- বইয়ের নামঃ মঞ্চভীতি
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
মঞ্চভীতি
০১.
এই কাজও কোরো না, কিশোর! সাবধান করল মুসা আমান। টেবিলের ওপাশ থেকে তাকিয়ে আছে।
খপ করে কিশোরের হাত চেপে ধরল জিনা, মরবে!
ডাক্তার আছে নাকি এখানে? বলল রবিন।
ভিড়ের দিকে তাকাল সে। রকি বীচ শপিং মলের একটা খাবারের দোকানে রয়েছে ওরা। রঙিন নিওন আলোয় রাঙা মুখ। এককোণে তাকের অনেক ওপরে চলছে একটা টেলিভিশন, ভিসিআরে পুরানো ছবি দেখানো হচ্ছে তাতে। দেখছে আর হাসছে লোকে।
একটু ভুরু উঁচু করল কিশোর। মুসা আর রবিনের দিকে তাকাচ্ছে না। গরমের ছুটি শেষ হয়ে এসেছে। আবার শুরু হবে স্কুল, তার আগেই শরীরটাকে যতটা সম্ভব ঠিক করে নিতে চায়।
শীতল সয়া বারগারের চারপাশ দিয়ে বেরিয়ে থাকা আলফালফার উঁটাগুলো মুখে ঠাসল কিশোর। এখানকার স্পেশাল খাবার এটা। তবে সে কেবল একলাই এর অর্ডার দিয়েছে। ইদানীং হঠাৎ করে আবার মোটা হতে শুরু করেছে, ছোটবেলার সেই রোগ। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সে। শরীর ফুলিয়ে ঢোল হতে আর চায় না। সেটা ঠেকানোর জন্যে যত কষ্ট হোক করবে। আদা আর ভাটুইয়ের মূলের রস বেরিয়ে এল বনরুটির ফাঁকের ভেতর থেকে। ফোঁটা পড়ল হাতে। দেখেও দেখল না সে। যত যাই বলো, এ জিনিস আমি খাবই। মজাও লাগবে।
কিন্তু মজা যে কি লাগছে, সেটা তার মুখের বিকৃত ভঙ্গি দেখেই আন্দাজ করতে কষ্ট হচ্ছে না। তবে কামড়ে নেয়া অংশটুকু চিবিয়ে গিলে ফেলে আবার কামড় বসাল।
ও তো সত্যিই খেয়ে ফেলছে। প্রায় ফিসফিস করে বলল রবিন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসা, এ ভাবে ডায়েট কন্ট্রোল করে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। প্লেট থেকে বীফ বারগারটা তুলে নিয়েও নামিয়ে রাখল আবার। আমার খিদে নষ্ট করে দিলে!
মুসা আমানের খিদে নষ্ট? চিবানোর ফাঁকে বলল কিশোর। তাড়াতাড়ি গিলে নিয়ে আবার কামড় দিল। কই, আমার তো খেতে খারাপ লাগছে না?
শুকনো কাঠ খেতে ভালও লাগে না, খারাপও লাগে না, মন্তব্য করল রবিন।
জবাব দিতে যাচ্ছিল কিশোর, হাসির হুল্লোড় বাধা দিল তাকে। ফিরে তাকিয়ে দেখল গোল একটা টেবিল ঘিরে বসে আছে জনাদশেক লোক, টিভির দিকে চেয়ে হাসছে। মঞ্চভীতি
মুহূর্তে মুখের ভার বদলে গেল কিশোরের, সর্বনাশ…
কি হয়েছে? জানতে চাইল জিনা।
জবাব দিল না কিশোর। চুপ করে তাকিয়ে আছে।
টিভির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল রবিন, ও, এই ব্যাপার। পাগল সংঘ ছবিটা দেখাচ্ছে, যেটাতে অভিনয় করে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল কিশোর।
কুঁকড়ে গেছে কিশোর। অনেক বছর আগে নিজের শৈশবের শরীর দেখে আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি কামড় বসাল বিস্বাদ বারগারে।
পর্দায় দেখা যাচ্ছে দশ বছরের একটা ছেলে ঢুকল ঘরে। মুখে শয়তানি হাসি। একটা চেয়ারে আঠা লাগিয়ে দিচ্ছে, ওটাতেই বসবে ছোট্ট কিশোর।
কি ঘটবে আন্দাজ করেই হাসতে লাগল দর্শকরা।
হাতের বাকি বারগারটুকু প্লেটে ফেলে দিল কিলোর। আর বসতে পারছি না। চলো, উঠি।
এক সেকেন্ড, কোণের একটা টেবিল দেখাল রবিন, জাহির বিলিয়ার্ডও এসেছে। আমার বস লজ বার্টলেটের নতুন একটা ব্যান্ডের ড্রামার। ভাল লোক। উঠে দাঁড়াল সে। চলো, পরিচয় করিয়ে দিই।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল মুসা আর জিনা। কিন্তু কিশোরের তেমন ইচ্ছে নেই। সে এখন এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে।
শেষে জোর করে মন শক্ত করে নিয়ে উঠল সে। অনেক দিন হয়ে গেছে, এখন আর তাকে চিনতে পারবে না কেউ।
অভিনয় তখনও দারুণ করতে! বলল লাল-চুল এক লোক।
চমকে গেল কিশোর। চিনে ফেলল নাকি? কিন্তু না, তার দিকে নয়, অন্য দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা।
জাহির, কেমন আছেন? আন্তরিকতা দেখিয়ে বলল রবিন।
ফিরে তাকাল লোকটা। ও, রবিন। বোসো। আমার বন্ধু পিটারের অভিনয় দেখছি।
গোয়েন্দাদের দিকে তাকাল তার পাশে বসা বন্ধু।
জিনা বলে উঠল, আপনাকে তো চিনি! কাল রাতে টিভিতে সাক্ষাত্তার দিয়েছেন। গারবার থিয়েটারে নতুন মিউজিক্যালটার স্টার আপনি।
মাথা ঝাঁকাল পিটার, উজ্জ্বল হলো চোখ, ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড! হ্যাঁ, ওটারই…
গোল টেবিলে বসা দর্শকদের হাসিতে চাপা পড়ে গেল তার কথা। ফিরে তাকাল পিটার। টিভির দিকে তাকিয়ে বলল, ওই যে, ওটাতেও অভিনয় করেছি আমি সেই ছোটবেলায় শুরু করেছিলাম, কিছুতেই আর ছাড়তে পারলাম না।
টিভির দিকে তাকাল কিশোর। চেয়ারের আঠায় তার প্যান্ট আটকে গেছে। টেনে তুলতে পারছে না। অসহায় করুণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চারপাশে, সাহায্যের আশায়। হাসি হাসি মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে দশ বছরের ছেলেটা, ওর দুর্দশা দেখে খুব মজা পাচ্ছে।
লাউডস্পীকার! নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে এল কিশোরের।
ঝট করে তার দিকে ঘুরে গেল পিটার।
জাহির বলল, লাউডস্পীকার?
ছবিতে ওই নামই ছিল তার, বলতে বাধ্য হলো কিশোর। কণ্ঠস্বরটা ছিল খুব জোরাল। মাইকও বলত কেউ কেউ।
স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে পিটার, তুমি জানলে কি করে?
বোকার মত ফাঁস করে দিয়েছে বলে রাগ হচ্ছে কিশোরের। আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই। দেখল, অনেকেই ফিরে তাকিয়েছে ওর দিকে। কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ওই যে চেয়ারে আটকে আছে, ওই ছেলেটা আমিই ছিলাম।
তুমিই মোটুরাম! বলে উঠল সোনালি-চুল একটা মেয়ে।
এই রে, শুরু হবে এখনি! মোটুরামকে নিয়ে টিটকারি, হাসাহাসি, যে জিনিসকে আজীবন ভয় পেয়ে এসেছে কিশোর। জবাব দিল, আমার নাম মোটুরাম নয়, মোটুরাম হলো চরিত্রটার নাম।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল পিটার। হাত বাড়িয়ে দিল। এখন বুঝি, মস্ত অভিনেতা তুমি! ওই বয়েসেও যা করেছ…অভিনয় তোমার রক্তে মিশে আছে।
পিটারের সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়ে বলল ও, তুমিও কম না। আরেকটা কি যেন নাম ছিল তোমার?
বাদ দাও, ওসব ভুলে আছি। এখন আমি পিটার হাইয়েম। এই নামেই চেনে লোকে।…পাগল সংঘ আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে। ওটার পর আর কোন ছবিতে চান্স না পেয়ে বিজ্ঞাপনের কাজ নিলাম। টাকা একেবারেই কম। অনেক কষ্টে কাটতে লাগল দিন। তবে শেষ পর্যন্ত আমার কণ্ঠই আমাকে বাঁচিয়ে দিল। লোকে বুঝতে আরম্ভ করল… হাসল সে। বাকিটা আর শুনে কাজ নেই, ইতিহাস। তোমার খবর কি?
এই আছি একরকম।
অভিনয় করো না?
না। চাচা-চাচীর কাছে থাকি। লেখাপড়া করি। তো, ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড তো খুব নাম করছে…
করবেই। খরচটা কেমন হচ্ছে। লস অ্যাঞ্জেলেসে এ যাবৎ যত মিউজিক্যাল শো হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল এটা। টাকা খরচ করতে কার্পণ্য করছেন না প্রযোজক। লেজার লাইট, মার্শাল আর্ট ডিসপ্লে, উন্নত টেকনোলজি। গল্পটাও নেয়া হয়েছে দারুণ!
জাহির বলল, আমি ওটাতে ড্রামারের কাজ করি। আসলেই টাকা ঢালছেন প্রযোজক-পোশাক, স্টেজ সব কিছু বদলে দিচ্ছেন। নতুন নতুন লোক ভাড়া। করছেন। একমাস হয়ে গেল, অথচ এখনও ওপেন করার তারিখ ঘোষণা করছেন। না।
এক মিনিট, জানতে চাইল মুসা, শো দেখানো মানেই তো ওপেন হয়ে যাওয়া। আবার তারিখ ঘোষণার কি দরকার?
আছে। যেটা চলছে সেটা প্রিভিউ। একটা শো ওপেন করার আগে কয়েক হপ্তা ধরে চলে তার প্রিভিউ। ভুলটুল কোথায় আছে, কি করলে আরও ভাল হবে, বোঝার চেষ্টা চলে। মাঝে মাঝে কান্তারাতি দৃশ্যপট বদলে ফেলা হয়। তারপর যখন মনে হয়, সব একদম পারফেক্ট, কোন ভুল নেই, তখন ঘোষিত হয় ওপেনিং নাইট। পত্রিকার লোকদের দাওয়াত দেয়া হয় সমালোচনার জন্যে।
ওপেনিং নাইট এটার আসবে কিনা তাই ভাবছি! নিচু স্বরে আনমনে বলল পিটার।
কেন, কোন সমস্যা? জানতে চাইল রবিন।
মাথা নাড়ল পিটার। না, কর্তৃপক্ষের কোন সমস্যা নেই। যে কোন দিন ব্রডওয়েতে মুক্তির ঘোষণা দিতে পারে। আর যদি পয়লা রাতেই হিট হয়ে যায়, তাহলে তো কাজই হয়ে গেল। নানা জায়গা থেকে অভিনয়ের ডাক আসবে, ভাড়া নেবে, সিনেমার চুক্তি হবে অনেক টাকা..অনেক।
কালো-চুল সুদর্শন এক লোক টেবিলের ওপাশ থেকে বলে উঠল, আসল কথাটা বলো, পিটার; প্রিভিউ লম্বা করার আরও কারণ আছে।
অপরাধীর হাসি ফুটল পিটারের মুখে। নিজের ঘরের খারাপ কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে অন্যকে শোনানোর কোন মানে হয় না, রলি। ইমপ্রেশন খারাপ করে লাভ কি।
কফি-টফি কিছু লাগবে কারও? জানতে চাইল ওয়েইট্রেস।
জিনা আর তিন গোয়েন্দা চেয়ার টেনে আনল টেবিলের কাছে।
কিশোরের দিকে তাকাল পিটার, এত বছর কি শুধু লেখাপড়াই করেছ?
না, শুধু লেখাপড়া করব কেন? ইলেকট্রনিকের কাজ শিখেছি, ইয়ার্ডে কাজ করেছি, গোয়েন্দাগিরি করছি।
গোয়েন্দা?
পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে দিল কিশোর।
কার্ডটা পড়ে মুখের ভাব বদলে গেল পিটারের। কিশোরের মনে হলো, ক্ষণিকের জন্যে যেন উজ্জ্বল হলো চোখ। সেটা লক্ষ করেই বলল ও, অসুবিধেয় পড়েছ?
অ্যাঁ!…হ্যাঁ! দ্রুত ডানে-বাঁয়ে ঘুরল পিটারের চোখ। হাসল। এই যে এখনকার মত।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। কিছু একটা এড়িয়ে গেল পিটার বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর।
উঠে দাঁড়াল পিটার। পকেট থেকে টাকা বের করে টেবিলে রেখে ওয়েইট্রেসকে ইশারা করে বোঝাল, খাবারের দাম। জাহিরকে বলল, আমি যাই। খানিকক্ষণ তাস খেলে আসি।
রবিনের সঙ্গে কথা বলছে জাহির, আনমনে মাথা ঝকাল। কয়েকটা মেয়েও বসেছে টেবিলে। সমস্বরে বিদায় জানাল পিটারকে।
মুসার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল কিশোর। রবিনের চোখে চোখেও তাকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সে তখন জিনা আর মেয়েগুলোর সঙ্গে গান নিয়ে তর্ক জুড়েছে।
সুতরাং তাকে ছাড়াই পিটারের পিছু নিল কিশোর আর মুসা। করিডরের শেষ মাথায় চলে এল। একটা দোকানের সামনে করাতে কাটা কাঠের গুঁড়ো স্তূপ হয়ে আছে, আর কিছু তক্তার গাদা। দোকানটা খোলেনি।
এদিক ওদিক তাকাল পিটার। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকাল, শুড়, এখানে কেউ নেই। কথা বলা যায়। সত্যিই গোয়েন্দা তো তোমরা? মস্করা নয়?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। অনেক জটিল কেসের সমাধান করেছি আমরা, ইচ্ছে করলে রকি বীচ থানায় খোঁজ নিতে পারো।
কণ্ঠস্বর খাদে নামাল পিটার, বিশ্বাস আসলে আগেই করেছি, নাহলে এখানে টেনে আনতাম না। বিপদে পড়েছি আমি। মস্ত বিপদ।
বিপদটা কেমন?
আমাকে মেরে ফেলতে চায়।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। কেন?
জানলে আর তোমাদের সাহায্য চাইতাম না। গত হপ্তা থেকে কয়েকটা চিঠি আর টেলিফোন পেয়েছি..
কি বলে? জানতে চাইল কিশোর।
কখনও ফোন ধরলেই রেখে দেয়, কখনও ভারি গলায় বলে: ইউ আর গন্যা গেট ইট! কথায় ব্রিটিশ টান। বুড়ো মানুষের মত মনে হয়। কখনও বলে: বিঅ্যাওয়্যার, থেসপিয়ান? কিশোরের দিকে তাকাল পিটার, থেসপিয়ান মানে জানো? পুরানো আমলে অভিনেতাকে থেসপিয়ান বলে ডাকার চল ছিল।
জানি। আর কি বলে ফোনে?
খিকখিক করে কুৎসিত হাসি হাসে, পুরুষেরও হতে পারে, মহিলারও। বুঝতে পারি না।
চিঠিতে কি লেখে?
এক্কেবারে পাগলের প্রলাপ পিটারের কণ্ঠ কেঁপে গেল। কি করে আমি মারা যাব, সেই খবর জানায়। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যা লিখেছে তার মানে হলো–রক্তমাখা সিংহাসনে ডুবে মারা যাব আমি। বনের মত কোন কিছু এগিয়ে আসবে আমাকে গিলে খাওয়ার জন্যে…
চিঠিগুলো দেখতে পারলে হয়। কোন সূত্র মিলতে পারে।
চোয়াল স্কুলে পড়ল পিটারের, পাবে না! সাংঘাতিক চালাক! কোন সূত্র রাখেনি।
সেটা দেখলেই বুঝব, মুসা বলল।
কি জানি…এমন খারাপ লাগে না!…মনকে বোঝাই, ও কিছু না, কোন ভক্ত হয়তো রসিকতা করছে। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টগুলো ঘটতে শুরু করতেই বুঝলাম রসিকতা নয়।
অ্যাক্সিডেন্ট?
সিনারি খসে পড়ে। আমার যেখানে নাচার কথা রহস্যময় ভাবে স্টেজের সেখানে পড়ে থাকে পেরেক, ব্লেড ভাঙা এ সব। ভয় ফুটল পিটারের চোখে। সত্যি, আমার সাহায্য দরকার। মনে মনে একজন গোয়েন্দা খুঁজছিলাম। কিন্তু কি ভাবে জোগাড় করতে হয়, কাকে বিশ্বাস করব, বুঝতে পারছিলাম না। গোয়েন্দা বলতে আমার চেহারায় ভাসে ছোটখাট একজন বুড়ো মানুষ, মঞ্চের পাঁচশো হাতের মধ্যে থাকলেও চোখে পড়ে যাবে। এমন কাউকে দিয়ে আর কি গোয়েন্দাগিরি করা? তবে তোমাদের বয়েসী হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, বলতে পারি আমার বন্ধু। কেসটা নেবে? তোমাদের সাহায্য দরকার আমার।
মুসার দিকে তাকাল কিশোর। কথা হয়ে গেল চোখে চোখে। পিটারের দিকে তাকাল সে। এক শর্তে করতে পারি কাজটা।
বলো।
আমাদের পরিচয় গোপন রাখতে হবে। বলা যায় না, ভেতরের কেউও কাজটা করে থাকতে পারে, তোমার অতি পরিচিত কেউ।
স্বস্তি এবং কৃতজ্ঞতা একই সঙ্গে ফুটল পিটারের চোখে। বেশ, তাহলে এইই কথা। আমার কেসটা নিলে তোমরা। আজ রাত ছটার দিকে ড্রেসিং রুমে দেখা কোরো আমার সাথে। সাড়ে সাতটার আগে মেকাপ করতে হবে না আমার। তার আগে বেশ কিছুটা সময় পাব তোমাদের ঘুরিয়ে দেখানোর জন্যে। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে যেতে পারলে আরও একটা জিনিস দেখতে পাবে। টিভি থেকে সাক্ষাৎকার নিতে আসবে আমার। এক এক করে মুসা, আর কিশোরের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিল। সে। কি ভাগ্য! এমন করে দেখা হয়ে যাবে তোমাদের সঙ্গে বিশ্বাসই করতে পারছি
পিটারের সঙ্গে হাত মেলানোর সময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা আজব অনুভূতিতে মোচড় দিয়ে উঠল কিশোরের পেট। কথা খুব মনে থাকে তো। তার, সেজন্যেই ধোয়াটে ভাবে মনে আছে, ছোটবেলায় অভিনয় করার জন্যে যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াত তখন হত এই অনুভূতিটা।
তারপর থেকে অভিনয়ের জগৎটাকে ঘৃণা করে এসেছে। এমন হতে পারে, চরিত্রটাই তার পছন্দ ছিল না, মোটুরাম বানিয়ে তাকে এভাবে হেনস্তার মধ্যে ফেলে। দেয়া উচিত হয়নি পরিচালকের। হঠাৎ করে এখন মনে হচ্ছে, অভিনয় জিনিসটা আসলে খারাপ লাগে না তার। গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়েও বহুবার বহুরকম অভিনয় করতে হয়েছে। তফাৎ কেবল, সামনে তখন ক্যামেরা ছিল না, কিংবা সে মঞ্চের ওপর ছিল না।
সে যে জাত অভিনেতা তাতে কোন সন্দেহ নেই। নইলে মঞ্চের কাছাকাছি যাওয়ার কথা শুনে রক্তে দোলা লাগবে কেন? তার ওপর যোগ হয়েছে রহস্য। কেসটা হাতে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না ও।
.
০২.
বিকেল বেলা ইয়ার্ডের পুরানো পিকআপটা চালিয়ে মুসা আর জিনাকে নিয়ে পিটারের সঙ্গে দেখা করতে রওনা হলো কিশোর। পথে মুসা বলল, এখানে একটু রাখো তো। আমার গাড়িটা হয়েছে নাকি দেখে যাই।
আগের গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে মুসা। নিলামে আরেকটা গাড়ি কিনেছে। টয়োটা করোলা, ষাট হাজার মাইল চলেছে। একটা বড় ওঅর্কশপে দিয়েছে পার্টস-টার্টস বদলে ভাল করে মেরামত করে দেয়ার জন্যে।
কিশোর বলল, পাঁচটা তো বাজে প্রায়। এখন…
সময় তো আছে। দেখিই না। বেশিক্ষণ লাগবে না।
গ্যারেজটার নাম রকি বীচ অটো ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কাঁচের দরজাটা ঠেলে খুলে চিৎকার করে ডাকল মুসা, আমার গাড়িটার কি খবর?
ভেতরে হাইড্রলিক লিফটের জঙ্গল হয়ে আছে। প্রতিটি লিফটে বসে আছে। একটা করে গাড়ি, ছাতের আলোয় কিভুত ছায়া পড়েছে মেঝেতে। এককোণে চেয়ার থেকে ঘুমজড়িত চোখে তাকাল একজন লোক। মুসার দিকে একবার। তাকিয়ে দেয়ালের ঘড়ি দেখল। বলল, বাপরে! পাঁচটা বাজে! ঘুমিয়েই পড়েছিলাম! কি করতে পারি তোমার জন্যে, বলো?
আমার গাড়িটা দিয়ে গিয়েছিলাম। স্টীল-গ্রে রঙের টয়োটা করোলা। হয়েছে?
মাথা চুলকাল লোকটা। গাড়িগুলোর দিকে তাকাতে লাগল। স্টীল-গ্রে টয়োটা..স্টীল-গ্রে টমোটা… আঙুল তুলল, ওটা?
হতাশায় কাঁধ ঝুলে পড়ল মুসার। লিফটে বসে আছে তার গাড়িটা। কোন মেরামতিই হয়নি এখনও। বলল, কি-কিছু করেননি।
কি করব, তোমার একটা পিটম্যান-আর্ম ক্ষয়ে গেছে। ওটা রেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না…
কি ক্ষয়ে গেছে?
ওই যে, হাত তুলে দেখাল মেকানিক, লম্বা একটা রডের সঙ্গে দুটো টায়ার যুক্ত। ওটা হলো স্টিয়ারিং লিংকেজ, চাকাগুলোকে ঘোরায়। এই ঘোরানোর জন্যে দরকার পড়ে আরেকটা যন্ত্রের, একে বলে পিটম্যান আর্ম। লিংকেজকে স্টিয়ারিং গিয়ারবক্সের সঙ্গে যুক্ত করে এটা, সেটা আবার যুক্ত স্টিয়ারিং কলামের সঙ্গে, সেটা যুক্ত স্টিয়ারিং হুইলের সঙ্গে। হাসল সে, মাঝখানে দুটো দাঁত নেই, ফাঁক। বেশ শক্ত ধাতু দিয়ে তৈরি পিটম্যান আর্ম, কিন্তু তারপরেও চিরকাল ঠিক থাকবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই।
তাহলে বদলে ফেলছেন না কেন?
মাথা নাড়ল মেকানিক। নেই। স্টকে রাখি না আমরা কেউই রাখে না। বানিয়ে আনতে হয়। অর্ডার দিলে বানিয়ে দেয়, দু-তিন হপ্তা লাগে। আবার হাসল সে। অপেক্ষা করতেই হবে তোমাকে। আর কোন উপায় নেই। এ কদিন চলাচলের অন্য কোন ব্যবস্থা করে নাওগে।
কোনমতেই কি চালু করা যায় না? অনুনয় করল মুসা, কোন ভাবে?
আবার মাথা চুলকাল মেকানিক, একটা কাজ করা যায় অবশ্য। আমার এক বন্ধুর গাড়ি ফেলে গেছে, নিতে দেরি হবে। তার গাড়িরটা
তাই দিন! লাফ দিয়ে গিয়ে মেকানিকের হাত জড়িয়ে ধরল মুসা। গাড়িটা বড় দরকার! অভ্যাস হয়ে গেছে। গাড়ি ছাড়া একদম চলতে পারি না।
মাথা ঝাঁকাল মেকানিক, দেখি কি করা যায়।
.
উফ! মরে গেলাম। খাইছে, কিশোর, গর্তটও দেখো না নাকি! মাথা নিচু করে ফেলেছে মুসা। বাড়ি লেগেছে যেখানটায়, ডলছে।
সরি, কিশোর বলল, সত্যিই দেখিনি। আসলে খুব একটা চালাই-টালাই না, জানোই তো…
ভাগ্যিস রবিন আসেনি, দুজনের মাঝে মোড়ামুড়ি করে আরেকটু জায়গা বের করার চেষ্টা করল জিনা।চ্যাপ্টা হয়ে যেতাম এতক্ষণে।
রবিন গেছে লজের ওখানে।
কিশোর বলল, আর কষ্ট করতে হবে না। এসে গেছি।
বড় একটা থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুটো সাদা গাড়ি। রাস্তা জুড়ে তারের ছড়াছড়ি। গিজগিজ করছে ক্যামেরাম্যান আর টেকনিশিয়ানে, চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছে, আলো ঠিক করছে। সব কিছুর ওপরে ক্রেনের সাহায্যে নামানো হচ্ছে বিশাল এক সাইনবোর্ড, তাতে লেখা:
ওয়াইল্ড! ওয়াইন্ড! ওয়াইল্ড।
ভাল করে দেখার জন্যে জানালা দিয়ে গলা বের করে দিল কিশোর।
মুসা বলল, সময়মতই এসেছি। টিভির লোকেরা ইন্টারভিউ শুরু করেনি এখনও।
আই, কিশোর! ডাক শোনা গেল।
বিশাল তাঁবুর নিচে উঁচু ক্যানভাস চেয়ারে বসে আছে পিটার। কালো পোশাক পরা একজন লোক তার চুল ঠিক করছে। কপালে পাউডার মাখাচ্ছে এক মহিলা। দু-জনকেই সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল পিটার। হাত নেড়ে ডেকে বলল, এসো। ক্যামেরা রেডি হয়ে গেছে।
বুলহর্ন মুখে লাগিয়ে আদেশ দিল একজন দাড়িওয়ালা লোক, জায়গাটা পরিষ্কার করুন, প্লীজ!
