- বইয়ের নামঃ এ মার্ডার ইজ অ্যানাউনসড
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর, রহস্য, গোয়েন্দা কাহিনী
এ মার্ডার ইজ অ্যানাউনসড
১. বিজ্ঞাপন ছাপা হল
এ মার্ডার ইজ অ্যানাউনসড (১৯৫০) – আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ
০১.
রীতিমত চমকে দেবার মত একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হল চিপিং ক্লেগহর্ন গেজেটের বিজ্ঞাপন কলমে।
…একটি খুন হবে শুক্রবার ২৯শে অক্টোবর, সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়, লিটল প্যাডকস-এ। বন্ধুরা অনুগ্রহ করে একমাত্র ঘোষণাটি লক্ষ্য করবেন।
লিটল প্যাডকস হল ভিক্টোরিয়া যুগের আদলে মাঝারি আকারের একটি বাড়ি। বাড়িতে সবার আগে চোখে পড়ে দীর্ঘ বারান্দা আর সবুজ পাল্লার জানালা।
বিরাট দীর্ঘ ড্রইংরুম। একসময়ে এই ঘরখানায় দুটো দরজা ছিল। ঘরের একদিকে জানালা সহ একটা ছোট ঘর। অনেক আগে দুটো আলাদা ঘর হিসেবেই এটি ব্যবহৃত হত। বর্তমানে মাঝখানের বাধা সরিয়ে দুটো ঘরকে একটা ঘরেই বদলে নেয়া হয়েছে।
ঘরের মধ্যে দুপাশে দুটি চুল্লী। তবে এগুলো ব্যবহার করা হয় কম। কেননা বাড়িতে কেন্দ্রীয় তাপচুল্লী রয়েছে।
লিটল প্যাডকস-এর বর্তমান কর্তী মিস ব্ল্যাকলক। তাঁর বয়স ষাট ছুঁয়েছে। তাঁর দূর সম্পর্কের এক ভাইঝি জুলিয়া সিমন্স ও ভাইপো প্যাট্রিক সিমন্স থাকে তার সঙ্গে।
আর আছেন মিস ডোরা বানার-মিস ব্ল্যাকলকের স্কুল জীবনের বান্ধবী। দুজনেই সমবয়স্কা। এই অনাথা বান্ধবীটিকে দেখাশোনার কেউ ছিল না। বৃদ্ধ বয়সের পেনসনেই তার দিন কাটত।
স্কুল জীবনের বান্ধবী। নিতান্ত আবেগ তাড়িত হয়েই মিস ব্ল্যাকলক তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন, এতবড় বাড়ি সামলানোর জন্য তার বিশেষ সাহায্যের দরকার ছিল।
বেচারী ডোরা একটু ভুলো মনের মানুষ। সবসময় সব ব্যাপার খেয়াল রাখতে পারেন না। তার জন্য মাঝে মাঝে বেশ সমস্যায় পড়ে যেতে হয় মিস ব্ল্যাকককে। তবে তাদের উভয়ের মধ্যে স্নেহ প্রীতি আনুগত্য অক্ষুণ্ণই ছিল।
.
সরকারী ভাবে ঘটনাটার তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছিল ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ডারমট ক্র্যাডকের ওপরে।
এই মুহূর্তে তার কাছেই ঘটনার বিবরণ শুনছিলেন মিডলসায়ারের চিফ কনস্টেবল জর্জ রাইডেসডেল।
ক্র্যাডক জানালেন, কনস্টেবল লেগ ফোন করেছিল স্যার। সে ঠিক মতই কাজ করে চলেছে। অবস্থার পর্যালোচনা করছে দ্রুত।
নিহত ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে? জানতে চাইলেন রাইডেসডেল।
-হ্যাঁ স্যর, রুডি সার্জ। জাতিতে সুইস। মেডেনহ্যাম ওয়েলসে স্পা হোটেলে রিসেপসানিস্টের কাজ করত। সার্জেন্ট ফ্লেচার সেখানে গেছে। সে বাসের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করে সেখানে যাবে।
এমনি সময় দরজা খুলে ঘরের ঢুকলেন স্যার হেনরি ক্লিদারিং। দীর্ঘ চেহারার সুপুরুষ চেহারার বয়স্ক মানুষ। ইনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রাক্তন পুলিস কমিশনার।
-ক্র্যাডক নর্থ বেনহ্যাম নিউজ আর চিপিং ক্লেগহন গেজেটে আধ ইঞ্চি পরিমাণ বিজ্ঞাপনটা পড়ে শোনালেন।
-বেশ আগ্রহ জাগানো বিজ্ঞাপন। বলনেল স্যার হেনরি।
–বিজ্ঞাপনটা কে দিয়েছিল? জানতে চাইলেন রাইডেসডেল।
বর্ণনা যা পাওয়া যায় তাতে জানা যায়, রুডি সার্জ নিজেই দেয় বুধবার।
–এর উদ্দেশ্য কি হতে পারে? স্যর হেনরি প্রশ্ন করলেন।
–কি আর উদ্দেশ্য–স্থানীয় মানুষের কৌতূহল জাগানোর চেষ্টা আর কি। রাইডেসডেল বললেন।
–চিপিং ক্লেগহর্ন জায়গাটা কি রকম? স্যর হেনরি প্রশ্ন করলেন।
-বেশ বড় এলাকা। প্রাকৃতিক দৃশ্যময় গ্রাম। কৃষি শ্রমিকদের জন্য ওখানে যেসব কটেজ বানানো হয়েছিল বর্তমানে সেখানে কিছু বয়স্কা অবিবাহিতা মহিলা আর কিছু অবসরপ্রাপ্ত দম্পতির বাস। ভিক্টোরিয় যুগের কিছু বাড়িও আছে।
বোঝা যাচ্ছে, বিজ্ঞাপনটা দেখে স্থানীয় সকলেই যে সন্ধ্যা ছটায় সেখানে ব্যাপার জানতে হাজির হবে তাতে সন্দেহ নেই। সেই বৃদ্ধা মহিলাটি যদি হাজির থাকতেন তাহলে তিনিও নির্ঘাৎ মাথা গলাতেন। বললেন স্যর হেনরি।
-বৃদ্ধা মহিলাটি কে?
–তিনি ঈশ্বরের বিশেষ সৃষ্টি একজন গোয়েন্দা। অসাধারণ প্রতিভাময়ী। সারাক্ষণ এই বয়স্কা অবিবাহিতাকে শুধু সেলাই করতেই দেখা যায়। তিনি তোমাকে অবলীলায় বলে দেবেন কি ঘটতে পারত, আর সত্যিই কি ঘটেছিল। আর এটাও তিনি বলতে পারবেন কেন এটা ঘটেছিল।
–কথাটা মনে রাখব স্যর। বললেন ইনসপেক্টর ক্র্যাডক।
এরপর রাইডেসডেল তাঁর বন্ধু স্যর হেনরিকে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন।
–তোমার অনুমানই ঠিক। পড়শীরা সবাই সেখানে হাজির হয় ৬-৩০ মিনিটে। কিন্তু ওই সুইডিস ছোকরা কি জানত যে তারা সেখানে হাজির হবেই? তাছাড়া লুঠ করে নেবার মত যথেষ্ট জিনিস তাদের কাছে সেই সময় থাকা কি সম্ভব?
স্যার হেনরি বললেন, এটা কোন লুঠ করার ঘটনা নয়। সিনেমার মত ভয় দেখানোর মজা করাই হয়তো উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু লোকটা নিজেকে গুলি করল কি ভাবে?
রাইডেসডেল একটা কাগজ টেনে নিয়ে একপলকে দেখে নিয়ে বললেন, ডাক্তারের প্রাথমিক রিপোর্ট হল রিভলভার ছোঁড়া হয় খুব কাছে থেকে–এটা আত্মহত্যা না খুন বোঝার উপায় নেই।
–রিভলভার সম্পর্কে রিপোর্ট কি?
–বিদেশে বানানো। এর জন্য সার্জের কোন অনুমতিপত্র ছিল না।
–তাহলে তো ছোকরা দেখছি সুবিধের ছিল না। বললেন স্যর হেনরি।
রাইডেসডেল বললেন, ক্র্যাডক, সার্জ সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় কিনা একবার রয়্যাল স্পা হোটেলে গিয়ে খোঁজ নাও।
.
রয়্যাল স্পা হোটেলে পৌঁছে ক্র্যাডক ম্যানেজার মিঃ রোল্যাণ্ডসনের ঘরে উপস্থিত হলেন।
ইনসপেক্টরের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানলেন, সার্জ অতি সাধারণ হাসিখুশি তরুণ বলেই মনে হয়েছে। এ ধরনের ডাকাতি করবার মত তাকে মনে হয়নি।
–আপনার এখানে সে কতদিন ছিল?
–তিন মাসের কিছু বেশি। প্রশংসাপত্র ভালই ছিল।
–মানে-ইয়ে–বলতে
–বোঝা যাচ্ছে কোথাও গোলমাল ছিল। কি সেটা?
–অনেকটা তাই মানে দুই একবার বিল নিয়ে একটু ঝামেলা হয়। এমন কিছু জিনিসের দাম ধরা হয়েছিল যা হোটেলে ছিল না। আর বিলের টাকা মিটিয়ে দেবার সময় সে সেই বাড়তি টাকা আত্মসাৎ করেছিল। এই রকমই কিছু…
–তার জীবনে কোন মেয়ে ছিল?
–হ্যাঁ, মার্না হ্যারিস-গ্রিলের একজন ওয়েট্রেস।
তার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। বললেন ক্র্যাডক।
.
মেয়েটি এককথায় সুন্দরী। চমৎকার মুখের গড়ন। রক্তিম চুল আর তীক্ষ্ণ নাক।
পুলিস দেখে সে বেশ ভীত আর সতর্ক হয়ে পড়েছিল।
–আমি কখনওই ভাবতে পারিনি রুডি এই ধরনের লোক। রিসেপশানে কাজ করতো বলে ভাল বলেই মনে করেছিলাম। এখন দেখছি বিদেশীদের বিশ্বাস করা যায় না। তবে ও খুব শান্ত আর ভদ্র ছিল।
-আপনি তাকে ভাল জানতেন?
-তা বলা যাবে না। তবে আমরা বন্ধু ছিলাম। ওর বেশি কিছু নয়। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি রুডি খুব বড় বড় কথা বলতে চাইত।
–কি রকম বড় বড় কথা? জানতে চাইলেন ক্র্যাডক।
–যেমন সুইজারল্যাণ্ডে ওর আত্মীয়রা সকলেই বড়লোক…অর্থকরী লেনদেনের বাধা-নিষেধের জন্যই সে দেশ থেকে টাকা আনাতে পারে না। আমি অবশ্য কোন গুরুত্ব দিতাম না এসব কথায়। আরও বলত, আল্পস পর্বতে ওঠার কথা…হিমবাহের কাছে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর সব গল্প…
–মিস ব্ল্যাকলকের কথা আপনাকে কখনও বলেছিল?
-না, রুডি তার নাম আমার কাছে কখনও করেনি। তবে জানতাম তিনি এই হোটেলে মাঝে মাঝে মধ্যাহ্ন ভোজ করেন। একবার এখানে থেকেও ছিলেন। আমি জানতাম রুডি তাকে চেনে।
–চিপিং ক্রেগহর্নের কথা কিছু বলেছিল?
–মনে করতে পারছি না।
মার্না হ্যারিসের কাছ থেকে আর কিছু জানা গেল না। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইনসপেক্টর উঠে দাঁড়ালেন।
.
০২.
লিটল প্যাডকস-এর সদর দরজায় এসে দাঁড়াল ক্র্যাডকের গাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে সার্জেন্ট ফ্লেচার বাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো।
–তুমি রয়েছে ফ্লেচার, বলার মত আছে কিছু?
-বাড়িতে খোঁজ নিয়েছি স্যর। সার্জের হাতের নিদর্শন কোথাও পাওয়া যায় নি। বাড়ির দরজা জানালা জোর করে ভেঙে ঢোকার কোথাও চেষ্টা করা হয়নি। মনে হচ্ছে, সে ছটার সময় মেডেনহ্যাম থেকে বাসে এখানে আসে।
শুনলাম বাড়ির পাশের দরজা সাড়ে পাঁচটায় বন্ধ করা হয়। সে সামনের দরজা দিয়েই ঢুকেছিল–বাড়ির পরিচারিকা কিন্তু জানিয়েছে সারা বিকেল দরজা বন্ধ ছিল। মেয়েটা একটু পাগলাটে-ইউরোপীয় উদ্বাস্তুরা যেমন হয়ে থাকে।
-আর কিছু? হাসলেন ক্র্যাডক।
–আলোর ব্যবস্থায় কোথাও কোন গোলমাল দেখা যায়নি। কেবল ড্রইংরুম আর হলঘরের সার্কিটটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আলোর কারচুপিটা সে কি ভাবে করে বুঝতে পারা যাচ্ছে না। ফিউজবক্সে কিছু করতে হলে রান্নাঘরের সামনে দিয়ে যেতে হত তাহলে পরিচারিকার চোখে পড়ত।
–সে সার্জের লোক হতে পারে।
–খুবই সম্ভব স্যর। দুজনেই বিদেশী। তাছাড়া পরিচারিকাটি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ফ্লেচার তার বক্তব্য শেষ করলে ক্র্যাডক সদর দরজায় ঘন্টা বাজালেন।
স্বর্ণকেশী সুন্দরী এক তরুণী দরজা খুলে তাকে ভেতরে নিয়ে গেল।
লিটল প্যাডকস-এর কত্রী মিস ব্ল্যাকলককে নিজের পরিচয় দিলেন ক্র্যাডক। তিনি লক্ষ্য করলেন, মাহিলার বয়স ষাটের কাছাকাছি। বেশ বুদ্ধিমতী আর দৃঢ়তাব্যঞ্জক চেহারা। তাঁর বাঁ কানে ব্যাণ্ডেজ লাগানো।
মহিলার পাশেই বসেছিলেন গোলাকৃতি মুখের প্রায় একই বয়সের একজন স্ত্রীলোক। ক্র্যাডক বুঝলেন ইনিই মিস ডোরা বানার-কনস্টেবল লেগ তার সম্পর্কেই একটা বিশেষণ ব্যবহার করেছিল–খ্যাপাটে।
প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের সুযোগে ক্র্যাডক ঘরটা জরিপ করে নিলেন।
ভিক্টোরিয় যুগের আদলে তৈরি জোড়া ড্রইংরুম। দুটো বড় চেয়ার, সোফা। মাঝখানের টেবিলে বড় পাত্রে রাখা হয়েছে ক্রিসানথিমাম-টাটকা আর সজীব।
–দুঃখজনক ঘটনাটা কি এই ঘরেই ঘটেছিল মিস ব্ল্যাকলক?
–হ্যাঁ।
গতরাত্রে এইঘর একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। বলে উঠলেন মিস বানার। –গতরাতের ঘটনার কথায় আসার আগে আমি একটা কথা জানতে চাই, রুডি সার্জকে আপনি কখন প্রথম দেখেছিলেন?
-রুডি সার্জ…লোকটার ওই নাম? মেডেনহ্যামের স্পা হোটেলে তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল?
-কতদিন আগে?
–প্রায় তিন সপ্তাহ আগে। আমি আর আমার বন্ধু এই ডোরা সেখানে সেদিন মধ্যাহ্নভোজ করছিলাম।
-কোন কথা হয়েছিল।
–আমরা যখন চলে আসি তখন এক তরুণ এগিয়ে এসে বলল, আপনি মিস ব্ল্যাকলক, তাই না? তারপর সে বলল, সে হল মট্রিউর হোটেল দ্য আলপসের মালিকের ছেলে। আমি আর আমার বোন যুদ্ধের সময় সেখানে একমাস ছিলাম।
-ওকে আপনি চিনতে পেরেছিলেন?
-না, চিনতে পারিনি। তবে হোটেলের মালিক অমায়িক মানুষ ছিলেন, তাই তার ছেলের প্রতি সৌজন্য দেখিয়ে বলি, ইংলণ্ডে তার কেমন লাগছে। সে জানায় তার বাবা তাকে ছমাসের জন্য হোটেল ব্যবসা শিখতে পাঠিয়েছে।
তার সঙ্গে আপনার দ্বিতীয়বার কোথায় দেখা হয়?
–প্রায় দিন দশেক আগে। হঠাৎ এখানে এসে হাজির হয়। কিছু টাকা চায় আমার কাছে। জানায় তার মা অসুস্থ, সুইজারল্যাণ্ডে ফিরে যাবার জন্য তার ভীষণ টাকার দরকার।
-লেটি ওকে টাকা দেয়নি। মিস বানার বলে উঠলেন।
-হ্যাঁ; বললেন মিস ব্ল্যাকলক, তখন আমার ধারণা হয়েছিল, ছেলেটি ধাপ্পাবাজ। কেননা তার বাবা স্বচ্ছন্দেই এখানে তার করে তার ফেরার ব্যবস্থা করতে পারতেন। আমার সন্দেহ হয় হোটেলের টাকা তছরুপ করেছিল সে।
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, টাকা না পেয়ে বিনা প্রতিবাদেই চলে গিয়েছিল সে। যেন টাকা পাবে না সে জানত।
–আপনার কি মনে হয়, টাকার অছিলা নিয়ে সে এবাড়ির খোঁজখবর নিতেই এসেছিল? অর্থাৎ গুপ্তচরবৃত্তি
-হ্যাঁ, কথাটা আমারও মনে হয়েছে। কেন না চলে যাওয়ার মুখে সে ঘরগুলো সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিল–তারপরই হঠাৎ সামনে লাফিয়ে সদর দরজা খুলে দেয়। সম্ভবতঃ দরজার খিল দেখতে চেয়েছিল।
-শুনেছি বাগানের দিকে একটা পাশের দরজা আছে।
–হ্যাঁ।
–যখন বাইরে যান তখন ওটা বন্ধ ছিল?
–ভেতরে ঢোকার পর বন্ধ করি।
–সময়টা কি ছটার পরে?
–ওরকমই হবে আন্দাজ।
–আর সদর দরজা?
–ওটা পরেই বন্ধ হয়।
-সার্জের ঢোকার ওটাই ছিল সহজ পথ। হ্যাঁ…পরিষ্কার লুকিয়ে থাকার কোন জায়গা দেখে নেয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল।
কিন্তু ইনসপেক্টর, কেউ এ ধরনের পরিশ্রম কেন করবে–এ বাড়িতে চুরি বা ছিনতাই করবার চেষ্টা কেনই বা করবে?
–এটা কোন চুরির ব্যাপার নয়, মিস বানার বলে উঠলেন, তোমাকে আগেও বলেছি; এ হল প্রতিশোধ। তুমি টাকা দাওনি বলে সে তোমাকে দুবার গুলি ছুঁড়েছিল।
–আচ্ছা, গতরাতে ঠিক কি ঘটেছিল মিস ব্ল্যাকলক?
একটু ভাবলেন মিস ব্ল্যাকলক। পরে বললেন, পড়শীরা অনেকেই উপস্থিত হয়েছিলেন–কিছু ঘটবে বলে সকলেই উদগ্রীব হয়ে ছিল। টেবিলের ঘড়িটা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আলো নিভে গেল।
–কোন্ কোন্ আলো জ্বলছিল?
দেয়ালের ব্রাকেটে আর ঘরের শেষে।
–তারপর?
–আচমকা দরজাটা খুলে গেল।
–কোন্ দরজা? এ ঘরে তো দরজা দুটো।
-এ ঘরের দরজা। অন্য ঘরের দরজা খোলে না। দরজা খুলে গেলে নজরে পড়ল রিভলভার হাতে একজন লোক। সে কিছু বলে উঠেছিল–
-হাত তুলুন না হলে গুলি করব–আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি। বলে উঠলেন মিস বানার।
–আপনারা সবাই হাত তুললেন?
–হ্যাঁ, আমরা সবাই তাই করি। বললেন মিস বানার।
–আমি তুলিনি। পরক্ষণেই আমার কানের পাশ দিয়ে একটা বুলেট বেরিয়ে গিয়ে পেছনের দেয়ালে গেঁথে গেল। কেউ কেউ আর্তনাদ করে উঠেছিল। আমার কানে ভীষণ জ্বালা বোধ করছিলাম।
পরেই কানে এলো দ্বিতীয় গুলির শব্দ। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি অস্থির হয়েছিলাম। মুখোস পরা মূর্তিটা কাত হয়ে পড়ে যায়…পরক্ষণেই আর একটা গুলির শব্দ শুনি। টর্চ নিভে যায়। ঘরে হুলুস্থুলু পড়ে যায়।
–আপনি কোথায় দাঁড়িয়েছিলেন মিস ব্ল্যাকলক?
–ওই টেবিলটার ওপাশে। খিলানের নিচে। আমার হাতে ছিল সিগারেটের বাক্স।
ক্র্যাডক উঠে গিয়ে দেয়ালটা পরীক্ষা করলেন। বুলেটের দুটো গর্ত পরিষ্কার দেখা গেল। রিভলভারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য গুলি দুটো বের করে নেয়া হয়েছিল।
-বরাতজোরে আপনি রক্ষা পেয়ে গেছেন। শান্তস্বরে বললেন ক্র্যাডক।
–লোকটা ওকে গুলি করেছিল, মিঃ বানার বললেন, আমি দেখেছি, লোকটা টর্চের আলোয় সকলকে দেখে নিয়ে ওর ওপর আলোটা ধরে আর গুলি করে তারপর না পেরে নিজেকেই গুলি করে।
–আমার মনে হয় না সে নিজেকে গুলি করতে চেয়েছিল। বললেন মিস ব্ল্যাকলক। আসলে গুলি ছোঁড়ার আগে পর্যন্ত সব ব্যাপারটাই আমার কাছে তামাশা বলে মনে হয়েছিল।
–আপনার এরকম মনে হবার কারণ? এমন অভিনব তামাশাটা কে করতে পারে বলে আপনার মনে হয়েছিল? বললেন ক্র্যাডক।
–প্যাট্রিকের কথাই প্রথমে তুমি মনে করেছিলে লেটি। বললেন মিস বানার।
–কে প্যাট্রিক? তীব্রস্বরে বলে উঠলেন ক্র্যাডক।
-আমার ভাইপো–প্যাট্রিক সীমন্স। বিজ্ঞাপনটা প্রথম দেখে মনে হয়েছিল, সেই মজা করার উদ্দেশ্যে করেছে। তবে সে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছিল।
–একটা খুন হবে পড়ে তুমি খুবই চিন্তিত হয়েছিলে লেটি, বললেন মিস বানার, তার গলার স্বর রীতিমত কাঁপছিল।
-আর কিছু জানতে চান ইনসপেক্টর?
-এবারে আমার জানার দরকার আপনার বাড়িতে ঠিক কতজন আছেন, তাদের সম্পর্কে কিছু কথা।
-হ্যাঁ, আমি আর ডোরা–এই তো দেখছেন। এ ছাড়া রয়েছে দূর সম্পর্কের দুজন বোনপো বোনঝি–প্যাট্রিক আর সীমন্স। ওদের মা ছিলেন আমার মাসতুতো বোন। ওরা আমাকে লেটি মাসী বলে ডাকে।
-ওরা বরাবর আপনার কাছেই আছে?
না, মাত্র দুমাস হল ওরা এসেছে। যুদ্ধের আগে ওরা দক্ষিণ ফ্রান্সে থাকত। প্যাট্রিক নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধের পর ওদের মা আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। পেয়িং গেস্ট হিসেবে আছে। থাকা-খাওয়ার জন্য সামান্য টাকা দেয়। প্যাট্রিক মিলচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আর জুলিয়া মিলচেস্টার জেনারেল হাসপাতালে ডিসপেনসারের কাজ শিখছে।
–শুনেছি ওরা ছাড়াও একজন মিসেস হেমস বলে কে আছেন?
-হ্যাঁ। সে ডায়াস হলে মিসেস লুকাসের বাড়িতে বাগান পরিচর্যার কাজ করে। আমার এখানে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। ও খুবই ভাল মেয়ে। ওর স্বামী ইটালিতে মারা যায়। বছর আটেকের একটি ছেলে আছে, স্কুলে পড়ে।
-বাড়ির কাজের লোকজন
–প্রতি মঙ্গলবার শুক্রবার একজন মালী আসে। সপ্তাহের পাঁচদিন গ্রাম থেকে আসে এক মিসেস হাগিন্স। এছাড়া একজন বিদেশিনী উদ্বাস্তু, মিৎসি তার নাম-সে রান্নার কাজ দেখে। বেচারী, আমার বিশ্বাস জীবনে বড় কোন আঘাত পেয়েছে, তাই সব সময়ই কেমন খ্যাপাটে মনে হয়। ওর ধারণা, সবাই ওকে অপমান করতে চায়। তবে রান্নাটা মোটামুটি করে।
-আমাকে যিনি দরজা খুলে দিয়েছিলেন তিনিই মিস জুলিয়া সিমন্স?
–হ্যাঁ। কথা বলতে পারেন ইচ্ছে করলে। প্যাট্রিক একটু বাইরে গেছে। ফিলিপিয়া হেমসকে ডায়াস হলে পাবেন।
.
০৩.
মিস ব্ল্যাকলক ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। জুলিয়া ঘরে ঢুকে তার খালি চেয়ারে এসে বসল।
–গত রাতের কথাটা আপনার কাছে জানতে চাই মিস সিমন্স। প্রশ্ন করলেন ক্র্যাডক।
–ওহ, গতকাল? একদল মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। কর্নেল আর মিসেস ইস্টারব্রুক, মিস হিনচক্লিফ আর মিস মারগাটরয়েড। মিসেস সোয়েটেনহ্যাম আর এডমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম এবং মিসেস হারমন, মানে ভিকারের স্ত্রী। এভাবেই পর পর তারা এসেছিলেন।
এরা সবাই ভাব দেখাচ্ছিলেন যেন হঠাৎ এসে পড়েছেন। তারপরেই ঘড়ি বেজে ওঠে আর আলো নিভে যায়।
দরজা খুলে একজন মুখোশধারী বলে ওঠে–সবাই মাথার ওপর হাত তুলুন। একদম ফিল্মের ব্যাপার যেন। তারপরেই সেই মুখোশধারী গুলি ছুঁড়ল লেটি মাসীর দিকে।
–ঘটনার সময় সকলে কোথায় ছিলেন?
–সকলে দাঁড়িয়েছিলেন।
–আপনারা সকলে এই ঘরটায়ই ছিলেন না দূরের ঘরটায়?
মনে হয় বেশিরভাগই এই ঘরে। প্যাট্রিক অন্য ঘরে শেরি আনতে গিয়েছিল।
–আপনি কোথায় ছিলেন?
–মনে হয় জানালার কাছে ছিলাম।
–লোকটার হাতে টর্চ ছিল, সে সেটা দিয়ে কি করছিল?
–সে আমাদের সকলের ওপর আলো ফেলে। আমাদের সকলেরই চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল।
–লোকটা আলো এক জায়গায় ফেলেছিল না ঘোরাচ্ছিল?
একটু ভেবে নিল জুলিয়া। পরে বলল, ঘোরাতে চাইছিল আলোটা। আমার চোখে এসে পড়েছিল, তারপরই গুলির শব্দ হয় পর পর দুবার।
-তারপর?
-তারপর? লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। মিৎসি সাইরেনের মত শব্দ করে আর্তনাদ শুরু করল। টর্চটা নিভে গেল, আবার গুলির শব্দ শোনা গেল। তারপরই দরজাটা কাচ কাচ শব্দ করে আস্তে আস্তে বন্ধ হতে লাগল।
–লোকটা কি ইচ্ছে করেই নিজেকে গুলি করেছিল বলে আপনার মনে হয়?
–আমার কোনই ধারণা নেই। আমি সবই তামাসা বলে ভাবছিলাম তখনও
–ধন্যবাদ মিস সিমন্স। এবারে মিৎসির সঙ্গে দেখা করতে চাই।
রান্নাঘরেই পাওয়া গেল মিৎসিকে। সে প্যাস্ট্রি তৈরি করছিল। ক্র্যাডককে দেখেই বলে উঠল, এখানে আপনার কি দরকার মিঃ পুলিসম্যান? আপনি কি জানতে চান?
–গত সন্ধ্যায় এ বাড়িতে যা ঘটেছে, সেটাই তোমার কাছে শুনতে চাই।
–সারা সন্ধ্যাই আমার খুবই খারাপ লাগছিল। একবার মনে হল চুপিচুপি কেউ যেন হলঘরে চলাফেরা করছে।
–ঘটনা কি ঘটেছিল তাই বল।
-তাইতো বলছি। আমি শেরী আর গ্লাসগুলো নিয়ে ড্রইংরুমে যাই। তখনই পরপর দরজা খুলে দিতে হচ্ছিল–একে একে সবাই আসছিল। তারপর আমি রান্নাঘরে চলে যাই। খুবই ভয় করছিল আমার।
-হ্যাঁ, তারপর?
–আমি গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। অমনি ডাইনিং রুমের দিকে ছুটতে থাকি–তখনই আবার গুলির শব্দ আর ধপ করে শব্দ করে হল ঘরে যেন কিছু পড়ল। আমি দরজার হাতলটা ঘোরাতে গিয়ে দেখি সেটা বাইরে থেকে বন্ধ। আমি ঘরের ভেতরে আটকে যাই। পরে ওরাই আমাকে হাতল ঘুরিয়ে বাইরে আসতে দেয়। ঘর অন্ধকার–আমি মোমবাতি নিয়ে এসে দেখি-উরে ব্বাপস-রক্ত-কেবল রক্ত।
–ঠিক আছে। আপাতত এই থাক মিৎসি।
.
হলঘর পার হয়ে সদর দরজার কাছে আসতেই ক্র্যাডক আর ফ্লেচারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল এক সুদর্শন তরুণের।
যথারীতি নিয়ম ধরেই ক্র্যাডক তার নাম, বয়স, তার যুদ্ধের কাজের খুঁটিনাটি দিয়ে কথা শুরু করলেন। তারপর বললেন, মিঃ সিমন্স, গত সন্ধ্যার ঘটনা যদি দয়া করে একটু বলেন
–গত সন্ধ্যার কথা, সে আর কি বলব সবাই নার্ভাস হয়ে পড়েছিল–বানি তো সারাদিন ধরে ভয় ধরানো কথা বলে চলেছিল।
-মিস বানার কিছু কি আশঙ্কা করছিলেন?
–মনে হচ্ছিল বেশ আনন্দ পাচ্ছিলেন।
–বিজ্ঞাপনটা দেখে মিস ব্ল্যাকক প্রথমে বোধহয় ওটা আপনার কাজ বলেই অনুমান করেছিলেন?
-ওহ, যাই ঘটুক, সবাই আমাকেই দায়ী করে।
মিঃ সিমন্স, এ ঘটনায় সত্যিই কি আপনার হাত ছিল?
–আমার–কখনই না।
–ওই রুডি সার্জকে আপনি আগে দেখেছিলেন?
–জীবনে কোনদিন না।
–এবারে দয়া করে বলুন, ঠিক কি ঘটেছিল?
-আমি পানীয় আনতে ছোট ড্রইংরুমে ঢুকেছিলাম, তখনই ঝপ করে আলো নিভে গেল। ঘুরে তাকাতেই চোখে পড়ল, একটা লোক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলছে–সবাই হাত তুলুন। অমনি অন্ধকার ঘরে চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। তখনই লোকটা রিভলভার ছুঁড়তে শুরু করল, তারপর নিজেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, তার হাতের টর্চ নিভে গেল। আর সবাই আমরা অন্ধকারে ডুবে গেলাম।
–লোকটা মিস ব্ল্যাকলককেই তাক করছিল বলে আপনার মনে হয়?
–ওসব কিছুই না। লোকটা মজা করতেই চেয়েছিল। যখন দেখল বাড়াবাড়ি করে । ফেলেছে–
-তখন বলছেন নিজেকেই গুলি করে?
–অসম্ভব মনে হয় না।
–আপনি নিশ্চিত যে রুডি সার্জকে কখনও দেখেননি?
–বলছি তো কোনদিন না।
ধন্যবাদ মিঃ সিমন্স, আপনাকে আর বিরক্ত করব না। গতরাতে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। কিভাবে শুরু করলে সুবিধা হবে?
–একেবারে নাগালের মধ্যে রয়েছে ফিলিপিয়া হেমস, তাকে দিয়েই শুরু করতে পারেন। উল্টো দিকের দরজাটাই ডায়াস হল। এরপর কাছাকাছি থাকে সোয়েটেনহ্যামরা–
.
০৪.
