আপনার পরিকল্পনার কাজ কেমন চলছে? আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না, আশা করি কিছু মনে করবেন না। তবে আমার বিশ্বাস এমন কিছু ব্যাপার আছে যেখানে আমরা দুজনে একমত হতে পারব।
হঠাৎ কেমন যেন অপ্রতিভ হয়ে পড়ল র্যাঁবেয়া। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, হ্যাঁ, আমারও সেই রকম মনে হয়। এরপর মাথার টুপিটা টেনে চোখের ওপর নামিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে রাস্তার ওপাশে চলে গেল। রিও দেখল, যে-হোটেলে জ তারিউ থাকে সেটাতেই ঢুকল ও।
মাথাটা সামান্য একটু নড়ল রিও-র। মনের ভেতর জেগে উঠল প্রশ্ন। নিজের সুখভোগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে অস্বীকার করে ঠিকই করেছে র্যাঁবেয়া। কিন্তু ও যে রিওকে দোষারোপ করেছে অবাস্তব চিন্তার মানুষ বলে, এটা কি ঠিক? শহরে প্লেগ এখন নিয়মিতভাবে তার পেট ভর্তি করে স্ফীত হচ্ছে, তার শিকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সপ্তাহে পাঁচশো। ওকে দিনের পর দিন কাটাতে হচ্ছে হাসপাতালে, এটা কি অবাস্তব? একটা অস্থায়ী হাসপাতাল পরিচালনা করতে হচ্ছে ওকে, হাসপাতালটার সব দায়িত্ব ওর। এ রকম তিনটে হাসপাতাল আছে ওর তত্ত্বাবধানে, এটা কি খুব সহজ দায়িত্ব?
হাসপাতালের একটা ঘর, সুন্দর করে গুছিয়ে যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে রিওকে। ঘরের মেঝেটো সম্পূর্ণ ঝেড়ে-মুছে। পানি আর ক্রিসটালিক অ্যাসিড দিয়ে বানানো হয়েছে একটা ছোট্ট হ্রদ। ওই হ্রদের মাঝখানে ইট দিয়ে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে ক্ষুদ্র একটা দ্বীপ। রোগী হাসপাতালে এসে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তাকে তোলা হয় ওই দ্বীপের ওপর। তার পরনের কাপড় দ্রুত ছাড়িয়ে নিয়ে ডুবিয়ে দেয়া হয় চারপাশের রোগজীবাণুনাশক পানির মধ্যে। তারপর রোগীর দেহ পরিষ্কার করে ধুয়ে, শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে, হাসপাতালের পোশাক পরিয়ে রিও-র কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, পরীক্ষার জন্যে; সেখান থেকে তাকে পৌঁছে দেয়া হয় তার নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে।
রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো থেকে শুরু করে সব কাজ নিজে তদারক করে রিও। সিরাম ইনজেকশন দিয়ে, দেহের স্ফীতিগুলো চিরে চিরে তা থেকে পুঁজ বের করে। রোগীর সংখ্যা। গুনে মিলিয়ে নেয় ও, এবং বিকেলে আবার আসে তাদের অবস্থা দেখার জন্যে। রাত নামতে না নামতেই বেরিয়ে পড়ে বাসায় বাসায় রোগী দেখতে। রোগীকে পরীক্ষার পর যদি দেখা যায় রোগ সংক্রমিত হয়েছে তাহলে তক্ষুণি তাকে পাঠানো হয় হাসপাতালে। এরপর শুরু হয় রোগীর পরিবারে ধস্তাধস্তির পালা। কেননা সবাই জানে রোগী একবার হাসপাতালে গেলে তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কেউই তার মুখ দেখতে পাবে না।
একটু দয়ামায়া তো আপনার কাছ থেকে আশা করতে পারি, ডাক্তার, এই বলে অনুনয় করে রোগীর মা-রা। কিন্তু এতে কোন কাজ হয় না। যদিও করুণা সে অবশ্যই বোধ করে।
