- বইয়ের নামঃ কুকুর খেকো ডাইনী
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
কুকুর খেকো ডাইনী
০১.
জুনের এক রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল। শক্তিশালী। একটা লাল কনভারটিবল গাড়ি চালাচ্ছে রবিন, এখানে আসার জন্যে ভাড়া নিয়েছে গাড়িটা। পাশে বসে তন্ময় হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে কিশোর। দু-ধারে চষা খেত। দূরে দেখা যাচ্ছে পকোনো পর্বতমালার সবুজ ঢাল। পেনসিলভানিয়া ডাচ এলাকার মধ্যে দিয়ে চলেছে ওরা।
পেছনের সীটে বসে ঝিমাচ্ছে মুসা।
হঠাৎ রসিকতার সুরে বলে উঠল রবিন, মুসা, ওই দেখো একটা। সাইনবোর্ড। ডাইনী তাড়ানোর জন্যে বসানো হয়েছে। ডাইনী আছে। এখানে।
চমকে চোখ মেলল মুসা, কই, কোথায়? দেখতে পেল নিজেই। চাষীর এক গোলাঘরের ওপর বিরাট একটা গোল জিনিস। এ রকম গোল কেন?
একে বলে হেকস্ সাইন। ডাইনী আর বজ্রপাতকে তাড়ানোর জন্যে বসানো হয়।
ডাইনী! আজকের দিনে?
কেন, ভূত যদি থাকতে পারে, ডাইনী থাকবে না কেন? কিছু কিছু ডাইনীর ক্ষমতা কিন্তু ভূতের চেয়ে বেশি, মুসাকে ভয় দেখানোর জন্যে বলল রবিন। তোমার গরুকে যদি জাদু করে দেয়, দুধ শুকিয়ে যাবে ওটার, আর দুধ দেবে না। আরও অনেক কুমন্ত্র জানে ডাইনীরা। ওসব শয়তানি যাতে না। করতে পারে সেজন্যেই বসানো হয়েছে ওটা।
ঘুম দূর হয়ে গেল মুসার চোখ থেকে। পরের দুটো গোলাবাড়ির দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল। নিজেকেই যেন বোঝাল, দূর, কি যে বলো, আজকাল। আর ওসব বিশ্বাস করে না কেউ! এটা বিংশ শতাব্দী। আমাকে আর ভয়। দেখানোর চেষ্টা কোরো না, বুঝলে, আমি এখন আর ডাইনী-ফাইনী বিশ্বাস। করি না।
তাই নাকি? হেসে বলল কিশোর, তাহলে ভয় পাচ্ছ কেন?
কই পাচ্ছি?
যাই বলো, আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা। সত্যি বলেছ, টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতেও হেক্স সাইন লাগায় লোকে?
খাইছে! দোহাই তোমার, কিশোর, এর মধ্যে আর রহস্য খুঁজো না তো! এই একটিবার অন্তত রক্ষা করো। এই ছুটিতে কোন গোয়েন্দাগিরি করব না আমরা, খাব-দাব আর ঘুরে বেড়াব।
শুধু ঘুরে বেড়ানোর জন্যে তোমাকে এতদূরে এত খরচ করে পাঠানো হয়েছে ভাবছ কেন?
তুমি না বললে বেড়াতে যাচ্ছি আমরা।
বেড়াতেই তো এসেছি, তবে বিনিময়ে একটা কাজ করে দিতে হবে। খামোকা কি আর কেউ কাউকে টাকা দেয়। আর আমরাই বা নেব কেন?
তা তো নেব না। কিন্তু ঘটনাটা কি খুলে বলো তো?
মিস্টার সাইমনের এক বন্ধু ক্যাপ্টেন ডেভিড রিচটনকে সাহায্য করার জন্যে পাঠানো হয়েছে আমাদের। ওই পর্বতের ভেতরে ব্ল্যাক হোলো নামে একটা জায়গায় তার কেবিন।
ক্যাপ্টেন রিচটন? কিসের ক্যাপ্টেন? সেনাবাহিনীর?
না, পুলিশের। পাঁচ-ছয় বছর আগেও পুলিশ চীফ ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন।
হু, বুঝেছি, আমি একটা গাধা! মুষড়ে পড়ল মুসা, এলিয়ে পড়ল আবার পেছনের সীটে, শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। আর কোন কাজ নেই কিছু নেই, শুধু বেড়াতে যাওয়ার এত আগ্রহ কেন তোমার, সেটা আগেই সন্দেহ করা উচিত ছিল আমার। তোমরাও কিন্তু বলোনি আমাকে।
তুমিও তো জিজ্ঞেস করোনি। বেড়ানোর নাম শুনেই লাফিয়ে উঠেছ।
চুপ হয়ে গেল মুসা। ভিকটর সাইমন যেদিন তিন গোয়েন্দাকে তার বাড়িতে ডেকেছিলেন, সেদিন গ্যারেজে জরুরী কাজ ছিল মুসার। নিজেদের গাড়িগুলো ধুয়েমুছে সাফ করছিল। সেজন্যে যেতে পারেনি। কিশোর আর রবিন গিয়েছিল। বিকেলে খবর জানিয়েছে রবিন, আগামী দিনই নিউ জারসিতে রওনা হচ্ছে ওরা। খরচ-খরচা সব মিস্টার সাইমন বহন করবেন। বোকার মত সে ভেবেছিল, শুধু বেড়াতেই বুঝি যাওয়া হচ্ছে। তিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, আর কি কি জানো বলে ফেলো তো?
আর? অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটছে ব্ল্যাক হোলোতে। এ কথা মিস্টার সাইমনকে লিখে জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন রিচটন। সাহায্যের অনুরোধ করেছেন। তাঁকে। কিন্তু তিনি এখন ভীষণ ব্যস্ত, আরেকটা অত্যন্ত জরুরী তদন্ত করছেন। ব্ল্যাক হোলোতে যাওয়া এখন তাঁর পক্ষে অসম্ভব। সেজন্যেই আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন…
তার দায়িত্বটা আমাদের ঘাড়ে চাপানোর জন্যে!
তোমার কি খুব রাগ হচ্ছে? খোঁচা দিয়ে বলল রবিন। বলো তো ফিরে যাই। কি বলো, কিশোর?
কিশোর হাসল। তাড়াতাড়ি মুসা বলল, না না, যাওয়ার আর কি দরকার, এসেই যখন পড়েছি। তা ছাড়া এতগুলো খাবার-দাবার কিনে আনলাম। সব নষ্ট হবে।
ঝলমলে বিকেল। প্যানসিলভানিয়া ডাচের চমৎকার উপত্যকা ধরে চলছে গাড়ি। সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে। পেছনে পড়েছে চাষের খেত। এঁকেবেঁকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে পথ, পাহাড়ের ঢালের গভীর বনের দিকে। এখানে ওখানে সবুজের মধ্যে থেকে মাথা তুলেছে ধূসর পাথরের চাঙড়।
পর্বতে ঢুকলাম, ঘোষণার মত করে বলল রবিন।
একটা শৈলশিরা পেরিয়ে এসে হঠাৎ করে নেমে গেছে পথটা, পরের পাহাড়শ্রেণীতে পৌঁছে আবার সোজা উঠেছে। সামনে তাকিয়ে আছে কিশোর। বাড়িঘর চোখে পড়ল, একটা শহর।
আচমকা কানে এসে লাগল লাউড-স্পীকারে বাজানো মিউজিক আর কথার শব্দ। কান খাড়া করে ফেলল তিনজনেই, কোথা থেকে আসছে দেখার চেষ্টা করল।
দেখে ফেলেছি! বলে উঠল মুসা। কান ও চোখের ক্ষমতা অন্য দু-জনের চেয়ে তার বেশি।
ররিন আর কিশোরও দেখল, একসারি তাঁবু। উজ্জ্বল রঙের ব্যানারে লেখা রয়েছেঃ
হ্যারিজ কার্নিভ্যাল
এই, থামো তো, মুসা বলল। এদিকের কার্নিভ্যাল দেখার শখ আমার অনেক দিনের। পপকর্নের গন্ধও পাচ্ছি। টেস্টটা দেখি কেমন।
কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। হেসে মাথা ঝাঁকাল গোয়েন্দাপ্রধান।
গাড়ি পার্ক করে নেমে এল তিন গোয়েন্দা। কান ঝালাপালা করে ঝমঝম বাজছে মিউজিক, সেই সঙ্গে ঘোষকের চিৎকার, কোলাহল। প্রচুর দর্শকের ভিড়। বনবন ঘুরছে নানারকম নাগরদোলা, বিচিত্র ওগুলোর নাম–হুঁইপ, অকটোপাস, ম্যাড় হর্স। ওগুলোতে বসা মানুষগুলো সমানে চেঁচাচ্ছে, বাচ্চা বুড়োতে কোন ভেদাভেদ নেই। একপাশে অনেকগুলো স্টল, চিৎকার করে ক্রেতা ডাকছে মালিক আর সেলসম্যানেরা।
অন্য কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা একটা খাবারের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল মুসা। কিনল এক কার্টন পপকর্ন, এক ব্যাগ পানাট, একগাদা ক্যান্ডি।
একটা সাইনবোর্ড দেখিয়ে রবিন বলল, ওই ভাবুটাতে ঢুকলে কেমন হয়?
মুসা আর কিশোরও পড়ল সাইনবোর্ডটাঃ
কর্নেল ডুম হুমবা
নির্ভীক অ্যানিমেল ট্রেনার
মাশাআল্লাহ! পপকর্ন চিবাতে চিবাতে বলল মুসা, নাম বটে। জন্তুর শিক্ষক যখন, হুমবা না রেখে হামবা রাখলেই হত, গরু, মানাত ভাল।
তাঁবুর ভেতর থেকে হিংস্র জানোয়ারের ডাক শোনা গেল। তারমানে বাঘ-সিংহ জাতীয় কিছু আছে। হুমবা কতটা নির্ভীক দেখার জন্যে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে পড়ল তিনজনে। এ
গোলাকার তাঁবুর কেন্দ্রে একটা গোল জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আঁটসাট সাদা পোশাক পরা একজন মানুষ, পায়ে গোড়ালি ঢাকা চকচকে কালো বুট। ঘন, ঝাঁকড়া কালো চুল, পুরু গোঁফ, মোটা ভুরু, তীক্ষ্ণ চোখ, হাতে কালো লম্বা চাবুক যেন কর্তৃত্ব জাহির করছে। এর দরকারও আছে, কারণ কাছেই একটু পর পর সাজানো ছোট টুলে তাকে ঘিরে বসে আছে চারটে ভয়ানক জন্তু, দুটো হলদেটে, আর দুটো কালো। চারটেই জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। লম্বা লেজের মাথা থিরথির করে কাঁপছে, বুঝিয়ে দিচ্ছে। মানুষকে পছন্দ করে না ওরা।
পুমা, নিচু স্বরে বলল রবিন। কি বিরাট দেখেছ!
সপাং করে উঠল চাবুক। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরছে ট্রেনারের শক্তিশালী দেহটা, প্রতিটি জানোয়ারকে টুল থেকে নেমে আবার লাফিয়ে উঠে বসতে বাধ্য করছে।
নাহ, লোকটা সত্যি নির্ভীক, প্রশংসা না করে পারল না কিশোর। যে ভাবে পেছন করে দাঁড়াচ্ছে জানোয়ারগুলোকে, ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লে দেখতেই পাবে না।
কিন্তু ভুল অনুমান করেছে সে। একটা কালো পুমা লাফিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি হলো। এক্কেবারে সময়মত কি করে টের পেয়ে পাক খেয়ে ঘুরে গেল ট্রেনার, হিসিয়ে উঠল চাবুক, থমকে গেল জানোয়ারটা, লাফ দেয়া আর হলো না।
খাইছে! এ তো সাংঘাতিক মানুষ! বলে উঠল মুসা।
হ্যাঁ, পাশের সীটে বসা অপরিচিত একজন দর্শক বলল, সাহস আছে। এখনও বুনোই রয়ে গেছে জানোয়ারগুলো, ওগুলো নিয়েই খেলা দেখাচ্ছে। এগুলোর সঙ্গে আরেকটা ছিল, হলুদ রঙের, এমন শয়তানের শয়তান, হুমবাও বাগ মানাতে পারেনি। একদিন আরেকটু হলেই দিয়েছিল ঘাড় মটকে, শেষমেষ ওটাকে বিদেয় করতে হয়েছে।
অবাক হয়ে হুমবার খেলা দেখল তিন গোয়েন্দা। তারপর তার প্রশংসা করতে করতে বেরোল তাঁবু থেকে। আবার চড়ল গাড়িতে।
.
দুই ঘণ্টা পর, শেষ বিকেলে খাড়া কাঁচা রাস্তা বেয়ে উঠে চলল ওপর দিকে লাল গাড়িটা। দু-পাশের বনের গোড়ায় তখন কালো ছায়া পড়েছে।
মনে হচ্ছে ঠিক পথেই যাচ্ছি, কিশোর বলল। তবু, শিওর হওয়া দরকার। ওই যে একটা বাড়ি।
বাড়িটার সামনে এনে গাড়ি থামাল রবিন। অনেক পুরানো, কাঠের তৈরি ঘর। সামনের বেড়ার রঙ উঠে গেছে বহু আগে। নীরব, নির্জন।
কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না, আশপাশটা দেখতে দেখতে বলল রবিন। কুকুর খেকো ডাইনী
গেটের দিকে এগোল তিনজনে। হাত তুলে বাড়ির পাশে গাছপালার ভেতর দিয়ে যাওয়া একটা রাস্তা দেখাল কিশোর। ওই যে, মানুষ আছে।
রোগাটে, ছোটখাট একজন মহিলা বেরিয়ে এল গাছের আড়াল থেকে। হাত ধরে টেনে আনছে বছর সাতেকের একটা ছেলেকে। চিৎকার করে, কাঁদছে ছেলেটা। গোয়েন্দাদের দেখে এগিয়ে এল মহিলা, আমি মিসেস ভারগন। তোমাদেরকে তো কখনও দেখিনি? কি চাও?
এটা কি রিম রোড? জানতে চাইল কিশোর। ক্যাপ্টেন রিচটনের বাড়িটা খুঁজছি।
রঙ ফ্যাকাসে হয়ে আসা একটা সুতার পোশাক পরেছে মহিলা। আরেকটু এগিয়ে এসে ভালমত দেখল ছেলেদের। রিচটন? সোজা সামনে, পথের মাথার শেষ বাড়িটা। একেবারে ব্ল্যাক হোলোর কিনারে বলে আরেকবার দেখল ছেলেদের।
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, কাঁদছে কেন ও? মন খারাপ? এই বাবু, একটা চকলেট খাবে? নাও।
কোন লাভ হবে না, মিসেস ভারগন বলল, ওর কান্না থামবে না। কাল রাতে ওর কুত্তা হারিয়ে গেছে। ওটা না পাওয়া পর্যন্ত আর কোন কিছু দিয়েই বন্ধ করা যাবে না।
তাই নাকি? দেখলে জানাব। কি কুকুর?
এই ছোট জাতের, বাদামী রঙ। একটা কান সাদা। গলায় কলার পরানো। তাতে ট্যাগে নাম লেখা আছে, ডব।
যাওয়ার জন্যে ঘুরল ছেলেরা। শুনতে পেল, ছেলেটাকে ধমক দিয়ে। মিসেস ভারগন বলছে, পটি, তুই কান্না থামাবি! মরে যাবি নাকি একটা কুত্তার জন্যে! তারপর আবার ডাকল গোয়েন্দাদের, এই, শোনো।
তা কিছুটা অবাক হয়েই ঘুরে তাকাল তিন গোয়েন্দা। গেটের কাছে এসে দাঁড়াল মহিলা। এদিক ওদিক তাকিয়ে, কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল, তোমরা এখানে নতুন, বুঝতে পারছি। সাবধান করে দেয়া দরকার। ব্ল্যাক হোলোর কাছে যেয়ো না।
কৌতূহলী হয়ে উঠল কিশোর, কেন?
জায়গাটা ভাল না। ডাইনীর আসর আছে। দুশো বছর আগে এখানকার এক সুন্দরী মেয়ে ডাইনী হয়ে যায়। কুত্তা দেখতে পারত না সে, মন্ত্র পড়ে ওগুলোকে গায়েব করে দিত। তারপর কি যে করল কে জানে, জোয়ান জোয়ান মানুষগুলো হঠাৎ অসুখ হয়ে মরে যেতে শুরু করল।
ঘাবড়ে গেছে মুসা। চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, কেউ কিছু করতে পারল না তার?
