- বইয়ের নামঃ ডীপ ফ্রিজ
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
ডীপ ফ্রিজ
০১.
ভয়ানক ঠাণ্ডা! কিশোর বলল।
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল প্যাসেঞ্জার। সীটে বসা রবিন, আর বেশি নেই। এসে গেছি।
এত ঠাণ্ডা নিশ্চয় সাইবেরিয়াতেও নেই! গাড়ি চালাতে চালাতে মুসা বলল। শার্লিরা থাকে। কি করে।
শুধু শার্লিরা না, হেসে বলল রবিন। আরও বহু লোক বাস করে এ অঞ্চলে। তারা থাকে কি করে?
থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে আরকি, মন্তব্য করল পেছনের সীটে বসা কিশোর। আমরা গরম অঞ্চল থেকে এসেছি বলে ঠাণ্ডাটা অনেক বেশি লাগছে।
নিউ ইয়র্কে বেড়াতে এসেছে ওরা। নিউ ইয়র্কের নিউ পোর্টে। রবিনের খালার বাড়িতে। এসে দেখে তিনি নেই। জরুরী কাজে চলে গেছেন। ঘরে একটা নোট রেখে গেছেন। তাতে লেখা: জরুরী কাজে বেরোতেই হলো। দিন সাতেকের মধ্যেই ফিরছি। ঘরে খাবারটাবার সব আছে। আশা করি তোমাদের কোন অসুবিধে হবে না।-আন মারগারেট।
সেটা গত কালকের কথা। আজ চলেছে ওরা পাইনভিউ লেকে। আরেক আন্টির বাড়িতে। বেলী আন্টি। তার মেয়ে শার্লি। আজকে ওর জন্মদিন। নিউ পোর্ট থেকে ফোন করেছিল রবিন। ওদের আসার খবর পেয়ে একটা সেকেন্ডও আর দেরি করেনি শার্লি। নিউ পোর্টে চলে গিয়েছিল রবিনদের সঙ্গে দেখা করতে। দাওয়াতটা তখনই দিয়ে এসেছে।
লোকের দিকে মুখ করা একটা বড়, চমৎকার বাড়িতে থাকে শার্লিরা। আগেও এখানে এসেছে রবিন। তবে কিশোর আর মুসা এই প্রথম।
পাইন বনের ভেতর দিয়ে গেছে রাস্তা। লেক ঘিরে আংটির মত একটা পাক খেয়ে এগিয়ে গেছে। বছরের এ সময়টায় বাইরের কেউই রাস্তাটা ব্যবহার করে না তেমন, কেবল স্থানীয় অধিবাসী আর আইস ফিশারম্যানরা ছাড়া।
জানুয়ারির শেষ দিকেই জমাট বরফ হয়ে যায় লেকের ওপরের পানি। আর এখন মধ্য-ফেব্রুয়ারিতে সেটা এতই পুরু, ট্রাক নিয়ে উঠে পড়ে আইস ফিশারম্যানরা। গাড়ি চালিয়ে চলে যায় নিজেদের ফিশিং শ্যান্টির কাছে। এই জমাট বরফে স্কেইটিংও খুব ভাল জমে।
তুষারে ঢাকা পিচ্ছিল রাস্তায় শেষ মোড়টা নিতেই সামনের বরফে ঢাকা লেকটা চোখে পড়ল ওদের।
উফ, কি দারুণ সুন্দর। চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। মুগ্ধ দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। একেবারে ছবির মত! ডীপ ফ্রিজ
লেকের একধারে অনেকগুলো ফিশিং শ্যান্টি। এক জায়গায় এ রকম শ্যান্টির জটলাকে স্থানীয় মাছ শিকারীরা বলে শ্যান্টি টাউন। আরেক ধারে আইস-হকি খেলতে নেমেছে ছেলের দল।
দেব নাকি বরফের ওপর দিয়েই চালিয়ে? জ্বলজ্বলে চোখে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা।
দাও, লেকের ওপর দিয়ে যাওয়ার আনন্দটা কিশোরও মিস করতে রাজি নয়।
.
পার হয়ে এল নিরাপদেই।
শার্লিদের ড্রাইভওয়েতে ঢুকল গাড়ি।
ওই দেখো! কি বানিয়েছে। বলে উঠল কিশোর।
একটা স্লেম্যানের গায়ে ফিনিশিং টাচ দিচ্ছে শার্লি আর তার বাবা-মা। কাউচে বসা লাইফ-সাইজ ভাস্কর্য। টেলিভিশন দেখছে সোম্যান। সব কিছুই বরফ দিয়ে। বানানো হয়েছে।
খাইছে। দারুণ তো। মুসা বলল।
মরগান আঙ্কেল খুব ভাল ভাস্কর, রবিন জানাল।
হুঁ, মাথা ঝাঁকাল মুসা। ভাল যে সেটা তো সৃষ্টি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর।
ড্রাইভওয়ের শেষ মাথায় গাড়ি রাখল মুসা। দরজা খুলে নামল।
দৌড়ে এল শার্লি। এলে। আমি তো তোমাদের দেরি দেখে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কাল রাতে যা তুষার পড়েছে! ভাবছিলাম, রাস্তার এত তুষার মাড়িয়ে হয়তো আর আসতেই পারলে না।
শার্লির গায়ে লাল পার্কা। কান ঢাকা সাদা মাফলারে। শীতের এই সাদা ওয়ান্ডারল্যান্ডে অপূর্ব সুন্দর লাগছে ওকে।
একে একে নামল কিশোর আর রবিন। শার্লিকে হ্যাপি বার্থডে উইশ করল ওরা। হাত-পা ছড়িয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে লাগল। গা গরম করার জন্যে কয়েক রাউন্ড স্নো-বল ছোঁড়াছুড়ি খেলল। তারপর দল বেধে এগিয়ে গেল শালির বাবা-মার সঙ্গে দেখা করার জন্যে।
এসো, মিসেস মরগান বললেন। শার্লি তো তোমাদের জন্যে অস্থির হয়ে গিয়েছিল।
কি করব। যা বরফ, জবাব দিল কিশোর।
হ্যাঁ, আসতে যে পারলে সেটাই বেশি।
পুরো সকালটাই নিশ্চয় এর পেছনে কাটিয়েছেন, স্লেম্যানের ভাস্কর্যটা দেখিয়ে বলল কিশোর।
হ্যাঁ, জবাব দিলেন বেলী আন্টি।
কাল রাত থেকে বানানো শুরু করেছি, যোগ করলেন মরগান আঙ্কেল।
কিশোর, আমার মা আর বাবা, শার্লি বলল।
হাসল কিশোর। সে তো বুঝেইছি।
মিস্টার জিম মরগান বেশ ভারিক্কি চেহারার মানুষ। ধূসর হয়ে এসেছে খাটো করে ছাঁটা চুলের রঙ। মিসেস বেলীল মরগান হাসিখুশি, আন্তরিক। হাসি লেগেই আছে মুখে।
কিশোরের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন মরগান আঙ্কেল। আমিও তোমাদের অপেক্ষাই করছি। জরুরী কথা আছে।
বাবা, প্লীজ, শার্লি বলল। মাত্র তো এল ওরা। আগে কিছু মুখে দিক। লাঞ্চটা শেষ হোক।
লাঞ্চ তো আর চলে যাচ্ছে না।
আসামাত্র বেচারা ছেলেগুলোকে নিয়ে পড়লে কেন? বাধা দিতে এগিয়ে এলেন বেলী আন্টি। ওরা এখানে আনন্দ করতে এসেছে। তোমার জরুরী কথা শুনতে নয়।
আমি শুধু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, এখানকার চুরি-ডাকাতিগুলোর খবর ওদের কানে গেছে কিনা, মরগান আঙ্কেল বললেন।
সজাগ হয়ে উঠল কিশোর। তাড়াতাড়ি বলল, না না, আন্টি, আমরা বিরক্ত হচ্ছি না। শোনার বরং আগ্রহই হচ্ছে।
কেউ জমায় স্ট্যাম্প, কেউ অন্য কিছু রবিন বলল, আমাদের হবি অপরাধের কিনারা করা।
সাবধানী চোখে ওদের দিকে তাকালেন বেলী আন্টি। সবগুলো পাগল।
মরগান আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কতদিন ধরে হচ্ছে এ সব?
হচ্ছে তো কয়েক বছর ধরেই। শীতকালে। শীতের ভয়ে লোকে পালায়। লেকের চারপাশের ওসব নির্জন বাড়িতে তখন চোর ঢোকে। জিনিসপত্র চুরি করে। নিয়ে যায়, মরগান আঙ্কেল জানালেন। পুলিশ কিছু করতে পারছে না। বড় দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। বাড়ি খালি রেখে আমরাও তো শহরে-টহরে যাই। তোমরা আসাতে ভালই হলো। শার্লি এসে কাল যখন বলল তোমরা এসেছ, ভাবলাম, যাক, এবার বোহয় এ সমস্যাটার একটা সমাধান হবে। শুনেছি তো, এমন এমন অনেক কেসের। কিনারা করেছ তোমরা, পুলিশও যার থই খুঁজে পায়নি। আর সে-বছর রবিনও এসে একটা জটিল কেসের কিনারা করে রেখে গেছে। তারপর থেকেই ভক্তি এসে গেছে। তোমাদের ওপর। একটা বাচ্চাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। দিব্যি খোঁজ-খবর করে কিডন্যাপারদের পাকড়াও করে ফেলল রনি। বাচ্চাটাকে উদ্ধার করল। তাই বলছিলাম, যদি চুরির কেসটারও কিছু করতে পারতে…
জিম, বাধা দিলেন বেলী আন্টি, এখানকার কাজটা তুমি শেষ করো। আমি বারগার বানাতে গেলাম।
ছেলেদের দিকে তাকালেন মরগান। তোমরা আনন্দ ফুর্তি করো। আমি যাই।
আচ্ছা, কিশোর বলল।
স্লোম্যানটার গায়ে ফিনিশিং টাচ দিতে লাগলেন মরগান আঙ্কেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিক দেখল তিন গোয়েন্দা। তার কাজের প্রশংসা না করে পারল না।
শার্লি বলল, লেকে যাবে নাকি? বাবা বলল, বরফের অবস্থা খুব ভাল। স্কেইটিং জমবে।
তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে বাড়ির পেছন দিক ঘুরে লেকের পাড়ে এসে দাঁড়াল সে।
সত্যি, এত সুন্দর জায়গা! লেকটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুসা বলল। পিকনিকের জন্যে এর তুলনা হয় না।
নির্বিঘ্নে চুরি-ডাকাতির জন্যেও তুলনাহীন, কিশোর বলল।
চোর-ডাকাতের কথা এখানে ভাল লাগছে না। দৃশ্যটার সঙ্গে বেমানান।
স্বর্গেও সাপ থাকে, গম্ভীর স্বরে জবাব দিল কিশোর। বাড়িঘরগুলোর অবস্থান দেখো। দেখলেই বুঝবে জায়গাটা কেন চোর-ডাকাতের স্বর্গ হয়েছে।
বেশির ভাগ বাড়িই বড় বড়। দুতিনতলা উঁচু। প্রতিটি বাড়ির চারপাশে প্রচুর খালি জায়গা। একজন মানুষকেও দেখা গেল না কোনখানে।
ডোবারকে ফোন করব কিনা ভাবছি, চিন্তিত ভঙ্গিতে রবিন বলল। চুরিগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করা যাবে। ডোবার কগনান নিউ পোর্ট থানার অফিসার। কিডন্যাপ করা বাচ্চাটাকে উদ্ধারের সময় আমাকে অনেক হেল্প করেছিল। খুব ভাল অফিসার।…থাকগে, পরেই করব। চলো, শরীরটাকে গরম করে আসি। স্পীড স্কেইট নিয়ে এলে ভাল হত, লেকের ওপর জমে থাকা শক্ত, সমতল, মসৃণ বরফের দিকে তাকিয়ে আফসোস করল সে।
আনলেও কোন লাভ হত না, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল মুসা। আমার সঙ্গে পারতে না। সাধারণ স্কেইট দিয়েই তোমাকে হারানোর ক্ষমতা রাখি আমি।
তাই নাকি? এসো, সাধারণ স্কেইট দিয়েই হয়ে যাক প্রতিযোগিতাটা।
চলো।
কিশোর এ সব চ্যালেঞ্জের মধ্যে গেল না। তবে গাড়ি থেকে অন্য দুজনের সঙ্গে সে-ও তার স্কেইট বের করে নিয়ে চলে এল লেকের কিনাবে। পরে নিল দ্রুত।
শার্লি বলল, তোমরা যাও। আমি বরং মাকে সাহায্য করিগে।
ঘুরে বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল সে।
কোনখান থেকে ছোটা শুরু করবে ভাবছে কিশোর, এমন সময় হই-চই কানে এল।
ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা।
লেকের একধারে জটলা করছে হকি খেলোয়াড় ছেলেগুলো। ওদের মুখোমুখি হয়েছে কয়েকজন বয়স্ক লোক। ঝগড়া করছে মনে হলো। তুমুল উত্তেজনা। কিশোর বলল, হকি খেলছে, না চোর ধরা পড়েছে?
চোর না, চোর না! পেছন থেকে বলে উঠল শার্লি। হট্টগোল শুনে কি হয়েছে দেখার জন্যে ফিরে এসেছে। তোমার মাথায় এখন চোর ছাড়া আর কিছু নেই মনে হচ্ছে। বারার মত!
আঙ্কেলকেও নিশ্চয় দোষ দেয়া যায় না, রবিন বলল। বছর বছর চুরি হচ্ছে। পুলিশ কিছু করতে পারছে না। এখানে বাস করছেন। চিন্তায় তো তিনি পড়বেনই।
তা ঠিক, একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
হট্টগোলের দিকে নজর দিল রবিন। ওর চেয়ে দুএক বছরের বড় একটা ছেলেকে দেখিয়ে আনমনেই বলে উঠল, পিটার হিগিনস না?
আচমকা হকি স্টিক তুলে একজন লোককে বাড়ি মারতে গেল ছেলেটা।
ওকে একদম সইতে পারে না বাবা, শার্লি বলল। এক্কেবারে বুনো। মারামারির জন্যে গত বছর আমাদের স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ওকে।
তবে ফুটবলটা ভালই খেলে, দেখে গিয়েছিলাম, রবিন বলল।
তা খেলে, শালি বলল। তবে ফাউল করে করে অনেকের পায়েই ব্যান্ডেজও আঁধায়। বাবার ধারণা, পিটার আর ওর বন্ধুরাই চুরিগুলো করে।
হঠাৎ লোকের কিনার থেকে ভেসে এল গলা ফাটানো চিৎকার। অ্যাই, ভাগো এখান থেকে। কোন কথা নেই। খেলা বন্ধ, ব্যস!
পিটার আর তার সঙ্গী খেলোয়াড়দের দিকে এগিয়ে আসছে আরও কিছু লোক। শার্লি জানাল, ওরা শিকারী। কারও কারও হাতে আইস বার। ইস্পাতের ভারী ওই শিকগুলোর সাহায্যে বরফ খোঁচায় ওরা। বরফে মাছ ধরার গর্তগুলোকে বুজে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। তবে এ মুহূর্তে পিটানোর জন্যেই নিয়ে এসেছে ওই শিক।
চলো! বলে শার্লি বাধা দেবার আগেই বরফের ওপর দিকে স্কেইটিং করে ছুটল কিশোর।
পিছু নিল তার দুই সহকারী।
ওরা যখন কাছে গেল, তুমুল ঝগড়া বেধে গেছে ততক্ষণে দুটো দলের মধ্যে। বুড়ো একজন লোকের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল পিটার, আমরা খেলবই। আপনি বাধা দেয়ার কে?
বুড়োর সব চুল সাদা। গায়ে লম্বা ঝুলওয়ালা উলের কোই।
নিচু স্বরে কিশোর আর মুসাকে জানাল রবিন, বুড়োর নাম জিথার জ্যাকসন। শীতকালে সব সময় ওই একটা কোটই পরে থাকে। টাকা-পয়সার যে অভাব তা নয়। অতিরিক্ত কিপটে। জ্যাকসনস বেইট শপ দোকানটার মালিক। এই লেকের পাড়ের একমাত্র দোকান। লোকে বলে ওর জন্মের পর থেকেই চালাচ্ছে।
দেখো না খেলে আবার। সমান তেজে চেঁচিয়ে পিটারের কথার জবাব দিল। বুড়ো।
খেলবই তো। কি করবেন?
বললাম না, খেলেই দেখো।
কঠোর আরেকটা জবাব দিতে যাচ্ছিল পিটার, চোখ পড়ল রবিনের দিকে। আরি রবিন; কখন এলে?
এই তো। একটু আগে, রবিন বলল। কি হয়েছে?
আরে দেখো না, হকি খেলতে বাধা দিচ্ছে। সব মাছ নাকি তাড়িয়ে দিচ্ছি আমবা। নিজেরা পারে না ধরতে, দোষটা এখন আমাদের।
হাই, রবিন। হাত নেড়ে ডাকতে দেখা গেল আরেকজন লোককে। মাথায় লাল ক্যাগ। লম্বা, ছিপছিপে দেহ। এত উঁচু, সবার মাথার ওপর দিয়ে তাকে দেখা যাচ্ছে।
হাই! হাত নাড়ল রবিন।
আজই এলে নাকি?
হুঁ।
হাতের ইশারা করল লোকটা, এসো এদিকে।
মেরিন ডগলাস, লোকটার দিকে এগোনোর সময় দুই বন্ধুকে জানাল রবিন। খুব ভাল মোটর মেকানিক।
রবিন কাছে যেতে দস্তানা পরা একটা হাত বাড়িয়ে দিল ডগলাস। কেমন আছ? কিশোর আর মুসার দিকে চোখ পড়তে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, বন্ধু। নাকি?
হ্যাঁ, হাতটা ধরে ঝাঁকি দিতে দিতে জবাব দিল রবিন। ও কিশোর।…আর ও মুসা।…ডগলাস, এত গোলমাল কিসের?
শুনলেই তো পিটারের কাছে। কিশোরের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে জবাব দিল ডগলাস। তারপর হাত বাড়াল মুসার দিকে। ওরা তো বলে হকি খেলে। কিন্তু যে কাণ্ডটা করে তাকে হকি খেলা বলে না। বরফের ওপর দিয়ে পাগলের মত ছুটতে থাকে। কোনদিন যে বিপদ ঘটাবে। হয় কারও শ্যান্টি ভাঙবে, নয়তো নিজেরাই বরফ ভেঙে পানিতে পড়ে মরবে।
শয়তানি করলে তো বিপদ হবেই। আপনারা বাধা দিচ্ছেন কেন? মাছ তাড়ায় বলে?
উঁহু। ভয়টা অন্যখানে। কোন রকম দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশ কাউকেই নামতে দেবে না আর লেকে। মাছ ধরাটা তখন যাবে আমাদের।
সবচেয়ে বেশি রাগ তো দেখা যাচ্ছে জ্যাকসনের, কিশোর বলল। ফেটে পড়ছে। এ রকম করছে কেন?
করবে না? এখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ হলে ওর ব্যবসা খতম। দোকানে লাল বাতি জ্বলবে যে। খেপাটা স্বাভাবিক।
পিটার কি করছে দেখার জন্যে ফিরে তাকাল রবিন। জ্যাকসনের সঙ্গে ঝগড়া। তুঙ্গে উঠেছে পিটারের। হকি স্টিক তুলে বাড়ি মারতে গেল বুড়োকে। তাকে সাহায্য করতে এগোল তার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডট আর কারনি। বয়েসে পিটারের দুতিন বছরের বড় হবে ওরা। গণ্ডগোল করার কারণে ওদেরকেও স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
জ্যাকসনও কম যায় না। কোমরের টুল বেল্টে ঝোলানো ছোট একটা কুড়াল একটানে খুলে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আমাকে বাড়ি মারবি? আয় তো দেখি কত্তবড় সাহস!
বাধা দিতে এগিয়ে গেল রবিন।
তার কথা কানেও তুলল না কেউ।
চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল কারনি। বেঁকিয়ে উঠল, নিজের চরকায় তেল দাওগে।
তবে খুনখারাবির মধ্যে কাউকেই যেতে দিল না জনতা।
পিটারদেরকে হকি স্টিক নামাতে বাধ্য করল। জ্যাকসনও আবার কুড়ালটা কোমরে ঝোলাল। কিন্তু কথার লড়াই বন্ধ করল না দুপক্ষের কেউই।
তীব্র স্বরে জ্যাকসন বলল পিটারকে, ভেবেছিস, চুরি-ডাকাতি করে এত সহজেই পার পেয়ে যাবি? আমি সব জানি!
কি জানো তুমি, বুড়ো ভাম কোথাকার! ঝাজিয়ে উঠল পিটার। মিথ্যে কথা বললে দেব এক বাড়িতে মাথাটাকে দুফাঁক করে।
আবার হকি স্টিক তুলল সে।
আবার কুড়ালে হাত দিতে গেল জ্যাকসন।
তবে দ্বিতীয়বারের মত আবার সামলে নিল নিজেদের।
পুলিশের সাইরেন কানে এল।
.
০২.
তিনটে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল লেকের কিনারে।
হুড়মুড় করে কয়েকজন পুলিশ অফিসার নেমে দৌড় দিল বরফের ওপর দিয়ে।
বরফে আটকানোর কাঁটা বসানো নেই ওদের বুটের নিচে। কাজেই প্রথম লোকটাই লেকে নেমে আছাড় খেল।
হেসে ফেলল মুসা।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে লোকটা আবার উঠে দাঁড়াতেই রবিন বলল, ডোবার কগনান।
কাছে এসে জনতার দিকে তাকিয়ে হাপাতে হাপাতে বলল সে, একটা ফোন পেলাম, এখানে নাকি গণ্ডগোল হচ্ছে?
নিজের দলের কাছে ফিরে গেছে পিটার। চিৎকার করে বলল, জ্যাকসন নিজেকে এই লেকের মালিক দাবি করছে।
অ্যাই, পাজি ছোঁড়া, মিথ্যে কথা বলবি না! চেঁচিয়ে উঠল জ্যাকসনও। চোরের মার বড় গলা।
শুরু হলো জনতার গুঞ্জন। সবাই একসঙ্গে কথা শুরু করল। কিছু বোঝার উপায় নেই।
চিৎকার করে উঠল ডোবার, আহ, একজন একজন করে বলুন না!
স্কেইট করে তার পাশে এসে দাঁড়াল রবিন।
অবাক হয়ে গেল ডোবার। আরি, তুমি এলে কখন? এরা কারা?
এই তো, খানিক আগে। কিশোর আর মুসার পরিচয় দিল রবিন।
কিশোরের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল অফিসার। আমি ডোবার কগনান। তোমাদের কথা অনেক শুনেছি রবিনের মুখে।
আপনার কথাও শুনেছি আমরা, হাত মেলাতে মেলাতে বলল কিশোর।
এদিকে এসো। কথা বলি। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে ভিড়ের কাছ থেকে সরে গেল ডোবার। তার সঙ্গের অফিসাররা গিয়ে জনতাকে পাহারা দিতে লাগল, যাতে ঝগড়া করতে না পারে।
গত তিন সপ্তাহে এই নিয়ে বারো বার আসতে হয়েছে আমাকে এখানে, ডোবার জানাল। এখন আমি চীফের অপেক্ষা করছি। এগারো বারের বার তিনি। আমাকে বলেছিলেন আবার এ রকম কিছু ঘটলে তিনি নিজে আসবেন তদন্ত করতে।
জ্যাকসনের দোকানের দিক থেকে লেকে নেমে আসতে দেখা গেল দুজন। যুবককে। জনতার ভিড়ের দিকে এগোল ওরা। বয়েস তেইশ-চব্বিশ। একজনের মাথায় সোনালি চুল, ছয় ফুট উঁচু। আরেকজনের কালো চুল, উচ্চতায় প্রথমজনের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি খাটো।
ওই যে, জ্যাকসনের দুই নাতি, ডোবার বলল। বড়টার নাম জ্যাকি। আর ছোটটা রকি। বাবা-মা থাকে ম্যারিল্যান্ডে। ওরাও ওখানেই থাকে। বছরে কয়েকবার করে আসে দাদার দোকানদারিতে সাহায্য করতে। ওদেরকে খারাপ লাগে না আমার।
পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইউরি রিকম্যানও এসে পৌঁছলেন। বরফের ওপর দিয়ে পা পিছলাতে পিছলাতে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল ডোবার। ক্যাপ্টেনও নেমে এগিয়ে আসতে লাগলেন। মাঝপথে মিলিত হলেন দুজনে। কিছু কথা হলো। তারপর একসঙ্গে জনতার দিকে এগোলেন।
অনেকেই আছেন দেখছি, ক্যাপ্টেন বললেন। ভালই হলো। আমি আপনাদের ঝগড়া থামাতে আসিনি। সেটা পার্ক কমিশনারের দায়িত্ব। আমি এসেছি জনসনদের বাড়ির ডাকাতির তদন্ত করতে। কেউ কোন তথ্য দিতে পারবেন আমাকে?
জনতার দিকে তাকিয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। কে কি বলে শুনতে আগ্রহী।
পারব, জবাব দিল জ্যাকসন।
অকারণে এর মধ্যে জড়াচ্ছ কেন, দাদা? চুপ করানোর চেষ্টা করল জ্যাকি।
কি চুপ করতে দিলেন না ক্যাপ্টেন। কি জানেন, বলুন?
বাড়িটার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেছি পিটার হিগিনসকে, জ্যাকসন জানাল।.
ফেটে পড়ল পিটার। দেখো বুড়ো, সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে। পস্তাতে হবে এর জন্যে। হকিস্টিক তুলে শাসাতে লাগল সে। মুখ টকটকে লাল।
দেখলেন, দেখলেন, আপনার সামনেই কেমন করছে? জ্যাকসন বলল। ওকে ছেড়ে রাখলে মানুষ খুন করবে একটু আগে আমাকেই খুন করতে চেয়েছিল…
তুমি থামো, পিটার, ক্যাপ্টেন বললেন। আমি দেখছি।
পিটারের কাছে সরে গেল রবিন।
আপনি জানেন না, ক্যাপ্টেন, চেঁচিয়ে উঠল পিটার, বুড়োটা অনেক দিন থেকেই আমাকে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করছে। বাবাকে তো শেষই করে দিয়েছে। ওর মিথ্যে কথা আপনি বিশ্বাস করবেন না।
শুনি তো আগে, জ্যাকসনের দিকে ঘুরলেন ক্যাপ্টেন। পিটারকে ওখানে কখন ঘুরঘুর করতে দেখেছেন?