ইনসপেক্টর ক্র্যাডক তার গৃহীত সাক্ষাৎকারের বিবরণ যথারীতি চিফ কনস্টেবলকে পেশ করলেন।
রাইডেসডেল বললেন, সুইস পুলিসের কাছ থেকেও রিপোর্ট পাওয়া গেল। ছোকরা অলঙ্কার চুরি, চেক জাল, পরিচয় ভাড়ানো-নানা অসৎ কাজের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। সবই অবশ্য ছোটখাট ব্যাপার।
কথা শেষ করে তিনি ক্র্যাডকের বিবরণ দ্রুত চোখ বোলাতে লাগলেন।
–খুবই সাধারণ ব্যাপার স্যর দেখছি। বিভিন্ন মানুষের বর্ণনা…বড্ড অসংলগ্ন আর পরস্পর-বিরোধিতা। তবে আসল ব্যাপারটা পরিষ্কারই পাওয়া যাচ্ছে।
-তবে স্যার, এটা একটা ভুল ছবি বলেই মনে হচ্ছে।
বেশ তো, ঘটনাটা আর একবার দেখে নেওয়া যাক। রুডি সার্জ মেডেনহ্যাম থেকে বাসে চেপেছিল ৫-২০ মিঃ। চিপিং ক্লেগহর্ন পৌঁছায় ছটার সময়। বাসের কণ্ডাক্টর আর দুজন যাত্রীর কাছ থেকে এই সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।
বাসস্টপ থেকে হেঁটেই সে লিটল প্যাডকস-এ পৌঁছায়। সম্ভবত সদর দরজা দিয়েই বাড়ির ভেতরে ঢোকে।
সে সকলকে রিভলভার দেখায়, গুলি ছোঁড়ে, একটা গুলিতে মিস ব্ল্যাকলক সামান্য আহত হন। তৃতীয় গুলিটাতে সে আত্মহত্যা করে।
এই শেষের ব্যাপারটাই যা একটু গোলমেলে, সেটা হঠাৎ দুর্ঘটনা জনিত না ইচ্ছাকৃত কোনটারই নিশ্চিত প্রমাণ নেই।
এতসব কাণ্ড এই ছোকরা কেন করল তার বিশ্বাসযোগ্য কোন কারণ অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে করোনারের জুরিরা সম্ভবত এটাকে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনাজনিত একটা কিছু বলবে। যাই বলা হোক আমাদের কাছে তা সমান।…এই তো মামলা
-তবু আমার মনে হয় স্যার, পুরো চিত্রটাই ভুল।
তার মানে তুমি বলতে চাইছ, চিপিং ক্লেগহর্নের ঘটনায় যাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদের কেউ তোমাকে মিথ্যা বলেছে?
-স্যার, ওই বিদেশী উদ্বাস্তু মেয়েটা, মনে হয় সে যা জানে সব বলেনি।
–তাকে লোকটার সঙ্গে জড়িত বলে মনে হচ্ছে তোমার? সে তাকে একাজে সাহায্য করেছিল?
-এরকম কিছু হবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে সেখানেও গোলমাল থেকে যাচ্ছে বাড়িতে মূল্যবান কিছুই ছিল না। মিস ব্ল্যাকক একথা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন। আবার মিস বানার অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন মিস ব্ল্যাকলককেই সরাসরি হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। চিন্তিত ভাবে বললেন ক্র্যাডক।
–কিন্তু রুডি সার্জ মিস ব্ল্যাকলককে হত্যা করতে চাইবে কেন?
–এখানেই তো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে স্যার। মিস ব্ল্যাকলকের কাছেও এটাই জিজ্ঞাস্য। অবশ্য যদি তিনি মিথ্যা বলে না থাকেন।
–ঠিক আছে–আরও একটু চেষ্টা করা যাক। আজ মেডেনহ্যামের হোটেলে তুমি আর স্যার হেনরির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে যাবে।
-ধন্যবাদ স্যার। ক্র্যাডক অবাক হয়ে তাকালেন চিফ কনস্টেবলের দিকে।
–ঘটনা হল আমরা একটা চিঠি পেয়েছি
ঠিক এই সময়ে স্যার হেনরি ঘরে ঢুকলেন।
সুপ্রভাত ডারমট।
–তোমার জন্যই একটা জিনিস নিয়ে অপেক্ষা করছি। বললেন রাইডেসডেল।
ব্যাপারটা কি
রয়্যাল স্পা হোটেলে আছেন এমন একজন বয়স্কা মহিলার কাছ থেকে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। চিপিং ক্রেগহনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে এমন কিছু তাতে আছে। মহিলার নামটা হল…কি যেন..মারপল-হ্যাঁ জেন মারপল।
–এই তো আমার সেই প্রতিভাময়ী গোয়েন্দাটি–এঁর কথাই বলেছিলাম, সোল্লাসে বলে উঠলেন স্যর হেনরি, যেভাবেই হোক তিনি মেডেনহ্যাম ওয়েলসে হাজির ছিলেন আর স্বভাববশে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
-ঠিক আছে, বললেন রাইডেসডেল, রয়্যাল হোটেলে মধ্যাহ্নভোজের পর আমরা এই মহিলার সঙ্গে দেখা করব।
.
গোলাপী মুখে সামান্য বলিরেখা জেগেছে, মাথায় শ্বেতশুভ্রা চুল, নীলাভ চোখে কোমলতা মাখানেনা। সারা দেহে পশমী পোশাক জড়ান। বেশ বৃদ্ধা মনে হচ্ছিল তাকে। কোন বাচ্চার জন্য কিছু বুনে চলেছিলেন। অবিরাম।
স্যার হেনরিকে দেখেই নির্মল হাসি হাসলেন তিনি। চিফ কনস্টেবল আর ডিটেকটিভ ইনসপেক্টরের পরিচয় পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।
-অনেক দিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা হল স্যার হেনরি। আমার ভাইপো রেমণ্ড তার একটা বইয়ের জন্য বেশ কিছু অর্থ পেয়ে গেছে। তাই জোর করে হোটেলে পাঠিয়ে দিল।
চিফ কনস্টেবল দু-চার কথার পরই সরাসরি কাজের কথা পাড়লেন।
–আপনার কথাই শুনতে এলাম মিস মারপল। বলুন এবারে শোনা যাক।
–ওহ। একটা চেকের ব্যাপার। ওই রুডি সার্জ সেটার কিছু বদলে দিয়েছিল।
রুডি সার্জ। চমকে উঠলেন রাইডেসডেল। আপনার চেকের লেখা বদলে দিয়েছিল।
–হ্যাঁ, আজই সকালে ব্যাঙ্ক থেকে এসেছে। চেকটা ছিল সাত পাউণ্ডের, সে সেটাকে সতের পাউণ্ড করে দেয়। সাত সংখ্যার আগে একটা দাগ বসিয়েছে আর অক্ষর লেখার শেষে ইংরাজি টিন কথাটা যোগ করেছে–একই কালি দিয়ে লেখা। আমার সন্দেহ হচ্ছে, এরকম কাজ সে আগেও করেছে।
তার এরকম কিছু দুষ্কর্মের কথা আমরাও সুইস পুলিসের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, বললেন রাইডেসডেল, পুলিসের খাতায় তার নাম আছে।
পুলিসের তাড়া খেয়েই হয়তো কাগজপত্র জুটিয়ে নিয়ে এদেশে চলে এসেছে, বললেন মিস মারপল।
–ঠিকই অনুমান করেছেন। সম্মতি জানালেন রাইডেসডেল।
মিস মারপল বললেন, ডাইনিংরুমের স্বর্ণকেশী মেয়েটির সঙ্গে সে মেলামেশা করতে চাইত। মেয়েটি বিশেষ সাড়া দিয়েছে বলে মনে হয় না। মেয়েটি সব কথা আপনাদের বলেছে?
ক্র্যাডকের উদ্দেশ্যে বললেন মিস মারপল। তাকে খুবই চিন্তিত লাগছিল।
ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর বললেন, তার কাছ থেকে আরও কিছু জানতে পারা যাবে বলছেন?
–সে হয়তো তাকে বলে থাকতে পারে লোকটি কে ছিল। বললেন মিস মারপল।
–লোকটি?
–হ্যাঁ, যে ছেলেটিকে কাজে লাগাতে চেয়েছি তার কথাই বলছি।
–এর পেছনে দ্বিতীয় কেউ ছিল বলছেন?
-হ্যাঁ। একজন সুদর্শন যুবক, বললেন মিস মারপল, চেক ইত্যাদি জাল করা এমনি ছোটখাট চুরিতে ও বেশ দক্ষ। আচমকা সে একটা রিভলভার নিয়ে খুনোখুনিতে নেমে পড়বে ব্যাপারটা বেশ অসংলগ্ন বলেই মনে হয়।
-আসলে তখন কি ঘটেছিল, সম্ভবত আপনিই বলতে পারবেন মিস মারপল। ক্র্যাডক বললেন।
মিস মারপলের মুখে লাল আভা দেখা গেল। তিনি বললেন, কিন্তু আমি জানব কি করে? খবরের কাগজে ঘটনার বিবরণ যা ছাপা হয়েছে তার বেশি কিছু চোখে পড়েনি।
–চিপিং ক্লেগহনে ক্র্যাডক যে সাক্ষাৎকার নিয়েছে, সেটা মিস মারপলকে একবার দেখিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বললেন স্যার হেনরি।
-হ্যাঁ, উনি দেখতে পারেন। তাঁর মতামত জানার জন্য আমারও আগ্রহ রয়েছে। বললেন রাইডেসডেল।
বলে তিনি টাইপকরা রিপোের্ট এগিয়ে দিলেন।
–বেশি সময় লাগবে না, আমাদের চোখে যা এড়িয়ে গেছে, আপনি তা পেতে পারেন। প্রসঙ্গত বলি, ক্র্যাডকেরও আপনার মতই মত–চিত্রটা অন্য রকম।
মিস মারপল কাগজগুলোতে চোখ বুলিয়ে নামিয়ে রাখলেন।
–মানুষ কত রকমই চিন্তা করে, বলেও আবোল তাবোল। বেশির ভাগই তুচ্ছ।
ক্র্যাডক কিছুটা হতাশই হল মিস মারপলের মন্তব্যে। কিছুটা বিরক্তিও জমল তার মনে। তিনি বললেন, যে যাই বলে থাকুক, একটা ব্যাপার পরিষ্কার, তারা সকলেই দেখেছিল রিভলবার হাতে একজন লোক টর্চ জ্বেলে দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছিল। সে হুকুম করেছিল, মাথার ওপরে হাত তুলবার জন্য।
–কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হল, মিস মারপল বললেন, তাদের কিছুই দেখবার সুযোগ ছিল না। হলঘরে কোন আলোই ছিল না, ওপরের চাতালেও না।
-হ্যাঁ, তা ঠিক। বললেন ক্র্যাডক।
-একটা লোক যদি অন্ধকার ঘরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টর্চের জোরালো আলো ঘরের মধ্যে ফেলে তাহলে কেবল আলো ছাড়া কোন লোকের পক্ষেই আর কিছু দেখা সম্ভব নয়।
হ্যাঁ, আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। বললেন ক্র্যাডক।
–এই অবস্থায় যদি কেউ বলে মুখোশপরা একজন মানুষ দেখেছে, তাহলে বোঝা যায়; এটা হল, তাদের আলো ফিরে আসার পরের চিন্তাধারারই ফল। সামনে রুডি সার্জ রয়েছে এটাই সকলে পরে দেখেছিল।
-আপনি বলতে চাইছেন, কারোর নির্দেশেই রুডি সার্জ ঘরভর্তি মানুষকে রিভলভার তুলে ভয় দেখিয়েছিল?
–আমার ধারণা তাকে একটু মজা করার কথাই বলা হয়েছিল, বললেন মিস মারপল, এজন্য তাকে টাকাও দেওয়া হয়েছিল। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার জন্যও টাকা পেয়েছিল সে।
বলা হয়েছিল নির্দিষ্ট রাতে মুখোশ আর কাল পোশাক পরে দরজা খুলে দাঁড়াতে, আর টর্চ জ্বালিয়ে চিৎকার করে বলতে–মাথার ওপরে হাত তুলুন।
-কিন্তু রিভলভার ছোঁড়ার ব্যাপারটা?
-ওহ, না তার কাছে কোন রিভলভার ছিল না।
–কিন্তু প্রত্যেকেই বলেছে
–হ্যাঁ, জানি। কিন্তু তার হাতে রিভলভার থাকলে সেটা কারোর দেখার কথা নয়। আমার ধারণা, সে হাত তুলুন বলার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল, আর তার কাঁধের ওপর দিয়ে পর পর দুবার গুলি ছুঁড়েছিল। রুডি সার্জ আচমকা গুলির শব্দে ভয় পেয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করতেই পেছনের লোক তাকে গুলি করে। পরে রিভলভারটা তার পাশেই ফেলে দেয়।
উপস্থিত তিন জনেই বিস্ফারিত চোখে মিস মারপলের দিকে তাকালেন।
-কিন্তু ওই অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে এসেছিল–লোকটি কে? রাইডেসডেল বললেন।
–সেটাই আপনাদের খুঁজে বার করতে হবে–সেই অজানা লোকটি কে যে মিস ব্ল্যাকলককে খুন করার উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল।
–তাহলে এটাকে ইচ্ছাকৃত আক্রমণ বলেই বলছেন আপনি?
–আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। তবে এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই যে, যে লোক এই পরিকল্পনা ছকেছিল রুডি সার্জ তাকে জানত। তার মুখ বন্ধ রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিল। রুডি যদি কিছু বলে থাকে তাহলে ওই মার্না হ্যারিসকেই বলা সম্ভব।
–আমি এখনই তার সঙ্গে দেখা করছি। উঠে দাঁড়ালেন ক্র্যাডক।
–হ্যাঁ, তাহলে কিছুটা আলো অন্তত পাওয়া যাবে।
ক্র্যাডক ঘর ছেড়ে চলে গেলে রাইডেসডেল বললেন, আপনি আমাদের কিছু নতুন চিন্তার খোরাক দিলেন মিস মারপল।
.
সামান্য কয়েক কথাতেই ক্র্যাডক মানা হ্যারিসের প্রতিরোধ ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর সতর্ক ও সহানুভূতিপূর্ণ ছিল।
–আপনাকে সবই আমি বলব। অনুগ্রহ করে আমাকে কেবল এসবের বাইরে রাখবেন।
একটু থেমে মার্না হ্যারিস আবার বলতে শুরু করল, ছবি দেখতে যাবার প্রস্তাব ও একদিন নিজেই করেছিল। ঠিক হয়েছিল ওই দিন সন্ধ্যার সময় যাব। কিন্তু পরে আমাকে জানাল ও আসতে পারছে না। কারণ সেদিন রাতে ও একটা মজার খেলায় যোগ দেবে, অবশ্য এতে পকেটেও কিছু আসবে।
একজন বিদেশীর কাছ থেকে এরকম ব্যবহার আমি মেনে নিতে পারিনি। তারপর থেকে আমি একরকম তাকে এড়িয়ে থাকবারই চেষ্টা করেছি।
মনে পড়ছে, ও বলেছিল ওই দিন রাতে কোন বাড়িতে একটা পার্টি হবে, সেখানে তাকে একটা ডাকাতের অভিনয় করতে হবে। তারপর কাগজের একটা বিজ্ঞাপনও আমাকে দেখাল।
এরপরে, স্যর, বুঝতেই পারছেন, কাগজ পড়ে সবই জানতে পারলাম। রুডি একজনকে গুলি করে পরে নিজেই আত্মহত্যা করে। খবরটা পড়ে আমি খুবই বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম। ব্যাপারটা আগেই জানতাম বলে নিজেকেও এর সঙ্গে জড়িত মনে হচ্ছিল।
রুডি আমাকে এমনভাবে কথাটা বলেছিল যে সত্যিই একটা কৌতুকের ব্যাপার বলেই মনে হয়েছিল আমার। তবে ওর যে একটা রিভলভার ছিল, সেকথা আমি জানতাম না।
–ওই পার্টি কে ঠিক করেছিল সেসব কিছু জানিয়েছিল সে?
প্রশ্নটা করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মান্নার মুখের দিকে তাকালেন ক্র্যাডক।
-না, এসব কিছু বলেনি।
–সবই কেমন অস্বাভাবিক ঠেকছে।
মেডেন হ্যাম ফেরার পথে রাইডেসডেল বললেন, একজন অজানা লোক অন্ধকারে সুইস ছোকরার পেছনে হাজির হল, কোথায় ছিল সে, কে লোকটা?
–সে পাশের দরজা দিয়ে আসতে পারে, বললেন ক্র্যাডক।
–রান্নাঘরের মধ্য দিয়ে এসেছিল বলছ?
–হ্যাঁ স্যর। ওই মেয়েটিকে আমার গোড়া থেকেই সন্দেহজনক মনে হয়েছে। সেই হয়তো ওই লোকটিকে ঠিক মুহূর্তে ঢুকতে সাহায্য করেছিল। পরে সন্দেহমুক্ত থাকবার জন্য ডাইনিং রুমের দরজা বন্ধ করে পরিত্রাহি চিৎকার জুড়েছিল।
কিন্তু ওই যে কি নাম…এডমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম, সে তো দেখলাম বলেছে দরজায় চাবি দেওয়া ছিল বাইরে থেকে। সে দরজা খুলে মেয়েটাকে বাইরে এনেছিল। বাড়ির ওই অংশে আর কোন দরজা আছে?
হ্যাঁ। পেছনের সিঁড়ির নিচে রান্নাঘরের দিকে একটা দরজা আছে। তবে ওটার হাতল নাকি তিন সপ্তাহ আগে খুলে যায়। সেটা এখনও লাগান হয়নি। দরজাটা তাই বন্ধই ছিল। হাতলের জায়গায় বেশ পুরু ধুলো জমে ছিল।
যাই হোক, মেয়েটার রেকর্ড ভাল করে দেখে নিও। যদিও পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে একটা থিওরি বলেই মনে হচ্ছে।
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ওই রিভলভারটা–যদি এই থিওরি সঠিক হয় তাহলে ধরতে হবে ওটা সার্জের নয়। তার যে কোন রিভলভার ছিল সেকথাও কেউ বলেনি।
-তদন্তের আর অন্য কোন দিক, স্যার
যদি থিওরি ঠিক হয় তাহলে কোথাও একটা মোটিভ পাওয়া যাবে। ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার পরিকল্পনা বিনা কারণে হয় না। কিন্তু বুঝতে পারছি না মিস ব্ল্যাকলককে কে খুন করার চেষ্টা করতে পারে? একথার উত্তর দিতে পারেন একমাত্র মিস ব্ল্যাকলক নিজে।
–কিন্তু তিনি তো জোরের সঙ্গে এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।
–হ্যাঁ স্যার। রুডি সার্জ তাকে কেন খুন করতে চাইবে এটা তিনি বিশ্বাসই করতে চাননি। তাছাড়া অন্য একটা ব্যাপারও আছে।
–সেটা কি?
–এই চেষ্টা আবার হতে পারে স্যার।
–তাহলে থিওরির সত্যতা প্রমাণ হবে। মিস মারপলের ওপরেও তুমি নজর রেখো। বললেন রাইডেসডেল।
–তিনি কেন, স্যার?
–আমি শুনেছি তিনি ক্রেগহর্নের ভিকারেজে আছেন। চিকিৎসার জন্য সপ্তাহে দুদিন মেডেনহ্যাম ওয়েলসে আসতে হয় তাঁকে। ভিকারের স্ত্রী সম্ভবত তাঁর বান্ধবীর মেয়ে। বুড়ি উত্তেজনার খোরাক খুঁজতে আনন্দ পায়।
.
০৫.
–আপনাকে আর একটু বিরক্ত করতে এলাম মিস ব্ল্যাকলক।
–শুনলাম ইনকোয়েস্ট সাতদিন পিছিয়ে গেছে?
–হ্যাঁ। সেজন্যই নতুন কোন সূত্রের সন্ধান করতে হচ্ছে, বললেন ক্র্যাডককে, রুডি সার্জ সম্পর্কে জানা গেছে, মন্ট্রির হোটেল কেম আলপসের মালিকের ছেলে নয়। সে আর্দালির কাজ করত বের্ন-এর হাসপাতালে। সেই সময় অনেক রুগীরই অলঙ্কার খোয়া যেত। এক রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজও করেছিল। সেখানে ডুপ্লিকেট বিল করে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিত।
এরপর জুরিখের এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কিছুদিন কাজ করে। সেখানেও যতদিন ছিল মালপত্র চুরি হত।
–ছিঁচকে চুরিতে ভালই হাত পাকিয়েছিল। তাকে আমার চেনা মনে হয়নি।
–হ্যাঁ, রয়্যাল স্পা হোটেলে সে আপনাকে চিনতে পারার ভাঁওতা দিয়েছিল। সুইজারল্যাণ্ডে পুলিসের তাড়া খেয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জাল করে এদেশে পাড়ি জমিয়েছিল।
–কিন্তু চিপিং ক্লেগহর্নে সে এসেছিল কেন?
–বাড়িতে আপনার সত্যিই কি কোন মূল্যবান জিনিস নেই বলছেন?
–আমি শপথ করে বলতে পারি ইনসপেক্টর।
–তাহলে বুঝতে হয়, আপনাকে আক্রমণ করার জন্যই এখানে এসেছিল।
–আমিও তোমাকে একথাই বলেছিলাম, লেটি। মিস বানার বলে উঠলেন।
–ওকথার কোন অর্থই হয় না। বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
-এমন হতে পারে সে এরকম ঘটনা ঘটাতে চায়নি, বললেন মিস বানার, তোমাকে ভয়ঙ্কর কোন ইঙ্গিত করতেই চেয়েছিল হয়তো। বিজ্ঞাপনটা দেখেই আমার ভয় ধরেছিল। মিৎসি দেখনি, কেমন ভয় পেয়েছিল।
-হ্যাঁ, ওই মেয়েটির সম্পর্কেও আরও কিছু আমাকে জানতে হবে। বললেন ক্র্যাডক।
–ওর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যথাযথই ছিল। বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
–ওসবে আমি সন্দেহ করছি না, রুডি সার্জের কাগজপত্রও ত্রুটি হীন বলেই মনে হয়েছিল।
–কিন্তু এটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, রুডি সার্জ আমাকে খুন করতে চাইবে কেন?
–তাকে দিয়ে একাজ কেউ করাতে পারে একথা ভেবে দেখেছেন?
ধীরে ধীরে বললেন ক্র্যাডক। কিন্তু এ কথায় মিস ব্ল্যাকলকের কোন প্রতিক্রিয়া তার চোখে পড়ল না।
–এই উত্তরও আমার জানা নেই। কেউ আমাকে খুন করতে চাইবে কেন?
–এর উত্তর আপনার কাছ থেকেই আশা করছি মিস ব্ল্যাকক।
–আমি এটুকুই বলতে পারি–আমার কোন শত্রু নেই। আর মিৎসি মেয়েটিকেও এর সঙ্গে জড়িত ভাবা একেবারেই হাস্যকর। গেজেটে বিজ্ঞাপন দেখেই ও ভয়ে আধমরা হয়ে ছুটে এসেছিল-মালপত্র নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার অনুমতি চেয়েছিল।
–এটা একটা কৌশলও হতে পারে। আপনি তাকে যেতে দেবেন না সে জানত।
-ওসব ভাবনা আপনার, উত্তরও আপনি নিজেই পেয়ে যাবেন। আমি এটুকু বলতে পারি, আমার প্রতি কোন রকম আক্রোশ থাকলে মিৎসি অনেক সহজ উপায়ে আমাকে বিষ খাওয়াতে পারত। সমস্ত ব্যাপারটাই অবাস্তব। বিদেশী বলেই তাকে ঠাণ্ডা মাথার খুনী ভাবা ঠিক নয়। দরকার হলে তাকে আবার জেরা করতে পারেন।
ক্র্যাডক এবারেও সহজ উত্তরই পেলেন মিৎসির কাছে। বিজ্ঞাপনটা পড়ে সে খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তাই চারটের পরেই সদর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
ক্র্যাডক তাকে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু মিসেস হেমস বলেছেন, কাজ সেরে ওই দরজা দিয়েই ৫-৩০ মিঃ বাড়িতে ঢোকেন। তারপর দরজা বন্ধ করে দেন।
–বন্ধ করেননি, বলল মিৎসি, আমার ধারণা তিনি খেয়াল রেখেছিলেন যাতে দরজা বন্ধ হয়।
-তোমার এ কথার উদ্দেশ্য?
–ওই ছোকরা আঁটঘাট আগে থেকেই বেঁধে নিয়েছিল। সে জানত কোথায় আসতে হবে, আর তার জন্য দরজাটা খোলা থাকবে।
–আরও পরিষ্কার করে বল মিৎসি।
-আমি বলতে পারি, কিন্তু জানি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। তবু বলছি, এক সপ্তাহ আগে ওই ছোকরা টাকা চাইতে এলে তাকে মিস ব্ল্যাকলক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাকে দেখেছি, বাইরে এসে মিসেস হেমসের সঙ্গে কথা বলেছিল।
-কিন্তু সামার হাউসে ওদের কি কথা হয় তা তোমার শোনা সম্ভব ছিল না নিশ্চয়ই।
–কেন সম্ভব হবে না। আমি তরকারীর জন্য কচি বিছুটি পাতা আনতে বাগানে গিয়েছিলাম। তখন আমি ওদের কথা বলতে শুনেছি। ছোকরা তাকে বলল, আমি কোথায় লুকোব? মিসেস হেমস বলেছিল, আমি দেখিয়ে দেব। ঠিক সওয়া ছটার সময়।
আমি ভেবেছিলাম ভালবাসার ব্যাপার–এখন বুঝতে পেরেছি ওরা দুজনে মিলে খুনের আর ডাকাতির মতলব করেছিল।
–আর কি দেখেছ তুমি?
–তাকে সামার হাউস থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম।
–এসবকথা সেদিন আমাকে বলনি কেন? সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করলেন ক্র্যাডক।
–ওদের মতলবটা তখনও বুঝে উঠতে পারিনি।
–কিন্তু ধর, কেউ যদি বলে, তোমাকে রুডি সার্জের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে—
মিথ্যে মিথ্যে, একদম মিথ্যে কথা।
মিৎসির কথাগুলো ক্র্যাডকের মনে আলোড়ন তুলেছিল। মিসেস হেমস সম্পর্কে কথাগুলো সে বেশ জোর দিয়েই বলেছে।
ফিলিপিয়া হেমসের সঙ্গে কথা বলবেন স্থির করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি।
হলঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় একটা ভুল দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন ক্র্যাডক।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখতে পেয়ে মিস বানার তাকে ঠিক দরজাটা দেখিয়েছিলেন।
–ওই দরজাটা খোলে না। বাঁদিকে পরের দরজাটা। আমারও প্রায়ই ভুল হয়ে যায়। ওটাতে ঠেস রেখে হলঘরে টেবিল রাখা হত। পরে সেটা দেয়ালের দিকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
ক্র্যাডক সচকিত হয়ে উঠলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, টেবিলটা সরানো হয়েছে? কতদিন আগে?
–দিন দশ-পনেরো হবে
বললেন মিস বানার।
–টেবিলটা সরানোর দরকার হল কেন?
–ঠিক মনে পড়ছে না। মনে হয় ফিলিপিয়া বড় একটা ফুলদানী তৈরি করেছিল। রঙবেরঙের ফুল ডাল পাতা সুন্দরভাবে সাজাতে পারে ও। ফুলগুলো দরজার সামনে না রেখে দেয়ালের দিকে রাখলে বেশি ভাল দেখাবে এজন্যই টেবিলটা সরিয়ে নিয়েছিল।
ক্র্যাডক লক্ষ করলেন, যে-দরজা তিনি খোলার চেষ্টা করছিলেন তার মাঝামাঝি সরু সরলরেখার মত একটা দাগ। টেবিলটা এখানে রাখা ছিল, এটা তারই দাগ, তিনি বুঝতে পারলেন।
দরাজাটা কি পেরেক এঁটে বন্ধ করা হয়েছিল? প্রশ্ন করলেন ক্র্যাডক।
–খুব সম্ভব তালা লাগিয়ে, খিলও আঁটা হয়েছিল। বললেন মিস বানার।
ক্র্যাডক হাত বাড়িয়ে খিলটা দেখতে চাইলেন, খিলটা সহজেই সরে এল।
-দরজাটা শেষ কবে খোলা হয়েছিল, মিস বানার?
–অনেক বছর হয়েছে, বললেন মিস বানার, আমি এখানে আসার পর ও দরজা খোেলা হয়নি।
-তালার চাবি কোথায় থাকে আপনি বলতে পারবেন?
–হলঘরের ড্রয়ারে অনেক চাবি আছে। তার মধ্যেই আছে নিশ্চয়।
ক্র্যাডক মিস বানারের সঙ্গে গিয়ে ড্রয়ারের অনেক চাবি নেড়েচেড়ে দেখলেন। একটা চাবি একটু অন্য রকম মনে হল তার। সেটা তুলে নিয়ে দরজার কাছে এলেন। চাবিটা সহজেই তালায় ঢুকে গেল। তারপর একটু ঠেলতেই দরজা খুলে গেল।
ক্র্যাডকের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। তিনি দরজাটা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে খুঁটিয়ে দেখলেন।
–মিস বানার, দরজাটা সম্প্রতি ভোলা হয়েছে দেখছি। কজায় তেল দেওয়াও হয়েছে। মিস বানার বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তিনি যেন ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
বিস্ময়ের ঘোর কাটলে বললেন, কিন্তু এ কাজ কে করতে পারে? দরজাটা তো খোলা যায় না জানতাম।
ক্র্যাডক বুঝতে পারলেন, অজানা যে লোকের সন্ধান তিনি করছেন, সে লোক–এখানে এই ড্রয়ংরুমেই ছিল সেই রাতে।
২. ইঙ্গিত
০৬.
মিস ব্ল্যাকলককে সবকথা জানালেন ক্র্যাডক। তার ইঙ্গিতও বুঝতে অসুবিধা হল না।
ধীর শান্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, গোটা ব্যাপারটাই বদলে যাচ্ছে দেখছি। কিন্তু আমাদের চোখের আড়ালে দরজায় এমন কারচুপি কে করল বুঝতে তো পারছি না।
ব্যাপারটা নিশ্চয় পরিষ্কার হয়েছে আপনার কাছে। সেদিন যখন আলো নিভে গিয়েছিল, যে কেউ গা ঢাকা দিয়ে এই দরজা দিয়ে রুডি সার্জের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে পারত, আর আপনাকে গুলি করাও তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না।
–হ্যাঁ, কারো চোখে পড়া সম্ভব ছিল না। বললেন মিস ব্ল্যাকক।
–হ্যাঁ। আলো নিভে যেতেই সকলে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়ে কথা বলতে শুরু করে। এরপর তাদের চোখে এসে পড়ে টর্চের জোরাল আলো।
–মনে করতে পারছি সবই। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করেন যে আমার পড়শীদের মধ্যে কেউ চুপিসারে বেরিয়ে এসে আমাকে খুনের চেষ্টা করেছিল? কিন্তু কেন খুন করতে চাইবে আমাকে? সেটাই তো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
–এর উত্তর তো একমাত্র আপনিই জানেন মিস ব্ল্যাকলক।
–কিন্তু, বিশ্বাস করুন, ইনসপেক্টর, সত্যিই আমি জানি না।
–কিন্তু আমাদের সে কথাটাই জানতে হবে। বেশ, একটু আলোচনা করে দেখা যাক। আপনি মারা গেলে আপনার টাকাকড়ি কে পাবেন?
মিস ব্ল্যাকলক একমুহূর্ত ইতস্তত করলেন। পরে বললেন, প্যাট্রিক আর জুলিয়া। আর বানি পাবে বাড়ির আসবাবপত্র আর সামান্য মাসোহারা। আসলে আমার মূলধন খুবই সামান্য। তার জন্য আমার খুন হবার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ অবাস্তব।
যাইহোক, যেটুকুই আছে, তা আপার বোনপো আর বোনঝি পাচ্ছেন।
–আপনি বলতে চাইছেন ওরা আমাকে খুনের পরিকল্পনা করবে? এ আমি কখনোই বিশ্বাস করি না। তারা এমন কিছু অনটনে পড়েনি।
–তাদের আর্থিক অবস্থার কথা আপনি জানেন?
–ওরা যা বলেছে, তাই জানি। তবে ওদের সন্দেহ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
একমুহূর্ত থেমে তিনি ফের বললেন, আমি খুন হওয়ার পর্যায়ে আসতে পারি, হয়তো একদিন, তবে এখন নয়।
ক্র্যাডক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মিস ব্ল্যাকলকের দিকে। বললেন, আপনার একথার অর্থ মিস ব্ল্যাকলক?