চেষ্টা কি আর কম করেছে। লোকে ধরে আটকে রেখে দিল ডাইনীটাকে। ভাবল, এইবার শয়তানি বন্ধ হবে। কিন্তু তা কি আর হয়। একদিন উধাও হয়ে গেল সে, ঢুকে পড়ল গিয়ে ব্ল্যাক হোলোর কাছে বনে।
রাতে বেরিয়ে এসে ঘুরে বেড়াত গায়ের পথে পথে, মন্ত্র পড়ে গরুকে শুকিয়ে মারত, কুত্তা ধরে নিয়ে যেত, আর ফিরে আসত না ওগুলো। লোকের ধারণা, কুত্তা খেত ডাইনীটা। আরও যত রকমের শয়তানি আছে করত। তারপর এক রাতে ভয়ানক চিৎকার শোনা গেল। গায়ের সবচেয়ে সাহসী দু-চারজন লোক গিয়ে দেখল, একজায়গায় একটা গর্ত হয়ে আছে। মাটি পুড়ে কালো হয়ে। গেছে।
কি-ক্কি হয়েছিল! ভয়ে তোতলাতে শুরু করল মুসা।
লোকের ধারণা, স্বয়ং শয়তান বেরিয়ে এসে ডাইনীটাকে ধরে নিয়ে। গেছে মাটির তলে! ভয়ে ভয়ে আবার এদিক ওদিক তাকাল মিসেস ভারগন। এর প্রায় একশো বছর পর আবার রহস্যজনক ভাবে কুত্তা হারাতে আরম্ভ করল। গর্তটার কাছে রাতে শোনা যেতে লাগল ডাইনীর চিৎকার। যেমন হঠাৎ করে আরম্ভ হয়েছিল, কিছুদিন পর আবার হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল। আরও একশো বছর পর এখন আবার যখন কুত্তা হারাতে শুরু করেছে, রাতে চিৎকার শোনা যায় শোনো, তোমাদেরকে ভাল ছেলে বলেই মনে হচ্ছে আমার, সেজন্যেই সাবধান করছি, নইলে আমার কি।
নিগ্রো ছেলেটার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যেতে দেখল মিসেস ভারগন। শ্বেতাঙ্গ ছেলেটার বিশেষ কোন ভাবান্তর হলো না। আর তৃতীয় ছেলেটার চোখ জুলজুল করছে।
বাড়ির ভেতরে টেলিফোনের শব্দ শোনা গেল।
কে আবার করল? যাই, দেখি। ভেবেছিল, ডাইনীর কথা শুনে ভয়ে একেবারে কাবু হয়ে যাবে ছেলেগুলো, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যাবে। হলো না। দেখে খানিকটা হতাশই হলো মহিলা। ভোতা স্বরে বলল, আমার সাবধান করা দরকার করলাম, শোনা না শোনা তোমাদের ইচ্ছে।
.
০২.
আমার রোম খাড়া করে দিয়েছে। মুসা বলল।
লো গীয়ারে গাড়ি চালাচ্ছে রবিন, ওপরের দিকে উঠছে। তুমিই না তখন বললে এই যুগে আর ডাইনী-ফাইনী বিশ্বাস করে না কেউ, তুমিও কোরো না।
কিন্তু এ জায়গাটা ভাল না। বলা যায় না, এখানে থাকতেও পারে। ঘন বন, একটা-দুটো.বাড়ি..এই কিশোর, মহিলা বানিয়ে বলেনি তো এ সব কথা? কি মনে হয় তোমার? পটির কুত্তাটা যে হারিয়েছে সেটাও তো ঠিক, নইলে অত কাদবে কেন?
হেসে বলল রবিন, এ সব গল্প এ ভাবেই ছড়ায়। রহস্যময় ঘটনা ঘটতেই পারে। আসল কারণটা না খুঁজে রঙ চড়িয়ে যার যা ইচ্ছে বানিয়ে বলে দেয়। যত দোষ ফেলে নিয়ে গিয়ে ডাইনী কিংবা ভূতের ওপর।
কিশোর বলল, কিছু বুঝতে পারছি না। চিৎকারটাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না, রবিন নিজে না শুনলে আমাদের আগ বাড়িয়ে এ ভাবে বলত না মিসেস ভারগন।
পাহাড়ের ওপরে উঠে প্রথম যে জিনিসটা চোখে পড়ল, তা হলো নতুন। রঙ করা একটা লেটার-বক্স। নাম লেখা রয়েছে: ডি. রিচটন। তার ওপাশে ঘাসে ঢাকা ছোট্ট একটুকরো খোলা জায়গা। জায়গাটাকে দু-পাশ থেকে ঘিরে এসেছে ঘন পাতাওয়ালা হার্ডউড আর দেবদারু গাছের জঙ্গল। ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তৈরি ছোট একটা কেবিন। বাড়ির ওপাশ থেকে উঁকি দিয়ে আছে পুরানো একটা গাড়ির নাক।
বাহ, গাড়ির যত্ন করেন ক্যাপ্টেন, চিনতে পারল রবিন। পনেরো বছর আগের মডেল, অথচ একেবারে ঝকঝকে রেখেছেন।
বাড়ির পেছনে কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ করেই যেন শূন্যে মিলিয়ে গেছে ঘাসে ঢাকা জায়গাটা। ওটা আসলে একটা বিরাট গর্তের কিনারা। কিনারে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে, ঘাস শেষ, তার জায়গা দখল করেছে ওখানে ধূসর, মসৃণ পাথর, প্রায় খাড়া হয়ে নেমেছে বাটির মত দেখতে একটা উপত্যকায়, ঢুকে পড়েছে লতায় ছাওয়া ঘন জঙ্গলের মধ্যে।
এটাই ব্ল্যাক হোলো, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। আশ্চর্য! ওখানকার গাছগুলো পর্যন্ত কালো লাগছে। অথচ এ রকম লাগার মত এতটা অন্ধকার কিন্তু হয়নি এখনও।
কিন্তু ক্যাপ্টেন কোথায়? বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। আমাদের গাড়ির শব্দ নিশ্চয় শুনেছেন। আসছেন না কেন? চিৎকার করে ডাকল, ক্যাপ্টেন রিচটন, আমরা এসেছি! তিন গোয়েন্দা!
কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অবাক হলো ওরা। আসার খবর চিঠি লিখে, জানিয়েছে ক্যাপ্টেনকে, তবে কি চিঠি পাননি? সেটা তো হতে পারে না। আর চিঠি পান বা না পান, ডাক শুনে এসে দেখার তো কথা?
এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিল রবিন। ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন রিচটন।
জবাব এল না এবারও।
দরজায় তালা নেই। ঢুকে পড়ল ওরা। সুন্দর, সাজানো-গোছানো একটা ঘর, এককোণে ছোট একটা বাংক। শুধু গাড়িরই যত্ন করেন না ক্যাপ্টেন, সব জিনিসেরই করেন, বোঝা গেল। কিন্তু তিনি গেলেন কোথায়?
ওপাশের ছোট রান্নাঘরটায় ঢুকল মুসা। মুহূর্ত পরেই তার চিৎকার শোনা গেল, অ্যাই, দেখে যাও! বন্যা হয়ে গেছে!
দৌড়ে গেল কিশোর আর রবিন। অনেক পানি জমে আছে মেঝেতে, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। ওই পানিটুকু বাদ দিলে রান্নাঘরটাও শোবার ঘরের মতই গোছানো, যেখানে যেটা থাকা দরকার, ঠিক সেখানেই আছে। চকচক করছে প্যান, চামচ, বাসন-পেয়ালা। পরিষ্কার পর্দাগুলোর কোথাও এতটুকু দাগ নেই।
মেঝেতে পানি এল কোত্থেকে? রবিনের কণ্ঠে বিস্ময়। এ রকম হওয়ার কথা নয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসেন ক্যাপ্টেন। পানি পড়লে সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলার কথা।
নুয়ে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল কিশোর। বরফের মত শীতল। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল এককোণে রাখা একটা পুরানো আমলের আইস-বক্সের কাছে। নিচ থেকে টেনে বের করল একটা বেসিন, পানিতে টইটম্বুর, ওটা থেকেই পানি উপচে পড়ে মেঝে ভাসিয়েছে।
দুই সহকারীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল সে, বরফ গলে এই পানি। জমেছে।
ভুরু কুঁচকে বলল রবিন, জমতে তো অনেক সময় লেগেছে নিশ্চয়। পরিষ্কার করলেন না কেন ক্যাপ্টেন?
বেসিনের পানিটা সিংকে ঢেলে খালি করল কিশোর। বিড়বিড় করল, ব্যাপারটা অদ্ভুত!
মুসা বলল, মানুষ তো আর সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকে না। হয়তো তিনি। যাওয়ার পর পড়েছে।
বিছানাটাও এলোমলো, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রবিন। বাইরে গেলে এ ভাবে ফেলে যাওয়ার কথা নয়। যে রকম গোছগাছ করা স্বভাব তার, গুছিয়েই রেখে যেতেন। পানি নাহয় পরে পড়তে পারে, কিন্তু বিছানাটা তো আর। আপনাআপনি অগোছাল হতে পারে না।
হয়তো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছেন, অনুমান করল মুসা। গোছানোর সময় পাননি?
তাহলে কি এমন কাজে চলে গেলেন, যে বিছানা গোছানোরও সময় পাননি? নিজেকেই প্রশ্নটা করল যেন কিশোর।
ব্যাপারটা খাপছাড়া লাগল গোয়েন্দাদের কাছে। বেরিয়ে এসে বাটির মত জায়গাটার কিনারে দাঁড়াল, যেখান থেকে উপত্যকায় নেমে গেছে ঢাল। মুখের কাছে হাত জড় করে চিৎকার করে ডাকল, ক্যাপ্টেন রিচটন! ক্যাপ্টেন রিচটন!
জবাবের আশায় কান পেতে রইল ওরা। কিন্তু কোন সাড়া এল না বিরাট কালো গর্তটা থেকে, এমনকি কোন প্রতিধ্বনিও নয়।
গুরুতর কিছু একটা হয়েছে মনে হয়, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলা যায় না, কোথাও জখম হয়েও পড়ে থাকতে পারেন। খুঁজতে যাব। একপাশের জঙ্গল দেখিয়ে বলল, মুসা, তুমি আর রবিন ওদিকে যাও, আমি এদিকে যাচ্ছি।
বনে ঢুকে পড়ল দুই সহকারী গোয়েন্দা। অনেক বড় বড় গাছের মাথা এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে, রোদ আটকে ফেলে, গোড়ায় আগাছা জন্মাতে দেয় না। ফলে হাঁটা সহজ। গোধূলির কালচে-ধূসর ছায়া নেমেছে বনতলে, আর আধঘণ্টার মধ্যেই পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর মুসা বলল, রাত তো হয়েই গেল। আর খুঁজে লাভ নেই। চলো, ফিরে যাই।
আবার খোলা জায়গাটায় ফিরে এল দু-জনে। কিশোরের নাম ধরে ডাকল মুসা। জবাব পেল না।
খাইছে! গুঙিয়ে উঠল সে, এ-কি ভূতুড়ে কাণ্ড! প্রথমে ক্যাপ্টেন, এখন কিশোরও গায়েব…
খসখস শব্দ শুনে থেমে গেল সে।
শশশ! ফিসফিস করে বলল রবিন, কিসের শব্দ?
খোলা জায়গাটায়ও এখন অন্ধকার। বনের ভেতরে আবার শোনা গেল শব্দটা, নড়ছে যেন কিছু। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে।
মুসা? রবিন? ডাক শোনা গেল বনের কিনার থেকে।
ও, কিশোর! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা।
কাছে এসে জানাল কিশোর, কোন চিহ্নই পেলাম না ক্যাপ্টেনের। উপত্যকায় নামার একটা পথ পেয়েছি। ওটা ধরে এগিয়েছিও কিছুদূর। এ জন্যেই দেরি হয়েছে। কিন্তু কিছু পেলাম না।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করল রবিন। এক রহস্যের কিনারা করতে এসে আরেক রহস্য…চলো, আমাদের মালপত্রগুলো ভেতরে নিয়ে যাই। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।
.
খানিক পরেই ছোট্ট কেবিনের রান্নাঘর থেকে মাংস আর ডিমভাজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। খেতে বসে গেল তিন গোয়েন্দা। গোগ্রাসে গিলছে মুসা। রিচটনের উধাও হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছে তিনজনে।
ঘরের দরজায় তালা নেই, গাড়িটাও রয়েছে, নিজেকেই যেন বোঝাল কিশোর, দুটো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।
হ্যাঁ, মাথা ঝকাল রবিন। হয় কেউ তাঁকে গাড়িতে করে নিয়ে গেছে, নয়তো তিনি নিজেই হেঁটে গেছেন। এত তাড়াহুড়া করে গেছেন, দরজায় তালা লাগানোরও সময় পাননি। হেঁটে গেলে এমন কোন জায়গায় গেছেন, যেখানে গাড়ি চলে না।
ওরকম জায়গা একটাই দেখেছি। গর্তের মত উপত্যকাটা, ব্ল্যাক হোলো।
প্লেটের খাবার চেটেপুটে শেষ করে ফেলল মুসা। রহস্য নিয়ে যত খুশি মাথা ঘামাও তোমরা, সূত্র খুঁজতে থাকো, আমি এই সুযোগে বাসন পেয়ালাগুলো ধুয়ে ফেলি। তারপর আরও কাজ আছে। তবে সেগুলো করতে পারি এক শর্তে।
কী? কিছুটা অবাক হয়েই জানতে চাইল কিশোর।
কিছু লাকড়ি এনে দিতে হবে।
মুসার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল কিশোর আর রবিন, ভেবেছিল কি না জানি বলবে। উঠে গেল রিচটনের জড় করে রাখা লাকডির স্তূপ থেকে লাকডি আনার জন্যে। ফিরে এল দু-জনে দুই বোঝা নিয়ে।
হ্যান্ডপাম্পটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মুসা। বসে না থেকে ঘরের ভেতরে খুঁজতে শুরু করল অন্য দু-জনে–কি খুঁজছে জানে না, তবে ক্যাপ্টেনের উধাও হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু।
কিশোর, লিভিংরুম থেকে ডাকল রবিন। গানরাকে একটা বন্দুক কম। রাইফেলও হতে পারে সেটা, কিংবা শটগান। জায়গাটা খালি।
রান্নাঘরের টেরিলে আরও মূল্যবান একটা সূত্র খুঁজে পেল কিশোর। ডাকল, রবিন, দেখে যাও।
রান্নাঘরে দৌড়ে এল রবিন।
টেবিলের ড্রয়ারে পাওয়া বুকসাইজ ক্যালেন্ডারটা দেখাল কিশোর। গত দুই মাসের তারিখগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তার। একটা বিশেষ তারিখের নিচের লেখা দেখিয়ে বলল, এই যে দেখো, কোন জাতের কুকুর, মালিকের নাম, পরিষ্কার করে লিখেছেন। জুনের দশ, বর্ডার টেরিয়ার, মালিকের নাম জন হিগিনস।
ক্যালেন্ডারটা হাতে নিল রবিন। আরও কয়েকটা কুকুরের নাম দেখল বিভিন্ন তারিখের নিচে। একটা তারিখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। এটা দেখেছ। লিখেছেন: চিৎকার শুনলাম!
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
বাসন ধুতে ধুতে ফিরে তাকাল মূসা, বাহ; চিৎকারটা তাহলে ক্যাপ্টেনও শুনেছেন! আর তো হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় না!
ঠিকই বলেছ। একজন পুলিশ অফিসার, ভালমত না শুনলে লিখতেন, কিশোর বল। আনমনে বিড়বিড় করল, চিৎকার শুনেছেন, কুকুরের কথা লিখেছেন: লোকে বলে ডাইনীটা চিৎকার করে, কুকুরও ধরে নিয়ে। যায়…
পটির কথা লিখেছেন নাকি দেখো তো?