কাল সন্ধ্যায় দেখেছি। আজ সকালে দেখেছি। সারা সপ্তাহ ধরেই দেখছি, জ্যাকসন জানাল। দিনে, রাতে, সব সময়। শুধু ওই বাড়িটাই নয়, আরও অনেক বাড়ির সামনে ওকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি।
তাহলে আমার সঙ্গে থানায় চলুন একবার, প্লীজ। লিখিত বক্তব্য পেলে ভাল হয়।
যাচ্ছি। এগুলো জেলে ভরতে না পারলে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না কেউ।
ঘুম তোমার এমনিতেই হয় না, বুড়ো ভাম! রাগে গজগজ করতে লাগল পিটার। শুধু শুধু চোরের দোষ দিও না।
চোরতাকে এখনও অ্যারেস্ট করছেন না কেন? ঝাঁজিয়ে উঠল জ্যাকসন।
অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন ক্যাপ্টেন। এ ভাবে কাউকে অ্যারেস্ট করা যায় না, মিস্তার জ্যাকসন। থানায় চলুন। আপনার বক্তব্য শুনি। পিটারকেও আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। ওর কি বলার আছে সেটাও শুনি। সে যে চোর, প্রমান পেলে তখন অ্যারেস্ট করা যাবে।
এতগুলো লোক যে ওকে বাড়িগুলোর সামনে ঘুরঘুর করতে দেখল, সেটা প্রমাণ না?
না। আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন, মিস্টার জ্যাকসন। চোর হলে ও বাঁচতে পারবে না। আর মিথ্যে বললে আপনাকেও ভুগতে হবে। সহকারী অফিসারদের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। ওকে নিয়ে চলো।
পিটারের দিকে এগিয়ে গেল কয়েকজন অফিসার।
আচমকা এক কাণ্ড করল পিটার। রবিনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, রবিন, এখনও তুমি চুপ করে আছ! কিছু করছ না! আমি যে চোর নই, তুমি তো জানো?
অ্যারেস্ট তো করেনি তোমাকে, প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল রবিন। শুধু কয়েকটা প্রশ্ন করতে নিয়ে যাচ্ছে থানায়।
পিটারের হাত ধরে টান দিল একজন অফিসার।
রবিন, মরিয়া হয়ে বলল পিটার, রবিন, তোমাকে কি আমি সাহায্য করিনি? কিডন্যাপ হওয়া সেই ছেলেটাকে খুঁজতে গিয়ে তুমি যখন বিপদে পড়লে…
মনে আছে আমার, পিটার, শান্তকঠে বলল রবিন। চুপচাপ চলে যাও এখন ওদের সঙ্গে কোন গোলমাল বাধিয়ো না। সত্যি যদি অপরাধী না হও, তোমাকে বের করে আনার ব্যবস্থা আমরা করব।
পিটারকে গাড়ির দিকে নিয়ে চলল পুলিশ।
জ্যাকসন, আপনিও আসুন, ক্যাপ্টেন বললেন দোকান বন্ধ করে আসতে সময় লাগবে?
না। যাচ্ছি, চলুন। দোকান আমার নাতিরাই সামলাতে পারবে।
ক্যাপ্টেনের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করল জ্যাকসন।
বুডোর দুই নাতির দিকে ঘুরল রবিন। হাত বাড়িয়ে দিল। আমি রবিন মিলফোর্ড। ডোবারের মুখে আপনাদের নাম জেনেছি। জ্যাকি আর রকি।
মুখটা গোমড়া করে রাখল জ্যাকি। রবিনের হাতটা আলতো করে ছুঁয়েই ছেড়ে দিল।
কিন্তু রকি তা করল না। রবিনের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল, আমি রকি জ্যাকসন। ও আমার বড় ভাই জাকি জ্যাকসন।
কিশোর আর মুসাকে দেখিয়ে রবিন বলল, এরা আম বন্ধু। কিশোর পাশা। ও মুসা আমান। আপনাদের মতই আমরাও বাইরের লোক। লস অ্যাঞ্জেলেসের রকি বীচ থেকে এসেছি।
অ, তাই নাকি?
কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করছ। ধমকে উঠল জ্যাকি। এসো জলদি!
ভাইয়ের আচরণে বিব্রত বোধ করল রফি। হাসিটা ধরে রাখল কোনমতে। কিছু মনে কোরো না। সবার সঙ্গেই এমন ব্যবহার করে ও। আমি যাই। দোকান সামলাতে হবে। পরে কথা বলব।
ভাইয়ের পিছু পিছু রওনা হয়ে গেল ও।
আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন কারণ নেই। যার যার পথে চলে যেতে লাগল সবাই। নেতাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। খেলাটেলা আর জমবে না বুঝতে পেরে পিটারের দুই দোস্ত ডট আর কারনিও আর দাঁড়াল না। আচমকা স্কেইটিং করে ছুটতে শুরু করল। তাকিয়ে আছে কিশোর। মুহূর্তে জ্যাকসনের নাতিদের কাছে পৌঁছে গেল ওরা। কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে রকিকে বরফের ওপর ফেলে দিল কারনি। ভান করল, যেন না দেখে করেছে। ডটের হকি স্টিকের মাথাটাও বেশ জোরেই লাগল জ্যাকির পিঠে।
কিশোরের কানে এল ডটের ব্যঙ্গভরা কন্ঠ, বরফের মধ্যে দেখে চলাফেরা কোরো।
হাসতে হাসতে চলে গেল পিটারের দুই দোস্ত।
ছেলে দুটোর আচরণ ভাল লাগল না তিন গোয়েন্দার।
এখানে আর করার কিছু নেই ওদেরও।
শার্লিদের বাড়িতে ফিরে চলল।
.
০৩.
দরজার কাছেই দেখা হয়ে গেল মরগান আঙ্কেলের সঙ্গে।
পুলিশকে আমিই ফোন করেছিলাম, জানালেন তিনি।
ভাল করেছেন, জবাব দিল কিশোর। নইলে খুনোখুনি হয়ে যেত।
আমিও বুঝতে পারছিলাম। যে ভাবে মারমুখো হয়ে উঠেছিল বুড়ো জ্যাকসন দূর থেকে দেখেও বেশ কেঝা যাচ্ছিলযাকগে। কেসটা হাতে নিয়েছ নাবি তোমরা?
তেমন করে হাতে এখনও নিইনি। তবে খেয়েদেয়ে জনসনের বাড়িটা একবার ঘুরে আসব। দেখি কোন সূত্র পাওয়া যায় কিনা। আন্টি, খিদে পেয়েছে। খাবার দিন।
খেতে বসে বার বার পার্টির কথা তুলে কিশোরকে নিরস্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন বেলী আন্টি। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারলেন না। মরগা আঙ্কেল আরও উসকে দিতে লাগলেন কিশোরের কৌতূহলটাকে। অতএব নাকেমুখে খাবারগুলো প্রায় খুঁজে দিয়ে দুই সহকারীকে নিয়ে উঠে পড়ল কিশোর। জনসনদের বাড়ি রওনা হলো।
জনসনদের বাড়িটা অনেক বড়। লেকের দিকে মুখ করা। কয়েকজন পুলিশ অফিসারকে দেখা গেল সূত্র খুঁজতে। ডোবার কগনানকেও পাওয়া গেল ওখানেই।
কিছু পেলেন? জানতে চাইল কিশোর।
নাহ, মাথা নাড়ল ডোবার। জ্যাকসনের কথার ওপরই কেবল ভরসা। তবে হিগিনসদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল নয় তার। মিথ্যেও বলে থাকতে পারে।
সম্পর্কটা খারাপ হলো কেন? কৌতূহলী হলো কিশোর।
এক সময় পিটারের বাবা মিস্টার হিগিনস আর জ্যাকসন একসাথে ব্যবসা করেছে। এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, সম্পর্কটা টেকেনি।
এর বেশি আর কিছু বলতে চাইল না ডোবার। কাজেই অন্য প্রসঙ্গে গেল কিশোর, কটা বাড়িতে চুরি হয়েছে?
গত তিন বছরে প্রায় দুই ডজন।
কি কি জিনিস নিয়েছে?
বেশির ভাগই সোনা-রূপার গহনা। ঘড়ি আর ওরকম সহজে বহনযোগ্য ছোটখাট দামী দামী জিনিস যা পেয়েছে সব নিয়েছে। কোন হদিস করা যায়নি ওগুলোর। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
বিক্রি না করে কোথাও লুকিয়ে ফেলেছে বলছেন?
হয় লুকিয়ে ফেলেছে, নয়তো অনেক দূরের কোন শহরে নিয়ে গিয়ে চোরাই বাজারে বিক্রি করেছে। রবিনের দিকে তাকাল ডোবার। আচ্ছা, পিটারকে তোমার সন্দেহ হয়?
উঁহু, মাথা নাড়ল রবিন। বদমেজাজী। তবে চোর বোধহয় নয়।
অভাবে স্বভাব নষ্ট অনেক সময় হয়ে যায়, ডোবার বলল। যাকগে, চোর নাহলেই ভাল।
বাড়িটার চারপাশে তিন গোয়েন্দাও খানিকক্ষণ খুঁজে দেখল। কিন্তু বরফে পুলিশের এত বেশি জুতোর ছাপ পড়েছে, চোরেরটা থেকে থাকলেও আলাদা করে চেনা এখন মুশকিল। কিছু পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে বাড়ির সীমানা থেকে বেরিয়ে চলে এল ওরা।
চলো, এখানে আর দেরি না করে শার্লিদের বাড়ি চলে যাই, রবিন বলল। পার্টিটায় যোগ দেয়া দরকার। নইলে শার্লি আর আন্টি, দুজনেই মনে কষ্ট পাবে। মরগান আঙ্কেলের কথা আলাদা। পার্টির চেয়ে চোর ধরার ব্যাপারটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন উনি।
রবিন, মুসা জিজ্ঞেস করল, সত্যিই কি তোমার মনে হয় পিটার নিরপরাধ? তার দোস্ত দুটোকে দেখে কিন্তু জ্যাকসনের ধারণাই সঠিক বলে মনে হচ্ছে আমার। পাজির পা ঝাড়া।
আর যে-ই করে থাকুক, পিটার যে নিজে চুরি করেনি এ ব্যাপারে আমি এখন মোটামুটি শিওর, জবাব দিল কিশোর।
কি করে শিওর হলে? রবিনের প্রশ্ন।
ডোবার কি বলল শোনানি? রহস্যময় এই চুরিগুলো হচ্ছে বছর তিনেক ধরে।
হ্যাঁ। তাতে কি?
তুমিই তো বলেছ গত বছর মিশিগানে চলে গিয়েছিল পিটার। তার মার কাছে এক বছর থেকে এসেছে। ও এখানে যখন ছিল না, তখনও তো চুরি হয়েছে।
হুঁ, এটা একটা শক্ত যুক্তি, মাথা দুলিয়ে বলল মুসা। তা ছাড়া নিজের এলাকায় থেকে এ ভাবে একের পর এক চুরি করার সাহস দেখাবে, এটাও অবিশ্বাস্য।
ঠিক, কিশোর বলল।
কিন্তু কথা হলো, প্রশ্ন তুলল রবিন, পিটার যদি চুরি না করে থাকে, তাহলে চোর কে?
সেটাই এখন খুঁজে বের করতে হবে আমাদের, জবাব দিল কিশোর।
শার্লিদের বাড়িতে ফিরে এল ওরা। বিশাল লিভিং রূমটায় বসে আছেন মরগান আঙ্কেল, বেলী আন্টি ও শালি। গরম চকোলেট খাচ্ছে সবাই।
কিশোরদের দেখেই জিজ্ঞেস করলেন বেলী আন্টি, আইসক্রীম খাবে?
গুঙিয়ে উঠল মুসা। ওটা তো আর গরম গরম দিতে পারবেন না।
হাসলেন বেলী আন্টি। দেখা যাক, গরম কি দেয়া যায়।
মরগান আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলেন, কিছু পেলে?
নাহ্, তেমন কিছু না, রবিন জানাল। কিশোর বলল, পুলিশ এখনও সূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আহ্, বিরক্ত হয়ে বললেন বেলী আন্টি, ছেলেগুলোকে একটু মুক্তি দাও না। ওরা এসেছে পার্টিতে আনন্দ করতে, আর তুমি ওদের লাগিয়ে দিলে গোয়েন্দাগিরিতে।
আমি জানি, পার্টির চেয়ে গোয়েন্দাগিরিতেই বেশি মজা পায় ওরা, মরগান শ্রাঙ্কেল জবাব দিলেন।
গরম চকোলেটের মগ, প্রচুর মাখন লাগানো কেক আর তিন-চার রকমের ফলের কুঁচি মেশানো আইসক্রীমের ট্রে এনে সোফার পাশের ছোট টেবিলে রাখলেন আটি। যার যারটা তুলে নিতে বললেন তিন গোয়েন্দাকে।
বেলী আন্টি নানা ভাবে চেষ্টা করলেও চুরির আলোচনা বাদে অন্য আলোচনা। জমল না। কোন সময় যে নিজেও তিনি যোগ দিয়ে ফেলে, বলতে পারবেন না।
আচ্ছা, আন্টি, চুরি হওয়ার রাতগুলোতে অস্বাভাবিক কোন কিছু কি চোখে। পড়েছে আপনার? কিংবা কোন শব্দ? প্রশ্ন করল কিশোর।
যতবার ডাকাতি হয়েছে, পৃলিশ এসে একই এশ করেছে আমাদের। আমরাও একই জবাব দিয়েছি না, কিছুই দেখিনি, কিছু শুনিওনি, বেলী আন্টি বললেন।
তবে এটা ঠিক, মরগান আঙ্কেল বললেন, আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে আমাদের অজান্তে কোন গাড়ির যাবার উপায় নেই। শুনতে আমরা পাবই!
কেন? জানতে চাইল মুসা।
কারণ আমাদের বাড়িটা রাস্তার একেবারে ধার ঘেঁষে তৈরি। পাইনভিউ থেকে বেরোনোর সময়ও আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হবে, ঢোকার সময়ও। গাড়ির রাস্তা ওই একটাই, জবাব দিলেন মরগান আঙ্কেল।
তা ছাড়া, বেলী আন্টি বললেন, শীতকালে যানবাহন চলাচলও এখানে নেই বললেই চলে। কালেভদ্রে প্রতিবেশীদের একআধটা গাড়ি যায়-আসে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে। সব শুনতে পাই আমরা। জায়গাটা এত নীরব বলেই শান্তির জন্যে এখানে বাস করতে এসেছি।
এক মুহূর্তের নীরবতার পর আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলেন, চুরিগুলো কি বন্ধ করতে পারবে তোমরা? কি মনে হয়?
এক মুহূর্ত চিন্তা করে জবাব দিল কিশোর, আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা তো আমরা অবশ্যই করব। দেখি কি করা যায়।
.
০৪.
থানাতেই পাওয়া গেল ক্যাপ্টেন ইউরি রিকম্যানকে। পাইনভিউ লেকের চুরির কেসটা নিয়ে ব্যস্ত। পিটার আর জ্যাকসনের দুটো সই করা লিখিত বক্তব্য রয়েছে তাঁর সামনে, টেবিলে। সেগুলো পড়ছেন।
সাড়া পেয়ে মুখ তুললেন। অ। তোমরা। বসো…কি খবর? ডোবারের তো তোমাদের সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা…
পিটার চুরি করেনি, কিশোর বলল।
ভুরু উঁচু করলেন ক্যাপ্টেন! কি করে বুঝলে?
গত বছর সে ছিলই না পাইনভিউতে। মিশিগানে মায়ের কাছে চলে গিয়েছিল। কিন্তু চুরি তো থেমে থাকেনি। তারমানে সে জড়িত নয়।
মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন! জড়িত নয় বলতে পারো না। কারণ তার দোস্তরা তো পাইনভিউতেই ছিল। সে নিজে সামনে ছিল না, এটা বলা যেতে পারে। কিন্তু জড়িত নয়, কিংবা জানে না বলাটা ভুল হবে। একটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে তিনজনেরই মুখের দিকে তাকালেন তিনি। তা ছাড়া, সে নিজেই স্বীকার করেছে চুরি করে ঢুকেছে একটা বাড়িতে।
হতবাক হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।
ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, মানে?
একটু আগে সে নিজের মুখে বলেছে, বন্ধুদের নিয়ে ডেভিড শফারের বাড়িতে ঢুকেছিল। দুই হপ্তা আগে চুরি হয়েছে বাড়িটাতে।
ও চুরি করেছে, এ কথা বলেছে?
না, তা বলেনি। বলেছে, সাহস দেখানোর জন্যে বাজি ধরে খালি বাড়িতে ঢুকেছিল। তবে বিনা অনুমতিতে যে ঢুকেছিল, এ কথা স্বীকার করেছে।
কথা বলা যাবে ওর সঙ্গে?
এসো। উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন!
তাকে অনুসরণ করে বাড়ির পেছন দিকের একটা হাজতের সামনে এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
দুহাতে মাথা চেপে ধরে একটা বাংকের ওপর বসে রয়েছে পিটার।
পিটার, দেখো কারা এসেছে, ডাক দিলেন ক্যাপ্টেন।
মুখ তুলল পিটার।
কিশোরের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন, তোমরা কথা বলো। আমি আসছি।
শিকের ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করল পিটার, আমাকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছ?
দেখি কি করতে পারি… জবাব দিল কিশোর। ক্যাপ্টেনকে বললাম, এক বছর তুমি ছিলে না পাইনভিউতে। কাজেই ওসময়কার চুরি-ডাকাতিগুলোতে তোমার সরাসরি জড়িত থাকা সম্ভব নয়।
তারমানে আমি নিরপরাধ, এই তো বলছ?
নিরপরাধ কিনা সে-প্রমাণ যেমন এখনও মেলেনি, চোরের সঙ্গে যোগসাজশ আছে কিনা সে-ব্যাপারেও শিওর নই, জবাব দিল কিশোর।
মানে? এগিয়ে এসে শিক ধরে দাঁড়াল পিটার।
ক্যাপ্টেন বললেন, তুমি নাকি ডেভিড শফারের বাড়িতে ঢুকেছিলে।
ও তো স্রেফ মজা করার জন্যে। ঢুকে, ফ্রিজ থেকে কিছু খাবার বের করে নিয়ে বেরিয়ে চলে এসেছি। মনে হচ্ছিল, বেশ একটা মজা হলো।
মজা!
জানি, জানি। গাধামি করেছি, বুঝতে পারছি এখন।
বড় এক গোছা চাবি নিয়ে হাজির হলেন ক্যাপ্টেন। তালাটা খুলে দিতে দিতে পিটারকে বললেন, আপাতত তোমাকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিন গোয়েন্দার দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল পিটার, অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে।
ধন্যবাদটা নিতে পারছি না আমরা, কিশোর বলল। তোমাকে ছাড়ানোর ব্যাপারে আমরা কিছুই করিনি।
গুঙিয়ে উঠল পিটার, তারমানে বাবা এসেছে।
উঁহু, জবাব দিলেন ক্যাপ্টেন। তাকে ফোন করে তোমার কথা জানালাম। ছাড়া তো দূরের কথা, সারা জীবন আটকে রাখতে বলে দিলেন।
দমে গেল পিটার। তাহলে ছেড়ে দিচ্ছেন কেন?
এইমাত্র খবর পেলাম, আরেকটা বাড়িতে চোর ঢুকেছিল, জবাব দিলেন ক্যাপ্টেন। তুমি এখানে আটকা রয়েছ। এই একটা চুরি অন্তত তুমি করোনি, এটা বোঝা গেছে।
তারমানে সত্যি আমাকে যেতে দিচ্ছেন?
বললাম তো, আপাতত। পরে তোমাকে আবার দরকার হবে আমাদের। জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। এখন বাড়ি যাও। দূরে কোনখানে যাবে না। খোঁজ করলে যেন পাই। রবিনের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। তোমরা যাবে সঙ্গে?
মাথা ঝকাল রবিন, যাব।
পিটারকে নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এল ওরা। মুসা বসল ড্রাইভিং সীটে। রবিন তার পাশে। পিটারকে নিয়ে কিশোর বসল পেছনে।
পাইনভিউতে ফিরে চলল আবার ওরা।
রাত যতই বাড়ছে, আবহাওয়া আরও ঠাণ্ডা হচ্ছে। রাস্তা খারাপ নয়, কিন্তু বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বরফের কারণে। গাড়ি চালাতে অতিরিক্ত সাবধান থাকতে হচ্ছে মুসাকে। একটু এদিক ওদিক হলেই গিয়ে পড়বে রাস্তার পাশের খাদে।
শহর থেকে বেরিয়ে এসে পাইনভিউর রাস্তায় পড়ল গাড়ি। পিটারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, তারপর? এই চুরির পেছনের আসল ঘটনাটা কি বলো তো?
আমি কি করে জানব? রুক্ষ স্বরে জবাব দিল পিটার।
দেখো, পিটার, ক্যাপ্টেন কিন্তু সহজে তোমাকে ছাড়বেন না। তোমার আর তোমার দুই দোস্তের ওপর দোষটা চাপানোর চেষ্টা করবেন তিনি। তোমাকে আমরা সাহায্য করতে চাইছি। আর কিছু না করো, নিজেকে বাঁচাতে অন্তত আমাদেরকে সহযোগিতা করো।
দোষ কি করে চাপাবে? গত চুরিটার সময় আমি হাজতে আটকা ছিলাম, ক্যাপ্টেন নিজের মুখে বলেছে।
এমনও তো হতে পারে তোমার দোস্তরা গিয়ে কাজটা সেরে এসেছে, তুমি যে নির্দোষ সেটা বোঝানোর জন্যে। তা ছাড়া শফারের বাড়িতে চুরি করে ঢোকার কথাটা বোকার মত স্বীকার করে ফেলে নিজের নামটাকে সন্দেহের তালিকায় লিখিয়ে দিয়ে এসেছ।
কিন্তু আমি চুরি করিনি। এ সব চুরি-ডাকাতিতে যুক্তও নই। আমার তো ধারণা, সব শয়তানির মূলে ওই বুড়ো জ্যাকসন।
সামনের প্যাসেঞ্জার সীট থেকে ঘুরে তাকাল রবিন। জনসনদের বাড়ির কাছে তোমাকেই সন্দেহজনক ভাবে ঘুরঘুর করতে দেখা গেছে। জ্যাকসনকে নয়। এর কি জবাব দেবে?
সন্দেহজনক ভাবে নয়, তীব্র প্রতিবাদ জানাল পিটার। দেখতে গিয়েছিলাম। বড় বড় বাড়িগুলো দেখতে আমার ভাল লাগে। দেখি আর ভাবি, আমিও একদিন ওরকম একটা বাড়িতে বাস করব।
ও কি বলতে চায় বুঝতে পারল রবিন। লেকের ধারের বাড়িগুলো এমনিতেই বড় বড়। আর জনসনদের বাড়িটা তো রীতিমত একটা প্রাসাদ। তাকিয়ে থাকার মতই।
ভাল সুন্দর কোন বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকাটা নিশ্চয় অপরাধ নয়? পিটার বলল, হোক না সেটা অন্যের বাড়ি।
চুরি করে বিনা অনুমতিতে কারও বাড়িতে ঢুকলে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে, জবাব দিল কিশোর। এটা আবার ভুলে যেয়ো না।
ভুলিনি। দেখো, একটা কথা বিশ্বাস করতে পারো, আমি বা আমার বন্ধুরা চোর নই। এই চুরির সঙ্গে জড়িত থাকা তো দূরের কথা।
তোমার কথা বাদ দিলাম। তোমার দোস্তরা যে জড়িত নয়, কি ভাবে প্রমাণ করবে? তোমাকে দেখতে কি থানায় গিয়েছিল ওরা? চুরিটা যখন হয়, তখন কি তোমার সামনে ছিল?
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিল পিটার, কাজে ব্যস্ত থাকলে যাবে কি করে?
এ সব বলে পুলিশকে বোঝাতে পারবে না।
আবার এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে পিটার বলল, দেখো, না বলে শফারদের বাড়িতে ঢুকে অপরাধ করেছি, ঠিক। তবে জিনিসপত্র চুরি করিনি। এই চুরিগুলো বুড়ো জ্যাকসনের কাজ। আমার বাবার ওপর প্রতিশোধ নিতে আমার ওপর দোষটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
তোমার বাবার সঙ্গে জ্যাকসনের শত্রুতাটা কি নিয়ে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ব্যবসায় পার্টনার ছিল। বেইট শপ আর ওটার চারপাশের জমির মালিক ছিল দুজনে, সমান সমান ভাগ, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল পিটারের কণ্ঠ। কিন্তু মার সঙ্গে বাবার ডিভোর্সের সময় বাবা বেশ বড় রকমের একটা সমস্যায় পড়ে গেল। টাকার সমস্যাও ছিল।
তারপর?
পেছন ফিরে তাকিয়ে আছে রবিন। শুনছে। গাড়ি চালানোর জন্যে পেছনে নজর দিতে পারছে না মুসা। পিচ্ছিল রাস্তায় গাড়ি চালাতে খুব সাবধান থাকতে হচ্ছে তাকে। তবু যতটা সম্ভব শোনার চেষ্টা করছে।
জ্যাকসনের কাছে টাকা ধার চাইল বাবা। কিন্তু বুড়ো একটা পয়সাও দিল না। বাবা তখন খানিকটা জমি বেচতে চাইল। বুড়ো তাতেও রাজি হলো না। টাকার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল বাবা। নামমাত্র মূল্যে পুরোটাই ঠকিয়ে নিল তখন জ্যাকসন। ওর কাছে বিক্রি করে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না বাবার। তারপর থেকেই বুড়োকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে বাবা। শত্রুতাটা বুড়োই জন্ম দিয়েছে। বাবা নয়।
এদিকেই যেন কোথায় তোমাদের বাড়িটা? শহরের একপ্রান্তে পৌঁছে জিজ্ঞেস করল রবিন।
হ্যাঁ, ডানে। ওই যে, গাছটার নিচে। হাত তুলে সবচেয়ে বড় গাছটা দেখাল পিটার।
গাছের কাছে গিয়ে গাড়ির গতি ধীর করল মুসা। পথ এত বেশি পিচ্ছিল, বাড়ির দিকে বাঁক নেয়ার সময় প্রায় শামুকের গতিতে গাড়ি চালাতে হলো তাকে।
রাস্তার ধারে কিছু ডালপালা পড়ে আছে। ঝড়ে ভেঙে পড়েছে হয়তো। তার ওপাশে একটা জীর্ণ মলিন পুরানো বাড়ির সামনে তার চেয়েও পুরানো একটা গাড়ি। বাড়ির একটা জানালার কাঁচ ভেঙে গিয়েছিল। সেখানটায় হার্ডবোর্ড লাগিয়ে ফোকর বন্ধ করা হয়েছে। বড়ই করুণ দশা।
কেউ কিছু বলার আগেই বলে উঠল পিটার, হ্যাঁ, এটাকেই বাড়ি বলে এখন আমার বাবা। কিন্তু বুড়ো জ্যাকসন যদি বাবার কথাটা মেনে নিত, তাহলে এত দরিদ্র হালে বাস করা লাগত না আমাদের। লেকের পাড়ের কোন একটা বাড়িতেই থাকতে পারতাম।
বাড়ির সামনে এনে গাড়ি রাখল মুসা। পুরানো ভলভো গাড়িটার পেছন থেকে আচমকা বেরিয়ে এলেন ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট পরা একজন মানুষ। হাতের শটগানটা তুলে কাঁধে ঠেকালেন। নিশানা করলেন মুসার দিকে।
.