-আমি বলতে চাইছি, হয়তো শিগগিরই আমি অনেক টাকার মালিক হতে পারি।
ব্যাপারটা খুলে বলবেন?
-বলব অবশ্যই। আপনি হয়ত জানেন না যে আমি কুড়ি বছর একজন বিখ্যাত ধনী ব্যক্তির সেক্রেটারি ছিলাম। র্যাণ্ডাল গোয়েডলারের নাম নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। ১৯৩৮ সালে তিনি মারা যান।
ক্র্যাডক বললেন, হ্যাঁ একজন, দুঃসাহসিক বিনিয়োগকারী বলে অর্থনৈতিক জগতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কোটিপতি মানুষ।
–কেবল কোটিপতি বললে সামান্যই বলা হবে। কেন না বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে তার অর্থের পরিমাণ ওঠা নামা করত। নতুন ঝুঁকিতে অর্থ বিনিয়োগ করা, বলতে পারেন তার নেশার মত ছিল।
যাইহোক, ধনী অবস্থাতেই তিনি মারা যান। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই ট্রাস্টের মাধ্যমে তার জীবদ্দশাতেই সব স্ত্রীকে দিয়ে যান। আর তাঁর মৃত্যুর পর সবেরই মালিক হব আমি।
একটা খবর ক্র্যাডকের স্মরণে এলো–শিরোনাম ছিল এরকম, বিশ্বস্ত সেক্রেটারির বিপুল সৌভাগ্যবা এরকম কিছু।
মিস ব্ল্যাকলক বলে চললেন, এ ঘটনা বছর বারো আগের। সেই সময় মিসেস গোয়েডলারকে খুন করার একটা মোটিভ আমার থাকতে পারত।
–মাপ করবেন, মিঃ গোয়েডলার তাঁর সম্পত্তি এভাবে দান করলেন, এটা তার স্ত্রীর মেনে নিয়েছিলেন?
আপনি অনেকটা রেখেঢেকেই বললেন, বললেন মিস ব্ল্যাকলক, আপনি বলতে চাইছেন, আমার সঙ্গে মিঃ গোয়েডলারের কোন গূঢ় সম্পর্ক ছিল কিনা। না, তেমন সম্পর্ক ছিল না। তিনি স্ত্রী বেলকে মৃত্যু পর্যন্ত গভীরভাবে ভালবাসতেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কৃতজ্ঞতা থেকেই তিনি ওই উইল করেছিলেন।
ইনসপেক্টর, মানুষের অবস্থা সবসময় এক রকম থাকে না। মিঃ গোয়েডলারও প্রথম দিকে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে ছিলেন। সেই সময় আমি তাকে একটু সাহায্য করেছিলাম। খুবই সামান্য মাত্র কয়েক হাজার টাকা।
স্বভাববশে অত্যন্ত ঝুঁকির কাজেই তিনি আমার সেই সামান্য পুঁজি লাগিয়েছিলেন। আর একসপ্তাহ পরেই তিনি অবিশ্বাস্য ধনী হয়ে যান।
অতীতের স্মৃতিচারণ করতে করতে যেন তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন মিস ব্ল্যাকলক। পরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
–সেই দিনগুলি কী উত্তেজনাময় আর উপভোগ্যই ছিল। এরপর আমার বাবা মারা গেলেন। আমার এক পঙ্গু বোন ছিল। সে খুবই অসহায় হয়ে পড়ল। আমাকে তাই সব ছেড়ে তাকে দেখার জন্য যেতে হল। এর একবছর পরেই মিঃ গোয়েডলার মারা যান।
কাজের সময় যথেষ্ট টাকা পেতাম আমি। তাই তিনি আমাকে কিছু দিয়ে যাবেন আশা করিনি। যখন শুনলাম তার স্ত্রী বেন মারা গেলে সব সম্পত্তি আমিই পাব, খুবই আনন্দ হয়েছিল।
র্যাণ্ডালের স্ত্রী ছিল রোগেভোগা, বেশিদিন বাঁচার আশা ছিল না। সে খুবই চমৎকার মানুষ আমাকে পছন্দ করত। আমার ধারণা, সব জেনে সে খুবই খুশি হয়েছে।
বেন এখন থাকে স্কটল্যাণ্ডে। যুদ্ধের আগে আমার বোনকে নিয়ে সুইজারল্যাণ্ডে এক স্বাস্থ্যনিবাসে গিয়েছিলাম। সেখনেই সে মারা যায়।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেই মিস ব্ল্যাকলক। পরে বললেন, মাত্র এক বছর আগে আমি ইংলণ্ডে এসেছি।
গভীর মনোযোগের সঙ্গে তার কথা শুনছিলেন ক্র্যাডক, এবারে বললেন, আপনি বললেন খুব শিগগিরই ধনী হতে পারেন–কত শিগগির মনে করেন আপনি?
–বোনকে যে নার্স দেখাশোনা করে তার কাছ থেকে শুনেছি, বোনের শরীর খুবই জীর্ণ হয়ে পড়েছে। হয়তো কয়েক সপ্তাহ আর বেঁচে থাকবে। কিন্তু ওই বিপুল পরিমাণ অর্থের কোন সার্থকতা আমার কাছে নেই। আমার সরল জীবনযাত্রার জন্য যেটুকু দরকার তা আমার আছে। আমার বয়সও হয়েছে। তবু আমাকে যদি প্যাট্রিক আর জুলিয়া খুন করতে চায় তাদের এখনও কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।
-কিন্তু, একটা প্রশ্ন মিস ব্ল্যাকলক, মিসেস গোয়েডলারের আগে যদি আপনি মারা যান তাহলে কি হবে?
–এ নিয়ে কখনও ভাবিনি…তবে সম্ভবত পিপ আর এমাই সব পাবে
ক্র্যাডক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন। মিস ব্ল্যাকলক হেসে বললেন, পিপ আর এমা কে বুঝতে পারছেন না, তাই না?
আমার ধারণা, মিসেস গোয়েডলারের আগে আমার মৃত্যু হলে সব অর্থের আইনত উত্তরাধিকারী হবে মিঃ গোয়েডলারের একমাত্র বোন সোনিয়ার দুই ছেলেমেয়ে। ওরা যমজ ভাইবোন।
গোয়েডলারের সঙ্গে বোনের সুসম্পর্ক ছিল না। সোনিয়া যাকে বিয়ে করেছিল, গোয়েডলার তাকে পছন্দ করতেন না। লোকটিকে প্রতারক আর শঠ বলেই তিনি মনে করতেন।
–সে কি সত্যিই তাই ছিল?
–গোয়েডলার লোকচরিত্র ভাল বুঝতেন। তিনি ভুল করেননি নিশ্চয়ই। ভদ্রলোক একজন গ্রীক বা রোমানিয় ছিল, নামটা…হা মনে পড়েছে–ডিমিট্রি স্ট্যামফরডিস।
–ওই লোককে বিয়ে করার জন্যই র্যাণ্ডাল গোয়েডলার তার উইলে বোনকে বঞ্চিত করেছিলেন?
গোয়েডলার আগেই বোনকে প্রচুর অর্থ দিয়েছিলেন, তবে সেই অর্থে তার স্বামীর হাত দেবার সুযোগ ছিল না।
যাই হোক, আমার ধারণা গোয়েডলারের উকিল তাকে পরামর্শ দিয়েছিল। আমার আগে মৃত্যু হলে উত্তরাধিকারী হিসেবে অন্য কারও নাম দেওয়া দরকার। গোয়েডলার তখন হয়তো অনিচ্ছার সঙ্গেই সোনিয়ার সন্তানদের নাম করেন।
–পিপ আর এমা সেই বোনেরই সন্তান?
-হ্যাঁ। আমার স্মরণ আছে, সোনিয়া বেলকে একবার চিঠিতে জানিয়েছিল তার দাদাকে জানাবার জন্য যে তার যমজ সন্তান হয়েছে। তাদের নাম পিপ আর এমা। এরপর সে আর চিঠি দেয়নি। তবে এসম্পর্কে যদি খোঁজখবর নিতে চান তাহলে আপনাকে বেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আমার ধারণা সে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে।
ক্র্যাডককে চিন্তিত দেখাল। তিনি বললেন, তাহলে এটা পরিষ্কার হচ্ছে যে আপনি খুন হলে এমন দুজন রয়েছে যারা বিপুল অর্থের মালিক হতে পারে। অর্থাৎ আপনাকে খুন করার মোটিভ রয়েছে। যে ঘটনা ঘটে গেছে তার সঙ্গে দুজন ভাইবোনের জড়িত থাকার সম্ভাবনা পাওয়া যাচ্ছে। তাদের বয়স এখন কত হতে পারে?
দাঁড়ান, হিসেবে করে দেখতে হবে…১৯২২ ঠিক মনে করতে পারছি না…যাই হোক পঁচিশ ছাব্বিশ ধরে নিতে পারেন।
–আমার মনে হয়, সেদিন গুলি ছোঁড়া হয়েছিল আপনাকে মারার জন্যই। সৌভাগ্যক্রমে আপনি বেঁচে গেছেন। তবে সে বা তারা আবারও একবার চেষ্টা করবে। সে কারণেই আপনাকে আমি সতর্ক করে দিতে চাই।
.
ফিলিপিয়া হেমসকে সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে সুন্দরী বলেই মনে হল ইনসপেক্টর ক্র্যাডকের। মাথা জুড়ে হাল্কা ধূসর সোনালী চুল, তীক্ষ্ণ চিবুক ও ঠোঁট। নীলাভ চোখ। আঁটোসাঁটো চেহারা।
একগুচ্ছ চুল মুখের ওপর থেকে সরিয়ে ফিলিপিয়া বলল, বলুন, ইনসপেক্টর?
চাঁচাছোলা আবেগহীন গলা। উদ্বেগ বা ভয়ের লেশমাত্র নেই।
-আমি দুঃখিত, কাজের সময় আপনাকে বিরক্ত করতেহচ্ছে। অবশ্য, লিটল প্যাডকসের বাইরেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। এখন কথা হচ্ছে, আজ সকালে এমন কিছু কথা শুনলাম যার সঙ্গে আপনি জড়িত।
ফিলিপিয়া কৌতূহলী হল। ভ্রূ তুলে তাকাল।
-আপনি বলেছিলেন ওই রুডি সার্জ আপনার অপরিচিত?
-হ্যাঁ, বলেছিলাম।
–তাকে কি আপনি সেদিনই প্রথম দেখেন?
–হ্যাঁ, সেইদিনই। আগে তাকে কখনও দেখিনি।
–আপনি কি লিটল প্যাডকসের সামার হাউসে কোন সময় তার সঙ্গে কথা বলেননি?
–সামারহাউস?
ক্র্যাডকের মনে হল ফিলিপিয়ার কণ্ঠস্বর সামান্য কেঁপে উঠল।
-হ্যাঁ, মিসেস হেমস।
–একথা আপনাকে কে বলেছে?
–রুডি সার্জকে আপনি বলেছিলেন, সে কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে আপনি দেখিয়ে দেবেন–সময়টা বলেছিলেন সোওয়া ছয়টা–এমন কথাও আমি শুনেছি। আমরা জেনেছি সার্জও ওই সময় বাসে করে এসেছিল।
ক্র্যাডকের কথা শেষ হতেই মিসেস ফিলিপা হেমস হেসে উঠল।
–আপনাকে এসব কথা কে বলেছে আমি আন্দাজ করতে পারছি। এসব কথা অত্যন্ত ঈর্ষাপীড়িত, সত্যতা বিন্দুমাত্র নেই। আমি বুঝি না মিৎসি কেন আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না।
-এসব কথা সত্যি নয় আপনি বলছেন?
–একেবারেই না। আমি রুডি সার্জকে আগে কখনও দেখিনি। তাছাড়া যেদিন সকালে সে আসে, আমি বাড়ির কাছাকাছিও ছিলাম না। এখানে কাজ করছিলাম।
ক্র্যাডক শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কোনদিন সকালে?
জবাব দিতে গিয়ে ইনসপেক্টরের চোখের দিকে তাকাল ফিলিপা। একটু থমকে গেল। পরে বলল, প্রতিদিন সকালে। এখান থেকে একটার আগে কোথাও যাই না। মিৎসি কি বলেছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। সবাই জানে ও মিথ্যা কথা বলে।
ফেরার পথে ক্র্যাডক সার্জেন্ট ফ্লেচারকে বললেন, এই দুই তরুণীর কার কথা তোমার বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়?
ফ্লেচার বলল, দুজনের কথাই পরস্পরবিরোধী। তবে ওই বিদেশী মেয়েটা যে মিথ্যা কথা বলে একথা এখানে প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে। তাছাড়া এটাও বোঝা যাচ্ছে ও মিসেস হেমসকে যে কোন কারণেই হোক হিংসা করে।
–তুমি বলতে চাইছে, মিসেস হেমসকেই বিশ্বাস করা উচিত?
–আপনার হয়তো অন্য কিছু ভাবনা থাকতে পারে, স্যর।
ক্র্যাডকের অবশ্য তেমন কিছু ভাবনা ছিল না। সেদিন সামার হাউসে রুডি সার্জের সঙ্গে মিসেস হেমসের আদৌ সাক্ষাৎ ঘটেছিল কিনা তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
তবে এটুকু পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন, তিনি যখন সামার হাউস কথাটা বলে উঠেছিলেন, তার গলার স্বর কেঁপে গিয়েছিল। তিনি তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে।
ক্র্যাডক স্থির করলেন, এই দুই তরুণীর ব্যাপারেই তিনি খোলা মন রাখবেন।
.
মিস মারপল ভিকারেজের বাগানে একটা ডেক চেয়ারে বসে উল বুনছিলেন। সম্পূর্ণ একা। তাকে ওভাবে দেখে ক্র্যাডক সজাগ হলেন। বললেন, আপনার এখানে আসা উচিত হয়নি মিস মারপল।
মুখ তুলে তাকালেন তিনি। বললেন, আপনি কি বলতে চাইছেন আমি জানি। আপনি অত্যন্ত বিবেচক। হাঞ্চের বাবা আমাদের সেন্ট মেরী গির্জার ভাইকার ছিলেন। তার মা আমার বহু দিনের বন্ধু। তাই মেডেনহ্যাম এলে আমাকে এখানে কদিন কাটিয়ে যেতে হয়।
-সেটা ভাল ব্যাপার, বললেন ক্র্যাডক, কিন্তু আপনি বাইরের দিকে চোখ কান না দিয়ে পারেন না, সেটাই শঙ্কার কারণ।
প্রত্যুত্তরে সামান্য হাসলেন মিস মারপল।
এরপর ক্র্যাডক র্যাণ্ডাল গোয়েডলার আর পিপ ও এমার কথা জানালেন মিস মারপলকে।
পঁচিশ বছর আগের কথা, মিস ব্ল্যাকলক তাদের শেষ কবে দেখেছিলেন, এখন তাদের কেমন হয়েছে দেখতে কিছুই জানার উপার নেই। তাছাড়া কেবল দুটো ডাক নাম–ইউরোপের কোথায় তাদের পাওয়া যাবে? তবে অবশ্য এমন হওয়াও সম্ভব তারা এই চিপিং ক্লেগহনেই রয়েছে।
স্থির হয়ে সব শুনলেন মিস মারপল। পরে শান্তস্বরে বললেন, আপনার হয়ে আমি কি এদের খুঁজে বার করতে পারি?
–কিন্তু, মিস মারপল
–আপনার ভাবিত হবার কোন কারণ নেই। খুবই সহজ কাজ। আমি তো আর সরকারী লোক নই, কাজেই আমার কাজ কারোর নজরেই আসবে না। কোথাও কোন গোলমাল থাকলে, কারুর সতর্ক হবার মত কারণও থাকবে না।
-আমি স্কটল্যাণ্ড যাচ্ছ। ওখানেই আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি ওদের সম্পর্কে জানতে পারব। মিসেস গোয়েডলার নিশ্চয় পিপ আর এমার সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারবেন।
–সেটা আরও ভাল কাজ, বললেন মিস মারপল, মিস ব্ল্যাকলককে আশাকরি আপনি সতর্ক করে দিয়েছেন?
-হ্যাঁ, তাঁকে পরিষ্কার ভাবেই সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আর আমাদের একজন লোককেও রেখে যাব সব দিকে নজর রাখার জন্য।
একটু থেমে আবার বললেন, আর আপনাকেও সতর্ক করে দিয়ে যাচ্ছি।
–আপনি নিশ্চিত থাকুন ইনসপেক্টর, বললেন মিস মারপল, নিজেকে আমি ভালই সামলাতে পারব।
.
০৭.
সেদিন মিসেস হারসন মিস মারপলকে নিয়ে লিটল প্যাডকসে এলেন চা খেতে। মিস মারপল এই প্রথম মিস লেটিসিয়া ব্ল্যাকলককে দেখলেন।
মিস ব্ল্যাকলক একটু আনমনাই ছিলেন। সারাক্ষণ চোরের ব্যাপারটাই তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে তা প্রকাশও করলেন তিনি।
–চোখ আর হুক এ দুয়ের কাছে চোরেরা জব্দ, মিস মারপল বললেন, দরজার শিকলটা ঠিক ভাবে দেবেন কেবল।
–কিন্তু আমার এখানে কেন চোর আসবে, চুরি করবার মত তো কিছু নেই।
-হাঞ্চ আমাকে সবই বলেছে, এখানে ডাকাতির ব্যাপারটা খুবই ভয়ানক ছিল। বললেন মিস মারপল।
উঃ, আমরা সকলেই খুব ভয় পেয়েছিলাম। এমন অভিজ্ঞতা আগে কারো হয়নি।
–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে লোকটা ব্যর্থ হয়। সে নিজেকেও গুলি করে। কিন্তু সে ঢুকেছিল কি ভাবে?
দরজাগুলো নিশ্চয়ই আমরা সে ভাবে বন্ধ করিনি। বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
–ওহো, লেটি, বলে উঠলেন মিস বানার, তোমাকে বলা হয়নি, ইনসপেক্টর আজ সকালে এক অদ্ভুত কাণ্ড করেছেন।
উনি দ্বিতীয় দরজাটা খোলার কথা বলছিলেন। বললাম, ওটা কখনো ভোলা হয় না, বন্ধ আছে। তিনি চাবি খুঁজে নিয়ে দরজাটা খুলেছিলেন। আর বললেন, দরজার কবজায় তেল দেওয়া হয়েছে। উনি একথা কেন বললেন বুঝতে পারছি না।
মিস ব্ল্যাকলক তার বান্ধবীকে থামতে ইঙ্গিত করছিলেন। সেটা দেরিতে বুঝতে পেরে মিস বানার বিস্মিত ভাবে থেমে গেলেন।
ব্যাপারটা সামাল দেবার জন্য মিস ব্ল্যাকলক বললেন, উনি যখন পরীক্ষা করছিলেন, তখন তুমি বুঝি সেখানে ছিলে। ইনসপেক্টর ক্র্যাডক চান না, এটা নিয়ে আলোচনা হয়। বুঝতে পারছেন তো মিসেস হারসন?
–নিশ্চয়ই, না, না, আমরা কোন কথা প্রকাশ করব না, কি বল জেন মাসি?
–চিপিং ক্লেগহর্নের মত ছোট জায়গায় কোন গোপনীয়তা রক্ষা করাও কঠিন। বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
–ঠিকই বলেছেন, বললেন মিস মারপল, বাড়ির চাকরবাকররাই বাইরে কথা ছড়িয়ে বেড়ায়।
–ব্যাপারটা আমি এবারে বুঝলাম, হাঞ্চ বলে উঠলেন, ওই দরজাটা খোলা সম্ভব হলে নিশ্চয় কেউ অন্ধকারে চুপিসারে ঢুকে ছিনতাই করতে পারত। বন্ধ ছিল বলে হয়নি। রয়্যাল স্পা হোটেলের সেই লোকটার কথা আমিও শুনেছি।
–ঘটনাটা তাহলে এই ঘরেই ঘটেছিল, বললেন মিস মারপল, কি ঘটেছিল সেদিন? খুবই আগ্রহ হচ্ছে জানতে।
সঙ্গে সঙ্গেই মিস বানার আর হাঞ্চ একই সঙ্গে নানা গোলমেলে বর্ণনা দিয়ে গেলেন। দু-এক ক্ষেত্রে তাদের ভুল সংশোধনও করে দিলেন মিস ব্ল্যাকলক।
সকলের কথাবার্তার মধ্যে প্যাট্রিক এসেও যোগ দিল। সে ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য তার লেটি মাসীকে খিলানের কাছে কোণের দিকে দাঁড় করিয়ে নিজে রুডি সার্জের অভিনয় করে দেখাল। দেয়ালের গায়ে বুলেটের গর্তগুলোও দেখানো হল।
-ওহ, নেহাৎ ভাগ্য আপনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে মিস ব্ল্যাকলক। শ্বাসরুদ্ধ স্বরে বললেন মিস মারপল।
–অতিথিদের জন্য আমি সবে সিগারেটের বাক্সটা নিতে যাচ্ছিলাম।
টেবিলের ওপরে রুপোর বাক্সটা দেখিয়ে বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
-ধূমপানের সময় লোকজন বড্ড বেখেয়ালি হয়ে পড়ে, সেটাই মারাত্মক ব্যাপার। দেখুন, এত সুন্দর টেবিলটাতে কি বিশ্রী দাগ পড়েছে। এ বরদাস্ত করা যায় না। বললেন মিস মারপল।
আমার ভাল লাগা জিনিস দু-পাঁচটাই ঘরে আছে–এসবের সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িত।
–ওহ, স্মৃতির অ্যালবাম। স্মৃতি সততই সুখের। ঘরের আসবাবের মত ফটোগ্রাফের ব্যাপারও তাই। আজকাল ওসব আর দেখতে পাই না লোকের ঘরে। আমার ভাইপো ভাইঝিদের পর্যন্ত, একেবারে বাচ্চা বয়সের ছবি রেখে দিয়েছি।
-ওহ, ছবির কথায় মনে পড়ে গেল, আমার তিন বছর বয়সের একটা বিচ্ছিরি ছবি তোমার কাছে আছে জেন মাসী। হাঞ্চ বলল।
প্যাট্রিককে উদ্দেশ্য করে মিস মারপল বললেন, আমার মনে হয় আপনার মাসীর কাছে আপনাদেরও অনেক ছবি আছে।
প্যাট্রিক তাকাল মিস ব্ল্যাকলকের দিকে। বলল, আমরা অনেক দূর সম্পর্কের।
–তোর বাচ্চা বয়সের একটা ছবি এলিনর মনে হয় আমাকে পাঠিয়েছিল। মিস ব্ল্যাকক বললেন, তবে সেটা আর নেই, এখন খুবই খারাপ লাগছে। ও চিঠি না লিখলে তো তোদের কথাও জানতে পারতাম না।
-আজকাল পারিবারিক বন্ধন ক্রমশই কেমন শিথিল হয়ে আসছে। আগেকার দিনের মত পারিবারিক মেলামেশাও আর নেই। বললেন মিস মারপল।
–প্যাট আর জুলিয়ার মাকে শেষ দেখেছিলাম ত্রিশ বছর আগে একটা বিয়ের সময়। ও খুব সুন্দরী ছিল। বললেন মিস ব্ল্যাকক।
–সেদিন, লেটি মাসী মনে আছে, তোমার একটা পুরনো অ্যালবাম দেখছিলাম। কেবল টুপি আর টুপি। বলল জুলিয়া।
মিস ব্ল্যাকলক আতুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
.
ফিরে আসার মুখে হাঞ্চ বলল, জেন মাসী, ওটা তুমি ইচ্ছে করেই করেছিলে, তাই না? ওই ফটোগ্রাফের কথাটা।
-হ্যাঁ। বোঝা গেল মিস ব্ল্যাকলক তার দুই তরুণ বোনপো বোনঝিকে আগে চিনতেন না, দেখেননি কথাটা ইনসপেক্টর ক্র্যাডককে জানাতে হবে।
.
লিটল প্যাডকসের বাড়িটা আজ সার্জেন্ট ফ্লেচারের এক্তিয়ারে চলে এসেছিল। তার ওপর বাড়ি সামলানোর দায়িত্ব চাপিয়ে সকালেই মিস ব্ল্যাকলক মিস বানারকে নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন।
মিৎসির আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সেও এগারোটা নাগাদ বাসে চেপে মেডেনহ্যাম ওয়েলসে চলে গেল।
ফ্লেচার এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। দ্রুত কাজে নেমে পড়লেন।
তেল লাগানো দরজাটা আবার দেখলেন। যেই তেল লাগিয়ে থাকুক, এই পথেই সে আলো নিভে যাবার পর চুপিচুপি ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মিৎসি ছাড়া এ দরজা আর কারো ব্যবহার করার দরকার হওয়ার কথা নয়।
পড়শীদের মধ্যে কারো পক্ষে বাড়ির লোকের অলক্ষ্যে দরজায় তেল দেওয়া সম্ভব নয়। বাড়িতে যারা আছে–প্যাট্রিক, জুলিয়া, ফিলিপিয়া হেমস আর ডোরা বানার এদের মধ্যেই কারোর কাজ।
বাড়িটা আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখলেন ফ্লেচার। কিন্তু কোথাও কোন গোপনীয়তা তার নজরে পড়ল না।
ফিলিপিয়া হেমসের ঘরে কেবল পাওয়া গেল ছোট একটা ছেলের ছবি, কিছু সাধারণ চিঠি। দক্ষিণ ফ্রান্সে তোলা কিছু ছবি ছিল জুলিয়ার ঘরে। প্যাট্রিকের ঘরেও ছিল কয়েকটা ছবি–তার নৌবাহিনীতে কাজ করবার সময়ের।
মিস ডোরা বানারের ঘরে ছিল তার ব্যক্তিগত সাধারণ কিছু জিনিস।
এমন সময় নিচের সিঁড়িতে শব্দ হল। কেউ উঠে আসছে সম্ভবত ফ্লেচার সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত ওপরে উঠে গিয়ে নিচে তাকালেন।
দেখা গেল মিসেস সোয়েটেনহ্যাম হল ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে এলেন। ড্রইংরুমের দিকে তাকালেন।
ফ্লেচার এবারে একটু শব্দ করে এগিয়ে এলেন।-ওহ, মিসেস সোয়েটেনহ্যাম
উঃ। বড় চমকে গিয়েছিলাম। বললেন মিসেস সোয়েটেনহ্যাম, ভাবলাম আবার চোর এল বুঝি।
ফ্লেচার নিচে নেমে এলেন।
-আমি মিস ব্ল্যাকলকের জন্য কিছু নাসপাতি এনেছিলাম, ড্রইংরুমের টেবিলে রেখেছি। ফ্লেচারের কৌতূহলী দৃষ্টি লক্ষ্য করে তিনি আবার বললেন, আমি ওই পাশের দরজা দিয়ে ঢুকেছি। এখানে আমরা সবাই সকলের বাড়িতে ঢুকি সার্জেন্ট। এই দরজা কেউ অন্ধকার হবার আগে বন্ধ করি না।
মিসেস সোয়েটেনহ্যাম এর পর চলে গেলেন। কিন্তু সার্জেন্ট ফ্লেচারের সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেল।
তিনি ভেবেছিলেন, বাড়ির লোক ছাড়া দরজায় অন্য কারো তেল লাগানো সম্ভব নয়। কিন্তু এখন বুঝতে পারলেন, বাড়িতে যখন কেউ থাকে না সে সময় যে কেউই এ কাজটা করতে পারে।
কর্নেল ইস্টারব্রুকের বাড়িতে হুলুস্থুলু বেঁধে গেল। তিনি চিৎকার করে ডাকলেন, লরা–কি বলছ ডার্লিং। মিসেস ইটারব্রুক এগিয়ে এলেন।
-আমার রিভলভারটা তোমাকে দেখিয়েছিলাম মনে আছে?
–বিচ্ছিরি সেই কালো জিনিসটা–হ্যাঁ, দেখিয়েছিলে, কি হয়েছে?
–ড্রয়ারে রাখা ছিল, দেখেছিলে তো?
–হ্যাঁ তাইতো।
–কিন্তু সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি কোথাও সরিয়ে রাখনি তো?
–ওহ না–না, ওই সাংঘাতিক জিনিসে হাত দিতে আমার ভয় করে।
–ওই বুড়ি–কি যেন নাম, সে কিছু করেনি তো?
–মিসেস বাট? না, না, ও ধরবে কেন?
–তাহলে,…তোমাকে কবে দেখিয়েছিলাম বলতো? মনে আছে?
আগের সপ্তাহেই তো, ড্রয়ার খুলেছিলে তখন দেখিয়ে বলেছিলেন হুনদের জিনিস।–হ্যাঁ হ্যাঁ–ঠিক একসপ্তাহ আগে। তারিখটা মনে নেই?
-তারিখ–আমরা ছবি দেখতে যাচ্ছিলাম–শেষে যাওয়া হল না-হা শনিবারেই তো-৩০ তারিখে। ভাল ভাবে মনে পড়েছে এবারে, মিস ব্ল্যাকলকের বাড়ির সেই ডাকাতির ঘটনার ঠিক পরের দিন। আগের দিনের গুলি চালানোর কথায় রিভলভারের কথা মনে পড়ল।
-আহ, বাঁচা গেল। কর্নেল ব্রুক বললেন।
–ওকথা কেন বলছ আন্টি?
-বুঝতে পারছ না, ওই ঘটনার আগে যদি রিভলভারটা হারাত তাহলে ওই সুইস ছোকরা হাতিয়েছে বলেই মনে হত।
–কিন্তু সে তোমার রিভলভারের কথা জানল কি করে?
–ওসব লোক সব খবর রাখে। আসলে ওটার জন্য কোন লাইসেন্স নিইনি। যুদ্ধ শেষ হলে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।
–তাই বলো।
–কিন্তু জিনিসটা গেল কোথায় বলতো?
-তাহলে মিসেস বাটকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখব। ওই ডাকাতির ঘটনার পর হয়তো ভেবেছেন বাড়িতে একটা রিভলভার রাখা উচিত
–তাকে জিজ্ঞেস করে কাজ নেই, তার মনে লাগবে। অত বড় বাড়িতে থাকেন—
বলে অন্য কাজে মন দিলেন কর্নেল ইস্টারব্রুক।
.
০৮.
ভিকারেজের গেট থেকে বেরিয়ে মিস মারপল গলি ধরে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে চললেন। তার হাতে রেভারেণ্ড জুলিয়ান হারমনের শক্ত বেতের ছড়ি।
শীতের সকালের ঠাণ্ডা ঠেকাতে অনেকেই ব্লুবার্ড কাফেতে এসে কফির কাপ নিয়ে বসেছেন মিস মারপলও সেখানে এসে ঢুকলেন।
একটা টেবিলে বসতে যেতেই মিস ডোরা বানারের কণ্ঠস্বর তার কানে এলো।
সুপ্রভাত মিস মারপল। চলে আসুন এপাশে, একাই আছি।
–ধন্যবাদ।
মিস মারপল এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন।
দুই বৃদ্ধার মধ্যে এর পর কিছুক্ষণ যে সব কথাবার্তা হল তার বিষয় ছিল গেঁটে বাত, নিউরাইটিস ইত্যাদি।
কাফের একটা মেয়ে তাদের কফি আর কেক পরিবেশন করে গেল।
এখানকার কেক খুব ভাল হয়। বললেন মিস বানার।
–সেদিন আপনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাগানে কাজ করছিল যে মেয়েটি-ভারি মিষ্টি দেখতে, কি যেন নাম
-হ্যাঁ, ফিলিপা হেমস–ভাল মেয়ে, আমাদের বাড়িতেই থাকে।
-এক কর্নেল হেমসকে আমি জানতাম, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন, ওরই বাবা হয়তো।
মেয়েটি হল মিসেস হেমস, বিধবা। ওর স্বামী ইতালিয়ন, কোথায় মারা যায়, আপনার কর্নেল হেমস তার বাবা হতে পারেন।
–ওই মেয়েটির মনে হয় রোমান্স গড়ে উঠেছে ওই লম্বা চেহারার তরুণটির সঙ্গে
–কার কথা বলছেন!
চশমাপরা তরুণটির কথা বলছি।
-ওহ বুঝেছি, এডমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম। আস্তে, ওপাশে কোণের দিকে ওর মা রয়েছে–মিসেস সোয়েটেনহ্যাম। ফিলিপাকে ও ভালবাসে বলছেন?