দ্রুত দেখে নিল রবিন। না। এটা মাত্র কাল রাতের ঘটনা। না লেখার আরেকটা মানে হতে পারে, তিনি এখানে তখন ছিলেন না, হয়তো আজ সারাদিনেও ফেরেননি।
হতে পারে, একমত হলো কিশোর। আমি এখন আরও শিওর হচ্ছি, বিপদেই পড়েছেন তিনি। কাল সকালে উঠেই তাকে খুঁজতে বেরোব।
আমার কাজ শেষ, টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল মূসা। হাই তুলতে তুলতে বলল, রাতে নিশ্চয় আর কিছু করবে না। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। বাংকে কে শোবে? দাঁড়াও, টস করে নিই।
টসফস লাগবে না, হেসে বলল রবিন। ইচ্ছে হলে তুমি ঘুমাওগে। আমি আর কিশোর মেঝেতেই শুতে পারব, স্লীপিং ব্যাগে।
মৃদু একটানা হিসসস আওয়াজ করে জ্বলছে হ্যাজাক লাইট। আলো জ্বেলে রাখা প্রয়োজন মনে করল না কিশোর। চাবি ঘুরিয়ে তেল বন্ধ করে দিল। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কমলা রঙ হয়ে রইল ম্যানটেলটা, তারপর নিভে গেল। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল কেবিন। একেবারে নীরব হয়ে গেল। অনেক পথ গাড়ি চালিয়ে এসেছে ওরা, তারপর বনের মধ্যে খোঁজাখুঁজি, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম।
মাঝরাতে ভয়াবহ একটা শব্দে চমকে জেগে গেল তিনজনেই। চোখ মেলে, কান পেতে চুপ করে পড়ে রইল অন্ধকারে, আরেকবার শব্দটা শোনার আশায়।
শোনা গেল আবার। রাতের নীরবতা খান খান করে দিল তীক্ষ্ণ, তীব্র চিৎকার, যেন ভীষণ আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল কোন মহিলা। কেবিনের পেছনে গর্তের নিচ থেকে এল বলে মনে হলো।
চিৎকারটা মিলিয়ে গেলে ফিসফিস করে মুসা বলল, ক্যাপ্টেন কাল এই চিৎকার শুনেই দেখতে যাননি তো?
জানি না, লাফিয়ে উঠে বসল কিশোর। মনে হয় কেউ বিপদে পড়েছে। এই, জলদি কাপড় পরে নাও, দেখতে যাব।
দুই মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। সন্ধ্যায় যে বুনোপথটা দেখে এসেছে কিশোর, সেটা ধরে দৌড়ে নেমে চলল উপত্যকায়। ঘন ঝোপঝাড় আর বড় বড় পাথরে পড়ে বিচিত্র ছায়া সৃষ্টি করছে টর্চের আলো,। একে তো অচেনা পথ, তার ওপর বেরিয়ে থাকা গাছের শেকড় বাধা দিয়ে গতি কমিয়ে দিচ্ছে।
কাউকে চোখে পড়ল না ওদের। একটা জায়গায় এসে থেমে দাঁড়াতে হলো। সামনে একটা পাহাড়ী নালা। পাথরে পাথরে বাড়ি খেয়ে যেন টগবগ করে ফুটতে ফুটতে, সাদা ফেনা তৈরি করে তীব্র গতিতে বয়ে যাচ্ছে স্রোত।
তখন এই পর্যন্ত এসেই ফিরে গেছি, পানির প্রচণ্ড শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল কিশোর। পেরোবে নাকি?
নিশ্চয়, বলেই বোকার মত পানিতে পা দিয়ে বসল রবিন। কিন্তু। স্রোতের শক্তি আন্দাজ করতে পারেনি সে, একটানে তাকে চিৎ করে ফেলল। নিজেকে সামলানোরও সময় পেল না। নিতান্তই একটা খড়কুটোর মত ভাসিয়ে নিয়ে চলল তাকে পানি।
.
০৩.
আলো সরাবে না! চিৎকার করে বলল কিশোর। ধরে রাখো!
রবিনের ওপর টর্চের আলো ধরে রেখে পাড় ধরে নিচের দিকে দৌড়ে নামতে লাগল দুজনে।
জবাব না দিয়ে তার টর্চটাও কিশোরের হাতে গুঁজে দিয়ে ওই স্রোতের মধ্যে নেমে গেল মুসা। বরফের মত শীতল পানি, কিন্তু গভীরতা বেশি নয়। উঠে দাঁড়াল সে, পানি বেশি না এখানে, মাত্র কোমর পানি, কিন্তু সাংঘাতিক টান, পেছন থেকে ঠেলা মেরে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে।
প্রায় বেহুশ হয়ে গেছে ততক্ষণে রবিন। নিচে নেমে যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো। করে যে নেমে যাবে মুসা, তার উপায় নেই। নালার নিচটা খুব পিচ্ছিল। পা রাখাই মুশকিল। নিজেকে বোঝাল, উল্টে পড়ে বিপদ আরও বাড়ানোর চেয়ে আস্তে নামাই ভাল।
কিশোরের হাতের দুটো টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে রবিনের কাছে পৌঁছে গেল সে। একটা পাথরে ঠেকে আটকে আছে রবিন। বেহুঁশ। নাকটা কেবল রয়েছে পানির ওপরে।
পা দুটো একটা খাঁজে শক্ত করে আটকে দিল মুসা, যাতে পিছলে না পড়ে। উবু হয়ে পাজাকোলা করে তুলে নিল রবিনকে। আগুন লাগলে দমকল কর্মীরা যে ভাবে কাঁধে তুলে নেয় আক্রান্ত মানুষকে, সে-ও তেমন করে কাঁধে ফেলল অচেতন দেহটাকে।
এদিক দিয়ে উঠে এসো! আলো ফেলে পথ দেখিয়ে চিৎকার করে ডাকল কিশোর।
পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে ইঞ্চি ইঞ্চি করে উঠে আসতে লাগল মুসা। কাঁধে বোঝা নিয়ে এখন পা পিছলালে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
তবে আর কোন অঘটন ঘটল না। তীরে উঠে রবিনকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে বসে হাঁপাতে লাগল সে।
চোখের পলকে রবিনের ওপর এসে ঝুঁকে বসল কিশোর। অবস্থা কতটা গুরুতর দেখতে শুরু করল। নাড়ি দেখল, ঠিকই আছে। নিজের গা থেকে শার্ট খুলে নিয়ে ওটাকেই তোয়ালে বানিয়ে মুখ থেকে পানি মুছতে লাগল।
টর্চের আলোয় মাথায় একটা জখম চোখে পড়ল, রক্ত বেরোচ্ছে, পাথরে। বাড়ি খেয়ে হয়েছে ওটা। টেনে টেনে রবিনের ভেজা জামাকাপড় খুলে ফেলল সে। ভেজা গা মুছিয়ে দিল।
একটু পরেই চোখ মিটমিট করল রবিন। তাকাল টর্চের আলোর দিকে। দুর্বল কণ্ঠে বলল, আলো সরাও।…আরি, আমার কাপড় কি করেছ তোমরা? ন্যাংটো বানিয়ে ফেলেছ…
এখানে আমরাই কেবল, অসুবিধে নেই, হাসল কিশোর। নিজের অর্ধেক ভেজা শার্টটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও, এটা পরে ফেলো। এক্ষুণি কেবিনে ফিরে গিয়ে গা গরম না করলে মরবে দু-জনেই।
চিৎকারটা কে করল…
জাহান্নামে যাক চিৎকার! কাল সকালেও সেটা জানা যাবে। ওঠো, জলদি চলো।
সে-রাতে আর চিৎকার শোনা গেল না। সকালে সোনালি রোদ এসে পড়ল কেবিনের চারপাশে ঘাসের ওপর। তখনও নীরব রইল কেবিনটা। রাতের ধকলের পর নিথর হয়ে ঘুমাচ্ছে তিন গোয়েন্দা।
আরও অনেকক্ষণ পর রান্নাঘরে কেটলি আর বাসন-পেয়ালার টুংটাং শোনা গেল। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল ডিমভাজা, প্যানকেক, আর কফির সুবাস।
একটা বাসন আর চামচ হাতে বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল কিশোর। বাসনটাকে ঘন্টার মত করে ধরে চামচ দিয়ে বাড়ি মারতে মারতে ডাকল, অ্যাই আলসেরা, ওঠো। দশটা বাজে।
নড়েচড়ে উঠল ঘুমন্ত দুটো শরীর।
আঁউ। আমার মাথাটা গেছে! উঠে বসতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল রবিন। বজ্ঞো ব্যথা!…ক্যাপ্টেন এখনও ফেরেননি, তাই না?
না, শুধু আমি আছি, আর প্যানকেক, হেসে জবাব দিল কিশোর। সারাদিন খালিপেটে থাকতে না চাইলে জলদি উঠে এসো। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে আমার, একাই সাবাড় করে দেব দেরি করলে।
তার হুমকিতে রবিনের কিছু হলো না, কিন্তু বিছানায় তড়াক করে উঠে বসল মুসা। দৌড় দিল বাথরুমের দিকে।
খিদে তিনজনেরই পেয়েছে। রাতের ধকলই এর জন্যে দায়ী। রাক্ষসের মত গিলতে শুরু করল। খেয়েদেয়ে, তৈরি হয়ে আধঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে। পড়ল ক্যাপ্টেন রিটনকে খুঁজতে। মাথার যন্ত্রণা অনেক কমেছে রবিনের।
আগে আগে চলেছে কিশোর, গলায় ঝোলানো একটা শক্তিশালী দূরবীন। প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে পথটা নেমেছে একেবেকে। বড় বড় গাছপালার মধ্যে ঢুকতেই রোদ সরে গেল গা থেকে, পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। একটু আধটু যা নামছে, ব্যস। বিশাল সবুজ চাদোয়া তৈরি করেছে যেন গাছের মাখাগুলো। তবে দিনের বেলা তো এখন, যথেষ্ট আলো আছে বনের তলায়। ক্যাপ্টেন রিচটনের যাওয়ার চিহ্ন খুঁজতে খুঁজতে এগোল ওরা।
জায়গাটার নাম ব্ল্যাক হোলো কেন হয়েছে, বুঝতে পারছি, রবিন, বলল এত কালো একটা গর্তের নাম আর কি হবে?
চারপাশে পাহাড়ের দেয়াল, সহজে বাতাসও যেন ঢুকতে পারে না এখানে। অস্বাভাবিক নীরবতা। একটা পাতা কাপে না, কোন জানোয়ারের নড়াচড়া চোখে পড়ে না। রবিনের কথাটা এই স্তব্ধতার মাঝে বড় বেশি হয়ে কানে বাজল। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল তিনজনেই।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মুসা। দাঁড়াও! কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করতে লাগল। চোখ ঘুরছে আশপাশের গাছপালার মধ্যে।
কাকের ডাক, রবিন বলল। মাইলখানেক।
নাহ, অন্য একটা শব্দ শুনলাম বলে মনে হলো।
সেই নালাটার কাছে এসে কাধ থেকে দড়ির বান্ডিল খুলে নিল মুসা। আজ আর বোকামি করল না কেউ, অসাবধান হলো না। মোটা গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে চলাচলের জন্যে একটা লাইফ-লাইন তৈরি করল।
নিরাপদে পার হয়ে এল অন্য পাড়ে। এগিয়ে চলল। পেছনে ফেলে এল পানির গর্জন। আবার ওদেরকে গিলে নিল যেন থমথমে নীরবতা।
আবার দাঁড়িয়ে গেল মুসা, দাঁড়াও!
কি শুনছ? অধৈর্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল রবিন।
কি রকম একটা খসখসানি!
তুমিই করছ শব্দটা। জিনসের প্যান্টের পায়ে পায়ে ঘষা লাগছে…এসো। এ ভাবে বার বার থামতে হলে গর্তের তলায় আর নামতে পারব না।
এগিয়ে চলল ওরা। সন্তুষ্ট হতে পারল না মুসা। খুঁতখুতানি থেকেই গেল মনে।
দাঁড়াও? এবার থমকে গেল কিশোর।
তুমিও শুনেছ? জানতে চাইল মুসা।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশের বনের দিকে তাকাতে তাকাতে নিচু স্বরে বলল কিশোর, দেখিনি, তবে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ… কিছু একটা আমাদের পিছে পিছে আসছে।
তাহলে এখন কোথায় শব্দটা? রবিনের প্রশ্ন। আমরা থামলেই কি থেমে যায়? আমি তো কিছু শুনছি না!
আবার এগোল ওরা! আগে চলে এসেছে রবিন, কারণ কিশোর আর মুসা প্রতিটি ঝোপঝাড়, গাছের আড়ালে নজর রেখে চলেছে। কর অবশেষে শেষ হলো ঢাল। সমতল হলো পথটা। চলার গতি বেড়ে গেল। জোরে জোরে পা চালিয়ে চলল রবিন। কিছু বোঝার আগেই একটা কাঁটা ডালে আটকে গেল প্যান্ট। খুদে খুদে কাঁটা কাপড় ফুটো করে খোঁচা দিতে লাগল চামড়ায়। নিচু হয়ে সেটা ছাড়াতে যেতেই অন্য ডালের কাটায় আটকে গেল সোয়েটারের পিঠ, হাতা, হাতের খোলা চামড়ায়ও খোঁচা লাগল! একটা ছাড়াতে গেলে আরও দশটা বিঁধে যায়।
পেছন থেকে হেসে বলল কিশোর, বনগোলাপের কাঁটা, তাড়াহুড়ো করলে আরও আটকে যাবে। খুব আস্তে আস্তে ছাড়াও, একটা একটা করে।
কিশোরের পরামর্শে কাজ করে কাঁটার ফাঁদ থেকে মুক্ত হলো রবিন। তবে বেশ কিছু খোঁচা সহ্য করার পর। সতর্ক হয়ে এগোল, আর আটকাতে চায় না। কিন্তু কয়েক পা এগোতে এগোতেই থমকে দাঁড়াতে হলো। কিশোর! মুসা!
কি হলো? আবার আটকেছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।
হাসিমুখে ফিরে তাকাল রবিন। আমাকেও শুধু বোকা বানায়নি ওই কাঁটা, আরও একজনকে বানিয়েছে। হাত বাড়িয়ে কাঁটা থেকে একটুকরো ছেঁড়া কাপড় খুলে আনল সে। উজ্জ্বল রঙ, চেককাটা ছাপ। দেখো। শার্ট ছেঁড়া। ক্যাপ্টেনেরও হতে পারে। পুরানো নয়, তাহলে রঙ চটে যেত।
দেখি, হাত বাড়াল মূসা।
কিশোরও দেখল। একটা চিহ্ন পাওয়াতে আশা হলো ওদের, এদিক দিয়েই গেছেন হয়তো ক্যাপ্টেন। কাঁটাঝাড়ের পাশ কাটিয়ে এসে বুনোপথ ধরে প্রায় ছুটতে লাগল এখন তিনজনে।
আবার চিৎকার করে উঠল রবিন। সামনে পাথরের গা কেটে, উপত্যকার এপাশ থেকে ওপাশে বয়ে চলেছে একটা সরু নদী। নদীটার পাড়ে একটা ছোট খড়ির পাড়ে বসে পড়ল সে। তুলে আনছে কিছু।
মুসা আর কিশোর কাছাকাছি হলো তার।
কি পেয়েছে দেখাল রবিন। একটা দেশলাইয়ের বাক্স। ভেজা, কিন্তু। রঙটা তাজা। তারমানে বেশি সময় পড়ে থাকেনি পানিতে। আজ যেন রবিনেরই দিন। একের পর এক সূত্র চোখে পড়ছে তার।
দারুণ! কিশোর বলল, ক্যাপ্টেন যদি না-ও গিয়ে থাকেন, এ পথ দিয়ে যে একজন মানুষ গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। নদীর পাড় ধরে হাঁটব। দেখি, আর কি পাই?
নরম মাটিতে পুরু হয়ে পড়ে আছে বাদামী পাইন নীড়ল, পা পড়লে দেবে। যায়, মনে হয় কার্পেটের ওপর দিয়ে হাঁটছে। পায়ের ছাপ পড়ছে না। তারমানে এখানে মাটি ভেজা থাকলেও কারও ছাপ পাওয়ার আশা নেই। রাস্তা জুড়ে এক জায়গায় পড়ে আছে একটা গাছ। তার কাছে চকচকে একটা জিনিসের ওপর দৃষ্টি আটকে গেল কিশোরের। ছুটে গেল সে। পাতার নিচ থেকে একটা নয়, দুটো চকচকে জিনিস বের করে আনল। শটগানের গুলির খোসা। শুকটুকে বলল, বারুদের গন্ধ আছে এখনও। যে-ই গুলি করে থাকুক, বেশি আগে করেনি।
কাপের আকৃতির দুটো গর্ত হয়ে আছে। একটাতে হাঁটু রেখে দেখল, খাপে খাপে বসে যায়। বলল, হাটু গেড়ে বসে গুলি করেছিল। ক্যাপ্টেন রিচটনের একটা বন্দুক গানর্যাকে নেই। তিনিও গুলি করে থাকতে পারেন। কিন্তু কাকে সই করে?
