তবে অসহায় বন্ধুটির প্রতি দয়া দেখাতেও কার্পণ্য করেনি সে। যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছিল সে। আর জীবনের শেষবারের মত জন্মদিনের আনন্দের ব্যবস্থা–তাতে ডোরার জন্য বিশেষ কেকের ব্যবস্থা।
জন্মদিনের পার্টির জন্য মিৎসিকে দিয়ে তৈরি করানো হয়েছিল ডোরা বানারের এই কেক–প্যাট্রিক যার নাম দিয়েছিল মধুর মরণ।
আসলে তার জন্য মধুর মৃত্যুরই ব্যবস্থা করেছিল সেদিন শার্লট। পার্টির পরে ডোরা নিজের অ্যাসপিরিনের বোতলটা খুঁজে না পেয়ে শার্লটের বোতল থেকে অ্যাসপিরিন নেবে এমন ব্যবস্থাই করে রাখা ছিল।
ব্যাপারটা এমন ভাবে সাজানো হয়েছিল যে অ্যাসপিরিনের বদলে বিষবড়িগুলো যে লেটিসিয়ার জন্যই রাখা হয়েছিল, তা মনে না হয়ে উপায় নেই।
সুখকর নিদ্রার মধ্যেই যন্ত্রণাহীন মৃত্যু হল ডোরা বানারের। বুদ্ধিমতী শার্ট রইল ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিরাপত্তা রইল অক্ষুণ্ণ।
কিন্তু ডোরাবানার ছিল শার্লটের একাকীত্বের একমাত্র সঙ্গী। নিজের জীবনের কথা বলার মত বন্ধু তার দ্বিতীয় কেউ ছিল না। তাই এই বন্ধুর অভাব তীব্র হয়েই বাজল। তার এই দুঃখ ছিল সত্যিকারের।
-নিজের হাতে বন্ধুকে হত্যা কী ভয়ানক। বললেন বাঞ্চ।
–শার্লট ব্ল্যাকলক আসলে ছিল দুর্বলচিত্ত খুনী। খুনীদের পক্ষে এই দুর্বলতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এরকম দুর্বলেরা যখন ভয় পায়, তখন তারা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে তারা হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর নির্মম। শার্লটের ভয়ের বলি হলেন মারগাটরয়েড।
–মারগাটরয়েড? জুলিয়া বলল।
-হ্যাঁ। মিস হিনচক্লিফ আর মারগারটরয়েড–দুজনে মিলে সেদিনের ঘটনার পর্যালোচনা করেছিলেন। শার্ট ওদের কটেজে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সবই শোনে। আর এখনই তার মনের ভয় দ্বিগুণ হয়ে ওঠে।
রুডি সার্জ আর ডোরা বানার, যাদের কাছ থেকে বিপদ আসার সম্ভাবনা ছিল তাদের সরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল শার্ট। আর কারও কাছ থেকে বিপদ আসতে পারে, এমন কোন ধারণাই তার ছিল না। সে নিশ্চিত জানত তার অপকর্ম আর কারো চোখে পড়েনি।
মিস হিনচক্লিফ থানায় যাওয়ার জন্য যখন গাড়িতে উঠেছেন সেই সময় সম্ভবত মারগাটরয়েড আচমকা আসল ব্যাপারটা আবিষ্কার করতে পারলেন। মানুষ যখন ঠাণ্ডা মাথায় পুরনো কথা মনে করবার চেষ্টা করে তখন অনেক ছোট ছোট বিষয় তার মনে পড়ে যায়। তাই হয়েছিল মারগাটরয়েডের। তিনি চেঁচিয়ে বলেছিলেন…সেই মহিলা ওখানে ছিলেন না।…
আমার ধারণা, মারগাটরয়েড ম্যান্টলপিস থেকেই দৃশ্যপট চোখের সামনে তুলে আনবার চেষ্টা করেছিলেন। তার পরে দুটো জানালা। কেউ কেউ ওদিকে দাঁড়িয়েছিল।