আধ ব্লক দূরে পিকআপটা পার্ক করে রেখে এল কিশোর। জিনা আর মুসাকে নিয়ে দৌড়ে গেল থিয়েটারের সামনে। কাঠের রেলিঙের বেড়া দিয়ে জায়গা আলাদা করে দেয়া হয়েছে দর্শকদের জন্যে, যাতে শূটিং দেখতে পারে। সেখানে এসে দাঁড়াল ওরা।
তাঁবুর ডানধারে গিয়ে দাঁড়াল পিটার।
সিল্কের শার্ট আর ঢলঢলে স্কার্ট পরা এক মহিলার চুলে স্প্রে করছে এখন হেয়ারড্রেসার। দ্রুত কাজ শেষ করে সরে গেল সে। মাইক্রোফোন হাতে পিটারের দিকে এগোল মহিলা। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ঝলমলে হাসি হাসল।
শোবিজ টুডের নিতা নিউমার, জিনা বলল।শো-টা খুব ভাল লাগে আমার।
খালি তো বকর বকর করে, মুসা বলল। এর বদনাম, ওর সমালোচনা, এই তো খালি…
তুমি কি বুঝবে ওসব! রেগে উঠল জিনা। তোমার তো খালি খেলা, অহেতুক সময় নষ্ট…
আহ, থামো তো তোমরা! ধমক দিল কিশোর। এটা ঝগড়ার সময় হলো নাকি…দেখি, শুনি কি বলে?
নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলল নিতা, চুপ হয়ে গেল দর্শক, সবাই জানেন আপনারা ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড গারবার থিয়েটারের একটা নতুন মিউজিক্যাল শো, অনেক দিন থেকে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় আছে। দারুণ একটা জিনিস, দর্শককে যেমন মজা দেবে, টাকাও আসবে হুড়মুড় করে। কিন্তু একটা উত্তেজনা চলছে ভেতরে ভেতরে। চ্যানেল ওয়ানের তদন্তকারী দল জেনে গেছে আজব কিছু ঘটছে এখানে, সবই হৃদয় জয় করা অভিনেতা পিটার হাইয়েমকে ঘিরে। পিটারের কাছে এখন আমাদের প্রশ্ন, সত্যিই কি ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড বিপজ্জনক হয়ে উঠছে তাঁর জন্যে?
পিটারের দিকে মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দিল নিতা।
কিন্তু পিটার কথা বলার আগেই ক্রেনের কাছে দাঁড়ানো একজন শ্রমিক চিৎকার করে উঠল, সরুন! সরে যান।
ওপর দিকে একবার তাকিয়েই তীক্ষ্ণ চিৎকার করে তাঁবুর মধ্যে ডাইভ দিয়ে পড়ল নিতা। তার চারপাশের লোকেরা হাত থেকে ক্লিপবোর্ড, স্যান্ডউইচ, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি সব ছেড়ে দিয়ে যে যেদিকে পারুল ছুটে পালাল।
কিশোর তাকিয়ে আছে ওপর দিকে। বিশাল সাইনবোর্ডটা ঝুলে আছে এখন মাত্র একটা তার থেকে। আরেকটা তার বোর্ডের গোড়া থেকে ছিঁড়ে গেছে।
বাকি তারটাও ছিঁড়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারল সে। ভারি বোর্ডটা ধরে রাখার সামর্থ্য নেই। চিৎকার করে উঠল কিশোর, পিটার, সরে যান?
.
০৩.
আর কোন উপায় না দেখে রাস্তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল পিটার। গড়িয়ে সরে গেল।
বিকট শব্দ করে রাস্তায় পড়ে ভাঙল বোর্ডটা। দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়েছে কিশোর, মুসা আর জিনা।
তারপর একধরনের বিশ্রী নীরবতা। চোখ থেকে হাত সরাল কিশোর। বোর্ডটা এখন প্লাস্টিকের একটা ধ্বংসস্তূপ। থিয়েটারের দেয়ালের কাছে, পিটার যেখানে রয়েছে তার পনেরো ফুট দূরে।
অবশেষে কথা ফুটল কিশোরের, কারও লেগেছে?
না, একসঙ্গে জবাব দিল মুসা আর জিনা।
বোর্ডটার দিকে এগোল কিশোর।
বিকেলের বাতাস চিরে দিল পুলিশের সাইরেন। ডান, বাম থেকে পা টিপে টিপে একজন দু-জন করে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে দর্শকরা। আবার ভিড় জমে গেল দেখতে দেখতে।
ঠেলেঠুলে ওদের ভেতর দিয়ে পথ করে এগোল কিশোর। পেছনেই রয়েছে জিনা আর মুসা। ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ক্যামেরাম্যানরা, দুর্ঘটনার পর পিটারের অবস্থা কি হয়েছে ধরে রাখার জন্যে যেন পাগল হয়ে গেছে।
তোলা হয়েছে সব? জিজ্ঞেস করলেন রূপালী-চুল এক ভদ্রলোক। চেহারাটা মোটেও ভাল না, কুৎসিত না বলে ভয়ঙ্কর বললে ঠিক হয়।
হয়েছে, জবাব এল একটা ক্যামেরার পেছন থেকে। পিটারের রিঅ্যাকশন, সাইনবোর্ডটা পড়ার দৃশ্য…সঅব।
গুড। এসেছিলাম সাধারণ সাক্ষাৎকার নিতে, পেলাম চমৎকার একটা ঘটনা। অ্যাকশন। বিউটিফুল।
এক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মি বলতে বলতে কনুই দিয়ে গুতো মেরে পথ করে। সামনে এগোল কিশোর। পিটারের টুকরো টুকরো কথা কানে আসছে, কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছে না। না না, আগে দেখিনি…ঠিকই আছি, কোন ক্ষতি হয়নি আমার…।
ভিড়ের কেন্দ্রে ঢুকে পড়ল কিশোর।
পিটারের পাশে বসে আছে নিতা। হাতে মাইক্রোফোন। একটা ক্যামেরার দিকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, আমাকে দেখা যায়?
যায়। শুরু করুন, জবাব দিল ক্যামেরাম্যান।
সঙ্গে সঙ্গে চেহারার ভঙ্গি বদলে গেল নিতার, শুরু হলো অভিনয়, প্রিয় দর্শকমণ্ডলী, আপনাদের চোখের সামনেই ঘটল ঘটনাটা। ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড যে সত্যি বুনো, তার প্রমাণ পেয়ে গেলেন হাতেনাতে। দেখলেন কি করে বিশাল সাইনবোর্ডটা নেমে আসছিল পিটার হাইয়েমের ওপর। মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছিল…।
মাথা? মুখ থেকে রক্ত সরে গেল পিটারের। আমার অতটা কাছে কিন্তু পড়েনি…
মাথা ঝাঁকাল নিতা। আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। ওরকম করে ভর্তা হতে কেউ চায় না। ধ্বংসপটা দেখিয়ে বলল সে, ওখানে গিয়ে একটা ক্লোজআপ নিলে কেমন হয়?
সেদিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল পিটার। বলল, সরি, ড্রেসিং রূমে কাজ আছে আমার। উঠে দাঁড়িয়ে কিশোরের হাত চেপে ধরে টান দিয়ে নিচুস্বরে বলল, এসো। এমন ভঙ্গি করো, যেন তুমি আমার বডিগার্ড।
ওদের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। জনতার দিকে তাকিয়ে বলল, দয়া করে, এখন সরুন আপনারা। আমাদের কাজ করতে দিন।
লোকে ভাবল, সে থিয়েটারের লোক। নির্দেশ মানল।
ফিরে তাকিয়ে কিশোর দেখল, জিনা আসছে পেছন পেছন। তার পেছনে মুসা। রাস্তায় নেমে গেছে দু-জন ক্যামেরাম্যান, দুটো পুলিশের গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মোটা এক লোক স্টেজের দরজা খুলে দাঁড়াল। পিটারকে জিজ্ঞেস করল, কোন চোটটোট লাগেনি তো?
না, লাগেনি।
মুসা আর কিশোরের দিকে সন্দিহান চোখে তাকাল মোটা লোকটা। পিটারকে আবার জিজ্ঞেস করল, এরা কারা?
আমার বন্ধু, হেসে বলল পিটার। কিশোরকে বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে কড়া সিকিউরিটি গার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছ তুমি। ওর নাম টোপাজ। অনুমতি না। থাকলে দেশের প্রেসিডেন্টকে ঢুকতে বাধা দেবে।
টোপাজের কঠিন চেহারায় এক চিলতে হাসি ফুটল। সরে ঢোকার জায়গা ছেড়ে দিল কিশোরদের। যাও।
থিয়েটারের ভেতর ঢুকল ওরা। বেশ নীরব। বাইরের কোলাহল ঢুকতে পারে না এখানে। পিটারের সঙ্গে ছোট একটা করিডর ধরে এগোল ওরা। বড় একটা কর্কবোর্ড ঝোলানো আছে দেয়ালে এক ইঞ্চি জায়গাও খালি নেই বোর্ডটায়। নোটিশ আটকে দেয়া হয়েছে পিন দিয়ে। ওটার পাশে টেলিফোন, অনেকগুলো ফোন নম্বর লেখা।
করিডরের শেষ মাথায় একটা আধখোলা দরজা। তাতে নাম লেখা নুরিখ টোপাজ। দরজার ভেতর দিকে একটা পেগবোর্ড থেকে ঝুলছে অনেকগুলো চাবি। টোপাজের অফিসের ডানে আরেকটা দরজা চলে গেছে স্টেজের দিকে।
দাঁড়ান, কিশোরদের সেদিকে নিয়ে যেতে দেখে পিটারকে ডাকল টোপাজ। ড্রেসিং রুমে লোক আছে। অচেনা কাউকে দেখলে খুশি হবেন না।
ফিরে তাকাল পিটার, কে?
মিস্টার কলিন আর মিস্টার রোম।
ও বলে কিশোরদের দিকে তাকাল পিটার। মিস্টার ডেভন কলিন হলেন প্রডিউসার, আর মিস্টার নরটন রোম মেইন ইনভেস্টর-এই থিয়েটারে সবচেয়ে বেশি টাকা খাটাচ্ছেন তিনি। আবার টোপাজের দিকে ফিরল সে। তো, তাদের সম্মানে কি করতে হবে? কিছু বলেছে নাকি তোমাকে? কণ্ঠস্বরে ঝাঁঝ।
তা বলেছে। গণ্ডগোল শুনে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিলেন দু-জনেই। যখন দেখলেন আপনার কোন ক্ষতি হয়নি, বললেন, মেক শিওর হি গেটস হিয়ার ইন ওয়ান পিস।
তাই বলেছে, না? আমার জন্যে দেখি বড় দরদ, একেবারে দেখেশুনে রাখার হুকুম! স্টেজের দরজার দিকে ঘুরল পিটার। বেশ, দেখেই আসি কি সম্মান দেয়া যায়। খোলা তরোয়াল ঘোরাতে ঘোরাতে যেন দরজা দিয়ে ছুটে ঢুকে পড়ল সে।
কিশোরের দিকে তাকাল মুসা, চোখে বিস্ময়।
লাইনটা শেকসপীয়ারের, কিশোর বলল। যুদ্ধে যাওয়ার সময় রাজা পঞ্চম হেনরি বলেছিলেন তার লোকদের।
চমৎকার! ভোঁতা স্বরে বলল মুসা।
আরেকটা কথা ভাবছি, আনমনে যেন নিজেকেই বলল কিশোর, পিটারকে হুমকি দিয়ে লেখা চিঠিতে বলেছে: রক্তমাখা সিংহাসনে মৃত্যু হবে তার, এবং একটা বন এসে গিলে ফেলবে তাকে।
অদ্ভুত কথা! মাথামুণ্ড বোঝা যায় না।
যায়। আমার মনে হয় এটা কোন নাটকের সংলাপ থেকে নেয়া।
তাতে কি?
আমাদের প্রথম সূত্র।
তারমানে বলতে চাইছ চিঠির লেখক থিয়েটারের লোক? জিনার প্রশ্ন।
মনে হয়। দরজা দিয়ে ঢুকে স্টেজের পেছন দিকে ওদেরকে নিয়ে এগোল কিশোর।
ডানের বন্ধ দরজাটার ভেতরে ঢুকবে না, সাবধান করে দিল টোপাজ। স্টেজের কাছে যাবে না।
ডানে মোড় নিল কিশোর আলো তেমন নেই এখানটায়, অন্ধকার। ঝুড়ি বোঝাই কাপড়, টেবিলে রাখা যন্ত্রপাতি, আর একপাশে একটা নকল মোটরগাড়ি পড়ে আছে। বয়ে স্টেজ, স্পটলাইটের উজ্জল আলোয় আলোকিত।
এককোণে একটা দরজা। চকচকে একটা ধাতব তারা ঝুলছে ফ্রেমের ওপর থেকে। নিচে প্লাস্টিকের নেমপ্লেট, তাতে লেখা: পিটার হাইয়েম। কিশোর, মুসা আর জিনা এগিয়ে গেল ওটার কাছে। ভেতর থেকে শোনা গেল রাগত কণ্ঠস্বর।
খাইছে! ফিসফিস করে বলল মুসা, খুব রেগে গেছে মনে হয়। এত দুঃখ কিসের?
দেখে আসি, কিশোর বলল। তোমরা থাকো, চোখকান খোলা রাখো। পিটারের ঘরের দরজাটা দেখিয়ে বলল, ওরা বেরোলে আমাকে ডাকবে।
আচ্ছা।
টোপাজের নির্দেশ অমান্য করে স্টেজের দিকে এগোল কিশোর। চুপচাপ দেখল কাঠমিস্ত্রী, টেকনিশিয়ান আর মঞ্চশ্রমিকদের ছোটাছুটি। ইলেকট্রিক ড্রিল মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে ওয়াকিটকিতে চেঁচিয়ে কথা বলা।
হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে গেল কিশোরের। এই শব্দ, আলোর উষ্ণতা, সারি সারি সীটের বিশাল শূন্যতা রক্তে দোলা দিতে লাগল তার। সাধারণ জীবন যাত্রা এখান থেকে অনেক দূরে। এখানে, এই থিয়েটারের মধ্যে একদল পেশাদার শিল্পী মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছে একটা ফ্যান্টাসি তৈরির কাজে।
স্টেজের পেছনের মেঝে থেকে বিশাল এক দৃশ্যপট ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে। দেখা যাচ্ছে গুহার দেয়াল-খোঁচা খোঁচা পাথরে বোঝাই, লুকানো আলো প্রতিফলিত হচ্ছে তাতে। বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ী নদী। প্লাস্টার আর নানা উপকরণে তৈরি একটা অসাধারণ সৃষ্টি এটা, বুঝতে পারছে কিশোর। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে শ্রমিকেরা। দড়ি ধরে টেনে তুলছে জিনিসটা। অন্ধকারে এমন ভাবে আড়াল করা আছে দড়িগুলো, কিশোর যেখানে আছে সেখান থেকে দেখা গেলেও সীটে বসা দর্শকদের চোখে পড়বে না কোনমতেই। গুহার দৃশ্যটা ওপরে উঠে যেতেই বেরিয়ে পড়ল আরেকটা দৃশ্য।
সামনের পর্দার দিকে ঘুরল কিশোর। মিটমিট করা, ইলেকট্রিক আলো চোখে পড়ল তার। ভেতরের আরেকটা পর্দার ওপাশে রয়েছে বুক-সমান উঁচু কন্ট্রোল বোর্ড। তাতে অসংখ্য বোতাম, সুইচ আর একটা কম্পিউটার কীবোর্ড। তার ওপরে কাঠের তাকে দেয়ালের সঙ্গে আটকে রাখা হয়েছে একটা মনিটর। ওটার কাছে দেয়ালে হুকে ঝোলানো একসেট হেডফোন।
ডানে-বাঁয়ে দু-দিকেই তাকাল কিশোর। সবাই কাজে ব্যস্ত। এই সুযোগে কম্পিউটারটায় কি আছে দেখার লোভ সামলাতে পারল না সে। সবার অলক্ষে নিঃশব্দে এমিয়ে গেল বোর্ডের কাছে। স্ক্রীনে ইংরেজিতে লেখা:
ওয়াইল্ড! ওয়াইল্ড! ওয়াইল্ড!
গারবার থিয়েটার, লস অ্যাঞ্জেলেস
সাউন্ড, লাইট, অ্যান্ড ফ্রাই কিউজ
জে, বারনারডি, এসএম
জে, ইভারসন, এএসএম
১। লাইট এ কে রেইজেস হ্যান্ড।
২। সাউন্ড এ কে লাস্ট পারসন অন আর্থ!
৩। সাউন্ড সিগন্যাল ফ্রম অর্ক, কনডাকটর
৪। লাইট বয়েজ অ্যাট সেন্টার স্টেজ
প্রেস রিটার্ন টু কনটিনিউ
ইউজ কারসর টু হাইলাইট কিউ
এফ১: কমান্ড মেনু
এফ২: এডিট মেনু
এফ৩: অ্যাড লাইন
এফ8: রেকর্ডার
কীবোর্ড নাড়াচাড়া শুরু করল কিশোর। রোল করে নিচ থেকে ওপরে উঠতে শুরু করল নি। বেরিয়ে আসতে লাগল মেনুর পর মেনু।
অ্যাই! হঠাৎ জোরাল কণ্ঠ হাঁক দিল পেছন থেকে।
ঝট করে কীবোর্ড থেকে উঠে চলে এল কিশোরের হাত। ঘুরে তাকাল সে।
এগিয়ে আসছে একজন তরুণ মঞ্চশ্রমিক। লম্বা লম্বা সোনালি চুল তার। রঙচটা ফ্যানেলের শার্টের হাতা গোটানো। বাহুতে উল্কি দিয়ে ছবি আঁকা।
সন্দেহে ভরা সবুজে চোখ ঘুরিয়ে ধমক দিল লোকটা, এখানে কি?
তাকিয়ে আছে কিশোর। বিড়বিড় করল, এই লোকই পিটারকে সাবধান করেছিল।
কি বললে?
বোর্ডটা পড়ার আগে চিৎকার করে আপনিই পিটারকে সাবধান করেছেন। চেহারাটা মনে আছে।
ভাল। এখন তোমার চেহারাটা এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেই খুশি হব। কম্পিউটারে তোমার কোন কাজ নেই। স্টেজ ম্যানেজার নও তুমি।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, অস্বীকার করছি না। কম্পিউটার দেখলেই লোভ লাগে, খালি টিপতে ইচ্ছে কমে দাঁড়ান, আগের জায়গায় এনে দিই।
কম্পিউটারের দিকে আবার সে ঘুরতেই ভারি থাবা পড়ল কাঁধে। হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিল পেছনে। কানের কাছে কঠিন কণ্ঠে বলল নোকটা, কিচ্ছু করার দরকার নেই তোমার। ভাগো!
আড়চোখে লোকটার হাতের দিকে তাকাল কিশোর। তেলকালি লেগে আছে আঙুলে। তার শার্টে লাগছে। কণ্ঠস্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করল, দেখুন, আমার কথাটা আগে শুনুন…
কোন কথা শুনতে চাই না। আবার হ্যাঁচকা টান মারল নোকটা।
ঝাঁ করে কানে রক্ত উঠে গেল কিশোরের। আর ভদ্রতার ধার ধারল না। কঠিন কণ্ঠে বলল, হাত সরান?
দাঁত বের করে হাসল লোকটা, আরি, আবার রাগও করে! জোরে এক ধাক্কা মারল সে। ছেড়ে দিল কাঁধ।
হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল কিশোর, কোনমতে সামলাল। ফিরে তাকিয়ে দেখল হাসছে লোকটা। এগিয়ে আসছে।
রুখে দাঁড়াল সে। বলল, আর এক পা এগোবেন না।
হাসি আরও বাড়ল লোকটার। এগিয়ে আসছে। ধরে ফেলল কিশোরকে।
জুডোর প্যাঁচ কষল কিশোর।
লাভ হলো না। লোকটাও জুড়ো জানে। কিশোরের চেয়ে ওস্তাদ। মাথার ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিল তাকে।
থ্যাপ করে কাঠের মেঝেতে আছড়ে পড়ল কিশোর।
.
০৪.
খালি মেঝেতে পড়লে ব্যথা পেত। শরীরের অর্ধেক পড়ল মেঝেতে, অর্ধেক দড়ির বান্ডিলের ওপর। আরও কণ্ঠস্বর কানে এল তার। পদশব্দ ছুটে আসছে।
সবার আগে পৌঁছে গেল লোকটা।
শেষ মুহূর্তে ঝটকা দিয়ে মাথা সরিয়ে নিল কিশোর। নইলে বুটের লাথি পড়ত মাথায়।
এই নিরু, কি করছ? বলে উঠল আরেকটা নতুন কণ্ঠ।
ফিরে তাকিয়ে কিশোর দেখল, লম্বা একজন লোক। মাথা ভরতি সাদা চুল। গায়ে জু-নেক সোয়েটার, পরনে খাকি প্যান্ট। কোটরে বসা চোখ। অবাক হয়েছে যে বোঝা যায়। পেছনে মুসা আর জিনা।
হাত ধরে কিশোরকে টেনে তুলল মুসা। ব্যথা পেয়েছ?
না, গায়ের ধুলো ঝাড়তে লাগল কিশোর। তবে সময়মত তোমরা না এলে। কি হতো বলা যায় না। এই যে মিস্টার নিরুটি, ইনি একজন মোষ…
নিরু, ধমক দিয়ে বললেন লম্বা ভদ্রলোক, এ সব আর কক্ষনো করবে না। যদি চাকরি করতে চাও এখানে।
আসলে…আমি…ও কম্পিউটারটা ঘাটতে লাগল…
তাই বলে গায়ে হাত তুলবে? জিজ্ঞেস করতে পারতে, টোপাজকে বলতে পারতে, তোমাকে মাতব্বরি করতে কে বলেছে? জানো, ও পিটারের বন্ধু? যাও, কাজে যাও।
চলে গেল নিরু।
হাত বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রলোক, ভিনসি জাপা, স্টেজ ম্যানেজার।
কিশোরও হাত বাড়াল। শুরু থেকেই লক্ষ করছে, উচ্চারণ কিছুটা অন্যরকম ভদ্রলোকের; যেমন আর উচ্চারণ করতে গিয়ে কখনও বলেন আউ, কখনও আহ্। ম্যানেজারকে উচ্চারণ করলেন ম্যানেজাহ। জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার বাড়ি কি নিউ ইয়র্ক সিটিতে?
অবাক হলেন ম্যানেজার, ব্রুকলিন। লং আইল্যান্ড। কি করে বুঝলে?
উচ্চারণ। মোষের কবল থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ।
ও কিছু না। নিরু আবার কোন শয়তানি করলে আমাকে বলবে।
আসলে দোষ আমারও আছে। না বলে কম্পিউটার ধরা উচিত হয়নি। আসলে কৌতূহলটা ঠেকাতে পারিনি…
হাসলেন জাপা। আর কোন কৌতূহল আছে? ঘুরে দেখতে চাও জায়গাটা?
হ্যাঁ, মন্দ কি?
মুসার দিকে তাকাল কিশোর। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল। বুঝল মুসা, বলল, তোমরা যাও। আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। আমি বরং এটা দেখি। একটা টেবিলে রাখা স্পোর্টস ম্যাগাজিন টেনে নিল সে। পিটারের দরজার দিকে নজর রাখতে হলে এখান থেকে সরা চলবে না।
ম্যানেজারের সঙ্গে চলল কিশোর আর জিনা। কিশোর ভাবছে, এই নিরু লোকটা কে? পিটারের প্রাণনাশের চেষ্টায় কি তারও হাত আছে? সেজন্যেই সাইনবোর্ডটা পড়ার সময় ক্রেনের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল? তাকে দেখেই বা এত রেগে উঠল কেন?
দু-জনকে নিয়ে স্টেজে উঠে এলেন ম্যানেজার। বললেন, ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড আসলেই একটা বুনো শো। গল্পটা হলো, কয়েকজন আমেরিকান তরুণ, মার্শাল আর্টের ছাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে আটকা পড়েছিল। তাদের নেতার অভিনয় করবে তোমাদের বন্ধু পিটার। পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়বে এক গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে। পুরানো মন্দির, গুহা, এ রকম অনেক জায়গার মধ্যে লুকাতে হবে তাকে।
সাংঘাতিক ব্যাপার! জিনা বলল।
কয়েকজন শ্রমিক একটা সেট সাজাচ্ছে। দুটো সোফা, একটা কালো টেবিল, তার ওপর একটা টেলিফোন রাখা। মাথায় হেডসেট পরা একজন লোক ফোনে কথা বলছে। আরেকজন পায়চারি করছে, একবার এদিক যাচ্ছে, একবার ওদিক। একটা ব্যালকনিতে গিয়ে উঁকি দিল। তার পেছনে একটা দৃশ্যপট, লিভিং রূমের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে, তাতে একটা বুককেস।
সহজ সেট, কিশোর বলল। এত লোক কি করছে?
যতটা সহজ দেখছ ততটা নয়, ম্যানেজার বললেন। এত সাধারণ একটা সেট চালাতেও ষোলোজন লোক লাগে।
ষোলো! অবাক হলো জিনা। মাত্র একটা লিভিং রুমের জন্যে?
