল গুঁজে দিয়ে জানাল, দুষ্টু ছোকরারা আরও তিনটা ইঁদুর ফেলে রেখে গেছে। তবে যাবে কোথায়, পাকড়াও করবই বাছাধনদের।
কথাটা শুনে একটু হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল রিও। গাড়িতে উঠে শহরতলির দিকে চলল সে। এদিকের রাস্তাগুলো নোংরা। তীক্ষ্ণ। দৃষ্টিতে ডাস্টবিনগুলো দেখতে লাগল সে। এক রাস্তাতেই, কয়েকটা ডাস্টবিনে, ডজন খানেক মরা ইঁদুর চোখে পড়ল ওর।
প্রথমে হাঁপানি রোগীর বাসায় গেল ও। ভদ্রলোক বৃদ্ধ, জাতিতে স্প্যানিশ। বিছানায় বসেছিল বৃদ্ধ। ঘাড়টা পেছন দিকে ফেরানো। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। ঘন ঘন হাঁচি দিচ্ছে। সামনে দুটো পাত্রে শুকনো মটরদানা। রিও ঘরে ঢোকার পর বৃদ্ধের স্ত্রীও ঢুকল। হাতে পানির গ্লাস।
ইনজেকশন দেয়া হতেই, হাঁপানির রোগী, ভদ্রলোক বলল, শুনেছেন, বেরিয়ে আসছে ওগুলো। আপনি দেখেছেন?
রিওকে ভদ্রলোকের স্ত্রী বুঝিয়ে বলল, ইঁদুরের কথা বলছে। আমাদের পাশের বাড়ির ভদ্রলোক তার দরজার সামনে তিনটাকে দেখেছে। মরা।
আচ্ছা। মনে হয় খিদের জ্বালায় বেরিয়ে আসছে, জবাব দিল রিও।
রোগীদের বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে রিও বুঝতে পারল, ইঁদুর মরা নিয়ে এই এলাকায় রীতিমত জল্পনা-কল্পনা আরম্ভ হয়েছে। তাড়াতাড়ি ফিরে এল সে।
নিচে দেখা হলো মিশেল-এর সঙ্গে। ও বলল, আপনার একটা টেলিগ্রাম এসেছে। ঘরে রেখে এসেছি।
রিও জানতে চাইল, আরও মরা ইঁদুর দেখেছ?
না, জানাল মিশেল।
টেলিগ্রাম এসেছে মা-র কাছ থেকে। জানিয়েছেন পরের দিন আসছেন। রি-ওর স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তিনিই ওর দেখাশোনা করবেন।
নার্স এসে গেছে। স্ত্রীর পরনে নতুন পোশাক। কিছু প্রসাধনও মেখেছে ও। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে, বলল রিও।
.
কয়েক মিনিট পর। ট্রেনের কামরায় স্ত্রীকে তুলে দিল রিও। ওর স্ত্রী বলল, ইঁদুর মরা নিয়ে কি হয়েছে বলো তো?
এখনও ঠিক বুঝছি না। তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে এসো। দেখবে নতুন জীবন শুরু হয়েছে।
হিসহিস করে উঠল ট্রেনের এঞ্জিন। স্ত্রীকে নাম ধরে ডাকল রিও। মুখ ফেরাল মহিলা। তখন অশ্রু ঝরছে ওর চোখ দিয়ে। এ কী, কাঁদছ তুমি? ভেবো না, লক্ষ্মীটি। দেখবে আবার সুস্থ হয়ে উঠেছ। গাড়ি ছাড়ার সময় হলো। চলি। স্ত্রীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল ও, তারপর পিছিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়ল আবার। এখন কেবল জানালায় ওর হাসিমুখ দেখতে পাচ্ছিল রিও।
শরীরের যত্ন নিও, স্ত্রীকে বলল সে। কিন্তু ওর কথা মহিলা শুনতে পেল না।
ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে যাবার পর খুব দ্রুত প্ল্যাটফরম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল রিও, গেটে দেখা হয়ে গেল পুলিস ম্যাজিস্ট্রেট মশিয়ে অথন-এর সঙ্গে।
শুনছি, আজকাল ইঁদুর…, বলতে বলতে থেমে গেলেন অথন।
কী যেন বলছিলেন আপনি? প্রশ্ন করল রিও।
না। তেমন কিছু নয়।
সেই মুহূর্তে রিও দেখল, রেলের এক কর্মচারী কাঠের একটা বাক্স নিয়ে যাচ্ছে। মরা ইঁদুর ভর্তি।
সেদিনই বিকেলে, রিও সবে রোগী দেখতে শুরু করেছে, ওর সঙ্গে দেখা করতে এল অপরিচিত এক যুবক। একজন পেশাদার সাংবাদিক। নাম র্যাঁবেয়া। মোটা। বেঁটে। পেশীবহুল চওড়া কাঁধ। মুখে দৃঢ়তার ছাপ। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পরনে খেলোয়াড়দের মত হালকা ফিটফাট পোশাক। প্যারিসের এক দৈনিক কাগজের প্রতিনিধি। হিসেবে এসেছে। উদ্দেশ্য, এখানে বসবাসকারী সাধারণ আরবদের জীবনযাত্রা স্বচোখে দেখা।
রিও বলল, ওদের জীবনযাত্রার মান তেমন উন্নত নয়। এরপর জানতে চাইল, আচ্ছা, সত্যি কথা প্রকাশের স্বাধীনতা আপনার আছে?
খুব বেশি না, স্বীকার করল র্যাঁবেয়া।
তাহলে আর কিছু লেখার কোন দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। তাই আপনার রিপোর্টের জন্যে তথ্য দিতে আমার আপত্তি আছে।
হাসল র্যাঁবেয়া। আপনি তো দেখছি একজন পয়গম্বর।
আমি প্রতিজ্ঞা করছি, কখনোই অন্যায়ের সংস্পর্শে যাব না বা কোন অবস্থাতেই সত্যের অপলাপ করব না।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল র্যাঁবেয়া। ধন্যবাদ। আপনার মনোভাব বুঝতে পেরেছি।
রিও দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল ওকে। আপনি বুঝতে পেরেছেন, সেজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। শহরে খুব বেশি সংখ্যায় ইঁদুর মারা যাচ্ছে। এটার ওপর লিখতে পারেন। নতুনত্ব আছে।