এখনও আপন মনে বসে যাচ্ছে গ্লাদ। কিন্তু কোন কথাই কানে ঢুকছে না রিও-র।
শুধুমাত্র একটা উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাওয়ার জন্যে গোটা একটা সন্ধ্যা, কখনও কখনও গোটা সপ্তাহই কেটে যায়, তাহলেই বুঝুন ব্যাপারটা।
আচ্ছা, এতক্ষণে বুঝলাম আপনার কথা, বলল রিও।
বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গঁদ বলল, অনুগ্রহ করে আমার বাসায় যদি আসেন, খুব খুশি হতাম।
খাবার ঘরে ঢুকল ওরা দুজন। টেবিলের পাশে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল গ্রাঁদ। সারা টেবিলের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কাগজ।
বসুন এবার, পড়ে শোনান দেখি কী লিখছেন।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করল গ্রাঁদ। তারপর ঝপ করে বসে পড়ল চেয়ারে।
নিচের রাস্তা থেকে একটা অদ্ভুত ভন ভন শব্দ উঠে আসছে ওপরে। মনে হচ্ছে যেন প্লেগের শোঁ শোঁ শব্দের জবাব ওটা। পড়তে আরম্ভ করল গ্রাঁদ: মে মাসের এক সুন্দর প্রভাতে অনেককেই হয়তো রুচিসম্পন্না এক যুবতী অশ্বারোহিণীকে পাটল রঙের সুন্দর একটি মাদি ঘোড়ায় চড়ে দুপাশে পুষ্পিত বৃক্ষ ঘেরা বল্গনা অ্যাভিন ধরে যেতে দেখে থাকবেন।
থামল গ্ৰাঁদ। নিচের যন্ত্রণাকাতর অসহায় শহর থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট কোলাহল। রিও-র দিকে মুখ তুলল ও।
কেমন হয়েছে?
রীতিমত কৌতূহল জাগছে। শেষে কী হবে সেটা জানার তাগিদ অনুভব করছি।
শুনে, টেবিলের ওপর থাপ্পড় মেরে গ্রাঁদ বলল, আপনি কি বোঝেননি। এটা একটা যেমন-তেমন খসড়া। আমি যে মোহময় বিভ্রম সৃষ্টি করতে চাইছি, সে পর্যায়ে যেতে হলে এখনও অনেক পরিশ্রম করতে হবে।
রিও দেখতে পেল, জানালার নিচে, রাস্তায় লোকজন ছুটোছুটি করছে। দ্রুত সিঁড়ির বেয়ে পথে নেমে এল, ও। হঠাৎ দুজন মানুষ ওর গায়ে ধাক্কা খেয়ে সামনের দিকে ছুটতে লাগল। মনে হলো শহরের কোন না কোন ফটকের দিকে ছুটছে ওরা।
প্রায় প্রতি রাতেই ইদানীং এমন ঘটনা ঘটছে। অনেকেই চেষ্টা করছে ফটকের দারোয়ানের দৃষ্টি এড়িয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে। এখানে-ওখানে হচ্ছে মারামারি, হাতাহাতি। একদিকে নিদারুণ গরম, অন্যদিকে প্লেগের নানা বিপর্যয়-এসব দেখতে দেখতে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়েছে শহরবাসীর।
.
