এই যে অভিশপ্ত মহামারী, এ-সম্পর্কে আপনার কী ধারণা, ডাক্তার সাহেব? ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তাই না? প্রশ্ন করল কটার্ড। ঘাড় নেড়ে ওকে সমর্থন করল রিও।
দুজন একসঙ্গে কিছুটা পথ হাঁটল। এক মুদির গল্প শোনাল কটার্ড। পরে বেশি মুনাফায় বিক্রি করবে বলে প্রচুর টিনজাত খাদ্যসামগ্রী মুজদ করে রেখেছিল লোকটা। কিন্তু ওর সে-আশা পূরণ হয়নি, তার আগেই মারা গেছে হাসপাতালে।
প্লেগের ছুতোয় কেউ যে কিছু টাকা কামিয়ে নেবে তারও কোন সুযোগ নেই, মন্তব্য করল কার্ড।
আরও একজন মানুষের গল্প বলল ও। লোকটার শরীরে তখন এই রোগের সমস্ত লক্ষণ ফুটে উঠেছে। দেহে ভীষণ জ্বর। সেই অবস্থায় ও ঘর থেকে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে আসে, এবং সেখানে প্রথমেই যে স্ত্রীলোকটিকে দেখতে পায়, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে থাকে, আমাকেও ধরেছে এবার।
সেদিনই বিকেলে গ্রাঁদ ওর মনের সমস্ত বেদনা প্রকাশ করল রিও-র কাছে। এই প্রথম ডাক্তারের সামনে বেশ কিছুটা প্রগলভ, হয়ে উঠল ও। শব্দ চয়নের ব্যাপারে ওর যে অসুবিধা সেটা অবশ্য এখনও আছে, কিন্তু প্রয়োজন মত উপযুক্ত শব্দ ওর মুখ দিয়ে আপনা-আপনি বেরিয়ে আসতে লাগল। গ্রাঁদ বলল, একেবারে নাবালক বয়সে ও প্রতিবেশী এক দরিদ্র পরিবারের খুব অল্প বয়স্ক এক মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করে। মেয়েটির নাম ছিল জেনি। এই বিয়ের জন্যেই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরি নিতে বাধ্য হয় ও
এরপর ওদের জীবনের যা কাহিনী তা অত্যন্ত সরল। সব, স্বামী-স্ত্রীর জীবনে যা ঘটে ওদের ভাগ্যেও তাই ঘটল। বিয়ের পর দুজন পরস্পরকে ভালবাসে, সেই সঙ্গে চলতে থাকে নিয়মিত কাজকর্ম; তারপর কাজের চাপ দিন দিন এতই বাড়তে থাকে যে তখন ভালবাসার অনুভূতি ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল মনের ভেতর। জেনিকেও চাকরি নিতে হলো। অফিসে সারাদিন ধকলজনিত অবসাদের ফলে ক্রমেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে থাকে গ্রাঁদ। স্ত্রীকে শোনানোর মত কথাও আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসে ওর। হঠাৎ একদিন ওকে ছেড়ে চলে গেল জেনি। যাবার সময় একটা চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিল ও।
সত্যিই একদিন গভীরভাবে ভালবাসতাম তোমাকে, কিন্তু এখন নিজেকে বড় ক্লান্ত মনে হয়, তাই তোমাকে ছেড়ে যাওয়াটা মোটেই সুখের নয়; কিন্তু জীবন যখন আমাকে আবার নতুন করেই আরম্ভ করতে হবে, তখন আর সুখের কথা নাই বা ভাবলাম।
গ্রাঁদ ওর পকেট থেকে তোয়ালের মত কী একটা বের করে বেশ শব্দ করে তাতে নাক ঝাড়ল। গোঁফজোড়াও ঠিক করে নিল মুছে। নীরবে, একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল রিও। গেট বন্ধ করে দেয়ার সপ্তাহ তিনেক বাদে একদিন সন্ধেবেলা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার সময় রিও লক্ষ করল একজন যুবক রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে. ওর জন্যে।
আমাকে চিনতে পারছেন তো? এই মহামারী শুরু হওয়ার ঠিক আগে আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমার নাম র্যাঁবেয়া, যুবকটি বলল।
ও হ্যাঁ। অবশ্যই মনে পড়ছে। আপনার কাগজে লেখা পাঠাবার মত অনেক উপকরণ এখন পেতে পারেন।
ঠিক সে-ব্যাপারে আপনার কাছে আসিনি। দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে আমি দুঃখিত।
রিও বলল, শহরের এক ডিসপেনসারিতে আমাকে একটু যেতে হবে। চলুন, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাবে।
নিগ্রো এলাকার ভেতর দিয়ে সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল ওরা। সন্ধ্যা নামছে চারদিকে। এ-সময় শহরটা সাধারণত কোলাহলমুখর থাকে, কিন্তু আজ অদ্ভুত রকমের শান্ত বলে মনে হচ্ছে। শব্দের মধ্যে ছিল শুধু দূরাগত বিউগলের আওয়াজ, পড়ন্ত সূর্যেরর সোনা-মাখানো বাতাসে ভেসে আসছে সেই আওয়াজ। সেনাবাহিনী, যে তাদের কাজকর্ম নিয়মিত করে যাচ্ছে, এই রকম একটা ভাব বাইরে বজায় রাখার চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। চারপাশে গোলাপী, ফিকে লাল এবং হলুদ দেয়াল। তারই ভেতর দিয়ে সোজা, সরু রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে ওরা। অবিরাম বকর-বকর করছে র্যাঁবেয়া। মনে হচ্ছে ওর শরীরের সবগুলো স্নায়ু যেন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।
র্যাঁবেয়া জানাল, স্ত্রীকে ফেলে এসেছে প্যারিসে ও। যেদিন থেকে বাইরের সাথে এই শহরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে, সেদিনই ও একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল ওকে। তখন ওর ধারণা ছিল শহরের এই অবস্থা খুবই সাময়িক। কিন্তু পরের দিনই ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর ওর মনে হলো, এই বিপর্যস্ত অবস্থা কতদিন চলবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং তক্ষুণি ও শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওর পেশাগত মর্যাদার সুবাদে ওপরতলায় এখানে-ওখানে সাড়া দিয়ে প্রিফেক্ট-এর অফিসে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার লাভে সক্ষম হয় ও। র্যাঁবেয়া ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বলে ওরাওঁ-এ ওর উপস্থিতি সম্পূর্ণ আকস্মিক ব্যাপার। এই শহরের সঙ্গে কোন ব্যাপারেই ওর কোন যোগসুত্র নেই। এ-অবস্থায় নিশ্চয় ও শহর ছেড়ে বাইরে যাবার অনুমতি পাওয়ার আশা করতে পারে। ভদ্রলোক উত্তরে র্যাঁবেয়াকে জানান, যদিও তিনি ওর অবস্থা বুঝতে পেরেছেন এবং ওর জন্যে যথেষ্ট সহানুভূতি বোধ করছেন, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আইনের কোনরকম ব্যতিক্রম ঘটানোর ক্ষমতা তার নেই। শেষে তিনি র্যাঁবেয়াকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে, যেহেতু ও একজন সাংবাদিক, তাই ওর লেখার উপযোগী চমৎকার চমৎকার উপকরণ ও এখন ওরাওঁ-এ পেতে পারে। এরপর দার্শনিকের মত মন্তব্য করেছিল ও, পৃথিবীতে এমন কিছু কখনও ঘটে না যার কোন শুভ দিক নেই।