উদাত্ত কণ্ঠে বাণী প্রচার করতে শুরু করলেন তিনিঃ ভায়েরা, এক কঠিন বিপদ নেমে এসেছে আপনাদের ওপর। কিন্তু, ভায়েরা, এই বিপর্যয় আপনাদেরই কৃতকর্মের প্রতিফল। ইতিহাসে যখন এই বিপর্যয়ের আবির্ভাব হয়, তখন একে ব্যবহার করা হয়েছিল আঘাত হানার অস্ত্র হিসেবে। ফেরাউন স্রষ্টার ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিল, তাই প্লেগের বিপর্যয় নেমে এসেছিল তার ওপর; যেন সে স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে অনুনয় জানাতে বাধ্য হয়।
এ-ভাবে সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে যারা স্রষ্টার আদেশ এবং নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চেয়েছে তাদের অপমান করার জন্যে, তাদের দর্পচূর্ণ করার জন্যে স্রষ্টার অভিশাপ হিসেবে পাঠানো হয়েছে প্লেগকে। বন্ধুগণ, আপনারা গভীরভাবে এ-বিষয়টি চিন্তা করুন, এবং আসুন আমরা নতজানু হয়ে স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করি।
ইতিমধ্যে বাইরে শুরু হয়েছে প্রবল বৃষ্টিপাত, গির্জার পুবদিকে জানালার ওপর অবিরাম বর্ষণের ফলে চারপাশের স্তব্ধতা হয়ে, উঠেছে আরও গভীর এবং আরও প্রকট।
আমাদের ভেবে দেখতে হবে কেন আবির্ভাব হয়েছে প্লেগের? যারা ন্যায় এবং সত্যের পথে চলেন, তাদের শঙ্কিত হবার কিছু নেই। যারা অন্যায় এবং অবৈধ কাজে লিপ্ত, তাদের হৃদয় এখন কাঁপবেই। আপনাদের মনে রাখতে হবে, সমগ্র পৃথিবীটা স্রষ্টার কাছে একটা শস্য মাড়াইয়ের বিরাট খামার, আর এই প্লেগ হচ্ছে সে শস্য মাড়াইয়ের দণ্ড। যতদিন না তিনি শস্য ঝেড়ে আবর্জনামুক্ত করতে পারছেন, ততদিন তাঁর ইচ্ছা অনুসারে চলবে এই দণ্ডমাড়াইয়ের কাজ। দীর্ঘদিন ধরে আমরা অন্যায় এবং অসত্যকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছি, দীর্ঘদিন ধরে আমরা নির্ভর করে এসেছি স্রষ্টার অপার করুণা এবং তার স্বেচ্ছাকৃত ক্ষমার ওপর। ভেবেছি অনুশোচনা করলেই সবকিছু পাওয়া যাবে। আমাদের ভেতর বিধি নিষেধ বলে কিছু নেই। আমরা সবাই একটা তৃপ্তিদায়ক নিশ্চিত আশ্বাসের মধ্যে বসবাস করছি।
দীর্ঘদিন ধরে অপার করুণার দৃষ্টিতে তিনি চেয়ে থেকেছেন এই শহরের দিকে। কিন্তু কতদিন আর তিনি অপেক্ষা করতে পারেন? তাঁর যে-চিরন্তন আশা, তা আমরা দীর্ঘদিন ধরে পূরণ হতে দেইনি; তারই ফলে আজ তিনি ভয়ঙ্কর রুষ্ট হয়েছেন।
অশান্ত ঘোড়া অনেকক্ষণ ধরে বাঁধা থাকলে যেমন থেকে থেকে নাক দিয়ে শব্দ করে, সমবেত উপাসনাকারীদের ভিড়ের ভেতর থেকে কে যেন তেমনি একটা ছোট্ট শব্দ করে উঠল। এদিক ওদিক চেয়ে ক্ষণিকের বিরতি দিলেন ফাদার প্যানালু। তারপর কিছুটা নিম্নস্বরে আবার শুরু করলেন ধর্মকথা।
