সিগারেটের স্বল্পতাও ছিল একধরনের শাস্তি। বন্দি হিসেবে যখন আমাকে আনা হয়েছিল তখন আমার বেল্ট, জুতোর ফিতা, সিগারেটসুদ্ধ পকেটের যাবতীয় জিনিস নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেলে রাখার পর আমি আমার সিগারেট ফেরত চাইলাম। ধূমপান নিষিদ্ধ, তারা জানাল। এই ব্যাপারটাই আমাকে অসহায় করে দিয়েছিল; এবং সত্যি বলতে কি প্রায় কয়েকটা দিন আমার খুবই খারাপ কেটেছিল। এমনকি তখন আমার কাঠের বিছানা থেকে চেলা ছিঁড়ে চুষেছিলাম পর্যন্ত। সারাদিন ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছি, মেজাজটা পর্যন্ত খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না কেন আমায় ধূমপান করতে দেয়া হবে না; এটা তো আর কারও ক্ষতি করছে না। পরে কারণটা বুঝলাম; এই কাপর্ণও ছিল আমার শাস্তির একটা অংশ। কিন্তু বুঝে উঠতে উঠতে ধূমপানের জন্যে আমার ব্যাকুলতা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং তখন আর এটা আমার জন্যে কোনো শাস্তি ছিল না।
এই অভাবগুলি ছাড়া আমি খুব-একটা অসুখী ছিলাম না। কিন্তু তবুও একটা বড় সমস্যা ছিল : কীভাবে সময় কাটানো যায়। কিন্তু যখন থেকে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করার কায়দাটা রপ্ত করলাম তখন সময় কাটানোটা একটা সমস্যাই মনে হল না। মাঝে মাঝে আমার শোবার ঘরের কথা চিন্তা করতাম, এক কোণ থেকে শুরু করে আরেক কোণ অবধি চোখ বুলিয়ে যেতাম, চোখ বুলাতাম প্রতিটি আসবাবপত্রে। প্রথমদিকে এর জন্যে লাগত এক কি দু-মিনিট। কিন্তু এরপর যতবার ভাবতাম, সময়ের সীমাও তত বাড়তে লাগল। প্রতিটি আসবাবপত্রকে আলাদা আলাদাভাবে দেখতাম, এর ওপরে বা ভিতরে কী আছে তাও দেখতাম, তারপর প্রতিটি জিনিসের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিসগুলিতেও নজর দিতাম, যেমন : কোথাও একটি আঁচড় লেগেছে, কোথাও একটু ভেঙে গেছে, সেগুলির রং, সবকিছু নিয়ে ভাবতাম। আসবাবপত্রের তালিকাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, কোনো জিনিস না-ছেড়ে, মনে রাখার চেষ্টা করতাম। এর ফলে কয়েক সপ্তাহ পর থেকে আমি আমার শোবার ঘরের জিনিসপত্রের কথা চিন্তা করে ঘন্টার পর ঘণ্টা কাটাতে পারতাম। যতই চিন্তা করতাম। ততই আধা-ভুলে-যাওয়া বা ভুলে-যাওয়া জিনিসের কথা, তাদের বিবরণ আমার স্মৃতিতে অনুরণন তুলত। এর কোনো শেষ ছিল না।
সুতরাং বুঝতে পারলাম কারও যদি বাইরের জগৎ সম্পর্কে একদিনের অভিজ্ঞতা থাকে তবে সে অনায়াসে একশো বছর জেলে কাটাতে পারবে। স্মৃতির ফোয়ারা তাকে হতাশ হতে দেবে না। একদিক দিয়ে, অবশ্যই, এটা ছিল একধরনের ক্ষতিপূরণ।
