‘আপনি বোধহয় জানেন, আমরা আপনাকে নিয়ে বেশকিছু ফিচার লিখছি। গরমকালে সবসময় আমাদের খবরের ভাণ্ডার শূন্য থাকে; আর এখন আপনার এবং আপনার পরের মামলাটা ছাড়া লেখার মতো তেমন কিছু নেই। পরের মামলাটা বোধহয় শুনেছেন যে একটি পিতৃহত্যা মামলা।‘
প্রেস-টেবিলে বসে-থাকা একটি দলের দিকে তিনি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, যেখানে মোটাসোটা ছোটখাটো একজন বসে ছিলেন। চোখে তার বড় কালো ফ্রেমের চশমা, দেখলেই পেটুক কোনো বেজির কথা মনে পড়ে।
‘ঐ লোকটি প্যারিসের একটি সংবাদপত্রের বিশেষ প্রতিনিধি। অবশ্য আপনার মামলার ব্যাপারে সে এখানে আসেনি। তাকে পাঠানো হয়েছিল পিতৃহত্যা মামলাটার ব্যাপারে কিন্তু তারা এখন তাকে আপনার মামলার ব্যাপারেও খবর পাঠাতে বলেছে।’
মুখ ফসকে প্রায় বলে ফেলেছিলাম, ‘তাদের অশেষ দয়া’, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল কথাটা হাস্যকর ঠেকবে। এরপর আন্তরিকভাবে হাত নেড়ে তিনি বিদায় নিলেন এবং তারপর কিছুক্ষণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটল না।
এরপর আমার উকিল সহকর্মী-পরিবেষ্টিত হয়ে ব্যস্তভাবে গাউন পরে ঢুকলেন। সাংবাদিকদের টেবিলের কাছে গিয়ে তিনি তাদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। যতক্ষণ-না তীক্ষ্ণভাবে ঘণ্টা বেজে উঠল ততক্ষণ তারা সবাই একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে হাসি-ঠাট্টা করতে লাগলেন যেন তারা কোনো ঘরোয়া পরিবেশে আছেন, তারপর সবাই নিজ নিজ জায়গায় ফিরে গেলেন। আমার উকিল কাছে এসে আমার সঙ্গে করমর্দন করে উপদেশ দিলেন নিজ থেকে যেন আমি কিছু না বলি এবং সব প্রশ্নের উত্তর যেন সংক্ষেপে দিই। আমাকে তিনি তাঁর ওপর নির্ভর করতে বললেন।
আমার বামপাশে চেয়ার টানার শব্দ হল এবং লম্বা পাতলা, চশমা পরনে একজন ভদ্রলোক চেয়ারে বসতে বসতে লাল গাউনের ভাজ ঠিক করলেন। আমার মনে হল ইনিই সরকারি উকিল। আদালতের একজন কেরানি ঘোষণা করল, মাননীয় বিচারকরা আসছেন এবং ঠিক সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপরে দুটো বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরতে শুরু করল। তিনজন বিচারক, দুজন কালো এবং একজন লাল রঙের পোশাক পরে, হাতে ব্রিফকেস নিয়ে ঘরে ঢুকলেন এবং তাদের আসনের দিকে ধীরগতিতে এগিয়ে গেলেন; আসনটি আদালতের মেঝ থেকে বেশ কয়েক ফুট উঁচু। লাল-পোশাক-পরা জন মাঝখানে উঁচু পিঠের চেয়ারটিতে বসে টেবিলের ওপর আদালতের বিশেষ টুপিটি রাখলেন, ছোট্ট টাকপড়া মাথায় রুমাল বুলোলেন এবং অতঃপর ঘোষণা করলেন, এখন শুনানি শুরু হবে।
