রাত দশটায় হাঁপানি রোগীর বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল রিও। আজকে এটাই ওর শেষ রোগী। সীট থেকে ক্লান্ত দেহটাকে টেনে। তুলতে রীতিমত বেগ পেতে হলো ওকে।
হাঁপানি রোগী বিছানায় বসে ওর প্রিয় পুরনো খেলাটা খেলছিল; এক পাত্র থেকে তুলে গুনে গুনে অপর পাত্রে রাখছিল শুকনো মটরদানা। রিওকে দেখে চোখ তুলে চাইল সে, আনন্দে ডগমগ করে উঠল ওর মুখ।
আসুন, ডাক্তার সাহেব। চারদিকে কলেরা শুরু হয়েছে, না?
এসব চিন্তা কে ঢোকাল আপনার মাথায়?
কেন, কাগজে দেখলাম। রেডিও-তেও শুনেছি।
না, কলেরা নয়।
উত্তেজিত হয়ে উঠল হাঁপানি বুড়োর চোখমুখ। হেসে বলল, কর্তারা তাহলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না।
সে রাতে তিরিশজন রোগীর খবর পৌঁছল কর্তৃপক্ষের কাছে। রিওকে টেলিফোন করল ডাক্তার ক্যাসেল।
রিও, স্পেশাল ওয়ার্ডে কতগুলো বেড আছে?
আশিটা।
রোগীর সংখ্যাও নিশ্চয়ই তিরিশের বেশি হবে।
এখন দুধরনের রোগী। একদল ভুগছে আতঙ্কে। আর অন্য দল আতঙ্কিত হওয়ার আগেই চলে যাচ্ছে কবরস্থানে। এদের সংখ্যাই বেশি। না বুঝতে পারছি। কবরস্থানে লাশ পরীক্ষা করে দেখা হয়?
না। রিচার্ডকে টেলিফোনে বলেছিলাম শুধু নোটিস এবং ইস্তেহার দিয়ে কোন লাভ হবে না; রোগের বিরুদ্ধে সত্যিকারের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে; আর নয়তো কিছু না করাই ভাল।
ঠিক বলেছ। তো ও কী বলল?
বলল ওর করার কিছু নেই। ক্ষমতা নেই। এইসব অজুহাত আরকি। কিন্তু আমার ধারণা, অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে।
রিও-র কথা বাস্তবে রূপ নিল। তিন দিনে রোগীতে ভরে গেল স্পেশাল ওয়ার্ড। রিচার্ড ওকে জানাল, শিশুদের একটা স্কুল দখল করে সেখানে অস্থায়ী হাসপাতাল খোলার কথাবার্তা চলছে। রিও অপেক্ষা করতে লাগল, প্যারিস থেকে কবে আসবে সিরাম।
বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি আরম্ভ করল ডাক্তার ক্যাসেল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাল লাইব্রেরিতে। ও সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, ইঁদুরগুলো মারা গেছে প্লেগ কিংবা তারই কাছাকাছি কোন রোগে, ফলে লক্ষ লক্ষ মাছির জন্ম হয়েছে শহরে; এখনি ওগুলোকে ধ্বংস করতে না পারলে জ্যামিতিক হারে বাড়বে প্লেগের জীবাণু।
হু-হু করে বেড়ে চলল, প্লেগের শিকার। প্রথম দিন মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল মোলোয়। দ্বিতীয় দিন চব্বিশে। তৃতীয় দিনে আটাশ। এবং চতুর্থ দিনে বত্রিশ। এ-দিনে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হলো; শিশুদের স্কুলটাতে অস্থায়ী হাসপাতাল ভোলা হয়েছে।
প্রিফেক্টকে টেলিফোন করে রিও বলল, স্যার, যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাতে কোন লাভ হচ্ছে বলে তো মনে হয় না।
হ্যাঁ, সাড়া দিলেন প্রিফেক্ট। মৃতের সংখ্যা আমি দেখেছি। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে অবস্থা উদ্বেগজনক।