আমি কি জানি? হাত উল্টাল মুসা।
রবিন বলল, গরম হয়ে উঠছে কিন্তু ব্যাপারটা!
ওখানে আর কিছু পাওয়া গেল না। নদীর ধারের পথ ধরে এগোতে লাগল ওরা। কিছুদূর গিয়ে আবার বুনোগোলাপের ঝাড় পড়ল, পথের ওপর উঠে এসেছে, সেখানে আরেক টুকরো কাপড় পাওয়া গেল, প্রথম টুকরোটার মত। একই পোশাক থেকে ছিঁড়েছে। এ মাটিতে চোখ বোলাতে লাগল কিশোর। এক জায়গায় দেবে গেছে অনেকগুলো বিছুটি, কোন কোনটার গোড়া ভাঙা, ভারী কিছুর চাপে অমন হয়েছে।
খাইছে! বলতে বলতে নিচু হয়ে একটা টর্চ তুলে নিল মুসা। কাঁচটা ভাঙা। টুকরোগুলোও পাওয়া গেল ওখানেই। ক্যাপ্টেন রিচটনের, কোন সন্দেহ নেই! উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল সে। এই দেখো, তাঁর নামের আদ্যক্ষর লেখা রয়েছে, ডি আর!
বিছুটিগুলো ভাল করে দেখার জন্যে বসে পড়ল কিশোর। সিরিয়াস ব্যাপার, বুঝলে, পাতায় দেখো কিসের দাগ লেগে আছে!
রক্ত! উদ্বিগ্ন শোনাল রবিনের কণ্ঠ।
এই সময় একটা খসখস শোনা গেল! ঝট করে ফিরে তাকাল মুসা। দেখল, একটা পাথরের চাঙড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে আছে একটা মুখ। রোদেপোড়া বাদামী চামড়া, লম্বা লম্বা চুল, কালো উজ্জ্বল চোখের তারা কেমন বন্য করে তুলেছে চেহারাটাকে। সামান্য ফাঁক হয়ে আছে ঠোঁট, বড় বড় দাঁত বেরিয়ে পড়েছে।
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে সে!
.
০৪.
একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ছেলেরা, যেন জ্বলন্ত ওই চোখজোড়া সম্মোহন করছে ওদের। তারপর হঠাৎ করেই পাথরের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল মুখটা।
ডাইনী! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুসার মুখ। ওটাই খেয়েছে ক্যাপ্টেন রিটনকে! আমাদের পিছু নিয়েছিল! বললাম না, শব্দ শুনেছি।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, কিশোর। এখনও বেশিদূর যেতে পারেনি! জলদি এসো!
আগে আগে দৌড় দিল সে। তার পেছনে রবিন, সবশেষে মুসা। ছায়াঢাকা, প্রায় অন্ধকার বনের ভেতর দিয়ে ছুটল তিনজনে। আঁকাবাকা অচেনা পথ। কখনও সামনে পড়ছে গাছের নিচু ডাল, কখনও ঝোপঝাড়, কখনও কাঁটাঝাড়। ওগুলো এড়িয়ে চলতে গিয়ে নানা রকম কৎ করতে হচ্ছে।
সামনে ছুটন্ত পায়ের শব্দ কানে আসছে। হুড়মুড় করে ঝোপে ঢুকে পড়ল কেউ। থামল না গোয়েন্দারা। বন এক জায়গায় সামান্য হালকা, ওখানে এসে কিশোরের নজরে পড়ল, গাছের আড়ালে ঢুকে গেল গাঢ় বাদামী ফ্ল্যানেলের, ট্রাউজার আর সবুজ সোয়েটার পরা লম্বা একটা দেহ। বড় বড় গাছগুলোকে। পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটল।
ডাইনী না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর। তবে ছুটতে পারে বটে!
মুসা ডাইনীর ভয়েই এগোচ্ছে না, নইলে হয়তো কাছাকাছি চলে যেতে পারত মানুষটার, কিন্তু কিশোর আর রবিন ওর সঙ্গে পারছে না। আচমকা বায়ে মোড় নিয়ে রাস্তা থেকে সরে ঘন বনে ঢুকে পড়ল সে। ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়, বনে চলতে অভ্যস্ত।
চোখের আড়াল কোরো না! চিৎকার করে বলল কিশোর। পাহাড়ের কাছে গিয়ে কোণঠাসা করব ওকে!
কিন্তু গর্তের মত উপত্যকার গাছে ছাওয়া ঢালের কাছে পৌঁছেও থামল না। মানুষটা। গাছের শেকড়, ডাল, আর গোড়া ধরে ধরে দ্রুত উঠে চলল ঢাল বেয়ে।
কিন্তু অভ্যাস না থাকায় ওই পথে অত তাড়াতাড়ি উঠতে পারল না। গোয়েন্দারা। দূরত্ব বাড়ছে ক্রমেই।
দেয়ালের নিচের অর্ধেকটায় গাছপালা আছে, তার ওপরে ফাঁকা, শুধু। পাথর আর পাথর। ওখানে পৌঁছে খোলা জায়গায় বেরোতে হলো লোকটাকে। গায়ে রোদ পড়ল। থামল না সে। কোণাকোণি চলে, পাথরের। পর পাথর ডিঙিয়ে হারিয়ে গেল গর্তের ওপরে উঠে।
খোলা জায়গাটায় বেরিয়ে আর পারল না গোয়েন্দারা। পাথরের ওপর। বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল।
শুনেছি, ঝাড়ুর ডাণ্ডাকে হাউই বাজি বানিয়ে তাতে বসে উড়ে চলে ডাইনীরা, মাথা নাড়তে নাড়তে বলল রবিন, কিন্তু একি! এ তো পা-কেই হাউই বানিয়ে ফেলেছে!
গলা থেকে দূরবীন খুলে নিল কিশোর। চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগল গর্তের কিনারে উঠে লোকটা যেখানে অদৃশ্য হয়েছে সেখানটা। সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ল না। শেষে ব্ল্যাক হোলোর নিচের দিকে দূরবীনের চোখ নামাল।
কিছু দেখছ? জানতে চাইল মুসা।
প্রচুর গাছপালা, আর কিছু না।
একপ্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে আরেক প্রান্তে নজর সরাচ্ছে কিশোর। ছোট্ট একটু খোলা জায়গার ওপর চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেল হাত।
দেখেছ মনে হচ্ছে কিছু? প্রশ্নটা করল এবার রবিন।
তার হাতে দূরবীন তুলে দিল কিশোর। যেদিকে খোলা জায়গাটা আছে নীরবে সেদিকে হাত তুলে দেখাল।
প্রথমে শুধু গাছ চোখে পড়ল রবিনের। কই, কিছু তো দেখছি না।
গর্তের দেয়ালের গোড়ায় দেখো।
রবিনও দেখতে পেল। শুরুতে যেগুলোকে কেবল পাথর মনে হয়েছিল, সেগুলোকেই এখন অন্য রকম লাগল, মনে হচ্ছে কাঠ আর পাথরকে যত্ন করে সাজিয়েছে কেউ। চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ, আরি, এ তো ঘর। দরজাও দেখতে পাচ্ছি। এমন করে ক্যামোফ্লেজ করে রেখেছে, যাতে নজরে না পড়ে।
রবিনের হাত থেকে দূরবীনটা প্রায় কেড়ে নিল মুসা। দেখে বলল, ওরকম বাড়িতে কে বাস করে, বলো তো? ওই ডাইনীমুখো লোকটা?
হতে পারে। যে-ই করুক, ক্যাপ্টেন রিচটনের খবর হয়তো জানাতে পারবে আমাদের। কিশোর, যাবে নাকি?
চলো।
আবার নামা! আঁতকে উঠল মুসা, এই পথে নামতে গেলে এবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।
তুমি কি ভেবেছিলে চিরকালই থাকব আমরা এখানে? হেসে বলল কিশোর।
ততক্ষণে নামতে শুরু করে দিয়েছে রবিন, পাহাড়ে চড়ায় অন্য দু-জনের চেয়ে দক্ষ সে।
নিচে নেমে পায়েচলা পথটা আবার খুঁজে বের করল ওরা।
আধঘণ্টা পর বন থেকে বেরিয়ে এল খোলা জায়গাটুকুতে। হাত তুলে থামার ইঙ্গিত করল কিশোর। এত কাছে থেকেও রহস্যময় ছোট্ট বাড়িটাকে চেনা কঠিন। আগে থেকে না জানা থাকলে হয়তো চোখেই পড়ত না, অথচ রয়েছে মাত্র দশ-বারো গজ তফাতে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল ওরা। পাথর আর কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর। জানালা নেই, সামনের দিকে কেবল একটা দরজা। কাউকে চোখে পড়ল না। পা টিপে টিপে বাড়িটার দিকে এগোতে শুরু করল কিশোর, পেছনে দুই সহকারী। সামনের খোলা চত্বরটুকু পেরিয়ে এসে কাঠের দরজার সামনে। দাঁড়াল সে। একমুহূর্ত দ্বিধা করে টোকা দিল দরজায়।
বার বার টোকা দিয়েও সাড়া মিলল না।
মুসা বলল, ভেতরে কিছু নড়েছে মনে হলো।
সরে গিয়ে এককোণ থেকে উঁকি দিল সে। কাউকে দেখতে পেল না। বাড়িটার গঠন দেখে অবাক হলো। আরেক পাশে সরে গিয়ে অন্য কোণ থেকে তাকাল। কাঠ আর পাথর দিয়ে তিনদিকে বেড়া তৈরি করা হয়েছে। বাকি একদিকের বেড়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে পাথরের দেয়ালটাকে। একধারে একটা খোয়াড়, ভেড়া রাখা হত বোধহয়, এখন শূন্য। একটা জানোয়ারও নেই।
দেখলে কিছু? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না। কেউ নেই।
তাহলে নড়ল কি?
কি জানি!
বাড়িটার গঠন কিশো; আর রবিনও দেখল। রবিন বলল, আরেকটা। দেয়াল বানাতে কি এমন কষ্ট হত? আলসে নাকি লোকটা? নাকি কোন কারণ আছে এ ভাবে বানানোর?
একটা কারণ হতে পারে, ক্যামোফ্লেজ, দেখতে দেখতে বলল কিশোর। এভাবে তৈরি করাতে দেয়ালের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে, সহজে চোখে পড়ে না।
হু। এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে, তারচেয়ে চলো বাড়িটা কার জানার চেষ্টা করি। ব্ল্যাক হোলোর মালিক কে, সেটা জানাও বোধহয় জরুরী।
বেরিয়েছি কিন্তু রিটনকে খুঁজতে, মনে করিয়ে দিল কিশোর। এই বাড়ির মালিক, কিংবা যে লোকটা আমাদের ওপর চোখ রাখছিল, তার সঙ্গে ক্যাপ্টেনের নিখোঁজ হওয়ার কোন সম্পর্ক না-ও থাকতে পারে। একটা ব্যাপারে এখন শিওর হয়ে গেছি আমরা, এখানে, এই গর্তের মধ্যে কিছু একটা ঘটেছে তার। শেরিফকে জানাতে হবে খবরটা।
একঘণ্টা জোরকদমে চলার পর গর্তের উল্টোধারের দেয়ালের ওপরে। এসে উঠল ওরা আবার, রিচটনের কেবিনের কাছে। একবাক্স বিস্কুট আর তিনটে আপেল বের করে নিল মুসা। ইতিমধ্যে ছোট্ট একটা নোট লিখে টেবিলে চাপা দিয়ে রাখল কিশোর, ক্যাপ্টেন ফিরে এলে দেখতে পাবেন; জানবেন, ওরা এসেছে।
আবার এসে গাড়িতে উঠল ওরা। ফরেস্টবার্গে শেরিফের সঙ্গে দেখা করতে যাবে।
.
০৫.
গাড়ি চালাচ্ছে মুসা। ভারগনদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল সামনের চত্বরে গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে পটি।
ওর কুত্তাটা খোঁজার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা।
রবিন বলল, যাবে আর কোথায়, হয়তো ফেরত চলে এসেছে।
আমার মনে হয় না, কিশোর বলল। এলে ওভাবে মন খারাপ করে বসে থাকত না। কুকুরটাও থাকত তার সঙ্গে।
বাকি কুত্তাগুলোর ব্যাপারে কি মনে হয় তোমার? হারিয়েছে যে বলল। মিসেস ভারগন? কোনও পশু চোরের কাজ?
চোরটা কে, জানি আমি, জবাব দিল মূসা। সেই ডাইনী।
রবিন ভেবেছিল, উড়িয়ে দেবে কিশোর, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে। বলল গোয়েন্দাপ্রধান, আমার ধারণা, ডাইনী আর কুকুর-নিখোঁজ রহস্যের। মধ্যে যোগাযোগ আছে। ক্যাপ্টেনও এটা সন্দেহ করেছেন। নইলে ক্যালেন্ডারে লিখে রাখতেন না।
কিশোরের কথায় মুসাও অবাক, ডাইনী আছে তুমি বিশ্বাস করো?
না।
আমিও না, রবিন বলল। তবে এখানকার লোকে যে করে তাতে সন্দেহ নেই। করার কারণ, পেনসিলভানিয়া ডাচেরা আসলে ডাচ নয়, জার্মান। দু-তিনশো বছর আগে ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্যে দেশ ছেড়ে এসে বসতি করেছিল এখানে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল ডাইনী, রক্তচোষা ভুত, জাদুমন্ত্র এসবের গল্প। ওদের অনেকেই এখনও এসব উদ্ভট গল্প সত্যি বলে মানে, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ওসব আছে।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল মুসা, মিসেস ভারগনও তো করে।
ডাইনীর গল্প অবশ্য আরও অনেক দেশে আছে। নিউ ইংল্যান্ডের পিউয়ারিটনরাও বিশ্বাস করে ডাইনী আছে।
চুপ করে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
কিছু ভাবছ মনে হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
অ্যাঁ! হ্যাঁ। রবিন, তোমার কি মনে হয়নি, কুত্তা চুরি করে কেউ ডাইনীর এই কিংবদন্তীটাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে?