ডোরা বানার তাকিয়েছিলেন ল্যাম্প আর সিগারেট বাক্স হাতে শার্লটের দিকে।
এরপরই শোনা গেল গুলির শব্দ। তারপর থেকেই পর পর সব তার মনে পড়ে যেতে থাকে। দেয়ালে যেখানে গুলি লেগে দাগ হয়েছিল তিনি সেটা দেখেছিলেন। ওই দেয়ালের সামনেই দাঁড়িয়েছিল শার্লট। তার দিকেই গুলি ছোঁড়া হয়েছিল।
মারগাটরয়েডের মনে পড়ে যায় সেখানে, দেয়ালের সামনে শার্লট ছিল না…
মিস হিনচক্লিফ তাকে তিনজন মহিলার কথা ভাবতে বলেছিলেন। তার মধ্যে একজনের কথা তিনি নিশ্চয় বিশেষ ভাবে মনে করতে বলেছিলেন। সেইভাবে ভাবতে গিয়েই মারগাটরয়েডের মনে পড়ে যায় তার কথা। আর তিনি বলে ওঠেন, হিনচ…উনি ওখানে ছিলেন না…
বাঞ্চ বলে উঠলেন, তুমি বোধহয় আগেই বুঝতে পেরেছিলে, তাই না জেন মাসী? কাগজে তো লিখেছিলেন, যখন ল্যাম্পটা ফিউজ হয়ে যায় আমাদের।
-হ্যাঁ প্রিয় বাঞ্চ। তখনই একে একে ঘটনাগুলো মনে পড়ে যেতে থাকে। খাপছাড়া আর রইল না কিছু। বললেন মিস মারপল।
-তুমি লিখেছিলেল্যাম্প…ভায়োলেট…অ্যাসপিরিনের বোতল…। ডোরা বানার তো তার বোতলটা খুঁজে পাননি। বাঞ্চ বললেন।
-হ্যাঁ, তার বোতল কেউ লুকিয়ে রেখেছিল। নয়তো নিজেই ভুলে গিয়েছিলেন কোথায় রেখেছিলেন, তাই তার বন্ধুর অ্যাসপিরিন নেবার দরকার হয়েছিল। এতে বোঝানো হয়েছিল শার্লটকে মারার জন্যই কেউ বোতলে বিষবড়ি রেখেছিল।
শার্লট ডোরা বানারের জন্য পার্টির ব্যবস্থা করে দয়ার পরিচয়ই দিয়েছিল। সে সত্যি কথাটাই বলেছিল রান্নাঘরে–আমি কাউকেই মারতে চাইনি।
আসলে সে যা একান্তভাবে চেয়েছিল তা হল অপর্যাপ্ত অর্থ। শার্লটের জীবনের সব আনন্দই হারিয়ে গিয়েছিল। তাই সে জীবনে যা পায়নি সেই অর্থের বিনিময়ে জীবনের পরিপূর্ণ আনন্দ উপভোগ করতে চেয়েছিল। অর্থের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল সে।
-আয়োডিনের কথা শুনে গলগণ্ডের কথা তোমার মনে হয়েছিল কেন মাসী? বললেন বাঞ্চ।
গলগণ্ডে ভুগছিল শার্লট। লেটিসিয়ার ভূমিকায় থেকে সে আমাকে বোঝাতে চেয়েছিল তার বোন যক্ষ্মারোগে মারা যায়। চিকিৎসার জন্য তাকে সুইজারল্যাণ্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
কিন্তু আমি জানতাম গলগণ্ডের বড় চিকিৎসকরা সুইজারল্যাণ্ডেই আছেন, সেখানেই এই রোগের চিকিৎসা হয়ে থাকে। আয়োডিনের কথা শুনেই তাই আমার সুইজারল্যাণ্ডের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।
আগেই নজরে পড়েছিল তার গলার অদ্ভুত আকারের মুক্তোর মালাটা, এটা যে স্টাইল নয়। বুঝতে আর দেরি হয়নি-সন্দেহ হয় অপারেশানের চিহ্ন ঢাকার জন্যই ওই মালা।
-সে-রাতে মালাটা যখন আচমকা ছিঁড়ে যায়, শার্লটের ব্যবহারও সঙ্গে সঙ্গে কেমন অদ্ভুত বেখাপ্পা হয়ে পড়ে। কিছু বুঝতে না পারলেও ব্যাপারটা আমাকে সন্দিহান করে তুলেছিল। বললেন ক্র্যাডক।