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মাথা নাড়লেন মিস মারপল।
–আপনি মিস ব্ল্যাকলকের স্কুলজীবনের বন্ধু শুনে আমার খুব ভাল লেগেছিল। এমন কেউ কাছে থাকলে ফেলে আসা জীবনের মধুর ছোওয়া পাওয়া যায়।
–ওর তুলনা হয় না, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিস বানার, মিস ব্ল্যাকলকের মত এমন বন্ধুবৎসল খুব কম লোকই হয়। এমন সুন্দর মেয়ে জীবনকে এত ভালবেসেছে, কিন্তু সবই কেমন দুঃখময়
–সত্যিই জীবন বড় দুঃখের। সহানুভূতির সুরে বললে মিস মারপল।
–দুঃখের আঘাত সহ্য করার শক্তি ওর অপরিসীম। তার জীবনে ভাল কিছু এলে সে তারই যোগ্য।
মিস ব্ল্যাকলকের ভবিষ্যতের প্রাচুর্যের কথা ভেবেই যে মিস বানার কথাটা বলছেন বুঝতে পারলেন মিস মারপল।
-হ্যাঁ অর্থ মানুষের জীবনকে সহজ করে তোলে। বললেন মিস মারপল।
মিস বানার কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। অতীতের ফেলে আসা দিনগুলিতে বুঝি ফিরে গিয়েছিল তার মন।
কেমন গভীর স্বরে বললেন, মিনচেস্টার হাসপাতালের সাহায্যের একটা খবর বেরিয়েছিল কাগজে। তাতে লেটির নাম দেখেছিলাম। ও ছিল বিরাট ধনী গোয়েডলারের সেক্রেটারি। দেখতে তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু জানতাম খুব দৃঢ় চরিত্রের মেয়ে ছিল ভাবলাম, আমার কথা হয়তো মনে আছে তাহলে ওর কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। সবার কাছে তো তা চাওয়া যায় না। তাছাড়া স্কুলের বন্ধুদের কে আর অত মনে রাখে
মিস ডোরা বানারের কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এসেছিল। চোখে অশ্রু টলমল করছে।
–চিঠি লিখলাম। আশ্চর্য, লেটি এসে আমাকে নিয়ে গেল। বলল বাড়িঘর নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, সাহায্য করার জন্য ওর একজন দরকার। কী দয়ার্দ্র মন, আর সহানুভূতি। পুরনো দিনের কথা কিছুই ভুলে যায়নি।
এই যে এখন…মাঝে মাঝে কেমন সব গোলমাল করে ফেলি…সবকিছু আগের মত মনে রাখতে পারি না। কিন্তু ধৈর্য রক্ষা করে ও সব সহ্য করে। ভাব করে যেন সত্যিই আমি ওকে সাহায্য করছি। এছাড়া সত্যিকার দয়া আর কি হতে পারে।
-হ্যাঁ, তাই তো। শান্ত স্বরে বললেন মিস মারপল।
লিটল প্যাডকস আসার পর খুব চিন্তা হত, ব্ল্যাকলকের কিছু হলে আমার কি হবে। এক অদ্ভুত ভাবনা।
লেটি বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল, তাই একদিন আমাকে ডেকে বলল, আমার জন্য কিছু মাসোহারার ব্যবস্থা করে রেখেছে। সেই সঙ্গে বাড়ির আসবাবপত্রগুলোও আমারই থাকবে।
হঠাৎ চুপ করে যান মিস ডোরা বানার। পরে বলেন, লেটির জন্য বড় কষ্ট হয় আমার। দুনিয়াটাকে একদম জানে না ও। বড় বেশিরকম বিশ্বাস করে ফেলে সবাইকে। এই সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ ওর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। স্বচ্ছল হওয়ায়, ও মানুষের ভেতরটা নিয়ে, অত বেশি মাথা ঘামায় না।
একটু থেমে আবার তিনি বললেন, ওই প্যাট্রিক, পয়সার টানাটানি বলে অন্তত দুবার এর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে।
কথা শেষ করেই মিস বানার সামনে ঝুঁকে বসলেন। বললেন, কাউকে বলবেন না, একটা কথা আপনাকে বলছি, সেদিনের ওই রহস্যময় ঘটনাটার সঙ্গে আমার মনে হয় প্যাট্রিক জড়িত। ও কিংবা জুলিয়া সুইস লোকটাকে চিনত। এসব কথা লেটিকে বলতে সাহস পাইনি আমি।
বেশি অদ্ভুত লাগে কি জানেন, ওরা তারই বোনপো-বোনঝি। লোকটা যে নিজেকে গুলি করেছে, আমার মনে হয় প্যাট্রিকই মতলবটা তাকে দিয়েছিল।
সব ব্যাপারটা যখন ভাবি, আমার কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। দরজাটা নিয়েই এখন পড়েছে সবাই। আমিও ভেবেছি। ইনসপেক্টর তো বললেন দরজায় নাকি তেল দেওয়া হয়েছে। আমি দেখেছিলাম–সেদিন প্যাট্রিককে ঝোপের মধ্যে দেখেছিলাম। হাতে একটা কাপ আর পালক ছিল, কাপটা তেল মাখার। দাঁড়িয়ে কিছু করছিল। আমাকে দেখতে পেয়েই অপরাধীর মত মুখ করে চমকে উঠে বলে উঠেছিল, ওটা কি দেখছিল। আমি ওর মিথ্যাকথা ধরতে পেরেছিলাম ঝোপের মধ্যে কাপটা যাবে কি করে?
আর একদিন জুলিয়ার সঙ্গে ওকে ঝগড়া করতে শুনেছিলাম। কি সব কালোবাজারিতে না কিসের সঙ্গে জড়িত না থাকার জন্য জুলিয়াকে শাসাচ্ছিল। জানেন, আমার ধারণা, প্যাট্রিকই ড্রইংরুমের ল্যাম্পটা নিয়ে কিছু করছিল যার জন্য আলো নিভে যায়।
ঠিক এমনি সময়েই দরজা খুলে ব্লুবার্ডে ঢুকলেন হাঞ্চ হারমন। টেবিলে ওদের দেখতে পেয়েই সোল্লাসে এগিয়ে এলেন।
-হ্যাল্লো, কফি কি সবই শেষ করে ফেলেছ?
–এসো, এককাপ নাও। খুশি হয়ে বললেন মিস মারপল।
-আপনারা বসুন। আমাকে একবার কেমিস্টের দোকানে যেতে হবে কটা অ্যাসপিরিনের জন্য।
বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন মিস ডোরা বানার।
-তোমাদের কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল? জিজ্ঞেস করলেন হাঞ্চ।
–সেদিনের সেই ঘটনার কথাই হচ্ছিল–অনেকেই তো রয়েছে সন্দেহ করার মতন বললেন মিস মারপল।
–সন্দেহ করার মত? হাতে গুণে বলা যায়, শোন, এই ভোর বানার, প্যাট্রিক সিমন্স, মিসেস সোয়েটেনহ্যাম আর এডমণ্ড আর ফিলিপিয়া হেমস, কর্নেল আর ইস্টারব্রুক। এছাড়া আমাকেও ইচ্ছে করলে এদের মধ্যে ফেলতে পার।
একটু থেমে হাঞ্চ ফের বললেন, তবে তুমি ঠিকই বলেছিলে, মিসেস ইস্টারব্রুকের মিস ব্ল্যাকলককে খুন করার কারণ আছে মনে হয় না।
-তা হতে পারে না। কোন কারণ নেই।
–খুনটা কে করেছে, তুমি বুঝতে পেরেছ, জেন মাসি?
অন্যমনস্কভাবে মিস মারপল বললেন, কিছুই জানি না…সময় বড় কম…খুবই কম… ।
কম মানে?
–সেই বৃদ্ধা মহিলা, যিনি স্কটল্যাণ্ডে আছেন যে কোন সময় মারা যেতে পারেন।
-তুমি তাহলে, অবাক হয়ে বলল হাঞ্চ, বিশ্বাস কর পিপ আর এমা বলে সত্যিই কেউ আছে? ওরাই তাহলে বলছ কাজটা করেছিল?
করেছিল, আবারও চেষ্টা করতে পারে। কাউকে খুন করার চেষ্টা করে কেউ ব্যর্থ হলে সে বসে থাকে না আবারও চেষ্টা করে। বিশেষ করে যদি বুঝতে পারে, কেউ সন্দেহ করেনি। বললেন মিস মারপল।
একটু কি চিন্তা করল হাঞ্চ। পরে মিস মারপলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, যদি পিপ আর এমারই এই কাজ হয়, তাহলে দুজন আছে যাদের সন্দেহ করা যেতে পারে। ওদের কথা ভেবেছ–প্যাট্রিক আর জুলিয়া। এরাও দুই ভাইবোন, বয়সটাও প্রায় একই।
-না হাঞ্চ, হাসলেন মিস মারপল, হিসেব অত সহজে মিলবে না। নানান ফ্যাকরা রয়েছে। তাছাড়া সরাসরি টাকা পাবার মালিক না হলেও তাদের মাও আছেন। ত্রিশ বছর আগে মিস ব্ল্যাকলক তাকে দেখেছেন, এখন দেখলেও তাকে চিনবেন কিনা সন্দেহ। আর সেই খারাপ লোকটি পিপ-এমার বাবাও রয়েছেন।উনি তো বিদেশী।
-তাতে কি, সেই অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান কর্নেলের ভূমিকায় তার অভিনয় করতে অসুবিধা কোথায়?
-তুমি তাহলে এদিক থেকেই এখন ভাবছ?
–যেখানে অনেক টাকার প্রশ্ন জড়িত সেখানে অনেক অভাবিত কাণ্ডই ঘটতে পারে। টাকার জন্য মানুষ কি না করতে পারে।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আমিও তাই ভাবি। কিন্তু এরা শেষ পর্যন্ত আদৌ লাভবান হয় কিনা সন্দেহ।
-সেটা বুঝবার মত অবস্থা তাদের থাকে না। হাঞ্চ বললেন, কিন্তু টাকাওয়ালা মানুষের কত কি কাজ করার সুযোগ থাকে। আমার তো নানা পরিকল্পনা মাথায় আসে–অসহায় স্ত্রীলোকদের জন্য বৃদ্ধাবাস, অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রম…
মিস মারপল হাঞ্চের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কোন মন্তব্য করলেন না।
–তবে এটা ঠিক জেন মাসী, এজন্য আমি কাউকে খুন করতে পারব না। কেননা ত জানি, সবাই বেঁচেবর্তে থাকতে চায়–সব প্রাণীই বাঁচতে চায়। আমি কোনও কিছুর জন্য কাউকে খুন করব না।
.
০৯.
মিসেস গোয়েডলার-লণ্ডনের অভিজাত এলাকায় তার চমৎকার বাড়ি রয়েছে, জমিদারী হ্যাঁন্সসায়ারে, দক্ষিণ ফ্রান্সেও রয়েছে একটা ভিলা। এই বৃদ্ধা, এখন স্কটল্যাণ্ডে শয্যাশায়ী হয়ে মৃত্যুর দিন গুনছেন। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও নিশ্চয় তার যোগাযোগ নেই।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই রাতটা ট্রেনে কাটিয়ে দিয়েছেন ডিকেটটিভ ইনসপেক্টর ক্র্যাডক।
হাইল্যাণ্ডসের একটা ছোট স্টেশনে তার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছিল। সেই গাড়িতে চেপে তিনি এসে পৌঁছলেন ধূসর রঙের পুরনো আমলের একটা বাড়ির সামনে।
দেখলে মনে হয় বিগত অতীত যেন এখানে সজীব হয়ে আছে।
একজন বয়স্ক বাটলার তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নান সেরে পোশাক পাল্টে তিনি নিজেকে চাঙা করে নিলেন। বিরাট একটা ঘরে তাকে প্রাতরাশের জন্য নিয়ে আসা হল।
প্রাতরাশের পর তার সঙ্গে দেখা করতে এল নার্সের পোশাক পরা সপ্রতিভ এক মহিলা। তিনি তার নাম বললেন মিস ম্যাকলয়েড বলে।
তিনি জানালেন, রোগিণী ইনসপেক্টর ক্র্যাডকের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য উৎসুক হয়ে আছেন।
ক্র্যাডক বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন সিস্টার কোন ভাবেই আমি তার উত্তেজনার কারণ ঘটাব না।
-তবুও আপনাকে আমার জানিয়ে দেওয়া উচিত, মিসেস গোয়েডলারকে দেখে আপনার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলেই মনে হবে। তিনি কথাও বলবেন স্বাভাবিকভাবেই। কথা বলতে ভালও বাসেন। তবে হঠাৎ করেই শক্তি ফুরিয়ে যাবে; নির্জীব হয়ে পড়বেন। আপনি সেই মুহূর্তেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে জানাবেন।
এখন সারাক্ষণই তাকে মরফিয়া দিয়ে রাখা হয়। আপনার আসার সংবাদ পেয়েই আজকের দিনের জন্য তাকে জোরালো উত্তেজক ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। ওষুধের ক্রিয়া যতক্ষণ আছে ততক্ষণ তিনি সজীবই থাকবেন। ওষুধের ক্রিয়া শেষ হয়ে এলেই নির্জীব হয়ে পড়বেন।
–হ্যাঁ, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি, সিস্টার। বর্তমানে মিসেস গোয়েডলারের স্বাস্থ্য কেমন চলছে দয়া করে যদি জানান ।
-এককথায় বলতে পারেন, তিনি মৃত্যুপথযাত্রী। বড়জোর সপ্তাহ কয়েক বেঁচে থাকতে পারেন। বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছার বলেই এখনো টিকে রয়েছেন, নইলে অনেক আগেই তার জীবনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার কথা। অসীম জীবনীশক্তি।
সিস্টার ক্র্যাডককে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে এক শয্যায় এক বৃদ্ধা মহিলা শায়িত। ক্র্যাডককে দেখে মনে হল মিস ব্ল্যাকলকের চেয়ে বয়স বেশ কয়েক বছর বেশিই হবে। অসুস্থতার জন্য বয়স আরও বেশি বলে মনে হয়। মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন থাকলেও মিষ্ট ভাবটি অমলিন রয়েছে। ক্র্যাডককে দেখে চোখের তারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার।
-কেমন আছে লেটিসিয়া ব্ল্যাকলক, শুনলাম, ওই আক্রমণে খুব বেশি আহত হয়নি। ব্যাপারটা খুবই কৌতূহলজনক। বললেন মিসেস গোয়েডলার।
–সৌভাগ্যবশত বড় আঘাত থেকে বেঁচে গেছেন। এখন ভালই আছেন। তিনি আপনাকে তার ভালবাসা জানিয়েছেন। বললেন ক্র্যাডক।
–শেষবার দেখেছি, বহুকাল হয়ে গেল। বড়দিনে একটা করে কার্ডের মাধ্যমেই কেবল যোগাযোগটা রয়েছে। শার্লটের মৃত্যুর পর যখন ইংলণ্ডে আসে, আমি তাকে এখানে আসার কথা বলেছিলাম। চিরকালই ব্লাকির বিচারবুদ্ধি প্রখর…আমাকে জানিয়েছে, এতবছর পরে ব্যাপারটা খুব বেদনাদায়ক হবে। খুব সত্যকথা বলেছিল ও।
নিজের কথা বলার আগে ক্র্যাডক বৃদ্ধাকে তার কথা বলে যেতে দিলেন। যদি এর মধ্য দিয়ে মিঃ গোয়েডলার ও মিস ব্ল্যাকলকের সম্পর্কটা উদ্ধার করা যায়।
মিসেস গোয়েডলার বলতে লাগলেন, পুলিসের কেউ এখানে বড় একটা আসে না। টাকার ব্যাপারটাই মনে হয় আপনার কাছে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে? আমার মৃত্যুর পরে ব্ল্যাকিই সব পাবে, র্যাণ্ডাল এরকমই ব্যবস্থা করে গিয়েছিল। আমি তো চিরকালই রোগভোগা মানুষ। ডাক্তার লেগেই ছিল। তাই আমি ওর পরে বেঁচে থাকব র্যাণ্ডাল কখনই ভাবেনি। ব্ল্যাক বেশ শক্তপোক্ত চেহারার ছিল, অসুখবিসুখে কখনও ভোগেনি।
একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন, নিজের জন্য আমি কোন দুঃখবোধ করিনি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, যে কোন সময় আমার আয়ুর মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে–স্বামীর আগেই আমি বিদায় নেব। কিন্তু, দেখতেই তো পাচ্ছেন…
ক্র্যাডক এই সুযোগে নিজের কথায় এলেন।–আপনার স্বামী এই সব টাকা মিস ব্ল্যাকলককে
-হ্যাঁ, কেন দিয়ে গেলেন? আপনি পুলিসের লোক, নিশ্চয়ই ভেবেছেন, এর মধ্যে কোন গোপন ভালবাসার ব্যাপার ছিল? আসলে কিন্তু তা নয়। ব্ল্যাকি অন্য ধাতের মেয়ে। নারীসুলভ দুর্বলতা বা অনুভূতি ওর ছিল না। এরকম নারীর সঙ্গে কোন পুরুষের ভালবাসার সম্পর্ক হওয়া অসম্ভব। তাছাড়া দেখতেও সুরূপা ছিল না। নারীজীবনের অনেক কিছু থেকেই ও বঞ্চিত ছিল।
মজা কি জানেন, র্যাণ্ডাল সবসময়ই ব্ল্যাকিকে তার ছোটভাই বলেই ভাবত। তার বিচার বুদ্ধির ওপর খুব নির্ভর করত। বহুবার ব্ল্যাকি তাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে।
–শুনেছি একবার অর্থ দিয়েও সাহায্য করেছিলেন।
–হ্যাঁ, তবে সেটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। আরও বেশি কিছু তার কাছ থেকে র্যাণ্ডাল পেয়েছে। র্যাণ্ডালকে সবসময় ব্ল্যাকি সঠিক পথে রাখত। নিজেও সে কখনও অসৎ পথে হাঁটেনি। তার চরিত্র অসাধারণ। প্রশংসা না করে থাকা যায় না।
ব্ল্যাকির জীবনের শুরুটা ছিল খুবই দুঃখবহ। বাবা ছিলেন গ্রামের সাধারণ এক ডাক্তার। ও লণ্ডনে চলে এসেছিল। পড়াশোনা করে চার্টারড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়। তার বোন শার্লট ছিল পঙ্গু। মৃত্যুর পর বোনটি অসহায় হয়ে পড়লে তাকে দেখাশোনা করার জন্যও চলে যায়।
–সেটা আপনার স্বামীর মৃত্যুর কতদিন আগে?
–তা বছর কয়েক আগে। ব্ল্যাকি আমাদের প্রতিষ্ঠানে থাকার সময়েই র্যাণ্ডাল উইল করেছিল। সে উইল আর পাল্টায়নি। কোথাও দানধ্যান করার কথা মনে করেনি। বলেছিল, আমাদের আপনার জন বলতে তো কেউ নেই। ব্ল্যাকিই এসব পাক, সে বুদ্ধিমতী, তাহলে অনেকটাই বাড়াতে পারবে।
দম নেবার জন্য একটু থামলেন মিসেস গোয়েডলার। তারপর বললেন, ঝুঁকি নেয়ার ব্যাপারটা র্যাণ্ডালের কাছে ছিল নেশার মত। ব্ল্যাকির মনটাও ছিল তারই মত। আর এই পুরুষসুলভ ব্যাপারগুলো করতে গিয়ে ভালবাসা সংসার সন্তান জীবনের এই মাধুর্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
কথা শেষ করে আবেশমাখা দৃষ্টিতে তিনি ক্র্যাডকের দিকে তাকালেন। আত্মমগ্নভাবে বললেন, আজ আমি আশক্ত পঙ্গু, কিন্তু একদিন জীবনের সবকিছুই পেয়েছিলাম। যাকে ভালবাসতাম তাকেই বিয়ে করেছিলাম। সন্তানও কোলে পেয়েছিলাম দুটো বছরের জন্য। আমি সকলের ভালবাসাও পেয়েছি–আমি ভাগ্যবতী।
ক্র্যাডক তার প্রশ্নটি আবার মিসেস গোয়েডলারকে ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন।
–আপনার স্বামী তার সব অর্থ মিস ব্ল্যাকলককে দিয়ে গেছেন। কিন্তু, তার তো নিজের এক বোন ছিল?
–হ্যাঁ। আপনি সোনিয়ার কথা বলছেন, কিন্তু বহু বছর আগেই দুই ভাই বোনে ঝগড়া হয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল।
–বোধহয় তিনি বোনের বিয়েটা মেনে নেননি?
-ঠিক বলেছেন। সোনিয়ার স্বামীর নাম দিমিট্রি স্ট্যামফোরডিস। কিন্তু র্যাণ্ডাল তাকে একদম সহ্য করত না। বলত সে শঠ, প্রতারক। কিন্তু সোনিয়া তাকেই ভালবেসেছিল আর বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে ফেলেছিল। সোনিয়ার তখন পঁচিশ বছর বয়স। নিজের ভাল মন্দ বোধ তার ভালই জন্মেছিল।
আমিও বিশ্বাস করতাম লোকটা ভাল ছিল না। শুনেছি তার পুলিসের খাতায় নামও ছিল। র্যাণ্ডাল ভাবত তার নামও আসল ছিল না। কিন্তু সে মেয়েদের কাছে ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। আর সোনিয়াকেও খুব ভালবাসত। তাই আমি বলতাম, সে যাকে ভালবেসেছে কেন তাকে বিয়ে করবে না। সে খুব সুন্দরী ছিল। তার প্রচুর অর্থও ছিল। তাদের সুখী না হবার কোন কারণ ছিল না।
-ভাইবোনের ঝগড়া কোনদিনই মেটেনি?
–না। তাদের আর কোনদিন বনিবনা হয়নি। বিয়ের পরই ভাইয়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক মিটিয়ে দিয়ে সোনিয়া চলে গিয়েছিল।
আঠারো মাস পরে বুদাপেস্ট থেকে তার একটা চিঠি পাই। ও লিখেছিল, র্যাণ্ডালকে জানাতে যে সে খুব সুখী আর সবেমাত্র তার যমজ সন্তান হয়েছে। তার চিঠিতে কোন ঠিকানা ছিল না।
–সোনিয়া আপনাকে তার সন্তানদের নাম জানিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ, পিপ আর এমা।
–তারপর?
–ও চিঠিতে জানিয়েছিল স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় চলে যাচ্ছে। র্যাণ্ডালকে জানিয়েছিলাম। ও বলেছিল ওই লোকটাকে বিয়ে করার জন্য সোনিয়াকে একদিন অনুতাপ করতে হবে। ব্যস। তারপর ওই পর্বের ওখানেই ইতি পড়েছিল। ওদের আর কোন খবর পাইনি।
পরে একসময় উইলের প্রসঙ্গ তুলে আমিই র্যাণ্ডালকে বলেছিলাম, মানুষের জীবনের কথা কিছুই বলা যায় না। দুর্ঘটনাতেও অকাল মৃত্যু হয় মানুষের। ব্ল্যাকি তখন টগবগে ঘোড়ার মত; কিন্তু দৈবাৎ যদি আমার আগে মারা যায়? কথাটা এভাবে ও ভাবেনি, তাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলেছি, তাহলে আর কি হবে, আর কেউ নেই। আমি বলেছিলাম, সোনিয়াকে তুমি না হয় বঞ্চিত করতে পার, কিন্তু পিপ আর এমা তো কোন দোষ করেনি। তুমি সবকিছু ওর সন্তানদের দাও। হয়তো পরে আরও কেউ হতে পারে। ও প্রথমে অমত করলেও পরে আমার। কথামতই কাজ করেছিল। কিন্তু ওরা যে কোথায় কোন দেশে আছে কিছুই জানি না।
আদৌ বেঁচে আছে কিনা তাই বা কে বলবে। যদি–ক্র্যাডকের চোখের ওপর দৃষ্টি ফেললেন মিসেস গোয়েডলার। শান্ত স্বরে বললেন, ব্ল্যাকি বড় ভাল…ওর কোন ক্ষতি না হয় দেখবেন।
কথা থেমে গেল তার। কেমন ঝিমিয়ে পড়লেন। চোখে মুখে ক্লান্তির ছায়া পড়ল।
ক্র্যাডক বুঝতে পেরে বললেন, আপনি ক্লান্ত, আমি এখন যাচ্ছি-
-শিথিল ভাবে মাথা নোয়ালেন মিসেস গোয়েডলার। ফিসফিস স্বরে বললেন, ম্যাককে পাঠিয়ে দিন। বড্ড ক্লান্তি লাগছে…দেখবেন…ওরা যেন…ব্ল্যাকির ক্ষতি করতে না পারে।…আমার মৃত্যু হওয়ার আগে পর্যন্ত ওর বড় বিপদ…ওকে দেখবেন
–আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব মিসেস গোয়েডলার।
ক্র্যাডক দরজার কাছে এসেই সিস্টার ম্যাকলেল্যাণ্ডকে দেখতে পেলেন। বিচলিত স্বরে বললেন, আশা করি ওঁর কোন ক্ষতি হয়নি।
–মনে হয় না। এমনই হয়।
-একটা কথা কিন্তু জানা হল না, বললেন ক্র্যাডক, পুরনো কোন ফটো ওঁর কাছে আছে। কিনা–
সিস্টার বাধা দিয়ে বললেন, দুঃখিত ইনসপেক্টর, সবই নষ্ট হয়ে গেছে। যুদ্ধের সময় লণ্ডনের বাড়িতে বোমার আগুনে সবই পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। অনেক ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট হয়ে যায় বলে মিসেস গোয়েডলার অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন।
.
তার এই ভ্রমণ শেষ করে ক্র্যাডক অনেকটাই আশান্বিত হলেন। একটা ছক তার চোখের সামনে পরিষ্কার ফুটে উঠল।
মিসেস গোয়েডলার যাই অনুমান করে থাকুন, এক ভাই আর এক বোন ইউরোপের কোথাও হয়ত বড় হয়েছে। তাদের মা সোনিয়া অর্থবতী ছিলেন। কিন্তু তার স্বামী দু-ভাইবোনের জন্মদাতা পিতার অপরাধী হিসেবে পুলিসের খাতায় নাম ছিল। একদিন হয়তো কপর্দকশূন্য অবস্থায় তারা ইংলণ্ডে এসেছিল। ভাইবোন সবার আগে এখানে যা করতে চাইবে তা হল, ধনী কোন আত্মীয় আছে কিনা তার খোঁজ করা।
সামারসেট হাউসে গিয়ে মিসেস ব্ল্যাকলকের কথা জানতে পারা তাদের পক্ষে অসম্ভব নয়। সেই সূত্রে র্যাণ্ডাল গোয়েডলারের বিধবা স্ত্রীর খোঁজ পেয়ে যেতে পারে তারা। যখন ওরা বুঝতে পারবে লোটেসিয়া ব্ল্যাকলক তার আগে মারা গেলে তাদের অর্থের অভাব চিরদিনের মত মিটে যেতে পারে…তারপর…তারপর…তারা একা অথবা একসঙ্গে…চিপিং ক্লেগহর্নে তাদের থাকা কি একেবারেই অসম্ভব?..
.
১০.
লিটল প্যাডকসের রান্না ঘরে মিৎসি কাজ করছিল। মিস ব্ল্যাকলক ঘরে ঢুকে বললেন, মিৎসি, আজ মিসেস বানারের জন্মদিন, কয়েকজন লোক আসবেন।
-তাই বুঝি! মিৎসির ভ্রূ উঁচু হল।
–তোমার সেই ছোট বিশেষ কেক বানাবে; যেরকম সুন্দর করে বানাও।
–কিন্তু সেই কেক বানাতে হলে আমার যে চকোলেট, বেশি মাখন আর চিনি চাই।
-আমেরিকা থেকে মাখনের যে টিন এসেছে সেখান থেকে নিতে পার। আর কিসমিস বড়দিনের জন্য রাখা আছে, চকোলেট আর চিনিও দরকার মত নিয়ে নিও।
-তাহলে দারুণ কেক বানিয়ে দেব। ওপরে চকোলেট লাগিয়ে দেখবেন শুভ কামনা লিখে দেব।
মিৎসির মুখ উজ্জ্বল হতে হতে আবার অন্ধকার হয়ে গেল।
–কিন্তু আমায় ওই কেককে মিঃ প্যাট্রিক বলেন মধুর মরণ। আমার কেকের ওরকম নাম একদম সহ্য হয় না।
মিৎসিকে সান্ত্বনা দিয়ে মিস ব্ল্যাক বললেন, এটা বলে ও তোমার কেকের প্রশংসাই করে মিৎসি। তোমার ওই কেক প্যাট্রিকের খুব প্রিয়।
–কিন্তু ওই মরা কথাটা ভাল লাগে না।
রান্না ঘর থেকে বাইরে এসে মিসেস ডোরা বানারের সঙ্গে দেখা হলো তার। তিনি হেসে বললেন। জান লেটি, রেমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম ফোন করেছিল। ও বিকেলে উপহার হিসেবে আমার জন্য একবোতল মধু নিয়ে আসবে। আর মিস হিঞ্চক্লিফ? বলেছেন আমার জন্য ডিম নিয়ে আসবেন।
–তোমার জন্মদিন উপলক্ষে চমৎকার সব হচ্ছে ডোরা। মধু, ডিম, তারপর জুলিয়া দিচ্ছে
–তোমার এই সুন্দর ব্রুচটাও তো রয়েছে।
গর্বিত আনন্দে বুকে ঝোলানো হীরের হারটা হাত দিয়ে দেখালেন মিসেস ডোরা বানার।
–গহনাটা তোমার পছন্দ হয়েছে বলে আমার ভাল লাগল।
বিকেলে সকলে ডাইনিং রুমের টেবিলে সাজানো ভাল জিনিসগুলো সানন্দে সকলে সদ্ব্যবহার করলেন। সকলেই কামনা জানালেন এমন জন্মদিন বারবার আসুক।
প্যাট্রিক একবার অবশ্য মিৎসির তৈরি জন্মদিনের কেকটাকে সোল্লাসে মধুর মরণ বলবার চেষ্টা করেছিল। মিস ব্ল্যাকলক তাকে চোখের শাসনে চুপ করিয়ে দিয়েছেন।
সকলে ড্রইংরুমে ফিরে আসার পর মিসেস হিঞ্চক্লিফ মিস ব্ল্যাকলককে বললেন, জেন মাসী এল না?
–না, কেন? বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
–একজন লোককে দেখলাম মুরগীর খাঁচার কাছে ঘুরঘুর করছে, সৈনিকের মত সুন্দর চেহারা।
জুলিয়া বলল, উনি আমাদের ডিটেকটিভ। ঘুরে ঘুরে বাড়ির ওপর নজর রাখছেন। লেটি পিসির জন্যই।
–পুলিস কি এখনো সন্তুষ্ট হতে পারেনি? বললেন মিসেস ইস্টারব্রুক।
–পুলিস সন্তুষ্ট নয়, সেই কারণেই ইনকোয়েস্ট পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন কর্নেল ইস্টারব্রুক।
-আসলে আমাদের সবার ওপরই পুলিসের নজর রয়েছে। বলল এডমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম।
–ওসব খারাপ কথা মিঃ সোয়েটেনহ্যাম, বললেন মিসেস ডোরা বানার, এখানকার কেউ আমার প্রিয় লেটির ক্ষতি চায় না আমি জানি।
জুলিয়া প্যাট্রিককে ফিসফিস করে কিছু বলল।
–কি ব্যাপার, তুমি কি কোন ভাবনায় পড়েছ ফিলিপা? বললেন মিসেস ব্ল্যাকল।
–ভাবনা? কেন? বিস্মিত হল ফিলিপা হেমস।
–কিছু হয়েছে নাকি? ইদানীং দেখছি কেমন আনমনা।
–ওহ, না, মিস ব্ল্যাকলক।
–যাক…ভাবছিলাম তুমি আর প্যাট্রিক বুঝি–তোমাদের দুজনকে খুব মেলামেশা করতে দেখছি তো
–প্যাট্রিক?
-হ্যাঁ। দেখ প্যাট্রিক আমার আত্মীয় বটে, কিন্তু তবু বলছি ভাল স্বামী হবার উপযুক্ততা তার নেই।
–আমি বিয়ে করব না। কঠিন স্বরে বলল ফিলিপিয়া।
-তোমার বয়স কম, বিয়েটা দেখে বুঝে করার সুযোগ পাবে। ও প্রসঙ্গ এখন থাক। আর কোন যেমন টাকাকড়ি–কোন অসুবিধা নেই তো?