করতে পারে। তবে কেন করবে এই কাজ, কিছু বুঝতে পারছি না।
সরু একটা পথ চলে গেছে ফরেস্টবার্গের দিকে। আশোঁপাশে বসতি খুব কম। প্রায় দুই ঘণ্টা একটানা চলার পর পাহাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে একটা চৌরাস্তা পড়ল। অন্য যে পথটা আড়াআড়ি কেটে চলে গেছে মূল রাস্তাটাকে, তার একটা প্রান্ত উঁচু হয়ে পাহাড়ে উঠে গেছে, অন্য প্রান্তটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে একটা পার্বত্য নদীর দিকে। নেমে যাওয়া দিকটার দু-দিকে অনেকগুলো। কাঠের তৈরি বাড়িঘর চোখে পড়ল। পুরানো একটা আঁতাকলও আছে।
ম্যাপ দেখে কিশোর বলল, ওটাই ফরেস্টবার্গ। ঘোরো।
গাড়ি ঘোরাল মুসা।
আগের দিনে ওটা দিয়ে গম ভাঙাত লোকে, আঁতাটা দেখিয়ে রবিন বলল। তখন ইলেকট্রিসিটি ছিল না, নদীর স্রোতকে কাজে লাগিয়ে ওটা ঘোরানো হত।
একটা বাড়ির ডিসপ্লে উইন্ডোতে বড় বড় করে লেখা রয়েছে: অ্যাংগাস জেনারেল স্টোর। আকৃষ্ট করল মুসাকে। ছাউনি দেয়া বারান্দায় পড়ে আছে দড়ির বান্ডিল, হাতুড়ি-বাটাল, খন্তা-কুড়াল জাতীয় যন্ত্রপাতি, আর গম-আটার। বস্তা।
আমি ঢুকব ওখানে, ঘোষণা করল সে। গোয়েন্দাগিরিতে অনেক পরিশ্রম, অনেক ক্যালোরি খরচ হয়, ঠিকমত না খেলে শরীর টিকবে না।
হেসে ফেলল রবিন। মুসা দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে গেলে সে বসল ড্রাইভিং সীটে। ড্রাইভ কিশোরও করতে পারে, কিন্তু গাড়ি চালাতে ভাল লাগে না তার। ছুটন্ত গাড়িতে আরাম করে বসে দু-ধারের দৃশ্য দেখাই, তার বেশি পছন্দ।
কেনাকাটা করার জন্যে মুসাকে রেখে কাউন্টি কোর্টহাউসে রওনা হলো। অন্য দু-জন। সাদা একটা কাঠের বাড়ি, সামনে ছড়ানো বারান্দার ওপরে। কাঠের খুঁটি দিয়ে ধরে রাখা চালা।
কাউন্টি ক্লার্কের অফিসে ঢোকার আগে দরজায় থাবা দিতে গেল কিশোর। কিন্তু পাল্লাটা ভোলা, চাপ লাগতেই ফাঁক হয়ে গেল। ভেতরে ঢুকল
সে আর রবিন। বিশাল, পুরানো আমলের একটা রোল-টপ ডেস্ক রয়েছে। ঘরে, ওটার খোপগুলোতে ঠেসে ভরা রাখা হয়েছে দলিলপত্র। টেবিলের ওপরেও গাদা গাদা কাগজ, বড় বড় পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেয়া।
কেউ নেই ঘরটায়। ওপাশের দরজাটার কাছে এসে সবে টোকা দিতে যাবে কিশোর, এই সময় খুলে গেল ওটা। বেরিয়ে এল চশমা পরা এক মধ্যবয়েসী মহিলা। কি চাই? ক্লার্ক মিস্টার রেনসন বাইরে গেছেন। আমাকে দিয়ে কোন সাহায্য হবে?
ব্ল্যাক হোলোতে ক্যাম্পিং করতে যেতে চাই আমরা, জবাব দিল কিশোর। জায়গাটার মালিক কে জানতে পারলে তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিতাম।
বহুবছর ধরে মহিলা এই এলাকার বাসিন্দা, এক অফিসে কাজ করতে করতে অনেক কিছু মুখস্থ হয়ে গেছে। ফাইল কিংবা রেজিস্টার দেখার প্রয়োজন বোধ করল না। জবাব দিয়ে দিল, পুরো উপত্যকাটারই মালিক আরিগনরা। যদূর জানি, এখনও যারা বেঁচে আছে, সবাই যার যার মত অন্য জায়গায় চলে গেছে। ওদের কেউ ওখানে এখন বাস করে কিনা বলতে পারব না।
আরিগন নামটা নোটবুকে টুকে নিল রবিন।
মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল দু-জনে।
শেরিফের অফিসের দরজায় গিয়ে টোকা দিল কিশোর।
ভেতর থেকে ভারি গলায় ডাক শোনা গেল, আসুন।
খাটো, ভারি শরীর, ধূসর রঙের পুরু গোঁফওয়ালা একজন মানুষ টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। ওয়েস্টকোটের বোতাম খোলা, বলিষ্ঠ বাহুর ওপরে গুটিয়ে রাখা শার্টের হাতা। খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছে তাকে। সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে ডেস্কের ওপর দিয়ে তাকালেন ছেলেদের দিকে।
দ্রুত নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর। শেরিফের নাম জানতে পারল, টোনার।
কি দরকার? জানতে চাইলেন শেরিফ।
সংক্ষেপে ক্যাপ্টেন রিচটনের নিখোঁজ সংবাদ জানাল কিশোর। তার যে খারাপ কিছু হয়েছে, এই সন্দেহের কথাও বলল।
ভুরু কুঁচকে নীরবে সব শুনলেন শেরিফ। কথা শেষ হলে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে কি করতে বলো?
ব্ল্যাক হোলোতে গিয়ে খুঁজে দেখার জন্যে যদি কাউকে পাঠাতেন…
মাথা নাড়লেন শেরিফ, সম্ভব না। আজ তো নয়ই, কালও পারব কিনা? জানি না। আমার সমস্ত লোক এখন হাইজ্যাকারদের পেছনে ব্যস্ত। ইন্টারস্টেট ট্রাক থেকে মাল হাইজ্যাক হয়ে গেছে। কদিন ধরেই উৎপাত। করছে খুব, মাঝে মাঝেই মালবাহী গাড়ির ওপর চড়াও হয়ে লুটপাট চালাচ্ছে। ব্যাটাদের ধরতেই হবে।
কিন্তু স্যার, মিস্টার রিচটনের ব্যাপারটাও কম জরুরী না, আবার বলল কিশোর। দেরি হলে আরও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে তার। প্রাণের ওপরও আঘাত আসতে পারে।
শোনো, ভারিক্কি ভঙ্গিটা কোমল করার চেষ্টা করলেন শেরিফ, এত ভাবার কিছু নেই। এসব এলাকায় মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যায় লোকে। বেড়াতে বেরোয়, ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় বহুদূরে, আবার একদিন ফিরে আসে। ক্যাপ্টেনও হয়তো তাই করছেন। শুধু সন্দেহের বশে আমার লোকদের জরুরী কাজ থেকে সরিয়ে আনতে পারি না, কোন প্রমাণ নেই…
আছে স্যার, প্রমাণ আছে, জোর দিয়ে বলল রবিন। তার ভাঙা টর্চটা আমরা পেয়েছি। গুলির খোসা, পাতায় রক্ত, শার্টের ভেঁড়া কাপড়..এসবকে কি প্রমাণ বলবেন না?
চুপ করে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত রবিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন শেরিফ। ভুরু কুঁচকে বললেন, এত কিছু পেয়েছ! তাহলে তো সিরিয়াস ব্যাপারই মনে হচ্ছে। কিন্তু তারপরেও… অসহায় ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি, আজ লোক দেয়া সম্ভব নয়। কাল একটা সার্চ পার্টি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব, তবে কথা দিতে পারছি না।
এখানে আর এমন কেউ কি আছে, যে আমাদের খুঁজতে সাহায্য করতে পারে? জানতে চাইল কিশোর।
সামনের রিপোর্ট পড়তে শুরু করে দিয়েছেন ততক্ষণে শেরিফ, কিশোরের কথায় চোখ তুলে তাকালেন, মিস্টার আরিগনের কথা ভাবছি। ওই হোলোতে বাস করে। ওখানকার প্রতিটি ঝোপ, প্রতিটি পাথর তার চেনা। জন্মের পর থেকে বাস করেছে ওই অঞ্চলে। তোমরা গিয়ে বললে খুশি হয়েই তোমাদের সাহায্য করবে। ওই রকমই মানুষ, সবাইকে সাহায্য করার জন্যে যেন তৈরি হয়েই থাকে। ভাল লোক।
আরেকবার দৃষ্টি বিনিময় করল দুই গোয়েন্দা। আবার টোনারের দিকে তাকাল কিশোর। ওই উপত্যকাতেই থাকে বলছেন?
হ্যাঁ, সে-রকমই তো শুনেছি, একটা কেবিনে। আমি কখনও যাইনি। তোমরা গিয়ে খোঁজো, বের করে ফেলতে পারবে।
কোর্টহাউস থেকে বেরিয়ে এল দুই গোয়েন্দা। গাড়ি নিয়ে চলে এল জেনারেল স্টোরের সামনে। বাইরে অপেক্ষা করছে মুসা। পায়ের কাছে নানারকম প্যাকেট, টিন আর বোতলের স্তূপ। পারলে পুরো দোকানের সব খাবারই যেন কিনে ফেলত। গাড়িতে উঠেই বলল, আগে কোথাও গাড়ি রেখে খেয়ে নেব।…তো, কি জেনে এলে তোমরা?
ভোঁতা গলায় জানাল রবিন, শেরিফ সাংঘাতিক ব্যস্ত। মনে হচ্ছে আমাদেরই সব করতে হবে। কিশোর, মিস্টার সাইমনের সাহায্য চাইব?
মন্দ হয় না। সাহায্য না দিতে পারেন, পরামর্শ হয়তো দিতে পারবেন।
টেলিফোনে কথা বলতে চাও তো? সে আশা বাদ রাখো, মুসা বলল। দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাজারই করেছি শুধু ভেব না, গোয়েন্দাগিরিও করেছি। এই শহরের অনেক কথা জেনেছি। জানো, সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় এখানে কাকে নিয়ে? মিসেস অ্যাংগা, জেনারেল স্টোরের মালিকের স্ত্রী। বেশি বকর বকর করে কে? মিসেস অ্যাংগা। টেলিফোন অপারেটর কে জানো? মিসেস অ্যাংগা। এখান থেকে টেলিফোনে যত গোপন কথাই বলো সেটা আর গোপন থাকবে না, চোখের পলকে ছড়িয়ে পড়বে। সারা শহরে।
হুঁ, বুঝেছি, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। রবিন ঠিকই বলেছে, যা করার সব আমাদের করতে হবে। শেরিফ বলেছেন, কাল সকালে সার্চ পার্টি পাঠানোর চেষ্টা করবেন। যদি না পাঠান, মিস্টার আরিগনকে খুঁজে বের করব আমরা। তার সাহায্য চাইব।
আচ্ছা, রবিন বলল, গর্তের নিচের ওই আজব ঘরটাতে থাকেন না তো তিনি?
থাকতে পারেন। আর কোন বাড়ি তো চোখে পড়েনি ওখানে।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা। একটা কাফের সামনে এনে গাড়ি রাখল। বলল, টিনের খাবার পরেও খেতে পারব। রান্না করা কিছু খেয়ে নিই এখন।
খাবার খুব ভাল কাফেটার। স্থানীয় পত্রিকাটা টেনে নিয়ে চোখ বোলাতে লাগল কিশোর। আচমকা চিবানো বন্ধ হয়ে গেল তার। বলল, জন্তু জানোয়ারের নিলাম হবে, সেখানে যাব আমরা।
অবাক হলো রবিন, জানোয়ার নিলাম!
কোথায়? মুসাও অবাক।
পরের শহরে। এই যে, বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। আজকেই হবে, এবং আধঘণ্টার মধ্যেই।
কিন্তু ওখানে আমরা কি কিনতে যাব? গরুর মাংস, ভেড়ার মাংস দুটোই নিয়েছি, জ্যান্ত পশু আমাদের দরকার নেই।
আছে। কুকুর। ডাইনীর জন্যে ফাঁদ পাততে হলে কুকুরের টোপ দরকার। ক্যাপ্টেন রিচটনের কেবিনে নিয়ে যাব ওটাকে আমরা। কুত্তা চোর যদি থেকেই থাকে ওখানে, নিতে আসুক আমাদেরটা, তৈরি হয়ে বসে থাকব আমরা।
হাসি ছড়িয়ে পড়ল রবিনের মুখে, ভাল বুদ্ধি করেছ!
চোরটা যদি সত্যি ডাইনী হয়? মুসা খুশি হতে পারছে না। অহেতুক একটা জানোয়ারকে…
বাধা দিয়ে কিশোর বলল, ভয় নেই, পাহারায় থাকব আমরা। কুকুরটার ক্ষতি করতে দেব না ডাইনীকে। বরং ডাইনী ধরার চেষ্টা করব। হেসে রসিকতার সুরে বলল, একটা ডাইনীকে যদি ধরে নিয়ে যেতে পারি আমরা, ভাবতে পারো কি ঘটবে? ওটা শো করার ব্যবস্থা করব। টিকেট বেচেই বড়লোক হয়ে যাব আমরা।
খাওয়া শেষ হলো। কয়েক মিনিট পর আবার গাড়িতে এসে উঠল ওরা।
ম্যাপ দেখে রাস্তা বলে দিতে লাগল কিশোর। শহর ছাড়িয়ে আসতে খুব খারাপ হয়ে গেল পথ। এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তা, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগছে।
খাইছে! শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে মুসা, কবে বানিয়েছিল এই রাস্তা! আমার তো বিশ্বাস, সেই ওয়াইল্ড ওয়েস্টের যুগে, ঘোড়ার গাড়ি ছাড়া যখন আর কিছু চলত না।
একেই খারাপ, তার ওপর প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে রাস্তার অবস্থা আরও করুণ হয়ে আছে। মাটি গলে সরে গিয়ে নিচের পাথর বেরিয়ে পড়েছে। টায়ারে নিষ্ঠুর আঘাত হেনে চলেছে ওগুলো।
চুলের কাঁটার মত অনেকগুলো তীক্ষ্ণ বাঁক নেয়ার পর আরেকটা বাকের কাছে এসে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল:
গতি কমান!
সামনে পুল
ভারি গাড়ি নিষিদ্ধ।
মোড় পেরোলে কাঠের ব্রিজটা চোখে পড়ল। দু-পাশে লোহার রেলিঙ আছে বটে, তবে এতই হালকা, কোন গাড়ির পতন রোধ করতে পারবে না ওগুলো। নিচে তীব্র গতিতে বয়ে চলেছে পাহাড়ী নদীর স্রোত।
বোকামি করে বসল মুসা। ভাবল, পেরিয়ে যেতে পারবে, কিশোর বাধা দেয়ার আগেই গাড়ি তুলে দিল ব্রিজে। অর্ধেক যেতে না যেতেই মড়মড় করে উঠল নিচের তক্তা, গাড়িটার ভার সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়ছে।
চিৎকার করে উঠল কিশোর, থেমো না, থেমো না, চালিয়ে যাও!
.
০৬.
চমকে গিয়ে ব্রেক চেপে ফেলছিল মুসা, কিশোরের চিৎকারে সেটা ছেড়ে দিয়ে আরও জোরে চেপে ধরল অ্যাক্সিলারেটর। লাফ দিয়ে এগোতে গেল ভারি গাড়িটা। পারল না, পেছনের অংশ বসে যাচ্ছে।
পড়ে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে! বলে পেছনের সীটে বসা রবিন চেঁচাতে শুরু করল।
অ্যাক্সিলারেটর ছাড়ল না মুসা। ভীষণ গোঁ গো শুরু করল ইঞ্জিন। পড়ে যাবেই, আর বাঁচানো গেল না!–যখন ভাবছে সে, এই সময় সামনের কাঠে কামড় বসাল টায়ার। টেনে তুলল গাড়ির পেছনের অংশটাকে। নিরাপদে টেনে আনল ব্রিজের অন্যপ্রান্তে, রাস্তার ওপর।
কখন যে অ্যাক্সিলারেটর ছেড়ে দিল মুসা, বলতে পারবে না। ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। কেয়ার করল না সে। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, বেঁচেছি, উফ! থরথর করে কাঁপছে সে।
কাঁপছে অন্য দুজনও।
ব্রিজের কতটা ক্ষতি হয়েছে দেখার জন্যে নেমে এল তিনজনে। মাঝখানের দুটো তক্তা ঝুলে আছে নিচের কালো পানির দিকে, আরেকটা গায়েব।
কোন গাড়ি উঠলেই এখন মরবে, গম্ভীর স্বরে কিশোর বলল। সাবধান করার ব্যবস্থা করা দরকার।
কি করে করব? রবিনের প্রশ্ন।
লোহার কাঠামোতে পা রেখে আর রেলিঙ ধরে প্রায় ঝুলে ঝুলে আবার। অন্যপাশে চলে এল ওরা। পাহাড় থেকে শুকনো ডাল এনে পথের ওপর বিছিয়ে, তার সামনে বড় বড় পাথর রেখে দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করল। এপাশটাতেও একই ভাবে প্রতিবন্ধক তৈরি করে দিল।
আবার গাড়িতে ওঠার পর রবিন বলল, একটা ফোন পেলেই রিপোর্ট করতে হবে।
বনে ঢাকা পাহাড়ের ঢালের নিচ দিয়ে প্রায় মাইলখানেক এগোনোর পর পথের ধারে একটা খামারবাড়ি চোখে পড়ল। নেমে গেল তিন গোয়েন্দা। লেটার বক্সে নাম লেখা: হুফার কট। দরজা খুলে দিলেন বাড়ির মালিক, সবে। খেতে বসেছিলেন, ঘণ্টা শুনে উঠে এসেছেন। খবরটা শুনে ফোনের দিকে। দৌড় দিলেন তিনি।
মিসেস কট বললেন, ওখানে বহুবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, পথের মোড়টার জন্যেই এমন হয়। একবার একটা গাড়ি স্পীড না কমিয়েই উঠে পড়েছিল ব্রিজে, আর সামলাতে পারেনি, রেলিং ভেঙে পড়ে গিয়েছিল, একজনও বাঁচেনি। তোমাদের ভাগ্য খুব ভাল, বেঁচে এসেছ?…এসো না, বসে যাও আমাদের সঙ্গে, খাও।
খুব ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান করল কিশোর। বলল, ওরা খেয়ে এসেছে, তা : ছাড়া পাশের শহরে নিলাম দেখতে যাচ্ছে। দেরি করলে গিয়ে আর পাবে না।
কটদেরকে গুডবাই জানিয়ে ফিরে এসে গাড়িতে উঠল ওরা।
পনেরো মিনিট পর সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল। তীর চিহ্ন এঁকে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে কোন দিকে যেতে হবে। বড় বড় অক্ষরে লেখা:
পশু নিলাম
একশো গজ সামনে।
বেশ কয়েকটা লাল রঙ করা বাড়ি আর খোয়াড়ের সামনে পার্কিঙের জায়গা। ওখানে গাড়ি রাখল মুসা। তিনজনেই নেমে এগোল উঁচু ছাতওয়ালা একটা বাড়িতে। সারি সারি বে রাখা। অনেক লোক বসে আছে ওগুলোতে। সামনের কাঠের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে ওয়েস্টকোট পরা একজন। রোগা টিংটিঙে লোক, শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক ভারি কণ্ঠে একটা বাদামী সাদা বাছুরের গুণগান করছে। বাছুরটাকে ধরে রেখেছে তার সহকারী।
এটা বড় জানোয়ারের জায়গা, কিশোর বলল। কুকুর অন্য কোন ঘরে।
আবার বেরোনোর দরজার দিকে এগোল তিন গোয়েন্দা। হঠাৎ কিশোরের হাত খামচে ধরল রবিন। একটা বেঞ্চে চাষীদের মাঝখানে বসে আছে লম্বা এক লোক। সতর্ক, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, পুরু গোফ। চওড়া কানাওয়ালা একটা হ্যাট মাথায়। গায়ে সুন্দর ছাঁটের স্পোর্টস জ্যাকেট।
চিনতে পারো? জিজ্ঞেস করল রবিন।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল মুসা ও কিশোর। চেনাই লাগছে।
হঠাৎ লম্বা মানুষটার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরে গেল ওদের দিকে। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল তিনজনেই। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চলে এল।
কর্নেল হুমবার মত লাগল না? রবিন বলল। এখানে কি করছে?
