.
২.০৬
ফাদার প্যানালু বক্তৃতা দেয়ার পরদিন থেকেই শহরে আরম্ভ হলো। উৎকট গরম। সূর্য যেন উঠে এল বাড়িঘরের মাথার ওপর, আর সেখান থেকে ছাড়াতে লাগল আগুনের হল্কা। একদিন সারাক্ষণ বইল লু হাওয়া। শুকিয়ে ঠনঠনে হয়ে উঠল শহরের সব দেয়াল। একমাত্র বাড়ির ভেতরে ছাড়া, শহরের বাসিন্দাদের প্রতিটি অলিগলি, এমনকি প্রতিটি নির্জন স্থানেও অনুসরণ করতে লাগল সূর্য। যেখানে পেল সেখানেই আঘাত হানল ওদের ওপর।
প্লেগের আক্রমণও বেড়ে গেল আশ্চর্যজনকভাবে। প্রথম সপ্তাহে। মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল সাতশোর কাছাকাছি। শহরে নেমে এল গভীর অবসাদ। শহরতলির দীর্ঘ রাস্তা আর সিঁড়ি থেকে হারিয়ে গেল প্রাণের চিহ্ন। প্রতিটি বাড়ির দরজাই সব সময় বন্ধ অবস্থায় দেখা যায় এখন, জানালাগুলো খোলা থাকলেও সেগুলোতে, ঝোলে পর্দা। মাঝে মাঝে কোন কোন বাড়ি থেকে ভেসে আসে আকস্মিক কান্নার শব্দ, আর্তনাদ। প্রথম প্রথম বাড়ির বাইরে রীতিমত ভিড় জমে উঠত লোকজনের। সবাই জানার চেষ্টা করত কী ঘটেছে? কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই বিপর্যয়ের মাঝে বাস করতে করতে সবার মন কঠিন হয়ে উঠল। এখন কেউই আর ওই ধরনের দৃশ্যে কিংবা শব্দে বিচলিত বোধ করে না, খুব সহজে পাশ কাটিয়ে যায়। করুণ আর্তনাদকে ওদের মনে হয় মামুলি কোন কথাবার্তা।
শহরের ফটকের সামনে প্রতিদিন মারামারি হয়। তা ঠেকানোর জন্যে পুলিসকে অনেক সময় আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়। এই সংঘর্ষের ফলে নিয়মিত কেউ না কেউ আহত হচ্ছেই। শুধু ফটকের সামনেই নয় শহরের সবখানে বিরাজ করছে একটা থমথমে উত্তেজনা।
তাই, পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যে বন্দোবস্ত করা হলো। এক নতুন ধরনের পাহারার। রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে আরম্ভ করল অশ্বারোহী পুলিস; নুড়িবিছানো শূন্য রাস্তায় শোনা যেতে লাগল ঘোড়ার খুরের শব্দ। আর মাঝে মাঝে শোনা যায় গোলাগুলির আওয়াজ। রোগের সংক্রমণ যাতে ছড়াতে না পারে সেজন্যে শহরের সমস্ত কুকুর আর বেড়াল মারার একটা ব্রিগেড তৈরি করা হয়েছে; গোলাগুলির আওয়াজ ওই ব্রিগেডের কর্মতৎপরতার ফল।
আরও একটি কারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল শহরবাসীরা। সবাই। আশঙ্কা করছে গ্রীষ্মকালে মহামারীর প্রকোপ আরও বেড়ে যাবে। আর গ্রীষ্ম যে এসে গেছে চারদিকে তার ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে সুস্পষ্টভাবে। ছাদের ওপর ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে চামচিকের সংখ্যা, সেই সঙ্গে চিঁ-চিঁ চিৎকার।