-না, মিস ব্ল্যাকলক। আমি ভাল আছি।
ছেলেদের লেখাপড়ার ব্যাপারে তোমার ভাবনা থাকা স্বাভাবিক, আমি বুঝতে পারি। তাই একটা কথা বলছি শোন, কদিন আগে মিলচেষ্টারে আমার উকিল বেডিংফেণ্ডের কাছে গিয়েছিলাম। একটা নতুন উইল করবার কথা কদিন থেকে মনে হচ্ছিল–নানান কথা চিন্তা করেই। আমি ব্যবস্থা করেছি ফিলিপা, বনির মাসোহারা ছাড়া বাকি সবকিছুই তুমি পাবে।
ফিলিপা যেন ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল, আমি তা চাই না…কেন…আমি কেন নেব… তাছাড়া…প্যাট্রিক আর জুলিয়া রয়েছে…ওরা আপনার আত্মীয়।
দূর সম্পর্কের। আমার টাকায় ওদের কোন দাবী নেই। অদ্ভুত স্বরে বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
–তবু আমি চাই না।
-তোমাকে আমার ভাল লেগেছে ফিলিপা, বনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তোমার ছেলে রয়েছে। অবশ্য আমি মারা গেলে খুব বেশি কিছু পাবে না…আবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অন্য রকমও হয়ে যেতে পারে। মিসেস হারমন আর মিস মারপল এখানে আসতে পারেননি, ভালই হয়েছে। দুজনেরই ছোঁক ছোঁক করা স্বভাব। সবেতেই বাঁকা চোখ।
একসময় গৃহকর্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে জন্মদিনের পার্টি শেষ হল।
শেষ অতিথি বিদায় নেবার কিছুক্ষণ পরে মিসেস ডোরা বানার বললেন তার ভয়ানক মাথা ধরেছে। প্যাট্রিক বলল, ও কিছু না, কেকের জন্য অমন হয়েছে, আমারও পেট কেমন করছে।
–সারাদিন উত্তেজনার মধ্যে কাটল–এবার একটু শুয়ে পড়িগে। কটা অ্যাসপিরিন খেয়ে ঘুমুবার চেষ্টা করব।
-হ্যাঁ, সেটাই ভাল। বললেন মিস ব্ল্যাককক।
মিস বানার ওপরে উঠে গেলেন। কিন্তু একটু পরেই আবার নিচে নেমে এলেন।
-কি হল বনি। জিজ্ঞেস করলেন মিস ব্ল্যাকলক।
–আমার অ্যাসপিরিনগুলো কোথায় রেখেছি, খুঁজে পাচ্ছি না।
-তাহলে আমার বোতল থেকে নিয়ে নাও, বিছানার কাছে আছে। বললেন মিস ব্ল্যাকল।
–আমার ড্রেসিংটেবিলের ওপরেও আছে। ফিলিপিয়া হেমস বলল।
–ধন্যবাদ। দেখি আমারটা পাই কিনা। একটা নতুন বোতল।
–কথাটা বলতে বলতে মিসেস ডোরা বানার আবার ওপরে চলে গেলেন।
-সারা দিনটা ধকলে গেছে। বেচারী কাল না আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। বললেন মিসেস ব্ল্যাকক। ফিলিপার বিস্মিত ভীত দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল মিস ব্ল্যাকলকের মুখের ওপরে।
–কিন্তু…কিন্তু আপনি মারা যাচ্ছেন না। বলল সে।
–হ্যাঁ, ঠেকাতে পারব যদি উপযুক্ত সাবধানতা নিতে পারি। ভাবলেই বুঝতে পারবে। কথা শেষ করেই মিস ব্ল্যাকলক ঘর ছেড়ে হঠাৎ চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরেই ড্রইংরুমে ঢুকল জুলিয়া। ওর চোখ ঝকঝক করছিল।
-তোমাকে যেমন ভেবেছিলাম, দেখছি তুমি তা নও ফিলিপিয়া। খেলা বেশ ভালই খেলেছ, কি বল?
-তুমি তাহলে শুনেছ?
–আমাকে শোনাতে চাওয়া হয়েছিল বলেই শুনেছি।
–এ কথার মানে?
–ভালই বুঝতে পারছ তুমি। লেটি মাসী বোকা নয়, তুমিও জাল ভালই বিছিয়েছ।
–ওহ জুলিয়া…আমি এসব কখনো ভাবিনি।
-কেন ভাববে না। টাকা কার না দরকার। তবে ভুলে যেও না, লেটি মাসীর কিছু হলে সবার সন্দেহ তোমার ওপরেই পড়বে।
–তা কখনোই হবে না। তাকে এখন মারলে খুবই বোকামি হবে–
-তুমি দেখছি মিসেস গোয়েডলার স্কটল্যাণ্ডে মরতে বসেছেন সে খবর ঠিকই রাখ। অবাক করলে ফিলিপিয়া।
–তোমাকে আর প্যাট্রিককে আমি বঞ্চিত করতে চাই না। আর্তস্বরে বলে উঠল ফিলিপিয়া।
–কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।
৩. মিলচেস্টারে পৌঁছে
১১.
মিলচেস্টারে পৌঁছে ক্র্যাডক চিফ কনস্টেবল রাইডেসডেলের কাছে তার ভ্রমণের রিপোর্ট পেশ করলেন।
-তাহলে মিস ব্ল্যাকলক যা বলেছেন তা প্রমাণিত হল। পিপ আর–এমা! বললেন তিনি।
-প্যাট্রিক আর জুলিয়া সিমন্স প্রায় ওদেরই বয়সী। যদি প্রমাণ করা যায় মিস ব্ল্যাকলক বাচ্চা বয়সে ওদের দেখেননি
তাকে বাধা দিয়ে রাইডেসডেল বললেন, আমাদের হয়ে সেই কাজ ইতিমধ্যে মিস মারপলই করেছেন। মিস ব্ল্যাকলক দুমাস আগেই তাদের প্রথম দেখেন।
–তাহলে তো স্যার।
–না, ক্র্যাডক, তা হবার নয়। অনেক যাচাই বাছাইয়ের ব্যাপার রয়েছে। যতদূর জানা যাচ্ছে, প্যাট্রিক আর জুলিয়া এসবের মধ্যে নেই। প্যাট্রিক নৌবাহিনীতে ছিল, তার রেকর্ডেও ত্রুটি নেই। ক্যানেতে মিসেস সিমন্সের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগ করেছি। তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন, তার দুই ছেলে মেয়ে চিপিং ক্লেগহর্ন তার আত্মীয়া মিস ব্ল্যাকলকের কাছে আছে।
-কিন্তু আমার ধারণা
রাইডেসডেল একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, পড়ে দেখ মিসেস ইস্টারব্রুক সম্পর্কে এটা জানা গেছে।
কাগজের ওপর চোখ বুলিয়ে ক্র্যাডকের ভ্রূ উঠে গেল।
কিন্তু এ ঘটনার সঙ্গে এর সম্বন্ধ তো পাচ্ছি না।
–আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে নেই–মিসেস হেমস সম্পর্কেও এরকম আছে।
-তাহলে ভদ্রমহিলার সঙ্গে আর একবার কথা বলতে হবে স্যার। এ খবর প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। স্যর, ফ্লেচার কি রকম করেছে–
–সে তো কাজ করে চলেছে। মিস ব্লকব্লকের অনুমতি নিয়ে সমস্ত বাড়ি সার্চ করে দেখেছে। এটাও পরীক্ষা করে দেখেছে, বাড়িতে কেউ না থাকার সময় যে কেউ বাড়িতে ঢুকে দরজায় তেল লাগাতে পারে।
–ফ্লেচার কি বলছে, সকলেই কি খাবার সময়েই বাড়িতে ঢুকেছিল। জানতে চাইলেন ক্র্যাডক।
–প্রায় সবাই। এরপর তিনি যে বিবরণ শোনালেন তা এরকম–একটা মুরগী নিয়ে মিস মারগাটরয়েড ঢুকেছিলেন ডিমে তা দেওয়ানোর জন্য।
এরপর আসেন মিসেস সোয়েটেনহ্যাম। মিস ব্ল্যাকলক বরাবর তার জন্য ঘোড়ার মাংস এনে দেন। সেটা থাকে রান্নাঘরের টেবিলে, মিৎসির অনুপস্থিতিতে মিসেস সোয়েটেনহ্যাম নিয়ে যান। মিৎসিকে তিনি সহ্য করতে পারেন না বলে এরকমই বরাবর চলছে।
মিস বলেছেন ইদানীং ওদিকে যাননি, কিংবা গেলেও মনে করতে পারছে না। কিন্তু মিৎসি তাকে পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখেছিল। মিসেস বাট বলে স্থানীয় একজনও দেখেছেন সেটা।
মিসেস ইস্টারব্রুক কুকুর নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, সেই সময় একবার ঢুকেছিলেন মিস ব্ল্যাকলকের কাছে সেলাইয়ের নক্সা জানতে। তবে তিনি বাড়ি ছিলেন না।
-আর কর্নেল?
–বিবরণ শুনতে শুনতে জিজ্ঞেস করলেন ক্র্যাডক।
–ভারতের ওপরে লেখা একটা বই মিস ব্ল্যাকলক চেয়েছিলেন, তিনি সেটা নিয়ে গিয়েছিলেন।
-আমাদের সহযোগিনী মিস মারপলও কাজ করেছেন বলে ফ্লেচার জানিয়েছে। উনি ব্লুবার্ড কাফেতে সকালে কফি পান করতে গেছেন, আর লিটল প্যাডকসে চা পান করতে।
মিসেস সোয়েটেনহ্যামের বাগান দেখে প্রশংসা করেছেন, কর্নেল ইস্টারব্রুকের ভারতীয় কিউরিও সংগ্রহও দেখেছেন।
-কর্নেল ইস্টারব্রুক প্রকৃতই কর্নেল কিনা তিনি জেনেছেন?
-না জেনে থাকলেও জানবেন নিশ্চয়ই। তাছাড়া প্রাচ্যের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই যাচাই করে নেওয়া যাবে।
–ইতিমধ্যে মিস ব্ল্যাকলকের ক্লেগহর্ন থেকে সরে থাকাই মঙ্গল। উনি কি রাজি হবেন বলে মনে হয়, স্যার? মিস বানারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি স্কটল্যাণ্ডে মিসেস গোয়েডলারের কাছেই গিয়ে কিছুদিন থাকতে পারেন।
মিসেস গোয়েডলারের মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা? এ ব্যাপারে মনে হয় রাজি হবেন না।
-কিন্তু ব্যাপারটা খুবই গুরুতর, তাঁর জীবন রক্ষার প্রশ্ন। সময়ের ব্যাপারটাও তো মাথায় রাখা দরকার।
–কথাটা অবশ্য ঠিকই বলেছে ক্র্যাডক।
-মিসেস গোয়েডলারের অবস্থা এখন তখন। খুনীর পক্ষে সময় বড়ই কম। সে জানে, আমরাও কেউ বসে নেই। সবকিছুই পরীক্ষা করে দেখছি।
রাইডেসডেলকে চিন্তাগ্রস্ত দেখাল।-হ্যাঁ, যাচাইয়ের ব্যাপারটা ভারতে করতে হবে-সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
-একারণেই বলছি স্যার বিপদ আমাদের ঘাড়ের ওপর। বহু টাকা যেখানে জড়িত
–এই সময়, একজন কনস্টেবল ঘরে ঢুকে জানাল, চিপিং ক্রেগহন থেকে কনস্টেবল ফোনে কথা বলতে চাইছেন।
চিফ কনস্টেবল লাইনটা ধরে কথা বললেন। তাঁর মুখ ভাব কঠিন হয়ে উঠেছে।
–একটা দুঃসংবাদ পাওয়া গেল ক্র্যাডক। মিস বানার–নিজের অ্যাসপিরিনের বোতল খুঁজে না পেয়ে মিস ব্ল্যাকলকের বোতল থেকেই দুটো নিয়ে খেয়েছিলেন। বোতলে মোট তিনটে ছিল। সেটা পরীক্ষার জন্য ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়েছিল, তিনি জানিয়েছেন কিছুতেই অ্যাসপিরিন না।
মিস বানার কি মারা গেছেন স্যার?
-হ্যাঁ আজ সকালে মৃত অবস্থায় তাকে বিছানায় পাওয়া গেছে। ডাক্তার জানিয়েছেন, ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে। স্বাভাবিক মৃত্যু কিনা তার সন্দেহ রয়েছে। অবশ্য আজ রাতে ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাওয়া যাবে।
–আমি দেখেছি মিস ব্ল্যাকলকের বিছানার কাছেই অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট রাখা থাকত। দু-একদিনের মধ্যে ওই বাড়িতে কেউ কি এসেছিল? জানতে চাইলেন ক্র্যাডক।
–আমাদের ছকের মধ্যে যারা রয়েছে তারা সকলেই গতকাল সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। মিস বানারের জন্মদিনের পার্টি ছিল। ওদের যে কারোর পক্ষে ওপরে উঠে গিয়ে ট্যাবলেট বদলে রাখা অসম্ভব নয়। তাছাড়া বাড়ির লোকেদের পক্ষেও তা সম্ভব।
.
১২.
বাইরে বেরুবার আগে ভিকারেজের দরজার সামনে বাঞ্চ মিস মারপলের হাতে একটা লেখা দিলেন।
বললেন, মিস ব্ল্যাকলককে বলবে লেখাটা নিয়ে জুলিয়ান যেতে পারল না বলে দুঃখিত। একজন মরণাপন্ন মানুষকে এখনই তাকে দেখতে যেতে হবে। লেখাটা অন্ত্যেষ্টির জন্য। ইনকোয়েস্ট বুধবার হতে পারে। অন্যের জন্যে রাখা বিষাক্ত অ্যাসপিরিন খেয়ে বেচারা বানি মারা গেল। তোমার কষ্ট হবে যেতে, জেন মাসি, কিন্তু বাচ্চাটাকে নিয়ে এখুনি আমার হাসপাতালে না গেলেই নয়।
ঝড়ের মত কথাগুলো বলে বাঞ্চ চলে গেল। মিস মারপল ধীরে ধীরে হেঁটে মিস ব্ল্যাকলকের ড্রইংরুমে এসে উপস্থিত হলেন।
ওপরে খবর পাঠিয়ে তিনি ড্রইংরুমটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।
ডোরা বানার একদিন ব্লুবার্ডে দেখা হলে বলতে চেয়েছিলেন, প্যাট্রিক ল্যাম্প নিয়ে কি কারসাজি করেছিল, যাতে আলো নিভে যায়।
ল্যাম্প নিয়ে প্যাট্রিক কি কারসাজি করেছিল মিস মারপল বুঝতে পারছিলেন না।
খিলানের কাছে টেবিলে ছোট একটা ল্যাম্প রয়েছে। ডোনা বানার বলেছিলেন ড্রেসডেনের চীনামাটির তৈরি ল্যাম্পটা। আগে সেটা বাতিদান ছিল। পরে বিদ্যুতের ল্যাম্প বানিয়ে নেয়া হয়।
মিস মারপলের মনে পড়ল, এক চাষী বউয়ের মূর্তির আকারের ল্যাম্প, ডোনা বলেছিলেন, মাথায় বড় শেড। ল্যাম্পটা জোড়ার একটা। তাহলে চাষী আর চাষী বউ। ঘটনার দিন টেবিলে ছিল চাষীবউ, তার পরদিন যেটা দেখা গেল, সেটা চাষীর মূর্তি। রাতের মধ্যেই ল্যাম্পটা বদলে দেওয়া হয়েছিল। ডোরা বানার সন্দেহ করেছিলেন, কাজটা করেছে প্যাট্রিক।
কিন্তু কাজটা প্যাট্রিক করল কি ভাবে? সামনে থাকা ল্যাম্পটা দেখতে দেখতে চিন্তা করতে লাগলেন মিস মারপল।
ল্যাম্পের তার প্লাগে লাগানো। তার টেবিলের ওপর দিয়ে গেছে। তারের মাঝে বরাবর একটা সুইচ। বিদ্যুতের ব্যাপারে কোন ধারণা নেই মিস মারপলের তাই এর কিছুই বুঝতে পারলেন না তিনি।
কিন্তু এটা তো দেখা যাচ্ছে চাষীর মূর্তি। চাষী বউ ল্যাম্পটা তাহলে কোথায়? গুদাম ঘরে কি থাকা সম্ভব? না অন্য কোথাও। তিনি ভাবলেন ব্যাপারটা ইনসপেক্টর ক্র্যাডককে জানানো দরকার।
প্যাট্রিকের ওপরে সন্দেহ মিস মারপলেরও ছিল। বিজ্ঞাপনটা দেখে সেই ওটা দিয়েছে বলে তিনি ভেবেছেন। প্যাট্রিকের এরকম মজা করার স্বভাবের ব্যাপারটা জানতেন বলেই তিনি এরকম ভেবেছিলেন।
সুদর্শন তরুণ যুবক প্যাট্রিক। তরুণীদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় সন্দেহ নেই। প্যাট্রিকই কি তবে পিপ? যুদ্ধের সময় সে নৌবাহিনীতে ছিল। একবার যাচাই করা দরকার। ছদ্মবেশ হলে ধরা পড়বে।
এই সময় মিস ব্ল্যাকলক ঘরে ঢুকলেন। এই কদিনে তার বয়স যেন আরও বেড়ে গেছে।
মিস মারপল ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করতে হল বলে দুঃখিত মিস ব্ল্যাকক।
বলে বাঞ্চের দেওয়া লেখা কাগজটা বাড়িয়ে দিলেন।
–এক মরণাপন্ন লোককে দেখতে গেছেন বলে ভিকার আসতে পারলেন না। বাঞ্চও একটা বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে। ভিকার কিছু লিখে পাঠিয়েছেন আপনাকে।
ধন্যবাদ জানিয়ে হাতবাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে পড়লেন মিস ব্ল্যাকলক।
-ভাইকার খুবই সহৃদয়। বললেন তিনি, তাঁকে জানাবেন, তার ইচ্ছা মতই সব হবে।
বলতে বলতে তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে এল। গলা বুজে এল।
অনেক কষ্টে তিনি নিজেকে সংযত করলেন। মুখ তুলে বললেন, ডোরাই ছিল অতীতের সঙ্গে আমার যোগসূত্র।
ও চলে গেছে–আমি একা হয়ে গেলাম।
মিস মারপল তাকে সহৃদয় সহানুভূতি জানালেন–যে মনে রাখে সে চলে গেলে মানুষ বড়ই একা হয়ে যায়।
এই সময় বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ইনসপেক্টর ক্র্যাডক ঘরে প্রবেশ করলেন। মিস মারপলকে এসময়ে তিনি সেখানে আশা করেননি। বিরক্তির স্পষ্টে ছাপ পড়ল তার মুখে।
মিস মারপল বুঝতে পারলেন তার উপস্থিতি ক্র্যাডকের পছন্দ নয়। তিনি বিদায় জানিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।
ক্র্যাডক ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাকে সহানুভূতি জানিয়ে সময় নষ্ট করব না মিস ব্ল্যাকলক। মিস বানারের মৃত্যুতে নিজেকে অপরাধী বোধ করছি। আমাদের এটা ঠেকানো উচিত ছিল।
–আপনারা আর কি করতে পারতেন।
-হ্যাঁ, খুব সহজ হত না কাজটা। এখন আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। আপনার ওপর দুবার আক্রমণ হল–যে আড়াল থেকে এসব করছে, সে সম্ভবত আবারও চেষ্টা করবে।
মিস ব্ল্যাকক নীরব দৃষ্টিতে অসহায় ভাবে তাকালেন ক্র্যাডকের দিকে।
–মিসেস গোয়েডলারের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। কিছু সাহায্য পাওয়া গেছে। পিপ ও এমা–এমন দুজন যারা আপনার মৃত্যুতে লাভবান হবে। একবয়সী প্যাট্রিক আর জুলিয়া সিমন্সের কথা স্বভাবতই মনে আসে, কিন্তু তাদের অতীত জীবন পরিষ্কার। তবু কেবল এই দুজনের ওপর নজর রাখলেই আমাদের চলবে না। মিস ব্ল্যাকক, আপনি এখন দেখলে সোনিয়া গোয়েডলারকে কি চিনতে পারবেন?
–সোনিয়াকে, চিন্তিতভাবে বললেন মিস ব্ল্যাকলক, অনেক দিনের কথা; প্রায় ত্রিশ বছর…তারও যথেষ্ট বয়স হয়েছে…মনে হচ্ছে চিনতে পারব না।
-যে সময় তাকে দেখেছিলেন, এখনকার তার চেহারাটা কি মনে আছে?
-সোনিয়া, একটু ভাবলেন মিস ব্ল্যাকলক, গাঢ় রঙ..ছোটখাট চেহারা…
কোন বিশেষত্ব মনে করতে পারেন…কোন মুদ্রাদোষ
–না, তেমন কিছু ছিল বলে মনে হয় না…তবে বেশ হাসিখুশি ছিল।
–তার কোন ফটোগ্রাফ আছে?
ফটোগ্রাফ..দাঁড়ান মনে করে দেখি…কোথাও একটা অ্যালবামের মধ্যে অন্তত একটা ছবিও থাকা উচিত। হ্যাঁ, আছে
-আছে, সেটা একবার দেখতে পারি?
নিশ্চয়ই। কিন্তু অ্যালবামটা…কোথায় রেখেছি দেখতে হবে।
–আচ্ছা মিস ব্ল্যাকলক, মিসেস সোয়েটেনহ্যাম কি আপনার মনে হয় সোনিয়া গোয়েডলার হতে পারেন?
–মিসেস সোয়েটেনহ্যাম? অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন মিস ব্ল্যাকলক, কিন্তু ওর স্বামী তো সরকারী চাকরি করতেন…প্রথমে ছিলেন ভারতে তারপরে হংকং-এ।
–সেটা তো সোনিয়ার বলা কথা–নিজে কি জেনেছেন?
–না, তা অবশ্য নয়…কিন্তু না…মিসে সোয়েটেনহ্যাম…অবাস্তব—
সোনিয়া গোয়েডলার কখনও অভিনয় করতেন? মানে অপেশাদার কোন অভিনয়?
–ওহ হ্যাঁ–হ্যাঁ ও ভালই করত।
–মিসেস হারমনের মুখে শুনেছি মিসেস সোয়েটেনহ্যাম পরচুলা পরেন।
–হ্যাঁ…ওরকম থোকা…পরচুলা হতে পারে–তবু ও খুব ভাল…সোনিয়া হওয়া অসম্ভব।
–আর একটা কথা। আরও দুজন রয়েছেন এরকম
মিস হিঞ্চক্লিফ আর মিস মারগাটরয়েড। ওদের কেউ
–তাহলে মিস মারগাটরয়েড?
–ওহ না…কোনোভাবে না
–আপনি তো চোখে ভাল দেখেন না, তাই না?
কাছের জিনিস দেখতে অসুবিধা হয়।
যাই হোক, সোনিয়া গোয়েডলারের ছবিখানা একবার দেখতে চাই। অনেকদিন আগের হলেও একটা আদল পাওয়া সম্ভব হবে।
–এখনই দেখবেন?
–হলে ভাল হয়।
সেদিন আলমারি সাফ করার সময় জুলিয়া সঙ্গে ছিল। জুলিয়া বোধহয়
–ঠিক আছে আমি তাকে ডেকে আনছি।
ক্র্যাডক সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে জুলিয়ার নাম ধরে বার কয়েক হাঁক পাড়লেন।
জুলিয়ার সাড়া পাওয়া গেল। সে একটা ঘোঘারানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল।
–আমি চিলে কুঠিতে ছিলাম, কি হয়েছে?
ক্র্যাডক তাকে অ্যালবাম খোঁজার কথাটা জানালেন।
ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, ঘরে ঢুকে সে বলল, স্টাডি রুমে সব রাখা আচ্ছে–এনে দিচ্ছি। কয়েকখানা পুরনো অ্যালবাম পাওয়া গেল।
ড্রইংরুমে ফিরে এসে ক্র্যাডক বললেন, এগুলো কি?
-হ্যাঁ। বললেন মিস ব্ল্যাকলক। এর মধ্যে ছিল একেবারেই খেয়াল ছিল না। ক্র্যাডক পাতা উল্টে অ্যালবামগুলো দেখতে লাগলেন। টুপি মাথায় টিলা পোশাকের মেয়েদের নানা আকারের ছবি। কালি দিয়ে তলায় বর্ণনা লেখা। অনেক লেখাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
একটা অ্যালবামের তৃতীয় পাতা খুলে মিস ব্ল্যাকক বললেন, এখানে সোনিয়ার বিয়ের আগেকার ছবি থাকা উচিত।
কিন্তু ছবি খুঁজতে গিয়ে থমকে গেলেন তিনি। পাতায় কয়েকটা ফাঁকা জায়গা। অনেক কষ্টে ক্র্যাডক তলার অস্পষ্ট লেখার পাঠোদ্ধার করলেন।
সোনিয়া আর বেন সমুদ্রের তীরে, সোনিয়া ও আমি। শার্ট, আমি আর সোনিয়া।
লেখাগুলো পড়ে গম্ভীর হয়ে গেল ক্র্যাডকের মুখ। বললেন, ছবিগুলো এখানে ছিল, কিন্তু কেউ সরিয়েছে।
–সেদিন আমরা যখন দেখি তখন এত ফাঁকা জায়গা ছিল না তাই না লেটি মাসী।
সম্ভবত খুব শিগগিরই সরানো হয়েছে সোনিয়া গোয়েডলারের সমস্ত ছবি। চিন্তিত স্বরে বললেন ক্র্যাডক।
.
১৩.
স্টাডিরুমে আগুনের পাশে বসে ইনসপেক্টর ক্র্যাডক কথা বলছিলেন মিসেস হেমসের সঙ্গে।
-আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম মিসেস হেমস।
-বলুন।
-বলেছিলেন আপনার স্বামী ইতালিতে যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু আসল সত্যটা সেদিন আমাদের জানালেই ভাল করতেন যে তিনি সেনাবাহিনী থেকে একজন পলাতক।
মুহূর্তে মিসেস হেমসের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। তিনি বারবার হাত মুঠো করতে লাগলেন।
–অতীতকে কি খুঁড়ে বার না করলেই নয় ইনসপেক্টর। তিক্তস্বরে বললেন ফিলিপা হেমস।
–নিজেদের সম্পর্কে সকলেরই উচিত সত্য কথা বলা। বললেন ক্র্যাডক।
–কিন্তু এসব কথা সকলে জানুক আমি চাই না।
–না, কেউ জানবে না।
–আমার ছেলে, হ্যারি, এসব জানে না। আমি চাই না সে জানুক।
–কিন্তু সেটা কি খুব ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাবে না মিসেস হেমস। বড় হয়ে সে যদি কোন দিন নিজে জানতে পারে তার বাবার কথা, সেটা তার পক্ষে ভাল হবে মনে হয় না।
–তা করা আমার ইচ্ছে নয়। ওর বাবা যুদ্ধে মারা গেছে একথাই সে জানবে।
–কিন্তু আপনার স্বামী কি এখনো জীবিত? বললেন ক্র্যাডক।
–হয়তো। আমি কিছুই জানি না।
–তাকে শেষ কবে দেখেছেন?
বহু বচ্ছর তাকে দেখিনি।
–দিন পনেরো আগে তার সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?
–আপনার একথার উদ্দেশ্য?
–সামার হাউসে রুডি সার্জের সঙ্গে দেখা করেছেন, একথা আপনি অস্বীকার করলেও মিৎসি জোর দিয়েই কথাটা বারবার বলেছে। আমি বলতে চাইছি, মিসেস হেমস, সেদিন সামার হাউসে আপনার স্বামীর সঙ্গেই কথা বলেছিলেন।
–না, সামার হাউসে কারো সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
–টাকার দরকারে হয়তো দেখা করতে এসেছিল।
–আমিতো বলছি আমার সঙ্গে কারো দেখা হয়নি।
–দেখুন পলাতকরা বড় দুঃসাহসিক হয়ে পড়ে। ছিনতাই ডাকাতি অনায়াসে তারা করে ফেলে। বিদেশী রিভলভারও তাদের কাছে থাকতে পারে।
–আমার কিছু বলার নেই ইনসপেক্টর, বহু বছর আমার স্বামীকে আমি দেখিনি।
–এই তাহলে আপনার শেষ কথা, মিসেস হেমস।
–আমি দুঃখিত।
.
রাগ হলেও নিজেকে সংযত রাখলেন ক্র্যাডক। তবে কিছুটা বাঁধা পড়লেন তিনি। ফিলিপা মিথ্যা বলছেন তিনি বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু প্রাক্তন ক্যাপ্টেন হেমস সম্পর্কে আরও খবর কি করে বার করা যায় তা বুঝতে পারছিলেন না।
নানা কথা যখন ভাবছিলেন ক্র্যাডক অকস্মাৎ তার মনে পড়ে গেল জুলিয়া চিলেকুঠিতে ছিল বলেছে, সে ওখানে কি করছিল?