জবাব দিতে পারল না কেউ।
লম্বা, সরু একটা ঘরের ভেতর থেকে বিচিত্র কোলাহল আসছে। মুসা বলল, কুকুর ওটাতে।
ঢুকল ওরা! মুরগি, কুকুর, শুয়োর, ভেড়া, ছাগল, খরগোশের খাঁচায় বোঝাই এ ঘরটা। ঘরের শেষ মাথায় রয়েছে কুকুরের খাঁচা। বেশির ভাগ কুকুরই দেখা গেল শ্রমিক কিংবা শিকারী জাতের। পশু খেদানোর কোলি কুকুরগুলোর পাশ কাটিয়ে এল মুসা, এগোল লম্বা কান, কোমল, আকর্ষণীয় চোখওয়ালা হাউন্ডগুলোর দিকে।
হাউডই আমার পছন্দ, বলল সে। পছন্দ করতে শুরু করল, কোনটা নেব? কুন হাউন্ড? উই, বেশি বড়। ব্লাড হাউন্ড? বেশি গোমড়া। ব্যাসিট? মোটুকরাম, পা এত খাটো, মনে হয় জন্মদোষ।
সবারই তো এ দোষ না সে দোষ, মুচকি হেসে বলল রবিন। তাহলে নেবেটা কি?
শোনার অবস্থা নেই মুসার। কোণের দিকে হাত তুলে বলল, চলো তো ওগুলো দেখি?
এগারো-বারো বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ছয়টা নাদুসনুদুস বাচ্চা ঘুরঘুর করছে তার পায়ের কাছে।
বাহ, বিগলস, চওড়া কাঁধ, সেই তুলনায় খাটো পা আর চোখা লেজওয়ালা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে উঠল মুসা। হঠাৎ একটা বাচ্চা লাফাতে লাফাতে ছুটে এল তার কাছে। তার পায়ে গা ঘষতে লাগল। নিচু হয়ে হাত বাড়াতেই মা জিভ বের করে তার হাত চেটে দিল।
বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে হাসিমুখে বলল সে, এটাই নেব।
ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কত?
দশ ডলার।
নিলাম। মাব্যিাগ বের করুল কিশোর।
আবার তার বাহুতে হাত রাখল রবিন। তাকানোর ইঙ্গিত করল। ভেড়ার খাঁচার সামনে দেখা গেল সেই লোকটাকে, কর্নেল হুমবা। একটা ভেড়া দামদরকরছে।
তোমাদের সঙ্গে এসেছে? ছেলেটা জিজ্ঞেস করল।
না, জবাব দিল রবিন। তবে চিনি।
ওটা নিলে ঠকবে। এত বুড়োর বুড়ো, দাঁড়াতেই পারে না। এই পশু দিয়ে কি করবে?
আমিও তো সে-কথাই ভাবছি, বিড়বিড় করল কিশোর। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল, ভেড়া কিনতে এল কেন হুমবা? পুমাকে খাওয়াবে?
গাড়িতে উঠল ওরা। থরথর করে কাঁপছে কুকুরের বাচ্চাটা। রবিনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, সেরে যাবে। এই প্রথম ভাইবোনদের কাছ থেকে সরে এল তো, ভয় পাচ্ছে। কোলে নিয়ে ওটাকে আদর করল সে।
গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসল এবার রবিন। কিশোর, কেবিনে ফিরে যাব?
হ্যাঁ।
গাড়ি চালাল রবিন। কাঁচা এবড়োখেবড়ো রাস্তাটা ধরে কয়েক মাইল এগোনোর পর খেয়াল করল ব্যাপারটা, আরি, গাধা নাকি! এই রাস্তা দিয়ে চলেছি কেন? ব্রিজ না ভাঙা?
অন্যমনস্ক হয়ে ছিল কিশোর। চমকে গিয়ে বলল, তাই তো! আমিও খেয়াল করিনি!
আর মুসা তত কুকুরের বাচ্চাটাকে নিয়েই ব্যস্ত, রাস্তার দিকে তাকায়নি সে।
কয়েক মিনিট ধরে ম্যাপ দেখল কিশোর। বলল, আবার ফিরে যেতে হবে। যেখানে নিলাম হচ্ছে সেখান থেকে আরেকটা রাস্তা গেছে ব্ল্যাক হোলোর দিকে। চলো।
দূর, গাধার মত কাজ করলাম!
নতুন রাস্তাটা আগেরটার মত অত খারাপ না। প্রায় সাতটা বাজে। এখনও সূর্য আছে, কিন্তু বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বেশ আরাম। রাস্তায় যানবাহনের ভিড়। বেশ কিছু গাড়ি কেবল একটা দিকেই চলেছে।
যাচ্ছে কোথায় ওরা? কিশোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল রবিন। প্রতিটি গাড়িতেই তো মনে হচ্ছে ফুল ফ্যামিলি। সেজেগুঁজে বেরিয়েছে।
মোড় নিতেই কিশোর বলল, ওই যে তোমার জবাব।
বাতাসে ভেসে এল মিউজিক। আরও এগোতে চোখে পড়ল সারি সারি তাঁবু। হ্যারিজ কার্নিভাল নতুন জায়গায় খেলা দেখাতে এসেছে।
ভাল, খুশি হয়ে বলল মুসা, থামব এখানে। আবার পপকর্ন আর পানাট খেতে ইচ্ছে করছে।
থামো!
অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা, তোমারও ওসব খেতে ইচ্ছে করছে!
না। পুমার খেলা আবার দেখতে ইচ্ছে করছে।
রবিন বুঝে গেল, খেলা দেখাটা আসল ব্যাপার নয়, অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে কিশোরের। কিছু জিজ্ঞেস করল না। গাড়ি রাখল পার্কিঙের জায়গায়। তিনজনে নেমে এগোল পুমার তাঁবুর দিকে। দলে এখন আরও একজন আছে, মুসার বাহুতে গুটিসুটি হয়ে থাকা কুকুরের বাচ্চাটা।
যাচ্ছি তো, বলল মুসা, কিন্তু খেলা দেখাবে কে? হুমবাকে তো দেখে এলাম নিলামের জায়গায়।
এতক্ষণে নিশ্চয় চলে এসেছে, রবিন বলল। উল্টো দিকে গিয়ে সময় নষ্ট করলাম না আমরা।
চলে তো এসেছেই, তিন গোয়েন্দা যখন তাঁবুতে ঢুকল, দেখল খেলাও আরম্ভ হয়ে গেছে। আগের বারের মতই টাইট পোশাক পরেছে হুমবা। সাদা খেলা দেখানোর পোশাকে কিছুটা অন্য রকম লাগছে তাকে, একটু আগে নিলামের জায়গায় যাকে দেখে এল ওরা, তার চেয়ে যেন সামান্য আলাদা। কঠিন শাসনে রেখেছে ভয়ঙ্কর জানোয়ারগুলোকে। তেমনি ঘৃণা দেখা যাচ্ছে ওগুলোর চোখে।
খেলা শেষ হলে, দর্শকরা যখন বেরোনোর গেটের দিকে হুড়াহুড়ি করে এগোল, কিশোর তখন দুই সঙ্গীকে নিয়ে চলল পুমাগুলোকে কাছে থেকে দেখতে। অল্পবয়েসী জানোয়ার, তেল চকচকে শরীর, খাওয়ার কষ্ট পায় না। বোঝা গেল।
আরেকটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে খাঁচার কাছে দাঁড়াল কর্নেল হুমবা।
দারুণ জানোয়ার পোষেণ, হেসে খাতির করার ভঙ্গিতে বলল কিশোর। কী খেতে দেন?
কাঁচা মাংস, কসাইয়ের দোকান থেকে আনা। শান্তকণ্ঠেই জবাব দিল কর্নেল, তবে কিছুটা অন্যমনস্ক, তাড়াহুড়ো করে সরে গেল ওখান থেকে।
কিন্তু তাকে আমরা ভেড়া কিনতে দেখেছি! ব্ল্যাক হোলোর দিকে আবার গাড়ি চালাতে চালাতে বলল রবিন। পুমাকে খাওয়াতে যদি কিনে থাকে, বলল না কেন?
কেবিনে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নটা বেজে গেল। সূর্য ডুবে গেছে, বনের মধ্যে অন্ধকার, কিন্তু আকাশ এখনও পুরোপুরি কালো হয়নি, কেমন একধরনের উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে।
ছেলেরা আশা করল, এইবার কেবিনে ঢুকে গৃহকর্তাকে দেখতে পাবে। কিন্তু নীরব হয়ে রইল বাড়িটা। কেউ বেরিয়ে এল না ওদের স্বাগত জানাতে। ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর তার নোটটা পড়ে থাকতে দেখল কিশোর। ফেরেননি ক্যাপ্টেন রিচটন।
হলো কি তার? উদ্বেগে ফেটে পড়ল রবিন, খুঁজে বের করতেই হবে, যত জলদি পারা যায়!
হঠাৎ হাত তুলল কিশোর, শোনো, গাড়ি!
ক্যাপ্টেন এসেছেন মনে করে দরজার কাছে দৌড়ে এল ছেলেরা। খোলা জায়গায় ঢুকেছে গাড়িটা, সব আলো নেভানো, কেবল পার্কিং লাইট জ্বলছে। মোটাসোটা, খাটো একজন মানুষ নামল। পরনে বিজনেস স্যুট। দড়াম করে। দরজা লাগিয়ে গটমট করে এসে দাঁড়াল ওদের সামনে।
রিচটন কোথায়? খসখসে কণ্ঠস্বর, অধৈর্য ভাবভঙ্গি।
তিনি নেই, জবাব দিল কিশোর।
নেই? কোথায় গেছে?
জানি না। এলে কিছু বলতে হবে?
আমি টাকা পাই ওর কাছে। দেয় না কেন?
এলে বলব। আপনার নামটা?
অ্যাঁ?.. হুগারফ। আর্নি হুগারফ। বললেই হবে ওকে, চিনবে। আমি ফরেস্টবার্গের অ্যাটর্নি।
অ্যাটর্নি? এক পা এগোল কিশোর, মনে হয় আপনি জানবেন, মিস্টার হুগারফ: ব্ল্যাক হোলোর মালিকের নাম কি? আরিগন?
হ্যাঁ। একটা সামার কটেজ ছিল এখানে ওদের, আগুন লেগে ছাই হয়ে গেছে। চলে গেল সব। তারপর আর কোন হুগারফকে দেখিনি।
ডাইনীর গল্প আপনি বিশ্বাস করেন? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল কিশোর।
প্রশ্নটায় যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অ্যাটর্নি। তিনজনের ওপর ঘুরতে লাগল চোখ। তারপর বলল, কিসের ডাইনী! ওই গর্তটাই যত নষ্টের মূল। অদ্ভুত প্রতিধ্বনি তোলে। ওই ধারটা তত কয়েক মাইল দূরে, কিন্তু ওখানে গিয়ে চিৎকার করলেও এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যাবে।
তাই নাকি! আচ্ছা, ক্যাপ্টেন রিচটন এলে আপনার কথা বলব।
গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই মুসা বলল, লোকটাকে একবিন্দু পছন্দ হয়নি আমার। কেমন খটখট করে কথা বলে দেখেছ?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমি এখনই পরীক্ষা করে দেখব। কয়েক মাইল দূর থেকে শোনা যায়, এ কথা বিশ্বাস হয় না আমার। গাড়ি নিয়ে হোলোর অন্যপাশে চলে যাচ্ছি। বাতাস এখন এদিকে বইছে। গিয়ে চিৎকার করব, দেখো, তোমরা শোনো কিনা। ওখানে পৌঁছে হেডলাইট জ্বেলে-নিভিয়ে সঙ্কেত দেব।
বারান্দা থেকে নেমে গেল সে।
.
০৭.
ব্ল্যাক হোলোর কিনারে এসে দাঁড়াল মুসা আর রবিন। অন্ধকার হয়ে গেছে। খানিক পর দেখতে পেল দুটো উজ্জ্বল আলো এগিয়ে যাচ্ছে গর্তের অন্য প্রান্তের দিকে। প্রায় দুই মাইল দূরে।
ওটাই কিশোর, দূরবীন চোখে লাগাতে লাগাতে বলল রবিন। কিছুক্ষণের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেল আলোটা। তারপর আবার দেখা গেল, জ্বলছে নিভছে, জ্বলছে নিভছে।
আমাদের দিকে গাড়ি ঘুরিয়েছে কিশোর, আবার বলল রবিন।
চিৎকার শোনার জন্যে কান খাড়া করে রাখল দুজনে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে শোনার চেষ্টা করল। গাড়িটার দিক থেকে এসে গালে পরশ বোলাচ্ছে বাতাস, কিন্তু কোন শব্দ শোনা গেল না। স্থির হয়ে গেল আলো দুটো, ঘুরল, তারপর আবার চলতে আরম্ভ করল। ফিরে আসছে কিশোর।
কেবিনে ফিরে জানাল সে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছি। হর্নও বাজিয়েছি।
আমরা কিছুই শুনিনি, রবিন বলল।
হ্যাজাক লাইট জ্বেলে রান্নার জোগাড় করছে মুসা।
টেবিলে কনুই রেখে কুটি করল কিশোর। কই, তেমন কোন প্রতিধ্বনিইতো হয় না হোলোতে। তারমানে হুগার মিথ্যে কথা বলেছে। কেন?
কিছু ঢাকার চেষ্টা করছে না তো? রবিনের প্রশ্ন। লুকাচ্ছে কিছু?