হেসে উঠলেন জাপা। হ্যাঁ। একজন লোক মাত্র একটা কাজই করে, যেমন যে আসবাব সেট করে সে কেবল সেটাই করে; ল্যাম্প, ফোন যে নাড়াচাড়া করে, তার সেটাই একমাত্র কাজ। আর কোন কাজ করতে দেয়া হবে না তাকে। তাতে জটিলতা বাড়ে। ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রতিটি কাজের জন্যে আবার এক্সট্রা নোক রাখতে হয়, কোন কারণে একজন যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা অন্য কিছু ঘটে তার, আসতে না পারে, তখন কাজ চালানোর জন্যে। বুঝলে কেন এত লোক লাগে?।
শিস দিয়ে উঠল কিশোর। শো-র সময় এত লোক একসঙ্গে কাজ করে কি করে? যোগাযোগ রাখতে গিয়ে গোলমাল হয়ে যায় না?
প্রশ্নটা তাহলে করেই ফেললে। দাঁড়াও, কন্ট্রোল বোর্ডটা দেখাই, তাহলে আন্দাজ করতে পারবে। এখন আর নিরু তোমাকে বিরক্ত করতে আসবে না।
স্টেজের ওপাশ থেকে ভেসে এল ভারি একটা কণ্ঠ, টার্নটেল নড়ছে!
দাঁড়াও, দাঁড়াও! তাড়াতাড়ি হাত তুললেন জাপা। মেঝেতে খাঁজকাটা বিশাল এক গোল চক্রের মধ্যে জিনা আর কিশোরকে নিয়ে এলেন তিনি। টেকনিশিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার চালাও।
ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করল চক্রটা। লিভিং রূমকে ওপরে সরিয়ে দিল। বেরিয়ে পড়ল আরেকটা সেট।
কন্ট্রোল বোর্ডের কাছে গিয়ে মনিটরের সামনে একটা টুল রাখলেন জাপা। শো-র সময় এখানে থাকি আমি, হেডফোন পরে। স্টেজের পেছন দিকে যারা থাকে, তাদের জন্যে নির্দেশ ঢোকানো থাকে কম্পিউটারে। মনিটরে লেখা ফুটতে। থাকে আর দেখে দেখে তাদের যার যার কাজের কথা বলতে থাকি আমি। এ ধরনের সিগন্যালকে আমরা বলি কিউ। এই যেমন, শব্দ আর আলো ঠিক করার ভার যাদের ওপর, তাদের হয়তো বললাম লাইটস থার্টি ফাইভ, গো। দৃশ্যপট যারা ওঠায়-নামায় তাদের কিউ করি টর্চলাইট দিয়ে। কিউর কয়েক সেকেন্ড আগে সাবধান করার জন্যে আলো জ্বালি একবার। রেডি থাকে শ্রমিকেরা। সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে দেয়।
আর কম্পিউটার নিশ্চয় নির্দেশ বদল করতে কিংবা নতুন করে সাজাতে সাহায্য করে আপনাকে, কিশোর বলল।
আমাকেই করে, মাথা ঝাঁকালেন জাপা, তবে ডাটাগুলো আমি ঢোকাই না। আরেকজন লোক আছে, সে এসে করে রেখে যায়। স্টেজ ম্যানেজারের দায়িত্ব হলো স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী কাজ করা। কিন্তু এই শো-র মত এত জটিল একটা শো-র জন্যে শুধু স্ক্রিপ্ট যথেষ্ট নয়, কম্পিউটার সেট আপ দরকার। আমার জন্যে সব কিছু প্রোগ্রামিং করে দিয়ে যায় একজন ওস্তাদ কম্পিউটার প্রোগ্রামার।
এত জটিল?
হ্যাঁ, এত জটিল। একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলেই গেল। দেখা যাবে বসার ঘরে ঢুকে পড়েছে মোটরগাড়ি, দিনের বেলার দৃশ্যে হয়ে যাবে-রাতের অন্ধকার…
মনিটরের লেখা পড়ে নির্দেশ দেন আপনি। যদি সেখানে ভুল লেখা থাকে এবং ধরতে পারেন, তাহলে নিশ্চয় ঠিকটা দেবেন?
তা তো বটেই। তবে ধরাটা বড় কঠিন…
জোরে জোরে কাশল মুসা।
কিশোর ফিরে তাকাতেই ইশারা করল।
ম্যানেজারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেদিকে রওনা হলো কিশোর আর জিনা। কাছে যেতেই মুসা বলল, ভেতরে তো মনে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে।
ফিরে তাকিয়ে দেখল কিশোর, ম্যানেজারকে দেখা যাচ্ছে না। গিয়ে কান পাতল ড্রেসিং রুমের দরজায়।
প্রথম কণ্ঠটা জোরাল, খানিকটা খসখসে, আবার বিশ্বাস করতে বলছ কি করে? একবার শয়তানি করে বললে আর করবে না, বিশ্বাস করলাম। কিন্তু আবারও করলে, উইকএন্ডে চলে গেলে ইয়োসিমাইটে। তারপরেও বলছ…
এ নিয়ে বহুবার আলোচনা হয়েছে, মিস্টার কলিন, পিটারের কণ্ঠ। মাঝে মাঝে কোনখান থেকে ঘুরে আসা ভাল, আপনিই বলেছেন…
তাই বলে পাহাড়ে চড়তে বলেছি? যখন জানো, নেতার অভিনয় করার জন্যে এই শো-তে আর কেউ নেই? যদি তোমার পা ভাঙত, কিংবা গোড়ালি মচকাত, কি অবস্থাটা হত! এমন সময় করলে কাণ্ডটা যখন টিকিট বিক্রি হতে আরম্ভ করেছে।
ভারি একটা কণ্ঠ বলল, দুই হপ্তা বন্ধ রাখায় অনেক লস হয়েছে আমাদের। দর্শক গেছে খেপে। টিকিটের দাম ফেরত দিতে হয়েছে, আরও নানা রকম গচ্চা। তারপরেও মুক্তি পাইনি খবরের কাগজওলাদের হাত থেকে। ওদের কুনজরে পড়েছি তো পড়েছিই, ভাল হওয়ার আর নাম নেই। আমি বাবা আর এর মধ্যে টাকা ঢালতে রাজি নই। যা যাওয়ার গেছে, লাভের আশা বাদ দিয়ে এখন লোকসান বাঁচানোর চেষ্টা করব।
আর ওসব বলে লাভ নেই, রোম, কলিন বললেন। অনেক দূর এগিয়ে গেছি, এখন আর শো বন্ধ করা যাবে না কোনমতে। দুনিয়াতে একজনই তো নেই, আরও লোক আছে…
আর্ট টিলারিকে আমার জায়গায় নেয়ার কথা ভাবছেন তো? বলে উঠল পিটার। সাংঘাতিক ট্যালেন্টেড অভিনেতা…এ কথাই বলতে এসেছেন আমাকে? তাহলে কানাঘুষাটা সত্যি, আমি ভাবছিলাম কিছু না।
ইয়ে… দ্বিধা করলেন রোম, আমরা চাই টিকেট বিক্রি।.
দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরব থাকার পর পিটার বলল, মিস্টার রোম, টাকাটা আপনার। আপনি ইচ্ছে করলে ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ভেঙে দিতে পারেন, কিংবা টিকিয়ে রাখতে পারেন। সুতরাং কাকে দিয়ে কাজ করাবেন, সেটাও আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই নির্ভর করে। আনুন টিলারিকে। দামী আর্টিস্ট আনার ঠেলা কাকে বলে বুঝবেন তখন। নিজের প্রশংসা করি না, তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাকে বাদ দেয়ার ফল ভাল হবে না আপনাদের জন্যে।
তোমাকে রেখেই বা আমাদের কি লাভ? কলিন বললেন। পরের উইকএন্ডে তো আবার পালাবে।
আমার ব্যাপারে আপনার কি রকম ধারণা হয়েছে বুঝতে পারছি, মিস্টার কলিন। কিন্তু এই নাটকের জন্যে আমি নিবেদিত। এখনও লোকে তেমন করে চেনে না আমাকে, নাম ছড়ায়নি, কিন্তু নাটকটা দেখার পর ছড়াতে দেরি হবে না। লোকে তখন আমার সঙ্গে সঙ্গে আপনার কথাও বলবে; বলবে, আপনিই আমাকে খুঁজে বের করেছেন।
পিটারের পক্ষে কথা বলে উঠতে ইচ্ছে করল কিশোরের। পরের কথাগুলো শোনার জন্যে আরও জোরে কান চেপে ধরল দরজায়।
আমার মনে হয়, ব্যাপারটা নিয়ে পরে আরেকবার আলোচনায় বসতে পারি আমরা, খানিকটা নরম হলেন কলিন, মাথা ঠাণ্ডা হলে।
চেয়ার ঠেলার শব্দ হলো। তাড়াতাড়ি দরজার কাছ থেকে সরে এল কিশোর, মুসা আর জিনা। শুনতে পেল পিটার বলছে, আরেকটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, আমার সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তাতে লেখা আছে কোন কারণে যদি আমাকে বাদ দেয়া হয়, তাহলেও আমার বেতন ঠিকই দিতে হবে। টিলারিকে নিলে দু-জনের বেতন দিতে হবে আপনাকে। বিরাট অঙ্কের টাকা। যতদিন নাটকটা চলবে, টাকা দিতে হবে আমাকে।
রোমের ঝাঁঝাল কণ্ঠ শোনা গেল, কলিন, কি বলে? এ কথা তো আমাকে বলোনি তুমি?
চুপ করে রইলেন কলিন।
মৃদু হাসি শোনা গেল পিটারের। এতগুলো টাকা বাঁচাতে হলে হয় আমাকে দিয়েই অভিনয় করাতে হবে, নয়তো আমাকে মেরে ফেলতে হবে।
পায়ের শব্দ, রাগত ঘোৎ-ঘোঁতের পর ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা।
জিনা আর মুসা ম্যাগাজিন পড়ার ভান করল। টেবিলে রাখা জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে লাগল কিশোর। দরজা খুলে তোক বেরোচ্ছে, তাতে যেন কিছু এসে যায় না তার।
তবে পেটের মধ্যে বিশ্রী একটা অনুভূতি হচ্ছে। মেরে ফেলার কথাটা এভাবে কলিন আর রোমের সামনে বলে ফেলাটা বোধহয় উচিত হয়নি পিটারের!
.
০৫.
নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছে, বিড়বিড় করল কিশোর।
মানে? বুঝতে পারল না মুসা।
কলিন আর রোমের সঙ্গে পিটারের কথা কাটাকাটির খানিক পর সেলুনের বাইরে কথা বলছে দুই গোয়েন্দা। ভেতরে দাঁড়িয়ে পিটারের চুল কাটা দেখছে। জিনা। যে লোকটা কাটছে তার নাম বব রডম্যান।
কিশোর বলল, কেউ একজন পিটারের পেছনে লেগেছে। মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে নানা ভাবে। আজ আরেকটু হলে আমাদের চোখের সামনেই শেষ হয়ে যাচ্ছিল সে।
তাতে নিজের বিপদটা ডেকে আনল কোথায়? এখনও বুঝতে পারছে না মুসা।
কেন, শুনলে না কলিন আর রোমকে নিজেই বলেছে তাকে মেরে ফেললে ল্যাঠা চুকে যায়?
সে তো রসিকতা।
কিন্তু রসিকতাটাকেই যদি সিরিয়াস ধরে নেয়া হয়? পিটার মরে গেলে তাদের লাভ আছে। সুতরাং সন্দেহের তালিকায় দু-জনের নাম যোগ হলো।
হুঁ।
সেলুনে চুল কিশোর।
চুল কাটতে কাটতে জিনাকে বলল বব, খুব সুন্দর তোমার চুল। এমন করে সাজিয়ে দিতে পারি মঙ্গল গ্রহের ছেলেরাও ঝাঁক বেঁধে লাগবে তোমার পেছনে।
লাল হয়ে গেল জিনার গাল।
তোমার বকর বকর বাদ দাও তো, ব, পিটার বলল। ভিনগ্রহ ছাড়া আর কিছু বোঝো না?
চোখ ওল্টাল বব, ভিনগ্রহ বাদ দিতে হলে মহাকাশকে বাদ দিতে হয়। আমাদের অস্তিত্ব তাহলে থাকল কোথায়? ওখান থেকেই তো এসেছি আমরা…
তুমি এসেছ, আমি নই!
কাঁচি চালানো বন্ধ করে ফেলল বব। পিটারের ঘাড়ে লেগে থাকা কাটা চুল ব্রাশ দিয়ে চেচে নিচের কাপড়ে ফেলল। সুন্দর কাটা হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি আর কেউ পারবে না।
নাপিতের চেয়ার থেকে নেমে এল পিটার। কিশোরদের দিকে তাকিয়ে বলল, খুব খিদে পেয়েছে। চলো কিছু খেয়ে আসি। সাড়ে সাতটা বাজতে এখনও প্রায় দেড় ঘন্টা বাকি।
ভাল কথা মনে করেছেন, হেসে বলল মুসা।
তারমানে আমাদের চ্যানেলে আসছ না তুমি? কিছুটা হতাশ কণ্ঠেই পিটারকে জিজ্ঞেস করল বব।
তোমাদের কিসে?
ভুলে গেছ? শো-র আগে কয়েকজন অভিনেতা আমার ওখানে আসছে। আধঘণ্টার জন্যে একটা অনুষ্ঠান হবে। আমাদের চ্যানেলে পৌঁছার চেষ্টা করব আমরা, অতীত জীবনের সঙ্গে যোগাযোগ করব..
মুখ বাঁকাল পিটার, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, বব। অতীত জীবনের চেয়ে একটা চীজবার্গারের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই এখন বেশি ভাল লাগবে আমার।
সেলুন থেকে বন্ধুদের বের করে নিয়ে গেল পিটার। ফিরে তাকালে দেখতে পেত রহস্যময় হাসি ফুটেছে নাপিতের ঠোঁটে।
সিঁড়ি দিয়ে পিটারের ড্রেসিং রূমে নেমে এল গোয়েন্দারা। এই প্রথম ভাল করে ঘরটা দেখার সুযোগ পেল কিশোর। দেয়াল জুড়ে বিশাল বিজ্ঞাপন করা হয়েছে। পিটার হাইয়েমের–খবরের কাগজের কাটিং, প্রেস রিলিজ, বাঁধাই করা সাদা কালো ছবি, ভক্তদের চিঠি সাটিয়ে রাখা হয়েছে। সবখানে ছড়িয়ে আছে পিটারের বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ভোলা হাসিমুখ।
বাহ, খুব বিখ্যাত লোক মনে হয় আপনি, মুসা বলল।
টান দিয়ে গায়ের শার্টটা খুলে ফেলল পিটার। কাটা চুল লেগে আছে তাতে। কাপড়ের র্যাক থেকে আরেকটা শার্ট নিয়ে পরতে পরতে বলল, থিয়েটারের লোকের কাছেই শুধু পরিচিত। তা-ও নিক ফ্লিন্টকে কাজে লাগানোয়। এই লাইনে সবচেয়ে ভাল এজেন্ট সে।
পিটার, শোনো, প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল কিশোর, একটু আগে প্রযোজকদের সঙ্গে তোমার কথা কাটাকাটিটা শুনে ফেলেছি আমরা।
একটা সানগ্লাস পরল পিটার। চলো, বার্গার ব্রিসটোতে খেতে যাব। ওখানেই আলাপ করা যাবে। এই জায়গাটায় দম আটকে আসছে আমার।
দরজার বাইরে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। কাঁধে ক্যানভাসের ব্যাগ ঝুলিয়ে নেমে যাচ্ছে কয়েকজন অভিনেতা। পিটারকে দেখে হাত নাড়ল।
রলিকেও দেখা গেল ওদের মাঝে। কালো চোখ নাচিয়ে পিটারকে বলল, ববের ওখানে যাবে না?
তোমাকেও পটিয়ে ফেলেছে নাকি?
হাসল রলি, ভালই লাগে। উদ্ভট সব কাণ্ড করে বব। আমরা কল্পনা করে নিই নানা রকম শব্দ শুনছি। বেশ মজা পাই। আসতে পারো, তোমারও খারাপ লাগবে না।
আমার খিদে পেয়েছে।
ও, এ জন্যে যাবে না? এটা একটা সমস্যা হলো? কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে জিপার খুলল রলি। ভেতর থেকে বের করল প্লাস্টিকের বড় একটা পোটলা। বার্গার বের করে দিল।
দ্বিধা করল পিটার। বন্ধুদের দিকে চেয়ে বলল, তোমরা কি বলো?
তাজা বনরুটি আর গরুর মাংসের বড়ার সুগন্ধ যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল নাকে। হাত বাড়াতে গিয়েও সামলে নিল কিশোর, অনেক কষ্টে নিরস্ত করল নিজেকে। শরীরটাকে পিপে বানিয়ে সারাক্ষণ কষ্ট পাওয়ার চেয়ে খাবারের কষ্ট ভাল। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তা যাওয়া যায়। নতুন একটা জিনিস দেখতে পাব, অসুবিধে কি?
বার্গার নিতে মুহূর্ত দ্বিধা করল না মুসা, কিন্তু ববের ওখানে যাওয়ার কথা ভাবতেই থমকে গেল, অতীত জীবন! ভূতুড়ে কোন ব্যাপার নয় তো?
তার দিকে তাকাল রলি। বুঝতে পারল না।
জিনা বলে দিল, ভূতকে ভীষণ ভয় পায় মুসা।
.
ও, হাসল বলি। না না, ভূতপ্রেত নেই ওখানে। গ্যারান্টি দিতে পারি।
রলি ভূত নেই বললেও পুরো ব্যাপারটা ভূতুড়েই মনে হলো মুসার কাছে।
পিটারের গাড়িকে অনুসরণ করে ছোট একটা দোতলা বাড়ির পার্কিং স্পেসে গাড়ি ঢোকাল কিশোর। পিকআপটা না নিলেও চলত, এক গাড়িতেই জায়গা হয়ে যেত সকলের, কিন্তু বার্গারের লোভ যদি শেষ পর্যন্ত সংবরণ করতে না পারে এই ভয়ে খাবারওয়ালা গাড়িতে গেলই না সে।
সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বব রডম্যান। ঘন ভুরুর নিচে তার দৃষ্টি কেমন বদলে গেছে, নাপিতের দোকানে চুল কাটার সময় যেমন ছিল তেমন নয়, যেন বহুদূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। স্বাগত জানাল, জুতো খুলে ঢোকো, অনেক যত্ন করে মেঝে পরিষ্কার করেছি, এই বলে।
বাইরে জুতো খুলে রেখে শুধু মোজা পরে লম্বা, সরু একটা করিডর ধরে এগোল কিশোর, মুসা আর জিনা। শেষ মাথায় ছোট, জানালাবিহীন একটা ঘর। ঢোকার মুখে টেবিলে রাখা একটা আলোকিত টেবিল ল্যাম্পকে মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে ছায়াঘন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। অদ্ভুত সব চাট ঝোলানো দেয়ালে। গ্রহ-নক্ষত্র আর এমন সব চিহ্ন ও নকশা আঁকা, কিছুই চিনতে পারল না কিশোর। শেকসপীয়ারের একটা শ্বেত পাথরের মূর্তির নিচে একটা পিয়ানো পড়ে আছে।
ঘরের মাঝখানে একটা পুরানো কার্পেট। সেটাতে হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে বসেছে অভিনেতারা। চক্রের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে দরজার কাছে বসল বব। তার পাশে বসতে ইশারা করল কিশোর, মুসা ও জিনাকে।
ওরা বসলে অনুষ্ঠান শুরু করল বব। মাপা মাপা নরম গলায় বলল, চোখ বন্ধ করো সবাই নিজেদেরকে পাত্র তৈরি করো চারপাশের শক্তিদের জন্যে।
শিউরে উঠল মুসা। জিনার কাছে মনে হলো হাস্যকর। কিশোর বোঝার চেষ্টা করল কি বলতে চাইছে নাপিত।
কষ্ঠরা আজ এসেছিল আমার কাছে, বব বলছে। ওরা বলেছে তোমাদের কোন একজনের জন্যে আজ রাতে একটা দরজা খোলা থাকবে। এমন একটা দরজা যা শত শত বছর ধরে লুকানো রয়েছে। কার কথা বলছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলেনি। দরজাটা কোন ধরনের জীবনে নিয়ে যাবে তা-ও জানতে চেয়েছি, নীরব থেকেছে ওরা।
নাক টানল একজন অভিনেতা। এই আজব পরিবেশে শব্দটা অবাস্তব লাগল।
আবার কথা বলল বব, বেশ ভারি একধরনের ফিসফিস শব্দ, অনেক যন্ত্রণা, বার বার বলেছে ওরা, তবে সবশেষে কাটবে মহাভার, হালকা হবে শরীর।
খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান থাকলে শরীরের ওজন কমে গিয়ে শেষ পর্যন্ত হালকা হবেই, ভাবল কিশোর। অনুভব করল, তার দু-পাশের লোকের ধীরে ধীরে দুলতে আরম্ভ করেছে। গুঞ্জন করতে লাগল দুটো কণ্ঠ।
তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বব বলল, কিজার কথা ভাবো…ধীরে… খুলছে…।
ভূতের ভয় দূর হয়ে গেছে মুসার। ভাবল, তার টয়োটা করোলার দরজা খুলছে। ধীরে ধীরে। পিটম্যান আর্মটা লাগাতে কত সময় লাগবে?
ওই যে… বব বলল, নতুন একটা পরিবর্তন টের পাচ্ছ, বাতাস হঠাৎ করে বদলে গেলে যেমন অনুভূতি হয়?
আর সহ্য করতে পারল না একজন অভিনেতা, হেসে ফেলল। শশশ করে। তাকে থামতে বলল আরেকজন। বব নয়, অন্য কেউ, বুঝতে পারল কিশোর। ওই লোক বোধহয় পুরো ব্যাপারটাই বিশ্বাস করছে। অনেকেই হয়তো করছে, কে জানে!
এখন… বব বলল, দুলতে দুলতে ঢুকে পড়ো নিজেদের গভীরতম সত্তার ভেতরে…আমরা যখন দুলছি, তখন অদৃশ্য শক্তির পরিমাণ বাড়ছে, আগন্তুককে বের করে দেয়া হবে…
দুলতে শুরু করল কিশোর। শান্ত থাকো, নিজেকে বোঝাল সে, জোরাল অটো সাজেশন দেয়ার মত কোন ব্যাপার ঘটছে। ইচ্ছে করলে যোগ দিতে পারো, না করলে…
হ্যাঁ… উত্তেজনায় গলা আটকে আসতে চাইছে ববের, আমার বিশ্বাস ওটা এখানেই আছে…আমার বিশ্বাস তোমাদের মধ্যেও একজন সেটা অনুভব করতে পারছ…হ্যাঁ
পরক্ষণে ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গেল ঘরটা। চোখ বোজা অবস্থাতেও সেটা বোঝা যাচ্ছে। নিভে গেছে বাতিটা।
তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার চিরে দিল নীরবতা। থ্যাপ করে কার্পেটের ওপর পড়ল ভারি কিছু।
আপনাআপনি খুলে গেল তার চোখ। চেঁচিয়ে বলল, আলো কই, আলো!
অন্ধকারে নড়াচড়া, দেয়ালে নখ ঘষার শব্দ।
মুসার হাত আঁকড়ে ধরল জিনা।
খাইছে!…কে-ক্কে… তোতলাতে শুরু করল মুসা।
মাথার ওপরে আলো জ্বলে উঠল।
চিৎ হয়ে পড়ে আছে পিটার। চোখ বোজা। কপালের পাশে লাল দাগ।
তার মাথার কাছে পড়ে আছে উইলিয়াম শেকসপীয়ারের মূর্তিটা।
.
০৬.
না, লাগবে না, ঠিকই আছি আমি, আস্তে করে ববের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল। পিটার। তার কপালে ভেজা কাপড় রাখতে যাচ্ছিল নাপিত। মূর্তির বাড়িতে কপাল কাটেনি তার, তবে ব্যথাটা জোরেই লেগেছে। ফুলে গেছে। লালচে রঙটা বেগুনী হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
হাসপাতালে ফোন করি, রিসিভার তুলে নিল মুসা।
না। প্রায় চিৎকার করে উঠল পিটার।
থমকে গেল মুসা।
কিশোরের দিকে তাকাল পিটার, আজ রাতের শো আমি কিছুতেই মিস করতে পারব না! বিপদে পড়ে যাব!
কলিন আর রোমের সঙ্গে পিটারের কথা কাটাকাটির কথা মনে করল কিশোর। বুঝতে পারল, নাটক থেকে তাকে বের করে দেয়া হবে এই ভয় পাচ্ছে সে। সেটা অন্য কেউ বুঝে ফেলার আগেই তাড়াতাড়ি ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল কিশোর, কি করে পড়ল? টেবিলের ওপর গিয়ে পড়েছিলে নাকি?
কপালের আহত জায়গা ডলল পিটার। না, চোখ বন্ধ করে বসে ছিলাম। হঠাৎ পড়ল মাথার ওপর।
মূর্তিটা আবার আগের জায়গায় তুলে রাখতে রাখতে জিনা বলল, অনেক ভারি। ব্যথা সেই তুলনায় কমই পেয়েছেন।
হাসার চেষ্টা করল পিটার, আমার মা বলত, আমার নাকি লোহার মত কপাল।
আরেকজন অভিনেতা বলল, পড়ল কি ভাবে? টেবিলের কিনারে বসানো ছিল নাকি? হয়তো অদৃশ্য শক্তিরা আসার ফলে ঘরের বাতাসে যে কাঁপুনি উঠেছিল…
হাত তুলে থামিয়ে দিল তাকে কিশোর। টেবিলের কিনারটা দেখছেন না কেমন উঁচু করে তৈরি? তুফান এলেও মূর্তিটা পড়ার কথা নয়।
দরজা দিয়ে মনে হয় প্রেতাত্মাকে আসতে দেয়া উচিত হয়নি, রলি বলল। না দেখে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।
হালকা হাসি শোনা গেল।
কিন্তু রসিকতায় কান দিল না বব। গম্ভীর মুখ করে তাকাল পিটারের দিকে। রহস্যময় কণ্ঠে বলল, তোমার বেলায় কেন এটা ঘটল আশা করি বুঝতে পেরেছ।
ক্ষণিকের জন্যে পিটারের চোখের তারায় ভয় ফুটতে দেখল কিশোর। জোর করে হাসার চেষ্টা করল অভিনেতা, চোখ সরিয়ে নিল আরেক দিকে।
আরেকজন অভিনেতা জিজ্ঞেস করল, কিসের কথা বলছ, বব?