কথাটা মনে হতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। কাছে ধারে কেউ ছিল না। যে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে জুলিয়া নেমে এসেছিল সেই সিঁড়ি ধরেই ওপরে উঠে গেলেন তিনি।
ছোট্ট চিলেকুঠিতে বাতিল আসবাব, ভাঙ্গা ট্রাঙ্ক, সুটকেস ভঁই হয়ে আছে। তার মধ্যে অনেক টুকিটাকি জিনিস, ভাঙ্গা চেয়ারের হাতল, ছেঁড়া পাপোস, কাপ ডিস, একটা চীনামাটির ল্যাম্প। কয়েকটা ট্রাঙ্ক খুলে কিছু পুরনো মেয়েদের কাপড়, পরদার কাপড় ছাড়া কিছু পেলেন না।
এটা সেটা হাটকে পরে একটা স্যুটকেস খুলে কাগজপত্র আর অনেক চিঠিপত্র পাওয়া গেল।
চিঠিগুলো লেটিসিয়া ব্ল্যাকলকের বোন শার্লটের। কয়েকটা চিঠিতে দ্রুত চোখ বোলালেন ক্র্যাডক।
মিস ব্ল্যাকলকও পঙ্গু বোনটিকে কিছু চিঠি লিখেছেন। বোনের জন্য তার মানসিক দুশ্চিন্তা। আর ভাবনার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ক্র্যাডক আশান্বিত হলেন, এখানেই কোন সূত্র পেয়ে যাবেন তিনি। অজানা অনেক কিছু। কয়েকটা ফটোও রয়েছে। যে অ্যালবামের ছবি সরিয়েছে, এখানে সোনিয়ার ছবি থেকে থাকলে নিশ্চয় তার সন্ধান সে পায়নি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন ছবি পাওয়া গেল না। কয়েকটা চিঠি পকেটস্থ করে ক্র্যাডক নিচে নেমে এলেন।
সিঁড়ির গোড়াতেই মিস ব্ল্যাকলকের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল।
-ওহ, আপনি চিলে কোঠায় ছিলেন? শব্দ পেয়ে আমি দেখতে যাচ্ছিলাম কে–
মিস ব্ল্যাকলক, বহুবছর আগে অসুস্থ বোন শার্লটকে লেখা আপনার কয়েকটা চিঠি খুঁজে পেয়েছি। এগুলো নিয়ে গিয়ে আমাকে পড়তে হবে।
প্রচণ্ড ক্রোধ অনেক কষ্টে সংবরণ করলেন মিস ব্ল্যাকলক। তিনি কোনক্রমে বলতে পারলেন, এগুলো সব ব্যক্তিগত চিঠি ইনসপেক্টর। আপনি যা খুঁজছেন, এতে কিছুই পাবেন না। এগুলো নিয়ে যাবার ক্ষমতা হয়তো আছে, কিন্তু এ ধরনের কাজ
–আপনার নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমার সব কিছু ঘেঁটে দেখা দরকার মিস ব্ল্যাকলক। বিপদটাকে আপনি অস্বীকার করতে পারেন না, এগুলোতে হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে সোনিয়ার বিষয়ে।
একমুহূর্ত চুপ করে রইলেন মিস ব্ল্যাকলক। তার চোখ ছলছল করতে লাগল। নিজেকে সংবরণ করে বললেন, বিপদের কথা আমি জানি ইনসপেক্টর। বনি আমার জন্য রাখা অ্যাসপিরিনের বড়ি খেয়ে মারা গেছে। এরপর হয়তো আমার জন্য রাখা চকোলেট বা পানীয় খেয়ে মারা যাবে আর কেউ। প্যাট্রিক বা জুলিয়া কিংবা মিৎসি বা ফিলিপা। তবু আমি বলছি সোনিয়ার কোন বিষয় চিঠিগুলো থেকে আপনি পাবেন না। নিয়ে যান আপনি চিঠি। শার্লট আর আমার কাছে ছাড়া এগুলোর কোন দাম নেই। পড়া হয়ে গেলে পুড়িয়ে ফেলবেন। শেষ হয়ে যাক অতীতের সব স্মৃতি।
গলায় ঝোলানো চমৎকার কৃত্রিম মুক্তোগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
পরদিন বিকেলে ভিকারেজে মিস মারপলের সঙ্গে দেখা করলেন ক্র্যাডক। বাঞ্চ পাশেই ছিলেন।
ক্র্যাডক একটা চিঠি মিস মারপলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সেটা কিভাবে পেলেন সেই বিবরণ শোনালেন।
–এই চিঠিটা আপনি পড়ে দেখুন মিস মারপল। জীর্ণ হয়ে আসা কাগজের চিঠিটা মিস মারপল চোখের সামনে তুলে ধরলেন। প্রিয় শার্লট,
এখানে প্রচণ্ড এক পারিবারিক জটিলতায় জড়িয়ে যাওয়ার জন্য দুদিন তোমাকে চিঠি লিখতে পারিনি। তোমার নিশ্চয় মনে আছে র্যাণ্ডালের বোন সোনিয়া একবার তোমাকে গাড়িতে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। ডিমিট্রি স্ট্যামফোরডিস নামে একজনকে সোনিয়া বিয়ে করবে মনস্থ করেছে। কিন্তু র্যাণ্ডাল সেই লোকটিকে একেবারে সহ্য করতে পারেন না। এই নিয়ে দুজনে প্রচণ্ড রাগারাগি হয়ে গেছে।
আমাকেও এ নিয়ে ওদের দুজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। কিন্তু র্যাণ্ডাল লোকটির সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে। যত দূর জানা গেছে সে গ্রহণযোগ্য নয়।
র্যাণ্ডাল আমার কাজে খুবই সন্তুষ্ট। নির্ভর করেন। কথায় কথায় সে কথা জানাতেও ভুল করেন না। মাঝে মাঝে বলেন, তুমি আমাকে সবসময়েই সোজা পথে চলতে সাহায্য কর ব্ল্যাকি। আইনের বাইরে কোন কাজ র্যাণ্ডাল করেন না।
বেলও সোনিয়ার ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করেছে। সে বলেছে, তার টাকা আছে, যাকে সে ভালবাসে তাকে কেন বিয়ে করতে পারবে না? এর মধ্যে কোন ভুল নেই–পরে অনুশোচনা করতে হলেও। র্যাণ্ডাল আর সোনিয়ার মধ্যে হয়তো আর বনিবনা হবে না।
বাবা কেমন আছেন? তাকে আমার ভালবাসা জানিও। তুমি মনমরা হয়ে থেকো না। লোকজনের সঙ্গে কথা বলো।
সোনিয়া বলেছে তোমাকে জানাতে, তাকে মনে রেখো। ওকে একটা রাগী বিড়ালের মত মনে হচ্ছে। র্যাণ্ডালের ওপর সে খুবই রেগে গেছে। আমার ভয় হয় সে না র্যাণ্ডালকে খুন করে বসে।
অনেক ভালবাসা রইল। আমি খোঁজ নিয়েছি, আয়োডিন চিকিৎসায় বেশ ভাল ফল পাওয়া যাবে। –তোমার প্রিয় বোন
লেটিসিয়া
মিস মারপল অন্যমনস্ক ভাবে চিঠিটা ফিরিয়ে দিলে ক্র্যাডক বললেন, সোনিয়া সম্পর্কে আপনার কি ধারণা হল বলুন, মিস মারপল।
–দেখুন ইনসপেক্টর, অন্য একজনের মনের কথা থেকে কারো সম্পর্কে কোন ধারণা গড়ে নেয়া সহজ নয়।
-তাকে রাগী বেড়ালের মত লাগছে, প্রচণ্ড রেগে গেছে। তাকে না খুন করে বসে…এসব মন্তব্য থেকেও…
মিস মারপল কোন উত্তর করলেন না। কেবল অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে রইলেন ক্র্যাডকের দিকে।
–ওই রিভলভারটা…ওটা রুডি সার্জের নয় জানা গেছে। ওটা কোথা থেকে আসে তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। চিপিং ক্লেগহনে কার রিভলবার আছে জানা দরকার। বললেন ক্র্যাডক।
-কর্নেল ইস্টারব্রুকের একটা আছে। বললেন বাঞ্চ। সেটা তার কলার রাখার ড্রয়ারে রাখা থাকে।–আপনি তা কি করে জানলেন মিসেস হারসন?
–মিসেস বাট বলেছেন তিনি সপ্তাহে দুদিন আমার কাজ করে দিয়ে যান। তিনিই বলেছেন, চোরডাকাতের ভয়ে কর্নেল অস্ত্রটা হাতের কাছে রাখেন।
–একথা কবে বলেছিলেন তিনি?
–অনেক দিন আগে, কয়েক মাস হবে।
-কর্নেল ইস্টারব্রুক, ভদ্রলোক একটা বই দিতে একদিন লিটল, প্যাডকসে গিয়েছিলেন। তাঁর পক্ষে দরজায় তেল লাগান অসম্ভব নয়।
মিস মারপল বাঞ্চকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি মিস ব্ল্যাকলকের লেখা কাগজটা ইনসপেক্টরকে দেখাও।
বাঞ্চ কাগজটা ক্র্যাডকের হাতে তুলে দিলেন।
আমি খোঁজ নিয়েছি প্রতি বৃহস্পতিবার তিনটের পর যে কোন সময়। আমার জন্য যদি কিছু থাকে যেখানে সাধারণত থাকে, সেখানেই রেখে যাবেন।
লেখাটা পড়ে কিছুই বুঝতে পারলেন না ক্র্যাডক। তার মুখভাব লক্ষ্য করে বাঞ্চ হারসন হাসলেন।
ব্যাখ্যা করে বললেন, একটা খামারে প্রতি বৃহস্পতিবার মাখন তৈরি হয়। যার দরকার নিয়ে আসে। মিস হিনচক্লিফই সবার হয়ে মাখন নিয়ে আসেন। এর মধ্যে একটা বদলাবদলির ব্যাপারও রয়েছে। কেউ মাখন পেয়ে পাঠিয়ে দেয়। কেউ শুয়োর মারা হলে মাংস। এমনি আর কি। এক জিনিসের বদলে অন্য জিনিস কিছুটা মনে হয় বেআইনী কাজ।
–আমাকে এসব কথা না শোনানোই ভাল, এরকম বদলাবদলির কাজ সবটাই বেআইনী।
একটু থেমে তিনি হতাশ স্বরে বললেন, আমি আপাতত পিপ আর এমাকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। পর পর দুটো খুন হল, একজন পুরুষ একজন মহিলা, আরও একজন মহিলা সম্ভবত খুন হতে চলেছেন। নির্দিষ্ট করে কিছুই জানা সম্ভব হচ্ছে না। সোনিয়াকে সামনে রেখে আপাতত এগুবার চেষ্টা করছি। তিনি দেখতে কেমন ছিলেন জানতে পারলে ভাল হত। চিঠিতে এসম্পর্কে কিছুই জানা গেল না।
–চিঠিতে যে তার ছবি নেই কিভাবে জানলেন?
–মিস ব্ল্যাকলক বলেছেন, তিনি ছিলেন বেশ গাঢ় বর্ণের ছোটখাট চেহারার।
–তাই বলেছেন? মিস মারপল আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
–অ্যালবামেও এমন ছবি পাওয়া যায়নি যাকে দেখে ওরকম মনে হতে পারে। মিসেস সোয়েটেনহ্যাম অল্প বয়সে গাঢ় রঙের ছিলেন, আপনার মনে হয়?
বাঞ্চ বললেন, খুব গাঢ় রঙ ছিল না। চোখের তারা নীল ছিল।
–ডিমিট্রি স্ট্যামফোরডিসের একটা ছবি পেলেও কিছুটা সাহায্য হত। যাই হোক, চিঠিটা পকেটে ঢুকিয়ে বললেন ক্র্যাডক, চিঠিটা থেকে বলছেন আপনার মনে কোন ধারণা জন্মায়নি?
–হয়েছে বৈকি, মিস মারপল বললেন, সেই জায়গাটা আবার পড়ে দেখুন–র্যাণ্ডাল গোয়েডলার ডিমিট্রি স্ট্যামফোরডিসের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিলেন।
ক্র্যাডক অবাক হয়ে তাকালেন। ঠিক এই সময়ই টেলিফোন বেজে উঠল।
বাঞ্চ উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরলেন। তিনি ফিরে এসে ক্র্যাডককে জানালেন, আপনার ফোন।
ক্র্যাডক উঠে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলেন। ওপাশে কথা বলছিলেন চিফ কন্সটেবল রাইডেসডেল।
–ফিলিপ হেমসের সঙ্গে তোমার কথাবার্তার রিপোর্ট দেখলাম। সে জোর দিয়ে জানিয়েছে দীর্ঘদিন স্বামীর সঙ্গে তার দেখা হয়নি। তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, দিন দশেক আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল–একটা লোক লরিচাপা পড়েছিল। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ আর মেরুদণ্ড ভাঙা অবস্থায় তাকে মেলচেস্টার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
মনে পড়েছে স্যার, একটা বাচ্চাকে লরির প্রায় নিচ থেকে উদ্ধার করেছিল লোকটি। কিন্তু নিজেই শেষে চাপা পড়েছিল।
–হ্যাঁ, সেই ঘটনাটার কথাই বলছি। লোকটি গতরাতে মারা গিয়েছে, তাকে সনাক্ত করতে কেউ আসেনি। তবে তাকে সনাক্ত করা হয়েছে–সে সেনাবাহিনী থেকে পলাতক, লোকটির নাম রোলাণ্ড হেমস, দক্ষিণ লোমসায়ারের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন।
–ফিলিপা হেমসের স্বামী?
-হ্যাঁ, তার পকেটে চিপিং ক্লেগহনের বাসের টিকিট আর বেশ কিছু টাকা ছিল। সম্ভবত স্ত্রীর কাছ থেকেই টাকা পেয়েছিল।
লোকটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ২৮ তারিখ। লিটল প্যাডকসের ডাকাতির ঘটনা ঘটে ২৯শে। এতে দেখা যাচ্ছে ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে তার যোগ থাকা সম্ভব নয়। তার স্ত্রী দুর্ঘটনার বিষয়ে কিছু জানত না। তার হয়ত ধারণা হয়েছিল, ওই ঘটনার সঙ্গে তার স্বামী জড়িত, তাই ওরকম মুখ বন্ধ করেছিল।
–কিন্তু স্যর, তার কাজটি কিন্তু বীরত্বের।
–হ্যাঁ, লরি দুর্ঘটনা থেকে শিশুটিকে বাঁচানো বীরত্বের কাজ বৈকি। সেকারণেই মনে হয় না কাপুরুষতার জন্য হেমস পলাতক ছিল। শোন, এই কেসটা গোড়া থেকে তোমারই তদন্তে রয়েছে। খবরটা তুমিই তাকে জানিও।
–তাই করব স্যর। তিনি লিটল প্যাডকসে ফিরে এলেই বলব। তবে তার আগে একজনের সঙ্গে কথা বলে নেব ভাবছি।
.
১৪.
টেবিলের ল্যাম্পটা সরিয়ে মিস মারপলের সামনে এনে রাখলেন। বাঞ্চ মিস মারপল সেলাই করছিলেন।
–মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে জেন মাসী। আলোটা তোমার কাছে এনে দিলাম।
টিগলথ পিলেজার নামের বাড়ির পোষা বেড়ালটা পায়ে পায়ে ঘুরছিল। হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে টেবিলের ওপরে উঠে বসল। ল্যাম্পের তারগুলো চোখে পড়ায় সে আঁচড়াতে শুরু করল।
–এরকম করে না পিলেজার। ছিঁড়ে গেছে–শক লেগে যাবে-
-বলে মিস মারপল হাত বাড়িয়ে ল্যাম্পের সুইচ টিপতে গেলেন।
দাঁড়াও, ফুলগুলো সরিয়ে দি। সুইচটা তারের শেষে আছে। একটা ফুল দানি থেকে বাঞ্চ বড়দিনের কিছু লাল গোলাপ ফুল সরিয়ে নেবার জন্য হাত বাড়াল, অমনি পিলেজার ওর হাত আঁচড়ে দিল।
বাঞ্চের হাত কেঁপে গেল। আর ফুলদানি থেকে বেশকিছুটা জল ছিটকে পড়ল বৈদ্যুতিক তারের ছেঁড়া অংশে।
মিস মারপল এবারে লম্বাকৃতি সুইচটা টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফাঁশ করে একটা শব্দ আর আলোর ঝিলিক জেগে উঠল। আলো নিভে গেল।
-যাঃ ফিউস হয়ে গেল। বাঞ্চ বলে উঠল, সব অন্ধকার হয়ে গেছে, টেবিলের এ জায়গাটা পুড়েও গেছে–দুষ্টু টিগলাথের জন্য–কি হল জেন মাসী?
মিস মারপল হঠাৎ স্থির হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, না কিছু না। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল, আগেই এটা বোঝা উচিত ছিল।
বাঞ্চ ফিউজটা ঠিক করার কথা বললে, মিস মারপল বললেন, ব্যস্ত হয়ো না। আমাকে একটু চুপচাপ ভাবতে দাও।
বাঞ্চ তার কাজে চলে গেল। মিস মারপল একটি কাগজ টেনে নিলেন। তারপর প্রথমে লিখলেন, ল্যাম্প…তারপর একমিনিট চিন্তা করলেন, আর একটা কথা লিখলেন…তারপর লিখে চললেন…
.
বুলডার্সের শোবার ঘরে মিস হিনক্রিফ মিস মারগাটরয়েডের কাছ থেকে কিছু কথা উদ্ধার করবার চেষ্টা করছিলেন।
–আমার কিছুই মনে পড়ছে না। বললেন মারগাটরয়েড।
–তুমি মনে করবার চেষ্টা করো। শোন আমি দৃশ্যপটটা বলে যাচ্ছি। ছোটঘরের দরজায় আগেই কেউ তেল লাগিয়ে রেখেছিল যাতে খুলতে কোন শব্দ না হয়। ওই দরজাটা বরাবর বন্ধ থাকত।
যাক শোন, আলো নিভে গেল। অমনি নিয়মিত দরজা খুলে গেল, লোকটা টর্চ নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঘরের ভেতরে আমরা হুল্লোড় শুরু করলাম। সেই সময় আমাদের অজানা একজন ছোট ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকে নিঃশব্দে সুইস ছোকরার পেছনে এসে দাঁড়াল। তাকে গুলি করল। তারপর হাতের রিভলবারটা ছোকরার পাশে ফেলে দিল যাতে প্রমাণ হয় ওই সুইস ছোকরাই গুলি ছুঁড়েছে আর আলো জ্বলে ওঠার আগেই সেই অজ্ঞাত লোকটি আবার ছোট ঘরে ঢুকে পড়ল। ব্যাপারটা এবারে বুঝতে পেরেছ?
–পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি….কিন্তু ওই লোকটি কে?
–কেবল তুমিই সে কথা বলতে পার মারগাটরয়েড। কেন না তুমি নিয়মিত দরজার পাল্লার পেছন দিকে ছিলে।
-হ্যাঁ, সেটা মনে আছে।
–আর সে সময় দূরে ড্রইংরুমে ছিল প্যাট্রিক সিমন্স, ফিলিপি হেমস আর কর্নেল ইস্টারবুক। তুমি ছিলে দরজার পেছনে। টর্চের আলো যেদিকে পড়েছিল, তুমি ছিলে তার বিপরীত দিকে। আমাদের সকলের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল, তোমার তা হয়নি।
–কিন্তু…হ্যাঁ…টর্চের আলো ঘুরছিল–সবার মুখের ওপর পড়ছিল।
তাতে কি দেখা যাচ্ছিল—
-হ্যাঁ, মনে পড়ছে, মিস বানার বিহ্বল হয়ে তাকিয়েছিল, আর মিসেস হারসন একটা চেয়ারের হাতলের ওপরে বসেছিলেন। চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন
–হ্যাঁ, এই তো এতক্ষণে পথে এসে গেছ। কাদের তুমি দেখেছ, এটা মনে করতে পারলেই বেরিয়ে পড়বে সে সময় কাকে তুমি দেখতে পাওনি। অনেকেই ছিল যেমন জুলিয়া সিমন্স, মিসেস সোয়েটেনহ্যাম, মিস ইস্টারব্রুক…এরাই আরো। কিন্তু এদের মধ্যে এমন কেউ ছিল যে ওখানে ছিল না…মনে করার চেষ্টা কর মারগাটরয়েড
মিস মারগাটরয়েড চোখ বুজে ভাবতে লাগলেন। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, টর্চের আলো পড়ল হ্যাঁ…মিসেস হারমান…ডোরা বানার…টেবিল…টেবিলল্যাম্প… খিলান… আচমকা রিভলবারের গুলি তারপর…তারপর…হা, ওই মহিলা ওখানে ছিলেন না…হা শোন…
এই সময় আচমকা টেলিফোন বেজে উঠল। মিস হিনচক্লিফ এগিয়ে গিয়ে টেলিফোন ধরলেন।
-হ্যাল্লো–কে–পুলিস স্টেশন–বলুন–মিস হিনচক্লিফ জানতে পারলেন সকাল থেকে তার কুকুরটা থানায় রয়েছে। একফোঁটা জলও মুখে তোলেনি। পুলিস তাকে ভুল করে নিয়ে গিয়েছিল। দুঃখ প্রকাশ করে পুলিস অনুরোধ করেছে কুকুরটাকে নিয়ে আসার জন্য।
মিস হিনচক্লিফ যখন মিস মারগাটরয়েডের দিকে ফিরলেন তখন তিনি বলে চলেছেন…ওই মহিলা…ওখানে ছিলেন না…
ফিরে আসার পর শুনব মারগাটরয়েড় আমি পুলিস স্টেশনে কুকুরটাকে আনতে যাচ্ছি, সকাল থেকে নাকি থানায় রয়েছে, একফোঁটা…
বলতে বলতে তিনি দ্রুত গতিতে গ্যারেজের কাছে পৌঁছে গেছেন।
গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে মিস মারগাটরয়েডও ওখানে পৌঁছে গেলেন–কথাটা শুনে যাও হিনচ..ওই মহিলা ওখানে ছিলেন না…
গাড়ি চলতে শুরু করেছে ততক্ষণে।
মিস মারগাটরয়েড গাড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল। কিছু পশমী পোশাক রোদ্দুরে ছড়ান ছিল। সেগুলো তুলতে ছুটলেন তিনি।
মিস মারগাটরয়েড যখন ক্লিপ খুলে সোয়েটারগুলো তুলছেন এমন সময়…এমন সময় পেছনে কার পদশব্দ জাগল।
পর মুহূর্তেই একটা স্কার্ফ তার গলায় জড়িয়ে দিল কেউ, তারপর আচমকা টানে সেটা গলার ওপরে চেপে বসল…মিস মারগাটরয়েডের মুখ হাঁ হয়ে গেল..দম আটকে গেল স্কার্ফ আরও শক্ত হয়ে চেপে বসল… . থানা থেকে ফেরার পথে মিস হিনচক্লিফ রাস্তা থেকে মিস মারপলকে গাড়িতে তুলে নিলেন। কুকুরটা দেখে মিস মারপল প্রশংসা করলেন, ভারি সুন্দর কুকুর।
গাড়িতে আসতে আসতে মিস হিনচক্লিফ বললেন, আমি আর মারগাটরয়েড সেদিনের ওই খুনের ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করছিলাম…সেই সময় থানা থেকে ফোন পেলাম…
গাড়ি এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াল। কুকুরটা লাফিয়ে নেমে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেল। পরক্ষণেই তার চিৎকার শোনা গেল।
মিস হিনচক্লিফ ভেতরে এসে দেখতে পেলেন ঝুলতে থাকা কিছু পোশাকের নিচে কিছু শুঁকতে চেষ্টা করছে তার কুকুর বিউটি।
-কি হল ওখানে—
তিনি দ্রুত এগিয়ে গেলেন সেদিকে। মিস মারপলও তার পেছনে গেলেন।
বৃষ্টি সমানে পড়ছে। তার মধ্যে এগিয়ে গিয়ে দুজনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সামনে পড়ে থাকা প্রাণহীন দেহটা নীলাভ হয়ে উঠেছে।
–মেয়েমানুষটাকে একবার পেলে আমি খুন করব। চাপা ক্রুদ্ধ কাতর স্বরে বলে উঠলেন মিস হিনচক্লিফ।
–মেয়ে মানুষ। প্রশ্ন করলেন মিস মারপল। অসহায় ভঙ্গীতে তার দিকে তাকালেন মিস হিনচক্লিফ।
-হ্যাঁ, মেয়েমানুষ..আমি প্রায় জেনে…ফেলেছিলাম।
কিছুক্ষণ মৃতা বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।
–পুলিসকে এখুনি জানাতে হবে। ও খুন হল আমারই জন্য। ব্যাপারটা আমি খেলার ছলেই নিয়েছিলাম…
ভেতরে এসে ফোন তুলে তিনি সবকথা পুলিসকে জানালেন।
এরপর মিস মারপলের দিকে ঘুরে বললেন, কুকুরটাকে আনার জন্য থানায় যাবার আগে আমি আর মারগাটরয়েড সেই ঘটনা নিয়ে কথা বলছিলাম। ও কিছু বললে আমি বুঝতে পেরেছিলাম–ওই মহিলা এখানে ছিল না। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন, মিস মারপল, তিনজন মহিলা, মিসেস সোয়েটেনহ্যাম, মিসেস ইস্টারব্রুক, জুলিয়া সিমন্স। ওদের বাদ দিতে পারিনি। এদেরই একজন ড্রইংরুমে ছিল না…তার মানে যে ছিল না সে নিশ্চয়ই অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে হল ঘরে চলে যায়।
-হ্যাঁ, ব্যাপারটা বুঝতে পারছি।
–ওই তিনজনের মধ্যে একজন…তবে কে ঠিক জানা হল না।
মিস মারপল চিন্তিত ভাবে বললেন, এটা সন্দেহজনক ইঙ্গিত বলেই মনে হচ্ছে…হ্যাঁ, এতে ব্যাপারটা অনেকখানিই বদলে যেতে পারে।
.
১৫.
বাইরে গাড়ির শব্দ হল। মিৎসি ভেতরে খবরটা পৌঁছে দিল, আবার পুলিস এসেছে।
ক্র্যাডক অসম্ভব গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকলেন। তিনি মিস ব্ল্যাকলককে বললেন, মিস মারগাটরয়েড খুন হয়েছে। মাত্র একঘন্টা আগে শ্বাসরুদ্ধ করে তাকে মারা হয়েছে।
জুলিয়া আর প্যাট্রিক সিমন্স সবে মাত্র বাইরে থেকে ফিরেছিল। তারাও সেখানে উপস্থিত ছিল।
–মিস সিমন্স, আপনি আজ সারাদিন কোথায় ছিলেন? জিজ্ঞেস করলেন ক্র্যাডক।
–মেলচেস্টারে, এইমাত্র ফিরলাম।
–আর প্যাট্রিক আপনি?
–আমি আগের বাসেই এখানে ফিরেছি।
–তারপর কি করেন?
–মাঠের দিকে একটু হাঁটতে যাই।
এমনি সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল। মিস ব্ল্যাকলক রিসিভার তুললেন।
-হ্যাঁ-কে, বাঞ্চ? কি বলছ…না উনি আসেননি। আমার জানা নেই…হ্যাঁ, এখানে আছেন।
মিস ব্ল্যাকলক ক্র্যাডকের দিকে রিসিভার এগিয়ে দিয়ে বললেন, মিস হারসন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। মিস মারপল ভিকারেজে ফেরেননি, তাই চিন্তায় পড়েছেন।
ক্র্যাডক রিসিভার তুলে বললেন ক্র্যাডক বলছি
–খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছি ইনসপেক্টর, জেন মাসী কোথায় গেছেন জানি না। শুনলাম মিস মারগাটরয়েড মারা গেছেন
-হ্যাঁ, মিস হারসন। মিস মারপল তো ঘটনাস্থলেই ছিলেন। আধঘণ্টা আগে বেরিয়ে যান। এখনও ফিরে না থাকলে হয়তো পড়শীদের কারও বাড়িতে গেছেন।
-না, আমি সবাইকেই ফোন করেছি। কি হবে ইনসপেক্টর, আমার ভয় লাগছে।
–আমি আসছি আপনার ওখানে।
–আসুন। একটা কাগজ পেয়েছি, জেন মাসি বেরুবার আগে লিখেছিলেন। কিছু বুঝতে পারছি না অবশ্য
ক্র্যাডক রিসিভার নামিয়ে রাখলেন চিন্তিত মুখে।
মিস মারপলের কিছু হয়নি তো? উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন মিস ব্ল্যাকলক।
–আমিও তাই আশা করছি। বললেন ক্র্যাডক।
মিস ব্ল্যাকলক তার গলায় ঝোলানো মুক্তোর মালা নাড়াচাড়া করছিলেন। চাপা গলায় বললেন, ক্রমশই অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে ইনসপেক্টর। কোন উন্মাদই এসব করে চলেছে
চিন্তাচ্ছন্ন চোখে তার দিকে তাকালেন ক্র্যাডক। মিস ব্ল্যাকলককে খুবই উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। তার অসতর্ক টানে হঠাৎ গলার মালা ছিঁড়ে গোলাকার মুক্তোগুলো মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ল।
-আমার মুক্তো, মিস ব্ল্যাকলক কাতরে উঠলেন, পরক্ষণে একটা যন্ত্রণাময় শব্দ করে দাঁড়ালেন। গলায় হাত চেপে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলেন।
ফিলিপা মুক্তোগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছিল। বলল, সব সময় এটা পড়তেন। কেউ দিয়েছিল হয়তো। তাই এমন ভেঙ্গে পড়লেন।
–হতে পারে। ক্র্যাডক বললেন।
–এগুলো কি আসল মুক্তো? একটা মুক্তোদানা হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করলেন। তার মনে হল এতবড় মুক্তো আসল হওয়া শক্ত। কিন্তু যদি কোনভাবে আসল হয় তাহলে, অবশ্যই অমূল্য। র্যাণ্ডাল গোয়েডলারের দেওয়া যদি হয় তাহলে তো এর দাম
ক্র্যাডকের মাথায় ঘুরতে থাকে–মিস ব্ল্যাকলক বলেছিলেন, এ বাড়িতে কোন মূল্যবান জিনিস নেই। যদি মুক্তোগুলো আসল হয়…আর এর সন্ধান যে জানে সে অনায়াসে খুনের ঝুঁকি নিতে পারে।
মিস মারপলের কথা মনে হল, বাস্তবে ফিরে এলেন ক্র্যাডক। তিনি নিখোঁজ। এখনই তাকে ভিকারেজে যেতে হবে।
.
বাঞ্চ আর তার স্বামী জুলিয়ান চিন্তিত মুখে বসেছিলেন। ক্র্যাডক বললেন, উনি এখনও ফেরেন নি? কোন কাগজের লেখার কথা বলছিলেন।
বাঞ্চ কাগজটা এগিয়ে দিলেন। ক্র্যাডক সেটা টেবিলে বিছিয়ে পড়তে চেষ্টা করলেন।
প্রথম শব্দ ল্যাম্প
তারপর, বেগুনী ফুল, অ্যা
সপিরিনের বোতল কোথায় গেল?
রমনীর মৃত্যু?
মিৎসি…চেক…উনি খোঁজখবর করছিলেন…দারুণ দুঃখ সহ্য করেছেন…আয়োডিন… মুক্তো …লেটি…বেন।
সব শব্দের অর্থ ক্র্যাডকের কাছে বোধগম্য হল না। তিনি বাঞ্চের দিকে তাকিয়ে বললেন, উনি মুক্তোর উল্লেখ করলেন কেন? আচ্ছা, মিস ব্ল্যাকলক কি ওই তিন সারি মুক্তোর মালা সবসময় ব্যবহার করেন?
-হ্যাঁ। সবসময় গলায় থাকে। ওঁর ধারণা তাকে ভাল দেখায়। তবে নকল
–অন্য কোন কারণ…
–আপনি বলতে চাইছেন ওগুলো আসল?
-ওই আকারের মুক্তো তো দুলমবার্ড মিসেস হারসন। যাক এখন আসল কাজ হল মিস মারপল–তাকে খুঁজে পেতে হবে।
ক্র্যাডক মিস মারপলের পেন্সিলের লেখা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি পরের পর সূত্র অনুসরণ করছিলেন। সেটাই তার বিপদ ডেকে আনেনি তো? তার মনে হল, একবার ফ্লেচারের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার।
ক্র্যাডক ভিকারেজ থেকে বেরিয়ে তার গাড়ির দিকে এগোলেন। এমনি সময় লরেল ঝোপের আড়াল থেকে সার্জেন্ট ফ্লেচার বেরিয়ে এল।
–স্যার…
৪. লিটল প্যাডকসে রাতের খাওয়া
১৬.
লিটল প্যাডকসে রাতের খাওয়া শেষ হল নিতান্ত নিরানন্দময় পরিবেশে, নিঃশব্দে।
মিস ব্ল্যাকলক। প্যাট্রিক আর জুলিয়া সিমন্স, ফিলিপা হেমস, মিৎসি কারোর মুখেই হাসি ছিল না। কেউ কেউ দু-একবার কথা বলার চেষ্টা করলেও জমেনি।
ইনসপেক্টর ক্র্যাডক জানিয়েছিলেন তিনি সকলকে নিয়ে আধঘন্টার মধ্যেই উপস্থিত হচ্ছেন। মিস মারপলের নিখোঁজ হওয়া মিস মারগাটরয়েডের মৃত্যু-সমস্যাগুলো আলোচনার দরকার।
সকলে ড্রইংরুমে অপেক্ষায় রয়েছেন। বাড়ির সব আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একটা গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল বাইরে। পরক্ষণেই ঘরে ঢুকলেন ক্র্যাডক। তার সঙ্গে কর্নেল আর মিসেস ইস্টারব্রুক, মিসেস সোয়েটেনহ্যাম আর তার ছেলে এডমণ্ড সবার শেষে মিস হিনচক্লিফ ঢুকলেন ঘরে। প্রত্যেকেই ম্রিয়মান।
সকলে আসন গ্রহণ করলে ক্র্যাডক দরজার পাশে দাঁড়ালেন। তার প্রায় মুখোমুখি রয়েছেন তিন মহিলা–জুলিয়া আর মিসেস সোয়েটেনহ্যাম সোফায় বসে, মিসেস ইস্টারব্রুক স্বামীর চেয়ারের হাতলে।
মিস ব্ল্যাকক আর মিস হিনচ বসেছিলেন আগুনের সামনে। এডমণ্ড ছিল তাদের পাশে। একটু দূরে বসেছিল জুলিয়া।
কোনরকম ভূমিকা না করেই ক্র্যাডক বলতে শুরু করলেন, মিস মারগাটরয়েড খুন হয়েছে, আপনারা সকলেই জানেন। তাকে যে খুন করেছে, আমাদের ধারণা সে একজন স্ত্রীলোক। বিশেষ কারণেই তাই আমাদের তদন্তের গণ্ডিও ছোট হয়ে গেছে। ওখানে উপস্থিত মহিলাদের কাছ থেকে আমি জানতে চাই তারা বিকেল চারটে থেকে চারটে কুড়ি মিনিট পর্যন্ত কোথায় ছিলেন, কি করেছেন।
মিস সিমন্স অবশ্য আমাকে আগেই তার বক্তব্য শুনিয়েছেন। তবু তাকে আর একবার তা শোনাতে বলছি। কনস্টেবল এডওয়ার্ড শর্টহ্যাণ্ডে আপনাদের বক্তব্য লিখে নেবে।
জুলিয়া বলল, বলতে যখন হচ্ছে, আমি আবারও বলছি, চারটে থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত আমি নদীর ধারে পথ ধরে হাঁটছিলাম। অবশ্য পথে কারও সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
–এবারে বলুন মিসেস সোয়েটেনহ্যাম। বললেন ক্র্যাডক।
-বলছি, একটু ভেবে নিতে দিন। বললেন মিসেস সোয়েটেনহ্যাম, যতদূর মনে পড়ছে, বৃষ্টি আসার আগে আমি শুকনো ক্রিসেন থিমাম ফুলের গন্ধ শুঁকে দেখছিলাম।
–ঠিক চারটে দশ মিনিটে বৃষ্টি নেমেছিল। বললেন ক্র্যাডক।
–বোধহয় তাই, আমি সে সময় ওপরে বারান্দায় একটা হাত ধোয়ার বেসিন রেখেছিলাম। বারান্দায় জল আসছিল বলে বর্ষাতি আর জুতো নিয়ে নিচে নেমে যাই। এডমণ্ডকে ডেকেছিলাম, ও কোন সাড়া দেয়নি, বোধহয় বই লিখছিল কিংবা ঘুমোচ্ছিল। এরপর আঁটা দিয়ে নর্দমা সাফ করতে থাকি। পাতা বোঝাই হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
–আপনাকে নর্দমা সাফ করতে কেউ দেখেছে?