সাংবাদিকরা কলম নিয়ে প্রস্তুত হলেন। তাদের সবার মুখের ভাব একই রকম বিদ্রুপাত্মক, নিস্পৃহতা মাখানো। শুধু একজন, পরনে তার ধূসর ফ্লানেলের পোশাক ও লাল টাই এবং বয়সে অন্যদের তুলনায় বেশ ছোট, কলমটি টেবিলের ওপর রেখে কঠোরভাবে আমাকে দেখছিল। মুখ তার গোলগাল, কিন্তু আমাকে আকৃষ্ট করল তার চোখ যা স্নান, টলটলে; তার আবেগহীন চোখ আমাকে বিদীর্ণ করছিল। মুহূর্তে আমার মনে এক অদ্ভুত ধারণার সৃষ্টি হল, আমি যেন নিজেকেই খুঁটিয়ে বিচার করছি। এ-ব্যাপারটা এবং আদালতের কার্যক্রম সম্পর্কে অনভিজ্ঞতার দরুন আদালতের প্রথমদিককার কার্যক্রম আমি ধরতে পারিনি। জুরি, সরকারি উকিল, জুরিদের ফোরম্যান এবং আমার উকিলের প্রতি প্রধান বিচারকের প্রশ্নাবলি (যখনই তিনি কিছু বলছিলেন তখনই জুরিরা উন্মুখ হয়ে তার দিকে তাকাচ্ছিল), দ্রুত চার্জশিট পড়া–এসব চলাকালীন কিছু পরিচিত জায়গা এবং লোকের নাম চিনলাম, তারপর আমার উকিলের প্রতি কিছু সম্পূরক প্রশ্ন রাখা হল।
এরপর বিচারক ঘোষণা করলেন যে, সাক্ষীদের ডাকা হবে। কেরানি যেসব নাম পড়ল তার মধ্যে কিছু নাম আমাকে বিস্মিত করল। আদালতে দর্শক যারা তখন পর্যন্ত আমার কাছে অস্পষ্ট মুখের সারিমাত্র, তাদের মাঝ থেকে উঠে দাঁড়াল রেমন্ড, ম্যাসন, সালামানো, বাড়ির দারোয়ান, বৃদ্ধ পিরেজ, এবং মারি, যে পাশের দরজা দিয়ে বের হওয়ার জন্যে অন্যদের অনুসরণ করার আগে নার্ভাস হয়ে হাত নাড়ল। আশ্চর্য হয়ে গেলাম এই ভেবে যে সবশেষে সেলেস্তের নাম ডাকার আগ। পর্যন্ত আমি তাদের কাউকেই দেখিনি। সেলেস্তে উঠে দাঁড়াবার পর লক্ষ করলাম যে তার পাশে পুরুষদের কোট পরে নিরুত্তেজ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছেন একজন মহিলা যিনি রেস্তোরাঁয় এক টেবিলে বসে একবার আমার সঙ্গে খেয়েছিলেন। লক্ষ করলাম, স্থিরভাবে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু তাকে নিয়ে ভাববার সময় আমার ছিল না, কারণ বিচারক আবার তার কথা শুরু করেছেন।
তিনি বললেন, বিচারের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে এবং বলা বাহুল্য দর্শকরা যে কোনো ধরনের মনোভাব প্রকাশে বিরত থাকবেন, এটাই তিনি আশা করেন। তিনি বললেন, বিচারের কার্যপ্রণালী পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিনি এসেছেন, অনেকটা আম্পয়ারের মতো এবং তিনি সাবধানতার সঙ্গে পক্ষপাতহীনভাবে বিচার করবেন। ন্যায়বিচারের আলোকে তিনি জুরিদের মত পর্যালোচনা করবেন। সবশেষে, বিন্দুমাত্র গণ্ডগোল হলে আদালত-কক্ষ থেকে তিনি সবাইকে বের করে দেবেন।
বেলা বাড়ছে। দর্শকদের কেউ-কেউ পত্রিকা দিয়ে বাতাস খাচ্ছে, কোঁচকানো কাগজের খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রধান বিচারকের নির্দেশে কেরানি তিনটি হাতপাখা নিয়ে এল। এবং বিচারক তিনজন সঙ্গে সঙ্গে এগুলি কাজে লাগালেন।