ক্যাপ্টেন রিচটন যে নিখোঁজ হয়েছে, কাজ করতে করতে বলল মুসা, এ কথা কিন্তু জানে না।
বলা যায় না, ভানও হতে পারে তার। হয়তো এসেছিল আমরা কতখানি জানি, জানার জন্যে।
একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ডাইনীর চেয়েও রহস্যময় কিছু একটা ঘটছে এখানে। ক্যাপ্টেনের ভাগ্যে খারাপ কিছুই ঘটেছে। কাল আবার খুঁজতে বেরোব।
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠার সিদ্ধান্ত নিল ওরা। তাই কুকুরটাকে টোপ হিসেবে বাইরে রেখে জেগে থাকার চিন্তাটা বাদ দিল সে-রাতের জন্যে। ঘুমানো দরকার।
কিন্তু ঘুম আসতে চাইল না। তিনজনেই কান পেতে আছে ডাইনীর। চিৎকার শোনার আশায়। চোখ লেগে এসেছিল, মাঝরাতে তন্দ্রা টুটে গেল তীক্ষ্ণ চিঙ্কারে।
ব্ল্যাক হোলোর নিচ থেকে উঠে এল যেন চিৎকারটা, আগের দিনের চেয়ে অন্যরকম। লম্বা, তীক্ষ্ণ, কাঁপা কাঁপা। গোঙাতে শুরু করল বাচ্চাটা, কাঁপছে। ভয়ে।
আজকেরটা আরেক রকম কেন? মুসার প্রশ্ন।
হঠাৎ হাসতে শুরু করল রবিন।
এত হাসির কি হলো! রেগে উঠল মুসা। দেখছ না, কুত্তাটাও ভয় পেয়েছে?
পাবেই তো, হাসতে হাসতে বলল রবিন। যে ডাকছে সে যে তার শত্রু। কুকুরের বাচ্চার অনেক শত্রু থাকে। ডাইনী নয় ওটা, বুঝলে, পেঁচার ডাক। অনেক বড় পেঁচা।
পেঁচা! ওরকম করে ডাকে নাকি?
ডাকে। অনেক জাতের পেঁচা আছে। একেকটার ডাক একেক রকম।
বাংকে উঠে বসল মুসা। তোমার ধারণা এটা পেঁচার ডাক? আর কিছু না?
মাথা ঝাঁকাল রবিন। না আর কিছু না। তবে কাল রাতে যেটা ডেকেছিল সেটা পেঁচা ছিল না। মুসাকে ভয় দেখানোর জন্যে বলল, পেঁচাকে কিন্তু অশুভ পাখি বলা হয়, ডাইনী আর ভূতের সঙ্গে নাকি সম্পর্ক আছে ওদের।
আহ, রাত-বিরেতে ওসব অলক্ষুণে কথা বোলো না তো!
এসব রসিকতার মধ্যে গেল না কিশোর, বলল, পেঁচা কিন্তু কুত্তা চুরি করতে পারে না, রবিন।..রাত দুপুরে ওসব আলোচনা থাক। এসো, ঘুমাই। কাল ভোরে উঠতে হবে।
.
খুব ভোরে উঠল ওরা। কুয়াশা পড়ছে ঘন হয়ে। বিষণ্ণ, ধূসর আলো। রোদের দেখা নেই। নাস্তা খাওয়া শেষ করে স্যান্ডউইচ বানাতে বসল মুসা। সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। যাতে খিদের জন্যে কাজের অসুবিধে না হয়।
কিশোর অপেক্ষা করতে লাগল শেরিফের লোকের জন্যে।
ঘণ্টাখানেক পর জোরাল বাতাস এসে হঠাৎ করেই সরিয়ে নিয়ে গেল। কুয়াশা। রোদ উঠল। ঝলমল করে হেসে উঠল যেন প্রকৃতি। মুহূর্তে দূর করে দিল সমস্ত বিষণ্ণতা।
ওরা আসবে না, বলল কিশোর। চলো, আমরা বেরিয়ে যাই। বসে থাকার মানে হয় না। আগে মিস্টার আরিগনকে খুঁজে বের করব।
কেবিনের দরজা খোলা দেখে একছুটে বেরিয়ে যেতে চাইল কুকুরের বাচ্চাটা, কিন্তু হ্যাঁচকা টান লেগে আটকে গেল। দড়ির একমাথা তার গলায় বাধা, আরেক মাথা মুসার হাতে ধরা। পিঠে বাঁধা একটা ব্যাগ। এই ফগ,. জোরাজুরি করিসনে। ব্যথা পাবি।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল রবিন। ফগ? বাচ্চাটার নাম রাখলে নাকি?
হ্যাঁ, সকালে কুয়াশা দেখেই নামটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ।
ভাল। বেশ ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে একটা ভাব আছে।
কেবিনের পাশের খাড়া সেই পথটা ধরে আবার নিচে নামতে শুরু করল। গোয়েন্দারা। আগের দিনের মতই নিথর, নীরব হয়ে আছে চারপাশের বন। ওর মধ্যে যাওয়ার ইচ্ছে এমনকি কুকুরটারও নেই, প্রজাপতি কিংবা ফড়িঙ খুঁজতেও নয়।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিলোর। নিচু স্বরে বলল, কালকের মতই অনুভূতি হচ্ছে! মনে হচ্ছে কেউ পিছু নিয়েছে আমাদের।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান পেতে রইল তিনজনে। কিন্তু কিছুই শোনার নেই। আবার হাঁটতে লাগল ওরা। নিজেদের অজান্তেই যেন চলে এল সেই ঘরটার কাছে। দরজায় থাবা দিল কিশোর।
সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। দেখা দিল একজন লম্বা, চওড়া কাঁধ, ভারি ভুরু, পুরু গোঁফওয়ালা নোক। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল গোয়েন্দাদের দিকে।
মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল রবিনের, কর্নেল হুমবা!
কর্নেল? ভারি কণ্ঠস্বর মানুষটার। জীবনেও কখনও আর্মিতে ছিলাম না, ওই র্যাঙ্ক পাব কি করে?
তারমানে, তোতলাতে শুরু করল মুসা, আ-আপনি বলতে চাইছেন, আপনি কর্নেল ডুম হুমবা নন? অ্যানিমেল ট্রেনার?
ভারি গলায় হাহ হাহ করে হাসলেন তিনি। ওসব কিছুই না আমি। আমি অতি সাধারণ ডোবার আরিগন।
হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোর। সাধারণ পোশাকে আবার কিছুটা অন্যরকম লাগছে তাকে, ভেড়া কেনার সময় যেমন লেগেছিল। বলল, মিস্টার হুম…সরি, আরিগন, আপনাকেই খুঁজছি আমরা। ক্যাপ্টেন রিচটন নামে একজনের ওখানে বেড়াতে এসেছি, কিন্তু তাকেই পাচ্ছি না। দুই রাত ধরে। তিনি নিখোঁজ।
হাসিখুশি মুখটা মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল আরিগনের। এসো, ভেতরে এসো।কুত্তাটাকে আনার দরকার নেই, বাইরে রেখে এসো।
ছোট একটা ঘরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। পুরানো কয়েকটা চেয়ার আর একটা টেবিল আছে। আরিগন বললেন, দরজাটা খোলা রাখো, নইলে অন্ধকার লাগবে। তোমরা বসো, আমি আসছি। মাথা নুইয়ে নিচু একটা দরজা দিয়ে ওপাশের রান্নাঘরে চলে গেলেন। বালতি নড়ার শব্দ হলো, দরজা বন্ধ হলো যেন একটা, তারপর ফিরে এলেন তিনি।
হ্যাঁ, বলো এবার। ক্যাপ্টেন রিচটন কে, তার কি হয়েছে, সব শুনতে চাই।
আগে নিজেদের পরিচয় দিল ছেলেরা। তারপর রবিন জানাল, তিনি আমাদের একজন বন্ধুর বন্ধু। আমরা চিঠি দিয়েছিলাম, আসছি। কিন্তু এসে দেখি তিনি নেই। একেবারে উধাও। এই হোলোতে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। তার ভাঙা টর্চটা পেয়েছি বনের মধ্যে, আর দুটো শটগানের গুলির খোসা। তিনিই ফায়ার করেছেন সম্ভবত।
হ্যাঁ, আরিগন বললেন, সেদিন রাতে গুলির শব্দ শুনেছি। প্রথমে ভাবলাম কেউ শিকার করতে এসেছে। এখানে কেবল কুন শিকারের অনুমতি আছে, আর কুন শিকার করতে কুকুর সঙ্গে আনে শিকারীরা। কিন্তু কুকুরের ডাক শুনলাম না। তখন ভাবলাম চুরি করে হরিণ মারতে ঢুকেছে কেউ। নাহ্, তোমাদের বন্ধুর কথা জানি না, কি হয়েছে বলতে পারছি না। সরি।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, আরেকটা কথা কি বলতে পারবেন? এখানে নাকি কুত্তাও হারিয়ে যাচ্ছে। বনের মধ্যে কোনটাকে একা একা ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন?
না, দেখিনি, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন আরিগন। কুত্তা হারাচ্ছে, সেটা কুত্তা চোরের কাজ হতে পারে। এদিকে কুকুর বিক্রির একটা চোরাই মার্কেট আছে। ওখান থেকে কারা কেনে জানো, ডাক্তারের দালালেরা। কিছু কিছু ডাক্তার কুকুরকে গিনিপিগ বানিয়ে গবেষণা করে, বড়ই নির-অবলা জানোয়ারের ওপর এই অত্যাচার, ধরতে পারলে মজা দেখাতাম–
কাল একটা লোককে দেখলাম, আমাদের ওপর নজর রাখছে। এক্কেবারে বুনো মনেহলো। পিছু নিয়েছিলাম, ধরতে পারুলাম না, পালাল।
হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি সাহায্য করতে পারি, একটা আঙুল তুললেন আরিনি। ওর নাম পিচার। বোবা। আর লোক কোথায় দেখলে, বয়েস তো বেশি না। পাশের উপত্যকায় থাকে ওর বিধবা মায়ের সঙ্গে। জন্ম থেকে বোবা নয় সে, কানে শোনে, একটা দুর্ঘটনায় কণ্ঠনালীতে ব্যথা পেয়ে বাকশক্তি হারিয়েছে। সারাটা গরমকাল বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। বুনো ফলমূল আর আশপাশের খামার থেকে চেয়েচিন্তে যা জোগাড় করতে পারে, খায়।
বিপজ্জনক? প্রশ্ন করল মুসা, মানে, ওর কাছ থেকে বিপদের ভয় আছে?
আমি ওকে এড়িয়েই চলি। কিছু হলেই পাথর ছুঁড়ে মারে, হাতের নিশান বড় সাংঘাতিক, বন্দুকের গুলিকেও হার মানায়। কুর্তগুলোকে সে-ও নিয়ে যেতে পারে। জন্তু-জানোয়ার, পাখি, এসবে ওর ভীষণ আগ্রহ।
আশ্চর্য জায়গায় মানুষ এখানে বুনো হয়ে ঘুরে বেড়ায়, রাতে ডাইনী এসে চিৎকার শুরু করে অবাক কাণ্ড না?
চোখের তারায় হাসি ফুটল আরিগনের। ডাইনী-ফাইনী আমি বিশ্বাস করি না। তবে রাতে চিৎকারটা ঠিকই শুনি। লোম খাড়া করে দেয়।
রান্নাঘরে পুটপুট শব্দ হলো। লাফিয়ে উঠলেন আক্লিান, আমার কফির পানি পড়ে যাচ্ছে! এসো না তোমরা, রান্নাঘরেই চলে এসো।
প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে নিচু দরজাটা পেরিয়ে অন্যপাশে এসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। জানালাবিহীন ছোট একটা ঘর, দুটো লণ্ঠন জ্বলছে। ঠাণ্ডার সময় ঘর গরম রাখার জন্যে ছোট একটা স্টোভ আছে। চুলায় কফির পানি ফুটছে। কেটলি থেকে কাপে কফি চলতে গেলেন আরিগন।
আমি এখানে ক্যাম্প করেই আছি বলতে পারো, বললেন তিনি। ছোট একটা টেবিল ঘিরে বসেছে সবাই। এখানে বিশ্রাম নিতে আসি। ইচ্ছে হলে ভেড়াটেভা পালি। খুব শান্তির জায়গা।
তা বটে, স্বীকার করল মুসা। একেবারেই নিরিবিলি।
আরও একটা ব্যাপার, পাগলামিও বলতে পারো। সন্ন্যাসীরা কেমন করে বাস করে, একা থাকতে কেমন লাগে তাদের, জানার খুব আগ্রহ আমার। সে জন্যেই এখানে এসে নিজের ওপরই পরীক্ষা চালাচ্ছি। এ ছাড়া জানার আর তো কোন উপায় নেই।
এই কেবিনটা আমার খুব পছন্দ। আশপাশটা কি চমৎকার দেখেছ? পেছনের দেয়াল একেবারে অরিজিন্যাল, নকল-টকল নয়। নিরেট পাথর। এই কেবিনটাও অনেক পুরানো, একশো বছরেরও বেশি। সে-সময় কি ঘটছিল এই এলাকায়, জানো?
স্মৃতি ঘেঁটে তথ্য বের করার চেষ্টা চালাল রবিন, সে-সময়? নিশ্চয় গৃহযুদ্ধ চলছিল। তাই না?
হ্যাঁ। পড়ালেখা করো তুমি, বোঝা যাচ্ছে। তখন এটা ছিল স্মাগলারদের একটা ঘাটি। মানুষ চোরাচালান করত ওরা। পালিয়ে আসা গোলামরা লুকিয়ে থাকত এখানে, তারপর তাদের পাচার করে দেয়া হত কানাডায়। এ জন্যেই এত লুকোছাপা, পাহাড়ের দেয়াল ঘেষে তৈরি, জানালা নেই, রাতে ঘরের ভেতর থেকে বাইরে আলো যাওয়ারও পথ নেই। জায়গাটা ছোট হতে পারে, কিন্তু খুব নিরাপদ, আরামদায়কও বটে।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে আর ভাবছে কিশোর: বিচিত্র এই ছোট্ট কেবিনটাতে মাত্র একটা দরজা, সামনেরটা; তাহলে কোন গোলাম যদি এসে লুকিয়ে থাকে এখানে, তারপর দেখে তাকে ধরতে আসা হচ্ছে, পালাবে কোন পথে? এমন একটা জায়গায় কি লুকাতে চাইবে ওরা যেখান থেকে পালানোর গোপন পথ থাকবে না? তা ছাড়া খানিক আগে যে আরেকটা দরজা লাগানোর আওয়াজ শুনল, সেটা কি সত্যি শুনেছে, না তার কল্পনা?
ঠিক এই সময় থাবা পড়ল সামনের দরজায়।
.
০৮.
দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে রোদ আসা আটকে দিল একটা মোটাসোটা শরীর। লম্বা মানুষটাকে দেখে বললেন, মর্নিং, মিস্টার আরিগন। অনুমতি না নিয়েই ঢুকে পড়লাম, সরি। আপনার সাহায্য দরকার আমাদের।
রান্নাঘর থেকে বাইরের ঘরে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। গলা শুনেই চিনতে পেরেছিল আগন্তুককে, শেরিফ টোনার। ওদের দেখে বলে উঠলেন, ও, তোমরা আগেই চলে এসেছ। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরও তিনজন। লোক। এই যে, তোমাদের সার্চ পার্টি নিয়ে এলাম। তিনজনের বেশি। পারলাম না, এই দিয়েই কাজ চালাতে হবে। তবে তোমরা তিন, মিস্টার আরিগন, আর আমরা মিলে আটজন হয়ে যাচ্ছি, কম না, কি বলো? একটা কুত্তা থাকলে আরও ভাল হত।
আছে, মিস্টার টোনার, মুসা জানাল। আমাদের ফগ।
কালই কিনলাম বিগলের বাচ্চাটা, রবিন বলল।
সার্চ পার্টি কেন, শেরিফ? জানতে চাইলেন আরিগন, সিরিয়াস কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে?
দ্রুত একবার আরিগনের হাসি হাসি মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন শেরিফ, কেন, ছেলেরা কিছু বলেনি আপনাকে?