–না, কেউ দেখেনি।
–মিঃ সোয়েটেনহ্যাম, আপনি আপনার মায়ের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন?
–না, এডমণ্ড উত্তর দিল, আমি ঘুমুচ্ছিলাম।
–এবারে মিসেস ইস্টারব্রুক বলুন।
মিসেস ইস্টারব্রুক বললেন, আর্চির সঙ্গে স্টাডিতে বসে রেডিও শুনছিলাম।
কর্নেল ইস্টারব্রুক স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ঠিক বলছ না, এ ধরনের তদন্তে সেটা জরুরী। আমি বলছি ইনসপেক্টর, আমার স্ত্রীর স্নায়ুর ওপরে এঘটনায় প্রচণ্ড চাপ পড়েছে, সে ঠিকভাবে বলতে পারছে না। আমি ল্যাম্পিয়নের সঙ্গে মুরগীর খাবার বিষয়ে কথা বলছিলাম। তখন প্রায় সোয়া চারটে। বৃষ্টি থামার আগে ফেরা হয়নি।
–আপনিও কি বাইরে গিয়েছিলেন মিসেস ইস্টারব্রুক? প্রশ্ন করলেন ক্র্যাডক।
ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মত মুখ হয়ে গিয়েছিল মিসেস ইস্টারব্রুকের। তিনি বললেন, না আমি বাইরে যাইনি রেডিও শুনছিলাম।
-ঠিক আছে আপাতত এতেই চলবে। আপনাদের বক্তব্য টাইপ করে সকলকে দেখানো হবে, আপনারা পড়ে ঠিক আছে কিনা দেখে সই করে দেবেন।
মিসেস ইস্টারব্রুক বললেন, অন্যদের কাছে তো কিছু জানতে চাইলেন না ইনসপেক্টর, ওই এডমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম আর জুলিয়া সিমন্স মেয়েটা?
ইনসপেক্টর ক্র্যাডক বললেন, মিস মারগাটরয়েড মারা যাবার আগে বলেছিলেন এমন একজনের কথা যিনি ডাকাতির ঘটনার সময়ে ঘরে অনুপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তার ঘরে থাকারই কথা ছিল। তিনি তার বন্ধুকে জানিয়েছিলেন সে রাতে একজন স্ত্রীলোক ঘরে ছিলেন না।
কিন্তু অন্ধকারে টর্চের আলোয় সকলের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। কারও কিছু দেখার সম্ভাবনা ছিল না। জুলিয়া বলে উঠল।
-মারগাটরয়েডের ছিল; বলে উঠলেন মিস হিনচক্লিফ, সে ছিল দরজার পেছনে, এখন ইনসপেক্টর যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। সেদিন ঘরে কি ঘটছে একমাত্র মারগাটরয়েডের পক্ষেই দেখা সম্ভব ছিল।
এই সময় মিৎসি এসে ঘরে ঢুকল।
–এই যে বীরপুরুষ পুলিস, আমি রান্নাঘরে কাজ করি বলে ডাকার দরকার মনে করেন নি, তাই না? কিন্তু আমি মিৎসি, অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি দেখতে পায়, অনেক বেশি জানে। ডাকাতির দিন আমি অনেক কিছু দেখেছিলাম। বিশ্বাস করতে পারিনি তাই কাউকে বলতে চাইনি।
তুমি ভেবেছিলে সব শান্ত হয়ে গেলে বিশেষ একজনের কাছে টাকা চাইবে, তাই তো? বললেন ক্র্যাডক।
–কেন চাই না? ফোঁস করে উঠল মিৎসি, একদিন যখন অনেক টাকা আসবে জানি, আর জানি যখন কি সব চলছে, তখন টাকা আদায় করতে ছাড়ব কেন? এখন আমার ভয় করছে, তাই আর চুপ করে না থেকে যা জানি সব বলব।
বেশ, তাহলে তাই বল। বললেন ক্র্যাডক।
-বলব, সব বলব সেই রাতের ঘটনা। আমি পার্টিতে ছিলাম না। রান্নাঘরে বাসনপত্র গুছোচ্ছিলাম। ডাইনিং ঘরে এলে গুলির শব্দ হল। তখন হলঘর একদম অন্ধকার। আবার গুলির শব্দ হল আর টর্চটা পড়ে গেল। তখনই আমি স্ত্রীলোকটাকে দেখলাম। সেই লোকটার পাশে বন্দুক হাতে দাঁড়ান। আমি দেখলাম মিস ব্ল্যাকলক দাঁড়িয়ে আছেন।
-কি বলছ মিৎসি, তুমি পাগল হয়েছ? হতবাক মিস ব্ল্যাকলক বলে উঠলেন।
–সম্ভব, এডমণ্ড বলে উঠল, মিৎসি কখনই মিস ব্ল্যাকলককে দেখতে পারে না।
-তাই বুঝি মিঃ সোয়েটেনহ্যাম, তীব্র শ্লেষের স্বরে বলে উঠলেন ক্র্যাডক, আমিও জানি মিৎসি মিস ব্ল্যাকলককে দেখেননি, কেননা সেখানে তখন তিনি ছিলেন না, ছিলেন আপনি। তাই না?
-আমি?…কি বলছেন আপনি, কখনও না–
–আপনিই কর্নেল ইস্টারব্রুকের রিভলবার তাঁর ড্রয়ার থেকে সরিয়ে ছিলেন, মজা করার জন্য রুডি সার্জের সঙ্গে রফা করেছিলেন। প্যাট্রিক সিমন্সকে অনুসরণ করে আপনি অন্য ঘরে গিয়েছিলেন। তারপর আলো নিভে যেতেই তেল লাগানো দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। মিস ব্ল্যাকলককে গুলি করে আপনি রুডি সার্জকে গুলি করে হত্যা করেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই কিছু না জানার ভান করে ড্রইংরুমে ঢুকে লাইটার জ্বালাবার চেষ্টা করেন।
এডমণ্ড একেবারে নীরব হয়ে গেল। পরক্ষণেই চিৎকার করে উঠল, আমার একাজ করার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? কেন আমি করব? সবই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
ক্র্যাডক বললেন, মিসেস গোয়েডলারের আগে যদি মিস ব্ল্যাকলক মারা যান তাহলে দুজনেরই লাভবান হবার কথা। তারা হল পিপ আর এমা। আমরা জেনেছি জুলিয়া সিমন্সই এমা
-আপনি বলতে চাইছেন, আমি পিপ? চিৎকার করে বলল এডমণ্ড, একেবারে গাঁজাখুড়ি গল্প। হয়তো আমি কাছাকাছি বয়সের। কিন্তু মিঃ পুলিশ, আমার জন্মের সার্টিফিকেট, স্কুল, কলেজের সার্টিফিকেটই বলবে আমি এডমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম।
এমন সময় অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা গলা শোনা গেল, ও পিপ নয়, আমিই পিপ ইনসপেক্টর।
ফ্যাকাশে মুখে সামনে এগিয়ে এল ফিলিপা হেমস।
-আপনি, মিসেস হেমস?
-হ্যাঁ। পিপ ছেলে একথাই সকলে ধরে নিয়েছিল, কেবল জুলিয়া জানত তার যমজ এক মেয়ে। সে একথা কেন বলেনি আমি জানি না।
-আমি হঠাই জানতে পেরেছিলাম তুমি কে, বলল জুলিয়া।
–প্রথমে আমারও তাই মনে হয়েছিল, ফিলিপা বলল, আমার স্বামী মারা গেলে আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। মা আগেই মারা গিয়েছিলেন? গোয়েডলারের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা জানতে পারি আমি। জেনেছিলাম, মিসেস গোয়েডলার মারা গেলে সব টাকাকড়ি পাবেন মিস ব্ল্যাকক নামে একজন। তার খোঁজ করে এখানে এসে মিসেস লুকাসের কাছে কাজ নিই। ভেবেছিলাম, মিস ব্ল্যাকলক নিশ্চয় আমার মত একজনকে সাহায্য করবেন। আমার হ্যারির শিক্ষার জন্য টাকার দরকার ছিল।
কিন্তু…দম নেবার জন্য কয়েক মুহূর্ত থামল ফিলিপা, ডাকাতির ঘটনাটাতে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কেননা, আমি জানতাম, সকলে আমাকেই সন্দেহ করবে। কেন না। মিস ব্ল্যাকলককে খুন করার মোটিভ একমাত্র আমারই থাকার কথা। জুলিয়া কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। আমরা যমজের মত দেখতেও একরকম ছিলাম না।
মিস ব্ল্যাকলক আমার সঙ্গে সদয় ব্যবহারই করেছিলেন। আমি তাকে কখনোই মারার চেষ্টা করিনি। তাহলেও আমিই পিপ। এডমণ্ডকে সন্দেহ করার কোনই কারণ নেই।
কথা শেষ করে হাঁপাতে লাগল ফিলিপা। তার হাত বারবার মুঠি পাকাতে লাগল।
নেই নয়, আছে। ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন ক্র্যাডক, মিঃ সোয়েটেনহ্যাম তরুণ, তার টাকার প্রয়োজন। যে কোন ধনবতাঁকেই সে বিয়ে করতে চাইবে। অথচ মিসেস গোয়েডলারের আগে মিস ব্ল্যাকলক মারা না গেলে এরকম অর্থবতাঁকে বিয়ে কথা সম্ভব নয়। সেই কারণেই এডমণ্ড বুঝতে পেরেছিলেন, কিছু একটা করা প্রয়োজন। ঠিক বলছি তো মিঃ সোয়েটেনহ্যাম?
-সব বানানো গল্প। চিৎকার করে উঠল এডমণ্ড।
ঠিক এই সময়েই রান্নাঘর থেকে একটা দীর্ঘ কাতর ভয়ার্ত আর্তনাদ ভেসে এল।
-একার গলা–মিৎসি তো নয়। জুলিয়া বলে উঠল।
-না। বললেন ক্র্যাডক, তিনজন মানুষকে খুন করেছে, এমন একজনেরই কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি আমরা…
.
১৭.
ইনসপেক্টর ক্র্যাডক যখন এডমণ্ডকে ধরে পড়েছেন, সেই সময় নিঃশব্দে মিৎসি রান্নাঘরে চলে গিয়েছিল। সে যখন সিঙ্কে জল ছাড়ছিল, সেই সময় মিস ব্ল্যাকক ঢুকেছিলেন।
-তুমি এমন মিথ্যা কথা বললে মিৎসি, হাসিমুখে কোমল স্বরে বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
মিৎসি লজ্জিত ভাবে পাশে তাকিয়ে তাকে দেখল।
–রুপোর বাসনগুলো আগে ধোবে। সিঙ্কে বেশি করে জল ঢেলে নাও।
মিৎসি বাধ্যমেয়ের মত সেভাবেই সিঙ্ক জল ভর্তি করল।
–আমার ওসব কথার জন্য আপনি রাগ করবেন না মিস ব্ল্যাকলক।
–রাগ করলে কি আর মেজাজ ঠিক থাকত? বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
–আমি তাহলে ইনসপেক্টরকে বলব যে সব মিথ্যে করে বলেছি।
–তিনি তোমার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছেন।
মিৎসি কল বন্ধ করবার জন্য নিচু হল। সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে দুটো শক্তিশালী হাত তার মাথা চেপে ধরে সিঙ্কের জলে চেপে ধরল।
-এবারই তুমি প্রথম সত্যি কথাটা বলেছিলে। হিসহিস করে বলে উঠলেন মিস ব্ল্যাকলক।
মিৎসি উন্মত্তের মত দুহাত ছুঁড়ে নিজেকে ছাড়বার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মিস ব্ল্যাকলক ছিলেন ঢের বেশি শক্তিশালী। তিনি তার মাথাটা জলে চেপে ধরেছিলেন।
সহসা বাতাসে ডোবা বানারের কাতর কণ্ঠ ভেসে এল।
–একি লোটি–লোটি–এমন কাজ করো না
ঘাড় ফিরিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন মিস ব্ল্যাকলক। দুহাত শূন্যে দুলিয়ে অদৃশ্য ভয়ানক কিছুকে যেন ঠেকাবার চেষ্টা করলেন।
মিৎসি ছাড়া পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়াল। দম টানতে কষ্ট হচ্ছিল তার। ঘর থেকে কোনমতে ছুটে বেরিয়ে গেল।
আর্তনাদ করে চলেছেন সমানে মিস ব্ল্যাকলক। রান্নাঘরে একা হয়ে গিয়ে তার ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
–আমায় মাপ কর ডোরা, ডোরা আমি নিরুপায় হয়েই একাজ করেছি
দিশা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। কোনদিকে যাচ্ছেন বুঝতে না পেরে বাসন মাজার ঘরের দিকে ছুটে গেলেন।
কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলেন না। সার্জেন্ট ফ্লেচার তার বিশাল বপু নিয়ে পথ আগলে দাঁড়ালেন।
ঠিক সেই সময় মিস মারপল মুখময় হাসি নিয়ে ঝটা বুরুশ রাখার আলমারি থেকে বেরিয়ে এলেন।
–মানুষের গলা আমি ভালই নকল করতে পারি। বললেন মিস মারপল।
মিস ব্ল্যাকলক ভয়ার্ত অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলেন।
–আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে, এই মেয়েটিকে আপনি জলে ডুবিয়ে মারতে চেষ্টা করেছিলেন। আমি তার সাক্ষী। চলুন মিস ব্ল্যাকলক।
উঁহু, শার্লট ব্ল্যাকলক, বললেন মিস মারপল, মুক্তোর মালা সরিয়ে নিলেই অপারেশনের দাগ দেখা যাবে।
–অপারেশন। বিস্মিত হলেন ফ্লেচার।
–হ্যাঁ, গলগণ্ড অপারেশন।
ততক্ষণে অনেকটা সামলে উঠেছেন মিস ব্ল্যাকলক। মিস মারপলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি সবই জেনেছেন?
-হ্যাঁ, সবই আমি জেনেছি।
শার্লট ব্ল্যাকক ডুকরে উঠলেন। অবসন্ন শরীরটাকে টেনে নিয়ে ধপ করে টেবিলের সামনে বসে পড়লেন।
–ডোরার গলা নকল করে আপনি আমাকে ব্যথা দিয়েছেন। ডোরাডোরাকে আমি ভালবাসতাম।
ইতিমধ্যে ঘরে প্রবেশ করলো ইনসপেক্টর ক্র্যাডক। তার পেছনে অন্য সকলে।
মিৎসি অনেকটা সামলে উঠেছিল। তার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। নিজের কাজের প্রশংসা সে নিজেই করতে শুরু করল।
–কী দারুণ অভিনয় আমি করলাম, করিনি? মরতে বসেছিলাম, তবু সাহস ছিল বলে না এতবড় ঝুঁকিটা নিয়েছিলাম।
ব্যাপারটা বুঝে উঠতে কয়েক মুহূর্ত দেরি করেছিলেন মিস হিনচক্লিফ। তারপরেই সকলকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মিস ব্ল্যাকলকের ওপরে।
-ওকে আমি খুন করব–আমাকে আটকাবেন না
মিস ব্ল্যাকলক সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ঠেকাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। তার হাঁপ ধরে গিয়েছিল।
-মিস হিনচক্লিফ–অমন করবেন না–আমার কথা শুনুন।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। মিস হিনচক্লিফ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে মিস ব্ল্যাকলকের গলা চেপে ধরবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
–আমি খুন করব–আমার বন্ধু মারগাটরয়েডকে ও খুন করেছে–
সকলে মিলে সামলালেন মিস হিনচক্লিফকে। রুদ্ধ আক্রোশে তিনি দাঁত কড়মত করতে লাগলেন। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে পড়তে চাইছে।
মিস ব্ল্যাকলক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। কাতর স্বরে বলে উঠলেন, আমি ওকে মারতে চাইনি। কাউকেই আমি মারতে চাইনি। তবু আমি না মেরে পারলাম না। ডোরাকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না-ওহ ডোরা–আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম–একা।
দু-হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মিস ব্ল্যাকলক ওরফে শার্লট ব্ল্যাকলক।
.
১৮.
রেভারেণ্ড জুলিয়ান হারসন, ইনপেক্টর ক্র্যাডক, জুলিয়া পাট্রিক সিমন্স, এডমণ্ড আর ফিলিপা এরা সকলেই আজ শ্রোতা। মিস মারপলের মুখ থেকে আদ্যপান্ত শোনার জন্য উৎসুক হয়ে যে যার সুবিধা মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছেন।
মিস মারপল সকলের মাঝখানে বসেছিলেন একটা আরাম কেদারায়। তার মুখোমুখি চুল্লীর সামনে বসে আছেন বাঞ্চ।
–এ কাহিনী আপনারই মিস মারপল। পাইপ টানতে টানতে বললেন ক্র্যাডক।
–ওহ, না, আমি তো একটু সাহায্য করেছি কেবল। তদন্তের সব ঝামেলা তো তুমিই সামলেছ বাছা। তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি জান। বললেন মিস মারপল।
অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন সকলেই। বাঞ্চ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ঠিক আছে আপনারা দুজন মিলেই বলবেন। শুরু কর তুমি, জেন মাসী। গোটা প্লটটাই যে মিস ব্ল্যাকলকের তুমি কখন বুঝতে পারলে?
–প্রিয় বাঞ্চ, বললেন মিস মারপল, কতগুলো ব্যাপারে গোড়া থেকেই আমার সন্দেহ হয়েছিল তার পক্ষেই এসব করা সম্ভব। অমন নিপুণ ডাকাতির দৃশ্য নিজের বাড়িতে তার পক্ষেই সাজানো সম্ভব ছিল।
রুডি সার্জের সঙ্গে একমাত্র তারই পরিচয় ছিল। তাছাড়া বাড়িতে কেন্দ্রীয় তাপ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কোন চুল্লী না রাখা নিজের বাড়িতে আর কার পক্ষে সম্ভব ছিল? ঘরে আগুন না রাখার পরিকল্পনাটা তারই ছিল।
গোড়াতে অবশ্য ব্যাপারটা অত সরল ছিল না। সবার মত আমাকেও ধাঁধায় পড়তে হয়েছিল। ভেবেছি, কেউ ওই লেটিসিয়া ব্ল্যাকলককেই খুন করতে চেয়েছে।
-ওই সুইস ছোকরা রুডি সার্জ থেকে শুরু কর তুমি। যা ঘটেছিল গোড়া থেকেই বল জেন মাসী। রুডি সার্জ কি ওকে চিনতে পেরেছিল?
-হ্যাঁ। ক্র্যাডকই তার পরিচয় খুঁজে বার করেছিল। বলে ইনসপেক্টরের দিকে তাকালেন মিস ব্ল্যাকল্লক।
–ও কাজ করত বের্নের ডাঃ অ্যাডলফ কথের ক্লিনিকে। বললেন ক্র্যাডক। শার্লট ব্ল্যাকলক সেখানে গিয়েছিলেন গলগণ্ড অপারেশান করাতে।
কিছু গোলমেলে কাজ করে ওই ক্লিনিক ছাড়তে হয়েছিল ছোকরাকে। সে ইংলণ্ডে এসে হোটেলে কাজ নিয়েছিল। সেখানে সে মিস ব্ল্যাকলককে দেখে চিনতে পারে। ক্লিনিকে উনি একসময়ে রুগী হিসেবে ছিলেন।
কিছু চিন্তাভাবনা না করেই ঝোঁকের মাথায় রুডি সার্জ এগিয়ে এসে তার সঙ্গে কথা বলেছিল। পরে নিশ্চয়ই ক্লিনিকের গোলমেলে কাজগুলোর কথা মনে করে সে সঙ্কুচিত হয়েছিল।
-তাহলে, সে হোটেল মালিকের ছেলে, ব্যবসা শিখতে এসেছে, এসব কথা বলেনি? বাঞ্চ বললেন।
–ওসব কিছুই বলেনি। রুডি সার্জের কথা বলার অজুহাত হিসেবে মিস ব্ল্যাকলক যা বলেছিলেন সবই ছিল তার নিজের বানানো কথা।
-ছোকরার সঙ্গে দেখা হবার পরই প্রথম ধাক্কা খেলেন মিস ব্ল্যাকলক। বললেন মিস মারপল, ব্যাপারটা তার কাছে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কেন না, তার আগে পর্যন্ত তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ বলেই ধরে নিয়েছিলেন। মিস শার্লট ব্ল্যাকলক, যিনি গলগণ্ড অপারেশনে করেছিলেন, নির্দিষ্ট ভাবে একজন তাকে চিনে ফেলবে, এ তিনি ভাবতে পারেননি।
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ওখান থেকেই–ওই গলগণ্ড রোগ। এক উজ্জ্বল হাসিখুশি তরুণী শার্ট ব্ল্যাকলকের গলায় ওই রোগ দেখা দেয়। তার জীবন ব্যর্থ হতে বসেছিল। নিজের রূপ সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিল সে। তার মা জীবিত ছিলেন না, বাবাও তেমন সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না। তাই সে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। স্বাভাবিক জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সে।
গলগণ্ড অপারেশন করার উপায় ছিল না। কেন না ডঃ ব্ল্যাকলক ছিলেন, আমার ধারণা, অত্যন্ত প্রাচীনপন্থী। তার সঙ্গে কিছুটা গোঁয়ারতুমিও ছিল। অপারেশনের ওপর তাই তার কোন আস্থা ছিল না। তিনি রোগগ্রস্ত মেয়েকে আয়োডিন ইত্যাদি ওষুধের মধ্যেই রেখেছিলেন। আর করার কিছু ছিল না ভেবে শার্লটের বোনও তাই মেনে নিয়েছিল।
শার্লট তার বাবার ব্যবস্থাই মেনে নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু গলগণ্ড ক্রমশ স্ফীত হয়ে উঠতে লাগল। ফলে বাইরে লোকজনের সামনে বেরনো সে বন্ধ করে দিয়েছিল।
ইনসপেক্টর ক্র্যাডক আমাকে বলেছেন, বেল গোয়েডলার তাকে বলেছিলেন, লেটিসিয়া ব্ল্যাকলক ছিলেন ব্যক্তিত্বময়ী। তার সতোর প্রশংসা তিনি বারবার করেছেন। মানুষ কিভাবে অসৎ কাজ করে তা তিনি বুঝতে পারতেন না। তিনি নিজে যেমন কোন অসৎ কাজ করেননি তেমনি রেণ্ডাল গোয়েডলারকেও সোজা পথে ধরে রেখেছিলেন।
লেটিসিয়া বোনের প্রতি খুবই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। তার জন্য অনুভব করতেন। বোনের মানসিক বিপর্যয় হাল্কা করবার জন্য তিনি যা কিছু ঘটত বোনকে বিস্তারিত লিখে জানাতেন এভাবেই দূর থেকেও তিনি হতভাগ্য বোনকে সঙ্গ দেবার চেষ্টা করতেন।
ডাঃ ব্ল্যাকলক মারা গেলে শার্লট অসহায় হয়ে পড়ল। তাকে দেখাশোনা করবার জন্য লেটিসিয়া র্যাণ্ডাল গোয়েডলারের কাজ ছেড়ে দিলেন।
অপারেশানের ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নেবার জন্য তিনি বোনকে সুইজারল্যাণ্ডে নিয়ে গেলেন। সেখানে অপারেশানের সাহায্যে সাফল্যের সঙ্গেই গলার খুঁতটা সারিয়ে ফেলা হল। গলার দাগ ঢাকা পড়ে গেল একছড়া মুক্তোর মালায়।
ইতিমধ্যে যুদ্ধ লাগল। সরাসরি ইংলণ্ডে ফেরা সম্ভব না হওয়ায় দুই বোন সুইজারল্যাণ্ডে রেডক্রশে নাম লেখালেন। তাইতো, ইনসপেক্টর?
-হ্যাঁ, মিস মারপল। আপনি বলতে থাকুন বললেন ক্র্যাডক।
ইংলণ্ডে বেল গোয়েডলারের স্বাস্থ্যের খবর ওদের কাছে পৌঁছেছিল। ওরা জেনেছিলেন তিনি বেশি দিন বাঁচবেন না। আমার ধারণা ভবিষ্যতে বিরাট সম্পদ লাভের স্বপ্ন দুই বোনের মধ্যেই ছিল। তবে সম্পদের লোভ লেটিশিয়ার চেয়ে শার্লটেরই বেশি ছিল। কেন না, জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দ সে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন তাকে বিভোর করে তুলেছিল। দেশ-বিদেশে ভ্রমণ, ছোট্ট একটা নিজস্ব বাড়ি, দাসদাসী, প্রাচুর্য এমনি এক ভোগ সুখের জীবনের স্বপ্ন দেখত সে।
এর মধ্যেই এমন এক অঘটন ঘটল যে শার্লটের ভবিষ্যতের সব রঙীন স্বপ্ন নিমেষে চুরমার হয়ে গেল।
স্বাস্থ্যবতী লেটিসিয়া অকস্মাৎ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই রোগটা নিউমোনিয়ার দিকে মোড় নিল। একসপ্তাহ ভুগেই তিনি মারা গেলেন।
শার্লটের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বেল গোয়েডলারের আগে মারা না গেলে-অন্তত আরও মাস কয়েক বেঁচে থাকলেই অঢেল অর্থের মালিক হত তারা দুই বোন। আর লেটিসিয়ার পর সেই অর্থ আসত শার্লটেরই হাতে। সব সম্ভাবনাই মিথ্যা হয়ে গেল লেটিসিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে।
দুই বোনের চরিত্রের বিভিন্নতা সেই সময়েই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। শার্লট তার ভাগ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় নেমে পড়ল। আমার মনে হয়, সে যা করতে চলেছিল তাকে অন্যায়। বলে তার মনে হয়নি। কয়েক মাস পরে, বেল গোয়েডলারের মৃত্যুর পর সব টাকা তো লেটিসিয়ারই হত, তাই সে লেটিসিয়া আর নিজেকে বোন ভেবে নিয়েছিল।
দুই বোনের মধ্যে যথেষ্ট মিল ছিল। লোকের চোখে চট করে পার্থক্য নজরে পড়ত না। এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিল শার্লট। তাই দুই বোনের এই আকারগত মিলটাকেই সে তার কার্যোদ্ধারের কাজে ব্যবহার করতে চাইল। শালটন মারা গেছে, লেটিসিয়া বেঁচে আছে–এমনটা লোককে বলার মধ্যে দোষের কি থাকতে পারে?
একটা আবেগ থেকেই মতলবটা মাথায় এসে গেল শার্লটের। সকলে তাই জানল শার্লট মারা গেছে, লেটিসিয়া ইংলণ্ডে ফিরে এল।
কিন্তু, বোনের মৃত্যুর পর লেটিসিয়া তার কর্মক্ষেত্রে নতুন মানুষ হয়ে ফিরল। তার কর্মকুশলতা আগের মত আর সজীব রইল না। কেমন নিষ্প্রভ। কিন্তু দাপট রইল আগেরই মত। মানসিক ভাব যেমনই হোক শার্লট তার দিদির হাবভাবে এভাবে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলতে লাগল।
তবে কয়েকটা ব্যাপারে শার্লটকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছিল। পরিচিতদের চোখের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নেবার জন্য তাকে ইংলণ্ডের অখ্যাত অপরিচিত অঞ্চলে একটা বাড়ি কিনতে হল। সে বিশেষভাবে এড়িয়ে চলতে চাইছিল তার দেশ ক্যাম্বারল্যাণ্ডের লোজন আর বেল গোয়েডলার। ওরা তাকে চিনে ফেলতে পারত। হাতের লেখার অমিলকে ঢাকবার জন্য শার্টকে হাতে গেঁটে বাতের আক্রমণ আমদানি করতে হয়েছিল। খুব কম লোকই শার্লটকে ভালভাবে চিনত, তাই সহজেই সে নিজেকে নিরাপদ ধারণা করে নিয়েছিল।
–কিন্তু, জেন মাসী, বাঞ্চ প্রশ্ন করল, তার সঙ্গে যদি লেটিসিয়ার পরিচিত কারু দেখা হত, এরকমতো অনেকেই ছিল?
