ইতিমধ্যে শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে গিয়েছিল ওরা। ভেবে দেখুন তো, ডাক্তার সাহেব, কী রকম মূর্খের মত কথাবার্তা বলে এরা। কিছুতেই বুঝতে চায় না, শুধুমাত্র সংবাদপত্রে নিবন্ধ লেখার। জন্যে পৃথিবীতে আমার জন্ম হয়নি। বরং একজন, নারীকে ভালবাসব, তাকে নিয়ে একসঙ্গে বাস করব, এজন্যই আমি জন্মেছি। সেটাই তো সঙ্গত, তাই না?
রিও অত্যন্ত সতর্কতার সাথে জবাব দিল, আপনি যে-সব কথাবার্তা বলছেন তার মধ্যে ভেবে দেখবার মত নিশ্চয় কিছু থাকতে পারে।
শহরের প্রধান বুলভার্দে সবসময় যেমন জনসমাগম দেখা যায়, আজ তার কিছুই চোখে পড়ল না। রিও ভাবল, র্যান্সডক ব্যুরো থেকে সর্বশেষ যে ঘোষণাটা দেয়া হয়েছে এটা হয়তো.তারই ফল। মৃত্যের সংখ্যা ঘোষণার দিনটাতে সবাই কেমন সন্ত্রস্ত থাকে। চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে যাবার পর শহরের অধিবাসীরা আবার সহজ এবং আশান্বিত বোধ করতে শুরু করে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের পরিচয় খুবই অল্প দিনের, র্যাঁবেয়া আবার কথা আরম্ভ করল, কিন্তু আপনাকে আমার খুব ভাল। লেগেছে। কোন সাড়াশব্দ দিল না রিও। বুঝেছি, আপনি খুব বিরক্ত বোধ করছেন। সত্যি, আমি দুঃখিত। আমি শুধু জানতে এসেছিলাম, এই অশিপ্ত রোগটা আমার দেহে সংক্রমিত হয়নি, এই বলে আপনি আমাকে একটা সার্টিফিকেট দিতে পারেন কি না। তাতে আমার যাওয়ার ব্যাপারটা একটু সহজ হত।
মাথা নাড়ল রিও। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ওর পায়ের ওপর ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। ও উবু হয়ে ছেলেটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল রাস্তার ওপর। হাঁটতে হাঁটতে ওরা এসে পৌঁছল প্যালেস দ্য আর্মস-এর কাছে। শাখা-প্রশাখা এলিয়ে দিয়ে স্ট্যাচু অভ রিপাবলিকের চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে ধুলিধূসর উইলো আর ডুমুর গাছের সারি। র্যাঁবেয়া-র চেহারার মধ্যে কেমন একটা অপ্রসন্ন এবং কঠিন একগুঁয়ে ভাব ফুটে উঠল।
আমি আপনার অবস্থা বুঝিনি, এমন সন্দেহ করবেন না, বলল রিও, কিন্তু আপনি যে যুক্তিগুলো দেখাতে চাইছেন সেগুলো শেষ, পর্যন্ত টেকানো শক্ত। আমি যদি আপনাকে সার্টিফিকেট দেই তাতেও আপনার কোন লাভ হবে না।
কেন?
কারণ, এই শহরে আরও হাজার হাজার লোক রয়েছে যাদের অবস্থা আপনারই মত, কিন্তু তাদের সবাইকে তো আর শহর ছেড়ে যাবার অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়।
তাদের দেহে প্লেগের জীবাণু সংক্রমিত হয়নি, তা জানা সত্ত্বেও তাদের শহর ছেড়ে যাবার অনুমতি দেয়া সম্ভব হবে না বলে আপনি, মনে করেন?