০৫.
বাবা, কি করছ? আমরা চেঁচিয়ে উঠল পিটার।
তোমার বাবা? কিশোর জানতে চাইল।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল পিটার। মাথা গরম। পাহারা দিচ্ছিল।
এই, কি করেছিলি তুই? চিৎকার করে জানতে চাইলেন মিস্টার হিগিনস। বন্দুক নামালেন।
কিছুই করিনি।
তাহলে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল কেন?
দরজা খুলে নেমে গেল পিটার। বুড়ো জ্যাকসনের শয়তানি।
আস্তে করে দরজা খুলে নেমে এল কিশোর। রবিন আর মুসাও নামল।
জ্যাকসন! কি করেছে? জানতে চাইলেন মিস্টার হিগিনস।
ঘরে চলো না। ঘরে গিয়ে বলি, পিটার বলল। এখানে ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি কথা।
জ্যাকসনের কথা আর কি বলব, বিড়বিড় করলেন মিস্টার হিগিনস। ওর মত ঠগবাজ আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।
আপনাদের ব্যবসার কথা সব বলেছে আমাকে পিটার, কিশোর জানাল।
পিটার আর তার বাবার পেছন পেছন ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল কিশোর। এতই জীর্ণ, দুএক জায়গায় তক্তাও নেই। সে-সব জায়গা টপকে পেরোল। রবিন আর মুসাও একই ভাবে উঠে গেল।
তোমরা ভাবছ আমিই সম্পর্কটা নষ্টের জন্যে দায়ী? শটগানটা নামিয়ে রেখে নড়বড়ে একা লাউঞ্জ চেয়ারে বসে পড়লেন মিস্টার হিগিনস। ভুলেও তা ভেবো না।
পুরানো লম্বা একটা কাউচ দেখিয়ে কিশোরদের বসতে বলল পিটার। কিন্তু কাউচের মাঝখানে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে একটা মন্তু কুকুর। এটাকে সরানোর চেষ্টা করল পিটার। নড়লও না কুকুরটা। এমনকি চোখের পাতা একবার মেলেই সেই যে বন্ধ করল, খুললও না আর।
দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। ঘরের চারপাশে দ্রুত একবার চোখ বোলাল। চুপচাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল মুসা আর রবিন।
মিস্টার হিগিনস, লেকের পাড়ের বাড়িগুলোতে চুরি হওয়ার কথা তো নিশ্চয় শুনেছেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বুড়ো জ্যাকসনের কাজ, সাফ জবাব দিয়ে দিলেন মিস্টার হিগিনস।
কিন্তু তিনি চুরি করবেন কেন? টাকার তো তার অভাব নেই।
ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে কি বললেন মিস্টার হিগিনস, বোঝা গেল না। ছেলের দিকে তাকালেন। তোকে থানায় নিয়েছিল কেন?
জনসনের বাড়ির কাছে আমাকে ঘুরতে দেখেছিল। সত্যি বলছি বাবা, বিশ্বাস করো, আমি চুরি করিনি।
আমার জীবনটা তো ধ্বংসই করে ছেড়েছে, এবার তোর পেছনে লেগেছে। ওই শয়তানটাকে আমি শেষ করে ছাড়ব আজ। থাবা মেরে বন্দুকটা তুলে নিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার হিগিনস। আজ আমারই একদিন কি ওর…।
তাড়াতাড়ি তার সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর। মিস্টার হিগিনস, প্লীজ। পুলিশ সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। যা করার ওরাই করবে। অকারণে বিপদে পড়তে যাবেন না।
কিন্তু তোমরা কে? এখানে কি করছ? ধমকে উঠলেন মিস্টার হিগিনস।
বাবা, ওরা আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে, পিটার বলল।
আমাদের ধারণা, জবাব দিল কিশোর, চুরিগুলো পিটার করছে না। সেটাই প্রমাণ করতে চাইছি আমরা।
তোমরা এতে নাক না গলালেই ভাল করবে, মিস্টার হিগিনস বললেন। এটা জ্যাকসন আর আমার সমস্যা।
আপনাদের সমস্যা নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু পিটার যে চুরিগুলোতে জড়িত নয়, এটা আমাদের প্রমাণ করতেই হবে। নইলে যে কোন সময় আবার ওকে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ।
কিছুটা শান্ত হলেন মিস্টার হিগিনস। বেশ। করো প্রমাণ। তবে বুড়োটা যদি আমার ছেলের পেছনে আবার লাগে, ওকে আমি খুন না করে ছাড়ব না।
আর লাগতে পারবে না। আমরা লাগতে দেব না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
বসে পড়লেন আবার হিগিনস। বন্দুকটা নামিয়ে রাখলেন।
আমরা এখন যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে আবার আসব।
রবিন আর মুসাকে নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর।
এগিয়ে দিতে এল পিটার। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। আমার জন্যে অনেক কষ্ট করলে।
ও কিছু না, কিশোর বলল। সত্যি যদি ডাকাতগুলোর সঙ্গে তোমার কোন সম্পর্ক না থাকে, বুড়ো জ্যাকসন তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। চলি। আবার দেখা হবে।
গাড়িতে উঠে রবিন জিজ্ঞেস করল, কি মনে হয় তোমার?
কিশোর প্রশ্ন করল, কোন ব্যাপারে?
চুরি। মিস্টার হিগিনসের ধারণা জ্যাকসনই চোর।
আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
আমিও না। চুরি করার কোন কারণ নেই তার। টাকার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া চুরি করে করে ঘাবড়ে দিয়ে এখানকার বাসিন্দাদের তাড়ালে আখেরে তারই লোকসান হবে। দোকানের আয় কমে যাবে। বন্ধই করে দিতে হবে হয়তো একদিন।
এঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা। গীয়ার দিতে দিতে বলল, কিন্তু, বুড়োর মারমুখো আচরণ দেখেছ? কাস্টোমারের সঙ্গে এই ব্যবহার করলে দ্বিতীয়বার আর তার দোকান মাড়াবে না কেউ। আমার তো ধারণা, নাতি দুটো ওকে না সামলালে এতদিনে মানুষের মার খেয়ে ভূত হয়ে যেতে হত বুড়োকে।
হুঁ, আনমনে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। নিচের ঠোঁট চেপে ধরে জোরে এক টান দিয়ে ছেড়ে দিল।
রবিন বলল, দুটো নয়, একটা। বড় নাতিটা তো বুড়োর মতই বদমেজাজী। দাদা-নাতি তিনজনের মধ্যে একমাত্র শান্ত মগজ কেবল ছোটটার। কিশোর, তুমি কিছু বলছ না?
অ্যাঁ?…হ্যাঁ। কাল সকালে দাদা-নাতি তিনজনের সঙ্গেই দেখা করতে যাব। মুসা, বাড়ি চলো এখন।
বাড়ি ফিরে আন্ট মারগারেটের কোন মেসেজ আছে কিনা দেখার জন্যে দোতলায় উঠে এল রবিন। আনসারিং মেশিনের প্লে বাটন টিপতেই শোনা গেল পুরুষকণ্ঠ: ভাবলাম, তোমাদের জানানো দরকার। জিথার জ্যাকসনের বাড়িতে রহস্যময় ভাবে আগুন লেগে পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সকাল বেলা চলে এসো। আমিও থাকব।-ডোবার কগনান।
.
০৬.
পরদিন রোববার।
সকাল সকালই জ্যাকসনের বাড়িতে পৌঁছে গেল তিন গোয়েন্দা। দেখল, ওদের আগেই পৌঁছে গেছে ডোবার। জ্যাকসন আর তার দুই নাতি রকি-জ্যাকির সঙ্গে কথা বলছে।
মূল বাড়ি, যেটাতে রয়েছে জ্যাকসনের বেইট শপ আর বসবাসের ঘর, সেটা থেকে ডজনখানেক গজ দূরে একটা জিনিসপত্র রাখার ছাউনি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পোড়া কয়লার টুকরো ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। আগুনের তাপে চারপাশের বরফ গলে গেছে। বরফ গলা পানিতে মাটি ভিজে কাদা হয়ে গিয়েছিল। সেই কাদা জমে এখন কাদার বরফ।
ভ্যান থেকে নেমে গেল কিশোর। নাকে লাগল পোড়া প্লাস্টিকের ঝাঁজাল পন্ধ।
মুসা আর রবিনও নেমে এগিয়ে গেল তার পেছনে।
এই যে, তিন গোয়েন্দা, ডোবার বলল। জ্যাকি জ্যাকসন আর রকি জ্যাকসনের সঙ্গে নিশ্চয় আগেই পরিচয় হয়েছে তোমাদের?
গতকালই, জবাব দিল কিশোর। হাত মেলানো চলল। গতকালকের মত আজ আর শীতল ব্যবহার করব না জ্যাকি। ব্যাপারটা লক্ষ করল কিশোর।
কি হয়েছিল? জিজ্ঞেস করল সে।
আগুন, ডোবার জবাব দেয়ার আগেই বলে উঠল জ্যাকি।
আমার কাছে কিন্তু দুর্ঘটনার মত লাগছে না, ডোবার বলল। ওই দেখো, হাত তুলে কিশোরকে পোড়া একটা পেট্রল রাখার ক্যান দেখাল সে। ছাউনির বেড়ায় পেট্রল ঢেলে তারপর আগুন দিয়েছে।
ওরকম ক্যান আমরা বিক্রি করি না, জ্যাকি বলল।
কেউ কিছু দেখেছে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
দাদার সঙ্গে পেছনের ঘরে বসে কথা বলছিলাম, জ্যাকি জানাল। এ সময় দেখি আগুন।
নিভানোর চেষ্টা করেছি, রকি বলল! হোস পাইপে বরফ জমে গিয়েছিল। পানি বের করতে করতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল ঘরটা।
রাগত দৃষ্টিতে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাল জ্যাকি।
কি ছিল ছাউনিতে? কিশোরের প্রশ্ন।
বেশির ভাগই গরমকালে লেকে ব্যবহারের জিনিসপত্র, জবাব দিল জ্যাকি। ভেলা, বালতি, চাকার টিউব-এ ধরনের জিনিস।
কয়েকজন মাছ শিকারী গিয়ে দোকানে ঢুকল এ সময়।
এক মিনিট, বলে গোয়েন্দাদের রেখে জিনিসপত্র বিক্রি করতে চলে গেল দুই ভাই। কিশোর লক্ষ করল, বড় ভাইকে ভীষণ ভয় পায় রকি।
এই দুজনের সম্পর্কে কতটা জানেন? ডোবারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
গতকাল যা যা বললাম। তার বেশি না।
বুড়ো জ্যাকসন এখন কোথায়?
মাছ ধরছে।
সত্যি! এত ঘটনা ঘটে গেল। ঘর, জিনিসপত্র পুড়ে নষ্ট হলো। তার কিছুই এসে গেল না?
দুই সহকারীকে নিয়ে পোড়া ধ্বংসস্তূপের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। একটা শিক পড়ে থাকতে দেখে সেটা দিয়ে পোড়া ছাই আর কয়লা ঘটতে শুরু করল। সূত্রের আশায়।
শিকটাকে তো পোড়া মনে হচ্ছে না, ডোবারের দিকে তাকাল কিলোর। কেউ ঘাটাঘাটি করে গেছে নাকি?
আমাদের ফরেনসিক বিভাগের লোকজন আর দমকল বাহিনীর কর্মীরা, ডোবার জানাল।
বুড়ো জ্যাকসন আর নাতিরা ঘাঁটেনি?
হয়তো ঘেঁটেছে। তবে জুতোর ছাপটাপ তো কিছু দেখলাম না পোড়া ছাইয়ের মাঝে। এমন পোড়া পুড়েছে, হয়তো কোন জিনিসই আর অবশিষ্ট নেই বুঝতে পেরে অকারণ কষ্ট করতে যায়নি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, অফিসার ডোবার, কিশোর বলল। খবরটা আমাদেরকে জানানোর জন্যে।
সাবধান থেকো, ডোবার বলল। চোরগুলোকে মোটেও সুবিধের মনে হচ্ছে না আমার। আগুন লাগিয়ে যারা বাড়ি পুড়িয়ে দিতে পারে, ওরা সহজ লোক নয়। আরও খারাপ কিছুও করতে পারে। জমাট লেকটার দিকে তাকাল সে। এত শান্ত। দেখে মনেই হয় না এখানে এ ধরনের কোন কিছু ঘটতে পারে!
ডোবার চলে গেল।
কিশোরের দিকে তাকাল রুবিন। এখন, কি করব?
বুড়ো জ্যাকসনের সঙ্গে কথা বলব।
খাড়া পাড় বেয়ে লেকের দিকে নামতে শুরু করল তিন গোয়েন্দা। আগে আগে চলেছে কিশোর। পানির চিহ্নও নেই। লেকের যেদিকেই তাকানো যায়, জমাট বরফ। কিনারের কাছটাতেও প্রায় ফুটখানেক পুরু। যত বরফ, আইস ফিশারম্যানদের ততই সুবিধে।
প্রচুর পরিশ্রম আর খুব যত্ন করে বানানো হয়েছে মাছ ধরার শ্যান্টিগুলো। খুপরির মত ঘরগুলোর কোন কোনটার মাথায় টেলিভিশনের অ্যান্টেনাও দেখা যাচ্ছে। আয়েশী শিকারী।
আহ্! নাক কুঁচকাল মুসা। খাবারের গন্ধ! রান্না করছে কে?
করছে, যাদের খিদে পেয়েছে, হেসে বলল রবিন।
মাংস ভাজার গন্ধ। গরম খাবার, টেলিভিশন, ঘরের মধ্যে বসে মাছ ধরা-বড় মৌজে আছে শিকারীরা, কিশোর বলল।
দেখো দেখো, কি কাণ্ড করেছে, রবিন বলল। প্রতিটি শ্যান্টির দরজায় রঙ দিয়ে বড় বড় করে নাম-ঠিকানা লেখা রয়েছে। এ সব লিখেছে কেন?
যদি হারিয়ে যায় শ্যান্টিগুলো, রসিকতা করল মুসা, চিনে যাতে বাড়ি ফিরে আসতে পারে।
বেশির ভাগ শ্যান্টির তুলনায় জ্যাকসনেরটা হোট। পুরানোও অনেক। প্রাইউডের দেয়ালের চলটা উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। চালায় নতুন আলকাতরা পড়েনি বহুকাল। কড়া রোদে পুড়ে শুকিয়ে সাদা সাদা হয়ে গেছে আগের আলকাতরা।
মলিন দরজাটায় থাবা দিল কিশোর। মিস্টার জ্যাকসন, আমি কিশোর পাশা।
ঢুকে পড়ো। ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বলল জ্যাকসন। আস্তে কথা বলো। কথা শুনে ভয় পেলে মাছ চলে যাবে।
ঠেলা দিয়ে দরজা খুলল কিশোর। ছোট্ট কেবিনটা জিনিসপত্রে ঠাসা। বেশির ভাগই মাছ ধরার সরঞ্জাম। বালতি থেকে শুরু করে ন্যাকড়া, রীল, নাইলনের সুতো সবই আছে। আর আছে ব্যবহার করে ফেলে দেয়া প্রচুর কফির কাপ। এক কোণে রাখা একটা মোটরচালিত ড্রিল মেশিন। ওটার কর্ক ব্লেডটা এক ফুট চওড়া।
কুঁজো হয়ে চেয়ারে বসে আছে জ্যাকসন। চেয়ারটা এতই পুরানো, হাতলের গদিতে পোর স্পঞ্জ বেরিয়ে পড়েছে। বুড়োর হাতে খাটো একটা ছিপ। সামনে বরফের মধ্যে ফুটখানেক চওড়া গোল একটা গর্ত। সেটা দিয়েছিপের সুতো চলে গেছে নিচে।
আহহা, দরজাটা লাগিয়ে দাও না, রুক্ষ স্বরে বলল বুড়ো। গর্তের নিচের বরফ-শীতল পানিতে ভাসমান একটা লাল-সাদা ফাতনার দিকে চক্ষু স্থির।
ভেতরে জায়গা বলতে নেই। তার মধ্যেই কোনমতে গাদাগাদি করে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
আগুন লাগার ব্যাপারে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম আপনাকে, কিশোর বলল।
ওই শয়তান ছেলেটার কাজ, পিটার হিগিনস, প্রশ্ন করার আগেই জবাব দিয়ে দিল জ্যাকসন। প্রতিশোধ নিল আমার ওপর। চুরি করায় পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছি বলে।
কাল রাতে ওর সঙ্গে দেখা করেছি আমরা, কিশোর বলল। চুরিটুরিগুলো, বোধহয় ও করেনি।
অ, একরাতেই ওর পক্ষে?
আমাদের কোন পক্ষটক্ষ নেই, স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল কিশোর। আমরা শখের গোয়েন্দা। এই অপরাধের তদন্ত করছি।…এমন হতে পারে, চোরেরাই আপনার ঘরে আগুন দিয়েছে।…আগুনটা দেখলেন কখন?
সাড়ে দশটার দিকে। আমরা তাস খেলছিলাম। আমি, জ্যাকি আর রকি।
কার চোখে পড়ল প্রথমে?
জ্যাকির। বাথরূম থেকে পোড়া গন্ধ পেয়ে দেখতে গিয়েছিল। খানিক পরে বাইরে থেকে ওর আগুন আগুন চেঁচানো শুনে আমরাও গেলাম।
পোড়া গন্ধটা আপনারা পাননি?
প্রথমে পাইনি। পরে পেয়েছি।
আগুন আগুন বলে চেঁচানোর আগে না পরে?
ঠিক মনে করতে পারছি না।
কাউকে দেখেছেন? গাড়ি-টাড়ি বা কোন কিছু?
এতক্ষণে মুখ তুলে তাকাল জ্যাকসন। তোমার কি মনে হয়? আগুন লাগিয়ে আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে গেল। দেখতে পেলে ছেড়ে দিতাম?
ফাৎনার দিকে চোখ পড়তেই অস্ফুট চিৎকার দিয়ে উঠল বুড়ো। পানির নিচে চলে গেছে ফানা।
খেয়েছে! বলে উঠল মুসা। চোখ চকচক করছে ফাত্রাটার দিকে তাকিয়ে। বোধহয় হাতও নিশপিশ করছে ছিপটাকে ধরে টান মারার জন্যে।
কথা বোলো না! ফিসফিস করে বলল জ্যাকসূন। খানিকটা সুতো ছাড়ল সে। তারপর ছিপ ধরে টান মারল।
উহহু, গেল ছুটে!যেৎ-ঘোৎ করে উঠল বুড়ো। তোমাদের জন্যে।
তার অভিযোগের ধার দিয়েও গেল না কিশোর। আগের প্রসঙ্গে অটল রইল। পিটার বাদে অন্য কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?
না। ভাগ্যিস ভেতরে মূল্যবান কিছু ছিল না। সুতো গুটাতে শুরু করল জ্যাকসন।
দামী কোন জিনিসই নষ্ট হয়নি?
না। ছাউনির চালায় কাল একটা ফুটো দেখতে পায় জ্যাকি। চালা খুলে মেরামত দরকার ছিল। ছাউনির সমস্ত দামী জিনিস দোকানে সরিয়ে ফেলি আমরা।
ছাউনিটা বীমা করানো ছিল?
না।
চুপ হয়ে গেল কিশোর। আর কি জিজ্ঞেস করা যায় ভাবছে।
এই সুযোগে ড্রিল মেশিনটা দেখিয়ে মুসা জিজ্ঞেস করল, মিস্টার জ্যাকসন, ওই জিনিসটা দিয়ে কি করেন?
বরফ ফুটো করি। দুই ফুট পুরু বরফও অনায়াসে ফুটো করে ফেলা যায়।
আরেকটা কথা। শ্যান্টিগুলোর দরজায় নাম-ঠিকানা লেখা কেন?
বোকা নাকি? মানুষের বাড়ির গেটে নাম-ঠিকানা লিখে রাখা হয় কেন? অধৈর্য হয়ে উঠল জ্যাকসন। কোনটা কার বাড়ি চিনে রাখার জন্যে। শ্যান্টির ব্যাপারেও সেই একই কারণ। হাত নেড়ে বলল, এখন তোমরা যাবে? ওসব চুরিদারি আর আগুন লাগানোর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে ভাল লাগছে না আমার। তবে বরফের মধ্যে মাছ ধরা যদি শিখতে চাও, বসতে পারো।
হা হা, শিখব শিখব! মুসার কণ্ঠে প্রচণ্ড উত্তেজনা।
এখন না। এখন সময় নেই, নিতান্ত বেরসিকের মত বলে উঠল কিশোর। আমাদের অন্য কাজ আছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, মিস্টার জ্যাকসন।
শ্যান্টি থেকে বেরিয় এল ওরা। খানিকক্ষণ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করল লেকের ওপর।
রাগ করে মুসা বলল কিশোরকে, কাজ তো কিছু দেখছি না। শুধু শুধু আমার মাছ ধরাটা বন্ধ করলে।
রবিন বলল, এক কাজ করা যায়। মেরিন ডগলাসের সঙ্গে কথা বলতে পারি। চুরি-ডাকাতিগুলোর ব্যাপারে তার কি অভিমত, জানা যাক।
কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে ডগলাসকে?
শার্লিদের বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস করার কথা ভাবল কিশোর। কিন্তু সেটা আর করতে হলো না। বেশ কিছুটা দূরে বরফের ওপর নিঃসঙ্গ বসে থাকতে দেখা গেল একটা লোককে। মাথায় লাল ক্যাপ।
হাত তুলে রবিন বলল, ওই যে!
এগিয়ে গেল ওরা। ভুল করেনি রবিন। মেরিন ডগলাসই। বিলাসবহুল কেবিন নেই তার। বাইরে খোলা বরফের ওপর বসে মাছ ধরছে। স্নেডে করে বয়ে এনেছে তার মাছ ধরার সরঞ্জাম। একটা বালতি উল্টো করে রেখে সেটার ওপর বসেছে। জড়সড় হয়ে আছে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটায়।
সাড়া পেয়ে ফিরে তাকাল ডগলাস। আরে রবিন যে। কেমন আছ তোমরা?
ভাল, জবাব দিল রবিন। খাচ্ছে কেমন?
দূর, বিরক্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়ল ডগলাস। একেবারেই না। মাছেরও মনে হয় আজ শীত লাগছে। অকারণ কষ্ট করছি। অনেকক্ষণ থেকেই বাড়ি যাবার কথা ভাবছিলাম।
চলুন তাহলে। আজ আপনার বাড়ি দেখব।
চলো। কফিটা তোমাদের সঙ্গে বসেই খাব।
ছিপ, সুতো এ সব গুছাতে তাকে সাহায্য করল তিন গোয়েন্দা। পেছন পেছন গিয়ে উঠল তার সবুজ পিকআপ ট্রাকটায়। লেক থেকে মাইলখানেক দূরে ডগলাস কার স্যালভিজ ইয়ার্ড-এ পৌঁছতে সময় লাগল না। কাঁটাতারের বেড়া দেয়া ইয়ার্ড। পুরানো, ভাঙাচোরা বাতিল গাড়িতে ভর্তি।
গেট দিয়ে ঢুকতেই বাড়ির ভেতর থেকে ঘেউ ঘেউ করে উঠল একটা কুকুর।
গাড়ি থেকে নেমে ডগলাসের বাড়িতে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। হলঘরের পাশেই শিকলে বাধা কুকুরটাকে দেখতে পেল। মনিবকে দেখে কাছে আসার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল ওটা।
এগিয়ে গিয়ে কুকুরটার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিল ডগলাস। এই তো আমি এসে গেছি, পুটি। খুব একা একা লাগছিল? আজ আর বেরোব না, যা, কথা দিলাম।
কুকুরের নাম পুটি। আজব নাম, মনে হলো মুসার। কিছু বলল না।
চুরি আর জ্যাকসনের বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করল তিন গোয়েন্দা। নতুন কিছু জানাতে পারল না ডগলাস। কফি খাওয়া শেষ হলো। যাওয়ার জন্যে উঠল ওরা।
গেট পর্যন্ত ওদের এগিয়ে দিল ডগলাস আর পুটি।
আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখল ডগলাস, কোন প্রয়োজন হলেই যেন নির্দ্বিধায় চলে আসে গোয়েন্দারা।
.
০৭.
এখন কি করব? রবিনের প্রশ্ন। বহুত তো জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কিছুই তো এগোল না।
আমি এখনও ভাবছি, নিচের ঠোঁটে ঘনঘন দুবার চিমটি কাটল কিশোর, মিস্টার মরগানের কালকের কথাটা।
কোন্ কথা? ভুরু নাচাল মুসা।
ওই যে, কালকে বললেন, চুরি হওয়ার পর কোন গাড়িটাড়ির শব্দ তাঁর বাড়ির কাছ দিয়ে যেতে শোনেন না।
তাতে কি?
তাতে? গাড়ির শব্দ যদি না শুনে থাকেন তিনি, তাহলে ধরে নিতে হবে চুরির মাল নিয়ে চলে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না চোরের। কারণ, সে এখানকারই বাসিন্দা।
তে কি করতে চাও এখন?
পরীক্ষা করে শিওর হব, মরগান আঙ্কেলদের বাড়ি থেকে গাড়ির শব্দ সত্যিই কতখানি শোনা যায়।
নেই কাজ তো খই ভাজ। এরচেয়ে বুড়োর সঙ্গে বসে মাছ ধরলে কাজ হত। আইস ফিশিঙের এতবড় একটা সুযোগ পেয়েও আমি হাতছাড়া করতে রাজি না এবার, মুসা বলল।
অনেক সুযোগ পাবে। আগে কেসটার একটা কিনারা করে ফেলি, কিশোর বলল।,
আর যেতে অরাজি হলো না মুসা, চলো তাহলে।
মুসার পাশে বসে নির্দেশ দিতে লাগল কিশোর। ভ্যান চালাতে বললে পাশের রাস্তা ধরে মরগান আঙ্কেলদের বাড়ির দিকে। সরু রাস্তাটা ধরে এগোনোর সময় তীক্ষ্ণ নজর রাখল কিশোর।
সামনে চুলের কাঁটার মত একটা মোড়।
মোড় পেরোলেই মরগান আঙ্কেলের সীমানা।
খানিকক্ষণ রাস্তাটায় আসা-যাওয়া করল ওরা। বাড়ির সামনে দিয়ে।
মরগান আঙ্কেল ঠিকই বলেছেন, পেছনের সীট থেকে বলে উঠল রবিন। বাড়ির কাছ দিয়ে চুপি চুপি পালিয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই কারও।
তুষারপাতের সময় ইঞ্জিনের শব্দ ঢাকা পড়ে যেতে পারে, মুসা বলল।
গেটের ভেতর গাড়ি ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এল শালি। কাছে এসে বলল, অনেকক্ষণ আগেই তোমাদের আসার শব্দ পেয়েছি। বাড়ির পেছনে ঘোরাঘুরি করছিলে কেন?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, তুষারপাতের সময়ও কি বাড়ি থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পাও?
নিশ্চয়ই। কেন?
এবারও শার্লির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মুসার দিকে তাকাল কিশোর, পেলে তো তোমার কথার জবাব?
কিন্তু এর পরও সন্তুষ্ট হতে পারল না কিশোর। রবিনকে বাড়ির ভেতরে গিয়ে কান পেতে থাকতে বলে বাড়ির সামনে-পেছনে বার বার ঘোরাঘুরি করতে থাকল ভ্যানটা নিয়ে। ফিরে এসে রবিনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, যতবার বাড়ির কাছে দিয়ে গাড়ি গেছে, ততবার ইঞ্জিনের শব্দ শুনেছে রবিন। এমনকি দুই মাইল গতিতে আস্তে চালিয়েও ফাঁকি দিতে পারেনি রবিনকে। শেষে ভ্যানের শব্দ বেশি বলে শার্লিদের শব্দ কম করা সেডান গাড়িটা চালিয়ে দেখল। ওটার শব্দও স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল বাড়ির ভেতর থেকে।
মরগান আঙ্কেল বাজার থেকে ফিরলে তাকে সব জানাল কিশোর।
তাহলেই বোঝো, তিনি বললেন। পুলিশকে আমি কোনমতেই বিশ্বাস, করাতে পারিনি। তাদের ধারণা, ঘুমিয়ে ছিলাম বলে আমি শুনতে পাইনি।
স্বামীর পক্ষ নিয়ে বেলী আন্টি বললেন, রাতে ও প্রায় ঘুমায়ই না আজকাল। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। টিভি দেখে। বই পড়ে। যতগুলো চুরি হয়েছে, সব হয়েছে সন্ধ্যারাতের সামান্য পরে। অত তাড়াতাড়ি আমিই ঘুমাই না। শার্লির বাপের তো কথাই নেই।
হু, কিশোর বলল। আমরা বুঝতে পেরেছি। দুই সহকারীর দিকে তাকাল, চলল, বাইরেটা গিয়ে আরেকবার দেখে আসি।
এবারও ড্রাইভিং সীটে বসল মুসা। বাড়িঘরগুলোর কাছ থেকে বেশ খানিকটা সরে এসে লেকের পাশে একটা খোলা জায়গায় গাড়ি রাখল। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। বাড়ছে ঠাণ্ডা।
দেখছ, কত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে যায় এখানে? রবিন বলল।
তদন্তটা গরমকালে করতে পারলে ভাল হত, মুসা বলল।
গাড়ির বুট খুলে গরম কাপড়-চোপড় বের করতে শুরু করল কিশোর। ভারী জ্যাকেট পরল। পায়ে দিল কাটা বসান বুট। যাতে বরফের ওপর হাঁটার সময় পিছলে না পড়ে।
বনে ঢুকল ওরা। ছয় ফুট লম্বা ডাল কেটে নিয়ে ছড়ি বানাল। বরফে বুকে দেখে বোঝার জন্যে, পাতলা না ভারী।
কথাটা ঠিকই বলেছ তুমি, কিশোরকে বলল রবিন। চুরিটা যে-ই করুক, গাড়িতে করে আসে না। এখানেই বাস করে। কিংবা রাতের বেলা বাইরের কোন জায়গা থেকে এসে বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে ঢোকে। কিন্তু তাতে যে পরিমাণ ঝুঁকি আর কষ্ট হবে, কোন চোরই সেটা করতে রাজি হবে কিনা সন্দেহ আছে আমার।
তবে বাইরে থেকে এলে মুশকিল হয়ে যাবে। কাউকে সন্দেহ করতে পারব না, মুসা বলল। ধরব কি করে ওকে?
দুজনের কথায় বিশেষ কান নেই কিশোরের। বেইট শপটার দিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। মগজে গভীর ভাবনা চলেছে ওর। আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, জ্যাকসনের ব্যাপারে কি ধারণা তোমাদের?
মানে! চমকে গেল মুসা আর রবিন দুজনেই।
আগুন লাগার ঘটনাটা?
বড় বেশি ভাগ্যবান মনে হয়েছে ওদেরকে, জবাব দিল রবিন। আগুন লাগার আগে সমস্ত দামী দামী জিনিস সরিয়ে ফেলা। ঘর পুড়ে যাওয়ার পরেও জ্যাকসনের অতিরিক্ত নির্বিকার ভাব। কাকতালীয় মনে হয়।
ঠিক বলেছ, বাতাসে তর্জনী দিয়ে বাড়ি মারার ভঙ্গি করল কিশোর। নির্বিকার থাকার কারণটা বোঝা যায়। পুড়েছে তো কেবল মূল্যহীন ভাঙা একটা ছাউনি। পুড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, কাজটা পিটারের। পুলিশ বা আমাদের নজর অন্য দিকে সরানোর জন্যেও এ কাজ করে থাকতে পারে। এক ঢিলে দুই পাখি।…কিন্তু আমি ভাবছি মোটিভটা কি? কেন চুরি করবে বুড়ো জ্যাকসন? তার টাকার অভাব হয়েছে বলে তো মনে হয় না!
তারমানে বুড়োকেই চোর সন্দেহ করছ তুমি? রবিনের প্রশ্ন।
কিংবা তার দুই নাতি। ওদেরকেই বেশি সন্দেহ হচ্ছে আমার। কতগুলো পয়েন্ট দিচ্ছি, ভেবে দেখো। এক, ওরা বিদেশী-অর্থাৎ এখানে সব সময় থাকে না। মাঝে মাঝে আসে দাদাকে সাহায্য করতে। দুই, অনেক দূরের শহরে থাকে ওরা। ম্যারিল্যান্ডে। চোরাই মাল নিয়ে ম্যারিল্যান্ডে গিয়ে আশপাশে কোনখানে যদি মালগুলো বিক্রি করে দেয়, জানার কথা নয় এখানকার পুলিশের, যদি খোঁজ না নেয়। ডোবার কি বলেছিল, মনে আছে? তার সন্দেহ দূরের কোন শহরে গিয়ে মাল বিক্রি করে দিয়ে থাকতে পারে চোরেরা। তারমানে ম্যারিল্যান্ডে খোঁজ নেয়নি। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করে শিওর হতে হবে। যাই হোক, তিন, জ্যাকির সন্দেহজনক আচরণ। লেকে ঝগড়ার সময় আমাদের পাত্তাই দিতে চায়নি, কিন্তু পরদিন যখন আগুন লাগার তদন্ত করতে গেলাম, যেচে এসে খাতির করতে লাগল। এর মানে কি? মানে হলো, আমাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা, যে পিটারই প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে আগুনটা লাগিয়েছে। চার, আগুন লাগার পর ধোঁয়ার, গন্ধ। জ্যাকসন আর রকি কাছাকাছি থেকেও গন্ধ পেল না, আর বাথরূম থেকে গন্ধ পেয়ে বেরিয়ে গেল জ্যাকি। কিছুক্ষণ পর আগুন আগুন বলে চিৎকার করল। এর একটাই ব্যাখ্যা, ধোয়ার গন্ধ মোটেও পায়নি সে। বেরিয়ে গিয়ে আগুন লাগিয়েছে ছাউনিতে। আগুন ভালমত লাগার পর চিৎকার করেছে। ধোয়ার গন্ধের কথা মিথ্যে বলেছে।
একটানা অনেক কথা বলে দম নিল কিশোর। তারপর বলল, এখন প্রশ্ন একটাই, চোরাই মাল কি ভাবে সরায় ওরা? পুলিশ যেহেতু ওদের সন্দেহ করে না, গাড়িতে করে নিয়ে সহজেই বেরিয়ে যেতে পারে পাইনভিউ লেক থেকে। গত কয়েক বছরের রেকর্ড থেকে জানা যায়, কেবল শীতকালে চুরিগুলো হয়। প্রতিটি বাড়িতে চুরি করার পর পরই ম্যারিল্যান্ডে যায় না ওরা যাওয়া সম্ভব নয়, অনেক দূরের পথ। গেলে যেতে-আসতে বেশ সময় লাগবে। যায় একবারই। সেটা শীতের পর। সমস্ত চোরাই মাল জমিয়ে একসাথে নিয়ে যায়।
আরেকটা প্রশ্ন আসে এখন। মালগুলো কি করে? জবাব, লুকিয়ে রাখে। আর রাখে পাইনভিউরই কোনখানে। পুলিশ ওদের সন্দেহ করে না। তাই দোকানের মধ্যে কিংবা তার আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে রাখাটাই ওদের জন্যে সুবিধে। যদিও লুকানোর সবচেয়ে ভাল জায়গা নয় দোকানটা। কোন কারণে যদি পুলিশ সন্দেহ করে বসে, গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে, বেরিয়ে যাবে মালগুলো।
ঝুঁকি নিতে না চাইলে দোকানে রাখবে না ওরা। অন্য কোথাও লুকাবে। তবে সেটা পরের কথা। আগে আমাদেরকে দোকানেই খোঁজ করতে হবে। সেখানে পাওয়া না গেলে ভেবে দেখব, আর কোথায় লুকাতে পারে।
কিন্তু ওরাই যে চুরি করছে, অত শিওর হচ্ছ কি করে? মুসার প্রশ্ন।
এখনও হইনি। তবে হয়ে যাব।
পিটার আর তার দুই দোস্তকে কি সন্দেহের তালিকা থেকে একেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছ?
না। তবে দোকানে খুঁজতে যেতে তো বাধা নেই। চোরাই মালগুলো ওখানে পেয়ে গেলে আমাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে।
তাহলে এখন কি করব?
দিই একটু পাহারা-টাহারা। বলা যায় না, আজকেও চুরি করতে বেরোতে পারে। তাহলে হাতেনাতেই ধরে ফেলতে পারব।
হাসল রবিন। বেশি আশা হয়ে যাচ্ছে না?
পাহারা দিতে দোষ নেই।
ঘণ্টাখানেক ধরে লেকের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়াল ওরা। লেকের পাড়ের বাড়িঘরগুলো দেখল। কোনটায় আলো আছে, কোনটাতে নেই। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে থাকতে ভাল না লাগায় গরম এলাকায় বেড়াতে চলে গেছে ওসব বাড়ির লোকরা। আর এই সুযোগে বিনা বাধায় ওসব বাড়িতে ঢুকে পড়ছে চোর।
রাত যত বাড়ছে, শীতও বাড়ছে। সেই সঙ্গে ধেয়ে আসছে কনকনে ঠাণ্ডা ঝোড়ো বাতাস। যত গরম পোশাকই গায়ে থাকুক, ঠেকাতে পারছে না। সুচের মত বিঁধছে। হাড় পর্যন্ত ঠাণ্ডা করে দিতে চাইছে।
আরও আধঘণ্টা ঘুরে বেড়িয়ে পুরো লেকটাকে এক চক্কর দিল ওরা। অস্বাভাবিক কোন কিছুই চোখে পড়ল না। ওদের দেখে নিশ্চয় সাবধান হয়ে গেছে চোর। চুরি করতে বেরোয়নি।
.
০৮.
পরদিন আবার এল ওরা পাইনভিউতে।
পিটারদের বাড়ির সামনের সরু রাস্তাটা পেরোনোর সময় মুসার বাহুতে হাত রাখল কিলোর, রাখো তো।
পিটারের বাবার সঙ্গে দেখা করবে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
থাকলে করব। পিটার কি করছে, সেটাও দেখেই যাই।
গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে এনে পিটারদের ড্রাইভওয়েতে ঢুকল মুসা।
গ্যারেজে পাওয়া গেল ওদের। পিটার আর তার দুই বন্ধু ডট ও কারনিকে। পিটারের পুরানো পিকআপ গাড়িটা চালু করছে তিনজনে মিলে।
জ্যাক দিয়ে পেছনটা উঁচু করে চাকা লাগাচ্ছে পিটার।
কাজকর্ম তো ভালই জানে মনে হচ্ছে, মুসা বলল।
হাসল রবিন। কি করে বুঝলে?
ভঙ্গি দেখে।
রতনে রতন চেনে, হাসিটা বাড়ল, রবিনের। একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি, মুসা। পিটারও তোমার মতই গাড়ি পাগলা।
কথা শুনে ফিরে তাকাল কারনি। দেখতে পেল তিন গোয়েন্দাকে। বলে উঠল, আরি আরি, কে এসেছে দেখো! জুনিয়ার শার্লক হোমসের দল। ন্যাকড়া দিয়ে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এল সে। হাতটা বাড়িয়ে দিল কিশোরের দিকে, কালি লাগবে কিন্তু।
লাগুক, হেসে হাতটা ধরল কিশোর।
তোমাদের কথা সব আমাদের বলেছে পিটার। যে ভাবে ওকে থানা থেকে বের করে এনেছ…
আমরা আনিনি, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। ক্যাপ্টেন ইচ্ছে করেই ছেড়ে দিয়েছেন। হয়তো ফাঁদ পেতেছেন, কে জানে! ছেড়ে না দিলে তো ফাঁদে ফেলতে পারবেন না।
কাছে এসে দাঁড়াল ডট আর পিটার।
ডট হাত মেলাল তিন গোয়েন্দার সঙ্গে।
পিটার জিজ্ঞেস করল, কাল আসোনি কেন? শুনলাম, কালও এসেছিলে পাইনভিউতে।
কালকে ব্যস্ত ছিলাম অতিরিক্ত।
চোর ধরা নিয়ে?
মাথা ঝাঁকাল কিলোর।
এগোল কিছু?
হ্যাঁ না দুটোই বলতে হয়। ডট আর কারনির দিকে তাকাল কিশোর। তোমাদের দুজনকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। কিছু মনে কোরো না। আশা করি সত্যি জবাব দেবে।
কুঁচকে গেল কারনির ভুরু। কি করে বুঝবে সত্যি বলছি?
বলোই না। বোঝাবুঝির ব্যাপারটা তো পরে।
বলে ফলো।
পিটারকে থানায় নিয়ে যাবার পর এ এলাকায় আরেকটা চুরি হয়েছে। তোমরা করোনি তো? পিটারকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে?
ভুরুটা আরও কুঁচকে গেল কারনির। তারপর হেসে ফেলল, না। আমরা, খারাপ ছেলে হতে পারি, কিন্তু অপরাধ করে আরেকজনকে নিরপরাধ প্রমাণ করার মত খারাপ নই, বোকাও নই। তা ছাড়া চুরি করার মত ঘৃণিত কাজ আমাদেরকে দিয়ে হবে না।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল জন। তারপর বলল, বিশ্বাস করছ আমাদের কথা?
নির্দ্বিধায় মাথা ঝাঁকাল কিশোর। করছি।
হাসি ফুটল কারনি আর ডটের মুখে।
ঘরে যাবে? পিটার বলল। একটা জিনিস দেখাব তোমাদের।
মাথা কাত করল কিশোর।
দুই বন্ধুর দিকে ফিরল পিটার। তোমরা চাকাটা লাগিয়ে ফেলো। আমি ওদের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।
তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল পিটার। নিজের বেডরূমে নিয়ে এল। দেয়ালে ছোট-বড় নানা রকম পোস্টার লাগানো। সবই গাড়ি কিংবা মোটর সাইকেলের ছবি।
এ জিনিসটা আশা করি সাহায্য করবে তোমাদের তদন্তে, বলে ড্রয়ার খুলল পিটার। পোস্টকার্ড সাইজের একটা কার্ড বের করল। তাতে নতুন মডেলের মস্ত
একটা ট্রাকের ছবি।
ছবিটা কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল সে, এটা আমার মিশিগানের বন্ধুদের। গত বছর ক্রিসমাসের সময় ওখানে ছিলাম আমি। উল্টে দেখাল কার্ডটা। দেখো, পেছনে নাম সই করা রয়েছে আমার বন্ধুদের। তারিখও দেয়া রয়েছে। বলতে পারো, কার্ড তো ডাকেও পাঠানো যায়। ওদের টেলিফোন নম্বর আছে আমার কাছে। ফোন করে কার্ডটার ব্যাপারে জানতে চাইতে পারো। সন্দেহ দূর হবে।
কার্ডটা হাতে নিল কিশোর। বলল, দেখিয়ে ভালই করলে। গোয়েন্দাগিরিতে কোন কিছুকেই সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না, যতক্ষণ না কেসটার সমাধান হয়ে যায়। আচ্ছা, আরেকটা কথা। রাতের বেলা কি করে কারনি আর ডট? ওরা যে চুরিগুলো হওয়ার সময় বাড়িতেই ছিল, প্রমাণ করার উপায় আছে?
হাসল পিটার। বড়ই খুঁতখুতে মন তোমাদের। তবে সেটাকে দোষ বলছি না। এ রকম না হলে বড় গোয়েন্দা হওয়া যায় না। মাথা ঝকাল সে, হ্যাঁ, প্রমাণ করার ভাল উপায় আছে। ওরা দুজনেই সন্ধ্যার পর একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করে। মাঝরাত পর্যন্ত। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো, এখানকার একটা চুরিও মাঝরাতের পরে হয়নি, সব আগে হয়েছে। আর রেস্টুরেন্টের নাম-ঠিকানা ফোন নম্বর লিখে দিচ্ছি, মালিকের নামও জেনে যাও, কারনি আর ডটের ব্যাপারে খোঁজ নিতে সুবিধে হবে।
তার আর দরকার হবে না, বলতে গেল মুসা, তোমাদের কথাতেই বিশ্বাস করলাম…
তাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর বলল পিটারকে, দাও, নাম-ঠিকানাগুলো লিখেই দাও। আর তোমার কার্ডটা আপাতত আমার কাছেই থাক।
০৯.
পরদিন আবার পাইনভিউ লেকে এল তিন গোয়েন্দা। জ্যাকসনের সঙ্গে কথা বলবে। সুযোগ পেলে বাড়ির ভেতর খুঁজে দেখবে। আর যদি আপনাআপনি সুযোগ না আসে, তাহলে সুযোগের ব্যবস্থা করবে।
দোকানের সামনের খোয়া বিছানো বিরাট আঙিনাটায় গাড়ি রাখল মুসা।
দোকানের দরজার পাশে রাখা জ্যাকসনের পিকআপ। নীল রঙের বডি।
উঁকি দিয়ে দেখে ফিসফিস করে বলল কিশোর, জ্যাকসনকে কেবল দেখা যাচ্ছে। কোন ভাবে বের করে দিতে পারলে, খোঁজাখুঁজিটা করা যেত। দেখি, কি করা যায়। আমি আর মুসা ওকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। রবিন, তুমি খোঁজ চালাবে।
ঘাড় কাত করল রবিন। ঠিক আছে।
দোকানে ঢুকল ওরা।
কাউন্টারের ওপাশে কতগুলো ফাত্না নিয়ে কি যেন করছে জ্যাকসন। বোধহয় বোঝার চেষ্টা করছে কোনটা ভালমত ভেসে থাকবে।
অ, তোমরা, মুখ তুলে দেখে বলল জ্যাকসন।
কেমন আছেন? আন্তরিকতার ভঙ্গি করল কিশোর।
তোমরা আসার আগে পর্যন্ত তো ভালই ছিলাম, মুখ গোমড়া করে জবাব দিল জ্যাকসন।
রেগে আছেন মনে হচ্ছে আমাদের ওপর? হাসল কিশোর। কারণটা কি?
হিগিনসদের বাড়িতে ঢুকতে দেখলাম তোমাদের, জ্যাকসন বলল।
তাতে অসুবিধেটা কি? প্রায় জিজ্ঞেস করে ফেলতে যাচ্ছিল মুসা। চোখের ইশারায় তাকে নিষেধ করল কিশোর।
জ্যাকসনের কথাটা যেন শুনতেই পায়নি কিশোর এ রকম ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাতে শুরু করল। অবাক হওয়ার ভান করে আনমনে বিড়বিড় করল, বাপরে, জিনিসপত্রে একেবারে বোঝাই।
মিথ্যে বলেনি সে। তাক বোঝাই জিনিসপত্র। বেশির ভাগই মাছ ধরার সরঞ্জাম। ছিপ, সুতো, বঁড়শি, ফাৎনা থেকে শুরু করে মাছ ধরার পর তোলার জন্যে বড় হাতলওয়ালা নেট, যা যা প্রয়োজন সবই আছে।
প্রচুর বিক্রি নাকি এ সব জিনিসের? জিজ্ঞেস করল কিশোর। হেঁটে গেল স্তূপ করে রাখা মাছ ধরার আধুনিক সরঞ্জামগুলোর মাঝখানের সরু গলিপথ ধরে। দেখল বোটে লাগানোর ছোট আউটবোর্ড এঞ্জিন আছে। আছে ইলেকট্রনিক ফিশ ফাইন্ডার, তাতে কম্পিউটারের ছোট স্ক্রীন লাগানো, লেকের তলায় কোথায় কি আছে দেখা যায় ওটার সাহায্যে। এক ধরনের স্যাটেলাইট সিসটেমও আছে। যন্ত্রটা আগেও দেখেছে কিশোর। কিন্তু কখনও ব্যবহার করেনি। গ্লোবাল পজিশনিং স্যাটেলাইট সিসটেম বলে এগুলোকে। হাতে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে মাছের অবস্থান নির্ণয় করা যায়। একটা মেটাল ডিটেক্টরও দেখা গেল একধারে রাখা।
ওসব পচা যন্ত্র নবিসদের জন্যে, যন্ত্রগুলোর প্রতি কিশোরের কৌতূহল লক্ষ করে জ্যাকসন বলল।
তাই? কিশোর বলল, আমি তো আরও ভাবলাম অতিমাত্রায় পেশাদারদের জন্যে ওসব যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে।
দূর। পেশাদাররা ফালতু যন্ত্রের সাহায্য নিতে যাবে কি করতে? মাছ খুঁজে বের করার জন্যে ওদের স্যাটেলাইট দরকার হয় না। এ ভাবে মাছ খুঁজে বের করে ধরার মধ্যে মজাও নেই।
তাহলে রেখেছেন কেন?
নবিসদের কাছে বিক্রি করি না আমি তা তো বলিনি। এ সব আলতু-ফালতু জিনিস ওরাই কেনে। হেসে উঠল জ্যাকসন।
মুসা আর রবিনও কিশোরের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগল। একটা বাক্স দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন, এটা কিসের জন্যে?
তোমরা তো দেখা যাচ্ছে একেবারেই আনাড়ি, জ্যাকসন বলল। কিছুই চেনো না।
সে-জন্যেই তো চিনতে চাইছি, মুখে হাসি টেনে এনে জবাব দিল কিশোর।
ওটা স্লেড বক্স। মাছ ধরার সমস্ত সরঞ্জাম ভরে নিয়ে বরফের ওপর দিয়ে টেনে নিতে পারবে। বয়ে নেয়ার ঝামেলা নেই। পিঠটা বাঁকা হওয়া থেকে বাঁচবে। মাছ ধরার সময় ওটাতে বসতেও পারবে। এক জিনিসে কত সুবিধে, তাই না?
কোত্থেকে আনেন এগুলো? জানতে চাইল মুসা।
নিজেই বানাই, গর্বের সঙ্গে জবাব দিল জ্যাকসন। এ মৌসুমেই গোটা আষ্টেক বিক্রি করে ফেলেছি।
সবগুলোই কি এক রকম? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বাজারে যেগুলো কিনতে পাওয়া যায়, আলাদা আলাদা ডিজাইন, সেগুলোর মত কিনা যদি জিজ্ঞেস করো, তাহলে বলব, না। আমারগুলো কাজের জিনিস, এটাই হলো আসল কথা।
অ, হঠাৎ করে যেন মনে পড়ে গেল কিশোরের, আপনার নাতিরা কোথায়?
মাছ ধরতে গেছে।
মনে মনে পুলকিত হলো কিশোর। ভাগ্যটা ভালই। এখন কোনমতে বুড়োটাকে সরিয়ে নিতে পারলেই পুরো বাড়ি খালি পাওয়া যাবে। ভাল মাছ কোনখানে পাওয়া যায়, জানে নিশ্চয় ওরা?।
শিখছে। প্রায়ই তো দেখি যন্ত্রপাতি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। আমিও বাধা দিই না। শিখতে চায় শিখুক। নবিস থাকার কোন মানে হয় না।
আমাদের কি ওরকম ভাল জায়গা চেনাতে পারবেন?
বাহ! তোমাদেরও দেখছি আইস ফিশিঙের শখ? অবাক মনে হলো জ্যাকসনকে।
হয়েছে আপনার কথা শুনে। আমরাও নবিস থাকতে চাই না, হাসল কিশোর। আইস ফিশিং দেখতে দেখতে ক্রমেই শখ বাড়ছে। কৌতূহলটাও ঠেকাতে পারছিনা। আর মুসা তো সেদিন আপনার সঙ্গে শ্যান্টিতে দেখা হওয়ার পর থেকে আমাকে ধরে মারে আর কি। আপনি ওকে মাছ ধরা শেখাতে চেয়েছিলেন, আমি টেনে বের করে নিয়ে গিয়েছিলাম বলে। ওর সঙ্গে সঙ্গে আমার শখটাও চাগিয়ে উঠেছে। ভাবলাম, একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? বঁড়শি-টড়শি কিনতে কিছু টাকা খরচ হবে আরকি।
খরচও তেমন বেশি কিছু না, আগ্রহী মনে হলো জ্যাকসনকে। দামী যন্ত্রপাতিগুলো ভাড়া নিতে পারো আমার কাছ থেকে। ভাল কমিশন দেব। কারণ তোমাদেরকে আমার পছন্দ হয়েছে।
টোপ গিলেছে। মনে মনে হাসল কিশোর। এখন খেলিয়ে ডাঙায় তুলতে পারলেই হয়। বলল, কিন্তু আমরা কি পারব এত তাড়াতাড়ি?
পারবে। একেবারে পানির মত সহজ। যদি ঠাণ্ডাটা কেবল মেনে নিতে পারো।
কোনখান থেকে শুরু করব?
জায়গা তো বেশ কয়েকটাই আছে। কাউন্টারের ওপাশ থেকে বেরোল না জ্যাকসন। তবে কিশোর বুঝল, আর সামান্য চাপ দিলেই বেরোবে।
জায়গাগুলো কি দেখাতে পারবেন? সময় হবে আপনার? অনুরোধের ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল সে।
বোঝা যাচ্ছে, না দেখানো পর্যন্ত শান্তিতে থাকতে দেবে না আমাকে, হাসল জ্যাকসন।
যাক, তাড়াতাড়িই বুঝতে পারলেন, হেসে জবাব দিল কিশোর।
চেয়ার থেকে উঠে এল জ্যাকসন।
মুসার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল কিশোর। জ্যাকসনের পেছনে পেছনে দরজার দিকে এগোল সে। রবিনকে বলল, তোমার আর আসার দরকার নেই। তুমি এখানেই থাকো বরং। দোকান পাহারা দাও।
হ্যাঁ। সে-ই ভাল, জ্যাকসন বলল। যে রকম চোরের উৎপাত এখানে। দেখা গেল, দিনের বেলাতেও চুরি শুরু করল। সুযোগ দেয়ার দরকার কি?