জাঁ তারিউ তখনও লিখে যাচ্ছে ওর ডাইরি। প্লেগের দুরবস্থার কথা বর্ণনা করতে করতে এক জায়গায় ও মন্তব্য করল: যেদিন থেকে বেতারে মূতের সাপ্তাহিক সংখ্যা ঘোষণার বদলে রোজকার সংখ্যা ঘোষণা শুরু হলো, সেদিন থেকে মহামারীর এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়েছে; মনে হচ্ছে সংবাদপত্র এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ প্লেগের সঙ্গে এক ফুটবল প্রতিযোগিতা খেলতে নেমেছেন; কেননা শুধু মাত্র সংখ্যা দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, দিনে। একশো ত্রিশটি মৃতের সংখ্যা সাপ্তাহিক নশো দশটি মৃত্যুর চেয়ে অনেক কম; সুতরাং তারা ভেবে আনন্দ পাচ্ছেন, এ প্রতিযোগিতায় তারাই জিতেছেন।
এছাড়াও, মহামারীজনিত যেসব অপ্রত্যাশিত বা চমকপ্রদ ঘটনা। পথচলতি চোখে পড়ছিল তারিউ-এর সেগুলোরও উল্লেখ আছে ওর ডাইরিতে। যেমন একদিন, এক জনশূন্য রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে ও, এমন সময় ঠিক ওর মাথার ওপর তিনতলার এক অন্ধকার, শোবার ঘরের জানালা আকস্মিকভাবে খুলে গেল এবং তার ভেতর থেকে একজন মহিলা বার দুই চিৎকার করার পর জানালাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল তেমনিভাবে।
তারিউ ওর ডাইরির আর এক জায়গায় লিখেছে: হঠাৎ শহরের সমস্ত দোকান থেকে পিপারমেন্ট লজেন্স উধাও হয়ে গেল, কারণ মানুষ বিশ্বাস করে এই লজেন্স মুখে রাখলে প্লেগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
আগের মতই সামনের বারান্দায় ওর সেই প্রিয় প্রাণীটির গতিবিধি লক্ষ্য করে যাচ্ছে ও। তারিউ-এর মনে হলো, দুর্ভাগ্য এই অবলা-পশু শিকারীকেও স্পর্শ করেছে। একদিন সকালে রাস্তায় বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল; গুলির আঘাতে বেশির ভাগ বেড়ালই মারা পড়ল, বাকিগুলো উধাও হয়ে গেল প্রাণের ভয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন ছোটখাট শরীরের বুড়ো মানুষটা। তার মুখে দেখা গেল বিস্ময়ের ভাব, শেষে রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে পড়ে এদিকে-ওদিকে তিনি খুঁজতে লাগলেন বেড়ালগুলোকে। এইভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হাতে যে কয়েক টুকরো কাগজ ছিল সেগুলোকে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ভদ্রলোক ফিরে গেলেন ঘরে। তারপর আবার ফিরে এলেন। বারান্দায়, এবার আগের চেয়ে বেশি সময় অপেক্ষা করে ফের চলে গেলেন ঘরে ঢুকেই বন্ধ করে দিলেন সমস্ত জানালা। এক সপ্তাহ ধরে এই কাণ্ডই করলেন বৃদ্ধ। যতই দিন যেতে লাগল তাঁর চেহারায় ফুটে উঠল কেমন একটা বিষাদ আর হতবুদ্ধির ভাব। আট দিনের দিন তাকে আর দেখা গেল না, শহরের আর সকলের মত তিনিও বন্ধ করে রাখলেন জানালা।
জাঁ তারিউ তার ডাইরিতে লিখেছে: রোজ সন্ধ্যায় বাইরে থেকে হোটেলে ফেরার পর চোখে পড়ে হোটেলের দারোয়ান বন্দুক হাতে প্রহরীর মত গেটের এমাথা-ওমাথা পায়চারি করছে। কারও সঙ্গে, কথা হলেই লোকটা বলে, এসব যে ঘটবে তা সে আগেই জানত। আমি ওকে মনে করিয়ে দিলাম, সে ভূমিকম্প সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ও বলে উঠল, এর চেয়ে ভূমিকম্প হলেই ভাল, হত, একবারেই সবকিছু ওলট-পালট করে দিত।