হ্যাঁ, কিসের কথা বলছে?-কিশোরও ভেবে অবাক হলো। একা পেলে জিজ্ঞেস করতে হবে পিটারকে।
ঘড়ি দেখল বব। আজ আর সময় নেই। অনুষ্ঠানটা আরেক দিন করা যাবে।
হ্যাঁ, উঠে দাঁড়াল পিটার। অন্তত আধডজন বন্ধু আর সহকর্মী তাকে সাহায্য করতে চাইল। কিন্তু কারও সাহায্য না নিয়ে একাই ধীরে ধীরে এগোল দরজার দিকে।
থিয়েটারের লোকেরা পিছু নিল তার। মুসা আর জিনাকে নিয়ে রয়ে গেল কিশোর। ববকে অনুরোধ করল, একটু পরীক্ষা করে দেখি ঘরটা?
কাঁধে ভারি ব্যাগ তুলে নিল বব। বাতির সুইচের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, নাহ্, এখনি বেরিয়ে যেতে হবে। খুব শক্তিশালী অদৃশ্য উপস্থিতি টের পাচ্ছি আমি। এটাকে এভাবেই থাকতে দেয়া উচিত।
কিন্তু…
কিশোর কথা শেষ করার আগেই কিট করে সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল বব।
অন্ধকারে মাথা নাড়ল কিশোর। তদন্তটা করতে দেয়া হলো না বলে নিরাশ হয়েছে।
.
সাড়ে সাতটায় স্টেজের দরজা দিয়ে যখন ঢুকছে কিশোর, খিদেয় পেটের মধ্যে পাক খাচ্ছে নাড়িভূঁড়ি। কিন্তু খেতে যাওয়ার সময় নেই এখন আর।
দেয়ালের একটা সাইন-ইন শীটের সামনে দাঁড়াল পিটার।
গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে বলল সে, শো শুরু হওয়ার আধঘন্টা আগে এখানে সই করতে হয় আমাদের। সময়মত এই সই না দেখলে অন্য ব্যবস্থা করবে ভিনসি জাপা।
মেসেজ বোর্ডে নতুন একটা নোটিশ দেখতে পেল জিনা। পিটারকে বলল, আরি, এটার কথা তো বলেননি আমাদের!
সাইনে লেখা
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের জন্যে বলা হচ্ছে:
ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড! ওয়াইল্ড! কোরাস অডিশন
মেইন স্টেজ, গারবার থিয়েটার
বৃহস্পতিবার, সকাল ১১.০০ টা
দুটো পার্টে অভিনয়ের জন্যে জরুরী ভিত্তিতে
একজন অভিনেতা ও একজন অভিনেত্রী লাগবে।
কেন? পিটার জিজ্ঞেস করল, তোমার আগ্রহ আছে?
ইয়ে…হলে মন্দ কি? নাচ তো শিখছিই আমি।
বেশ! এখনও দু-দিন সময় আছে হাতে। তৈরি হতে থাকো। কাজটা পেয়ে
গোয়েন্দাদের নিয়ে করিডরে বেরিয়ে এল পিটার, টোপাজকে অফিসে বসে থাকতে দেখে হাত নাড়ল।
এবার আর ড্রেসিং রুমে ঢুকতে কিশোরদের বাধা দিল না ডোরম্যান। একটা খাম তুলে নিয়ে কিশোরের দিকে বাড়িয়ে ধরল পিটার, নাও, তিনটে ফ্রী টিকেট আছে এতে। সবচেয়ে ভালগুলোর তিনটে। পঞ্চম সারির মাঝখানে। এখন যাও, আমার কাজ আছে। তৈরি হতে হবে।
বাইরে বেরিয়ে জিনা বলল, লোকটার এনার্জি আছে। বিকেলে আমরা আসার পর থেকে কতগুলো ঘটনা ঘটে গেল। মাথায় এমন একটা বাড়ি খেল। তারপরও কিছু হয়নি। এখনও একেবারে স্বাভাবিক।
মাথা ঝাঁকাল মুসা। থিয়েটারের মধ্যে এ ভাবে আর কখনও ঢুকিনি। ভালই লাগে কিন্তু। স্টেজে ওঠাটা দারুণ রোমাঞ্চকর নিশ্চয়। এত লোকের চোখ সব তোমার ওপর থাকবে, হাসবে, প্রশংসা করবে, হাততালি দেবে…খুব ভাল, তাই না?
কিশোরও একমত হলো। শো-বিজনেস থেকে সরে আসার জন্যে জীবনে এই প্রথমবার দুঃখ হলো কিশোরের।
.
শো শেষ হওয়ার পর স্টেজের আলো নিভে এল, স্তব্ধ নীরবতা বিরাজ করতে লাগল হলের মধ্যে। সবাইকে থ করে দিয়েছে পিটার। তার জোরাল কণ্ঠের শেষ। কথাগুলো যেন এখনও ঘরের বাতাসে ভাসছে।
প্রথমে একটা-দুটো হাততালি পড়ল। তারপর যেন ফেটে পড়ল দর্শকরা। অনৈকে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, শিস দিয়ে প্রশংসা করতে লাগল পিটারের।
সাংঘাতিক। মুসা বলল। দুই আঙুল মুখে পুরে তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে উঠল।
আলো জ্বলে উঠল হলে। স্টেজের পর্দা পড়ল। আবার যখন সরল, স্টেজেও উজ্জ্বল আলো জ্বলছে তখন। কয়েক সারিতে দাঁড়িয়েছে অভিনেতারা। মূল অভিনেতারা রয়েছে সামনের সারিতে।
দর্শকদের অভিবাদন জানাতে সবার শেষে মঞ্চের একপাশ থেকে বেরিয়ে এল। পিটার। হাততালি আর চিৎকারে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়।
হাসল পিটার। মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাল দর্শকদের। মেকআপে ঢাকা পড়েছে তার কপালের দাগটা। কিশোর, মুসা আর জিনার দিকে তাকিয়ে আলতো চোখ টিপল। স্টেজের কিনারে এসে দাঁড়াল অনেক আগ্রহী দর্শকের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্যে।
কি যেন বলতে যাচ্ছিল মুসা, থেমে গেল বিস্ফোরণের শব্দে। সেই সঙ্গে তীব্র আলোর ঝিলিক। থতমত খেয়ে গেল দর্শকরা। চিৎকার করে উঠল কেউ কেউ।
হাঁ করে তাকিয়ে আছে কিশোর।
মুহূর্ত আগেও পিটার যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে এখন ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলী!
.
০৭.
সীটের মাঝের গলিপথ ধরে ছুটল কিশোর, মুসা আর জিনা। হই-চই করছে। দর্শকরা। যারা সীটে বসা ছিল, তাদের অনেকেই উঠে পড়েছে।
ধাক্কা দিয়ে সামনের লোক সরিয়ে পথ করে এগোচ্ছে মুসা! পেছনে অন্য দু জন। অর্কেস্ট্রা রাখার জায়গাটা, অর্থাৎ অর্কেস্ট্রা পিট পেরিয়ে লাফিয়ে উঠল মঞ্চে।
ধোঁয়া সরে গেছে। নিথর হয়ে পড়ে আছে পিটার। কনুই দিয়ে লোক সরিয়ে তার কাছে পৌঁছল মুসা আর কিশোর।
পিটারের মাথাটা তুলে ধরেছে একজন অভিনেত্রী।
ঠিক আছে তো? জানতে চাইল কিশোর। হাটু গেড়ে বসে পড়ল পিটারের পাশে।
কপালে হালকা একটা লাল দাগ দেখা যাচ্ছে, বেরিয়ে পড়েছে কড়া মেকআপ ভেদ করে।
চুমু খাও আমার কপালে, ফিসফিস করল পিটার
কুঁচকে গেল কিশোরের ভুরু, মানে?
আমাকে..আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে…অর্কেস্ট্রাটা কোথায়?
পিটার! আমি কিশোর, কিশোর পাশা। তোমার কি হয়েছে?
বার কয়েক মিটমিট করে খুলে গেল পিটারের চোখের পাতা। ক্কি কিশোর!..মনে হচ্ছে ওয়েস্ট সাইড স্টোরির মৃত্যুর দৃশ্যটা অভিনয় করছিলাম!।
হাসি এবং স্বস্তি একসঙ্গে ফুটল অনেকের মুখে। কিন্তু কিশোর আরও গম্ভীর হয়ে গেল। তাকিয়ে আছে পিটারের মুখের দিকে।
স্টেজ ম্যানেজার জাপা আর একজন লম্বা ড্যাসার দাঁড়াতে সাহায্য করল পিটারকে।
ধরা লাগবে না, আমি ঠিকই আছি, টলতে টলতে মঞ্চ থেকে নামার জন্যে এগোল সে।
আবার প্রশংসার হাততালি দিল দর্শকরা। ভাবল, আরেকটা অভিনয় করছে পিটার! বেরোনোর দরজার দিকে সারি দিয়ে এগোতে শুরু করল ওরা
মঞ্চের কিনারে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাল কিশোর।
অর্কেস্ট্রা পিটে দু-জন ইলেকট্রিশিয়ান তার পরীক্ষা করছেrমঞ্চের কিনারে অনেকটা টর্চের ব্যাটারির মত দেখতে একটা ধাতব যন্ত্রের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে তারগুলো। জাহির বিলিয়ার্ড আর আরেকজন মিউজিশিয়ান পঁড়িয়ে ওদের কাজ দেখছে।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
হাত নাড়ল জাহির, কি জানি? আমার মাথাটাই উড়িয়ে নিত আরেকটু হলে।
ধাতব যন্ত্রটা দেখিয়ে গোমড়ামুখো এক ইলেকট্রিশিয়ান বলল; ফ্ল্যাশ-পাষ্টেলুজ কানেকশন। এর মধ্যে খুব কম শক্তির একধরনের বিস্ফোরক রাখা থাকে ইলেকট্রিক সিগন্যাল পেলেই ফেটে যায়। কালো হয়ে যাওয়া যন্ত্রটার দিকে আবার হাত তুলল সে, পাওয়ারের গণ্ডগোলে মনে হয় কোন ধবনের সিগন্যাল পাঠিয়েছে। ব্যস, গেছে ফেটে।
মাঝে মাঝেই ঘটে নাকি এ রকম? জানতে চাইল কিশোর।
ঘটে না, তবে ঘটতে পারে। এখানে এই প্রথমবার ঘটল।
হুঁ-ভাবল কিশোর, ব্যাপারটা স্বাভাবিক ধরে নিতে ইচ্ছে করল না তার।
আরও কয়েক সেকেন্ড ইলেকট্রিশিয়ানদের কাজ দেখল সে আর মুসা, তারপর চলে এল পিটারের ড্রেসিং রূমে। জিনা আগেই এসে বসে আছে। আরও কয়েকজন অভিনেতা কথা বলছে। ইলেকট্রিক হট পটে চা বানাচ্ছে একজন। মেকআপ টেবিলের সামনে বসেছে পিটার, ফোনে কথা বলছে, কি করে ফ্ল্যাশ-পটটা ফাটল বলতে পারব না।…কেমন আছি জিজ্ঞেস করলে না?…হ্যাঁ, ভালই আছি।…ঠিক আছে, রুথ, পরে দেখা হবে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিল সে। কিশোরকে দেখে বলল, এসেছ। অন্য অভিনেতাদের বলল, এই, তোমরা এখন যাও, মেহমান আছে। আমি ঠিক হয়ে গেছি। অনেক ধন্যবাদ।
হাসিমুখে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অভিনেতারা। গায়ে কাঁটা দিল একবার পিটারের। শূন্য দৃষ্টি ফুটল চোখে। এক সন্ধ্যায় তিন-তিনবার দুর্ঘটনা! আনমনে কপালের জখমে হাত বোলাল। আরও কতবার হবে কে জানে…
সামনে ঝুঁকল কিশোর। এই শো-তে যারা কাজ করছে, তাদের কথা কিছু বলো তো আমাকে। জানা দরকার।
ভুরু সামান্য উঠে যেতে দেখল পিটারের। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকাল কিলোর। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বব রডম্যান।
যাক, ভালই আছ, স্বস্তিভরা কণ্ঠে বলল বব।
কেন, খুব খারাপ থাকব ভেবেছিলে নাকি? মনে করেছ পুরানো অভিশাপে আমাকেও ধরেছে। ম্যাকবেথ আর না বলার অনুরোধ করতে এসেছ?
শক্ত হয়ে গেল বব। তোমার আর শিক্ষা হবে না, পিটার!
কিশোরদের দিকে তাকাল অভিনেতা। বলল, বুঝতে পারছ না তো? দাঁড়াও, বুঝিয়ে দিই। ম্যাকবেথ নামটা বলা আমার জন্যে বারণ। বললেই ম্যাকবেথের অভিশাপে পড়তে হবে।
থমথমে হয়ে গেছে ববের মুখ। দোহাই তোমার, এবার বন্ধ করো, পিটার?
ব্যাপারটা কি বলুন তো? জানতে চাইল মুসা।
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল বব। থিয়েটারের জগতের সবচেয়ে প্রাচীনতম অভিশাপ এই শব্দটা। উইলিয়াম শেকসপীয়ারের এই বিখত নাটকের নামটা মঞ্চে বলা অভিনেতাদের জন্যে বারণ। যে বলবে, তারই দুর্ভাগ্য শুরু হবে, নানা ভাবে…
কচু হবে, পিটার বলল।
নাকের ফুটো বড় হয়ে গেল ববের। দেখো, পিটার, পুরানো অনেক অভিশাপকে পাত্তা না দিয়ে বহুলোক অপঘাতে মরেছে। তোমাকে ভালবাসি বলেই সাবধান করছি, বিশ্বাস করো আর না করো, রসিকতা কোরো না ওসব নিয়ে। চুপ করে থাকলেই হয়। এই যে একের পর এক অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে, আঘাত আসছে তোমার ওপর এর কি ব্যাখ্যা দেবে? যাওয়ার জন্যে ঘুরল সে। আবার ফিরে তাকাল কাঁধের ওপর দিয়ে। আবারও বলছি, তোমাকে ভালবাসি বলেই এত কথা, নইলে আমার কি ঠেকা ছিল? এখনও সাবধান হও। উইলিয়াম শেকসপীয়ারের আত্মাকে নিয়ে অনেক বদনাম আছে, কাউকে কখনও ওটা ক্ষমা করেছে বলে শোনা যায়নি।
বেরিয়ে গেল বব।
কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। চোখে অস্বস্তি।
লোকটা ভাল, পিটার বলল, তবে বোকা। নইলে এ সব বিশ্বাস করে?
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। চিন্তায় ডুবে গেছে। পিটারের কথায় কান আছে বলে মনে হলো না।
মুসা বলল, এ সব ব্যাপার একেবারে উড়িয়ে দেয়া কিন্তু ঠিক না।
কৃত্রিম বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল পিটার, আরি, আরও একজন দেখি পাওয়া গেছে। মুসাকে আরও গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে গাল চুলকাল, ভাবল, তারপর বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, না বললে যদি খুশি হও তোমরা, নাহয় না-ই বললাম।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, বাস্তবে ফিরে এল যেন কিশোর, এই শো-তে যারা কাজ করছে, তাদের ব্যাপারে কিছু বলো।
.
আরও একঘণ্টা পর থিয়েটার থেকে বেরোল ওরা। পিটার বসল তার গাড়িতে, জিনা, কিশোর আর মুসা উঠল পিকআপে।
গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবতে লাগল কিশোর, অনেক কথা বলেছে তাকে পিটার, কিন্তু তার মধ্যে থেকে কোন সূত্র উদ্ধার করতে পারেনি।
আগে আগে গাড়ি চালাল পিটার। পথে কোন দুর্ঘটনা হতে পারে ভেবে পেছনে থেকে তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল গোয়েন্দারা। নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরল।
জিনাকে তাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ইয়ার্ডে ফিরে চলল মুসা আর কিশোর।
আমার মনে হয় জাপার কাজ, মুসা বলল। ফ্ল্যাশ-পট ফাটানো তার জন্যে কঠিন কিছু না।
হয়তো নয়, সামনের পথের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, কিন্তু ববের বাড়িতে তিনি ছিলেন না। তাহলে আলো নিভিয়ে দিয়ে মূর্তি ফেলল কে? তাঁবুর কাছেও তাঁকে দেখা যায়নি। তাহলে সাইনবোর্ডই বা ফেলল কে?
ইয়ার্ডে ঢুকে ওঅর্কশপের সামনে গাড়ি রাখল কিশোর। নামার আগে বলল, আরও একটা ব্যাপার, পিটারের সঙ্গে কেন শত্রুতা করবেন ম্যানেজার? মোটিভটা কি?
কি জানি? হাত ওল্টাল মুসা। তাহলে কে করল এ কাজ? নিরু না তো?
সাইনবোর্ডটা পড়ার সময় অবশ্য ওখানে ছিল সে। স্টেজেও কাজ করেছে। কিন্তু পিটার বলেছে, তার কাজ সেট সাজানো, আর কিছুতে হাত দেয়া নিষেধ।
গাড়ি থেকে নেমে হেডকোয়ার্টারে ঢুকল ওরা। টেলিভিশনটা অন করে দিয়ে চেয়ারে বসল। নিউজ হচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে বলল, পিটারের ওপর কোন কারণে অবশ্য কড়া রাগ থাকতে পারে নিরুর। তবে কড়া রাগ তার সারা দুনিয়ার ওপরই থাকতে পারে, স্বভাবটাই ওরকম।
একটা টুলে বসল মুসা। ফ্ল্যাশ-পটটা ছিল অর্কেস্ট্রা পিটে। ফাটানোর কায়দাটা জানা থাকলে কোন মিউজিশিয়ানও কাজটা সেরে দিতে পারে।
জাহির বিলিয়ার্ডের মত কেউ?
মাথা ঝাঁকাল মুসা। ববকেও সন্দেহের তালিকায় ফেলা যায়। লোকটার মাথায় দোষ আছে। রলির ওপরও সন্দেহ হয়। ববের ঘরে ছিল মূর্তিটা পড়ার সময়। পিটারকে সরাতে পারলে নতুন স্টার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তার।
আমার মনে হয় না রলি আছে এ সবে, কিশোর বলল। তার স্টার হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। পিটার সরলে সঙ্গে সঙ্গে আর্ট টিলারিকে খবর পাঠাবেন কলিন। বরং তাকেই সন্দেহ করা উচিত।
টিভির দিকে তাকাতেই পিঠ সোজা হয়ে গেল মুসার, খাইছে, দেখো!
পর্দায় দেখা যাচ্ছে গারবার থিয়েটার। আস্তে আস্তে সরে গেল ক্যামেরা, নিতা নিউমারকে দেখা গেল, পিটারের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় যে দুর্ঘটনা ঘটেছে সবিস্তারে সেটার বর্ণনা শুরু করল।
আতঙ্কিত নিরুকে দেখা গেল, চিৎকার করে সাবধান করছে। তারপর দেখা গেল, সাইনবোর্ডটা পড়ছে। স্লো-মোশনে দেখানো হলো দৃশ্যটা। নিচে এদিক ওদিক ছুটে পালাচ্ছে লোকে।
সাইনবোর্ডটা পড়ে ভাঙল। নিজের অজান্তেই টুলে বসেও কুঁকড়ে গেল মুসা। এরপর পর্দায় বড় হয়ে ফুটল পিটারের চেহারা। ঘাম-চকচকে, বিধ্বস্ত।
মঞ্চে শো শেষে ফ্ল্যাশ-পট বিস্ফোরিত হওয়ার কথাও বাদ গেল না সংবাদে।
খবরটা জানল কি করে ওরা
কিশোরের প্রশ্নের জবাবেই যেন বলল সংবাদ-পাঠক, ওগুলো আসলে দুর্ঘটনা না অস্বাভাবিক কিছু এ ব্যাপারে আমাদের লেট-নাইট নিউজ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে। একজন জবাব দিয়েছে, এর মধ্যে অনেক বেশি শক্তিশালী আর বিপজ্জনক কিছুর অদৃশ্য হাত রয়েছে।
বব রডম্যানকে হাজির করা হলো। থিয়েটারের বাইরে ক্যামেরার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নার্ভাস ভঙ্গিতে ম্যাকবেথের অভিশাপের কথা বলল।
ববের কথা শেষ হলে ক্যামেরার দিকে ফিরল রিপোর্টার। নাটকীয় বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বলল, থিয়েটারের জগতে স্কটিশ ওই নাটকটা নিয়ে একটা সাংঘাতিক ভীতি আছে। নামটা কেউ উচ্চারণ করতে চায় না। এটা কি কুসংস্কার? কেউ বলে, হ্যাঁ, কিন্তু তারাও বলে ভয়ে ভয়ে। নাম উচ্চারণ করার সময় থমকে যায়। সাড়ে তিনশোরও বেশি বছর আগে বার্ড অভ অ্যাভনের মৃত্যুর পর হয়তো জানতে পারব আমরা কেন এই বিশ্বাস আজও এত জোরাল।
কিশোরের দিকে ফিরল মুসা, এই বার্ড অভ অ্যাভনটি কে?
শেকসপীয়ারের ডাকনাম।
অস্বস্তি দেখা দিল মুসার চোখে। কিশোর, তুমি হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না, কিন্তু জবাবটা তো এখানেই!
কিসের জবাব?
পিটারকে খুনের চেষ্টা জাহির কিংবা বব কিংবা অন্য কেউ করেনি। কাজটা শেকসপীয়ারের ভূতের!
.
০৮.
পরদিন সকালে চোখ বড় বড় করে কিশোরের মুখে সব কথা শুনল রবিন। ইস, কাল বিকেলে তোমাদের সঙ্গে যেতে পারলে খুব ভাল হত। কিন্তু অফিসে এত কাজ…
কম্পিউটার অন করল কিশোর। জানি, পুরো হপ্তাটাই ব্যস্ত থাকবে। তবু এরই মধ্যে সূত্রের খোঁজ কোরো।
জাহিরের সঙ্গে কথা বলব। যে কোন সময় চলে আসবে।
ঝট করে ঘুরে তাকাল কিশোর, জাহির এখানে আসবে?
হ্যাঁ। সাউন্ড সিসটেমের ব্যাপারে ফ্যানাটিক বলতে পারো। যখন বললাম আমাদের কাছে কোয়াড্রোফোনিক স্পীকার আছে, কিছু টেপ নিয়ে এসে বাজিয়ে শুনতে চাইল।
আমরা কে বলেছ নাকি?
না। আমি কেবল বলেছি এখানে আড্ডা মারি আমরা। ক্ষতি করে দিলাম নাকি?
নাহ। আমরা যে গোয়েন্দা এ কথাটা গোপন রাখলেই চলবে। কেস শেষ হওয়ার আগে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। জাহিরকেও না।
কম্পিউটারে মন দিল কিশোর। আঙুলের কয়েকটা দ্রুত টোকায় ডাটাসার্ভ নেটওঅর্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলল। এটা একটা ইনফর্মেশন সার্ভিস, কম্পিউটার এনসাইক্লোপিডিয়া, সদস্য হলেই ব্যবহার করা যায়।
অ্যাই, রবিন! বাইরে থেকে ডাক শোনা গেল, আছ নাকি?
ওই যে, জাহির এসে গেছে।
তাকে ওঅর্কশপের ভেতর নিয়ে এল রবিন।
কাঁধে ক্যানভাসের ব্যাগ। ঘরের ভেতর চোখ বোলাল জাহির। চওড়া হাসি ফুটল। চমৎকার! এই ক্লাবের সদস্য হতে হলে কি করতে হবে আমাকে?
হাসল রবিন। কি ধরনের ক্যাসেট এনেছেন দেখি আগে, তারপর বলব।
ব্যাগটা টেবিলে রাখল জাহির। দেখো।
ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল রবিন। বের করে আনল একমুঠো ক্যাসেট। বাহ, কি সব জিনিস! দা মোস্ট হ্যাপি ফেলা, ওয়েস্ট সাইড স্টোরি, ক্যানডিড, সুইনি টোড–সব তো শো মিউজিক। কোত্থেকে জোগাড় করলেন? বাপের কালেকশন মেরে দিয়েছেন?
না, মাথা নাড়ল জাহির, ইদানীং আমার এগুলোই ভাল লাগতে আরম্ভ করেছে। হোক না পুরানো আমলের।
আমি ভেবেছিলাম আপনি রক মিউজিশিয়ান। কিন্তু যা দেখছি…আজকালকার ভাল জিনিসের তুলনায় এগুলো তো একেবারে…
কি বলছ বুঝতে পারছি। পিটারের সঙ্গে খাতির না হলে আমিও ঢুকতাম না। এর মধ্যে। যাই বলো, লোকটা জিনিয়াস। এ যাবৎ যত মিউজিক্যাল লেখা হয়েছে, সবগুলোর সব গান তার জানা। বেশির ভাগই আবর্জনা, কিন্তু কিছু আছে শুনলে চমকে যেতে হয়।
একটা মুহূর্ত জাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকল রবিন। আমি ভেবেছিলাম টাকার জন্যে ওয়াইল্ড ওয়াইন্ডে কাজ নিয়েছেন আপনি। কিন্তু যা সব দেখছি…
টাকার জন্যেই। অনেক দিন ধরে চলে এ রকম একটা শো-তে কাজ নিতে পারলে টাকার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। তা এত হেলাফেলা না করে বাজিয়েই দেখো না, খারাপ লাগবে না।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিল রবিন। বেশ, শুনব। একটা কথা, শুনেছি, রক সিনের চেয়ে শো-বিজ লাইফ খুব একটা ভাল না। শো বন্ধ হয়ে গেলে কাজও চলে যাবে আপনার। কিন্তু রক কখনও হুট করে বন্ধ হয় না, টাকাও অনেক বেশি…
জানি। কাদের জন্যে বেশি? হাতে গোণা কয়েকজনের জন্যে, যাদের গান হিট হয়ে গেছে। আমার মত মড়াদের জন্যে নয়। এগিয়ে গিয়ে সুইনি টোডের ক্যাসেটটা ক্যাসেট প্লেয়ারে চাপিয়ে দিল জাহির। শোনো, কেমন লাগে?