কিশোর আর মুসাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল জ্যাকসন।
ওরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজে নামল রবিন। একটা সেকেন্ডও দেরি করল না। দোকানের পেছনে একটা দরজা আছে। জ্যাকসনদের বেডরূমে ঢোকার। দৌড়ে এসে সেটা দিয়ে ঢুকে পড়ল সে।
বড় একটা ঘর। আসবাবপত্রে ঠাসা। এক পাশে রান্নাঘর আরেক পাশে বাথরূম। জানালার কাছে জ্যাকসনের বিছানা। দুটো চারপায়ার ওপর রাখা দুটো স্লীপিং ব্যাগ। জ্যাকি আর রকির জন্যে। ওদের ব্যাগ আর কাপড়-চোপড় মেঝেতে স্তূপ করা। ধোয়াধোয়ির আর ধার দিয়ে যায় না। অপরিচ্ছন্ন। নোংরা।
জ্যাকসনকে বাইরে কতক্ষণ আটকে রাখতে পারবে কিশোররা, বলা যাচ্ছে না। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। দুটো চারপায়ার মাঝখানে রাখা ছোট টেবিলটার দিকে নজর দিল সে। কিন্তু সন্দেহ করার মত কোন জিনিস দেখল না।
দ্রুত জ্যাকসনের ড্রেসারের ড্রয়ার পরীক্ষা করে দেখল। তারপর ঢুকল রান্নাঘরে। কেবিনেটগুলো খুলে দেখল। কোথাও চোরাই মাল আছে কিনা। নেই। এত সাধারণ জায়গায় থাকবে, আশাও করেনি। তবু দেখল। নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। মাল থাকলে হয় দেয়ালের ফাপা কোন জায়গায় থাকবে, নয়তো মেঝের তক্তার নিচে, মনে হলো তার।
পাঁচ মিনিট খোঁজাখুঁজি করে কোন কিছুই পাওয়া গেল না। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, এখনও লেকের বরফের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে কিশোররা। সময় নষ্ট না করে সরে এল রবিন।
সারা ঘরে নতুন করে আবার চোখ বোলাল সে। বোঝার চেষ্টা করল কেন জায়গায় থাকতে পারে জিনিসগুলো। স্লীপিং ব্যাগগুলো উঁচু করে দেখল। তারপর মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে চারপায়াগুলোর নিচে উঁকি দিল। চোখে পড়ল ছোট এক টুকরো ভাঁজ করা কাগজ। একটা চারপায়ার ক্যানভাসের নিচে গোঁজা।
কৌতূহল হলো।
বের করে এনে দেখল, তাতে দুই সারি নম্বর লেখা। তালিকার মত। তবে কোন জিনিসের নাম লেখা নেই নম্বরগুলোর বিপরীতে।
কি মানে এগুলোর, বুঝতে পারল না কিছু। কিন্তু মনে হতে লাগল, এর মধ্যে সূত্র আছে। নইলে এত যত্ন করে ওখানে লুকিয়ে রেখেছে কেন?
পকেট থেকে নোটবুক বের করে তার ভেতর থেকে কাগজ বের করল। পেন্সিল দিয়ে দ্রুত নকল করে নিল নম্বরগুলো। ঠিক যে ভাবে লেখা রয়েছে, সে ভাবে সাজিয়ে। আসল কাগজটা রেখে দিল আগের জায়গায়।
বাইরে কথা শোনা গেল। জোরে জোরে কথা বলছে কিশোর। বুঝল, সাবধান করে দিচ্ছে।
এ ঘরে আর কিছু পাওয়ার আশা নেই। আর থাকলেও সময় নেই। তাড়াতাড়ি দোকানে ফিরে এল রবিন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সামনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল জ্যাকসন। পেছনে কিশোর আর মুসা। বাপরে, বড় বাঁচা বেঁচেছে!-বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে রবিনের। আর সামান্য দেরি করলেই যেত ধরা পড়ে।
তারমানে তো মাছ ধরার সরঞ্জাম লাগবে এখন তোমাদের, জ্যাকসন জিজ্ঞেস করল। দেব?
এখন দেবেন? রবিনের দিকে তাকাল কিশোর।
মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিতে বোঝাল রবিন, কাজ হয়ে গেছে।
জ্যাকসনকে বলল কিশোর, থাক পরেই দেন। আজকে মেরিন ডগলাসের সঙ্গে এক জায়গায় যাওয়ার কথা আছে আমাদের।
শুধু শুধু আমাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে আমার সময় নষ্ট করলে কেন তাহলে? রেগে উঠল জ্যাকসন। কাউন্টারের ওপাশের চেয়ারে গিয়ে বসল।
কারণ আপনি ছাড়া মাছের সবচেয়ে ভাল জায়গাগুলো আর কেউ দেখাতে পারত না, তেলানোর ভঙ্গিতে জবাব দিল কিশোর।
তাতে অবশ্য কাজ হলো। নরম হলো জ্যাকসন। একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করল।
ও, ভাল কথা, কিশোর বলল, আপনার দুই নাতির সঙ্গে একটু দেখা করার দরকার ছিল। কোথায় ওরা?
কেন, লেকে দেখোনি ওদের? ম্যাগাজিনটা জানালার দিকে নাড়ল জাকসন।
না তো। ঠিক আছে। এখন যাচ্ছি। দেখি পাওয়া যায় নাকি, বলে আর দাঁড়াল না কিশোর। দরজার দিকে রওনা দিল। বেরিয়ে এল দুই সহকারীকে নিয়ে।
পাহাড়ের গা বেয়ে লেকের দিকে নামতে নামতে ফিরে তাকাল একবার কিশোর। দেখল, জানালা দিয়ে ওদের দিকে নজর রাখছে কিনা জ্যাকসন।
দেখা গেল না তাকে।
রবিনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কিছু পেলে?
নোটবুক থেকে কাগজটা বের করে দিল রবিন। এটা দেখো, কিছু বুঝতে পারো নাকি।
কতগুলো নম্বর, দেখতে দেখতে বলল কিশোর।
পাশ থেকে দেখার জন্যে কাত হয়ে এল মুসা।
নম্বরগুলোর মানে কি? জিজ্ঞেস করল রবিন।
বুঝতে পারছি না, জবাব দিল কিশোর। থাক, এটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। হাত তুলে দুজন মানুষকে দেখাল, জ্যাকি আর রকি না ওরা? মুসা, ডাক দাও তো।
অ্যাই, শুনছেন! চিৎকার করে ডাকল মুসা।
ফিরে তাকিয়ে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল দুই ভাই। কিন্তু কাছে এল না। কিশোররা ওদের দিকে এগোল। ওরা সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। লেক পার হয়ে ওপারে চলে যাবে মনে হচ্ছে।
তিন গোয়েন্দাও গতি বাড়িয়ে দিল। বুটের নিচে কাঁটা থাকায় পিছলে পড়া থেকে বাঁচল।
এত তাড়াহুড়া করছে কেন? রবিনের প্রশ্ন। দেখছে না ওদের কাছে যেতে চাইছি আমরা?
আগে আগে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ টের পেল রবিন, পায়ের নিচে পাতলা হয়ে এসেছে বরফ। চাপ পড়তেই চড়চড় করে উঠল।
এগিয়ো না! এগিয়ে না! দুই বন্ধুর উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল সে।
ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল যেন কিশোর। তার গায়ের ওপর এসে পড়ল মুসা। কি হয়েছে?
পাতলা বরফ, স্থির দাঁড়িয়ে থেকে জবাব দিল রবিন। তোমরা যেখানে আছে, ওখানেও পাতলা। নোড়া না।
পাতলা বরফে কি করতে হয় জানা আছে মুসার। এক মুহূর্ত দেরি না করে। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরের ভার বিশেষ এক জায়গায় না রেখে ছড়িয়ে দিল। মাত্র কয়েক ফুট সামনে দাঁড়ানো রবিনকে বলল, শুয়ে পড়ো। খুব ধীরে ধীরে।
মুসার দেখাদেখি কিশোরও একই ভঙ্গিতে বরফের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ রবিনের দিকে।
সামনের দিকে দুই হাত লম্বা করে দিল মুসা। রবিনকে ধরার জন্যে।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। বরফ ভেঙে জোরাল একটা ঝপাৎ শব্দ করে পানিতে পড়ে গেল রবিন।
ভাসল না আর।
.
১০.
রবিন! চিৎকার করে উঠল মুসা। ভাবল, ডাক শুনে বরফের গর্তটা দিয়ে মাথা তুলবে রবিন। কিন্তু ঝপাৎ শব্দটার পর আর কোন শব্দই কানে এল না তার।
হামাগুড়ি দিয়ে গর্তটার দিকে এগোল সে।
বরফ-শীতল পানিতে শুধু বরফের টুকরো ভেসে থাকতে দেখল।
গর্তটার মধ্যে রবিনকে ভেসে ওঠার জন্যে কয়েক সেকেন্ড সময় দিল। কিশোর। তারপর চেঁচানো শুরু করল, আপনারা জলদি আসুন! রবিন পড়ে গেছে! পড়ে গেছে!
মুহূর্তের মধ্যেই চতুর্দিক থেকে দৌড়ে আসতে শুরু করল মাছ শিকারীরা। কারও হাতে ইস্পাতের ভারী শিক, কারও হাতে বরফ ছিদ্র করার ড্রিল মেশিন। অবাক হয়ে দেখল কিশোর, উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে আসছে না। বরং ৬জনখানেক দূরের কয়েকটা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে এসো! কিশোরদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল একজন শিকারী। স্রোতের টানের মধ্যে পড়েছে সে। দ্রুত সরে যাচ্ছে।
স্রোত!
তারমানে ওপরটা জমাট বরফ হয়ে গেলেও নিচের পানিতে ঠিকই স্রোত প্রবাহমান। এতক্ষণে বোঝা গেল কেন পানিতে পড়ে মাথা তোলেনি রবিন। তুলতে পারেনি আসলে। বরফের নিচে চলে গেছে সে।
পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরে শিউরে উঠল কিশোর। দম নিতে পারছে না রবিন। সেই সঙ্গে মারাত্মক ঠাণ্ডা পানি।
ওসব ভাবনা-চিন্তার ধার দিয়ে গেল না মুসা। যা করার, সেটাই করল। পাতলা বরফের কাছ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত পিছিয়ে গেল সে। লাফ দিয়ে উঠে দৌড় দিল শিকারীদের দিকে।
মরিয়া হয়ে ততক্ষণে বরফকে আক্রমণ করেছে ওরা। আইস বার দিয়ে খোঁচাচ্ছে কেউ, কেউ কোপাচ্ছে কুড়াল দিয়ে, বাকিরা ব্যবহার করছে ড্রিল মেশিন।
বরফের নিচে রবিনের হলুদ রঙের পার্কাটা সরে যেতে দেখা গেল পলকের জন্যে।
এই যে এখানে। এখানে! চিৎকার করে উঠল মুসা।
কোন দিকে ভেসে যাচ্ছে রবিন, হাত তুলে দেখাল সে। রবিনের যাত্রাপথে যাতে গর্ত খুঁড়তে পারে শিকারীরা।
কিশোরও উঠে এসেছে। মুসার পাশে দাঁড়িয়ে বরফের নিচে তাকাল। মুখ। তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল রবিন যেদিকে সরছে সেদিকে কোন গর্ত আছে কিনা।
মুসা দৌড় দিল নয় ইঞ্চি গোল একটা সদ্য কাটা গর্তের দিকে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে হাত ঢুকিয়ে দিল গর্তের ভয়ানক ঠাণ্ডা পানিতে। ওখান দিয়ে ভেসে গেলেই খপ করে ধরবে রবিনকে। ওর চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল মাছ শিকারীরা। যে কোন সাহায্যের জন্যে তৈরি।
এই যে আসছে চিৎকার করে বলল একজন শিকারী।
হলুদ রঙের পার্কাটা ভেসে আসতে দেখল মুসাও। হাত আরও খানিকটা পানিতে ঢুকিয়ে দিল। ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে আসছে হাত। রবিনের কষ্টটা আঁচ করতে পারল। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা। বাঁচবে তো রবিন!
এল অবশেষে রবিন। সঙ্গে সঙ্গে তার আস্তিন খামচে ধরল মুসা। টান দিয়ে পানির ওপর তুলে নিয়ে এল রবিনকে। মাথাটা ভেসে উঠল। নাক উঁচু করে লম্বা দম নিতে লাগল রবিন।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। বেঁচে তো আছেই। হুঁশও হারায়নি এখনও রবিন।
তবে বুঝতে পারছে বিপদটা কেবল শুরু। আসল বিপদ আসছে।
উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিকারীরা। গর্তের চতুর্দিকের কিনারা কেটে বড় করতে শুরু করল। রবিনকে টেনে তুলে আনার জন্যে।
রবিন, তুমি ঠিক আছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।
ভীষণ ঠাণ্ডা… রবিন জানাল।
আর সামান্য একটু সহ্য করো, মুসা বলল। নিয়ে আসব বের করে।
কিন্তু সে বুঝতে পারছে একটুতে হবে না, গর্তের মুখ বড় করতে অনেক সময় লাগবে। ইতিমধ্যেই প্রায় মিনিট দুয়েক পানিতে কাটিয়ে ফেলেছে রবিন। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এর একটা কারণ, মারাত্মক ঠাণ্ডা পানি তার পেশী শক্ত করে ফেলছে।
গর্তের মুখ বড় করছে শিকারীরা। কিশোর আর মুসা রবিনকে ধরে রেখেছে। টান দিয়ে দেখল, তুলে আনার মত এখনও যথেষ্ট বড় হয়নি ফোকরটা।
ওকে তুলে এনে বরফের ওপর শোয়াতে আরও মিনিটখানেক লাগল।
উফ, ভয়ানক ঠাণ্ডা! কথা বলতে গিয়ে দাঁতে দাতে বাড়ি খাচ্ছে রবিনের। যে বিপদের ভয়টা পাচ্ছিল মুসা, সেটা এসে গেছে। পেশী ঠাণ্ডা হয়েছে। একে একে এখন শরীরের সমস্ত অঙ্গ ঠাণ্ডা হতে থাকবে। কাজ করতে পারবে না। রক্ত চলাচল ব্যহত হবে। দেহের তাপমাত্রা কমে যাবে। এবং সবশেষে দেহ অসাড় হয়ে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু।
বাঁচানোর একটাই উপায়। যত দ্রুত সম্ভব গা গরম করা।
ওর গা গরম করা দরকার, মুসা বলার আগেই বলে ফেলল কিশোর।
একজন বলল, জ্যাকসনের ওখানে নিয়ে যাই। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই ধরো তো। জলদি করো।
না না, মিস্টার মরগানের বাড়িতে নিয়ে চলুন। ওখানেই ভাল হবে। মিসেস মরগান নার্স, সেবাটা ঠিকমত হবে। কিশোর বলল। জ্যাকসনদের বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
গ্র্যাহাম গুন নামে একজন মাছ শিকারী গিয়ে তাড়াতাড়ি করে তার স্নোমোবাইলটা নিয়ে এল। পেছনে টেনে নিয়ে এল জ্যাকসনের হাতে বানানো একটা শ্লেড। রবিনের পাশে এনে রাখল। রবিনকে শ্লেডে তুলে দেয়া হলো। মুসা উঠে বসল তার মাথার কাছে। গরম রাখার জন্যে রবিনের মাথাটা দুই হাতে চেপে ধরে রাখল।
স্নোমোবাইল চালানো শুরু করল গ্রাহাম।
রবিন? জেগে আছ তত? রবিনের নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
বিড়বিড় করে কিছু বলল রবিন, স্নোমোবাইলের এঞ্জিনের গর্জনে বোঝা গেল না।
তার ঠোঁটের কাছে কান নিয়ে এল মুসা।
পায়ের তালুতে কোন সাড়া নেই, রবিন জানাল।
মুসা জানে, রবিনের জন্যে এ সময়টা এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। ঠাণ্ডা পানিতে কাটিয়ে এসে দেহ ঠাণ্ডা। তার ওপর গায়ের সমস্ত কাপড়-চোপড় ভেজা। বরফ-ঠাণ্ডা বাতাসের সংস্পর্শে এসে সেগুলো জমে যেতে আরম্ভ করেছে। তাতে দেহটা আরও দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
জেগে থাকো, রবিন, মুসা বলল। খবরদার, ঘুমিয়ে না। এসে গেছি আমরা।
.
স্নোমোবাইলের পেছন পেছন দৌড়ে চলেছে কিশোর। কি মনে হতে থেমে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল। লেকের কোনখানে দেখতে পেল না জ্যাকি কিংবা রকিকে। সন্দেহটা জোরালো হলো তার। ইচ্ছে করে ওদেরকে পাতলা বরফের দিকে টেনে নিয়ে গেছে, দুই ভাই। একটাই উদ্দেশ্য। পানিতে ফেলে খুন করা। লোকে ব্যাপারটাকে দেখবে অ্যাক্সিডেন্ট হিসেবে। শত্রুকে শেষ করে দেয়া হবে। নিজেদেরও কিছু হবে না।
চমৎকার পরিকল্পনা।
কিন্তু কেন করল?
কারণ, সঠিক পথেই এগোচ্ছে তিন গোয়েন্দা।
তার মানে, চুরিগুলোর পেছনে যে জ্যাকি আর রকির হাত আছে, তাতে কোনোই সন্দেহ থাকল না আর।
*
মুখ তুলে শার্লিদের বাড়ির দিকে তাকাল মুসা।
হাত নাড়তে দেখল শার্লিকে।
বাড়ির পেছনের দরজার কাছে এনে স্নোমোবাইল থামাল গ্র্যাহাম।
পানিতে পড়ে গিয়েছিল রবিন, শার্লিকে জানাল মুসা।
শ্লেড থেকে রবিনের প্রায় জমে যাওয়া দেহটা গ্রাহামের সহায়তায় তুলে নিল সে।
ওকে যে তোমরা তোলার চেষ্টা করেছ, দেখেছি আমরা, শার্লি জানাল। রেডি হয়ে আছে মা।
রবিনকে বয়ে নিয়ে আসা হলো।
জরুরী কণ্ঠে বেলী আন্টি বললেন, সোজা ওকে বাথরুমে নিয়ে যাও। কাপড়-চোপড় সব খুলে ফেলো। শার্লি, চুলায় গরম পানি হয়ে গেছে। যা, নিয়ে। আয়। আমি আসছি।
ধরাধরি করে রবিনকে নিয়ে চলল মুসা আর গ্রাহাম। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগল।
দোতলায় এসে সোজা বাথরূম।
গরম পানি দিয়ে টাবটা ভর্তি করে রেখেছেন বেলী আন্টি। মুসা আর গ্রাহাম মিলে দ্রুত হাতে রবিনের গায়ের সমস্ত জামা-কাপড় খুলে দিল। শুধু আন্ডারওয়্যার বাদে। বাথরূমে ঢুকলেন বেলী আন্টি।
লজ্জা-শরমের সময় নেই এখন, বললেন তিনি। প্রাণ বাঁচানোটাই আসল কথা। এগুলোও খোলো। তারপর গরম পানিতে শোয়াও।
যে ভাবে যা করতে বলা হলো, অক্ষরে অক্ষরে পালন করল মুসা আর গ্রাহাম।
ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া দেহ গরম পানিতে রাখতেই কেঁপে উঠল রবিন।
ওর দিকে চোখ রাখো, বেলী আন্টি বললেন। আমি গরম কিছু নিয়ে আসিগে অ্যামবুলেন্সকে ফোন করে দেয়া হয়েছে। চলে আসবে যে কোন সময়।
কিশোর ঢুকল এ সময়। শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাল রবিনের দিকে। ও ভাল হবে। তো?
পানিতে খুব বেশিক্ষণ ছিল নাকি? জানতে চাইলেন বেলী আন্টি।
হিসেব রাখতে পারিনি। মিনিট তিনেক হবে বড় জোর। পানি থেকে যখন তুললাম, তখন জ্ঞান ছিল ভালমতই।
তাহলে চিন্তা নেই। ভাল হয়ে যাবে।
ধীরে ধীরে জেগে উঠতে শুরু করল রবিন।
রঙ ফিরতে লাগল শরীরে।
ওকে খাওয়ানোর জন্যে এক মগ গরম পানি নিয়ে এলেন বেলী আন্টি। বললেন, ওর ভেতরটাও গরম করা দরকার।
ডাক্তার আসতে আসতে রীতিমত সুস্থ হয়ে গেল রবিন। উঠে বসল টাবের মধ্যে। বিমূঢ়ের মত তাকাতে লাগল।
বাথরূমে ঢুকলেন ডাক্তার। কেমন আছ এখন?
ভাল, দুর্বল কণ্ঠে জবাব দিল রবিন।
তার দেহের তাপমাত্রা দেখলেন ডাক্তার। নাড়ি দেখলেন। ব্লাড প্রেশার মাপলেন। তোমার কপাল ভাল, তাড়াতাড়ি তুলে ফেলেছে। গা ভালমত গরম করতে হবে এখন। তবে বিপদ কেটে গেছে।
কত রকম ভুল কথা বলে মানুষ। এত ভোগান্তির পর কপাল ভাল হয় কি করে? ভাল তো হত যদি একেবারেই না পড়ত, মুসা বলল। রবিন বেঁচে যাওয়াতে অতি আনন্দে দিশেহারা।
হেসে ফেললেন ডাক্তার। পরিস্থিতির আড়ষ্ট ভাবটা কেটে গেল। হাসিটা সংক্রমিত হলো উপস্থিত সবার মাঝে।
পুরোপুরি ভাল হতে কত সময় নেবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ভাল মোটামুটি হয়েই গেছে। প্রাণশক্তি খুব বেশি। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি আমরা ওকে। তবে তার বোধহয় আর প্রয়োজন হবে না। যা করার মিসেস মরগানই করতে পারবেন। ওকে বিছানায় রেখে মাঝে মাঝে টেম্পারেচার পরীক্ষা করা আর গরম তরল খাবার খাওয়ানো ছাড়া কিছুই করা লাগবে না।
ফিরে তাকাল কিশোর। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন বেলী আন্টি। আপনি কি বলেন, আন্টি? হাসপাতালে পাঠাব?
ডাক্তারের সঙ্গে আমিও একমত। আমার মনে হয় না আর নেয়ার কোন প্রয়োজন আছে।
তাহলে আমি বরং থেকেই যাই, রবিন বলল। এখানে সবার সামনে হাসপাতালের চেয়ে ভাল থাকব।
থাকতে পারো, হেসে বললেন বেলী আন্টি, এক শর্তে। আমার কথা সব শুনতে হবে। ইচ্ছে করলেই উঠে বেরিয়ে যাওয়া চলবে না।
না না, যাব না, রবিন এক কথায় রাজি। হাসপাতালে যাওয়ার চেয়ে যে। কোন শর্ত মেনে নেয়া অনেক ভাল। যা বলবেন তাই করব। পথ্য যা খেতে দেবেন, খাব।
হেসে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তার।
রবিনকে একটা মেয়েদের বাথরোব এনে দিলেন বেলী আন্টি। পশমী মোজা দিলেন। ভেজা কাপড়-চোপড়গুলো ড্রাইয়ারে ঢোকালেন শুকানোর জন্যে। রবিনকে বললেন, আগুনের কাছে গিয়ে বসে থাকোগে।
রোবটা গায়ে দিল রবিন। উসখুস করতে লাগল।
কি হলো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
এ রকম একটা বাথরোব পরে এখানে মেয়েমানুষদের সামনে ঘোরাফেরা করতে লজ্জা লাগছে আমার, আড়চোখে শার্লির দিকে তাকাল রবিন।
তাতে কি হয়েছে? গায়ে কাপড় তো আছে, কিশোর বলল।
খানিক আগে বাথরূমে যে অবস্থায় ছিলে সে ভাবেই যে থাকতে বলেননি, এটাই বরং তোমার ভাগ্য, মুসা বলল।
মুচকি হাসলেন বেলী আন্টি। হাসিটা বেড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ঠেকানোর জন্যে কৃত্রিম ধমক লাগালেন, এখনই কিন্তু কথা না শোনা শুরু করেছ তুমি।
আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর দ্বিধা করল না রবিন। তাড়াতাড়ি গিয়ে আগুনের কাছে বসে পড়ল।
মুসা আর কিশোর বসল তার কাছাকাছি।
গরম চকলেট ড্রিংক এনে দিল শার্লি।
আগুনের উত্তাপ শোষণ করতে লাগল রবিনের শরীর। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বেড়ে যেতে শুরু করল। কিশোরের দিকে তাকাল সে। লেকে আসলে কি ঘটেছিল তখন, বলো তো?
জ্যাকি আর রকি এ রকম করল কেন জানতে চাইছ তো?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রবিন।
আমার বিশ্বাস, ইচ্ছে করেই আমাদেরকে পাতলা বরফের ওপর টেনে নিয়ে। গিয়েছিল ওরা, কিশোর বলল।
শেষ দিকে আমারও তাই মনে হচ্ছিল, রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল মুসার কণ্ঠে। রবিন পড়ে যাওয়ার পর ওর দিকে ছাড়া আর কোনদিকে তাকানোর সুযোগ ছিল না। কিশোরের দিকে তাকাল সে। ওরা কি করেছে দেখেছ নাকি?
নাহ্, মাথা নাড়ল কিশোর। আমার নজরও রবিনের দিকেই ছিল। পরে যখন খেয়াল হলো, ফিরে তাকালাম, দেখি ওরা দুজন চলে গেছে।
অ, ওরা আর সবার মত ছুটে আসেনি?অবাক হলো রবিন।
না।
এ সময় শার্লি ঢুকল ঘরে। রবিনের কাছে এসে বলল, তোমার পকেটের জিনিসপত্র। একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ পাওয়া যায় কিনা দেখি, ভরে রাখার জন্যে।
তাহলে তো ভালই হয়, শার্লির হাত থেকে মানিব্যাগটা নিয়ে আগুনের সামনে রাখল রবিন। থাক এখানে। শুকাক।
আর এই যে তোমার হিসেবের কাগজ, জ্যাকসনের ঘর থেকে নকল করে। আনা কাগজটা রবিনের হাতে দিল শার্লি।
ওহহো, ভুলেই গিয়েছিলাম এটার কথা। সাবধানে ভেজা কাগজটার ভাজ খুলল সে, যাতে ছিঁড়ে না যায়। কালি জাবড়ে গেছে। তবে পড়া যায় নম্বরগুলো।
জিনিসপত্রগুলো দিয়ে চলে গেল শার্লি।
বেলী আন্টি রান্নাঘরে।
নম্বরগুলো দেখতে দেখতে কিশোর বলল, কি ভাবে পড়তে হবে? ওপর থেকে সারি দিয়ে নিচের দিকে, না পাশের দিকে জোড়ায় জোড়ায়?
কি জানি, হাত ওল্টাল রবিন।
মুসার দিকে তাকাতেই মাথা নাড়ল মুসা, আমার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, যেটা তুমি বুঝতে পারছ না, সেটা আমি কি করে বুঝব?
