মানুষকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে নোটিসে। উপদেশ দেয়া হয়েছে: কেউ যদি নিজের শরীরে ঘনঘন। মাছি বসতে দেখেন, তাহলে তক্ষুণি মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে খবর দেবেন; বাড়িতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে জানাবেন; তাকে পাঠাতে হবে বিশেষ ওয়ার্ডে।
আরও কিছু অতিরিক্ত নিয়ম পালনের নির্দেশ রয়েছে নোটিসে। তার একটা হচ্ছে: রোগীর ঘর এবং যে গাড়িতে রোগী চলাফেরা করেছে সেগুলো যাতে জীবাণুমুক্ত থাকে, তার জন্যে বাধ্যতামূলকভাবে ওগুলোতে জীবাণুনাশক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।
নোটিস পড়ে হাসপাতালের দিকে চলল রিও। ওখানে ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল গ্রাঁদ। রিওকে দেখেই নাটকীয়ভাবে দুই হাত তুলল।
হ্যাঁ, শুনেছি, বলল রিও, মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
আগের দিন দশজন মরার খবর পাওয়া গেছে।
সম্ভবত সন্ধেয় আপনার সঙ্গে দেখা হবে। তখন আমি কটার্ড-এর কাছে যাব, গ্রাঁদকে বলল রিও।
তাহলে ওর খুব উপকার হয়, গ্ৰাঁদ বলল, ভদ্রলোক হঠাৎ যেন পাল্টে গেছেন।
কিভাবে?
আগের চেয়ে ওকে এখন অনেক অমায়িক মনে হয়।
আগে অমায়িক ছিল না?
প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেল গ্রাঁদ। কটার্ড অমায়িক নয়, এটা ও বলতে পারে না। তবে কার্ড কিছুটা চুপচাপ আর গোপন স্বভাবের মানুষ। কখনও কখনও সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে যায়। আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে চুপি চুপি।
কটার্ড গ্ৰাঁদকে জানিয়েছে, ও মর্দজাতীয় পানীয়-র বিক্রেতা। প্রায়ই ওর কাছে দুতিনজন লোককে আসা-যাওয়া করতে দেখেছে গ্ৰাঁদ। হয়তো ওর খদ্দের।
মাঝে মাঝে সিনেমা হলে ঢোকে কটার্ড। যেসব ছবিতে মারামারি গোলাগুলি আছে সেগুলো দেখার ঝোঁক একটু বেশি ওর।
মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে কটার্ড। মানুষ সম্পর্কে ভীষণ সন্দেহপরায়ণ ও। কিন্তু গ্রাঁদ লক্ষ করেছে, কিছুদিন থেকে একেবারেই পাল্টে গেছে মানুষটা।
ইদানীং সবার সঙ্গে ও একটা ভাব গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। নিজেই যেচে আমার সঙ্গে কথা বলে, গ্রাঁদ বলল।
ইঁদুর মরা দেখে হয়তো ওর মাথায় গোলমাল হয়েছিল, মন্তব্য করল রিও, আর এখন জ্বর দেখে খুব ঘাবড়ে গেছে।
আমার মনে হয় আপনার ধারণা ঠিক নয়। আমার মতে…, কথার মাঝপথে থেমে গেল গ্রাঁদ। একটা বিকট ঝনঝন শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওদের সামনে দিয়ে পার হলো ইঁদুর ধ্বংসকারী ভ্যান।
আমার ধারণা কোন ব্যাপারে ও ওর বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে আছে, গম্ভীরভাবে বলল গ্রাঁদ।
.
বিকেলে ক্যাসেল-এর সঙ্গে কথা হলো রিও-র। প্যারিস থেকে এখনও সিরাম এসে পৌঁছায়নি।
এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বলল রিও। সিরাম আদৌ কোন কাজে লাগবে কিনা সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ হচ্ছে। জীবাণুগুলো কেমন অদ্ভুত।
দেখো, রিও, ওকে বাধা দিয়ে বলল ক্যাসেল। আমি তোমার সাথে একমত নই। এগুলো আসলেই অদ্ভুত। কিন্তু আসলে ওরা একই গোষ্ঠীর।
সন্ধ্যায় কটার্ড-এর বাসায় গেল রিও। খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ও। টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে একটা ডিটেকটিভ বই, খোলা।
আপনার শরীর কেমন? জানতে চাইল রিও।
মোটামুটি ভালই, চেয়ারে বসে বেশ ঝাঁঝের সাথে বলল কটার্ড। কেউ জ্বালাতন করবে না এই নিশ্চয়তা থাকলে আরও ভাল থাকতাম।
মানুষ সবসময় একা থাকতে পারে না।
আপনি ভুল বুঝেছেন। আমি তা বলিনি। আমি বলছিলাম সেইসব লোকের কথা, যারা একজন মানুষের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহল দেখায় মানুষটিকে বিপথে ফেলার জন্যে।
আমি আপনার সাথে একমত। এ ধরনের অধিকার কারুর। নেই। কিন্তু আপনার উচিত মাঝে মাঝে বাইরে বেরুনো। এভাবে সারাক্ষণ ঘরে থাকা ঠিক নয়।
বাসায় আর কতক্ষণ থাকি। সবসময় তো বাইরে বাইরেই ঘুরতে হয়, বেশ বিরক্তির সুরে বলল কার্ড।
রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল কটার্ড-এর ঘর। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল রিও। ওকে অনুসরণ করল কটার্ড।
হঠাৎ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি, আপনার ওয়ার্ডে ভর্তি করবেন, তো?
অবশ্যই।
হাসপাতাল থেকে পুলিস কখনও অসুস্থ মানুষকে গ্রেপ্তার করে?
অমন ব্যাপার আগে ঘটেছে। তবে তা নির্ভর করে অসুস্থতার ওপর।
আপনি তো শহরের দিকে যাচ্ছেন। আমাকে একটু পৌঁছে দেবেন?
শহরের মাঝামাঝি পৌঁছে কটার্ড-এর অনুরোধে গাড়ি থামাল রিও। পাশে একদল বাচচা এক্কা-দোক্কা খেলছিল। ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে কটার্ড প্রশ্ন করল, সবাইকে দেখছি মহামারী মহামারী করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তেমন কোন আশঙ্কা আছে?
মানুষ সবসময় একটা না একটা হুজুগ নিয়ে থাকতে চায়। এটাই তো স্বাভাবিক।
ঠিক বলেছেন। হঠাৎ দশটা লোক মারা গেলে মানুষ ভাবে কেয়ামত এসে গেছে। কিন্তু আমি এখন ওরকম কিছু আশা করি না।
তাই! তাহলে কী আশা করেন?
গাড়ির দরজাটা চেপে ধরল কটার্ড। চলে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল, ভূমিকম্প। ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাক।
পরের দিন শহরের এমাথা-ওমাথা ছুটাছুটি করল রিও। কয়েকদিন থেকে নিজের পেশাটা ওর কাছে মনে হচ্ছে এক কঠিন বোঝ। এতদিন দেখেছে, রোগীরা স্বেচ্ছায় নিজেদের পুরোপুরি ছেড়ে দেয় ওর হাতে। কিন্তু কয়েকদিন থেকে ও উপলব্ধি করছে, ওর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে চাইছে ওরা। রোগ আড়াল করতে চাইছে। কেমন একটা আক্রোশ নিয়ে ওরা তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।