শুধু উদ্বেগজনক নয়, এতে সবকিছুই বোঝা যাচ্ছে।
ঠিক আছে। আমি সরকারকে নির্দেশ দেবার জন্যে অনুরোধ করব।
রিচার্ড-এর মাধ্যমে রিও-র কাছে অনুরোধ করলেন প্রিফেক্ট, বর্তমান পরিস্থিতির ওপর একটা বিবরণী তৈরি করতে হবে ওকে; কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে ওটা।
বিবরণী তৈরি করল রিও। ওতে থাকল রোগের বিভিন্ন উপসর্গের বর্ণনা, মৃতের সংখ্যা। সেদিন মারা গিয়েছিল চল্লিশজন। প্রিফেক্ট নিজে সবকিছু তদারকির দায়িত্ব নিলেন।
পরের দিন প্লেনে প্যারিস থেকে এল সিরাম। আপাতত যা, এসেছে যথেষ্ট। কিন্তু রোগের প্রকোপ বাড়লে ওতে কুলোবে না। প্যারিসে আবার তার পাঠাল রিও। উত্তর এল, জরুরী অবস্থা মোকাবিলায় যে মজুদ ছিল তার সবটাই শেষ হয়ে গেছে; নতুন করে তৈরি করার প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে ঋতুতে এল পালা বদল। শহরতলি থেকে শহরের দিকে পা বাড়াল বসন্ত। রাস্তার দুপাশে, বাজারে, দেখা দিল ফুল বিক্রেতারা। ঝুড়িভর্তি শুধু গোলাপ আর গোলাপ। বাতাস ভারি হয়ে উঠল ওদের সুবাসে।
মহামারীর আক্রমণটাও কেমন যেন শিথিল হয়ে এল। কোন দিন মৃতের সংখ্যা নেমে আসে মাত্র দশজনে। আবার কোন দিন লাফ দিয়ে ওঠে অনেক ওপরে। এমনই একদিন, মৃতের সংখ্যা পৌঁছল তিরিশে। সেদিন, রিওকে একটা সরকারি টেলিগ্রাম পড়তে দিলেন প্রিফেক্ট।
টেলিগ্রামে লেখা আছে: ঘোষণা করো, শহরে প্লেগ দেখা দিয়েছে। বন্ধ করে দাও শহরের দরজা।
২য় পর্ব : উদ্বেগের কারণ প্লেগ
দ্বিতীয় পর্ব
২.০১
এখন থেকে সবার কাছে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াল প্লেগ। এতদিন শহরবাসী ওদের চারপাশে বিচিত্র ঘটনা ঘটতে দেখে বিস্ময় বোধ করলেও যতদূর সম্ভব তারই ভেতর নিজেদের স্বাভাবিক কাজ-কর্ম চালিয়ে গেছে। কিন্তু শহরের ফটক বন্ধ করে দেয়ার পর ওদের সম্মুখীন হতে হলো বঞ্চনার। মাত্র কয়েকদিন আগেও পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় ওরা ধরে নিয়েছিল ওদের এই ছাড়াছাড়ি সাময়িক। প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে সামান্য দু-একটা মামুলি কথাবার্তা বলে, একটু চুমু খাওয়াখাওয়ি করে বিদায় নিয়েছে ওরা, ধরে নিয়েছিল মাত্র কয়েকদিন পরেই আবার দেখা হবে ওদের। এখন হঠাৎ দেখল, বড় অসহায়ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সবাই।
লোকজন ব্যাপারটা বোঝার বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই বন্ধ করে দেয়া হয় শহরের ফটক, তাই ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করার কোন অবকাশই পায়নি কেউ। ফলে ওরা এমন আচরণ করতে বাধ্য হলো যা থেকে মনে হলো ব্যক্তিগত অনুভূতি বলতে কিছুই নেই ওদের। শহর ছাড়ার আবেদনপত্র নিয়ে প্রিফেক্ট এর অফিস ঘেরাও করল জনতা। কিন্তু কাউকেই বাইরে যাবার অনুমতি দেয়া হলো না।