খানিকক্ষণ নম্বরগুলো নিয়ে মাথা ঘামাল ওরা। কিন্তু কি ভাবে পড়লে বা মানে কি এগুলোর– কোন সমাধান করতে পারল না।
হঠাৎ তুড়ি বাজাল রবিন। কে পারবে জানো? রয় কভারলি।
ভুরু কুঁচকাল কিশোর। কভারলিটা কে?
কম্পিউটারের জাদুকর। শার্লির মামাত ভাই। ওর কাছে এ ধরনের যে সমস্যা নিয়ে যাবে, সমাধান করে দেবে। সেবার কিডন্যাপ করা বাচ্চাটাকে? বের করতে আমাকে অনেক সাহায্য করেছিল সে।
কিশোর বলল, তোমার যখন এত আস্থা, তার কাছেই যাওয়া দরকার
ফোন বাজল।
রান্নাঘরের এক্সটেনশন থেকে ধরলেন বেলী আন্টি। ডেকে বললেন, কিশোর, তোমাদের চায়। যে কেউ একজন আসো।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। তোমরা বসো। আমি দেখে আসি, কে।
রান্নাঘরে ঢুকে বেলী আন্টির হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে কানে ঠেকাল কিশোর।
ওপাশের কথা শুনতে শুনতে গম্ভীর হয়ে গেল সে। বেলী আন্টি লক্ষ করলো। ব্যাপারটা। রিসিভারটা রেখে দিয়ে যখন ঘুরল কিশোর, জিজ্ঞেস করলেন, কি?
আসুন, ফায়ারপ্লেসের কাছে। সবাইকে একবারেই বলি।
কিশোর বসার ঘরে ঢুকতেই মুসা জিজ্ঞেস করল, কার ফোন?
জানি না, জবাব দিল কিশোর। শার্লির দিকে তাকাল। ওপর থেকে কাজ সেরে এসে সে-ও বসেছে এখন ফায়ারপ্লেসের কাছে। একটা অচেনা পুরুষ কণ্ঠ। আমার মাধ্যমে মরগান আঙ্কেলদেরকে একটা মেসেজ দিতে চায়।
দুঃসংবাদ। বুঝতে পারলেন আন্টি। কি মেসেজ?
হুমকি দিল আপনাদেরকে…
কি হুমকি? চিৎকার করে উঠল শার্লি।
আস্তে! কিশোরের দিকে তাকালেন আবার বেলী আন্টি। কি বলল?
বলল, তিন গোয়েন্দাকে সাহায্য করেছেন। এখন বিপদের জন্যে প্রস্তুত হোন।
কিশোরের কথা শেষ হতে না হতেই তীক্ষ্ণ, জোরাল একটা শব্দ হলো।
গুলির শব্দের মত।
.
১১.
মাথা নিচু! মাথা নিচু! চিৎকার করে উঠল কিশোর। বসে পড়ো সবাই মেঝেতে!
পাশে বসা শার্লির হাত ধরে একটানে নিচে নামিয়ে ফেলল মুসা। একই সঙ্গে নিজেকেও ছুঁড়ে দিল মেঝেতে।
রাবন নিজেই নামতে পারল।
বেলী আন্টিকে সাহায্য করল কিশোর।
অপেক্ষা করে রইল ওরা। কিন্তু গুলির শব্দ আর হলো না।
নিচেই থাকো, ফিসফিস করে বলল কিশোর। ওরাও হয়তো অপেক্ষা করছে। আমাদের ওঠার জন্যে।
আরও দুতিন সেকেন্ড অপেক্ষা করে আচমকা লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে দৌড় দিল সে।
কিশোর, কোথায় যাচ্ছ! মুসা বলল। কি করছ তুমি? মরবে তো!
জবাব দিল না কিশোর। এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে ফেলে বাইরে লাফিয়ে পড়ল। এঁকেবেঁকে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল একটা ঝোঁপের মধ্যে।
ঘরে যারা অপেক্ষা করছে তারা কান পেতে আছে। কিশোর কোথায় আছে, কি করছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। মাঝে মাঝে সামান্য খসখস ছাড়া আর কোন শব্দ আসছে না ওদের কানে।
অনন্তকাল ধরে যেন পড়ে রইল ওরা ঘরের মেঝেতে।
অবশেষে সামনের দরজায় শব্দ হলো।
পাল্লাটা খুলল।
ভেতরে ঢুকল জুতোর শব্দ।
বন্ধ হলো পাল্লাটা।
ঠিক আছে, এখন উঠতে পারো। কিশোরের কণ্ঠ।
সবার আগে উঠে পড়ল শার্লি। ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, হাতে একটা বড় ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।
ঘরের কোণে ডালটা নামিয়ে রেখে এসে আগুনের কাছে বসল সে। ডাল ভাঙার শব্দ হয়েছিল। গুলি নয়।
জিমের অত শখের জাপানী ফেদার ম্যাপলের ডাল, বেলী আন্টি বললেন। রেগে আগুন হয়ে যাবে ও। কিন্তু ডাল ভাঙতে এল কেন?
নিশ্চয় ডালের ওপর উঠে বসে নজর রেখেছিল ঘরের ভেতর, জবাব দিল কিশোর। টেলিফোন পেয়ে আমাদের কি প্রতিক্রিয়া হয়, দেখতে চাইছিল হয়তো। ফিরে গিয়ে যে ফোন করেছে তাকে জানাত।
পড়ে গিয়ে কোমরটা যদি ভাঙত আমি খুশি হতাম, রাগত স্বরে বলল মুসা।
মুসার দিকে তাকাল কিশোর। দুঃখের বিষয়, খুশিটা আর হতে পারলে না। চলো এখন, রয়ের ওখান থেকে ঘুরে আসি। রবিন, তুমি থাকো। শার্লিকে ঝলল, শার্লি, দাও তত দ্রুত একটা চিঠি লিখে। তোমার মামাত ভাইয়ের কাছে। কাগজ কলম নাও। যা যা বলি, লেখো।
আমি গেলে অসুবিধে কি? রবিনের প্রশ্ন।
না, মাথা নাড়লেন বেলী আন্টি। তোমার শরীর এখনও বাইরে বেরোনোর উপযুক্ত হয়নি।
রয়ের কাছে কেন যাচ্ছে, সংক্ষেপে বেলী আন্টি আর শার্লিকে জানাল কিশোর।
শার্লি বলল, রয়কে একটা ফোন করে দিলেই তো হয়। আমিও দিতে পারি। রবিনও পারে।
উঁহু, মাথা নাড়ল কিশোর। চমকে দেয়ার মজাটা আর তাহলে থাকে না। টেলিফোনেই যদি কাজটা সেরে ফেলা যেত, যাওয়া আর না লাগত, তাহলে আলাদা কথা ছিল। কিন্তু যাওয়া যখন লাগবেই, গিয়েই পরিচয় করে নেব। জানাব সব।…দাও দাও, চিঠিটা লিখে দাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
*
যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কেসটার কিনারা করে ফেলা জরুরী, কিশোর বলল। ফোনে ওই হুমকি দেয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকবেন মরগান আঙ্কেলরা।
বনের ভেতরের সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে মুসা। জ্যাকসনদেরই সন্দেহ করছ এখনও?
সন্দেহটা এখন পর্যন্ত ওদিকেই তো বেশি যাচ্ছে। তাই না? বিশেষ করে আমাদেরকে পাতলা বরফের দিকে নিয়ে যাওয়ার পর।
তা বটে। ম্যারিল্যান্ডে জ্যাকি আর রকি কারও কাছে কোন রকম জিনিস বিক্রি করেছে কিনা, সে-খোঁজ নিতে এখন বলা যেতে পারে ডোবারকে। ওদের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় হয়ে যাবে।
তারচেয়ে ভাল হয়, যদি চোরাই মালগুলো বের করে ফেলতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এবারের মৌসুমে যা চুরি করেছে, সব পাইনভিউতেই আছে এখনও। সরায়নি। লুকিয়ে রেখেছে। শীতের পর নিজেরা যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।
সারাটা পথ আলোচনা করেও কি ভাবে মালগুলো বের করবে, তার কোন সমাধান বের করতে পারল না ওরা।
*
রয় কভারলিকে পেল ওরা, রয়দের বাড়ির বোমেন্টে। মাটির নিচের এই মস্ত ঘরটায় রয়ের ওঅর্কশপ। বড় একটা ওঅর্কবেঞ্চে বসে গভীর মনোযোগে কাজে ব্যস্ত। চারপাশে ছড়ানো ছিটানো কম্পিউটারের অসংখ্য পার্টস। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জোড়া দিয়ে একটা কম্পিউটার তৈরি করছে।
রয়, তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, দূরজায় উঁকি দিয়ে মিসেস কভারলি বললেন।
কি করছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।
ফিরে তাকাল রয়। চোখ থেকে সেফটি গগলসটা খুলে নিল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দুই গোয়েন্দার দিকে। দুচোখে প্রচণ্ড বিস্ময়। তোমরা?
আমি কিশোর পাশা, ও মুসা..।
আরে জানি জানি! কিন্তু এলে কি ভাবে?
রবিন আর শার্লির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে।
রবিন কই?
পাইনভিউতে, জবাবটা দিল মুসা। পানিতে ডুবে আধমরা হয়ে এখন আগুনের সামনে দম নিচ্ছে।
দেখেই চিনলে কি করে আমাদের? কিশোরের প্রশ্ন। নিশ্চয় আমাদের ছবি এত বেশি দেখিয়েছে রবিন…।
মাথা ঝাঁকাল রয়। তারপর লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, দেখো, কথাই বলে যাচ্ছি শুধু। বসতে বলতেও ভুলে গেছি। এসো এসো, ভেতরে এসো।
তারা কথা বল, মিসেস কভারলি বললেন। আমি চা পাঠাচ্ছি।
একটা বিষয়ে আটকে গেছি, রয়, বলল কিশোর। তোমার কম্পিউটার জ্ঞান দিয়ে কোন সাহায্য পাওয়া যায় কিনা, দেখতে এলাম। রবিন বলল, তুমি এ ধরনের কাজে বিশেষজ্ঞ।
পকেট থেকে শার্লির চিঠিটা বের করে দিল কিশোর।
পড়ে বলল রয়, এটার কোন প্রয়োজন ছিল না। তোমরা সোজা এসে। বললেই পারতে।,
তখন কি আর জানতাম, দেখামাত্র চিনে ফেলবে।
যাকগে, বলো কি করতে হবে? জানতে চাইল রয়।
পকেট থেকে নম্বর লেখা কাগজটা বের করে রয়ের হাতে দিল কিশোর।
কাগজটার দিকে তাকিয়ে রয় বলল, ভিজল কি করে?
ওই যে বললাম, চুবানি খেয়েছে। পাইনভিউ লেকের পানিতে সাঁতার কাটতে নেমেছিল রবিন, মুসা বলল।
চোখ কপালে উঠল রয়ের। তার মানে! পাগল হয়ে গেছে?
পাইনভিউতে চুরির খবর জানা আছে রয়ের। তিন গোয়েন্দা কেসটা হাতে নেয়ার পর কি কি ঘটেছে জানাল ওকে কিশোর। সব শেষে কাগজটা দেখিয়ে বলল, আমার ধারণা, পাইনভিউ লেকের চুরি-ডাকাতিগুলোর সঙ্গে এ নম্বরগুলোর কোন সম্পর্ক আছে। কোন ধরনের কোডও হতে পারে।
তীক্ষ দৃষ্টিতে লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল রয়। মুখ তুলে বলল, চলো, ওপরে।
ওপরে এসে কিশোর বলল, তোমাদের ফোনটা ব্যবহার করা যাবে?
রান্নাঘরের দিকে হাত নেড়ে রয় বলল, কিরো গিয়ে।
কাকে করবে? জানতে চাইল মুসা।
ডোবার কগনানকে। যাও না। তুমিই করে এসো না। জিজ্ঞেস করবে, নতুন কিছু জানতে পারল কিনা।
ফোন সেরে দোতলায় চলে এসো, রয় বলল। ডান দিকের প্রথম ঘরটা।
নিজের ঘরে কিশোরকে নিয়ে এল রয়। কাণ্ডই করে রেখেছে। ঘরের দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে ইলেকট্রনিক যন্ত্র লাগানো। তারের জটলা দেখে মনে হয় না এগুলো আর কোনদিন ছাড়ানো যাবে।
একটা কম্পিউটারের সামনে বসে পড়ল রয়। প্রথমে কাগজের নম্বরগুলো টাইপ করে নিল। তারপর একটা ম্যাথমেটিক্যাল টেস্ট চালাল সেগুলোর ওপর।
বুঝলে কিছু? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা নাড়ল রয়। এখনও না।
কোন ধরনের সাঙ্কেতিক লেখা নাকি?
মনে হয় না। প্রথম সারির নম্বরগুলো দেখো ভালমত খেয়াল করে। সাত তিন অর্থাৎ তিয়াত্তর দিয়ে শুরু। সবগুলোই। দ্বিতীয় সারিরগুলো চার শূন্য অর্থাৎ চল্লিশ। তারপর ফুলস্টপ। আবার একজোড়া সংখ্যা। আবার ফুলস্টপ। আবার সংখ্যা…
রয়ের কাঁধের ওপর দিয়ে নম্বরগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা চিৎকার করে উঠল কিশোর, ইস, আমি একটা গাধা! অনেক আগেই বুঝে যাওয়া উচিত ছিল আমার। রয়, ম্যাপ আছে?
এবার অবাক হওয়ার পালা রয়ের। তা তো আছে। কিন্তু কি বুঝলে?
ম্যাপটা কোথায়? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে কিশোর।
বুকশেলফ থেকে একটা ম্যাপ এনে দিল রয়।
বুঝলে না এখনও? কিশোর বলল। লনগিটিউড এবং ল্যাটিচিউড।
হাসি ছড়িয়ে পড়ল রয়ের মুখে। ঠিক। ঠিক বলেছ। কিন্তু তার জন্যে তো ম্যাপ বইয়ের দরকার নেই।
কম্পিউটারেই একটা ম্যাপের প্রোগ্রাম খুলে নিল রয়। মাউসের সাহায্যে লনগিটিউড ৭৩ ও ল্যাটিচিউড ৪০-এর চারপাশে রেখা একে একটা বাক্স তৈরি করল। মাউসের সাহায্যেই বাক্সটাকে বড় করতে লাগল।
নিউ ইয়র্ক, কিশোর বলল।
কাগজের নম্বর দেখে টাইপ শুরু করল রয়। রিটার্ন বাটন টিপতেই বড় হয়ে সামনে এগিয়ে এল ম্যাপ।
নিউ পোর্ট, বলে উঠল কিশোর। উত্তেজনায় গলা কাঁপছে। আরও জুম করো। টার্গেট ঠিক করো।
কাগজের নম্বরের সারি দেখে আবার নম্বর টাইপ করল রয়। পাইনভিউ লেকের ওপর লাল রঙের ক্রস চিহ্ন জুলতে নিভতে শুরু করল।
এটাই তোমার জায়গা, কণ্ঠস্বরেই বোঝা যাচ্ছে রয়ও উত্তেজিত হয়ে। উঠেছে।
লেকের মধ্যে? আনমনে যেন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল কিশোর।
হ্যাঁ।
ঘরে ঢুকল মুসা। ডোবারের সঙ্গে কথা বললাম। নতুন কিছু পায়নি। বলল, আরও কয়েক জায়গায় খোঁজ নেবে।
নিতে থাকুক। এসো, দেখে যাও।
কিছু পেলে নাকি? এগিয়ে এল মুসা।
তোমাদের নম্বরগুলো হলো লনগিটিউড এবং ল্যাটিচিউড, রয় বলল।
মানে? কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে রইল মুসা।
ওকে ওভাবেই থাকতে দিয়ে কিশোর বলল রয়কে, এগিয়ে যাও। দেখা যাক, কি আসে?
আবার খানিকক্ষণ নম্বর টিপল রয়। লেকের ওপর এখন জ্বলতে-নিভতে শুরু করল লাল ক্রস।
দরজায় থাবা পড়ল এ সময়। রয়ের মা ডাকলেন, এই, চা নিয়ে যা।
তুমি কাজ করো, মুসা বলল। আমি আনছি।
দরজা খুলে মিসেস কভারলির হাত থেকে ট্রেটা নিয়ে ফিরে এল। তাতে চা আর বিস্কুট। একটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল।
ট্রের দিকে একবার তাকিয়েই মুখ ফেরাল কিশোর। নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটল দুবার। মাছ ধরার অতি চমৎকার জায়গা! মুসার দিকে তাকাল সে। এত ভাল জায়গাগুলো বিছানার নিচে লুকিয়েছে কেন, বলো তো?
মুসার হা-টা আরও বড় হলো। অহেতুক কেন আমার মাথাটাকে গুলিয়ে দিচ্ছ?
জবাবটা নিজে নিজেই দিল কিশোর, গোপন রাখার জন্যে। উন্নত আধুনিক যন্ত্রপাতি পছন্দ করে না বুড়ো জ্যাকসন। কাগজটা দেখলে নিশ্চয় কিছু বুঝতে পারবে না সে।
মজা পেয়ে গেছে রয়। দ্রুত টাইপ করে চলেছে তার আঙুলগুলো। লেকের ওরে আরও কয়েক জায়গায় লাল ক্রস আবিষ্কার করল।
আর দরকার নেই, কিশোর বলল। লেকে গিয়ে এখন খোঁজ নিতে হবে। রয়, ক্রসগুলো সহ তোমার ম্যাপের এই অংশটার একটা প্রিন্ট দিতে পারবে?
তা তো পারবই। সঙ্গে আরও ভাল জিনিসও দিতে পারব।
একটা তাকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল রয়। নানা ধরনের ছোট ছোট ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির মধ্যে থেকে একটা যন্ত্র টেনে বের করল। দেখতে সেলুলার ফোনের মত যন্ত্রটার বড় একটা এলসিঁড়ি স্ক্রীন আছে। কিশোরকে দিয়ে বলল, এটা ব্যবহার করতে পারো। গ্লোবাল পজিশনিং স্যাটেলাইট সিসটেম। সংক্ষেপে জিপিএস। স্যাটেলাইটকে ব্যবহার করে এটা তোমার অবস্থান বলে দিতে পারবে। বোঝা যাবে তুমি কোথায় আছ। যে ক্রস চিহ্নগুলো আবিষ্কার করলাম, নিখুঁত ভাবে ওই সব জায়গা বের করা যাবে এটার সাহায্যে। জায়গাগুলোতে কি আছে, খুঁজলেই বেরিয়ে পড়বে। কখন রওনা হচ্ছি আমরা?
মুসার দিকে তাকাল কিশোর, কখন?
দেরি করে লাভ কি? জবাব দিল মুসা। যদিও মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারিনি এখনও আমি।
চলো। যেতে যেতে বলছি।
চাটা খেয়ে নাও, রয় বলল।
*
গাড়িতে এসে উঠল ওরা। জিপিএসটা আর ম্যাপের প্রিন্টআউট সঙ্গে নিয়েছে রয়।
লেকের কাছে যখন পৌঁছল ওরা, অন্ধকার হয়ে গেছে। শীতের ঠাণ্ডা রাত নামছে। তুষার পড়ছে। মেঘে ঢাকা চাঁদ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ঝোড়ো বাতাস ঝাঁপটা দিয়ে যাচ্ছে। টান মারছে পরনের কয়েক প্রস্থ পোশাকের একেবারে ভেতরেরটা ধরেও।
কষ্ট আর ভোগান্তি জোগাড়ের সমস্ত উপায়গুলো মনে হচ্ছে তোমাদের জানা, গায়ের কোটটা টেনে দিতে দিতে বলল রয়।
এলে কেন? কিশোর বলল। স্পটগুলো খুঁজে বের করো।
কোন রকম ঝুঁকি নিল না সে। গাড়িতে চুরি আছে। সোজা দেখে কয়েকটা ডাল কেটে নিল ছড়ির মত ব্যবহারের জন্যে। ডালগুলো হেঁটেছেটে সাফ করে নিল।
রবিন তো দিনে পড়েছিল বলে রক্ষা। কিশোরের হাত থেকে একটা ডাল নিয়ে নিল মুসা। অন্ধকারের মধ্যে এখন পানিতে পড়লে বাঁচতে হবে না আর।
লেকে নেমে পড়ল ওরা। লাঠি ঠুকতে ঠকতে আগে বাড়ল। ম্যাপ দেখে। এগোল, সবচেয়ে কাছের স্পটটার দিকে। ম্যাপ আর জিপিএস-এর স্ক্রীনের সবুজ আভার দিকে নজর রয়ের। বরফ ঠুকতে ঠকতে আগে আগে চলেছে কিশোর। রয় মাঝখানে। পেছনে মুসা, টর্চের আলো ফেলে পথ দেখাচ্ছে।
কিছু দেখতে পাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল রয়।
পাচ্ছি। বরফ। জবাব দিল কিশোর।
বাতাসের গর্জনকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল রয়, কি জিনিস খুঁজতে এসেছি আমরা?
বলতে পারলে খুশি হতাম।
ডাকাতির মাল লুকিয়ে রাখেনি তো স্পটগুলোতে? তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে লেকের পাড়ের বাড়িগুলোকে দেখার চেষ্টা করল রয়।
মনে তো হচ্ছে। এখনও কেউ মাছ ধরছে নাকি দেখা যাক।
বলাটা যত সহজ, করা ততটাই কিংবা তারচেয়েও বেশি কঠিন হলো। তাজা, তুষার বরফ ঢেকে দিচ্ছে। এক জায়গায় এসে থামল রয়। পা দিয়ে খোঁচা মেরে। সেখান থেকে তুষার সরিয়ে দিতে লাগল মুসা। দেখাদেখি কিশোর আর রয়ও তা-ই করতে লাগল। কয়েক মিনিট অবিরাম চেষ্টা করে আট ফুট ব্যাসের গোল একটা জায়গা থেকে তুষার সরিয়ে ফেলল ওরা। নিচের কঠিন বরফ বেরিয়ে এল। টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল মুসা।
কিছু দেখছ? জিজ্ঞেস করল রয়।
পরিষ্কার করা জায়গাটায় নতুন করে তুষার এনে ফেলছে ঝোড়ো বাতাস।
নাহ্, কিছুই নেই, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল রয়। এ স্রেফ পাগলামি! অকারণ কষ্ট!
এত তাড়াতাড়িই কাবু হয়ে গেলে? তোমার আসার ইচ্ছে দেখে তো মনে হচ্ছিল গোয়েন্দাগিরির খুব শখ? মুসা বলল। গোয়েন্দাগিরিটা কষ্টেরই। আরাম করে এ কাজ হয় না।
থাক থাক। আর লেকচার দেয়া লাগবে না, জবাব দিল রয়।
হাটু গেড়ে বসে পড়ল কিশোর।
পাতলা বরফ নাকি দেখো আগে, সাবধান করল মুসা। রবিনের পড়ে ওয়ার দৃশ্যটা কল্পনা করে শিউরে উঠল নিজের অজান্তেই।
কিছু একটা আছে এখানে, কিশোর বলল। আলোটা আরও সরাও তো দেখি।
কিশোরের নির্দেশিত জায়গায় আলো ফেলল মুসা। বরফের গায়ে একটা খাজমত চোখে পড়ল ওখানে। ম্যানহোলের ঢাকনার চেয়ে ছোট।
একটা গর্ত, কোন সন্দেহ নেই, দেখতে দেখতে বলল কিশোর। বরফ পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
আলোটা আরও কাছে নিয়ে এল মুসা। আলোকরশিতে ধরা পড়ল চকচকে ছোট একটা জিনিস। বরফের মধ্যে গেঁথে রয়েছে।
কি ওটা? মুসার প্রশ্ন।
নতুন করে পড়া তুষারে দ্রুত ঢেকে যাচ্ছে জিনিসটা। হাত দিয়ে ডলে পরিষ্কার করে নিল কিশোর। টিনের পাত মনে হচ্ছে।
কোকের ক্যানের হতে পারে। এখানকার মানুষগুলো বড় নোংরা। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে, রয় বলল।
এখানে ময়লা ফেলতে আসবে কে? তা ছাড়া কোকের ক্যানের টিন এ রকম নয়।
তা-ও তো কথা। পরের স্পটটায় দেখব নাকি? রয় বলল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমিও বরফ হয়ে যাচ্ছি।
চলো, দেখাই যাক, উঠে দাঁড়াল কিশোর।
কি করে খুঁজতে হয় বুঝে ফেলেছে এখন ওরা। পরের স্পটটা বের করতে সময় লাগল না। প্রথমটার মতই একই রকম আরেকটা বুজে যাওয়া গর্ত দেখতে পেল। লেকের বরফের ওপর তুষারের আস্তর জমে আবার বরফ হয়েছে। স্তর দুটো আলাদা ভাবে বোঝা যায়।
এখানেও তো তেমন কিছু দেখছি না, হতাশ ভঙ্গিতে বলল কিশোর। দেখি, আরেকটা।
এত ঠাণ্ডা, উফ! রয় বলল।
ঠাণ্ডার জায়গায় ঠাণ্ডা তো হবেই, উঠে দাঁড়িয়ে রয়ের হাত থেকে ম্যাপটা নিয়ে নিল কিশোর।
তৃতীয় স্পটটায় এসে আবার গোল করে বরফ পরিষ্কার করল। আগের দুটোর মতই গোল একটা গর্তের চিহ্ন। বুজে গেছে বরফে। এটার মাঝখানেও প্রথমটার মত টিন গোঁজা।
নাহ, এখানকার লোকগুলো সত্যি… বলতে গেল রয়।
চুপ! ওকে থামিয়ে দিল মুসা। আলো নিভিয়ে দিল।
কি হয়েছে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রয়।
শব্দ, কান পেতে আছে মুসা। ইঞ্জিনের।
ওদের পায়ের নিচের বরফে শব্দ বাড়ি দিতে শুরু করল। বাড়তে লাগল। ক্রমে। মুহূর্ত পরেই বোঝা গেল ওটা ইঞ্জিনের শব্দ। বরফে আঘাত হানাতে ওরকম শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ঘুরে সেদিকে টর্চের আলো ফেলল মুসা। চকচকে ক্রোমের ওপর গিয়ে পড়ল আলো।
পালাও! চিৎকার করে উঠল কিশোর।
একটা ট্রাককে ছুটে আসতে দেখা গেল ওদের দিকে। সে আর রয় ঘুরে ডাইভ দিয়ে পড়ল এক দিকে। মুসা আরেক দিকে। কয়েক ইঞ্চির জন্যে বেঁচে গেল কিশোর। তার পাশ দিয়ে ট্রাকটা যাওয়ার সময় টর্চের আলোয় দেখতে পেল বডিতে লেখা: মেরিন ডগলাস স্যালভিজ।
.
১২.
গর্জন করতে করতে ছুটে অন্ধকারে হারিয়ে গেল ট্রাক।
চিৎকার করে উঠল কিশোর, মুসা, কোথায় তুমি?
আমি এখানেই আছি। ভাল। তোমরা?