হাসপাতালে টেলিফোন করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না ওর। এরপর শব্দ শোনা যায় অ্যাম্বুলেন্সের। প্রথম প্রথম অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ পেলে প্রতিবেশীরা জানালা খুলে চেয়ে চেয়ে দেখত, কিন্তু ইদানীং ওই শব্দ শুনতে পেলেই দ্রুত জানালা বন্ধ করে দেয় সরাই। তারপর শুরু হয় রোগীকে নিয়ে বিরোধ, অশ্রুবর্ষণ, আর কাকুতিমিনতির পালা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোগীকে যেতেই হয় হাসপাতালে। তারপর বিদায় নেয় রিও।
প্রথম দিকে হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে টেলিফোন করে দিয়েই অন্য রোগী দেখার জন্য বেরিয়ে পড়ত ও, অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে অপেক্ষা করত না। এতে পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে হয়ে উঠছিল। ও চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর আত্মীয়স্বজনরা তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দিত বাড়ির দরজা, যেন অ্যাম্বুলেন্স এসে রোগীকে নিয়ে যেতে না পারে। তারপর শুরু হত দরজার ওপর প্রবল আঘাত। কান্নাকাটি। পুলিসের আগমন। এবং শেষে সৈনিকের আবির্ভাব। সবরকমের বাধা তছনছ করে রোগীকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হত হাসপাতালে। এখন প্রত্যেক ডাক্তারের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে একজন পুলিস অফিসারও রোগীর বাসায় আসছে। ফলে এখন আর অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে অপেক্ষা করতে হয় না রিওকে। একজনকে দেখেই অন্য রোগীর বাসায় চলে যায় ও।
এ-ভাবে কেটে গেল একটার পর একটা অবসাদময় সপ্তাহ। পার হলো সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা.। উদ্দেশ্যহীনভাবে জীবন কাটাতে লাগল শহরের অধিবাসীরা। মানুষ বুঝল দয়ামায়া শব্দগুলো অর্থহীন। হৃদয়ের বেদনা প্রকাশ করা নিরর্থক। এক ধরনের নির্লিপ্ততা আচ্ছন্ন করে ফেলল ওদের চেতনাকে।
.
২.০৩
প্রথম মাসের শেষের দিকে চার্চ কর্তৃপক্ষ স্থির করলেন প্লেগের বিরুদ্ধে এক সংগ্রাম আরম্ভ করবেন তাঁরা। এই উপলক্ষে জনসাধারণকে ধর্মীয়বাণী শোনাবার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হলো ফাদার প্যানালুকে। আয়োজন করা হলো একটা প্রার্থনা সপ্তাহ এর।
প্রথম দুতিন দিন অনেকেই দাঁড়িয়ে রইল গির্জার বারান্দার বাইরে অপেক্ষা করল বারান্দার সামনের পথে, ডালিম গাছের তলায়। দূর থেকে শুনল গির্জার ভেতর মিলিত কণ্ঠের প্রার্থনা। এরপর দেখতে দেখতে সবাই ঢুতে শুরু করল গির্জার ভেতর। কণ্ঠ মেলাতে লাগল প্রার্থনা এবং আহ্বানে।
রোববারে, ফাদার প্যানালুর বাণী শোনার সময় দেখা গেল উপাসনাকারীরা গির্জার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আশেপাশের সমস্ত সংলগ্ন স্থান ভরে ফেলেছে। আগের দিন থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, সেদিন সকাল থেকে আরম্ভ হলো প্রবল বর্ষণ। যারা গির্জার বাইরে দাঁড়িয়েছিল তারা সবাই মাথার উপর মেলে ধরল ছাতা। গির্জার ভেতরটা ভরে উঠল ধূপের মৃদু সুবাস, এবং ভেজা জামাকাপড়ের গন্ধে। মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন ফাদার প্যানালু।