ওয়র্কশপে ছড়িয়ে পড়ল বিষঃ মিউজিক। কিশোরের ভাল লাগল। ম্যাকবেথের অভিশাপ সম্পর্কে তথ্য খোঁজার পরিবেশ তৈরি করে দিল তাকে। কীবোর্ডে উড়ে চলল ওর আঙুল। পর্দায় শব্দ ফুটতে থাকল:
থিয়েটার
কুসংস্কার
অভিশাপ
প্রতিটি ফাইল খুঁজে দেখল সে। কিছুই পেল না।
বের করল, ম্যাকবেথ
সংক্ষেপে কাহিনী বলা হয়েছে নাটকের। রাজা হওয়ার জন্যে একজনকে খুন করেছিল ম্যাকবেথ নামে একজন। ডাইনীরা তাকে সাবধান করে দিয়েছিল, দুর্গের চারপাশ ঘিরে যখন এগিয়ে আসবে বন তখন তার মৃত্যু হবে। ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিল। কিন্তু বনটা আসল বন নয়, পাতাসহ ডাল কেটে ক্যামোফ্লেজ তৈরি করে তার আড়ালে আড়ালে এগিয়ে এসেছে সৈন্যরা। রক্তাক্ত এক বিদ্রোহে মারা পড়ল ম্যাকবেথ।
ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজতে লাগল কিশোর। চারটে সিনেমার নাম পাওয়া গেল…
হঠাৎ থেমে গেল সে। চারপাশ ঘিরে যখন এগিয়ে আসবে বন–পরিচিত না বাক্যটা?
এই সময় বাজল ফোন। রবিন ধরল।
সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিল কিশোর। ড্রয়ার খুলে একটা ফাইল বের করল। তাতে কিছু নোট আছে। লিখে রেখেছে:
*কথায় ব্রিটিশ টান। বুড়ো মানুষের কণ্ঠ; বলেছে, সাবধান! থেসপিয়ান!
*চিঠিতে লেখা–রক্তেভরা সিংহাসনে মারা যাবে সে।
*চিঠিতে লেখা–বন এগিয়ে এসে গিলে ফেলবে তাকে।
চেয়ারে হেলান দিল কিশোর। পিটারের মত ঠিক একই ধরনের হুমকি ম্যাকবেথকেও দেয়া হয়েছে। যোগাযোগটা কোথায়?
ভাবতে লাগল সে। কে ফোন করেছে পিটারকে? বব রডম্যান? চিঠিগুলোও কি তারই লেখা? কেন করছে এ সব? অভিশাপটা যে সত্যি এটা বোঝানোর জন্যে? দুর্ঘটনাগুলোও তারই সৃষ্টি? কিন্তু এতসব করে লাভটা কি তার?
অন্য কেউও হতে পারে। এমন ভাবে করছে, যাতে সন্দেহটা ববের ওপর পড়ে। কারণ অভিশাপ নিয়ে বড় বেশি মাথা ঘামাচ্ছে বব।
হঠাৎ করেই পেটের মধ্যে অদ্ভুত এক শূন্য অনুভূতি হলো কিশোরের। অভিশাপটাতে কি আসলেই কিছু আছে?
মনে মনে হেসে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল। এ সব সে বিশ্বাস করে না।
কিন্তু তবু…
ভাবনায় বাধা পড়ল রবিনের কথায়, মুসা করেছে, কিশোর। তোমাকে বলতে বলেছে, স্কুলে যাচ্ছে। বাস্কেটবল প্র্যাকটিসের ব্যাপারে নাকি কি কাজ আছে ওখানে। বেশিক্ষণ লাগবে না।
আচ্ছা, অন্যমনস্ক হয়ে বলল কিশোর। আবার ভাবনায় ডুবে গেল সে।
জাহিরের টেপ বাজানো শেষ হলো। রবিন বলল, খিদে পেয়েছে। কোথাও গিয়ে কিছু খেয়ে এলে কেমন হয়?
খুব ভাল হয়।
কিশোর, তুমি কি বলো?
তোমরা যাও। আমার কাজ আছে। শেষ করতে হবে। মুসার জন্যেও অপেক্ষা করতে হবে। ও এলে ওকে নিয়ে বেরোব। পিটারের ওখানে যেতে হবে।
ঠিক আছে। পরে দেখা হবে।
জাহিরকে নিয়ে বেরিয়ে গেল রবিন।
মনিটরের পর্দার দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু মাথায় ঘুরছে খাবারের ভাবনা। ডায়েট কন্ট্রোল করতে গিয়ে ভাল খাবার আর পেটে পড়ছে না অনেক দিন। মনে পড়ল রলির বের করে দেয়া বার্গারের কথা-কামড় বসাচ্ছে রলি আর পিটার, ববের বাড়িতে যাওয়ার আগে…
ববের বাড়ি!
হুম! আনমনেই মাথা দোলাল কিশোর। একটা জরুরী কাজ বাকি রয়ে গেছে। কাজটা আগের দিনই করার কথা ছিল, করতে পারেনি।
চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল সে। বব রডম্যান এখন বাড়ি থাকলেই হয়।
০৯.
প্রথম যেতে হবে রকি বীচ হাই স্কুলে, মুসাকে তুলে নেয়ার জন্যে।
ওকে খুঁজে বের করতে দেরি হলো না। জিনাকেও পাওয়া গেল ওখানে। মেয়েদেরও বাস্কেটবল প্রতিযোগিতা আছে।
কিশোরকে দেখে দু-জনেই অবাক হলো। বাস্কেটবলের প্র্যাকটিস দেখতে এসেছ? জিজ্ঞেস করল জিনা।
না, মুসাকে নিয়ে যেতে। তোমাকে পেয়ে গিয়ে ভালই হলো। কাল ববের বাড়িতে শেকসপীয়ারের মূর্তিটা তুলে রেখেছিলে তুমি। কেমন লেগেছিল?
দ্বিধা করল জিনা। মার্বেলের মত ঠাণ্ডা, মসৃণ…
আর কিছু?
ভাবল জিনা, আঠা আঠা!
কি ধরনের আঠা? তেলতেলে খাবারের ওপর যেমন থাকে, বার্গারের ওপর?
আবার দ্বিধা করল জিনা। কি জানি, হবে হয়তো।
এতেই চলবে। মুসার দিকে তাকাল কিশোর, যাবে না?
কাজ শেষ হয়নি তো এখনও।
ঘড়ি দেখল কিশোর। ১টা বেজে ৫ মিনিট। থিয়েটারে যাওয়ার কথা দুটোর সময়। এক ঘণ্টা সময় নেই হাতে। ববের ওখানে গেলে এক্ষুণি যেতে হবে। ঠিক আছে, তুমি থাকো। আমি একাই সেরে আসি। দুপুর দুটোয় থিয়েটারে হাজির থেকো।
প্রায় ছুটে পার্কিং লটে ফিরে এল কিশোর। পিকআপে চড়ে স্টার্ট দিল। ফ্রিওয়েতে বেরিয়ে এসে রওনা হলো পশ্চিম হলিউডে।
কাজটা সহজ হবে না–চালাতে চালাতে ভাবছে সে-ববের কাছ থেকে তথ্য আদায় করাটা সহজ না।
ববের বাড়ির সামনে যখন গাড়ি রাখল সে, ঘড়িতে ঠিক দেড়টা বাজে। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠল ওপরে। দরজার ঘণ্টা বাজাল।
কে? ভেতর থেকে সাড়া এল।
কিশোর পাশা।
নীরব হয়ে রইল ওপাশ।
পিটার হাইয়েমের বন্ধু, আবার বলল কিশোর।
দরজা খুলল। চোখের পাতা সরু হয়ে এল ববের, তোমার নাম যে কিশোর, জানতাম না। তোমার নামের মধ্যে একটা অনুসন্ধানের গন্ধ পাচ্ছি। জানার ইচ্ছে বড় প্রবল।
সত্যি বলতে কি, অস্বস্তিতে পড়ে গেল কিশোর, আসলে কয়েকটা প্রশ্নই করতে এসেছি আপনাকে। ভেতরে আসব?
ঘড়ি দেখল বব। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেরোব, থিয়েটারে যেতে হবে। কি প্রশ্ন তোমার?
আমার বন্ধু পিটারের ব্যাপারে। ভয়ই লাগছে। অভিশাপ নিয়ে তার এমন হাসিঠাট্টা ভাল লাগছে না আমার। তার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আপনি কি পরামর্শ দিতে পারেন, কি করা যায়?
মাথা ঝাঁকিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল বব, এসো।
লোকটার চোখে আলোর ঝিলিক চোখ এড়াল না কিশোরের। করিডরের শেষ মাথায় ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বব বলল, আমার অনুষ্ঠান তাহলে ভাল লেগেছে তোমার?
লেগেছে। তবে খিদে না থাকলে আরও লাগত।
হাসল বব। আসলে খালি পেটেই এ সব কাজ করা ভাল। আমি তো কাল সারাদিনই কিছু খাইনি।
যা ভাবার ভেবে ফেলল কিশোর–বর কিছু না খেয়ে থাকলে তার হাতে বনরুটির তেল লাগার কথা নয়। কাল বিকেলে রলি আর পিটার বার্গার খেয়েছে। তার আঙুলে লেগে থাকাটা স্বাভাবিক।
সুইচ টিপে আলো জ্বালল বব। দরজার ডান পাশে সুইচটা। আরেকটু ডানে সরে দেয়ালের গায়ে সকেট, তাতে প্লাগ ঢুকিয়ে টেবিল ল্যাম্পের লম্বা তার বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেঝেতে পড়ে থাকা তারটার মাঝামাঝি জায়গায় কয়েকটা প্যাঁচ খেয়ে আছে। টেবিলেই রয়েছে ল্যাম্পটা। উল্টোদিকের টেবিলে রাখা শেকসপীয়ারের মূর্তিটা, গম্ভীর, সার্বক্ষণিক কুটি করে আছে।
মনে মনে হিসেব করল কিশোর, সকেট থেকে ল্যাম্পের দূরত্ব পনেরো ফুট। মনে করার চেষ্টা করল অনুষ্ঠানের সময় কে কোথায় বসেছিল। দরজার কাছে বব, তার ডান পাশে চশমা পরা একটা মেয়ে, তার পাশে কোকড়া-চুল এক লোক, তারপর রলি, এবং তারপর তিনজন অভিনেতা। তাদের শেষজনের পাশে পিটার, মূর্তিটার কাছাকাছি, তারপর আরও দু-তিনজন অভিনেত্রী। চক্রের বাকি অংশটা। পুরণ করেছে সে নিজে, মুসা আর জিনা।
লোকটার কাছ থেকে কি ভাবে কথা আদায় করবে ভাবছে সে। আসলে, যত যা-ই বলুন, আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ব্যাপারটা আধিভৌতিক কিছু। বরং…
মানুষের শয়তানি বলতে চাইছ? মুচকি হাসল বব। প্রথম প্রথম এলে আর এ রকম কিছু ঘটলে সবাই তাই ভাবে। পরে ঠিক হয়ে যায়। বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। বেশ, তুমি আমাকে বলো, বাতিটা আপনাআপনি নিভল কি করে?
টাইমার লাগানো থাকতে পারে, জবাব দিল কিশোর।
আবার হাসল বব। হ্যাঁ, ওভাবে বাতি নিভিয়ে, অন্ধকারে এতগুলো মানুষকে ডিঙিয়ে, কারও গায়ে সামান্যতম ছোঁয়া না লাগিয়ে গিয়ে মৃতিটা ফেলে, আবার সবাইকে ডিঙিয়ে এসে আগের জায়গায় বসে পড়লাম; তারপর জ্বেলে দিলাম মাথার ওপরের বাতিটা! এতই সহজ!
ল্যাম্পের বাল্বটা কেটে গিয়ে থাকতে পারে।
কাটেনি। দেখেছি। সকেট থেকে প্লাগটা খুলে গিয়েছিল।
তাই নাকি? আমি গাধা তাহলে লক্ষ করলাম না কেন কাল? ভাবল কিলোর। পিটারের জন্যে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম আর তার দিকে খেয়াল ছিল বলেই বোধহয় দেখিনি। বলল, তাহলে কেউ টেনে খুলে ফেলেছে।
কেউ নয়, কিছু, শুধরে দিল বব।
ঠোঁট গোল করে নীরবে শিস দেয়ার ভঙ্গি করল কিশোর। তাজ্জব ব্যাপার…
তার কাঁধে হাত রাখল বব। ইয়াং ম্যান, তোমার বন্ধুর জন্যে নিশ্চয় একটা দায়িত্ব আছে তোমার। আমার চেয়ে তোমার কথা বেশি গুরুত্ব দেবে সে, জানি। তাকে বোঝাওগে। ঘড়ি দেখল বব, আর সময় নেই, থিয়েটারে যেতে হবে। তোমাকে আর সময় দিতে পারছি না, সরি।
অনেক দিয়েছেন, ধন্যবাদ। ঘুরে করিডরে বেরিয়ে এল কিশোর। ববের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ভাল কথা, আমার বন্ধু জিনা আপনার কাছে মাপ চেয়ে নিতে বলেছে। এখানে আসার আগে বার্গার খেয়েছিল। হাতে তেল লেগে ছিল। মূর্তিটায় লেগে নোংরা হতে পারে, এ জন্যে চিন্তা হচ্ছে তার। অত উত্তেজনার মধ্যে পরে আর মুছতে মনে ছিল না।
মাথা ঝাঁকাল বব। দেখেছি। কাল ওটা তোলার সময় লেগে গিয়েছিল আরকি। ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে হয়েছে আমাকে। গন্ধটা দারুচিনির মত। লাইটের সুইচেও এই জিনিস লক্ষ করেছি।
অবাক হয়েছে যে, সেটা চেহারায় প্রকাশ পেতে দিল না কিশোর। যাই হোক, জিনা আপনাকে সরি বলতে বলেছে।
হাসল বব। ও কিছু না। ওকে অত চিন্তা করতে মানা কোরো। আমি মুছে ফেলেছি।
থ্যাংকস।
সামনের দরজা দিয়ে বেরোল দু-জনে। তালা লাগাতে লাগাতে বব বলল, আবার একদিন এসে যোগ দিতে পারো। তবে মনে হচ্ছে এবার অনুষ্ঠান করতে দেরি হবে। উইলের শান্ত হতে সময় লাগবে।
উইল?
উইলিয়াম শেকসপীয়ার।
ও। ঠিক আছে, যাই। থিয়েটারে দেখা হবে।
আবার পিকআপ নিয়ে ফ্রিওয়েতে বেরিয়ে এল কিশোর। অল্পক্ষণেই স্পীডোমিটারের কাটা উঠে গেল পঞ্চাশ-পঞ্চান্নতে, আর তার মগজের কাটা কয়েক শো-তে। জিনা আর মুসাকে বাদ দিলে, পিটার ছাড়া একমাত্র রলিই বার্গার খেয়েছিল। তার টেনে প্লাগ খুলে, দৌড়ে ঘর পার হয়ে গিয়ে মূর্তি ফেলে এসে সুইচ টিপে মাথার ওপরের আলো জ্বেলে দেয়া–এতগুলো কাজ কি সে করতে পেরেছে অন্ধকারের মধ্যে?
ভুরু কাছাকাছি হয়ে গেল কিশোরের। বব নিজের ব্যাপারেও এই প্রশ্নই তুলেছিল তখন। তবে ববের চেয়ে রলির বয়েস কম। ক্ষিপ্র হওয়া স্বাভাবিক। কাজটা তার জন্যে কঠিন হলেও হয়তো অসম্ভব নয়।
আর যা-ই হোক, শেকসপীয়ারের ভূত এসে মূর্তি ফেলে দিয়েছে, এ কথা কিছুতেই বিশ্বাস করে না কিশোর।
.
১০.
গারবার থিয়েটারের পার্কিং লটে ঢোকার আগে গাড়ির গতি কমাল কিশোর। অনেক লম্বা লাইন পড়েছে টিকেট কাউন্টারের সামনে। নিশ্চয় গতরাতের নিউজ দেখেছে। কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ বোধহয় একেই বলে–বার বার মরতে বসছে পিটার, ব্যবসা করছে অন্য লোক।
এগিয়ে গেল সে। মারাত্মক কতগুলো চোখা কাটা ডিঙিয়ে। প্রিং লাগানো। গাড়ি ঢোকার সময় মাটিতে দেবে থাকে। বেরোনোর সময় লাফ দিয়ে উঠে আসে। টায়ারে লাগলে চিরে ফালাফালা হয়ে যাবে। বেরোনোর একমাত্র পথ তখন, গেট। সুতরাং পার্কের ভাড়া মেরে দেয়ার আর উপায় থাকে না। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার। পার্কিং লটগুলোতে প্রচুর এই জিনিস দেখেছে কিশোর, তারপরেও দেখলেই কেন যেন মধ্যযুগীয় অত্যাচার-কক্ষের কথা মনে পড়ে যায় তার।
গাড়ি পার্ক করে রেখে থিয়েটার স্টেজের দরজার দিকে দৌড় দিল সে।
করিডরে ঢোকার মুখে টোপাজের সঙ্গে দেখা। বাধা দিল না। মাথা নুইয়ে যাওয়ার ইশারা করল। কর্কবোর্ড পার হয়ে এল সে। স্টেজে ঢোকার দরজার ঠিক ওপাশেই মুসা আর পিটারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পিটারের কপালের দাগটার কোন চিহ্ন নেই এখন।
হেসে বলল কিশোর, বেঁচেই আছ দেখতে পাচ্ছি।
আছি। আর কিছু ঘটেনি।
মুসাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, জিনা আসেনি?
মৃদু আলোকিত একটা কোণ দেখিয়ে মুসা বলল, ওখানে।
নাচছে জিনা।
কি করছে ও? কিশোরের প্রশ্ন।
হাসল মুসা, ভুলে গেছ? করিডরের সাইনটার কথা মনে নেই?
অডিশন নোটিশ? তারমানে সত্যিই সে…
জিনা তো তোমার অচেনা নয়। একবার কিছু করবে বলে গো ধরলে করেই। ছাড়ে।
হু! এইজন্যেই মেয়েদের এড়িয়ে চলতে চাই আমি।
কিন্তু সব সময় সবকিছু চাইলেই কি আর পারা যায়?
লাউডস্পীকারে গমগম করে উঠল পিটারের গলা, শুরু হতে যাচ্ছে কিয়োটো কন মোটো! আজ রাতের সবচেয়ে বড় ড্যান্স নাম্বার।
ঘোষণা শুনে দৌড়ে এল জিনা। মুসা আর কিশোরের সঙ্গে পাশের একটা দরজা দিয়ে ঢুকল অডিয়েন্সে।
ওরা বসতে না বসতে অন্ধকার হয়ে গেল স্টেজ। গুঞ্জন করে উঠল একটা মোটর, মোলায়েম সুরে বাজতে শুরু করল পিয়ানো। অর্কেস্ট্রা পিটের ভেতর থেকে উঠে আসছে মিউজিক।
অন্য বাদকেরা কোথায়? জানতে চাইল মুসা।
আনলেই পয়সা দিতে হবে, জবাব দিল কিলোর। তাই প্রতিটি রিহার্সালে আনা সম্ভব হয় না।
বেশ কিছু আলো জ্বলে উঠল। স্টেজের পেছনে ফুটে উঠল জাপানের একটা দৃশ্য।
হঠাৎ জোরাল হয়ে গেল মিউজিক। পর্দার আড়াল থেকে নাচতে নাচতে ঢুকল। নাচিয়েরা। আলোটা এমন ভঙ্গিতে ফেলা হয়েছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না ওদের, ছায়াগুলো মনে হচ্ছে একটা আরেকটাকে ভেদ করে যাচ্ছে আড়াআড়ি ভাবে। ওদের শরীরের তীক্ষ্ণ মোচডগুলোতে মার্শাল আর্টের প্রকাশ প্রবল।
মুগ্ধ হয়ে দেখছে কিশোর। হালকা, সরু সরু আলোকরশ্মি যেন বাতাস চিরে ছুটে চলেছে এদিক ওদিক।
আচমকা যেন জমে গেল নর্তকেরা। একেবারে স্থির। একটা পর্দার আড়াল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এল আরেকজন নর্তক। মনে হলো যেন উড়ে এল বাতাসে ভর করে। আস্তে করে এসে মঞ্চে নামল তার ছায়া। একাই নাচতে শুরু করল।
ওহ, পিটার! বিস্ময় চাপতে পারল না জিনা।
সচল ছায়াটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। পিটার যে ভাল নাচতে পারে জানা ছিল তার, কিন্তু এতটা ভাল কল্পনা করেনি। মুহূর্তে যেন দখল করে নিয়েছে পুরো মঞ্চটা।
মনে হচ্ছে মার্শাল আর্টের ওস্তাদ! প্রশংসা করল মুসা।
নাচতে নাচতে শরীর বাকিয়ে, মুচড়ে, নানা রকম কায়দা-কসরৎ দেখাচ্ছে পিটার।
নাচ চলেছে, এই সময় একটা ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল কিশোরের, টার্নটেবল ঘুরছে!
পর্দা কাঁপতে শুরু করল। মেঝেতে পড়ে গেল নাচিয়েরা। বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল কেউ কেউ।
লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে পড়েছিল পিটার।পড়ল হাঁটু ভাজ করা অবস্থায়। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেতে।
একলাফে সীট থেকে উঠে মঞ্চের দিকে দৌড় দিল কিশোর, মুসা আর জিনা। বাজনা থেমে গেছে। আলো জ্বলে উঠেছে। উত্তেজিত হয়ে পড়েছে দর্শক।
গোয়েন্দাদের মঞ্চে উঠতে বাধা দিল উল্কি আঁকা একটা হাত, কঠিন গলায় বলল, নামো! এখানে ওঠা বারণ।
নিরু। কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিনজনের দিকে। চোখের আগুনটা বর্ষিত হচ্ছে মূলত কিশোরের ওপর।
আপনি তো আমাদের চেনেন! কিশোর বলল।
কি হবে চিনলে? থিয়েটারের লোক ছাড়া আর কাউকে উঠতে দেয়ার নিয়ম নেই। এখন তো আরও দেয়া যাবে না। কোন কিছু ঘটে গেলে দায়ী হবে কে?
অসহায় দৃষ্টিতে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। নিরু অন্যায় কিছু বলেনি।
তবু মুসা বলল, আমরা কোন সাহায্য করতে পারি নাকি দেখতাম।
কি ব্যাপার? সেট খসে পড়েছে নাকি?
পরিচিত কণ্ঠ শুনে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল কিশোর। মুসা আর জিনাও ঘুরল।
তিনজনেই অবাক। পিটার দাঁড়িয়ে আছে। বলল, এমন করে তাকাচ্ছ যেন আমাকে চিনতে পারছ না! হয়েছেটা কি?
আ-আ-আপনি নন! তোতলাতে শুরু করল জিনা।
মঞ্চ থেকে একজন লোককে ধরাধরি করে তুললেন ভিনসি জাপা এবং আরেকজন শ্রমিক। যাকে তোলা হলো সে পিটারের সমান লম্বা, সোনালি চুল।
ছায়া দেখে কিন্তু অবিকল একই রকম লাগছিল! নিজেকে যেন বোঝাল কিশোর।
আমরা ভেবেছিলাম…আমরা..মানে… কথা সাজাতে পারছে না মুসা।
বিস্ময়টা দূর হয়ে গেল পিটারের চেহারা থেকে। এইবার বুঝেছি! টেরি হান্না। অক্সিডেন্ট করেছে। তোমরা মনে করেছ আমি।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল জিনা।
অনেকটা আমার মতই দেখতে। লম্বা, চওড়া…ভাড়া করে আনা হয়েছে আমার জায়গায় চালানোর জন্যে। নাচটাচ তো জানি না ওরকম
চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ, ট্রট, টার্নটেবলটার কি হয়েছিল?
টার্নটেবলের উচ্চারণটা শোনাল টয়টেবল। ভিনসি জাপার নিউ ইয়র্ক টান।
স্টেজ থেকে জবাব এল, আপনি কিউ দিয়েছেন সেভেনটি সেভেন। ওটা টার্নটেবলের কিউ।
কী! ঝট করে কম্পিউটারের দিকে ফিরে তাকালেন ম্যানেজার। কিন্তু একটা লোককে তুলে ধরে রাখায় দৌড়ে যেতে পারলেন না।
কম্পিউটারে কোন গোলমাল হয়নি তো? টার্নটেবল অপারেটর জিজ্ঞেস করল।
হতে পারে! বিড়বিড় করলেন ম্যানেজার, কিন্তু কথাটা কিশোরের কান এড়াল না। টেরি হান্নাকে স্টেজের ধারে একটা কটে নামিয়ে রেখে ফোনের দিকে দৌড় দিলেন।
টেরির কাছে গিয়ে জানতে চাইল পিটার, কি অবস্থা তোমার?