আমি ভাল নেই, জবাব দিল রয়। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
তার কথায় পাত্তা না দিয়ে অন্ধকারে ট্রাকটা যেদিকে চলে গেছে সেদিকে তাকিয়ে মুসা বলল, দেখা দরকার, কে এ রকম করে রাতের বেলা চড়াও হতে এসেছিল আমাদের ওপর।
ট্রাকটা তো ডগলাসের! উঠে দাঁড়াল কিশোর।
তারমানে ডগলাসই চোর? মিথ্যে সন্দেহ করেছি আমরা জ্যাকি আর রকিকে? আলো ফেলে ডালটা খুঁজতে লাগল মুসা।
আমাদের খুন করতে চেয়েছিল নাকি? রয়ের প্রশ্ন।
বুঝলাম না, জবাব দিল কিশোর। খুন করার ইচ্ছে থাকলে তো ঘুরে আবার আসত।
ভয় দেখাতে এসেছিল আমাদের, মুসা বলল। বরফে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে একটা বোনাস মজা দিয়ে দিলাম আমরা।
ডগলাস কিনা সন্দেহ আছে আমার, চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল। ভাবছি, ওর বাড়িতে খোঁজ নিতে যাব নাকি?
চলো, মুসা রাজি।
খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যাওয়ার আর সাহস হলো না ওদের। ফিরে এল। নিজেদের গাড়িতে। ডগলাসের স্যালভিজ ইয়ার্ডে রওনা হলো।
ইয়ার্ডে পৌঁছে ড্রাইভওয়ের উল্টো দিকে রাস্তার ধারে গাড়ি রাখতে বলল কিশোর। গেটের দিকে হাত তুলে বলল, ওই দেখে। চাকার তাজা দাগ।
গাড়ি থেকে নামল ওরা। দাগগুলো পরীক্ষা করতে গেল কিশোর।
দাগের ওপর তুষারের স্তর পাতলা, বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই বলল। সে। তারমানে বড়জোর ঘণ্টাখানেক আগে গেছে।
উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল কিশোর।
গর্জন করে পাক খেয়ে বইছে হিমেল বাতাস। ইয়ার্ডের ভাঙাচোরা গাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে শিস কেটে যাচ্ছে।
পুটি কোথায়? কিশোরের প্রশ্ন।
কোন সাড়া নেই কুকুরটার। কোথাও দেখা গেল না ওটাকে। একটিবারের জন্যে ঘেউ ঘেউও করল না।
মূল বাড়িটা অন্ধকার। অফিসটাও।
মুসার হাত থেকে টর্চটা নিয়ে প্রথমে অফিসের দিকে গেল কিশোর। জানালা দিয়ে ভেতরে আলো ফেলল। আসবাবপত্র এলোমেলো। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে খবরের কাগজ। মেঝেতে পড়ে থাকা বড় এক টুকরো মাংসের ওপর আলো পড়ল। টুকরোটার পাশেই নেতিয়ে পড়ে আছে পুটি।
সেদিক থেকে চোখ না সরিয়ে বলল সে, গোলমাল তো একটা দেখা যাচ্ছে।
তার পাশে এসে জানালা দিয়ে উঁকি দিল মুসা আর রয়।
পুটিকে দেখতে পেল।
ঘুমাচ্ছে নাকি কুকুরটা? রয়ের প্রশ্ন।
ওটার পাঁজরের ওঠানামা চোখে পড়ল কিশোরের। বলল, বেঁচেই আছে। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে মনে হয় ওকে।
ডগলাস কোথায়? মুসার প্রশ্ন।
চলো, খুঁজে দেখা যাক। একসঙ্গে না গিয়ে তিনজন তিন দিকে।
ভাঙাচোরা গাড়ির সারির ভেতর দিয়ে এগোতে লাগল ওরা। মাটির দিকে চোখ। তুষারে পায়ের চিহ্ন খুঁজছে। কিন্তু ছাপ এত বেশি ওখানে, কোনটা যে নতুন বোঝা মুশকিল। দুর্ঘটনায় ভেঙেচুরে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া গাড়ি আছে প্রচুর। তিন-চার থাক করে একটার ওপর আরেকটা রাখা। কোন কোনটা পুড়ে এমন অবস্থা হয়েছে, চাকাটাকা তো নেই-ই, দরজা-জানালা, বাম্পার এমনকি ফেন্ডার প্যানেল পর্যন্ত গায়েব।
শব্দ শুনতে পাচ্ছি, অন্য সারির মধ্যে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে জানাল মুসা।
দৌড়ে গেল কিশোর আর রয়।
থাবা দেয়ার শব্দ, মুসা বলল। শুনতে পাচ্ছ?
কোনখান থেকে আসছে? কান পাতল রয়।
ঝোড়ো রাতের বাতাসের মধ্যে অন্য কোন শব্দ বোঝা কঠিন। তারপরেও তিনজনেই শুনতে পেল শব্দটা।
ডগলাস? ডগলাস? আপনি করছেন শব্দ? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
পুরানো সেডান গাড়ির একটা উঁচু স্তূপ থেকে দুবার জোরাল থাবা দেয়ার শব্দ হলো। একটারও জানালার কাঁচ নেই। কোন কোনটার দরজা গায়েব। তবে প্রত্যেকটার ট্রাংক রয়েছে। যদিও রঙ চটা।
এদিকে, শব্দ লক্ষ্য করে দৌড় দিল মুসা।
নিচের গাড়িটার ট্রাংক থেকে শব্দটা আসছে মনে হলো। সেটাতে থাবা দিল মুসা। সামান্য আঘাতেই নড়ে উঠল ওপরের গাড়িগুলো।
ওপর দিকে টর্চের আলো ফেলে কিশোর বলল, সাবধান। একদম ওপরের বড় গাড়িটার ভাবভঙ্গি ভাল না। পড়ে যাবে।
বের করো আমাকে! ডগলাসের কথা ভেসে এল নিচের গাড়িটার ট্রাংক থেকে।
এক মিনিট। এখনই বের করছি, জবাব দিল মুসা।
রয়, একটা শাবল পাও নাকি দেখো তো, কিশোর বলল। বেয়ে ওঠা গেলে ওপরেরটা ঠেলে ফেলা যাবে হয়তো।
কিন্তু উঠতে গেলেই যদি উল্টে পড়ে সব?
স্তূপটা পরীক্ষা করে দেখে মাথা দোলাল কিশোর, হুঁ, পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
রয় শাবল নিয়ে ফিরে এলে মুসা বলল। যে ভাবে আছে এ ভাবেই খোলার চেষ্টা করতে হবে।
যে ট্রাংকটায় আটকে আছে ডগলাস, সেটার দিকে কাত হয়ে মুসা বলল, ডগলাস, একটা ভেজালে পড়ে গেছি আমরা। আপনার ওপরের গাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে নাড়া লাগলেই উল্টে পড়ে যাবে।
ক্রেনটা নিয়ে এসে ওপরের গাড়িটা সরিয়ে ফেলা যেতে পারে, রয় বলল।
না না! ট্রাংকের ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠল ডগলাস। ক্রেনটায় গণ্ডগোল আছে। আমি ওটা মেরামত করে সারতে পারিনি।
তাহলে আর কি, জবাব দিল মুসা। দেখি এই অবস্থায় কতটা কি করতে পারি।
ট্রাংকের তালার নিচের ফাঁকটায় শাবলের মাথা ঢুকিয়ে দিল মুসা। বলল, ডগলাস, রেডি! ট্রাংকের ডালা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে চলে আসবেন।
শাবলের চাড় পড়তেই তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ হতে লাগল। চাপ লাগছে যে। মাথাটায়, গাড়ির সে-দিকটা নিচু হয়ে গেল।
ওপরের গাড়িটাতে টর্চের আলো স্থির রেখেছে কিশোর। গাড়ির পেছন দিকটা নিচু হয়ে গেছে অনেক। মুসা, সাবধান। আস্তে চাপ দাও।
শাবলে হাতের চাপ কমিয়ে ফেলল মুসা। কিন্তু চাপ ছাড়া খুলব কি করে?
আস্তে আস্তে চাপ বাড়িয়ে দেখো কি হয়।
ওপরের গাড়িটার দিক থেকে চোখ সরাচ্ছে না কিশোর। মুসা চাপ কমাতেই স্থির হয়ে গেল ওটা। ঠিক আছে। চাপ দাও আবার।
ট্রাংকের মধ্যে শাবলের মাথাটা আরও কয়েক ইঞ্চি ঢুকিয়ে দিল মুসা। ধীরে ধীরে চাপ বাড়াতে থাকল। বাঁকতে শুরু করেছে তালার কাছটা।
থামো! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
চাপ কমিয়ে দিল মুসা। ওপরের গাড়িটাকে দুলুনি বন্ধ হওয়ার সময় দিল।
ডগলাস, ডেকে বলল মুসা, আবার! রেডি!
শাবল দিয়ে জোরে এক চাড় মারল মুসা। লাফ দিয়ে ওপরে উঠে গেল ট্রাংকের ডালা। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগল দ্বিতীয় গাড়িটাতে। দুলুনি অনেক বেড়ে গেল ওপরের গাড়িটার।
উঠে বসতেও প্রচুর সময় লাগিয়ে দিল ডগলাস। ঠাণ্ডার মধ্যে এ ভাবে আটকে থেকে আড়ষ্ট হয়ে গেছে শরীর। বড় বেশি ধীরে নড়ছে। শাবলটা ফেলে দিয়ে তার হাত চেপে ধরল মুসা।
পড়ে যাচ্ছে! চিৎকার করে উঠল রয়।
পেছনে ঢলে পিছলে পড়তে শুরু করেছে ওপরের গাড়িটা। দৌড়ে সরে গেল। রয়। লাফ দিয়ে গিয়ে সামনে পড়ল কিশোর। ডগলাসের আরেক হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। সে আর মুসা মিলে প্রায় চ্যাংদোলা করে বের করে নিয়ে এল ডগলাসকে। তাল সামলাতে না পেরে তুষারের ওপর পড়ে গেল তিনজনেই। নিচে পড়ল ওপরের গাড়িটা। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল ওরা। ময়লা সহ তুষারের কণা এসে ছিটকে পড়ল ওদের গায়ে।
খাড়া হয়ে রয়েছে গাড়িটা। হুডের প্রায় পুরোটাই ঢুকে গেছে কঠিন বরফে।
চলুন এবার ভেতরে যাওয়া যাক, মুসা বলল।
কি মনে করে এখানে এসেছিলে তোমরা? জিজ্ঞেস করল ডগলাস। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে গিয়ে দেখল ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না। ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে যাওয়া পা ফেলে কোনমতে খুড়িয়ে হাঁটতে লাগল।
আপনার ট্রাক নিয়ে আমাদের ভয় দেখাতে গিয়েছিল কেউ, মুসা বলল। লেকের মাঝখানে।
আমি যাইনি। যাওয়ার অবস্থায় যে ছিলাম না দেখলেই তো। অফিসের দিকে এগোনোর সময় শঙ্কিত ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাল ডগলাস। পুটি কোথায়?
অফিসের ভেতরে, জবাব দিল কিশোর। মনে হয় ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে।
খোঁড়াতে খোঁড়াতেই দৌড়ে গিয়ে অফিসে ঢুকল ডগলাস। হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল কুকুরটাকে।
কি করেছে তোকে ওরা, পুটি!
আধখাওয়া মাংসের টুকরোটার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল কিশোর। সাদা পাউডার ছড়ানো রয়েছে মাংসের ওপর। বলল, যা অনুমান করেছিলাম। ঘুমের ওষুধ গুঁড়ো করে দিয়েছে। আরও কিছুক্ষণ গভীর ঘুম ঘুমাবে।
ঘুমটা ভাঙলেই বাঁচি, উদ্বিগ্ন শোনাল ডগলাসের কণ্ঠ। মাটিতে থাকলে ঠাণ্ডা লাগবে, সে-জন্যে কুকুরটাকে কাউচে শুইয়ে দিল সে।
পুলিশকে ফোন করে আসি, মুসা বলল।
ডগলাসকে বলল কিশোর, সাইডারের রস গরম করে দেব? খাবেন? গা গরম হবে।
কালো কফি। ফুটন্ত। এবং অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে।
দিচ্ছি।
বাধা দিল রয়, তুমি বসো। আমিই যাচ্ছি। আমারও লাগবে কফি।
মুসা বলল, আমিই বা আর বাদ যাই কেন? যা ঠাণ্ডার ঠাণ্ডা!
ঠিক আছে, আমার জন্যেও এনো, রয়কে বলে ডগলাসের দিকে ফিরল কিশোর। আপনাকে আটকেছিল কে?
দুটো লোক। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার মাথায় একটা ব্যাগ পরিয়ে দিয়ে বয়ে নিয়ে গেল বাইরে।
চিনতে পেরেছেন?
কালো স্কি মাস্ক পরে ছিল মুখে। চেহারা দেখিনি।
কিছু বলেছে?
ভয় দেখিয়েছে।
গলা চিনতে পেরেছেন?
পরিচিতই লেগেছে। তবে চিনতে পারিনি।
জ্যাকসনের নাতিরা না তো?
কুকুরটার গায়ে হাত বোলানো থেমে গেল ডগলাসের। ঠাট্টা করছ?
না।
তাই তো! ঠিকই বলেছ তো! আকার-আকৃতিতে মিলে যায়। গলাটাও ওদেরই মনে হচ্ছে এখন।
ধূমায়িত কফির কাপ নিয়ে হাজির হলো রয়। পেছনে এল মুসা।
পুলিশ আসছে, জানাল সে।
ডগলাস, লেকটার ব্যাপারে আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি? লেকের ম্যাপটা বের করে ডগলাসকে দেখাল। এই স্পটগুলো দেখুন। কিছু বুঝতে পারছেন?
কি বলতে চাও তুমি? ম্যাপের দিকে তাকাল ডগলাস।
জায়গাগুলোর তালিকা করে লুকিয়ে রেখেছে জ্যাকসনের নাতিরা।
কেন?
সেটাই তো জানার চেষ্টা করছি। আইস ফিশিঙের জন্যেও করা হয়ে থাকতে পারে।
কি যেন ভাবল ডগলাস। উঠে গিয়ে ডেস্কের কাগজপত্রের ভেতর থেকে লেকের একটা ছেঁড়াফাটা ম্যাপ বের করল। পেন্সিল দিয়ে গিজিগিজি করে প্রচুর নোট লেখা তাতে।
দুটো ম্যাপ পাশাপাশি রেখে কয়েক মিনিট মিলিয়ে দেখল। তারপর মাথা নাড়ল, তুমি শিওর, এই ম্যাপটা আইস ফিশিঙের জন্যে করা হয়েছে?
না, শিওর না, জবাব দিল কিশোর।
আমার ধারণা মাছ ধরার জন্যে চিহ্নিত করেনি। ফিশিং স্পট হিসেবে মোটেও ভাল না জায়গাগুলো। ভীষণ বিপজ্জনক। দুএক জায়গায় বঁড়শি ফেলে দেখেছি। খায় না তেমন। অকারণ ঝুঁকি নেয়া। রয়ের ম্যাপটার একটা ক্রস চিহ্নে আঙুল রাখল। এ জায়গাটার নিচ দিয়ে তীব্র স্রোত বয়। বরফকে কোনমতেই একভাবে থাকতে দেয় না। দিনের শেষ ভাগে এখানে রোদও পড়ে বেশি।
তাতে কি? মুসার প্রশ্ন।
রোদ মানেই গরম। আর গরমে বরফের ওপর দিকটা গলে যায়। রাতে আবার শক্ত হয়। এ রকম করতে থাকলে দুর্বল হয়ে যায় বরফ। ওসব জায়গায় মাছ ধরতে গেলে প্রাণের ঝুঁকি নিতে হবে। কে যায়?
তবে অন্য কোন লাভজনক কারণে কেউ ঝুঁকি যদি নিতে চায় নিতে পারে, তাই না? কিশোর বলল।
কোন কারণেই নিতে চাইবে না কেউ। মাথায় যদি সামান্যতম ঘিলু থাকে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা পড়লে বরফের পাতলা স্তরও ভীষণ শক্ত থাকে। তখন বোঝাটোঝা কম নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কি কারণে যাবে?
কারণ, মাছ শিকারীরা কেউ ওদিকে যায় না। রহস্যময় কণ্ঠে বলল কিশোর।
পুলিশ এল। ডগলাসের বক্তব্য শুনল। ওষুধ মেশানো মাংসের টুকরোটা দেখল। একটা ব্যাগে তুলে নিল গবেষণাগারে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করানোর জন্যে। তারপর ডগলাসকে সাবধান থাকতে বলে চলে গেল।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বয় বলল, আজকের মত তো শেষ হলো। কাজ। বাড়ি গিয়ে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করছে।
চিন্তা নেই। পৌঁছে দেব, কিশোর বলল। কিংবা এত রাতে আর বাড়ি ফিরে না গিয়ে চলো শার্লিদের ওখানেই চলে যাই। বাড়িতে মাকে একটা ফোন করে দিয়ো, রাতে ফিরছ না।
তা কথাটা মন্দ বলোনি, অরাজি হলো না রয়। ঠিক আছে, চলো। এত কাছে এসে রবিনকে না দেখে গেলে রাগ করবে। তা ছাড়া এখানে কম্বলের নিচে ঢোকাটাও তাড়াতাড়ি হবে।
হেসে ফেলল মুসা আর কিশোর।
.
১৩.
পরদিন সকাল সকালই উঠে বাড়ি রওনা হয়ে গেল রয়। জানিয়ে গেল, বিকেলের আগে সময় দিতে পারবে না। স্কুলে যেতে হবে। জরুরী আরও একটা কাজ আছে। শেষ করে তারপর আসবে। বার বার করে বলে গেছে, তাকে বাদ দিয়ে যেন কোনমতেই স্পটগুলোতে খুঁজতে না যায় তিন গোয়েন্দা। হুমকি দিয়েছে, তাহলে চিরকালের শত্রুতা হয়ে যাবে।
দিনের অনেকটা সময়ই তদন্তের কাজে ঘুরে বেড়াল মুসা আর কিশোর। ডগলাসের ট্রাকটা দেখতে পেল বনের ভেতর। পরিত্যক্ত অবস্থায়।
রবিন সারাটা দিনই বিশ্রাম নিল।
বিকেলে আসার আগে ফোন করল রয়। জানাল, সে রওনা হচ্ছে।
কিশোর বলল, রয়, একটা মেটাল ডিটেক্টরও দরকার আমাদের। সেই সঙ্গে কালকের ম্যাপ আর তোমার জিপিএসটা তো আনবেই।
ডোবার কগনানকে ফোন করল সে। চলে আসতে বলল। বলল, পাইনভিউ লেকের চুরিগুলোর ব্যাপারে মূল্যবান তথ্য দিতে পারবে। তারপর ফোন করল পিটারকে। মিস্টার মরগানের বাড়িতে আসতে বলল সবাইকে।
পনেরো মিনিটের মধ্যেই চলে এল পিটার।
রয় আসতে আসতে সন্ধ্যা করে ফেলল। অন্ধকার হয়ে গেছে ততক্ষণে।
গাড়ির শব্দ শুনেই বেরিয়ে গেল তিন গোয়েন্দা আর পিটার।
হাসিমুখে গাড়ি থেকে নামল রয়। কাঁধে জিনিসপত্রের ব্যাগ। এক হাতে মেটাল ডিটেক্টর, অন্য হাতে একটা হালকা কুড়াল আর একটা আইস পিক।
ওর ভঙ্গি দেখে বলে উঠল মুসা, খাইছে! মেরু অভিযানে যাবে নাকি?
হেসে জবাব দিল রয়, বরফ কাটতে কাজে লাগবে। বাড়তি যদি না থাকে এখানে, সেজন্যে নিয়ে এলাম।
আর কারও সাহায্য দরকার হবে? জিজ্ঞেস করলেন মরগান আঙ্কেল। নিজের কথাই বোঝালেন তিনি।
আপাতত লাগবে না, কিশোর বলল। লাগলে জানাব।
হতাশ মনে হলো আঙ্কেলকে। তবে আর কিছু বললেন না। উঠে গিয়ে বসলেন বেশ কিছুটা দূরে। বেলী আন্টি আর শার্লি যেখানে বসে টিভি দেখছে।
বলে বলে হাল ছেড়ে দিয়েছেন বেলী আন্টি। গোয়েন্দাদের কাজে বাধা দিতে এলেন না আর। এমনকি ওদের কথার মধ্যেও এলেন না। ওদের কর্মকাণ্ড গা সওয়া হয়ে গেছে গত কয়েক দিনে।
কার কি কাজ, ভালমত বুঝিয়ে দিতে লাগল কিশোর। পিটারকে বলল, পিটার, তুমি আর রবিন গিয়ে জ্যাকসনদের ওপর নজর রাখবে। যদি বোঝে ওরা আমাদের ওপর হামলা চালাতে আসছে, শিস দিয়ে সঙ্কেত, দেবে। তিনবার। শিস-দুবার ছোট, একবার লম্বা। যাও, দশ মিনিট সময় দিলাম। অবস্থান নাওগে।
আরনির বাড়িতে ছুটল পিটার আর রবিন। বনের ভেতর দিয়ে এগোল যাতে চোখে পড়ে না যায়। জ্যাকসনের বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখল ভেতরে আলো ওলছে। বেশি কাছে যাওয়ার সাহস পেল না ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। তবে নিজেদের নিয়ে চিন্তিত নয় রবিন-বাড়িটার বেশি কাছে না গেলেই হলো, ভাবছে। কিশোরদের কথা। ওদের বরফ কাটার শব্দ যদি শুনে ফেলে জ্যাকসনরা?
ভেবে লাভ নেই। যা হবার হবে। যেটা করতে বলা হয়েছে ওদের, সেটাই করল। দুজন দুদিকে সরে গিয়ে দোকানের দুটো প্রবেশ পথের দিকে লক্ষ রাখতে লাগল।
রবিনদেরকে অবস্থান নেয়ার সময় দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিলোর। মুসা, আর রয়কে নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। লেকের দিকে রওনা হলো।
ঠাণ্ডা নির্মল রাত। চাঁদের আলোয় আলোকিত লেকের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, যাক, আবহাওয়াটা ভালই আজ। কালকের মত না। কাজ করতে অত কষ্ট হবে না।
ডোবার তো এল না এখনও, রয় বলল।
বলেছে যখন, আসবে, বলল কিশোর। কোন কারণে দেরি হচ্ছে আরকি। আসার আগেই দেখি কাজটা শেষ করে ফেলতে পারি কিনা আমরা।
হাতের লম্বা লাঠির মত জিনিসটা দিয়ে খোঁচা দিতে দিতে এগিয়ে চলল কিশোর। আগের দিন যে স্পটগুলো দেখেছে, সেগুলোতে গেল না আর।
তাকে অনুসরণ করল রয়। হাতের জিপিএসটার দিকে চোখ। যন্ত্রটার এলসিডি স্ক্রীন থেকে সবুজ আভা বেরোচ্ছে।
হঠাৎ বলে উঠল, ডানে!…হ্যাঁ হ্যাঁ, আরেকটু ডানে।
জিপিএস পকেটে রেখে দিয়ে মেটাল ডিটেক্টরের দিকে নজর দিল সে। কানে হেডফোন লাগানোই আছে। কিশোরের পাশ কাটিয়ে আগে চলে গিয়ে ডিটেক্টরের সাহায্যে তুষারে ঢাকা বরফের মধ্যে খুঁজতে শুরু করল। কয়েক বর্গগজ খুঁজেই থেমে গেল আচমকা।
এখানেই আছে, চেঁচিয়ে উঠল সে।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মুসা আর কিশোর। আগের রাতের মত হাত দিয়ে তুষার সরাতে লাগল, ডিটেক্টরটা যেখানে নির্দেশ করছে ঠিক সেই জায়গায়। বেরিয়ে পড়ল সাদা বরফ।
কুড়াল দিয়ে কোপানো শুরু করল মুসা। কঠিন বরফে আঘাত হানার শব্দ লেকের পাড়ে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে এল। শব্দ না করে কাটা সম্ভব না।
প্রায় এক বর্গগজ জায়গায় ইঞ্চি পাঁচেক বরফ কাটা হতেই বেরিয়ে পড়ল অনেকগুলো টিনের পাত নিয়ে গোল করে পাকানো একটা বল।
কালকের মতই তো টিনের পাত। কাল ছিল একটা। আজ অনেকগুলো।
বলটায় মাছ ধরার সুতো বাঁধা, দেখতে পাচ্ছ? কিশোর বলল। কালকেরগুলো পরিত্যক্ত জায়গা। কাজ সেরে চলে যাওয়ার সময় টিনের পাতগুলো সরানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। কল্পনাই করেনি হয়তো, এ সব জায়গায় খুঁজতে আসবে কেউ।
আইস পিক দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে টিনের বলটার চারপাশের তুষার সরিয়ে ফেলল সে।
ভাল করে দেখার জন্যে মাথা বাড়িয়ে দিল রয়।
দস্তানা খুলে ফেলল কিশোর। বলটাকে শক্ত করে ধরে বরফ থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। উঠে আসতে শুরু করল ওটা। টান লাগল। ওটার সঙ্গে বাঁধা সুতোটায় টান পড়ল।
সুতোর চারপাশের বরফ কুপিয়ে কেটে ফেলতে শুরু করল মুসা। থেমে গেল হঠাৎ। শিসের শব্দ। দুবার খাটো। একবার দীর্ঘ।
*
জ্যাকসনের বাড়ির পেছনের ঘরের জানালায় টেলিভিশনের আলো নড়াচড়া করতে দেখছিল রবিন। হঠাৎ দেখে দুটো কালো ছায়ামূর্তি দোকানের সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
জ্যাকি আর রকি, রাতের বাতাসকে উদ্দেশ করে যেন ফিসফিসিয়ে বলল রবিন।
কি করব এখন? একই ভঙ্গিতে ফিসফিস করে জবাব দিল পিটার।
চমকে গিয়ে ফিরে তাকাল রবিন। কথামত কাজ না করায় রেগে গেল। পিটারের ওপর। তোমার এখানে কি?
একা একা ওখানে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন কি করব আমরা?