দেখুন, রোগ সংক্রমিত হয়নি এটা জানাই তো তাদের শহর ছেড়ে যাবার অনুমতি দেবার পক্ষে যথেষ্ট কারণ নয়।
কিন্তু আমি এই শহরের অধিবাসী নই।
দুঃখের সাথে জানাচ্ছি এখন থেকে নিজেকে আপনার এই শহরের একজন বলেই মনে করতে হবে।
এবার গলার স্বর একটু চড়িয়ে দিল র্যাঁবেয়া। গোল্লায় যাক। কিন্তু, ডাক্তার, আপনি কি বোঝেন না এটা মানুষের সাধারণ অনুভূতির ব্যাপার? বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কি আপনি অনুভব করেন না?
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রিও। তারপর বলল, আমি সবকিছুই অনুভব করি। আমি চাই সবাই আপনজনদের সঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পাক। কিন্তু আইন আইনই। শহরে প্লেগ দেখা দিয়েছে, তাই এ-ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী আমার যা কর্তব্য আমাকে তা করতেই হবে।
না, আমার মনে হচ্ছে আপনি কিছুই বোঝেন না, তিক্ততার সঙ্গে বলল র্যাঁবেয়া, কারণ আপনি যেসব কথা বলছেন সেগুলো যুক্তির কথা, বুদ্ধি বিবেচনার কথা, হৃদয়ের কথা নয়। আপনি বাস করেন বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক কল্পনার রাজ্যে।
স্ট্যাচু অভ রিপাবলিকের দিকে চোখ তুলে রিও বলল, আমি বাস্তব নিয়ে কথা বলছি।
র্যাঁবেয়া ওর টাই সোজা করতে করতে বলল, অর্থাৎ আপনার কাছ থেকে কোন সাহায্যের আশা করা আমার উচিত হবে না, এই তো? কিন্তু জেনে রাখুন, এ-শহর ছেড়ে আমি যাবই।
রিও আবারও বলল, আমি সব জানি এবং বুঝি। কিন্তু আমার। করার কিছুই নেই।
মাফ করবেন। শুনেছি এটা আপনারই কাজ, র্যাঁবেয়ার গলার। স্বর আবার চড়ল, শুনেছি যে-নির্দেশ জারি করা হয়েছে তার খসড়া আপনারই দেয়া। ভেবেছিলাম, যে-আইন তৈরি করতে আপনি সাহায্য করেছেন, অন্তত একটা বিশেষ ক্ষেত্রে তা ভঙ্গ করার ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে কিছুটা সাহায্য পাব। কিন্তু আমার কথার কোন গুরুত্বই দিলেন না আপনি। বিচ্ছেদের বেদনা যে কী তা অনুভব করার কোন চেষ্টাই করছেন না আপনি। এ রিও স্বীকার করল, র্যাঁবেয়ার অভিযোগ কিছুটা সত্যি। তবে এসব কথা চিন্তা না করাই ও এখন শ্রেয় বলে মনে করে।
ঝাঁজাল কণ্ঠে র্যাঁবেয়া বলল, এরপর নিশ্চয় জনসাধারণের
বৃহত্তর স্বার্থের দৃষ্টান্ত দেবেন। কিন্তু জনসাধারণের কল্যাণ আমাদের সবার কল্যাণের যোগফল।
এতক্ষণ পর হঠাৎ যেন একটা স্বপ্নের ভেতর থেকে জেগে উঠল রিও। বেশ, বেশ। একটু হাঁটুন দেখি। কথাটা ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু ভাববার আছে, বলল ও। কিন্তু আপনি রাগ করছেন কেন? আপনি এ-শহর থেকে মুক্তি পেলে আমি অত্যন্ত। খুশি হব। তবে সরকারি দায়িত্বের খাতিরে অনেক জিনিস আমি। করে উঠতে পারছিনে।
মাথা ঝাঁকিয়ে র্যাঁবেয়া বলল, ধন্যবাদ। আসলে এতটা বিরক্তি দেখানো আমার ভুল হয়েছে। আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম, কিছু মনে করবেন না।