ব্যথায় ককাতে ককাতে জবাব দিল টেরি, মনে হয় গোড়ালিটা গেছে।
কিশোর আর জিনার দিকে ফিরল মুসা, গোড়ালি ভেঙে থাকলে কয়েক মাসের জন্যে বাতিল। নাচানাচি বাদ।
ব্যাপারটা পিটারের বেলায়ও ঘটতে পারত, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। কিন্তু তদন্ত করারও কোন উপায় দেখছি না। আমাদের উঠতে দেবে না। জোর করে কিছু করতে গেলে পুলিশের কাছে দিয়ে দেবে।
তাহলে কি করব? আমরা শ্রমিক নই, অভিনেতা নই, থিয়েটারের কেউ নই। এখানকার লোকেরাও পিটারের বন্ধু হিসেবে আমাদের চিনে ফেলেছে। ফাঁকি দিতে পারব না। তাহলে? নিরাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়ল মুসা।
একটা উপায় অবশ্য আছে… চোখ চকচক করছে জিনার।
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আউটার করিডরের দিকে তাকাল মুসা ও কিশোর।
আধখোলা দরজা দিয়ে অডিশন নোটিশটা চোখে পড়ছে। বাইরে থেকে আ বাতাস লাগলেই নড়ে উঠছে কাগজটা।
ওখানে ঢোকার কথা বলছ নাকি? মুসার প্রশ্ন।
মাথা নাড়ল জিনা।
কিশোর আগেই বুঝেছে। মুসার কথার জবাব দিল, না। তবে নোটিশটা বলেছে একজন পুরুষ আর একজন মহিলা প্রয়োজন।
তাকে শুধরে দিল জিনা, এখন একজন পুরুষে আর হবে না, দু-জন লাগবে টেরির সমান লম্বা, মার্শাল আর্ট জানা…
এতক্ষণে বুঝেছে মুসা, আমি আমার কথা বলছ! কিন্তু নাচের ন-ও তে জানি না আমি। জীবনে কখনও স্টেজে উঠিনি…
তাতে কি? কিশোর বলল, মার্শাল আর্ট তো জানো। ঠিকমত অঙ্গভা করতে পারলে, জড়তা এড়াতে পারলে ওটাই নাচ হয়ে যাবে। তা ছাড়া আমি তে থাকবই আশেপাশে। ভয় কি?
কিন্তু আমাদের নেবে কেন?
এখন ওদের লোক প্রয়োজন। আমাকে নেবেই ওরা, কারণ অভিনেতা হিসে ছোটবেলায়ই সুনাম করে ফেলেছি। জিনাকে নেবে পিটারের সুপারিশে। আ আমাদের তিনজনের সুপারিশ তোমাকে নেয়ার জন্যে যথেষ্ট।
.
১১.
দরদর করে ঘামছে মুসা। কিশোরের কথাই ঠিক হয়েছে। ঢুকতে কোন অসুবি হয়নি ওদের। নিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নাচ শিখতে শিখতে এখন প্রাণ বেরোনো জোগাড় মুসার। বাস্কেটবল প্র্যাকটিসের চেয়ে অনেক কঠিন লাগছে তার কাছে।
কিশোরকেও নাচতে হচ্ছে। মুসার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। কারণ অ ফিট নয় তার শরীরটা।
পরদিন সকালে বিছানা থেকে নামার সময় মুসার মনে হলো একটা ট্রাক যে চলে গিয়েছিল তার শরীরের ওপর দিয়ে। পেশীতে ব্যথা। এই শরীর নিয়েই আবা যেতে হবে প্র্যাকটিস করতে।
কিশোরের অবস্থা আরও খারাপ। তার সঙ্গে দেখা হতেই মুসা বলল, এ নাচিয়েগুলো মানুষ না, কিশোর! আন্না ওদের শরীরে কি দিয়েছে আল্লাই জানেন?
হেসে বলল কিশোর, ওদেরকে বাস্কেটবল খেলতে দিলে বলবে, বাস্কেটব খেলোয়াড়েরা মানুষ নয়:…সব কাজেই প্র্যাকটিস দরকার। একেক কাজে একে রকম প্র্যাকটিস। একজনের কাজ আরেকজনকে করতে দিলে এবং সেটা তা জানা না থাকলে সাংঘাতিক কঠিন মনে হবে।
কিন্তু কিশোর, স্টেজে গিয়ে দর্শকদের সামনে যদি না পারি? পচা ডিম মেরে শেষ করে দেবে। কয়েক মন সাবান দিয়ে ধুয়েও গন্ধ দূর করতে পারব না!
আরে অত ঘাবড়িও না, পারবে ঠিকই। আমরা তো আর হিরো হতে যাচ্ছি, কোনমতে কাজ চালিয়ে দিতে পারলেই হলো। আমাদের আসল কাজ হলো গোয়েন্দাগিরি করা, পিটারকে বাঁচানো।
কিন্তু মঞ্চে উঠলেই তো আমার হাত-পা সিঁটিয়ে যাবে। অভিনয়ের আমি কি বুঝি? আমি পারব না, কিশোর, ভাই, আমাকে মাপ করো…
আরে দূর, অত ঘাবড়াও কেন? পারবে, খুব পারবে। না পারলে আমি শিখিয়ে দেব। আসল কাজটা হলো চেষ্টা করা। চেষ্টায় সব হয়।
নাচ শেখান যে ভদ্রলোক, তার নাম হেফটি ভাগনার। মুসার ভয় দেখে হাসলেন। সান্ত্বনা দিলেন, তোমার চেয়ে অনেক আনাড়িকে নাচের ওস্তাদ বানিয়ে দিয়েছি আমি। তোমার তো রীতিমত ট্যালেন্ট আছে। ভাল লাফ দিতে পারো…বাস্কেটবল এই একটা সুবিধা করে দিয়েছে তোমার। ভয় নেই, কোন ভয় নেই, দর্শকরা তোমার প্রশংসাই করবে, আমি হেফটি ভাগনার বলছি।
ওস্তাদের কথায় ভয় অনেক কাটল মুসার, আত্মবিশ্বাস বাড়ল।
.
অবশেষে মুসাকে ছাড়পত্র দিয়ে দিলেন ভাগনার। কোন পার্ট করতে হবে তা-ও বুঝিয়ে দিলেন, পিটার আর তার হিরোইন নেলি গুহার ভেতর থেকে পালানোর চেষ্টা করবে। সৈকতে বেরিয়ে গিয়ে পড়বে জাপানীদের খপ্পরে। ওই দৃশ্যটাতে ওদের সঙ্গে থাকবে তুমি।
আমি এটা ভাল পারতাম।
তুমি সবই ভাল পারবে, জাত অভিনেতা, বুঝে গেছি আমি। তোমাকে আরও কঠিন একটা পার্ট দেয়া হবে। ঘোরের মধ্যে স্বপ্ন দেখবে পিটার-ক্যালিফোর্নিয়ায় বাড়ি পৌঁছে গেছে, সৈকতে বেড়াতে বেরিয়েছে। গান গাইবে ওখানে, নাচবে, নানা রকম খেলা খেলবে, সেখানে তুমিও থাকবে তার সঙ্গে…
হু, মন্দ না। তারপর?
বীচবল খেলতে হবে তার সঙ্গে তোমাকে…
বীচবল!
মুচকি হাসল জিনা। কিশোরের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম সমবেদনায় জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল।
আঁতকে উঠলে যে? পারবে না নাকি? জিজ্ঞেস করলেন ভাগনার।
পারব না, কারণ যে কোন আউটডোর গেম আমার অপছন্দ-বললে কাজ হারানোর ভয় আছে, চুপ করে রইল কিশোর।
হেসে বলল মুসা। আরে দূর, অত ঘাবড়াও কেন? পারবে, খুব পারবে। না পারলে আমি শিখিয়ে দেব। আসল কাজটা হলো চেষ্টা করা। চেষ্টায় সব হয়। কিশোরের দিকে চেয়ে ভাগনারের অলক্ষে চোখ টিপল। বোঝাতে চাইল–কেমন মজা! আমার সময় তো খুব বলেছিলে, চেষ্টায় সব হয়। অন্যকে পরামর্শ দেয়া খুব সহজ!
তাহলে আর কি? ভাগনার বললেন, ঠিক আছে, যাও এখন। তিনটায় আবার দেখা কোরো।
.
পিটারের ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল কিলোর, পিটার, ভাল খবর আছে। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মুসা আর জিনা।
হাসিমুখে ওদের স্বাগত জানাল পিটার আর ভিনসি জাপা।
পিটার বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও, বোলো না! দেখি আন্দাজ করতে পারি কিনা? চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রাখল সে। শেকসপীয়ারের ভূতকে তাড়া করে ধরে ফেলে এখন শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছ। চোখ মেলে হাসল। এমনি, দুষ্টুমি করছিলাম। খবরটা আমি জানি। আরও জানি, ভালই করবে তোমরা।
থিয়েটারে স্বাগতম, মুসা আর কিশোরের সঙ্গে হাত মেলালেন জাপা। এখানে ঢুকতে আর কোন বাধা থাকল না এখন তোমাদের। সেই সুবাদে খানিকটা পপকর্ন হয়ে যাক? মাঝারি আকারের একটা কাগজের ঠোঙা বের করে আনলেন যে চেয়ারে বসেছেন সেটার পেছন থেকে। একেবারে তাজা দিয়েছে।
ডায়েট কন্ট্রোল করার ফলে পেট প্রায় খালিই থাকে কিশোরের। জিভে জল এসে গেল তার। কিন্তু সে কথা বলার আগেই জিনা বলে উঠল, বাহ, পোশাকটা তো সুন্দর! নতুন?।
পিটারের কস্টিউম র্যাকের দিকে এগিয়ে গেল সে। সিল্কের একটা আলখেল্লার মত ঢোলা পোশাক, তাতে নানা রঙের ফিতার বন্ধনী লাগানো। ধরার জন্যে হাত বাড়াল।
ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙল। চিৎকার করে উঠল পিটার, আহহা, গেল তো পড়ে!
ফিরে তাকাল জিনা।
ভাঙা কাঁচ কুড়ানোর জন্যে নিচু হলো মুসা, ভাঙা আয়না মানে ব্যাড লাক!
তুমিও দেখি ববের মত কথা বলো, পিটার বলল।
কাঁচ কুঁড়াতে মুসাকে সাহায্য করল কিশোর আর জিনা।
দরজার দিকে এগোতে এগোতে জাপা বললেন, কম্পিউটারে নাম্বার সাজাতে বলিগে। কান খাড়া রাখবে কিন্তু। কিউ ভুল কোরো না। রিহার্সালের সময় যা বলেছি, অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখবে। শেষ কথাগুলো নতুন অভিনেতাদের উদ্দেশে বললেন তিনি।
আসছি, পিটার বলল। কাঁচগুলো তুলেই চলে আসব।
ড্রেসিং রুম থেকে বেরোনোর আগে পপকর্নের ঠোঙাটার দিকে লোভীর মত তাকাল কিশোর। স্টেজের ডানে চলে গেল পিটার, ওদিক দিয়েই তার ঢোকার কথা। জিনা বসল দর্শকদের মাঝে। কিশোর আর মুসা স্টেজে রয়ে গেল ঢোকার অপেক্ষায়।
কিশোর দেখল, সুতো আর কঁচি হাতে পিটারের ড্রেসিং রুমের দিকে যাচ্ছে। একজন লোক। গলায় ঝোলানো দর্জির ফিতে।
পিটারের দর্জি, মুসাকে বলল কিশোর।
দর্জি?
থিয়েটারে নানা রকম পোশাক লাগে, কস্টিউম। সব সময় রেডি রাখতে হয়। কোথাও ছিঁড়ল-ফাটল কিনা দেখে রাখে দর্জি। মেরামত দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা সেরে রাখে।
বাপরে, থিয়েটারে অনেক ঝামেলা!
কাছে একটা টুলে পড়ে থাকা খবরের কাগজের হেডিঙে চোখ পড়ল কিশোরের:
দুর্ভাগ্যের শিকার তরুণ অভিনেতা
শেকসপীয়ারের প্রতিশোধ!
কাগজটা হাতে নিল সে। হেডলাইনের নিচে পিটারের একটা ছবি। কপালের ফোলাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার নিচে ক্যাপশন:
ওয়াইন্ড! ওয়াইল্ড! ওয়াইল্ড-এর স্টার পিটার হাইয়েম
এই হপ্তায় অনেকগুলো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
ছবিটা দেখতে দেখতে মুসা বলল, আসলে যতটা ফুলেছিল তার চেয়ে বেশি ফোলা লাগছে ছবিতে।
হ্যাঁ, চোখের পাতা সরু হয়ে এল কিশোরের। ইচ্ছে করেই হয়তো ছবিটায় এ রকম করেছে। দ্রুত পাতা উল্টে শো-বিজের গসিপ পাতায় চলে এল সে।
এটা দেখো, কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে দেখতে দেখতে বলল মুসা, আর্ট টিলারি একটা বিদেশী ফিল্মে কাজ করার কন্ট্রাক্ট সই করেছে। পিটারকে ছাড়া কলিনের আর কোন পথ নেই, তাকে পছন্দ করুন আর না-ই করুন।
তীক্ষ একটা চিৎকার ভেসে এল পিটারের ড্রেসিং রুম থেকে।
চোখের পলকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সেদিকে দৌড় দিল মুসা। কাগজটা হাত থেকে ফেলে তার পেছনে ছুটল কিশোর। ওদের পেছনে আরও কয়েকজন।
ঘরে ঢুকে দেখা গেল পাগলের মত ডান হাত চুলকাচ্ছে পিটারের দর্জি। চামড়া লাল হয়ে উঠেছে।
কি হয়েছে? জানতে চাইল কিশোর।
কোণের সিঙ্কের কাছে দৌড়ে গেল দর্জি। কল ছেড়ে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে হাত ভেজাতে ভেজাতে বলল, উফ, জ্বলে গেল! পুড়ে যাচ্ছে যেন!
এই, ডাক্তার ডাকুন! দরজার কাছে উঁকি মারছে অনেক লোক, তাদের উদ্দেশে বলল কিশোর। দর্জির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, হয়েছে কি?
আঙুলের কাছ থেকে বাহুর মাঝামাঝি পর্যন্ত এখন লাল অনেকগুলো দাগ দেখা যাচ্ছে দর্জির। কি জানি, বলতে পারব না! ওটা কেবল ছুঁয়েছি, অমনি এই অবস্থা!
কাঁপা হাতে পিটারের নতুন পোশাকটা দেখাল সে।
.
১২.
আর আধ ঘন্টা বাকি। প্লীজ, যার যার জায়গায় যান, স্টেজের স্পীকারে বেজে উঠল জাপার কণ্ঠ।
আমি যাই, মুসা আর কিশোরকে বলল পিটার। রেডি হতে হবে।…ও, ডাক্তার বুঝেছেন কি জিনিস লাগানো ছিল পোশাকে। অ্যানটিভোট দিয়ে দিয়েছেন ফক্সিকে, ঠিক হয়ে যাবে।
গুড, কিশোর বলল। দর্জির জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে ছিল সে। তোমার পোশাকের কি হবে? ওটা তো আর পরতে পারবে না।
মুখে ছায়া নামল পিটারের। বলতে কষ্টই হলো যেন, আজ রাতের জন্যে অন্য আরেকটা দেয়া হবে আমাকে। দেখেটেখে দেবে, যাতে ক্ষতিকর কিছু লাগানো না থাকে।
আজ রাতে পারবেন কাজ করতে? মুসার প্রশ্ন।
পারব। তবে মনের জোর আর রাখতে পারছি না। ভয়ই লাগছে। ভাগ্যিস পরিনি পোশাকটা! ফক্সি বেচারার জন্যেই বেঁচে গেলাম। আমার যন্ত্রণাটা গেল তার ওপর দিয়ে।
বাঁচলে তো বটেই, কিশোর বলল। স্টেজে যাওয়ার আগে গায়ে দিলে আর অভিনয় করতে হতো না। যে লাগিয়েছে সে এটাই চাইছিল, যাতে মঞ্চে যেতে না পারো। এখন মনে করার চেষ্টা করো তো পোশাকটা কে কে ধরেছিল আজকে?
মাথা হেলিয়ে ভাবল পিটার। ফক্সি ধরেনি এটা ঠিক…
সে তো জানা কথাই, মুসা বলল। নিজে আজেবাজে জিনিস লাগিয়ে আবার নিজেই ধরতে যেত নাকি?
কে লাগিয়েছে কার কথা বলি? নিজের থুতনিতে টোকা দিল পিটার। নিচের ওয়ারড়ো ডিপার্টমেন্টের কেউ হতে পারে, ডিজাইনারদের কেউ হতে পারে। কজনকে সন্দেহ করব?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমার ধারণা, তোমার ঘরে এসে ঝোলানোর পর পোশাকটাতে ওই জিনিস লাগানো হয়েছে। নইলে যে নিয়ে আসত তারও হাতে লাগত; চুলকাত। পুরো কাপড়ে না লাগিয়ে সামান্য একটু জায়গায় লাগালৈ অবশ্য আলাদা কথা।
ওটা আনার পর ড্রেসিং রূমে অনেক লোক ঢুকেছে। ভিনসি জাপা, হেফটি ভাগনার, রলি ওয়ারনার, কয়েকজন অভিনেতা। ওদের যে কেউ লাগিয়ে থাকতে পারে।
রলি ওয়ারনারের নামটা লাফ দিয়ে উঠে এল কিশোরের মনে। রলি-পিটারের সহকারী। বব রডম্যানের বাড়িতে দুর্ঘটনার সবচেয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তি। পিটারকে বসিয়ে দিয়ে নিজেকে তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে করছে এ সব?
দরজায় উঁকি দিলেন জাপা। কিশোর আর মুসাকে বললেন, দেরি করছ কেন তোমরা? টিকিট বিক্রি শেষ। একটা সীটও পড়ে নেই। তোমাদেরকে বসার জায়গা দেখিয়ে দেব, এসো।
ড্রেসিং রুম থেকে প্রায় ছুটে বেরোল দুই গোয়েন্দা। দরজা দিয়ে দর্শকরা ঢুকলে সীট নম্বর দেখে তাদের বসানোর ব্যবস্থা করছে একজন লোক। সেই লোকই কিশোর আর মুসাকে বারের কাছাকাছি একটা জায়গা দেখিয়ে দিল। জিনা দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। হাত নেড়ে ওদের ডাকল। বক্স অফিসের কি অবস্থা দেখার জন্যে উঁকি দিল কিশোর। টিকেট কাউন্টারের সামনে এখনও লম্বা লাইন। আশায় আছে লোকগুলো, যদি কোনমতে একটা টিকিট পেয়ে যায়!
সাংঘাতিক ব্যবসা হবে মনে হচ্ছে, যে লোকটা ওদের সীট দেখিয়ে দিয়েছে। তাকে বলল কিশোর। ঘরভর্তি লোকের সামনে মঞ্চে উঠে অভিনয় করতে কেমন লাগবে, ভাবতেই রোমাঞ্চিত হলো সে।
তিন মাসের জন্যে বুকড হয়ে গেছে শো, জবাব দিল লোকটা। অথচ এখনও প্রিভিউ চলছে, আসল শো শুরুই হয়নি। অর্ডারের পর অর্ডার আসছে। কে ভেবেছিল এই কাণ্ড হবে এ হপ্তায়? আগে তো মরেই ছিল।
চলে গেল লোকটা।
জিনা বলল, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অনেকের কথা শুনছিলাম। পিটারের অ্যাক্সিডেন্টের কথাই বলাবলি করছে সবাই। যেন শো দেখতে নয়, দুর্ঘটনা দেখতে এসেছে। ঘটলে খুশি হবে। কখন ঘটবে তার অপেক্ষা করবে। হায়রে মানুষ।
মুসা বলল, যে কোন ধরনের বিজ্ঞাপন শো-র জন্যে ভাল।
একটা লোকের ওপর বার বার আঘাত আসছে, মরেও যেতে পারে, এটাকে বিজ্ঞাপন বলো! তুমিও তো মনে হচ্ছে মনে মনে চাইছ অ্যাক্সিডেন্ট থোক!
কমতে শুরু করল আলো। চুপ হয়ে গেল দর্শকরা। অর্কেস্ট্রা বাজতে শুরু করল।
অভিনয় দেখতে দেখতে যেন অন্য এক জগতে চলে গেল কিশোর। ভুলে গেল সে গোয়েন্দা, অভিনয় নয়, তদন্ত করতে এসেছে এই থিয়েটারে।
.
মধ্যবিরতির পর স্টেজের পেছনে এসে উঠল সে, জিনা আর মুসা।
পিটারকে দেখে জিনা বলল, আপনি সত্যি ভাল অভিনয় করেন, পিটার।
মুখ তুলে হাসল পিটার, থ্যাংকস। বাধাটা যে পুরোপুরি ভেঙে দিলাম সেটা কেমন লাগল?
বাধা…
মুসা কথাটা শেষ করার আগেই মাথার ওপর কি যেন নড়ে উঠল। ঝট করে মুখ তুলে তাকাল কিশোর। পরক্ষণেই এক হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিল পিটারকে।
ফ্লাই এরিয়া থেকে ভারি একটা কাঠের দরজা খসে পড়ল। আরেকটু হলেই লাগত পিটারের গায়ে। মেঝেতে পড়ার আগেই আটকে গেল, ওপরের অংশটা দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা।
স্টেজে ছুটে এল জাপা। চিৎকার করে ডাকল নিরুকে।
পর্দার আড়াল থেকে মাথা বের করল নিরু।
এটা কি! দরজাটা দেখিয়ে বললেন জাপা।
আমি কি করে বলব?
কি করে বলবে মানে?
কিউটা তো আপনিই দিলেন। আপনার কথামতই কাজ হয়েছে।
ক্ষণিকের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল যেন সবাই। জাপাকে দেখে মনে হচ্ছে ফেটে পড়বেন। এমন ভঙ্গিতে এগোলেন নিরুর দিকে, যেন কথা বললেই মেরে বসবেন। চোখের মাথা খেয়ে বসেছিলে? আমি তো ছিলাম পর্দার আড়ালে, দেখেছি নাকি কি ঘটছে? তুমি তো দেখেছ। আমি বললেই তুমি শুনবে কেন? উফ্, আর কত! বিরক্ত হয়ে গেছি এ সব অ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে!
আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? কিউ দেয়ার মালিক আপনি, আমরা আপনার কথামত কাজ করি। ইচ্ছে করে কি আর ফেলেছি? না পারলে আপনি বরং চলে যান, অন্য কেউ আসুক। অ্যাক্সিডেন্টগুলো আপনার জন্যেই হচ্ছে।
চড় মারার জন্যে হাত তুললেন ম্যানেজার।
তাড়াতাড়ি তাঁকে ধরে ফেলল চারজন শ্রমিক। শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল।
নিরুর দিকে তাকিয়ে ফুঁসতে লাগলেন জাপা, তুমি কি করে চাকরি করো এখানে দেখে নেব! সব শয়তানি তোমার! সমস্ত শয়তানির মূলে তুমি!
যান যান, যা করতে পারেন করুনগে! নিরুও জাপার হুমকির তোয়াক্কা করল না। •
ঠেলতে ঠেলতে স্টেজের দরজা দিয়ে ম্যানেজারকে বের করে নিয়ে গেল লোকেরা।
তার পেছনে চলল কিশোর, মুসা আর জিনা। যে পরিমাণ খেপেছেন জাপা, তাঁকে দিয়ে আপাতত আর কাজ হবে না, বাকি নাটকটা চালানোর দায়িত্ব অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হলো।
কিশোর দেখল, দরজায় লাগানো পেগবার্ড পরীক্ষা করছে টোপাজ। খুব ভাল। অফিসের চাবি ফেরত দিয়ে যেতে ভুলে গেছে ম্যানেজার। বিড়বিড় করল সে।
মুসা আর জিনাকে টেনে সরিয়ে আনল কিশোর। ফিসফিস করে বলল, ভুলে যায়নি।
মানে? দুজনেই হাঁ।
পকেট থেকে খাটো একটা চেনসহ চাবি বের করে দেখাল কিশোর, রেখেছিলেন ঠিকই। গোলমালের সুযোগে আমি সরিয়ে ফেলেছি। জাপার অফিস খুঁজে দেখব। জানার চেষ্টা করব অ্যাক্সিডেন্টগুলোর মূলে তিনিই কিনা।
.
মুসার টর্চের আলো ঘুরে বেড়াতে লাগল অফিসঘরে। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। চুরি করে থিয়েটারে ঢোকার আগে কাউকে চোখে পড়েনি তার।
হঠাৎ বলল ফিসফিস করে, শুনছ?
শুনছি, জবাব দিল কিশোর। তোমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ। দেখি, আলোটা আরেকটু ফেরাও তো এদিকে।
কিশোরের হাতের ফোল্ডারটার ওপর আলো ফেলল মুসা। কভারে লেখা: পারসোনাল।
নিরু ওয়ারনারের ফাইল।
কি লেখা? জানতে চাইল মুসা।
বারের মধ্যে গোলমাল করার অপরাধে একবার অ্যারেস্ট হয়েছিল। আরও খানিকক্ষণ দেখে ফাইলটা বন্ধ করে ফেলল কিলোর। আর কিছু নেই। তিনসি জাপার ফাইলে সন্দেহ করার মত কোন তথ্য নেই। তবে টোপাজের ফাইলে আছে। একটা অপরাধে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। জামিনে মুক্তি দিয়েছে। নিয়মিত হাজিরা দিতে হয় থানায়।
আর কিছু?
নাহ্, মাথা নাড়ল কিশোর। চলো, বেরোই। ফাইলটা ফোল্ডার কেবিনেটে রেখে দিল সে।
বেরোনোর সময় বা হাতে দরজার হাতল ধরে টানল।
গ্রাউন্ড ফ্লোরের নিচের তলায় অর্থাৎ মাটির নিচে রয়েছে ওরা। পা টিপে টিপে এগোচ্ছে। সিঁড়ির রেলিঙ ধরতেই উহ্ করে উঠল। বাঁ হাত চুলকাতে শুরু করল।
কি হলো? জানতে চাইল মুসা।
চুলকানি। দুটো ধাপ উঠল কিশোর। আরও বাড়ল চুলকানি। আরি, বাড়ছেই তো! অসহ্য!
আশ্চর্য! বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। এখানে চুলকানির বিষ এল কোত্থেকে? বিছুটির ব-ও তো নেই কোথাও।
এই জিনিসই যে পিটারের কাপড়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছিল, সন্দেহ রইল না কিশোরের। মনে হচ্ছে জাপার পপকর্নের ঠোঙায়…
…ছিল এই বিষ! বাক্যটা শেষ করল মুসা।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, তোমার চুলকাচ্ছে?