রাগটা চেপে রাখল রবিন। বলল, ওরা সরলেই সাবধান করে দিতে হবে কিশোরদের।
দৌড়ে দোকানের পেছন দিকে চলে গেল দুই ভাই। একটু পরেই ইঞ্জিনের গর্জন শোনা গেল। রবিনরা দেখল স্নোমোবাইলে চড়ে লেকের দিকে ছুটে যাচ্ছে দুজনে।
*
দ্রুত হাতে তখন ঠাণ্ডা পানি থেকে সুতোটাকে টেনে তুলছে কিশোর। কানে এল ইঞ্জিনের শব্দ।
স্নোমোবাইল, রয় বলল।
আলো নেভাও, বলে উঠল কিশোর।
দ্রুত টর্চ নিভিয়ে ফেলা হলো। তবে চাঁদের আলোতেও সাদা বরফের ওপর তাদের আকৃতি বহুদূর থেকে চোখে পড়বে।
সুতো টানা বন্ধ করল না কিশোর। আজকে জিনিসগুলো বের করেই ছাড়বে। তার আগে কিছুতেই যাবে না লেক ছেড়ে।
সুতো শেষ হলো। শেষ মাথায় বাঁধা রয়েছে একটা মোটা দড়ি। দড়ি ধরে টানতে লাগল।
কাছে চলে আসছে স্নোমোবাইলের ইঞ্জিনের শব্দ।
সরে যাওয়া দরকার, রয় বলল।
দড়িটাও শেষ হলো। মাথায় বাঁধা একটা কালো রঙের প্লাস্টিকের ব্যাগ। মুখটা খুলল কিশোর। চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠল ভেতরের রূপালী জিনিস।
কাছে চলে এসেছে স্নোমোবাইল।
কিশোর, চলে এসো, জরুরী কণ্ঠে রয় বলল।
ব্যাগের মুখটা আবার বেঁধে ফেলতে লাগল কিশোর। তোমরা দৌড়াতে থাকো। আমি আসছি। একেকজন একেক দিকে যাও।
দৌড়ানো শুরু করল রয়। মুসা ছুটল তার পেছনে।
ইঞ্জিনের গর্জন বাড়ছে। কাপুনি টের পাওয়া যাচ্ছে বরফে।
ব্যাগের মুখ বাঁধা হয়ে গেছে কিশোরের। ওটাকে টেনে নিয়ে দৌড় দিল সে ও।
.
১৪.
ডগলাস বলেছে স্পটগুলো বিপজ্জনক। প্রমাণ পেল এখন। মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে বরফ ভাঙার শব্দ কানে এল কিশোরের।
জায়গাটা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান সোমোবাইল চালকের। কি করতে হবে জানা আছে। সোজা না এসে, অনেকখানি ঘুরে চক্কর দিয়ে এগোতে শুরু করল। কিশোরের দিকে। যে ভাবেই হোক ওরা বুঝে গেছে চোরাই মাল কিশোরের কাছেই আছে।
বরফ ভাঙার শব্দ বাড়ছে। জমাট বরফের মত স্থির হয়ে গেল কিশোর। নড়লেই মুহূর্তে এখন বরফ ভেঙে নিচে পড়ে যাবে। যদি না নড়ে তাহলেও বিপদ। স্নোমোবাইল চালক এগিয়ে এসে ঝাঁকুনি দিয়ে ভেঙে দেবে। তাতেও নিচে পড়ে যাবে সে।
ওরা ভাঙলে অন্য একটা সম্ভাবনাও আছে। স্নোমোবাইল নিয়ে ওরাও নিচে পড়ে যেতে পারে। মরলে ডাকাতগুলোকে নিয়েই মরা উচিত। তৈরি হয়ে দাঁড়াল। সে।
শেষ মুহূর্তে কয়েক ইঞ্চির জন্যে মিস করল ওকে স্নোমোবাইল। কারণ চালকের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ঝাঁপ দিয়ে বরফের ওপর পড়ে গেছে কিশোর। গায়ের কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে শাই করে চলে গেল ইস্পাতের ভারী আইস বারের মাথা। আগের জায়গায় থাকলে হয় শিকটা শরীরে গেঁথে যেত, নয়তো মাথায় বাড়ি খেত।
মুসার চিৎকার শুনে মাথা উঁচু করে দেখল সে, ওকে পড়ে যেতে দেখে ছুটে আসছে মুসা।
পালাও, মুসা! এসো না! চিৎকার করে উঠল কিশোর। মুসার দিকে ছুটে যাচ্ছে এখন স্নোমোবাইল।
ঘুরে আবার দৌড় দিল মুসা। স্নোমোবাইলের সঙ্গে পারল না।
পৌঁছে গেল স্নোমোবাইল। রকি চালাচ্ছে। জ্যাকি পেছনে বসা। হাতের আইস বারটা দোলাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে কিশোরের মতই একপাশে ঝাঁপ দিল মুসা। ওর গায়েও লাগাতে পারল না জ্যাকি।
থামল না স্নোমোবাইল। ছুটছে। পৌঁছে গেল রয়ের কাছে। কিশোর কিংবা মুসার মত অতটা ক্ষিপ্রতা দেখাতে পারল না রয়। হাঁটুর পেছন দিকে আইস বারের প্রচণ্ড বাড়ি খেল সে। প্রায় ডিগবাজি খেয়ে পড়ল।
শীতল বরফের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে কিশোর। চড়চড় শব্দ তুলে ভেঙে যাচ্ছে বরফ। টুকরোটা কতখানি বড় হয়ে ভাঙবে তার ওপর নির্ভর করছে তার বাঁচা-মরা। বেশি ছোট হলে উল্টে যাবে। পানিতে তলিয়ে যাবে সে। আর বড় হলে তার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থেকে ভেলায় ভাসার মত ভেসে থাকতে পারবে। চারপাশের বরফ ভাঙার শব্দ হৃৎপিণ্ডটাকে যেন খামচে ধরছে। একভাবে পড়ে থেকে জ্যাকি আর রকির ফেরত আসার অপেক্ষা করতে লাগল।
কতখানি দূরে আছে ওরা দেখার জন্যে আবার মাথা তুলল সে। অবাক হয়ে গেল দুটো মূর্তিকে স্কেইট করে স্নোমোবাইলটার দিকে ছুটে যেতে দেখে। মুসাকে দৌড়ে আসতে দেখল তার দিকে।
বরফ যেখানে ভাঙছে সেখান থেকে খানিকটা দূরে এসে থেমে গেল মুসা।
কাছে এসো না! বরফ ভাঙছে, চিৎকার করে উঠল কিশোর। সরে যাও! সরে যাও! নিজের মাথার পেছন দিকে ইঙ্গিত করল। মেটাল ডিটেক্টরটা তুলে নাও।
দৌড়ে গিয়ে বরফের ওপর পড়ে থাকা মেটাল ডিটেক্টরের লম্বা ডাণ্ডাটা ধরে তুলে নিল মুসা। কি করব এটা দিয়ে?
মধ্যযুগীয় নাইটরা কি করে যুদ্ধ করত মনে আছে?
আগে কি আর জানতাম এখন কাজে লাগবে? তাহলে ইতিহাসের ক্লাসে কখনোই অমনোযোগী হতাম না।
বল্লমের মত ব্যবহার করতে পারো নাকি দেখো। তাহলেই চলবে।
বুঝলাম। আমি যাচ্ছি। ফিরে এসে যেন করফের ওপরই পাই তোমাকে, মুসা বলল।
পাবে, হেসে জবাব দিল কিশোর। সাঁতার কাটার এক বিন্দু ইচ্ছেও আমার নেই।
ঘুরে কিশোরদের দিকে আসছে এখন স্নোমোবাইলটা। পেছন পেছনে তাড়া করে আসছে ছায়ামূর্তি দুটো। কাছে আসতেই বোঝা গেল মূর্তি দুটোর একজন রবিন, আরেকজন পিটার।
ড্রাইভারটাকে বাড়ি মেরে ফেলে দিতে পারো নাকি দেখো, মুসাকে বলল কিশোর।
দৌড় দিল মুসা। ঝাঁকি লেগে বরফের টুকরোটা মূল বরফের গা থেকে আরও খানিক ছুটল, কিশোর যেটাতে পড়ে আছে।
তিন দিক থেকে স্নোমোবাইলটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে মুসা, রবিন আর পিটার। মুসার হাতের মেটাল ডিটেক্টরের ডাণ্ডাটা মনে হলো বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে ওদের। এগোলেই বাড়ি খাবে বুঝে গেছে। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। চক্কর দিয়ে স্পীড বাড়িয়ে তীব্র গতিতে ছুটে আসতে শুরু করল মুসাকে লক্ষ্য করে।
জোরে চড়চড় করে উঠল বরফ। লড়াইটার দিকে আর নজর দিতে পারল না কিশোর। চোখ ফেরাতে হলো নিজের চারপাশের বরফের দিকে। কানে এল মুসার ইয়াহু চিৎকার। পরক্ষণে ধাতুর সঙ্গে ধাতুর বাড়ি লাগার শব্দ। নিশ্চয় ডিটেক্টরের ডাণ্ডা আর আইস পিকের সংঘর্ষ হয়েছে। তারপর হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেল সব। কৌতূহল দমন করতে পারল না কিশোর। দেখার জন্যে মাথা উঁচু করতেই হলো তাকে।
দেখল স্নোমোবাইলটা ছুটে আসছে তার দিকে। ইঞ্জিন বন্ধ। গায়ের ওপর এসে পড়তে আর সামান্যই বাকি। ক্ষণিকের জন্যে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল বাতাস। পরক্ষণে কানের কাছে বিকট এক গর্জন শুনতে পেল সে। তারপর ঝাঁকি। সবশেষে দুলুনি। তলিয়ে যাবার আগের মুহূর্তে দেখল স্নোমোবাইলটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। পানিতে পড়ে একে অন্যকে মই বানিয়ে বেয়ে ওপরে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেছে রকি আর জ্যাকি।
*
বাঁচাও! বাঁচাও! বরফ পানিতে হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করে উঠল রকি।
চোরাই মাল বাঁধা দড়িটার একপ্রান্ত থাবা দিয়ে তুলে নিল মুসা। সাবধানে এগোল বরফের মাঝখানের বিশাল গর্তটার দিকে। ওখানেই পড়েছে কিশোর, রকি, জ্যাকি আর স্নোমোবাইলটা। গর্তটা বড় বলেই আবার মাথা তুলতে পেরেছে ওরা, স্রোতের টানে রবিনের মত নিচে চলে যায়নি। বরফের স্তর এত পুরু, বেয়ে ওপরে ওঠা অসম্ভব।
দড়ির মাথাটা কিশোরের দিকে ছুঁড়ে দিল মুসা। ধরো জলদি!
গাধা নাকি! কোথায় ছুঁড়েছে? আমি তো এখানে, ধমকে উঠল জ্যাকি।
অন্ধকারে দাপাদাপি করছে কিশোর। দড়িটা খুঁজে পেল না।
তুলে এনে আবার ছুঁড়ে মারল মুসা। এবার ধরতে পারল কিশোর।
বরফকে বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। ভাঙা গর্তের এতটা কিনারে চলে এসেছে, যে কোন মুহূর্তে ওর ভারে ওই জায়গাটাও ভেঙে পড়তে পারে। দড়ির আরেক মাথা থেকে ব্যাগটা খুলে ফেলে দিয়ে মাথাটা নিজের কোমরে পেঁচিয়ে নিল। চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে কিশোরকে টেনে নিয়ে সামনে এগোল। যখন বুঝল, এখানে বরফ ভাঙার ভয় আর নেই, উঠে দাঁড়াল।
নাক দিয়ে দম টেনে মুখ দিয়ে ছাড়ল। একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে আগে বাডল। পিচ্ছিল বরফে নিজের দেহটাকে নিয়েই হাঁটা কঠিন, তার ওর ভারী বোঝা টেনে এগোতে হচ্ছে। বার বার পিছলে পড়ার হাত থেকে বাঁচাতে হচ্ছে নিজেকে। গতি বড় ধীর। কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে কিশোর?
যতক্ষণ পারে পারুক। ওসব ভেবে লাভ নেই। নিজের কাজ করে গেল মুসা।
থামা, দম নেয়া, আগে বাড়া!
থামা, দম নেয়া, আগে বাড়া!
কতক্ষণ যে এ রকম করে এগোল বলতে পারবে না। দড়িতে ঢিল পড়তেই ধড়াস করে উঠল বুকের মধ্যে। মনে হলো দড়ি ছেড়ে দিয়েছে কিশোর। কিংবা দড়িটা ছুটে গেছে তার হাত থেকে।
ঘুরে গর্তের দিকে দৌড় দিতে গেল সে। কখন যে চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে। মেঘের নিচে খেয়ালই করেনি। আলো নেই। অন্ধকারে কিছু দেখতে পেল না। কিসে যেন হোঁচট খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। কনুই আর হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে গুঙিয়ে উঠল।
মেঘ সরে গেল চাঁদের মুখ থেকে। আলোকিত হয়ে উঠল আবার মুসার চারপাশের জায়গাটা। কিসের ওপর পড়েছে দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসল। বরফের ওপর লম্বা হয়ে পড়ে আছে কিশোর। নড়ছে না।
কিশোর! চিৎকার করে উঠল মুসা।
সাড়া পেল না।
কিশোরের গায়ে জোরে জোরে ঠেলা দিতে লাগল। কিশোর! এই কিশোর?
পুরোপুরি সরে গেছে মেঘ। উজ্জ্বল তুষারে প্রতিফলিত ফকফকা জ্যোৎস্না। অনেক কষ্টে একটা চোখ মেলল কিশোর। ঠোঁট নীল। ফিসফিস করে বলল, জমে যাচ্ছি!
এত হট্টগোল শুনে লোকজনও ছুটে এল দল বেঁধে।
রকি আর জ্যাকিকে তুলতে গেল কয়েকজন।
চিৎকার করে বলল মুসা, এদিকে আসুন কেউ…কম্বল! স্লেড!
*
দশ মিনিট পর মিস্টার মরগানের বাড়িতে পৌঁছে গেল কিশোর, ডোবার কগনানের গাড়িতে চড়ে। স্নোমোবাইলটা পানিতে পড়ার পর ওখানে গিয়েছিল সে।
রকি আর জ্যাকিকেও তোলা হয়েছে। প্রচুর চাপ পড়ল বেলী আন্টির ওপর। বরফ-পানিতে ডোবা তিন তিনজন মানুষের ভেতরে-বাইরে গরম করতে গিয়ে। হিমশিম খেতে লাগলেন তিনি।
ডাক্তারকে খবর দেয়া হলো।
.
১৫.
ফায়ারপ্লেসের গনগনে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে রবিন, মুসা আর ডোবার কগনান নিজেদের গরম করছে।
রকি আর জ্যাকিই আপনার আসামী; রবিন বলল। মাল চুরি করে নিয়ে গিয়ে বরফের নিচে লেকের তলায় লুকিয়ে রাখে ওরা। পরে সুযোগ সুবিধে মত বের করে। আমাদের ধারণা, ম্যারিল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে ওগুলো। খোঁজ নিয়ে দেখুন। বের করে ফেলতে পারবেন।
ওখানে আর খোঁজ নিতে যাওয়ার দরকার নেই, কঠোর পুলিশী কণ্ঠে বলল ডোবার। ওদের মুখ থেকেই বের করে নেব।
দরজার কাছে হই-চই শোনা গেল। দেখা গেল পিটারের কাঁধে ভর দিয়ে টলোমলো পায়ে ঘরে ঢুকছে রয়।
কোথায় ছিলে এতক্ষণ তোমরা দুজনে? জানতে চাইল ডোবার।
শয়তান জ্যাকিটা ইস্পাতের রড দিয়ে আমার পায়ে বাড়ি মারল, রয় বলল। পায়ে ব্যথা নিয়েই দৌড়াতে থাকলাম…
আমি ওকে দৌড়াতে দেখলাম, পিটার বলল। যে ভাবে ছুটছিল, থেকে থেকেই ভাজ হয়ে যাচ্ছিল পা, বুঝলাম পায়ের অবস্থা কাহিল। বেশি দূর যেতে পারবে না। পিছে পিছে ছুটলাম।
গিয়েছিলে বলেই বেঁচেছি, কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলল রয়। কিভাবে যে লেক থেকে উঠে গিয়ে বনের মধ্যে ঢুকলাম বলতে পারব না। মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। হুঁশ হলে দেখি হাতে বানানো স্ট্রেচারে করে আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে পিটার। ওকে যে আমি কি বলে…
তাকে থামিয়ে দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল পিটার, ছোট্ট এই গল্পটার এখানেই সমাপ্তি।
না, সমাপ্তি নয়, রয় বলল। পিটার, আমাকে বলতে দাও। তুমি আমার পিছু না নিলে বনের মধ্যে আজ মারাই যেতাম। বরফের মধ্যে বেহুশ হয়ে যে ভাবে পড়ে গিয়েছিলাম, হুঁশই হয়তো আর ফিরত না…
থাক থাক, হাত তুলে বাধা দিল পিটার। খবরটা আর ছড়ানোর দরকার নেই। বিরাট হৃদয়ের অধিকারী, মহান উদ্ধারকারী-এ সব বিশেষণে ভুবন বিখ্যাত হয়ে যাব শেষে।
রয়কে বেডরূমে নিয়ে গেল ডোবার। বেলী আন্টি আর ডাক্তার মিলে ওখানে অসুস্থদের সেবা করছেন।
পিটারও ওদের সঙ্গে ঢুকল। ফায়ারপ্লেসের সামনে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।
তারমানে ভাল কাজ একটা করেই ফেললে, পিটারের ওপর থেকে রাগ যায়নি রবিনের। কিন্তু তাই বলে, তোমার জায়গা ছেড়ে সরে আসার কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না আমি। তুমি তখন সরে না এলে ঘটনাটা অন্য রকম ঘটত।
কৈফিয়তের ভঙ্গিতে পিটার বলল, দেখো, রবিন, তুমি তিন গোয়েন্দার একজন। সোনার টুকরো ছেলে। সব সময়ের হিরো। তোমার মত গোয়েন্দা আমি হতে পারব না। সবই মেনে নিলাম। কিন্তু দুই ভাইকে বাধা দিয়ে আমি ঠেকাতে পারতাম না। মারামারি করে পারতাম না ওদের সঙ্গে। পিটিয়ে তক্তা বানাত। তারপর-ঠিকই স্নোমোবাইলটা নিয়ে চলে যেত।
তক্তা বানালে বানাত, নরম হলো না রবিন। মরে তো আর যেতে না। কিন্তু তোমার ভীতুপনার জন্যে কি সর্বনাশটাই না ঘটতে যাচ্ছিল।
যা ঘটেছে সেটা আমি সরে না এলেও ঘটত, পিটার বলল। আমার কথা শেষ করতে দাও। আড়াল থেকে দুই ভাইয়ের কথা শুনেই আমি বুঝেছিলাম স্নোমোবাইল নিয়ে বেরোবে ওরা। চুপচাপ গিয়ে ট্যাংকের সব তেল ফেলে দিলাম। তারপর গেছি তোমার কাছে।
নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ল রবিনের। কি করেছ। তুমি কি করেছ?
রবিনের কথায় কান দিল না পিটার। কেন সরতে না পেরে সোজা গিয়ে বরফ ভেঙে পানিতে পড়ল স্নোমোবাইল? ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে। কেন বন্ধ হলো ইঞ্জিন? ট্যাংকের ইিপ লাইন আর কারবুরেটরের সামান্য তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে।
পিটারকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল রবিনের। আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে ওর একটা হাত ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল।
বাহ্, হাসিমুখে বলল পিটার, হিরো তাহলে শেষমেষ হয়ে গেলাম আমিও। চোরের অপবাদ থেকে হিরো!
*
একটু সুস্থ হতেই জ্যাকি আর রকিকে নিয়ে রওনা হলো পুলিশ। প্রথমে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। পুরোপুরি সুস্থ হলে হাজতে নেবে।
গাড়িতে উঠতে যাবে দুই ভাই, এমন সময় গাড়ি নিয়ে ঢুকল জিথার জ্যাকসন।
ঘটনাটা কি? চিৎকার করে উঠল সে।
আপনি না এলে প্রশ্নটা আমরা আপনার বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, জবাব দিল ডোবার। দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?
দুই ভাইকে ধরে জ্যাকসনের দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করল সে।
রকি! জ্যাকি! বিশ্বাস করতে পারছে না জ্যাকসন। তোদের পুলিশে ধরেছে কেন?
চুরি করেছে, তাই ধরেছি, জবাবটা ডোবারই দিয়ে দিল। এ এলাকায় বেড়াতে এসে দোকানে কাজ করার ছুতোয় আপনার বাড়িতে থেকেছে। রাতে মানুষের বাড়িতে ঢুকে টুকে চুরি-ডাকাতি করেছে। লুটের মাল নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখেছে লেকের বরফের তলায়। গত কয়েক বছর ধরে করছে এ সব। এবারও বাদ দেয়নি।
অবিশ্বাসটা বাড়ল জ্যাকসনের। জ্যাকি, কি বলছে ওরা?
জবাব দিল না জ্যাকি। নীরবে মুখ ফিরিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
রকি?
বুকের ওপর ঝুলে পড়ল রকির মাথা।
এ ভাবে আমার…আমার-কান কাটলি তোরা! গাড়ির গায়ে গিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল জ্যাকসন। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।
.
১৬.
দিন কয়েক পরে আবার একটা পার্টি দিল মরগান আঙ্কেলরা।
গাড়ি ভর্তি করে এল তিন গোয়েন্দা সহ পিটার, রয় ও শার্লির বন্ধুরা। রাস্তার শেষ মোড়টা ঘুরতে চোখে পড়ল ওদের পাইনভিউ লেকের ছবির মত দৃশ্য। কিন্তু এক প্রান্তের আইস-ফিশিং শ্যান্টিগুলোর কাছে একজন মৎস্য শিকারীকেও দেখা গেল না। অন্য প্রান্তে নেই হকি খেলোয়াড়ের দল।
মরগান আঙ্কেলদের মূস্ত লিভিং রূমটাতে ঢুকল ওরা দল বেঁধে। আরও লোককে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। তারা এসে পৌঁছায়নি এখনও।
পিটারের বাবাকেও দাওয়াত দেয়া হয়েছে। তিনিও এসেছেন। বুড়ো জ্যাকসনকে দাওয়াত দেয়া হবে না জেনেই এসেছেন।
ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে. তিন গোয়েন্দা। ঘরে ঢুকলেন পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন, ইউরি রিকম্যান।
কেসটার সমাধান করে দেয়ার জন্যে পুলিশের তরফ থেকে তোমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ, তিন গোয়েন্দাকে বললেন তিনি। হাততালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানাল উপস্থিত মেহমানরা।
আপনাদেরকেও ধন্যবাদ, তিন গোয়েন্দার পক্ষ থেকে জবাব দিল কিশোর। কিন্তু আপনাদের সাহায্য ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারতাম না।
তার কথার সঙ্গে যোগ করল রবিন, আন্টি যে ভাবে জলে ডোবা মানুষগুলোকে বাঁচিয়েছেন, সেটার প্রশংসা না করেও পারছি না।
মাছ শিকারীরা সবে কথা বলা শুরু করেছে পিটার ও তার বন্ধুদের সঙ্গে, ঠিক এ সময় দরজায় দেখা দিল বুড়ো জ্যাকসন।
এক্সকিউজ মী, বিব্রত ভঙ্গিতে বলল সে। দাওয়াত ছাড়াই এসে ঢুকে পড়লাম। কারণ, জানি আজ সবাইকে এখানে একসঙ্গে পাব। আমি আমার নাতিদের হয়ে মাপ চাইতে এসেছি সবার কাছে। ভাবলেই আমার এত খারাপ লাগে…বিশ্বাস করুন, ঘুণাক্ষরেও যদি টের পেতাম, পিটিয়ে সোজা করে ফেলতাম।..
টের পাননি কি আর করা, ক্যাপ্টেন রিকম্যান বললেন। আপনার হয়ে জেলখানার চোর-বদমাশরাই এখন ওদের সিধে করুক।
ঘরের ভেতর চোখ বুলিয়ে পিটার আর তার বাবাকে দেখতে পেল জ্যাকসন। পিটারের কাছে আমি বিশেষ ভাবে মাপ চাইতে এসেছি।
জ্যাকসনের কথা শুনে গুঞ্জন উঠল মেহমানদের মধ্যে।
পিটার, বুড়ো বলল, অকারণে তোমার ওপর দোষ চাপিয়েছিলাম আমি। আমাকে মাপ করে দাও। আমি এখন বুঝতে পারছি, তুমি সত্যিই একটা ভাল ছেলে। আমি যা করেছি তোমার বিরুদ্ধে, সেটা ঠিক করিনি।
ঘরের মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেল পিটায়। জ্যাকসনকে অবাক করে দিয়ে তার হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল। আমি কিছু মনে করিনি, মিস্টার জ্যাকসন।
ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলেন এরপর মিস্টার হিগিনস। জ্যাকসনের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, জ্যাকি, পরস্পরকে ঘৃণা করাটা চালিয়ে যেতেই পারি আমরা, ব্যাপারটা যত খারাপই হোক। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক খারাপের জন্যে গাঁয়ের মানুষকে ঝামেলায় ফেলাটা কি ঠিক হচ্ছে?
এরপর যা ঘটল, বিশ্বাস করতে পারল না মেহমানরা। চোখ বড় বড় করে। সবাই দেখল, হাতে হাত মেলাচ্ছেন মিস্টার হিগিনস আর বুড়ো জ্যাকসন। ঘর ভর্তি মানুষ আনন্দে হুল্লোড় করে উঠল। হাততালি দিতে লাগল।
একটা সত্যি কথা বলি এবার? হেসে বলল জ্যাকসন, বরফের ওপর হকি খেলাটা আমাদের মাছ শিকারীদের জন্যে বরং ভাল। লেকের এক প্রান্তে খেলা চললে ভড়কে গিয়ে ওদিকের সমস্ত মাছ চলে আসবে অন্য প্রান্তে আমাদের দিকে। কাজেই হকি খেলতেই পারে ছেলেরা। আপনারা কি বলেন?
হাসতে শুরু করল শৌখিন মৎস্য শিকারীর দল।
পিটার বলল, তাহলে আর মুফতে খেলতে যাচ্ছি না। খেলে দেয়ার জন্যে। আমাদের টাকা দিতে হবে।
পিটারের কাঁধে হাত রাখলেন ক্যাপ্টেন রিকম্যান। খেলার জন্যে টাকা দেবে কি দেবে না সেটা মেছুয়াদের ব্যাপার। কিন্তু আমার একটা প্রস্তাব আছে। আমি জারি গাড়ি সাংঘাতিক ভালবাসো তুমি। মেরামত করাটা তোমার নেশা। আমি তোমাকে একটা কাজ দিতে চাই। আগামী দুমাস প্রতি শনিবারে গিয়ে আমাদের থানার সবগুলো পুলিশের গাড়িকে টিউনিং করে দিয়ে আসবে!
পিটারের মুখ দেখে মনে হলো, লটারির টাকা পেয়ে গেছে। সত্যি বলছেন?
মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন। মুখে মৃদু হাসি।
ঘরের পরিবেশ হালকা হয়ে এল। পার্টি শুরু হলো সবাই যার যার মত কথা বলছে। গরম সাইডার আর চকলেট খাচ্ছে।
পিটার বলল, মুসা, হয়ে যাবে নাকি একটা হকি ম্যাচ। কালকেই খেলে ফেলতে পারি আমরা।
উঁহু, খেলাটেলা পরে, হাত নেড়ে মানা করে-দিল বুড়ো জ্যাকসন। আগে ওরা আইস-ফিশিং শিখবে। মুসার দিকে ভুরু নাচাল। কি বলো, মুসা আমান? আড়চোখে কিশোরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল সে। ছিপটিপের জন্যে পয়সা দিতে হবে না। কিশোর বলল, তাহলে আমি রাজি। মাথা দুলিয়ে সায় দিল রবিন। তুমি কি বলো, রবিন?