তারপর আসে ঘুমের পালা। প্রথমদিকে, রাতে আমার ভালো ঘুম হত না, দিনে তো না-ই। কিন্তু আস্তে আস্তে রাতগুলি চমৎকার হয়ে উঠল, দিনেও ঝিমোতে লাগলাম। সত্যি বলতে কি, শেষের দিনগুলিতে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি ষোলো থেকে আঠারো ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। বাকি থাকত ছ’ঘণ্টা–এ সময়টা খাবার খেয়ে, প্রাতকৃত্যাদি সেরে, স্মৃতি রোমন্থন করে আর চেক গল্পটা পড়ে কেটে যেত।
একদিন, আমার মাদুরটা উলটেপালটে দেখার সময় নিচের দিকে দেখলাম পত্রিকার একটি টুকরো আটকে আছে। পুরনো হয়ে যাওয়ায় কাগজটি হয়ে গেছে বিবর্ণ, হলুদ, কিন্তু তবুও অক্ষরগুলি পড়া যাচ্ছিল। গল্পটি ছিল অপরাধ-বিষয়ক। গল্পের প্রথম অংশটি ছিল না, তবুও অনুমান করে নেয়া যায় চেকোস্লোভাকিয়ার কোনো গ্রামে এই ঘটনার কিছু অংশ ঘটেছিল। জনৈক গ্রামবাসী ভাগ্যান্বেষণে গ্রাম ছেড়ে বিদেশ যাত্রা করেছিল। পঁচিশ বছর পর একজন অবস্থাপন্ন লোক হিসেবে স্ত্রী এবং পুত্রকন্যাদের নিয়ে সে গ্রামে ফিরে আসে। ইতোমধ্যে তার মা ও বোন, সে যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিল সেখানে একটি ছোট হোটেল খুলে ব্যাবসা শুরু করে দিয়েছিল। তাদের অবাক করে দেওয়ার জন্যে স্ত্রী-পুত্রদের অন্য একটি সরাইখানায় রেখে সে ছদ্মনামে তার মা’র হোটেলে একটি ঘর ভাড়া। করল। তার মা এবং বোন তাকে একেবারেই চিনতে পারেনি। সন্ধেয় খাবার সময় সে তাদের নিজের টাকার বেশকিছু দেখাল এবং রাতে তারা তাকে হাতুড়ির আঘাতে হত্যা করল। টাকাপয়সা সরিয়ে নেবার পর তার মৃতদেহটিকে নদীতে ভাসিয়ে দিল। পরদিন সকালে, লোকটির স্ত্রী এসে কোনোকিছু না-ভেবেই স্বামীর পরিচয় ফাঁস করে দিল। তার মা গলায় দড়ি দিল। বোন একটি কুয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাজারবার বোধহয় আমি গল্পটি পড়েছিলাম। একদিকে ব্যাপারটা যেমন অবিশ্বাস্য ঠেকত, অন্যদিকে আবার বিশ্বাসযোগ্যও মনে হত। যাহোক, আমার মতে লোকটি নিজেই তার বিপদ ডেকে এনেছিল; এ-ধরনের বোকামি করা কারও উচিত নয়।
সুতরাং, দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে, স্মৃতিচারণ করে, খবরের কাগজের টুকরোটা পড়ে, আলো-আঁধারের স্রোতে দিনগুলি কেটে যেতে লাগল। আগে পড়েছিলাম, জেলে থাকলে সময়ের হিসাব রাখা যায় না। অবশ্য এগুলি আমার কাছে তেমন কোনো অর্থ নিয়ে দাঁড়ায়নি। দিনগুলি ছোট কি বড় বুঝতাম না। সন্দেহ নেই দিনগুলি বড় ছিল, কিন্তু একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে যেত; এসব নিয়ে আমি ভাবিনি। দুটো শব্দ তখনও আমার কাছে অর্থবোধক ছিল : ‘গতকাল’ এবং ‘আগামীকাল’।
একদিন যখন ওয়ার্ডার এসে জানাল জেলে আমার ছ’মাস কেটে গেছে তখন তাকে বিশ্বাস করলাম–কিন্তু শব্দগুলি আমার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না। আমার কাছে মনে হল, যেদিন থেকে সেলে আছি সেদিন থেকে এ-পর্যন্ত ঐ একটি দিনই কেটেছে, এবং আমিও সবসময় একটি কাজই করেছি।