চিঠি লেখার আনন্দ থেকেও বঞ্চিত করা হলো শহরবাসীকে। কর্তৃপক্ষ মনে করলেন এর ফলে রোগের জীবাণু শহরের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রথমদিকে অন্যান্য শহরের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের ব্যাপারে কোন বাধা-নিষেধ ছিল না, কিন্তু এর পরে টেলিফোন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় এত বেড়ে গেল যে কয়েক দিনের জন্যে বন্ধ করে দেয়া হলো এই যোগাযোগ ব্যবস্থা। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ রক্ষার একমাত্র মাধ্যম হলো টেলিগ্রাম। হৃদয়ের গভীর আর্তিগুলো সীমাবদ্ধ হলো কয়েকটি শব্দে তোমার শরীর ভাল, কিংবা সব সময় তোমার কথা মনে পড়ে, প্রিয়।
কিছুদিন এভাবে কাটবার পর যখন সবাই পরিষ্কার বুঝতে পারল, কারুরই আর শহর ছেড়ে বাইরে যাবার বিন্দুমাত্র আশা নেই, তখন প্রশ্ন উঠল প্লেগ শুরু হওয়ার আগে যারা বাইরে গিয়েছিল তাদের ফিরে আসার অনুমতি দেয়া হবে কিনা? কিছুদিন আলাপ-আলোচনার পর কর্তৃপক্ষ জানালেন এই অনুমতি দিতে তাদের আপত্তি নেই। সেই সঙ্গে এটাও জানিয়ে দিলেন, একবার যারা ফিরে আসবে কোন অবস্থাতেই তাদের আর শহর ছেড়ে যেতে দেয়া হবে না। ইতিমধ্যে প্লেগের কবলে যারা পড়েছিল তারা উপলব্ধি করল এই ব্যবস্থার ফলে পরিবারের লোকদের অকারণে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে টেনে আনা হবে; তাই, অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও, ওদের অনুপস্থিতিকেই মেনে নিল ওরা।
মানুষ হয়ে উঠল সন্দেহপরায়ণ। যে-সব স্বামী এতদিন স্ত্রীর ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখে এসেছে, তারাই হঠাৎ নিজের স্ত্রীর ওপর ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠল। প্রেমিকদের ক্ষেত্রেও ঘটল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
শহরের অধিবাসীরা বন্ধ করে দিল সামাজিক মেলামেশা। শহরের ক্ষুদ্র গণ্ডীর ভেতর প্রাণহীন রুটিন মেনে চলে, একই রাস্তায় বারবার ঘুরেফিরে বেড়িয়ে, দিনের পর দিন একই অতীত স্মৃতির রোমন্থন করে মিথ্যা সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা করার ভেতর সীমাবদ্ধ হলো ওদের জীবন।
এভাবে প্লেগ শহরবাসীকে ঠেলে দিল নির্বাসিত জীবনে। সুখের যত স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল সবাই। ভাবল, বাইরে ছিল যে প্রিয়জন সে ফিরে এসেছে, এখনই দরজায় বেল বাজবে, একটু পরে সিঁড়িতে শোনা যাবে পরিচিত পায়ের শব্দ। অতীত ছাড়া কিছুই থাকল না ওদের। উদ্দেশ্যহীনভাবে দিন কাটানো এবং নিষ্ফল স্মৃতিচারণ এই দুই অসহায় অবস্থার শিকার হয়ে এক নির্মম সঙ্কটের মধ্যে বাস করতে লাগল ওরা।
.
২.০২
দুই শহরবাসীকে এই আকস্মিক বিচ্ছিন্ন অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়ে শহরের ফটকে পাহারাদার হয়ে বসল প্লেগ নিজেই। ফিরিয়ে দিতে লাগল বন্দরে নোঙর করতে আসা বাইরের জাহাজগুলোকে। কোন যানবাহনই আর ভেতরে ঢুকতে পারে না। বুলভার্দের চূড়া থেকে নিচে তাকালে শহরের দৃশ্য অদ্ভুত মনে হয়; মনে হয় শহরের সবগুলো গাড়ি যেন একটানা একটা বৃত্তাকার পথে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে। রোগের সংক্রমণ যাতে বাইরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, ।তার জন্যে যে কয়েকটা জাহাজ আটকে রাখা হয়েছিল, শুধু সেগুলোকেই চোখে পড়ে সাগরে নোঙর করা অবস্থায়। জেটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিরাট বিকট চেহারার ক্রেন, এখানে ওখানে কাত হয়ে পড়ে ছোট বড় ওয়াগম।
ব্যুরো থেকে ঘোষণা করা হলো, প্লেগের আবির্ভাবে তৃতীয় সপ্তাহে, শহরে তিনশো দুজন লোকের মৃত্যু হয়েছে। পাঁচ সপ্তাহ পরে মৃতের সংখ্যা দেখা গেল তিনশো একুশ। ছসপ্তাহ পরে তা উঠল তিনশো পঁয়তাল্লিশে।
যানবাহন চলাচল এবং খাদ্য সবরাহের নিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রিফেক্ট কিছু ব্যবস্থা চালু করলেন। রেশনিং ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হলো পেট্রল, খাদ্যবস্তুর বিক্রয়ের ওপর আরোপিত হলো নিয়ন্ত্রণ। বিদ্যুতের ব্যবহারও চলে এল নিয়ন্ত্রণের আওতায়। শুধুমাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলোকে ছাড়পত্র দেয়া হলো শহরে ঢোকার যানবাহন চলাচল দ্রুত হারে হালকা হতে হতে এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছাল যখন শহরের রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ি বলতে কিছুই চোখে পড়ছে না আর।
রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেল বিলাসবহুল সামগ্রীর সব দোকান। রাস্তাঘাটে পথচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেল বহুগুণ। এবং যে সময়ে কাজকর্মের চাপ সাধারণত কম থাকে, সে সময়ে রাস্তাঘাটে এবং কাফেতে প্রচণ্ড ভিড় জমতে লাগল, কারণ দোকানপাট এবং বেশ কিছু সরকারি অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেককেই নিষ্ক্রিয়ভাবে সময় কাটাতে হচ্ছে। এর ফলে লাভবান হলো সিনেমাহলের মালিক এবং মদের ব্যবসায়ীরা। সিনেমা দেখা, কিংবা মদ খাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প রইল না শহরবাসীর। যদিও প্রতিটি সিনেমা হলে একই ছবি চলছিল দিনের পর দিন ধরে, তবু দর্শকের ভিড় কমতে দেখা গেল না কোথাও। মদ্যপানের পরিমাণটাও বেড়ে গেল আগের চেয়ে। এক কাফের মালিক দোকানের সামনে একটা স্লোগান লিখে দিল: রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে চাইলে প্রয়োজন বড় এক বোতল মদ।
এখন প্রতিদিনই রাত দুটোর দিকে দেখা যায় বেশ কিছুসংখ্যক মাতাল, বিভিন্ন কাফে থেকে যাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, টলতে টলতে বাড়ির দিকে হাঁটছে আর তারস্বরে চেঁচিয়ে শোনাচ্ছে জীবন সম্পর্কে আশাবাদের কথা।
শহরের ফটক বন্ধ করে দেয়ার দুদিন পর, ডাক্তার রিও ফিরছে হাসপাতাল থেকে, পথে দেখা হলো কটার্ড-এর সঙ্গে। কটার্ড-এর চেহারা থেকে উপচে পড়ছে খুশি। ওকে সুস্থ দেখে অভিন্দন জানাল রিও।