–সেটা এমন কিছু সমস্যা সৃষ্টি করত না। তারা এটাই ভেবে নিত যে লেটিসিয়া অনেক বদলে গেছে। দশ বছরে মানুষ অনেক বদলে যেতে পারে। সে যে লেটিসিয়া নয়, এমন সন্দেহ কারো মনেই আসত না। কেননা লেটিসিয়ার হাবভাব, চালচলন সে ভালভাবেই জানত, কার সঙ্গে তার পরিচয়, কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার সব খুঁটিনাটিই তার জানা ছিল। কাজেই সহজেই নিজেকে রপ্ত করে নিয়েছিল।
ঘটনার দ্বিতীয় পর্যায়ই বলা চলে এটাকে–লিটল প্যাডকসে লেটিসিয়া বেশি শার্লটের বসবাস। এখানে অল্পদিনেই সে পড়শীদের জেনে নিল। সে এখন পুরোদস্তুর লেটিসিয়া ব্ল্যাকক।
এর মধ্যে একদিন এল দূর সম্পর্কের এক বোনের চিঠি। দুই বোনপো বোনঝিকে পেইংগেস্ট রাখার অনুরোধ নিয়ে। তাদের কখনো আগে দেখেনি জেনেও সে দয়া দেখিয়ে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে এল।
কোথাও কোন উপদ্রবের সম্ভাবনা ছিল না। সবকিছু বেশ ভালই চলছিল। এর মধ্যে লেটিসিয়ার স্কুলের এক সহপাঠিনীকে দয়া দেখাতে গিয়ে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে নিয়ে এল। নতুন ভূমিকায় শার্লটের এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল।
অবশ্য নিজের দুঃসহ একাকীত্ব মোচনের জন্যও তাকে এটা করতে হয়েছিল, মেনেও নিতে হয়েছিল। স্কুলজীবনে ডোরা বানার ছিল লেটিসিয়ার প্রিয় বন্ধু। সেই হিসেবে দুঃস্থ অবস্থায় সাহায্যের আশায় সে চিঠি লিখেছিল লেটিসিয়াকে। আবেগের তাড়নায় সে চিঠি লিখল ডোরা বানারকে। সে বেচারী চিঠি পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যায়। কেন না, তিনি চিঠি লিখেছিলেন লেটিসিয়াকে, আর উত্তর পেয়েছিলেন শার্লটের কাছ থেকে।
এখানে আর নিজেকে গোপন রাখতে চায়নি শার্লট। সে জানত তাতে লাভ হত না। ডোরা তার সাহায্য পেলে গোটা ব্যাপারটা তার মত দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখবে, এমন একটা বিশ্বাসও তার ছিল। তাই সে সবকথা তাকে নিষ্পাপ ভঙ্গীতে খুলে জানায়। ডোরাও সবশুনে তাকে মন থেকে সমর্থন করেন। লেটিসিয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে শার্লট বঞ্চিত হবে–অজানা অচেনা কারুর হাতে সব অর্থ চলে যাবে, তার মনে হয়েছিল, এরকম হওয়া উচিত নয়।
এলোমেলো মানসিক অবস্থা হলেও ডোরা বানার এটা ভালই বুঝেছিলেন যে কোন কথা প্রকাশ হতে দেয়া যাবে না। কিন্তু সবসময় তাল ঠিক রাখা তার পক্ষে সম্ভব হত না।
ডোরা বানার লিটল প্যাডকসে চলে আসার কিছুদিনের মধ্যেই শার্লট বুঝে গেল, কি মারাত্মক ভুল সে করে ফেলেছে।
অদ্ভুত মানসিক বিপর্যয়ের জন্য ডোরা প্রায়ই কাজকর্মে গোলমাল পাকিয়ে ফেলতেন, তেমনি বেশি কথা বলার জন্য বেশ কথাও মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ত। তার মত মানুষকে নিয়ে বাস করাই ছিল এক বিড়ম্বনা। শার্লটের পক্ষে ছিল প্রাণান্তকর।
তবু ব্যাপারটা সে মেনে নিতে চেষ্টা করেছিল নিজের একজন একান্ত সঙ্গীর অভাব বোধ থেকে। দ্বিতীয়ত ডাক্তার জানিয়েছিল, সে বেশিদিন বাঁচবে না।
ডোরা বানার দুই বোনকে নাম ধরেই ডাকতেন। ছোট্ট করে সম্বোধন করতেন লেটি আর লোটি। শার্লট ছিল লোটি।
ডোরা সাবধান থেকেই শার্লটকে সম্বোধন করতেন। তবু মাঝে মাঝে লোটি ডাকতে গিয়ে আসল নাম লেটি বলে ফেলতেন। স্কুল জীবনের অভ্যাসের বশেই এই ভুলটা হয়ে যেত। ফলে শার্লটকে এব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হত। তবে ব্যাপারটা ক্রমশই তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। তার স্নায়ুর ওপর খুবই চাপ পড়তে থাকে।
তবে, ডোরার মুখের উচ্চারণে এই সামান্য ভুল কারোরই নজরে আসেনি। সেটা স্বাভাবিক বিকৃতি বলেই মেনে নিয়েছিল সকলে।
লেটিসিয়ার নিরাপত্তার দিক থেকে আসল ভয়ের ব্যাপার ঘটল রয়্যাল স্পা হোটেলে, যখন রুডি সার্জ তাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এসে কথা বলল।তবে এই সুইস ছোকরা যে শার্লটকে ব্ল্যাকমেল করার উদ্দেশ্য নিয়ে তার কাছে টাকা চেয়েছিল, একথা আমি বিশ্বাস করি না। ইনসপেক্টর ক্র্যাডকও বিশ্বাস করেন না। কেন না, ভেতরের লুকোচুরির ব্যাপার-স্যাপার তার জানা ছিল না।
-হ্যাঁ, ব্ল্যাকমেলের কোন ধারণাই রুডি সার্জের মাথায় ছিল না। একজন বয়স্কা মহিলার কাছে নিজের দুরবস্থার কথা বলে সাহায্য আদায় করা যেতে পারে এর বেশি সে ধারণা করেনি। বললেন ক্র্যাডক।
তবে রুডি সার্জের সঙ্গে দেখা হবার পর থেকেই নিজেকে নিরাপদ করার স্বার্থে ছক কষতে শুরু করেছিল শার্লট। আমার ধারণা হোটেলের তছরুপ করা টাকা মিটিয়ে দেবার টাকাটা শার্লটের কাছ থেকেই পেয়েছিল সে।
শার্লট ব্ল্যাকলকের অপরাধী মন। সে এই দেখাসাক্ষাতের বা টাকা চাওয়ার ব্যাপারটাকে অন্যভাবেই দেখেছিল। তার ধারণা হয়, রুডি সার্জ কিছু সন্দেহ করেছে, তাই ব্ল্যাকমেলের উদ্দেশ্যে তার দিকে হাত বাড়িয়েছে।
শার্লট আরো ভেবে নেয়, কিছুদিন পরে বেল গোয়েডলারের মৃত্যু সংবাদ খবরের কাগজে প্রকাশিত হবার পর স্বাভাবিক ভাবেই তাকে তার স্থায়ী রোজগারের উৎস করে নিতে পারে।
নিজেকে সে ইতিমধ্যেই জালিয়াতিতে ভাল রকমেই জড়িয়ে ফেলেছিল। সে নিজেকে লেটিসিয়া ব্ল্যাকলক বলেই পরিচিত করে তুলেছিল। বিশেষ করে ব্যাঙ্কে ও বেল গোয়েডলারের কাছে। কাজেই আসল পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়বে আশংকা তার শতগুণ বেড়ে গেল হোটেলের কেরানী সন্দেহজনক চরিত্রের রুডি সার্জের সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকেই। পথ নিষ্কণ্টক করে নিশ্চিন্ত হবার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হল তাকে।
শার্লট রুডি সার্জকে মজা করার উদ্দেশ্যে একটা ডাকাতির মহড়ার কথা জানাল। এজন্য অচেনা কাউকে প্রচুর অর্থ দেবার ইচ্ছাও প্রকাশ করল।
রুডি সার্জ নিজেও ছিল একজন অপরাধী। সে অর্থের লোভে সহজেই টোপ গিলল। সে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার টাকা পেল। লিটল প্যাডকসে ঘুরিয়ে দেখিয়ে আঁটঘাটও তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হল। কোথায় তার সঙ্গে দেখা করবে রুডি সার্জ সেই জায়গাও শার্লট তাকে দেখিয়ে দিল।
এই সব কিছুই কিন্তু করা হয়েছিল ডোরা বানারের অজ্ঞাতে। তিনি বিন্দুবিসর্গ জানতে পারেননি।
একনাগাড়ে কথা বলে হাঁপ ধরে গিয়েছিল। তাই দম নেবার জন্য কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, এবারে এসে গেল আসল দিন।
–হ্যাঁ। বললেন মিস মারপল, মতলব পুরোপুরি সফল হবে কিনা এ নিয়ে একটা ভয় অবশ্যই ছিল, তাই ডাকাতির ঘটনার দিন গোড়া থেকে সে বিমর্ষ হয়ে ছিল।
ডোরা বানার আমাদের বলেছিল, লোটি সেদিন বেশ ভীত ছিল।
এখনো ঘটনার সূত্রপাত হয়নি, শার্লটের পিছিয়ে আসার সুযোগ ছিল। পিছিয়ে আসার কোন ভয় ছিল না।
উপযুক্ত সময়ে কাজে ব্যবহারের জন্য ইতিমধ্যে কর্নেল ইস্টারব্রুকের রিভলবার অলক্ষিতে সরিয়ে নিয়েছিল শার্ট। সম্ভবত ফাঁকা বাড়িতে ডিম, জ্যাম বা এমনি কিছু নিয়ে ঢুকেছিল। সুযোগ মত বন্ধ দরজায় তেল ঢালার কাজও সেরে রেখেছিল যাতে খোলার সময় শব্দ না হয়। দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে যে টেবিলটা রাখা ছিল ফিলিপিয়ার ফুল সাজাবার ব্যবস্থার অজুহাতে সেটাও সরিয়ে রাখা হয়েছিল। সবটাই ছিল একটা মজার খেলার মত। কিন্তু শেষটা আর খেলার মত থাকবার কথা নয়। শার্লটের মনে তাই ভয় বাসা বেঁধেছিল-মতলব ভেস্তে যাবার ভয়।
–পরিকল্পনা ছিল নিখুঁত, বললেন ক্র্যাডক, ঠিক সন্ধ্যা ছটার পর শার্লট বাড়ির হাঁসদের ঘর বন্ধ করতে বেরলো। তখনই রুডি সার্জকে গোপনে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে টর্চ, মুখোশ, দস্তানা দিয়ে দেয়।
টেবিলের ঘড়িতে সাড়ে ছটার ঘণ্টা বাজতেই সিগারেট হাতে নিয়ে টেবিলের কাছে দাঁড়াল। সবই হতে লাগল পরিকল্পনা মাফিক। অতিথিদের জন্য সিগারেট নেওয়ার ব্যাপারটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। সেই সময় প্যাট্রিকও গেল পানীয় আনতে।
শার্লট জানত, সকলেরই নজর থাকবে ঘড়ির দিকে। ছিলও তাই। তবে একজন ছিলেন ব্যতিক্রম। ডোরা বানার–তার চোখ লেটির পেছনে লেগে ছিল। তিনি আমাদের বলেন, সকলেই যখন ঘড়ির দিকে চোখ রেখেছেন, তখন শার্লট ফুলদানীটা তুলে নেয়।
ল্যাম্পের তারের ওপরের অংশ আগেই এমন ভাবে ছিঁড়ে রেখেছিল যাতে ভেতরের তার বেরিয়ে থাকে। এরপর কেবল সামান্য জল ঢেলে দিলেই হল তারের সেই খোলা অংশে। চোখের নিমেষে তাই করল শার্লট আর সুইট টিপে দিল। জল বিদ্যুতের সুপরিবাহকসঙ্গে সঙ্গে লাইন ফিউজ হয়ে গেল।
সেদিন ভিকারেজে যেমন হয়েছিল, বললেন বাঞ্চ, এজন্যেই সেদিন তুমি চমকে উঠেছিলে জেন মাসী?
-হ্যাঁ, প্রিয় বাঞ্চ। আলোর ওই ব্যাপারটা আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল। বিদ্যুতের ব্যাপার স্যাপার আমার ভাল জানা ছিল না। আমি তাই খুঁজছিলাম দুটো ল্যাম্প, যার একটা ড্রইংরুমের ল্যাম্প বদলে রাখা হয়েছিল রাত্রিবেলা।
-সেকারণেই পরদিন ফ্লেচার ল্যাম্পটা পরীক্ষা করে কোন ত্রুটি দেখতে পায়নি। লাইনে কোন ফিউজও ছিল না।
–তার পরেই আমার কাছে ডোরা বানারের বলা চাষীবউ-ল্যাম্পের কথাটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, বললেন মিস মারপল, তবে তার কথা শুনে প্যাট্রিকের ওপরেই আমার সন্দেহ পড়েছিল গোড়ায়। তবে তার কথায় পারম্পর্য ছিল না বলে পুরোপুরি নির্ভর করাও কষ্টকর ছিল।
তবে শার্লট ফুলদানী তুলে নিয়েছিল এই কথাটা ডোেরা ঠিক বলেছিলেন। আমি এই সূত্রেই জেনে গিয়েছিলাম, তারের ওপর ফুলদানীর জল ঢেকে শার্লটই ফিউজ করে থাকতে পারে।
টেবিলে পোড়া দাগটা আমি ধরতে পারিনি, ক্র্যাডক বললেন, ডোরা বানার বলেছিলেন, তিনি একটা ঝিলিক আর চড়চড় শব্দ শুনেছিলেন। তাতে টেবিলের ওপর যে পোড়া দাগ পড়েছিল আমি ভেবেছিলাম কেউ সিগারেট রাখতেই দাগটা হয়েছিল। অথচ আমারই বোঝার ভুল ছিল, সেই সন্ধ্যায় কেউই সিগারেট ধরাননি…আর ফুলদানীর ফুলগুলোও শুকিয়ে গিয়েছিল ফুলদানীতে জল ছিল না বলে। সদাসতর্ক শার্লট এখানে মস্ত ভুল করে ফেলেছিল, ফুলদানীতে জল দিলে এমনটা হত না। ড্ডারা বানার ভেবেছিলেন, তিনিই ফুলদানীতে জল দিতে ভুলে গেছেন।
–ডোরা বানরের কথা এলোমেলো হলেও তাতে অনেক সত্য ছিল, বললেন মিস মারপল, সেই কথাগুলো শার্লট অন্যভাবে কাজে লাগিয়েছিল। সে তার মনে প্যাট্রিক সম্পর্কে সন্দেহ জাগিয়ে দিতে পেরেছিল।
–এভাবে আমাকে বেছে নিয়েছিল কেন? ব্যথিত ভাবে বলল প্যাট্রিক।
–ব্যাপারটা যে ভেবেচিন্তে করা হয়েছিল তা আমার মনে হয় না, বললেন ক্র্যাডক।
যাই হোক, এরপরে ছকমতই কাজ এগিয়ে চলল। আলো নিভে যেতে নিয়মিত দরজা খুলে রুডি সার্জ টর্চ হাতে ঘরে ঢুকল। আর শার্লট নিঃশব্দে ছোট ঘরের তেল লাগান দরজা দিয়ে। ঢুকে রুডি সার্জের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। সে বুঝতেই পারেনি রিভলবার হাতে তার পেছনে একজন এসে দাঁড়িয়েছে।
টর্চের আলো ঘরে ঘুরছে, এমনি সময়ে শার্লট গুলি করল, পরপর দুবার। পরে ঘুরে কাছে থেকে রুডিকে গুলি করে অস্ত্রটা তার পাশে ফেলে দেয়। তারপর হলঘরের টেবিলে দস্তানা রেখে নিজের জায়গায় ফিরে যায়। এই সময় কিছু একটা দিয়ে নিজের কানে ক্ষতও করে নেয়া–
–নিজের নখ কাটার যন্ত্র দিয়ে, বললেন মিস মারপল, কানের লতিতে সামান্য আঘাতেই অনেক রক্ত ঝরতে থাকে। রক্ত দেখে সকলেই তাকে গুলির আঘাতে আহত ভেবে নেয়।
–নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা সফল হয়েছিল, বললেন ক্র্যাডক, ডোরা বানার বারবার বলেছে, রুডি সার্জ মিস ব্ল্যাকলককেই গুলি করেছিল। শালর্টকে যে আহত হতে তিনি দেখেছিলেন, সেকথা বোঝাতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত রুডি সার্জের মৃত্যু আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা বলেই ধরে নেয়া হত, মিস মারপলের জন্যই এতবড় ভুলটা এড়ানো সম্ভব হয়েছিল।
-ওহ, না, না, আমার ব্যাপারটা ছিল নিছকই আকস্মিক। মিঃ ক্র্যাডক, তদন্তে আপনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি–সেজন্যই ভুলটা ধরা পড়েছিল।
–কোথাও একটা গরমিল রয়েছে বুঝতে পারছিলাম, ক্র্যাডক বললেন, কিন্তু ধরতে পারলাম আপনি দেখিয়ে দেবার পর। এরপর আবিষ্কার করলাম দরজার রহস্যটা। তদন্তও নতুন দিকে মোড় নিল। লেটিসিয়া ব্ল্যাকলকের খুনীকে খুঁজে বের করার জন্য আমরা উঠে পড়ে লাগলাম।
–তাকে খুন করবার মত আরও একজন যে কাছাকাছি ছিল তা শার্লটের আজানা ছিল না। বললেন মিস পারপল, আমার ধারণা তিনি ফিলিপাকে দেখেই চিনতে পেরেছিলেন। ফিলিপা হেমস অনেকটাই তাদের মায়ের মত দেখতে।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, ফিলিপাকে দেখে তিনি আতঙ্কিত বা অখুশি হননি। বরং খুশিই হয়েছিলেন। সম্ভবত তিনি ঠিক করেছিলেন, টাকা দিয়ে ওকে বশ করবেন অথবা মেয়ের মতই কাছে টেনে নেবেন।
ইনসপেক্টর যখন পিপ আর এমার সম্পর্কে খোঁজখবর করতে শুরু করলেন, তখন দেখা গেল শার্লট ফিলিপাকে আড়াল করবারই ব্যবস্থা করল। সে তার পুরনো দিনের অ্যালবাম থেকে ফিলিপার মায়ের অর্থাৎ সোনিয়ার ছবি, লেটিসিয়ার ছবি–সব বেমালুম সরিয়ে ফেলল।
–এদিকে আমার মাথায় ঢোকেমিসেস সোয়েটেনহ্যামই হলেন সোনিয়া গোয়েডলার। বিরক্তির সঙ্গে বললেন ক্র্যাডক।
-শার্লট আসলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল ডোরা বানারকে নিয়ে। তাঁর বকবক করা স্বভাব, তার আবার অনবরত ভুল করা–কখন কি বিপদ ঘটিয়ে বসে সেটাই হয়েছিল উদ্বেগের বিষয়।
ওদের ওখানে যত কয়দিনই চা খেতে গেছি, লক্ষ্য করেছি, ডোরা বানারকে শার্লট সতর্ক নজরে রেখেছে।
একদিন ডোরা বানার তাকে লেটি সম্বোধন করল কথায় কথায়, শার্লটের চোখে স্পষ্ট দেখতে পেলাম ভয়ের ছায়া। শব্দটা যে নিছকই কথার ভ্রম নয়, তখনই আমার মাথায় আসে।
এর আগে ব্লু বার্ড কাফেতে যেদিন ডোরার সঙ্গে বসে কফি খেলাম, সেদিনও তার কথায় পরস্পরবিরোধী ভাব ছিল। মনে হয়েছিল তিনি দুজনের কথা বলছেন।
বন্ধুর সম্পর্কে বলতে গিয়ে একবার তিনি লেটি খুব দৃঢ় চরিত্রের মেয়ে বলে বললেন। পরক্ষণেই মন্তব্য করলেন খুবই হাল্কা চরিত্রের মেয়ে সে। একবার বললেন সে ছিল বুদ্ধিমতী, আর সফল। কিন্তু পরক্ষণেই এমন কথা বললেন, লেটিসিয়া ব্ল্যাকলকের জীবনের সঙ্গে যার কোন মিলই ছিল না।
ডোরা বানার সেদিন যখন জোড়া ল্যাম্পের কথা বলছিল আর সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, কৃষক বউয়ের ল্যাম্পটা কেউ রাতারাতি বদলে গিয়েছে, তখন শার্লট কাফেতে গিয়েছিল। আমার মনে হয় আমাদের সবকথাই সে শুনতে পায় আর বুঝতে পারে ডোরা বানার তার বিপদ ডেকে আনছে।
সেদিন আমাদের সেই কথাবার্তার পরিণামেই শার্লট তার পক্ষে চরম বিপজ্জনক হয়ে ওঠা বন্ধুটির সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল। ডোরা বানারকে জীবিত রাখা কোন দিক থেকেই আর তার কাছে নিরাপদ মনে হচ্ছিল না।
তবে অসহায় বন্ধুটির প্রতি দয়া দেখাতেও কার্পণ্য করেনি সে। যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছিল সে। আর জীবনের শেষবারের মত জন্মদিনের আনন্দের ব্যবস্থা–তাতে ডোরার জন্য বিশেষ কেকের ব্যবস্থা।
জন্মদিনের পার্টির জন্য মিৎসিকে দিয়ে তৈরি করানো হয়েছিল ডোরা বানারের এই কেক–প্যাট্রিক যার নাম দিয়েছিল মধুর মরণ।
আসলে তার জন্য মধুর মৃত্যুরই ব্যবস্থা করেছিল সেদিন শার্লট। পার্টির পরে ডোরা নিজের অ্যাসপিরিনের বোতলটা খুঁজে না পেয়ে শার্লটের বোতল থেকে অ্যাসপিরিন নেবে এমন ব্যবস্থাই করে রাখা ছিল।
ব্যাপারটা এমন ভাবে সাজানো হয়েছিল যে অ্যাসপিরিনের বদলে বিষবড়িগুলো যে লেটিসিয়ার জন্যই রাখা হয়েছিল, তা মনে না হয়ে উপায় নেই।
সুখকর নিদ্রার মধ্যেই যন্ত্রণাহীন মৃত্যু হল ডোরা বানারের। বুদ্ধিমতী শার্ট রইল ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিরাপত্তা রইল অক্ষুণ্ণ।
কিন্তু ডোরাবানার ছিল শার্লটের একাকীত্বের একমাত্র সঙ্গী। নিজের জীবনের কথা বলার মত বন্ধু তার দ্বিতীয় কেউ ছিল না। তাই এই বন্ধুর অভাব তীব্র হয়েই বাজল। তার এই দুঃখ ছিল সত্যিকারের।
-নিজের হাতে বন্ধুকে হত্যা কী ভয়ানক। বললেন বাঞ্চ।
–শার্লট ব্ল্যাকলক আসলে ছিল দুর্বলচিত্ত খুনী। খুনীদের পক্ষে এই দুর্বলতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এরকম দুর্বলেরা যখন ভয় পায়, তখন তারা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে তারা হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর নির্মম। শার্লটের ভয়ের বলি হলেন মারগাটরয়েড।
–মারগাটরয়েড? জুলিয়া বলল।
-হ্যাঁ। মিস হিনচক্লিফ আর মারগারটরয়েড–দুজনে মিলে সেদিনের ঘটনার পর্যালোচনা করেছিলেন। শার্ট ওদের কটেজে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সবই শোনে। আর এখনই তার মনের ভয় দ্বিগুণ হয়ে ওঠে।
রুডি সার্জ আর ডোরা বানার, যাদের কাছ থেকে বিপদ আসার সম্ভাবনা ছিল তাদের সরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল শার্ট। আর কারও কাছ থেকে বিপদ আসতে পারে, এমন কোন ধারণাই তার ছিল না। সে নিশ্চিত জানত তার অপকর্ম আর কারো চোখে পড়েনি।
মিস হিনচক্লিফ থানায় যাওয়ার জন্য যখন গাড়িতে উঠেছেন সেই সময় সম্ভবত মারগাটরয়েড আচমকা আসল ব্যাপারটা আবিষ্কার করতে পারলেন। মানুষ যখন ঠাণ্ডা মাথায় পুরনো কথা মনে করবার চেষ্টা করে তখন অনেক ছোট ছোট বিষয় তার মনে পড়ে যায়। তাই হয়েছিল মারগাটরয়েডের। তিনি চেঁচিয়ে বলেছিলেন…সেই মহিলা ওখানে ছিলেন না।…
আমার ধারণা, মারগাটরয়েড ম্যান্টলপিস থেকেই দৃশ্যপট চোখের সামনে তুলে আনবার চেষ্টা করেছিলেন। তার পরে দুটো জানালা। কেউ কেউ ওদিকে দাঁড়িয়েছিল।
ডোরা বানার তাকিয়েছিলেন ল্যাম্প আর সিগারেট বাক্স হাতে শার্লটের দিকে।
এরপরই শোনা গেল গুলির শব্দ। তারপর থেকেই পর পর সব তার মনে পড়ে যেতে থাকে। দেয়ালে যেখানে গুলি লেগে দাগ হয়েছিল তিনি সেটা দেখেছিলেন। ওই দেয়ালের সামনেই দাঁড়িয়েছিল শার্লট। তার দিকেই গুলি ছোঁড়া হয়েছিল।
মারগাটরয়েডের মনে পড়ে যায় সেখানে, দেয়ালের সামনে শার্লট ছিল না…
মিস হিনচক্লিফ তাকে তিনজন মহিলার কথা ভাবতে বলেছিলেন। তার মধ্যে একজনের কথা তিনি নিশ্চয় বিশেষ ভাবে মনে করতে বলেছিলেন। সেইভাবে ভাবতে গিয়েই মারগাটরয়েডের মনে পড়ে যায় তার কথা। আর তিনি বলে ওঠেন, হিনচ…উনি ওখানে ছিলেন না…
বাঞ্চ বলে উঠলেন, তুমি বোধহয় আগেই বুঝতে পেরেছিলে, তাই না জেন মাসী? কাগজে তো লিখেছিলেন, যখন ল্যাম্পটা ফিউজ হয়ে যায় আমাদের।
-হ্যাঁ প্রিয় বাঞ্চ। তখনই একে একে ঘটনাগুলো মনে পড়ে যেতে থাকে। খাপছাড়া আর রইল না কিছু। বললেন মিস মারপল।
-তুমি লিখেছিলেল্যাম্প…ভায়োলেট…অ্যাসপিরিনের বোতল…। ডোরা বানার তো তার বোতলটা খুঁজে পাননি। বাঞ্চ বললেন।
-হ্যাঁ, তার বোতল কেউ লুকিয়ে রেখেছিল। নয়তো নিজেই ভুলে গিয়েছিলেন কোথায় রেখেছিলেন, তাই তার বন্ধুর অ্যাসপিরিন নেবার দরকার হয়েছিল। এতে বোঝানো হয়েছিল শার্লটকে মারার জন্যই কেউ বোতলে বিষবড়ি রেখেছিল।
শার্লট ডোরা বানারের জন্য পার্টির ব্যবস্থা করে দয়ার পরিচয়ই দিয়েছিল। সে সত্যি কথাটাই বলেছিল রান্নাঘরে–আমি কাউকেই মারতে চাইনি।
আসলে সে যা একান্তভাবে চেয়েছিল তা হল অপর্যাপ্ত অর্থ। শার্লটের জীবনের সব আনন্দই হারিয়ে গিয়েছিল। তাই সে জীবনে যা পায়নি সেই অর্থের বিনিময়ে জীবনের পরিপূর্ণ আনন্দ উপভোগ করতে চেয়েছিল। অর্থের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল সে।
-আয়োডিনের কথা শুনে গলগণ্ডের কথা তোমার মনে হয়েছিল কেন মাসী? বললেন বাঞ্চ।
গলগণ্ডে ভুগছিল শার্লট। লেটিসিয়ার ভূমিকায় থেকে সে আমাকে বোঝাতে চেয়েছিল তার বোন যক্ষ্মারোগে মারা যায়। চিকিৎসার জন্য তাকে সুইজারল্যাণ্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
কিন্তু আমি জানতাম গলগণ্ডের বড় চিকিৎসকরা সুইজারল্যাণ্ডেই আছেন, সেখানেই এই রোগের চিকিৎসা হয়ে থাকে। আয়োডিনের কথা শুনেই তাই আমার সুইজারল্যাণ্ডের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।
আগেই নজরে পড়েছিল তার গলার অদ্ভুত আকারের মুক্তোর মালাটা, এটা যে স্টাইল নয়। বুঝতে আর দেরি হয়নি-সন্দেহ হয় অপারেশানের চিহ্ন ঢাকার জন্যই ওই মালা।
-সে-রাতে মালাটা যখন আচমকা ছিঁড়ে যায়, শার্লটের ব্যবহারও সঙ্গে সঙ্গে কেমন অদ্ভুত বেখাপ্পা হয়ে পড়ে। কিছু বুঝতে না পারলেও ব্যাপারটা আমাকে সন্দিহান করে তুলেছিল। বললেন ক্র্যাডক।
সেকারণেই তুমি লিখেছিলে লোটি? বলল বাঞ্চ।
–হ্যাঁ, আমি জানতাম, লেটিসিয়ার বোনের নাম ছিল শার্লট যাকে ডোরা বানার ডাকতেন লোটি বলে। কয়েকবার তিনি আমার সামনেই মিস ব্ল্যাকলককে লোটি বলে ডেকে ফেলেছিলেন। আর প্রতিবারেই তিনি লোটি বলার পরেই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে ওঠেন।
–বের্নের কথা লিখেছিলে কেন? বললেন বাঞ্চ।
–ওখানে হাসপাতালেই রুডি সার্জ বয়ের কাজ করত। নিচু স্বরে বললেন মিস মারপল। যাই হোক মারগাটরয়েডের আকস্মিক মৃত্যু ঘটলে বুঝতে পারলাম, আরে দেরি করা ঠিক হবে না। যা করবার দ্রুত তা করে ফেলতে হবে। অথচ হাতে জুৎসই প্রমাণও ছিল না। তাই কাজের একটা ছক করে নিয়ে সার্জেন্ট ফ্লেচারের সঙ্গে কথা বললাম।
ইনসপেক্টরের সঙ্গে আগে কথা না বলে ফ্লেচার কিছু করতে রাজি হচ্ছিল না। অনেক বলে কয়ে আমি তাকে রাজি করিয়েছিলাম। তারপর দুজনে মিলে লিটল প্যাডকসে গিয়ে মিৎসিকে ধরে তালিম দিলাম।
আগে ওকে বুঝিয়ে দিলাম কি করতে হবে। বারবার মহড়া দিয়ে ও নিজেকে তৈরি করে নিল। যা যা করতে হবে আমাদের করে দেখাল। তারপর ইনসপেক্টর ক্র্যাডক এলে ওকে ওপরে পাঠিয়ে দিলাম।
–মিৎসি যা করেছে এক কথায় অপূর্ব। বলল জুলিয়া।
–কিন্তু এতসব করার কি দরকার ছিল তা তো বুঝলাম না। বাঞ্চ বলল।
–একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, বললেন মিস মারপল, ব্যাপারটা জটিল অবশ্য। আমার পরিকল্পনা ছিল, মিৎসি স্বীকার করবে যে তার ব্ল্যাকমেল করারই ইচ্ছে ছিল। সে স্বীকার করবে যে ডাইনিং ঘরের চাবির গর্ত দিয়ে দেখেছে, মিস ব্ল্যাকলক একটা রিভলবার হাতে নিয়ে রুডি সার্জের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যা যা ঘটেছিল ও সবই পরিষ্কার দেখেছে।
একটা ভয় ছিল শার্লট না বুঝে যায় চাবির ফুটো দিয়ে কিছু দেখা মিৎসির পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু আচমকা চমকে গেলে মানুষ যুক্তিবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। তাই এই ভরসাতেই আমরা ঝুঁকি নিয়েছিলাম।
ব্যাপারটা খুবই ফলপ্রসূ হয়, বললেন ক্র্যাডক, আমিও একেবারে অন্য দিক থেকেই আক্রমণ করি এডমণ্ডকে, যদিও ভাল করে জানতাম সে কখনওই একাজ করতে পারে না। সরাসরি তাকে অভিযোগ করি।
–আমার অংশের অভিনয়ও নিশ্চয় যথাযথ হয়েছিল, বলল উল্লসিত ক্র্যাডক, আমি দৃঢ়ভাবেই অভিযোগ অস্বীকার করলাম। একেবারে পরিকল্পনার ছক ধরে। তবে আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে যা ছিল না তা হল, জুলিয়া আচমকা নিজে থেকেই বলে ওঠে সেই হল পিপ। ভেবেছিলাম পিপ আমিই হব।
জুলিয়ার কথা শুনে আমার মত ইনসপেক্টর ক্র্যাডকও হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তবে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এই ব্যাপারটা সুন্দরভাবে সামলে নেন। তিনি বলেন, কোন অর্থবতী মহিলাকে বিয়ে করাই আমার অভিপ্রায়।
–এতসবের কি দরকার ছিল? বলল জুলিয়া।
দরকার ছিল এজন্য যাতে শার্লট বিশ্বাস করে মিৎসি সত্যি সত্যি কিছু দেখে থাকবে। আর মিৎসিও একই কথা বারবার বলতে থাকে যাতে তার কথা সকলে শুনতে বাধ্য হয়। এরকম না হলে তাকে চুপ করাবার দরকার হবে না। ক্র্যাডক বললেন।
এরপর বললেন যেমন তাকে তালিম দেওয়া হয়েছিল, সেভাবেই মিৎসি ঘর ছেড়ে রান্না ঘরে চলে যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শার্লটও বেরিয়ে গেল।
রান্নাঘরে মিৎসি একা হলেও আসলে একা ছিল না। সার্জেন্ট ফ্লেচার ছিলেন রান্নাঘরের পাশে বাসনমাজার ঘরের দরজার পেছনে। আর আমি ছিলাম রান্নাঘরে ঝটা বুরুশ রাখার আলমারির মধ্যে।
–ঘটনা কি ঘটবে তা তুমি ভাবতে পেরেছিলে জেন মাসী? বললেন বাঞ্চ।
দুটো ব্যাপার আমি ভেবেছিলাম। হয় মিৎসির মুখ বন্ধ রাখার জন্য শার্লট তাকে টাকা দিতে চাইবে। তা হলে সার্জেন্ট ফ্লেচারই এই ঘটনার সাক্ষী থাকবেন।
তা না করলে, আমি ধরে নিয়েছিলাম, শার্লট মিৎসিকে খুন করতে চাইবে।
শার্লটের মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। নিজেকে ধরে রাখার শক্তি আর তার ছিল না।
মিস হিনচক্লিফ আর মারগাটরয়েডের ঘটনাটার পর থেকে সে বেসামাল হয়ে পড়েছিল।
মিস হিনচক্লিফ পুলিশ স্টেশনে চলে গেলেন। তিনি ফিরে এলেই মারগাটরয়েড তাকে বলে দেবেন সে-রাতে শার্লট যে ঘরটায় যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানে ছিলেন না।
জানালার আড়ালে থেকে, এই পরিস্থিতিতে, শার্লট বুঝে গিয়েছিল, মারগাটরয়েডের মুখ তখনই বন্ধ করার ব্যবস্থা করা দরকার যাতে মিস বাঞ্চ কিছু জানতে না পারেন।
মাত্র কয়েক মিনিট সময় ছিল হাতে। কোন পরিকল্পনা নেবার মত সময় ছিল ন। সরাসরি খুন ছাড়া কিছু করার ছিল না। এক মিনিট সময় নষ্ট না করে শার্লট গলায় ফাঁস এঁটে বেচারী মারগাটরয়েডকে হত্যা করে।
তারপর দ্রুত বাড়িতে ফিরে এসে পোশাক পাল্টে নেয়।
শার্লটের ভাগ্য খারাপ হল, এর পরেই ঘটল মুক্তোর মালা ছেঁড়ার ঘটনা। অপারেশনের দাগটা পাছে কেউ দেখে ফেলে এই ভেবে নিদারুণ ভয় পেয়ে গেল।
পরে পরেই ইনসপেক্টর ফোনে জানালেন, তিনি সকলকে নিয়ে আসছেন–মারগাটরয়েডের মৃত্যুর ঘটনাটা তদন্তের জন্য।
পর পর ধাক্কা আসতে লাগল। চিন্তা করবারও সময় ছিল না। মিৎসি এবারে ঘটালো নতুন বিপদ। ভয়ে দিশাহারা অবস্থায় একটা হিংস্র পশুতে পরিণত হল শার্লট।
আমি তার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছিলাম। সে কারণেই বঁটা রাখার আলমারিতে থেকে ডোরা বানারের গলা নকল করে আমি তাকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
–হয়েছিলও ঠিক তাই…একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল।