বাইরে থেকে আর্দ্র বাতাসের একটা ঝাঁপটা এসে ঢুকল গির্জার ভেতর। নুয়ে পড়ল বাতির শিখাগুলো, কেঁপে কেঁপে উঠছে থেকে থেকে। মোম পোড়ার ঝাঁঝাল গন্ধ, কাশি ও চাপা হাসির শব্দ ভেসে আসছে এক সঙ্গে। ফাদার প্যানালু আবার ফিরে এলেন। তাঁর বক্তৃতায় আমার লক্ষ্য, আপনাদের সত্যের পথে নিয়ে যাওয়া। কিভাবে এই বিশ্ব সৃষ্টির মহা আনন্দে শরিক হতে হয় আমি সবাইকে সেটাই শেখাতে চাই। কয়েকশো বছর আগে আবিসিনিয়ার খ্রিস্টানরা একবার এই প্লেগের মধ্যে দেখতে পেয়েছিল বিধি-নির্দেশিত পথ। যাদের প্লেগে ধরেনি এমন বহু মানুষ তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যে যে বিছানায় প্লেগের রোগী মারা গেছে তা থেকে চাদর তুলে নিয়ে নিজেদের শরীরে জড়িয়েছে। এটা বাড়াবাড়ি, ধৃষ্টতা, নিন্দনীয়। কোন কিছুর জন্যে স্রষ্টাকে বাধ্য করতে চাওয়া সঙ্গত
গির্জার ভেতর সবাই ভাবল ফাদার প্যানালুর উপদেশ বোধহয়। এখানেই শেষ। বাইরে ইতিমধ্যে থেমে গেছে বৃষ্টি। হলুদ দেখাচ্ছে গির্জার সবকটা বাগান। রাস্তা থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট কথা বার্তার আওয়াজ, গাড়ি চলার চাপা গুঞ্জন। উপাসনাকারীরা খুব সাবধানে গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেদের জিনিসপত্র। কিন্তু ফাদার, প্যানালুর বলা তখনও শেষ হয়নি।
আমি আশা করি বর্তমান দুর্যোগের এই বিভীষিকা, এবং লক্ষ লক্ষ যন্ত্রণাকাতর মানুষের করুণ আর্তনাদ সত্ত্বেও আপনারা সবাই মিলিতভাবে স্রষ্টার কাছে হাত তুলে একবার প্রার্থনা জানাবেন। আর এরপরের যা কিছু তা স্থির করার সব দায়িত্ব স্রষ্টার নিজের।
.
২.০৪
যে রবিবারে ফাদার প্যানালু তাঁর উপদেশবাণী শোনালেন সেদিন থেকেই শহরের সবখানে একটা বড় রকমের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই বলল, একটা সম্পূর্ণ অজানা অপরাধের কারণে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে।
একদিন শহরতলিতে রোগী দেখতে যাচ্ছে রিও। গাঁদও আছে ওর সঙ্গে। দুজন কথা বলতে বলতে, হাঁটছে, এমন সময় অন্ধকারের ভেতর একজন মানুষের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল রিও। লোকটা ফুটপাথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার ডানে আর একবার। বাঁয়ে ঝুঁকে পড়ছে, কিন্তু সামনে এগুনোর কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না ওর মধ্যে। ঠিক তখুনি জ্বলে উঠল রাস্তার আলো। ওরা দেখল, লোকটার চোখ বন্ধ, আর মুখ বুজে হাসছে নিঃশব্দে। মুখের ভঙ্গিটাও কেমন বিকৃত। দুপাশ দিয়ে দরদর করে গড়িয়ে পড়ছে। ঘাম।
আরে, এ যে দেখছি একটা বদ্ধ পাগল, ছাড়া পেল কিভাবে? মন্তব্য করল গ্ৰাঁদ।
গ্রাঁদ-এর একটা হাত চেপে ধরে ওকে সামনের দিকে ঠেলার সময় রিও, দেখল থরথর করে কাঁপছে কেরানির শরীর।