২.০৫
আরও অনেকের মত এ-শহরের আতঙ্ক থেকে পালাবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করছে র্যাঁবেয়া। দিনের পর দিন বিভিন্ন অফিসে ধরনা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ও। অবশ্য এর ফলে, একটা লাভ হয়েছে, ওর; সময়টা কেটে যাচ্ছে, তাই সাময়িকভাবে হলেও সংকটের চিন্তা থেকে মনটাকে সরিয়ে রাখতে পারছে ও।
এর মাঝেই হঠাৎ একদিন আশার ক্ষীণ আলো দেখতে পেল। ও। প্রিফেক্ট-এর অফিস থেকে একটা ছাপানো ফরম এল ওর কাছে। নিজের পরিচয়, আর আয়ের বর্তমান এবং অতীত উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফরমের শূন্য ঘরগুলো পূরণ করে দিতে হবে। কিন্তু অনুসন্ধান করে র্যাঁবেয়া জানতে পারল এর সঙ্গে ওর শহর ছেড়ে যাবার কোন সম্পর্ক নেই। এই ফরমের উদ্দেশ্য। আলাদা। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তার পরিবারকে খবর দেয়া এবং হাসপাতালে তার চিকিৎসার খরচ মিউনিসিপ্যালিটি না তার আত্মীয়স্বজন বহন করবে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে এই ফরম পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
কিছুই করার থাকল না র্যাঁবেয়ার, ফুঁ মেরে বেড়াতে লাগল এক কাফে থেকে আরেক কাফেয়। সকালবেলায় বারান্দায় বসে দৈনিক কাগজের পাতা উল্টায়। মনে মনে আশা করে এমন কোন ইঙ্গিত খুঁজে পাবে যা থেকে মনে হবে আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে সঙ্কট। কখনও কখনও দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে পথচারীদের মুখ দেখে। কিন্তু একটানা বিষণ্ণ চেহারা দেখে দেখে মুখ ফেরাতে বাধ্য হয় সে। এরপর দোকানের সাইনবোর্ড এবং বিজ্ঞপ্তিগুলো পড়া শেষ করে নেমে পড়ে শূন্য রাস্তায়। এভাবে দুপুরের রোদে নির্জন রাস্তায় ঘোরা তার কোন কাপে বা রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুঁ দেয়, এইভাবে সময় কাটিয়ে দেয় সন্ধ্যে পর্যন্ত।
একদিন সন্ধ্যায়, রিও ওকে এক কাফের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে দেখল, যেন ঢুকবে কিনা সে ব্যাপারে মনস্থির করতে পারছে না। অবশেষে ভৈতরে ঢুকে পিছন দিকের একটা টেবিলে বসল ও। তখন ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে সন্ধ্যার। ধূসরতা; দেয়ালের আয়নাগুলোয় কাঁপছে অস্তাচলগামী সূর্যের লালিমা; ঘনায়মান অন্ধকারে ঝকঝক করছে শ্বেতপাথরের টেবিলগুলো। নির্জন ঘরে ছায়ার মত বিষণ্ণ হয়ে বসে রইল র্যাঁবেয়া। দুশ্চিন্তায় মুখখানা করুণ দেখাচ্ছে। রিও ভাবল, এইসব মুহূর্তে নিশ্চয় ভীষণ নিঃসঙ্গ বোধ করে ও।
কখনও কখনও এ-সময়টায় স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা করে র্যাঁবেয়া। বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দেয় ট্রেনের টাইম টেবিল, প্ল্যাটফর্মের ওপর থুতু ফেলা নিষেধ এবং যাত্রীসাধারণের চলাফেরা সম্পর্কে বিভিন্ন নির্দেশ-পড়ে পড়ে। এগুলো পড়া শেষ হলে ওয়েটিং রুমে নির্বিকারভাবে বসে থাকে ও। ওই কামরার ঠিক মাঝখানে, একটা লোহার পুরানো স্টোভ রয়েছে। বেশ কয়েক মাস ওতে আগুন জ্বলেনি, গায়ে চায়ের ছোপ ছোপ দাগ। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে রঙ-চঙে পোস্টার, তাতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ক্যানেস বা ব্যান্ডলে অবসর কাটানোর।
ওয়েটিং রুমের নির্জন কোণে বসে এক ধরনের স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করে র্যাঁবেয়া। ওর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে প্যারিসের পুরানো জীবনের কথা। আগে কখনও র্যাঁবেয়া অনুভব করেনি ওই জীবনকে সে কত ভালবাসে।