রাজা আমবার্টোর আমলে সারা ইতালি জুড়ে এক ভয়ঙ্কর প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তার নিষ্ঠুরতম ধ্বংসলীলা চলেছিল রোম এবং প্যাভিয়ায়। লাশ কবরস্থ করার মত যথেষ্ট লোক আর জীবিত ছিল না তখন। এমন সময় সেখানে নেমে আসে দুজন স্বর্গীয় দূত। একজন সৎ, অন্যজন অসৎ। সৎ প্রকৃতির দূতটা বিভিন্ন বাড়িতে, আঘাত হানার আদেশ করত অসৎ প্রকৃতির দূতটাকে। অসৎ দূতটার হাতে থাকত মস্ত বড় এক বর্শা। সে ওর ওই বর্শা দিয়ে। একটা বাড়িতে যতবার আঘাত হানত, সে-বাড়ি থেকে ঠিক ততটা লাশ আপনা-আপনি অদৃশ্য হয়ে যেত।
এই পর্যায়ে ফাদার প্যানালু তাঁর ছোট হাত দুখানা প্রসারিত করলেন খোলা, বারান্দার দিকে। বাইরের অঝোর বৃষ্টির আড়ালে, কোন কিছুর প্রতি ইঙ্গিত করলেন যেন। তারপর উচ্চস্বরে খেই ধরলেন: ভায়েরা, সৈই ভয়াবহ শিকার শুরু হয়েছে আবার। শহরের পথে পথে ছড়িয়ে আছে তারই ধ্বংসলীলা। ওই দেখুন, আপনাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে মহামারীর স্বর্গীয় দূত, লুসিকারের দেহকান্তি, সাক্ষাৎ শয়তান যেন। আপনাদেরই বাড়ির ছাদের ওপর ঘুরছে সে। তার দক্ষিণ হাতে প্রকাণ্ড এক বর্ষা, যে কোন মুহূর্তে আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুত। হয়তো এ-মুহূর্তে আপনাদের কারও দরজার দিকেই চেয়ে রয়েছে তার আঙুল, লাল বর্শটা ভেঙে ফেলেছে কবাট, আর বাঁ হাতটা বাড়িয়ে রেখেছে অন্য কারও বাড়ির দিকে। আর প্লেগ এতক্ষণে আপনার শোবার ঘরে ঢুকে অপেক্ষা করছে আপনার ফেরার।
এরপর ফাদার প্যানা বক্তৃতা হয়ে উঠল উচ্ছল, আবেগময়। কল্পনা করুন, বিরাট আকারের একটা কাঠের দণ্ড যেন সারাক্ষণ এই শহরের ওপর বনবন ঘুরছে, সামনে যা-কিছু পাচ্ছে এলোপাতাড়ি আঘাত হানছে তাতে। আবার ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে সেই দণ্ড, আর বৃষ্টির ধারার মত তার গা থেকে চারদিকে ছিটিয়ে পড়ছে শোণিতের ধারা। ( একটানা দীর্ঘ বক্তৃতার পর কিছুক্ষণের জন্যে থামলেন ফাদার প্যানালু। মাথার চুল বিক্ষিপ্ত হয়ে এসে পড়েছে কপালের ওপর, সারা শরীর কাঁপছে থরথর; আর তাঁর হাত বেয়ে সেই কম্পন ছড়িয়ে পড়ছে মঞ্চ অবধি। আবার যখন বক্তৃতা আরম্ভ করলেন, তিনি, তখন দেখা গেল অনেক খাদে নেমে গেছে তার কণ্ঠস্বর, কিন্তু আগের মতই কাঁপছে অভিযোগের আবেগে।
দেখুন, নিজেদের সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে আমাদের সামনে। আমরা বরাবর বিশ্বাস করে এসেছি যদি, রবিবারৈ গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা-সভায় যোগ দেই, তাহলে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর জন্যে আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত, যথেচ্ছভাবে চলাফেরা করতে আর কোন বাধা নেই। কিন্তু স্রষ্টা এ-ধরনের উপহাসের পাত্র নন। তিনি আরও ঘন ঘন এবং আরও দীর্ঘ সময় ধরে কাছে পেতে চান আমাদের। এটাই তার ভালবাসার ধরন।