আর কিছুদিন এমন চললে সারা শহরটাই পরিণত হবে পাগলা গারদে, মন্তব্য করল রিও। অনুভব করল ওর শরীরও ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে, শুকিয়ে আসছে গলার ভেতরটা।
গ্রাঁদ বলল, চলুন, কোথাও কিছু একটা খাই
একটা কাফেয় ঢুকল ওরা দুজনে। যে জায়গায় মদ বিক্রি হয় শুধু সেই কাউন্টারে বাতি জ্বলছে একটা। ঘরের ভেতর বাতাস ভারি, দম আটকে আসার মত অবস্থা। আশেপাশের সবাই কথা বলছে চাপাস্বরে।
গ্রাঁদ ঢুকেই ফরমাশ দিল মদের, এবং একচুমুকে খালি করে ফেলল পেয়ালা। দেখে অবাক হয়ে গেল রিও। যেদিক দিয়ে যায়, একেবারে আগুনের মত জ্বলতে থাকে, মন্তব্য করল গ্রাঁদ। কিন্তু কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই বাইরে যাবার জন্যে রিওকে তাগাদা দিতে লাগল ও।
রাস্তায় নেমে চারদিকের অন্ধকারের ভেতর কেমন একটা অদ্ভুত ফিসফিসানির শব্দ শুনতে পেল রিও। রাস্তার আলোর সংক্ষিপ্ত সীমানার ওপরে যে অথৈ অন্ধকার তার ভেতর থেকে ভেসে আসছে শাঁ শাঁ শব্দ। ফাদার প্যানালু যে শস্য মাড়াইয়ের দণ্ডের কথা বলেছিলেন, হঠাৎ রিও-র মনে পড়ল সেটার কথা। চারদিকের ওই শূন্য অন্ধকারের মাঝে যেন অবিরাম কাজ করে চলেছে সেই অদৃশ্য দণ্ডটি। এই ভীতিজনক পরিস্থিতি এড়াবার জন্যে রিও গ্রাঁদ-এর কাছে জানতে চাইল ওর লেখা কতদূর এগিয়েছে।
হ্যাঁ। নিশ্চয় কিছুটা এগিয়েছি বলতেই হবে।
এখনও তাহলে অনেক কিছু বাকি আছে?
তা এখন কিভাবে বলব, বলুন। তবে, ডাক্তার সাহেব, লেখাটাই কিন্তু আসল জিনিস নয়।
চারপাশের অন্ধকার এখন বেশ গম্ভীর হয়ে এসেছে। কাছের কিছুও দেখার উপায় নেই। তবু রিও অনুভব করল, কথা বলার সময় গ্রাঁদ ওর হাত দুটি খুব সুজোরে নাড়ছে। মনে হলো ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে লোকটা। কথাগুলো যেন, ঠেলাঠেলি করে একসঙ্গে ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
আমার এখন একটাই আকাক্ষা; আমি যেদিন আমার পাণ্ডুলিপি শেষ করে কোন প্রকাশকের হাতে দেব, তখন সে সঙ্গে সঙ্গে সেটা পড়া শেষ করে তাঁর কর্মচারীকে বলবে আপনারা সবাই টুপি খুলে ওকে সম্মান দেখান।
কথাটা শুনে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল রিও। দেখল, গ্রাঁদ সত্যি সত্যি ওর টুপি খুলে অদৃশ্য কাউকে সালাম দিচ্ছে। অন্ধকারের ভেতর আকস্মিকভাবে বেড়ে গেল হিসহিস শব্দ।
এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কাজটা কতখানি নিখুঁত হওয়া দরকার, বলল গ্ৰাঁদ।
সাহিত্য সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নেই রিও-র। তাই নীরব থাকাই সমীচীন মনে করল ও। মাথার ভেতর তখনও ওর ফিসফিস করছে ওই অদ্ভুত ভীতিজনক শব্দটা। ইতিমধ্যে গ্রাঁদ-এর মহল্লায় পৌঁছে গেছে ওরা। জায়গাটা যেহেতু রাস্তা থেকে সামান্য একটু উঁচুতে, গালে হিমেল হাওয়ার পরশ পেল ওরা, আবার সেই সঙ্গে টের পেল বাতাসের ধাক্কায় শহরের কোলাহল হারিয়ে যাচ্ছে দূরে।