না।
তাহলে দরজার হাতলে লেগে ছিল, রেলিঙে নয়। কোন ভাবে লাগিয়ে ফেলেছেন জাপা…।
ভোঁতা একটা শব্দ হলো।
এটা কিন্তু আমার হার্টের নয়! কান পাতল মুসা।
বাঁ দিক থেকে আসছে। চলো, দেখি?
জাপার কম্পিউটারের দিক থেকে আসছে শব্দটা। দৌড়ে এল দু-জনে। মনিটরের জ্বলন্ত পর্দা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। টর্চ জ্বালল মুসা।
জলদি নেভাও! ধমক এল পেছন থেকে।
ফিরে তাকাল দুই গোয়েন্দা।
মনিটরের পর্দার হালকা আভায় পিস্তলের চকচকে নলটা চিনতে ভুল হলো না ওদের।
.
১৩.
হাত তোলো! সাবধান, কোন চালাকি নয়। আদেশ এল কঠোর কণ্ঠে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এল কিশোর আর মুসা। ওদের সামনে পিটারের ড্রেসিং রূম। সামান্য ফাঁক হয়ে আছে।
ওই দরজা দিয়ে ঢোকো! আবার আদেশ।
পা দিয়ে ঠেলে পাল্লা খুলল কিশোর। নিয়ন আলোয় আলোকিত একটা ছোট ঘড়ি রাখা পিটারের ড্রেসিং টেবিলে, গোলাপী আভা ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে।
সুইচ টেপার শব্দ হলো। উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল।
গলা শুনেই লোকটাকে চিনেছে কিশোর। হাতে ৩৮ ক্যালিবারের রিভলভার। নুরিখ টোপাজ।
হাতের চুলকানি বন্ধ হয়নি কিশোরের।
তাহলে তোমরাই! টোপাজ বলল।
চট করে কিশোরের দিকে তাকিয়ে নিল মুসা। আমরা মানে? বুঝতে পারল না।
রিভলভারে শক্ত হলো টোপাজের আঙুল। বলেছি না আমার সঙ্গে চালাকি। করবে না। কম্পিউটারটাতে তোমরাই গোলমাল করে রেখেছ। হাত দিতে দেখেছি।
আমরা নই!
পুলিশকে বোলো, এ কথা। রিভলভারটা তাক করে ধরে রেখে ফোনের দিকে হাত বাড়াল টোপাজ।
পুলিশকে বোঝানো মোটেও কঠিন হবে না, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। সমস্যা আপনারই বেশি হবে। থানায় যে অফিসারের কাছে হাজিরা দিতে যান, তিনি যদি শোনেন আপনার কাছে একটা বেআইনী অস্ত্র আছে, খুশি হবেন না নিশ্চয়।
অন্ধকারে আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছিল কিশোর, লেগে গেল। চমকে যেতে দেখল টোপাজকে। রিভলভারের ভয় আর করল না, সিংকের কাছে এগিয়ে গিয়ে কলের মুখ ছেড়ে ঠাণ্ডা পানি দিতে লাগল হাতে।
ফোনের ওপর স্থির হয়ে গেছে টোপাজের হাত। তুমি জানলে কি করে?
রিভলভারটার কথা অনুমান করেছি, হাসল কিশোর। তবে অপরাধ যে একটা করেছেন, এটা জানি।
রিভলভার নামাল টোপাজ। যাও, ভাগো! এবারের মত ছেড়ে দিলাম।
কিন্তু আমরা ছাড়লে তো? সুযোগ পেয়ে গেল মুসা। কম্পিউটারের কাছে আপনি কি করছিলেন?
আমি এখানে গার্ডের চাকরি করি। যেখানে খুশি যাওয়ার অধিকার আমার আছে। স্টেজের ডানে চেয়ারে বসে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ জেগে গেলাম। দেখি কম্পিউটারের সামনে একটা ছায়া নড়াচড়া করছে। তোমাদের টর্চের আলো দেখে দিল দৌড়…
কি ধরনের ছায়া? জানতে চাইল কিশোর।
দুজনের দিকে একবার করে তাকিয়ে নিল টোপাজ। খাটো, তোমাদের মত নয়। রোগা, সেটাও তোমাদের মত নয়।
তার মানে আমরা নই, মুসা বলল, বুঝলেনই তো। আর কিছু বলার আছে?
দেখো, আমাকে যা-ই ভাব তোমরা, একটা কথা বিশ্বাস করো, এই থিয়েটারটাকে সত্যি ভালবাসি আমি। এর কোন ক্ষতি চাই না। দয়া করে যদি এখন বলো, এত রাতে এখানে কি করছিলে, খুশি হব। পিটারের বন্ধু সেজে আসলে কি করছ বলো তো?
কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। জবাব দিতে দ্বিধা করছে।
একটা মুহূর্ত ভাবল কিশোর। মাথা ঝাঁকাল। মিস্টার টোপাজ, আপনাকে বলতে রাজি আছি। তবে কথা দিতে হবে গোপন রাখবেন…
চোখ উজ্জ্বল হলো টোপাজের, তারমানে তোমরাই সেই গোয়েন্দা!
অবাক হবার পালা কিশোরের। হাত চুলকানি বন্ধ করল।
মুসা জানতে চাইল, আপনি জানলেন কি করে?
কেউ বলেনি। পত্রিকায় পড়েছি।
অসম্ভব! বলে উঠল কিশোর।
তাহলে নিজের চোখেই দেখো। ভাঁজ করা একটা পত্রিকার পাতা প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে টেনে বের করল টোপাজ। দেখো, লিখেছে; গোপন সূত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে দুজন গোয়েন্দা গোপনে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজছে, তদন্ত চালাচ্ছে থিয়েটারে। মুখ তুলল ডোরম্যান, খবরটা পড়ে অবাক হয়েছি। ভাবছিলাম, কে হতে পারে?
এখন তো জেনে গেলেন। কাউকে বলবেন না আশা করি।
না, বলব না। তোমরা যে তদন্ত করছ, তাতে খুশিই হয়েছি। বললাম না, থিয়েটারটাকে ভালবাসি।
থ্যাংক ইউ। কিছু মনে না করলে একটা সাহায্য করুন আমাদের।
কি সাহায্য?
প্যান্টের পেছনে ডলে ভেজা হাত মুছল কিশোর। আসুন আমার সঙ্গে।
ড্রেসিং রূম থেকে বেরিয়ে কম্পিউটারের দিকে এগোল সে। টোপাজকে বলল, ওটা একবার দেখব।
দেখো।
মুসা এগোল কিশোরের পেছনে। অফিসের দিকে চলে গেল টোপাজ।
কিউর একটা তালিকা দেখা গেল মনিটরের পর্দায়। ওপরে লেখা: এডিট মোর।
এ তো গ্রীক ভাষা মনে হচ্ছে আমার কাছে, মুসা বলল।
কিংবা বলো গ্রীক বিয়োগান্তক নাটক।
নাকি শেকসপীয়ারের ট্র্যাজেডি?
এই কুসংস্কারের আলোচনা বাদ দাও তো, মুসা। বাস্তব কথা বলো। প্রমাণ দরকার এখন আমাদের।
নম্বর আর কোডগুলো তো পাগলের পাগলামি মনে হচ্ছে আমার কাছে। কি করে বুঝবে এ সবের মানে?
বোঝার দরকার নেই এগুলো। আমি দেখতে চাইছি অন্য জিনিস।
কয়েক মিনিট পর উঠে দাঁড়িয়ে কিশোর বলল, গণ্ডগোল করে রাখা হয়েছে এখানে।
টোপাজকে বলে থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এল দুই গোয়েন্দা। গার্ডের সন্দেহ জাগতে পারে এই ভয়ে পার্কিং লট থেকে দুরে রাস্তার ধারে পিকআপ রেখেছে কিশোর। সেদিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ টের পেল, হাতের চুলকানি চলে গেছে। পানিতে সেরেছে বোধহয়।
খবরের কাগজওলারা আমাদের কথা জানল কি করে? প্রশ্ন করল মুসা।
মুখ ফসকে বলে দিয়েছে হয়তো পিটার।
বলেছে যে এ কথা আমাদের জানানো উচিত ছিল।
হয়তো জানাতে চায়নি। এ সবে সে-ও জড়িত থাকতে পারে। দুর্ঘটনায় যদি আহত হয়ে বসেও থাকে, তাহলেও ক্ষতি নেই তার। অভিনয় বন্ধ থাকলেও বেতন দিতে হবে তাকে, সেরকমই চুক্তি হয়েছে।
ভেবে বলল মুসা, কিন্তু বসে থাকার মত লোক মনে হয় না পিটারকে। কাজ করতেই ভালবাসে সে।
আমি ভাবছি কম্পিউটারটাকে স্যাবটাজ করল কে?
ভিনসি জাপা নন তো?
কিন্তু তিনি হলে রাতের বেলা চুরি করে ঢুকে করতে যাওয়ার দরকার কি? দিনের বেলা সবার সামনেই পারেন, কম্পিউটারে তিনি হাত দিলে কেউ সন্দেহ করবে না। তা ছাড়া আমাদের কাছে বলেছেন, প্রোগ্রামিং করতে জানেন না।
আরও একটা ব্যাপার, মোটেও খাটো কিংবা রোগা নন তিনি।
ঠিক, মাথা ঝাঁকাল কিশোর, ও রকম লোক কে আছে থিয়েটারে? কাকে কাকে চিনি আমরা?
এক মুহূর্ত চুপ করে ভাবল মুসা। তারপর বলল, শুধু শরীর স্বাস্থ্যে মিললেই হবে না, তাকে প্রোগ্রামিংও জানতে হবে, তাই না? কোন ধরনের পেশাজীবী কম্পিউটার বেশি ব্যবহার করে? গবেষক, লেখক
ছাত্র, বাদক…
থমকে দাঁড়াল কিশোর, বাদক!
রবিনকে প্রায়ই বলতে শুনি, কম্পিউটারে ড্রাম ট্র্যাকস প্রোগ্রাম করে ড্রামাররা, নানা রকম বাদ্যযন্ত্র…
জানি। থিয়েটারে ও রকম একটা লোককেই চিনি। ফ্ল্যাশ-পটের খুব কাছাকাছি ছিল, অথচ বিস্ফোরণে গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি।
খাইছে! তাই তো! জাহির বিলিয়ার্ড!
তাহলে বুঝলে তো, শেকসপীয়ারের ভূত ঘটাচ্ছে না এ সব অঘটন!
.
১৪.
গারবার থিয়েটারের পার্কিং লটে যখন গাড়ি রাখল কিশোর, সকালের রোদ ঢুকছে তখন জানালা দিয়ে।
আমার মনে হয় না কাজটা করতে পারব, মুসা বলল। যতই প্র্যাকটিস করাক।
পারবে, হাই তুলতে তুলতে বলল কিশোর। অনেক রাতে ঘুমিয়েছে। তারপর তোরে উঠেছে আবার। থিয়েটারে এসেছে প্র্যাকটিস করতে। ওরা নতুন লোক। সেজন্যে বেশি প্র্যাকটিস করতে হচ্ছে। জোর রিহার্সাল চলছে।
গাড়ি থেকে নেমে থিয়েটারের দিকে এগোল দুজনে।
কিন্তু এ ভাবে না ঘুমিয়ে আর কতদিন চালাব? মুসার প্রশ্ন।
কে যায় চালাতে? তুমি কি ভাবছ স্টেজে গিয়ে বীচবল খেলতে ভাল লাগবে আমার? একটুও না। কেসটার একটা কিনারা করতে পারলেই পালাব। তোমার আগে ঘুম থেকে উঠেছি আমি আজ। রবিনকে ফোন করেছি। ওকে টেনে তুলেছি বিছানা থেকে।
গালাগাল করেনি?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। করেছে। গাড়িতে করে রাত তিনটেয় ফিরেছে সান ফ্রানসিসকো থেকে। প্রথমে তো ঘুম জড়ানো স্বরে বকাবকি শুরু করল। কিন্তু জাহিরের কথা যেই বললাম, পুরো সজাগ হয়ে গেল। বলল, আজকে রিহার্সালের পর ওর সঙ্গে লেগে থেকে কিছু বের করার চেষ্টা করবে।
স্টেজ ডোর দিয়ে স্টেজে ঢুকল ওরা। কালো পর্দার আড়ালে জাপার কন্ট্রোল চেম্বারের ভেতর থেকে আসছে কম্পিউটারের কী-র একটানা খটাখট।
মিস্টার জাপা, ডেকে বলল মুসা, আমরা এসে গেছি। তাড়াতাড়িই এলাম, কি বলেন?
খটাখট বন্ধ হয়ে গেল। জবাব নেই।
মিস্টার জাপা? পর্দা সরাল কিশোর।
মনিটরের সামনে বসা পিটার ঘুরে তাকাল। ঠোঁটে আঙুল রেখে কথা বলতে নিষেধ করল ওদের। ফিসফিস করে বলল, চুরি করে এখানে বসেছি, দেখলে আমাকে মেরে ফেলবে!
কণ্ঠস্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কি করছ?
কম্পিউটার স্ট্যান্ডে রাখা একটা মোটা ফাইল দেখিয়ে বলল পিটার, কিউর হার্ড কপি এটা। কম্পিউটারের নিচের তাকে রেখে দেয় জাপা। কয়েক হপ্তা আগে বানিয়েছে। কোন পরিবর্তন করতে হলে নিজের হাতে করে। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখে নিল সে, অন্য কেউ শুনছে কিনা। তারপর স্বর আরও নামিয়ে বলল, কম্পিউটারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছি, কোন গোলমাল করা হয়েছে নাকি। সত্যি বলতে কি, জাপাকে এখন সন্দেহ হচ্ছে আমার।
রাগ ফুটল মুসার কণ্ঠে, নিজেই যদি করবেন, তাহলে আমাদের ডেকে আনলেন কেন…
ঠিক আছে, ঠিক আছে, হাত তুলল কিশোর, সন্দেহ যখন হয়েছে, দেখুক। আমাদের না জানলেই কি? পিটার, তুমি কিন্তু ভুল করেছ। আমাদের ওপর যখন তদন্তের দায়িত্বই দিলে, কথা গোপন করা ঠিক হয়নি তোমার। এই বইটার কথা বলা উচিত ছিল।
মাথা কাত করে পিটার বলল, বলেছি তো। কাল রাতে মাথায় এল কথাটা। তোমাদের অ্যানসারিং মেশিনকে মেসেজ দিয়ে রেখেছি। পাওনি?
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর, না। ভাবল, মেশিনটা কি খারাপ হয়ে গেল?
যাই হোক, কথাটা মনের মধ্যে খোঁচাতে থাকল, পিটার বলল। সকালে উঠেই চলে এলাম দেখার জন্যে। হাসল সে। কিছু মনে কোরো না, তোমাদের সাহায্যই করতে চেয়েছি।
কিছু পেলে?
দ্বিধা করল পিটার, না…এখনও পাইনি। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
বিশ্বাস করতে পারল না কিশোর। পিটারের আচরণ সন্দেহজনক মনে হলো ওর। নার্ভাস হয়ে আছে। কিছু যেন লুকানোর চেষ্টা করছে। কেন? অসুবিধেটা কি?
করিডরে গলার স্বর শুনে তাড়াতাড়ি কম্পিউটার বন্ধ করে দিল পিটার। বইটা রেখে দিল নিচের তাকে।
জাপা ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এই, তোমরা এসেছে নাকি?
ভেতরে ঢুকলেন তিনি। সঙ্গে এসেছেন হেফটি ভাগনার, আর চারজন অভিনেতা।
এসেছি, হেসে জবাব দিল কিশোর। জিনা একটু পরে আসবে।
আচ্ছা। আসুক। আজ সারাদিন রিহার্সাল চলবে তোমাদের। রাতে স্টেজে উঠতে হবে।
নার্ভাস ভঙ্গিতে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা।
মাথা ঝাঁকিয়ে, হেসে অভয় দিল তাকে কিশোর।
.
তবে যত ভয়ই পাক, স্টেজে উঠে অন্য মানুষ হয়ে গেল মুসা। তার মধ্যে যে এতটা ট্যালেন্ট আছে, জানত না। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল দর্শকরা।
পিঠ চাপড়ে দিয়ে জাপা বললেন, চমৎকার। চেষ্টা করলে ভাল অভিনেতা হতে পারবে তুমি।
রাতে বাড়ি ফেরার পথে হেসে বলল জিনা, স্টার তাহলে বনেই গেলে?
কে যায় স্টার বনতে! আমি খেলোয়াড় হতে চাই। স্টেজে নাচানাচি করতে ভাল লাগে না।
চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে কিশোর।
রেডিওটা নাড়াচাড়া শুরু করল জিনা। নব ঘুরিয়ে স্টেশন টিউন করতে লাগল। একটা স্টেশনে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক হচ্ছে…আরেকটাতে বেসবল খেলা…তারপরেরটাতে খবর।
দূর, কোনটাই ভাল না, বিরক্ত হয়ে বলল জিনা। রবিনের কাছ থেকে ভাল কয়েকটা টেপ চেয়ে নিয়ে রেখে দেয়া উচিত গাড়িতে।
রেখে লাভ নেই। মনে করিয়ে দিল কিশোর, গাড়িটা আমার নয়, চাচার। খবরটা দাও তো। গলাটা চেনা মনে হলো!
ঠিকই বলেছে কিশোর। এ তো পিটারের গলা! টেপ করা ইন্টারভিউ হচ্ছে।
গারবার থিয়েটারে বার বার তার ওপর আঘাত আসার কথাই বলছে পিটার ফুলিয়ে-ফাপিয়ে।
সাক্ষাৎকার যে নিচ্ছে সে-ও কম যায় না। বলল, কয়েক দিনেই আপনার যা জনপ্রিয়তা লক্ষ করছি, আর্ট টিলারিকেও তো ছাড়িয়ে যাবেন আপনি। ব্রডওয়েতে তো যাবেনই, সেটা ছাড়িয়েও আরও বহুদূর।
বুঝতে পারছি না কি হবে! দীর্ঘশ্বাস ফেলল পিটার। উইলিয়াম শেকসপীয়ারের ভূত এখন আমার পিছু ছাড়লেই হয়!
হঠাৎ ব্রেক কষল কিশোর।
গতি কমে যাওয়ায় ঝটকা দিয়ে সামনে ঝুঁকে গেল জিনা আর মুসা।
কি হলো? চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
বুঝে গেছি। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল কিশোর।
কি বুঝেছ?
জবাব দেয়ার আগেই পেছনে টায়ারের শব্দ হলো। আরেকটা গাড়ি ব্রেক করেছে।
ফিরে তাকাল ওরা। একটা স্পোর্টস কার।
মুসা বলল, কিছুক্ষণ থেকেই আয়নায় দেখছি গাড়িটাকে! শিওর আমাদের পিছু নিয়েছে!
.
১৫.
অ্যাক্সিলারেটর চেপে ধরল আবার কিশোর। পরের মোড়টায় যেন উড়ে চলে এল পিকআপ।
পেছন পেছন ঠিকই আসতে লাগল গাড়িটা।
স্টিয়ারিং বাঁয়ে কাটল কিশোর। মাটি থেকে লাফ দিয়ে উঠে গেল পিকাপের ডান পাশটা। চিৎকার করে উঠল জিনা।
কোথায় যাচ্ছ? চেঁচিয়ে জানতে চাইল মুসা।
জানি না।
একটা ছোট গর্তে পড়ল চাকা। ঝট করে মাথার ওপরে হাত তুলল মুসা, দেরি করে ফেলেছে। ছাতে ঠোকর খেল চাদি। উফ করে উঠল ব্যথায়। বলল, ভাঙা গাড়িতে চড়ার এই হলো শাস্তি।
গুলির শব্দ হলো পেছনে।
মাথা নামাও! বলে জিনার মাথাটা ড্যাশবোর্ডের নিচে চেপে দিয়ে নিজেও মাথা নুইয়ে ফেলল মুসা।
কিশোরের সে-সুযোগ নেই। কারণ গাড়ি চালাতে হচ্ছে ওকে।
আবার পাশে কাটল সে। নাহ, আর পারবে বলে মনে হয় না। কারণ ও চালাচ্ছে ঝরঝরে পিকআপ, পেছনের গাড়িটা স্পোর্টস কার। গতি বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে ক্ৰমে। বাঁয়ের রকটা মনে হচ্ছে মাইলের পর মাইল লম্বা। পথের পাশে গাছের সারি। ডানেও একই অবস্থা, কেবল মাঝে মাঝে বিশাল বিল্ডিঙগুলোতে ঢোকার জন্যে যেটুকু খোলা। একটা বাড়িকে শপিং মল করা হয়েছে। গেটের কাছে নিওন আলোয় লেখা PARK শব্দটার আলো নেভানো।
পালানোর আর কোন পথ না দেখে তীক্ষ্ণ মোড় নিয়ে সেই গেটের দিকে এগোল কিশোর। হলুদ রঙের একটা CLOSED সাইন, যেন ছুটে আসতে লাগল ওদের দিকে।
কিশোর, কি করছ? চিৎকার করে উঠল জিনা। বলেই দু-হাতে মুখ ঢাকল।
তীব্র ঝাঁকুনি, গেটের কাঠ ভাঙার মড়মড় শব্দ। পার্কিং গ্যারেজে ঢুকে পড়ল কিশোর। র্যাম্পে উঠতে শুরু করেছে পিকআপ। মাথাটাকে সীটের পেছনে চেপে ধরেছে সে।
চারতলায় একটা বইয়ের দোকান আছে, এরই মধ্যে কোনমতে বলল কিশোর।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! মুসা বলল।
ড্যাশবোর্ড আঁকড়ে ধরে আস্তে মাথা উঁচু করে জানালা দিয়ে তাকাল জিনা। ওপরে উঠতে চাও তো? ফাঁদে পড়ব।
দেখা যাক, কিশোর বলল। ঘুরে ঘুরে উঠতে শুরু করল পিকআপ।
বাড়িটা ছয়তলা। ছয়টা তলাই পার হয়ে র্যাম্প থেকে প্রায় লাফ দিয়ে অ্যাসফল্টের ছাদে বেরিয়ে এল গাড়ি। সাদা দাগ দিয়ে ঘর একে চিহ্ন দেয়া রয়েছে। একেকটা ঘরে একটা করে গাড়ি থাকবে। কিন্তু এখন কোন গাড়ি নেই। ওদের বয়ে দেয়াল, তাতে এলিভেটর, কাঁচের ছোট দরজা। ওটার পাশে সিঁড়ি।
পিকআপের ইঞ্জিনের গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ কানে আসছে না কিশোরের। ওরা কি একা? রিয়ারভিউ মিররে তাকাল। র্যাম্পের মুখ, যেখান দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা, সেটাকে লাগছে কালো একটা গর্তের মত। পঞ্চাশ ফুট পেছনে।
মনে হয় হারিয়ে দিয়েছি, বলল সে।
তাহলে আর কি? ঝাঁপ দাও ওপর থেকে। রাস্তায় নেমে পড়ি, তিক্ত কতে বলল মুসা। যাওয়ার আর তো কোন উপায় দেখছি না।
ছাদের চারটে কোণের দিকে তাকাল কিশোর।
স্পোর্টস কারটার কোন সাড়া না পেয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার নামার জন্যে র্যাম্পের দিকে রওনা দিল।
এই সময় নিচ থেকে আলোকিত হতে শুরু করল কালো গর্তটা।
ওরাই আসছে! জিনা বলল।
ব্রেক কষল কিশোর। অ্যাসফল্টের গায়ে ঘষা খেয়ে আর্তনাদ করে উঠল রবারের চাকা।
থামলে কেন? চেঁচিয়ে উঠল মুসা, জোরে চালাও না! সরিয়ে দিতে পারবে ধাক্কা দিয়ে!
কিন্তু কাশি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল পিকআপের ইঞ্জিন।
ইগনিশনে মোচড় দিল কিশোর।
স্টার্ট হলো না ইঞ্জিন।
দুটো হেডলাইটের আলো বেরিয়ে আসতে লাগল র্যাম্পের গর্ত থেকে।
আবার চেষ্টা করল কিশোর। লাভ হলো না।
নেমে পড়ো গাড়ি থেকে! এক হাতে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে আরেক হাতে জিনার হাত চেপে ধরে টান মারল মুসা।
তিনজনেই নেমে দৌড় মারল সিঁড়ির দিকে।
উঠে পড়েছে স্পোর্টস কার। ওটার হেডলাইটের আলো ওদের ওপর পড়ে লম্বা লম্বা কিভুত ছায়া তৈরি করল-পা অস্বাভাবিক লম্বা, মাথা ছোট।
প্রাণপণে ছুটছে ওরা। আর বিশ ফুট যেতে পারলেই
আচমকা ডানে সরে গেল হেডলাইটের রশ্মি। চোখের পলকে সামনে চলে এল কালো রঙের চকচকে গাড়িটা, সামনে দেয়াল তৈরি করে দাঁড়িয়ে গেল। আটকে দিল সিঁড়িতে ঢোকার পথ।
দেখো, আমার কাছে পিস্তল আছে। গর্জে উঠল একটা ভোঁতা কণ্ঠ।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল গাড়ির দুদিকের দরজা।
পিস্তলটা দেখতে পেল কিশোর। কোন রকম প্রতিবাদ না করে মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াল।
দেখাদেখি মুসা আর জিনাও তাই করল।
গাড়ি থেকে নামল দুজন লোক। স্কি মাস্ক দিয়ে মুখ ঢাকা। যে লোকটা ড্রাইভ করছিল, তার হাতে পিস্তল।
মুসা জিজ্ঞেস করল, কে আপনারা?
ইটের গাঁথনি তুলে দেয়াল তৈরি করে ঘিরে দেয়া হয়েছে ছাতের চারপাশ। একদিকের দেয়াল দেখিয়ে পিস্তল নেড়ে ধমক দিল ড্রাইভার। ওদিকে যাও?
পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল কিশোরের, ছাদ থেকে আমাদের লাফ দিতে বলবেন নাকি…
যাও বলছিকথা কম! আবার ধমক দিল ড্রাইভার। সঙ্গীকে বলল, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কি? পিকআপটার ব্যবস্থা করো।
আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে কিশোর। তারপরেও বুদ্ধি ঠিকই কাজ করছে। বুঝতে পারছে, কণ্ঠস্বর আরেক রকম করে কথা বলছে লোকটা। যেন ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় করছে।
দ্বিধা করল অন্য লোকটা। তারপর স্পোর্টস কারের দরজা দিয়ে মাথা ঢোকাল। বের করে আনল দুই বোতল মদ। পিকআপের দিকে এগোল।
কি-ব্ধি করতে চান? তোতলাতে শুরু করল কিশোর, ও-ওটা আমার চাচার গাড়ি!
শব্দ করে হাসল পিস্তলধারী। তাতে কি? মরে গেলে চাচাটাচা কিছু থাকবে না। এগারোটার নিউজে কি বলবে এখনই শুনতে পাচ্ছি আমি: তিনটে ছেলেমেয়ে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গাড়ি চালিয়ে মলের ছাদে উঠে পড়েছিল। ছাদের কিনারের দেয়ালে গুতো লাগিয়ে দেয়াল ভেঙে নিচে পড়েছে। তিনজনই মৃত। হাহ হা!
আমরা মাতাল…অসম্ভব…
কথা শেষ করতে পারল না কিশোর। তরল পদার্থ পড়ার শব্দ হলো। ফিরে তাকিয়ে দেখল পিকআপের সীটে মদ ঢালছে লোকটা। ও-কি করছেন? মদ ঢেলে দিচ্ছেন কেন?
এই থামো, সহকারীকে বাধা দিল পিস্তলধারী, সব ঢেলো না। খানিকটা রেখে দাও। ওদের গেলাতে হবে। রক্তে অ্যালকহল লেভেল বেশি দেখতে না পেলে সন্দেহ করে বসবে পুলিশ।
একটা বোতল পুরো ঢেলে শেষ করল অন্য লোকটা। বাকি বোতলটা নিয়ে এগোল ওদের দিকে।
শয়তান কোথাকার… মুঠো পাকাল মুসা। কি করতে চায় লোকগুলো বুঝে ফেলেছে।
থামো, মুসা, বাধা দিল কিশোর, কিছু কোরো না!
পিস্তলটা মুসার মুখের দিকে তাক করে ধরেছে ড্রাইভার। ঠিক। তোমার বন্ধু যা বলছে, করো!
চুপ হয়ে গেল মুসা।
যা বলছি করো, আবার বলল পিস্তলধারী, তাতে ব্যথা কম পাবে। হয়তো টেরই পাবে না কিছু। বোতলের মুখ খুলে দেয়ার জন্যে ইশারা করল সঙ্গীকে। মুসাকে খেতে বলল প্রথমে।
বিড়বিড় করছে জিনা। প্রার্থনাই করছে বোধহয়।
মুসার ঠোঁটের কাছে বোতলের মুখ ঠেকাল লোকটা 1 দাতে দাঁত চেপে রেখেছে মুসা! তাকিয়ে আছে পিস্তলটার দিকে। কি করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আস্তে করে ঠোঁট ফাঁক করল।
হঠাৎ ইঞ্জিনের শব্দ হলো। পাই করে সেদিকে ঘুরল পিস্তলধারী। কে এল। আবার…
সুযোগটা ছাড়ল না জিনা। মাথা নিচু করে ছুটে গেল লোকটার দিকে। কঁধ দিয়ে ধাক্কা মারল পেটে, বেল্টের সামান্য ওপরে। একই সঙ্গে থাবা চালাল পিস্তল ধরা হাতে।
বিস্ময় এবং ব্যথায় ছোট্ট একটা আর্তচিৎকার বেরোল লোকটার গলা থেকে। হাত থেকে উড়ে গেল পিস্তল।
অ্যাসফন্টের ওপর খটাং করে পড়ল ওটা। পড়ার আগেই ধরার জন্যে ডাইভ দিয়েছে মুসা। ধরে রাখতে পারল না। হাতের ঠেলা লেগে দূরে গিয়ে পড়ল পিস্তলটা। আনার জন্যে এগোতে যাবে, এই সময় চিৎকার করে বলল কিশোর, মুসা, লাগবে না।
ফিরে তাকিয়ে মুসা দেখল, তাড়াহুড়ো করে গিয়ে গাড়িতে উঠছে লোকগুলো। দরজা টেনে ধরে রেখেছে কিশোর আর জিনা, যাতে বন্ধ করতে না পারে। মুসাকেও ডাকল কিশোর।
স্টার্ট দিয়ে সরে যেতে লাগল স্পোর্টস কার।
র্যাম্পের মুখ দিয়ে বেরোল আরেকটা গাড়ি। একটা লাল পুরানো ফোক্সওয়াগেন।
রবিন! অবাক হয়ে গেল কিশোর।
প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি রবিন। যেই বুঝল, নাক ঘুরিয়ে তেড়ে গেল স্পোর্টস কারটাকে।
পিকআপে উঠে পড়ল কিশোর, মুসা আর জিনা। এইবার ইগনিশনে মোচড় দিতেই স্টার্ট হয়ে গেল ইঞ্জিন। সোজা র্যাম্পের মুখের দিকে গাড়ি ছোটাল কিশোর।
নাকে আসছে অ্যালকহলের কড়া গন্ধ। এই ভয়াবহ উত্তেজনার মধ্যেও দেখতে পাচ্ছে মেরিচাচীর বিস্মিত মুখ। বাড়িতে কেউ মদ খায় না। একটু আধটু অভ্যাস যা। ছিল রাশেদ চাচার, সেটাও ছাড়িয়েছেন চাচী। কিশোর খেয়েছে, এটা যদি মাথায় ঢোকে তার বাকিটা আর ভাবতে চাইল না কিশোর!!
র্যাম্পের মুখে বাধা সৃষ্টি করা গেল না, তার আগেই ঢুকে পড়ল স্পোর্টস কার। তীব্র বেগে নেমে যেতে লাগল। পেছনে লেগে রইল পিকআপ আর ফোক্সওয়াগেন।
নিচে তিরিশ গজ দূরে লাল একটা সাইন দেখা যাচ্ছে: ENTRANCE ONLY তার ওপাশে রাস্তা।
ধ্যাত্তোর! গেল চলে! হতাশায় ড্যাশবোর্ডে দুম করে কিল মারল মুসা।
কিন্তু গতি না কমিয়ে বেরোতে গিয়েই ভুলটা করল ড্রাইভার। যে পথ ধরে নামছিল, তার গোড়াটা ঢালু হয়ে গিয়ে হঠাৎ করেই সোজা হয়ে গেছে। সেটাতে সামনের চাকা পড়তেই সাংঘাতিক ঝাঁকুনি লাগল। বলের মত ড্রপ খেয়ে ওপরে উঠে গেল গাড়ি। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দুপাশের দরজা। বাইরে ছিটকে পড়ল দুই আরোহী। গাড়িটা সরে চলে গেল।
ব্রেক কষল কিশোর। পড়ে থাকা দুটো দেহের দশ ফুট দূরে এসে থামল পিকআপ।
একধাক্কায় দরজা খুলে ফেলে লাফিয়ে নেমে দৌড় দিল কিলোর। অন্যপাশ দিয়ে নামল মুসা আর জিনা।
পিকআপের পেছনে ফোক্সওয়াগেন থামিয়ে রবিনও নেমে পড়ল।
নিথর হয়ে পড়ে আছে দুটো দেহ।
নিচু হয়ে টেনে একজনের মুখোশ খুলে ফেলল কিশোর।
টান লেগে ডান থেকে বায়ে কাত হয়ে গেল রলি ওয়ারনারের মুখটা।
অন্য লোকটার মুখোশ খুলল রবিন।
ভিনসি জাপা!
.
১৬.
আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দেহ দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে জিনা। মরে যায়নি তো?
ওদের নাড়ি দেখল কিশোর। না। তবে অবস্থা ভাল না। আঘাত ভালইলেগেছে।
তাহলে তো অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দেয়া দরকার; মুসা বলল। বাড়িতে ঢোকার মুখেই একটা টেলিফোন আছে। সেটার দিকে দৌড় দিল সে।
আশ্চর্য! মাটিতে বসে পড়েছে জিনা। রলিকে আমি বরাবরই সন্দেহ করেছি, কিন্তু ম্যানেজারকে খুব ভাল মানুষ মনে হয়েছে!
আরও আশ্চর্য হওয়ার মত খবর আছে আমার কাছে, রবিন আর জিনা দুজনের দিকে তাকাল কিশোর। ওরা দুজনই শুধু নয়, এর মধ্যে আরও লোক জড়িত। মিউজিশিয়ানদের লকার খুঁজতে গিয়ে জাহিরের সম্পর্কে কি পেয়েছি দেখো, জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা খাম বের করে দিল সে।
ভেতর থেকে একটা হলদে ভাজ করা কাগজ বের কর কিশোর। তাতে নম্বর আর তথ্য ভরা। এগুলো কিউ এবং কিউ নম্বর। সে-রাতে আমি যেগুলো দেখলাম কম্পিউটারে, গোলমাল করা, সেগুলোও আছে এতে।
তারমানে জাহিরও আছে এর মধ্যে, জিনা বলল। কিন্তু কেন?
আবার ভাঁজ করে কাগজটা খামে ভরে নিজের পকেটে রেখে দিল কিশোর। প্রশ্নের জবাব জানতে চাইলে আরও গভীরে যেতে হবে আমাদের। পালের গোদাটাকে খুঁজে বের করতে হবে।
টেলিফোন সেরে ফিরে এসে মুসা জানাল, অ্যাম্বুলেন্স আসছে।
রবিন জিজ্ঞেস করল কিশোরকে, মনে হয় গোদাটা কে জানা আছে তোমার?
পিটারের ওপর বার বার আক্রমণ. এলে একটা লোক সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে, থামল কিশোর। এক এক করে তাকাল সবার মুখের দিকে। এ ভাবে শ্রোতাদের ঝুলিয়ে রেখে মজা পায় সে। চিরকালের অভ্যাস।
কে? জানতে চাইল মুসা।
খুলেই বলি, দাঁড়াও। গাড়ির রেডিওতে খবরটা শোনার পর ব্যাপারগুলো খাপে খাপে বসে গেল আমার মাথায়। পিটারের কথা শুনে মনে হতো, অ্যাক্সিডেন্ট ঘটায় খুশিই হয়েছে সে নইলে এমন করে টিকিটও বিক্রি হত না, তারও কাজ থাকত কিনা সন্দেহ।
ওসব তো জানি আমরা, অধৈর্য হয়ে জিনা বলল। পিটার ব্রডওয়েতে যাবে, আরও ওপরে উঠবে। খ্যাতির চূড়ান্তে চলে যাবে। তাতে আমাদের কি? আসল লোকটা কে বলো?
খ্যাতির লোভ বড় লোভ, সেই সঙ্গে যদি টাকা আসে তাহলে তো কথাই নেই। পিটার হাইয়েমের কাছে এর চেয়ে বেশি আর কি চাওয়ার আছে: যা যা করেছে সে, তাতে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়। নিজের গুণগান প্রচার করার লোক নিজে ঠিক করেছে সে। ডেভন কলিনের সঙ্গে কথা বলার সময় নিজেই নিজের বিজ্ঞাপন করেছে, নির্লজ্জের মত নিজের প্রশংসা করেছে। জোর করে টিকে থাকতে চেয়েছে নাটকটাতে…।
লোকটার মাথায় যে ছিট আছে, সে তো জানিই আমরা, মুসা বলল। নিজের সম্পর্কে বড় বেশি উঁচু ধারণা। কিন্তু এ সব বলে কি বোঝাতে চাইছ তুমি?
অ্যাক্সিডেন্টগুলো ঘটার আগে টিকিট বিক্রি হত না, মরেই যেত হয়তো শো টা। দর্শক না থাকলে কাকে দেখাবে? কিন্তু পরে, দুই হপ্তার মধ্যে সাংঘাতিক হিট হয়ে গেল, অথচ এখনও ওপেনিঙের ঘোষণাই দেয়া হয়নি। এই পরিবর্তনটা কেন ঘটল?
খবরের কাগজ আর টিভি-রেডিয়ো ঘটিয়েছে ঘটনাটা, জবাব দিল মুসা, এ তো জানা কথা। এমন প্রচার শুরু করল..
একদম ঠিক, এক আঙুল তুলল কিশোর। কাগজগুলো পেয়ে গেল মজা। যেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে, অমনি ফলাও করে ছেপে দেয়। থিয়েটারে তাদের কোন রিপোর্টার ওই সময় না থাকলেও খবরটা ঠিকই পেয়ে যায়।
তারমানে, রবিন বলল, কেউ খবরটা পাঠিয়ে দেয় ওদের।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। এমন কেউ পাঠায়, যার কাছে বিজ্ঞাপন আর প্রচার একটা বিরাট ব্যাপার। সে জানে, এই একটা মাত্র জিনিসই তার চাকরি বাঁচাবে।
বুঝেছি! পিটার! বলে উঠল মুসা।
ভেবে দেখো, মুসার কথা যেন কানেই ঢোকেনি কিশোরের, তুমি একজন তরুণ অভিনেতা, একটা নাটক করছ যেটার সফল হওয়ার সম্ভবনা আছে। সারা জীবন একটাই স্বপ্ন তোমার, একটা নাটক হিট হোক। কিন্তু কাজটা করতে গিয়ে দেখলে কোন কারণে টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। বন্ধ হয়ে যেতে পারে.নাটক। তাহলে কাজ চলে যাবে তোমার। আবার সেই ভাতেমরা অভিনেতায় পরিণত হবে, না খেয়ে থাকতে হবে। কি করবে তখন?
হাত ওল্টাল মুসা, কি আর করব? মোটর মেকানিকের কাজ নেব।
আরে দূর, তোমার কথা কে বলছে, একটা উদাহরণ দিচ্ছি, কিশোর বলল। তুমি তখন চাইবে নাটকটার উন্নতি, যে ভাবেই হোক। ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড দেখতে এখন কেন যাচ্ছে লোকে? নাটক দেখতে যতখানি, তার চেয়ে বেশি পিটারের দুরবস্থা দেখতে। আশা করছে একটা অক্সিডেন্ট ঘটবেই।
হু, মাথা দোলাল মুসা, বুঝতে পারছি।
আমার কিন্তু সে-রকম মনে হয় না, জিনা একমত হতে পারল না। নিজের ওপর নিজে দুর্ঘটনাগুলো কি করে ঘটাল সে?
সে তো ঘটায়নি, কিশোর বলল। হুমকি দিয়ে ফোনঃআসা, চিঠি আসা, এগুলো কেবল তার মুখের কথা, আমাদের কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি সে। চিঠিগুলো কোথায় যখন জানতে চেয়েছি, বলেছে ফেলে দিয়েছে। আমার তো। ধারণা, সব মিথ্যে কথা, ওরকম কোন চিঠি পাইনি সে। দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্যে লোক ঠিক করেছে সে-ই। এমন করে সাজিয়েছে, যাতে মনে হবে অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে, কিন্তু সত্যি সত্যি কোন ক্ষতি হবে না। থিয়েটারের বাইরে সেদিন যে সাইনবোর্ডটা পড়ল, দেখেছ কোনখানে পড়েছে? পিটার যেখানে দাঁড়ানো ছিল তার চেয়ে কতটা দূরে?
দেখেছি, ক্যামেরার একেবারে চোখের সামনে, যাতে সহজেই ধরা পড়ে। বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে জিনা।
আর ফ্ল্যাশ-পট অ্যাক্সিডেন্টটাও সাংঘাতিক বিপজ্জনক মনে হয়েছে, মুসা। বলল। কিন্তু এমন সময় ফেটেছে, যখন সরে যাওয়ার জন্যে ঘুরেছে পিটার।
রবিন বাল, জাহিব করে থাকতে পারে এ কাজ, অর্কেস্ট্রা পিট থেকে।
জাপার নির্দেশে, যোগ করল কিশোর। যাই হোক, এই ঘটনার পর পিটারের ড্রেসিং রূমে ঢুকেছি আমরা। নিক নামে একজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল তখন সে। ব্যাপারটা নিয়ে প্রথমে মাথা ঘামাইনি আমি, যতক্ষণ না তার বিজ্ঞাপন প্রচারকের নামটা মনে পড়ল।
নিক ফ্লিন্ট। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ফ্লাশ-পট অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা প্রচার করে দেয়ার জন্যে তাকে ফোন করেছিল পিটার। এখন বুঝতে পারছি গোপনে, আমাদের তদন্ত করার কথাটা খবরের কাগজকে কে জানিয়েছে। পিটার নিজে। এটাতে আরেকটা বিজ্ঞাপন হয়েছে তার।
ঠিক, কিশোর বলল। আর মনে হচ্ছে কম্পিউটারের দায়িত্বটা ছিল জাহিরের ওপর। চুরি করে থিয়েটারে ঢুকে কিছু কিছু কিউ গোলমাল করে দিত, অবশ্যই জাপার সহায়তায়।
তারপর সে-রাতে টোপাজের হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল জাহির, মুসা বলল। আর যেতে সাহস করেনি। তাই বাধ্য হয়ে গোলমাল করার কাজটা নিজেই করতে গেল পিটার।
কিংবা হয়তো দেখতে গিয়েছিল আজ সকালে, জাহির ঠিকমত সব করতে পেরেছে কিনা। কোন কিউটাতে দুর্ঘটনা ঘটবে, এটা জানা না থাকলে সত্যি সত্যিই দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই আগে থেকে সাবধান থাকতে চাইছিল।
সুতরাং কাল রাত থেকে শুরু করে আজ সকাল পর্যন্ত অনেক ভাবে ওদের বাধা দিয়েছ তোমরা, রবিন বলল। পুরো ব্যাপারটা ফাস হয়ে যাওয়ার ভয়ে শেষে তোমাদের পেছনেই লেগেছিল এরা। মুখ বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল।
এক মিনিট, হাত তুলল জিনা। পোশাকে চুলকানির ওষুধ লাগানো আর মূর্তি ফেলার ব্যাপারটা তাহলে কি?
জবাবটা মুসাই দিতে পারল, নতুন পোশাকটা যেদিন পেয়েছে পিটার সেদিনের কথা মনে করো। একটা প্যাকেট হাতে বেরিয়ে গেল জাপা, বলল পপকর্নের প্যাকেট। আসলে তার মধ্যেই চুলকানির ওষুধ বলো আর বিষ বলো, জিনিসটা ছিল। পোশাকে লাগিয়েছিল সে-ই। তুমি যখন পোশাকটা ধরতে গেলে ইচ্ছে করে আয়নাটা ফেলে দিয়ে ভাঙল পিটার, তোমাকে সরানোর জন্যে। নাহলে তুমি ধরে ফেললে তোমারও হাত চুলকানি শুরু হতো। কে লাগিয়েছে হয়তো আন্দাজ করে ফেলতাম আমরা, এই ভয়ে তখন চুলকানির খবরটা জানাতে চায়নি পিটার।
কিশোর বলল, শেকসপীয়ারের মূর্তি ফেলার ঘটনাটা পিটার আর ওলি দুজনে। মিলে ঘটিয়েছে। ববের বাড়িতে যাওয়ার পথেই নিশ্চয় আলোচনা করে ঠিক করেছে, ওখানেও একটা দুর্ঘটনা ঘটাবে। দুজনেই বার্গার খেয়েছে, আঙুলে বনরুটির। তেল লেগেছিল। সেজন্যে মূর্তি আর বাতির সুইচ দুটোতেই লেগে গিয়েছিল ওই তেল। রলি তার ধরে টেনে টেবিল ল্যাম্পের প্লাগ খুলেছে, আর পিটার নিজের গায়ে নিজেই মূর্তি ফেলেছে। আমরা তখন চোখ বন্ধ করে আছি, ফলে কেউই দেখতে পাইনি কিছু।
কিন্তু পিটারের কপালে বাড়ি লেগেছিল, প্রশ্ন তুলল জিনা। আরেকটু হলেই কেটে যেত।
আমার কাছে অবাক লেগেছে, এত জোরে বাড়িটা লাগল, পরদিনই আবার মিলিয়ে গেল, বলল মুসা।
মেকআপ করে করেছিল ওরকম, জবাব দিল কিশোর। পকেটে বোধহয়। লাল মোম রেখে দিয়েছিল, কপালে লাগিয়ে দিয়েছে। নিজের কপাল নিজেই চেপে ধরে রেখেছিল, অন্য কেউ তো আর দেখতে যায়নি আঘাত কতখানি।
টার্নটেবলের ব্যাপারটা কি? আবার প্রশ্ন করল জিনা। একটা নিরপরাধ লোকের পা ভাঙল ওভাবে পিটার?
না, এই কাজটা সম্ভবত জাপা করেছে। টার্নটেবলের দায়িত্বে ছিল সে।
বুঝলাম। কিন্তু একটা কথা এখনও বুঝতে পারছি না, পিটারের নাহয় স্বার্থ আছে, সে এ সব করেছে, কিন্তু বাকি লোকগুলো? তারা কেন করেছে?
পিটারের মতই রলিরও কাজ হারানোর ভয়। জাহিরেরও টাকার দরকার ছিল। বড় কিছু অভিনেতা আর গায়ক-বাদক ছাড়া সবাই টাকার কষ্টে ভোগে, কাজটাকে পেশা হিসেবে নিলে।
স্টেজ ম্যানেজারেরও নিশ্চয় চাকরি হারানোর ভয়? মুসার প্রশ্ন।
মাথা নাড়ল কিশোর, এই একটা ব্যাপারই বুঝতে পারছি না। স্টেজ ম্যানেজারের চাকরির অভাব হয় না। কাজ জানা লোকের খুব কদর। ওয়াইল্ড ওয়াইল্ডের মত জটিল একটা নাটকের কাজ যাকে-তাকে দিয়ে হবে না। তারমানে জাপা কাজ জানে।
হঠাৎ কপালে ভাঁজ পড়ল মুসার। বুঝলে, টার্নটেবল অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটাও কেমন যেন গোলমেলে। জাপা যদি জানেই পিটার নাচছে, তাহলে ওভাবে অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটাত না। তাকে অচল করে দেয়ার তো ইচ্ছে ছিল না কারোরই।
স্টেজ ম্যানেজার জানত যে লোকটা পিটার নয়, যুক্তি দেখাল জিনা।
মাথা নাড়ল রবিন, তাহলে একজন ভাল ড্যান্সারকেই বা অচল করে দেয়ার কি যুক্তি থাকতে পারে?
জবাবের আশায় কিশোরের দিকে তাকাল তিনজনেই।
শিওর হয়ে আমিও কিছু বলতে পারছি না, কিশোর বলল। তবে জবাবটা কি করে জানা যাবে হয়তো বলতে পারি। উচ্চারণ।
বুঝলাম না, জিনা বলল।
এসো আমার সঙ্গে।
ফোনের কাছে ওদের নিয়ে এল কিশোর। পিটারের নম্বরে ফোন করল। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এল মুসা, রবিন আর জিনা, যাতে ওপাশের কথা রিসিভারে শুনতে পারে।
হালো? পিটারের গলা ভেসে এল।
জাপার নিউ ইয়র্কি উচ্চারণ নকল করে জবাব দিল কিশোর, হ্যাঁ, ভিনস্ বলছি।
ওদেরকে ধরেছ?
ধরেছি।
যাক, বাঁচা গেল। খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ। আমাকে কম্পিউটার ধরতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল কিশোরের। পুরো ব্যাপারটা ফাস করে দিত সে।
হ্যাঁ।
রলির কি খবর? তার ব্যবস্থা করেছ?
থমকে গেল কিশোর। তার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিন সহকারী।
জবাব দাও। চুপ করে আছো কেন? চিন্তায় চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল!
হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর।
ঠিক আছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পিটার। কাল তোমার চেক পেয়ে যাবে।
জাপাও তাহলে টাকার জন্যেই এ কাজ করেছে। বুঝতে পারল কিশোর।
পিটারকেও ধরা, দরকার-ভাবল সে। তবে ফোনে কিছু বলা ঠিক হবে না। সাবধান হয়ে গিয়ে পালাতে পারে।
রাখলাম, ওপাশ থেকে বলল পিটার।
আচ্ছা।
রিসিভার রেখে দিল কিশোর। পিটার কি কি বলেছে, বন্ধুদের জানাল।
রবিন বলল, শেষ প্রশ্নটার জবাবও তাহলে পেয়ে গেলাম।
নীরবে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হ্যাঁ-না কিছু বোঝা গেল না।
মুসা বলল, আরেকটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। রলির পেছনে লাগল কেন পিটার?
নিশ্চয় বুলি লেগেছিল পিটারের পেছনে। সে মনেপ্রাণেই চাইছিল পিটার একটা দুর্ঘটনায় পড়ে অকেজো হয়ে যাক, তাহলে তার পালা আসবে। পিটারের জায়গায় অভিনয়ের সুযোগ দেয়া হবে তাকে। সেজন্যে টার্নটেবলের সুইচ টিপেছিল সে। জানত না, পিটারের জায়গায় অন্য লোক নাচছিল তখন। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। তাই রলিকে শেষ করে দিতে চেয়েছে পিটার।
দূরে সাইরেনের শব্দ শোনা গেল।
অ্যাম্বুলেন্স আসছে, রবিন বলল।
মাথা ঝাঁকিয়ে আবার রিসিভার তুলে নিল কিশোর, এবার পুলিশকে ফোন করা দরকার। পিটারকে ধরতে হবে। জাহিরকেও।
বিড়বিড় করল জিনা, কি আশ্চর্য! লোভে পড়ে মানুষ কি না করে। অথচ কে ভাবতে পেরেছিল জাপার মত ভদ্রলোক…।
খাঁটি দার্শনিকের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মুসা, শুধু চেহারা দেখে কখনোই বিচার করা উচিত নয় কে ভাল লোক, কে মন্দ। তা বটে! মাথা ঝাঁকাল জিনা।