এটা শুনে আমরা আঁতকে উঠি আর ব্যথা পাই যে, অনেকজাতেরই আমাদের ইহুদিদের সম্বন্ধে মনোভাবের বদল হয়েছে। আগে শোনা যায়, এ সব মহলে কেউ কখনও ইহুদিবিদ্বেষের কথা ভাবতও না, এখন তাদের মধ্যে এ জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা আমাদের সবাইকেই খুব ভাবিয়ে তুলেছে। ইহুদিদের প্রতি ঘৃণার কারণগুলো বোঝা যায়, এমন কি সময় সময় তা মানবিকও বটে, কিন্তু জিনিসটা ভালো নয়। খৃস্টানরা দোষ দিয়ে বলে যে, ইহুদিরা জার্মানদের কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে; সাহায্যকারীদের প্রতি তারা বেইমানি করেছে; আরও অনেকের কপালে যা জুটেছে, সেই একই দুর্ভাগ্য বহু খৃস্টানকে বরণ করতে হয়েছে ইহুদিদের মারফত, এবং পেতে হয়েছে ভয়াবহ শাস্তি আর সাংঘাতিক পরিণতি।
এ সবই সত্যি। কিন্তু এসব জিনিস সব সময়ই দুই তরফা দেখা উচিত। আমাদের অবস্থায় পড়লে খৃষ্টানরা কি অন্য রকমের আচরণ করত? পেট থেকে কি ভাবে কথা বের করতে হয় জার্মানরা তার কায়দা জানে। ইহুদি হোক, খৃস্টান হোক–কেউ যদি সম্পূর্ণ ভাবে ওদের মুঠোয় গিয়ে পড়ে, তাহলে সব সময় কি কথা না বলে থাকতে পারে? প্রত্যেকেই জানে, বাস্তবে তা অসম্ভব। কেন তাহলে লোকে ইহুদিদের কাছে এই অসম্ভবের দাবি করবে?
গুপ্তভাবে যারা কাজ করছে, তাদের মহলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে–যে সব জার্মান ইহুদি হল্যাণ্ড ছেড়ে এখন পোল্যান্ডে গিয়ে আছে, তাদের হয়ত এখানে ফিরতে দেওয়া হবে না; এক সময় তাদের হল্যাণ্ডে শরণাগতের অধিকার মিলেছিল, কিন্তু হিটলার চলে গেলে তাদের আবার জার্মানিতে ফিরে যেতে হবে।
এটা শুনলে স্বভাবতই তখন ভেবে অবাক লাগে, কেন আর আমরা এই দীর্ঘ আর কঠিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা সর্বদাই শুনছি আমরা নাকি সকলে কাঁধে কাঁধ দিয়ে স্বাধীনতা, সত্য আর ন্যায়ের জন্যে লড়ছি। লড়াই করা অবস্থাতেই কি অনৈক্য মাথা চাড়া দেবে ইহুদির কুদর কি আবারও আর কারো চোখে কম বলে গণ্য হবে? এটা দুঃখের, খুবই দুঃখের যে, আবারও, এই নিয়ে কতবার যে সেই পুরনো সত্যটি প্রমাণিত হল–একজন খৃস্টান কিছু করলে তার জন্যে সে নিজে দায়ী, একজন ইহুদি কিছু করলে তার দায় সব ইহুদিদের ঘাড়ে পড়বে।’
সত্যি বলছি, এটা আমি বুঝি না–যে ডাচেরা মানুষ হিসেবে এত ভালো, সৎ, সাচ্চা। কেন তারা আমাদের এভাবে দেখবে? আমরা তো দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিপীড়িত, সবচেয়ে অসুখী এবং বোধহয় সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষ।
আমার একটাই আশা, এবং সেটা হল, এই ইহুদিবিদ্বেষের ব্যাপারটা থাকবে না, ডাচেরা দেখিয়ে দেবে তারা কী, এবং তারা কখনও টলমল করবে না আর ন্যায়বোধ হারাবে না। কেননা ইহুদিবিদ্বেষ অন্যায়।
যদি এই সাংঘাতিক হুমকি কার্যত সত্যি হয়, তাহলে ইহুদিদের এই অবশিষ্ট ছোট্ট দুঃখার্ত দলটিকে হল্যাণ্ড ছেড়ে চলে যেতে হবে। ছোট ছোট পোটলাপুঁটলি নিয়ে আমাদেরও আবার পাড়ি দিতে হবে, ছেড়ে যেতে হবে এমন সুন্দর দেশ, যা আমাদের একদিন সোৎসাহে স্বাগত জানিয়েছিল এবং আজ যা আমাদের দিকে পিঠ ফিরিয়েছে।
আমি হল্যাণ্ডকে ভালবাসি। আমার কোনো স্বদেশ না থাকায় আশা করেছিলাম এটাই হয়ত তবে আমার পিতৃভূমি। আমি এখনও সেটাই হবে বলে আশা রাখি।
তোমার আনা।
.
বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
প্রত্যেক দিনই তাজা কিছু। আজ সকালে আমাদের সব্জিঅলাকে তুলে নিয়ে গেল। ওর বাড়িতে নাকি দুজন ইহুদিকে ও থাকতে দিয়েছিল। এটা আমাদের পক্ষে একটা বড় আঘাত। শুধু এজন্যে নয় যে, ঐ দুই ইহুদি বেচারা রসাতলের কিনারায় এসে টাল সামলাতে চেয়েছে; ঐ লোকটার পক্ষেও এটা খুব মর্মান্তিক।–দুনিয়ার আজ ওলটপালট অবস্থা; যারা নমস্য ব্যক্তি, তাদের পাঠানো হচ্ছে বন্দীনিবাসে, জেলখানায় আর নির্জন কুঠুরিতে; যারা নীচ, তারা থেকে গিয়ে আবালবৃদ্ধের, ধনী দরিদ্রের মাথায় ছড়ি ঘোরাচ্ছে। একজনের যদি ফাদে পা পড়ে কালোবাজার ঘুরে, তবে দ্বিতীয়জনের পড়ে অজ্ঞাতবাসে যাওয়া ইহুদি বা অন্য লোকদের সাহায্য করতে গিয়ে। স্থানীয় নাসীদের দলের লোক না হলে কবে যে কার কী হয় কেউ বলতে পারে না।
সব্জিঅলার চলে যাওয়া আমাদের খুব ক্ষতির কারণ হয়েছে। আমাদের ভাগের আলু টেনে তুলতে ছোট মেয়েরা পারে না। তাদের দেওয়াও হয় না। কাজেই একমাত্র উপায় খাওয়া কমানো। এটা আমরা কিভাবে করব বলছি। তবে তাতে কষ্টের কিছু লাঘব হবে না। মা-মণি বলছেন আমরা প্রাতঃরাশের পাট তুলে দেব। দুপুরে খাব ডালিয়া আর রুটি; সন্ধ্যের খাওয়াটা আমরা সারব ভাজা আলু এবং হয়ত সপ্তাহে দুবার সব্জি বা লেটুস দিয়ে। ব্যস, আর কিছু নয়। এতে আমাদের পেটের ক্ষিধে মরবে না; কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার চেয়ে সেও বরং ভালো।
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ২৬ মে, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে জানালার ফোকরের সামনে আমার টেবিলে এসে নিরিবিলিতে বসতে পেরেছি। তোমাকে সব কিছু লিখে জানাব।
গত কয়েকমাসের মধ্যে নিজেকে কখনও এত মনমরা লাগেনি। এমন কি সিঁদকাটার ঘটনার পরও আমি সে সময়ে এখনকার মতো এতটা ভেঙে পড়িনি। একদিকে সব্জিঅলা, সারা বাড়িতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচিত ইহুদি সমস্যা, আক্রমনের বিলম্ব, অখাদ্য খাবার, দেহমনের ওপর ধকল, চারদিকের হতচ্ছাড়া আবহাওয়া, পেটার সম্পর্কে আমার আশাভঙ্গ; অন্যদিকে এলির বাগদানের ব্যাপার, হুইটসানের আদর অভ্যর্থনা, ফুল, ক্রালারের জন্মদিন, চিত্রবিচিত্র কেক আর সেই সঙ্গে ক্যাবারে, সিনেমা আর কনসার্টের গল্প। সেই পার্থক্য, সেই বিরাট পার্থক্য তো সব সময়ই আছে। একদিন আমরা হো হো করে হাসি, কোনো একটা অবস্থার মজার দিকটা ঠিক চোখে পড়ে; আবার ঠিক পরের দিনই আমাদের মুখ শুকিয়ে যায়; আমাদের মুখের মধ্যে ফুটে ওঠে ভয়, অনিশ্চয়তা আর হতাশ্বাস।