বলেছে। ওদের এক ক্যাপ্টেন বন্ধুর নাকি খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমার ধারণা, বনের মধ্যে লম্বা সফরে বেরিয়েছে। সার্চ পাটি নিয়ে খোদ শেরিফ এসে হাজির হয়ে যাবেন তাকে খুঁজতে, এতটা সিরিয়াস ভাবিনি, হেসে কথাটা শেষ করলেন আরিগন।
ভ্রূকুটি করলেন শেরিফ-যেন বলতে চাইছেন, আরও কত জরুরী কাজ ফেলে এসেছি সেটা তো জানেনই না! কিন্তু বললেন না। কিশোর আর রবিন বুঝতে পেরে চট করে তাকাল পরস্পরের দিকে। ঘাবড়ে গেল, মত বদলে শেষে না খোঁজা বাদ দিয়েই চলে যান।
কিন্তু তা করলেন না তিনি, শান্তকণ্ঠে বললেন, মিস্টার আরিগন, এই এলাকা সবচেয়ে ভাল চেনেন আপনি, আপনার সাহায্য পেলে খুশি হব।
নিশ্চয় করব। খুঁজতেই যখন এসেছেন, আমার এই ঘরটা থেকেই শুরু হোক। কারণ একসময় লুকানোর জায়গা হিসেবেই ব্যবহার করা হত এটাকে। আপনি আসার আগে ছেলেদের এই গল্পই শোনাচ্ছিলাম।
শেরিফকে রান্নাঘর দেখাতে নিয়ে গেলেন আরিগন, ছেলেরা বাইরের ঘরে অপেক্ষা করতে লাগল। চুপ করে বসে না থেকে তিনজন ডেপুটির সঙ্গে পরিচয়ের পালাটা শেষ করে ফেলল ওরা।
বাচ্চাটা কি করছে দেখার জন্যে বাইরে বেরোল মুসা। ভেড়ার খোয়াড়ের কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে ওটা। ওটাকে ডেকে ফিরিয়ে আনতে যাবে, হঠাৎ চোখ পড়ল ঘাসের ওপর। কি যেন একটা চকচক করছে। তুলে নিয়েই থমকে গেল, কুঁচকে গেল ভুরু। রেখে দিল পকেটে।
শেরিফ আর অন্যদের নিয়ে ঘর থেকে বেরোলেন আরিগন। মাথায় নরম হ্যাট। সামনের দিকটায় উজ্জ্বল রঙের একটা প্লাস্টিকের প্রজাপতি বসানো। ছেলেদের দেখিয়ে দেখিয়ে লম্বা নলওয়ালা, কারুকাজ করা সাদা বাঁটের একটা পিস্তল জলেন কোমরের বেল্টে, যেন খুব মজা পাচ্ছেন। হেসে বললেন, জীবনে কখনও ডেপুটি হওয়ার সুযোগ পাইনি।
সার্চ পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে নিলেন তিনি। তাঁর নির্দেশিত পথেই চলতে লাগল সবাই।
কিছুদূর এগিয়ে মুসাকে বললেন, কুত্তাটাকে নিয়ে তুমি আগে আগে থাকো। গন্ধেই অনেক কিছু বুঝতে পারবে ওটা। সবার উদ্দেশ্যে জ্ঞান। বিতরণ করলেন, দুই ধরনের তরাই আছে ব্ল্যাক হোলোতে, নিচে বন, আর ঢালের গায়ে পাথর। প্রথমে বনে ঢুকব আমরা, সেখানে কিছু না পেলে পাথুরে এলাকায় খুঁজতে যাব।
সবাইকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন শেরিফ। প্রতিটি লোক তার ডান পাশের লোককে নজরের মধ্যে রাখবে। তাহলে দলছুট হয়ে পড়ার ভয় থাকবে না কারও।
ফগকে নিয়ে মুসা রইল দলটার ঠিক মাঝখানে। সারির বা প্রান্তের শেষ লোকটি হলেন শেরিফ, ডান প্রান্তে কিশোর। তার পাশের লোকটি রবিন। মুসার পাশে আরিগন। ঘন বনে ক্যাপ্টেন রিচটনের খোঁজ চালাল সার্চ পার্টি।
লতায় ছাওয়া ঝোপঝাড়, স্বল্প আলো, আর ঘন হয়ে জন্মানো বড় বড় গাছ বাধা দিয়ে কঠিন এবং ধীর করে তুলল খোঁজার কাজ।
শেরিফ! চিৎকার করে বললেন আরিগন, আপনার সামনে একটা খাত পড়বে। ওটাতে ভাল করে দেখবেন। হাড়গোড় ভেঙে ওতে পড়ে থাকতে পারেন ক্যাপ্টেন।
এক মিনিট পরেই জবাব এল, নেই এখানে।
খানিক পরে রসিকতার সুরে কিশোরদের বললেন আরিগন, তোমাদের সামনে একটা বড় গাছ পড়বে। তাতে মস্ত ফোকর। ভাল করে দেখো, ওর মধ্যে লুকিয়ে বসে আছেন কিনা তোমাদের বন্ধু।
আরিগন ব্যাপারটাকে এত হালকা ভাবে নিয়েছেন দেখে রাগ হতে লাগল কিশোরের। রবিনেরও ভাল লাগছে না এ ধরনের আচরণ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাটি আর আশপাশের সব কিছু দেখতে দেখতে চলেছে দু-জনে। মূসা আর ফগও খুব সতর্ক।
বিষণ্ণ বনের মধ্যে চলল একঘেয়ে খোঁজার কাজ। হঠাৎ কোন কিছু চমকে দিল ফগকে, সামনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার শুরু করল।
মানুষ! চেঁচিয়ে বলল মূসা, একটা লোক পড়ে আছে!
দুই পাশ থেকে দৌড়ে এল সবাই। হাত তুলে দেখাল-মুসা। সবাই দেখল, আবছা অন্ধকার বনের মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে কালো কোট, কালো টুপি আর ধূসর ট্রাউজার পরা একটা দেহ।
সবার আগে ছুট লাগাল ফগ। তার পেছনে দৌড় দিল সবাই। পড়ে থাকা দেহটার কাছে আগে পৌঁছল তিন গোয়েন্দা।
দূর! মানুষ কোথায়? হতাশ কণ্ঠে বলে উঠল রবিন, ক্যাপ্টেনের লাশ দেখতে হয়নি বলে খুশিও হয়েছে, এ তো গাছ!
রসিকতা করে ফগকে বললেন আরিগন, কেমন কুত্তারে তুই? গাছকে মানুষ ভেবে বসিস?
কিন্তু সে যে মানুষ ভেবে চিৎকার করেনি তার আচরণেই বোঝা গেল। ছোঁক ছোঁক করছে গাছটার কাছে। নাক নামিয়ে শুকছে। ইঁদুর বা বেজি জাতীয় কোন প্রাণীর গন্ধ পেয়েছে মনে হয়, খোড়লে ঢুকে পড়েছে ওটা।
ওর আর দোষ কি? আমরাও তো ভেবেছি, মুখ কালো করে বলল একজন ডেপুটি। নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল অন্য দুজন।
দূর থেকে কিন্তু এক্কেবারে মানুষ মনে হয়েছে, কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল মুসা। এমন একটা ভুল করাতে লজ্জা লাগছে তার।
শেরিফ বললেন, থামি এখানে। একটু জিরিয়ে নিই।
খুশিমনে ব্যাগ খুলে খাবার বের করতে লাগল মুসা। হাতে হাতে তুলে দিল টিউনা মাছ, ডিমের সালাদ, আর ভেড়ার মাংস ও পনিরে তৈরি স্যান্ডউইচ। যে গাছের গুঁড়িটা বোকা বানিয়েছে ওদের, তার ওপর বসেই চিবাতে লাগল তিন ডেপুটি। নিচে বসল তিন গোয়েন্দা ও শেরিফ। খানিক দূরে একটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে বসেছেন আরিগন।
ঘড়ি দেখে মুখ বাকিয়ে শেরিফ বললেন, এখন যে দুপুর, বনের মধ্যে এই অন্ধকার দেখলে কে বিশ্বাস করবে!
খাওয়ার পর আবার উঠে আগের মতই ছড়িয়ে গেল দলটা। আবার চলল খোঁজা। বিকেল নাগাদ বনে ছাওয়া উপত্যকার নিচেটা পুরো দেখা হয়ে গেল। পাওয়া গেল না কিছু। বন থেকে বেরোতে সামনে পড়ল হোলোর পাথুরে দেয়াল।
ওই যে ওখানে একটা গুহা আছে, হাত তুলে একটা পাথরের চাঙড় দেখিয়ে বললেন আরিগন। ওর মধ্যে পড়ে থাকলে অবাক হব না। গোয়েন্দাদের বললেন, তোমরা যাও। উঠে গিয়ে দেখো। আমি পেছনেই আছি। পা-টাতে যে কি হলো আজ, চাপই দিতে পারছি না।
তরতর করে উঠে যেতে লাগল রবিন। তার পেছনে মূসা, সবশেষে কিশোর। কিছুদূর উঠেই গুহার কালো মুখটা নজরে এল। পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা শৈলশিরা। খাড়া ঢাল থেকে ওটার ওপর সবে নিজেকে টেনে তুলেছে রবিন, এই সময় শাঁ করে কি যেন একটা চলে গেল তার কানের পাশ দিয়ে।
খবরদার! তোমার ওপরে! নিচ থেকে চিৎকার করে উঠলেন আরিগন।
একের পর এক পাথর ছুটে আসতে লাগল ছেলেদের দিকে। কিন্তু। কোনটাই গায়ে লাগল না। অল্পের জন্যে মিস হতে লাগল। মুখ তুলে ওরা দেখল, লম্বা, পাতলা একটা মূর্তি উঁকি দিয়ে আছে দেয়ালের একেবারে কিনার থেকে। পাথরগুলো সে-ই ছুড়ছে।
পিচার! ও-ই পিচার! আবার চিৎকার করে উঠলেন আরিগন।
মুঠো পাকিয়ে ওপর থেকে হাত ঝাঁকাতে লাগল বোবা ছেলেটা। কিশোরের মনে হলো, কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। সরে যেতে বলছে যেন।
ওপরে উঠতে মানা করছে আমাদের, রবিন বলল। কে শোনে তার কথা! আমরা উঠবই, দেখি কি করতে পারে!
পাথর ছুঁড়েও ঠেকাতে না পেরে যেন হাল ছেড়ে দিল ছেলেটা। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
গর্তের কাছাকাছি চলে এসেছে রবিন আর মুসা। কিনারে এসে ভেতরে তাকিয়েই থমকে গেল। ধড়াস করে উঠল বুক।
মাত্র তিনফুট দূরে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে মারাত্মক বিষাক্ত একটা র্যাটল স্নেক। ছোবল হানতে প্রস্তুত। চোখের পলকে পাথরের আড়াল থেকে ওটার কাছে চলে এল আরও দুটো সাপ। উদ্দেশ্য ওগুলোরও ভাল না!
.
০৯.
ঝট করে যে পিছিয়ে যাবে ওরা, তারও উপায় নেই, শৈলশিরাটা এতই সরু। আটকে দিয়েছে ওদেরকে ভয়াবহ সরীসৃপগুলো। খাড়া ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে সরে যাওয়া যাবে না, তার আগেই ছোবল খেতে হবে। তাড়াহুড়ো করতে গেলে আরও বিপদ আছে, হাত ফসকে যেতে পারে, তাহলে আছড়ে পড়তে হবে অনেক নিচের পাথরে। ভাল বিপদেই পড়া গেছে! ওদিকে লেজের খড়খড় আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসছে অন্য দুটো সাপ। যে কোন মুহূর্তে কামড়ে দেবে।
বিপদ থেকে উদ্ধারের কোন পথই দেখছে না দুই গোয়েন্দা, এই সময় টাশশ করে উঠল পিস্তল। ছোবল মারতে তৈরি হয়েছিল যে সাপটা, নিমেষে গায়েব হয়ে গেল ওটার মাথা। শরীরটা পাথরে আছড়ে পড়ে মোচড় খেতে লাগল। গুলির শব্দে ভাঁড়কে গিয়ে পালাতে শুরু করল অন্য দুটো।
জলদি সরে এসো ওখান থেকে। চিৎকার করে ডাকল কিশোর।
শৈলশিরা ধরে যত দ্রুত সম্ভব গর্তের কাছ থেকে সরে গেল মুসা আর রবিন। ওদের কাছে উঠে এলেন আরিগন আর কিশোর। আরিগনের পিস্তলের নল থেকে এখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
ওরা চারজন নিরাপদে মাটিতে নামার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন শেরিফ। ভুরুর ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ওখানে যাওয়াটা উচিত হয়নি তোমাদের! গলা কাঁপছে তার।
এক্কেবারে সময়মত গুলিটা করেছিলেন, মিস্টার আরিগন, কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলল রবিন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি থাকাতে আজ বাঁচলাম।
হাসি মুছে গেছে আরিগনের মুখ থেকে। গম্ভীর স্বরে বললেন, এখানে আমি ছিলাম বলে রক্ষা, এটা অন্য কোথাও ঘটতে পারত। সাবধান না হয়ে অত তাড়াহুড়ো করে গর্তের কাছে যাওয়া উচিত হয়নি তোমাদের। অচেনা জায়গায় আরও দেখেশুনে যেতে হয়।
আন্তরিক ভঙ্গিতে একটা হাত মুসার কাঁধে, আরেক হাত রবিনের কাঁধে রাখলেন তিনি। শোনো, আমি যা বলি মন দিয়ে শোনো। বনে চলার অভিজ্ঞতা নেই তোমাদের, বুঝতে পারছি। এখানে আরও অনেক সাবধান থাকতে হয়। কোথায় যে কোন বিপদ ঘাপটি মেরে থাকে কল্পনাও করতে পারবে না। এই সাপগুলোর কথাই ধরো না, ওরা যে ওখানে আছে ভাবতে পেরেছিলে? অথচ ভাবা উচিত ছিল। গর্তের কাছে পাথুরে জায়গায় শুয়ে রোদ পোয়ায় সাপেরা, কাজেই গর্তের কাছে যাওয়ার আগে সাবধান থাকতে হয়। বুনো এলাকা এটা, এখানে বনের ভেতরে যেমন বিপদ, বাইরেও বিপদ।
তার কথায় সায় জানাল একজন ডেপুটি।
আরেকজন নীরবে মাথা ঝাঁকাল।
শেরিফ বললেন, বনের মধ্যে এ ধরনের বিপদে আনাড়ি লোকেরাই সাধারণত পড়ে। শহরে বাস করা মানুষকে এনে এই পর্বতের মধ্যে ছেড়ে দিলে মুহূর্তে পথ হারিয়ে বসে থাকবে। বেরোতেই পারবে না আর।
হাসি ফুটল আবার আরিগনের মুখে, হালকা হয়ে এল কণ্ঠস্বর, যাই হোক, বুদ্ধিমান লোকেরা একবারই বোকামি করে। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি বুঝতে পারছি তোমরা বুদ্ধিমান। আশা করব, ব্ল্যাক হোলোর ধারেকাছেও আসবে না আর। এখানে পদে পদে বিপদ যে ওঁত পেতে থাকে, নিজের চোখেই তো দেখলে।
ক্যাপ্টেন রিচটনকে খোঁজার এখানেই ইতি হলো। আরিগন, শেরিফ আর তাঁর তিন ডেপুটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে হতাশ হয়ে কেবিনে ফিরল তিন গোয়েন্দা। সাপের কবল থেকে বাঁচার পর থেকেই শরীরটা দুর্বল লাগছে। রবিনের, ধপ করে শুয়ে পড়ল বাংকে। কুকুরের বাচ্চাটাকে কিছু খাবার দিয়ে। মুসা গেল রান্নাঘরে। আবার রিচটনের ক্যালেন্ডারটা নিয়ে বসল কিশোর। দেখতে লাগল মনোযোগ দিয়ে।
শিক কাবাব, পটেটো চিপস আর ভেজিটেবল সুপ রান্না করে সবাইকে খেতে ডাকল মুসা। তখনও চুপ করে আছে রবিন। কিশোর গম্ভীর। এই পরিস্থিতি ভাল লাগল না মুসার। হালকা করার জন্যে বলল, ব্যাপারটা খারাপ লাগেনি তোমাদের?
মুখ তুলল কিশোর, কোনটা?
এই যে খোকাবাবু মনে করে আমাদের লেকচারটা দিয়ে দিলেন আরিগন। আমার তো রাগই হচ্ছিল। বনেবাদাড়ে ঘুরতে ঘুরতে ঝানু হয়ে গেলাম, আর আমাদের কিনা বলে বন চিনি না। আরে বাবা ক্যাম্প করেই তো থাকলাম কত শতবার।
চিবাতে চিবাতে রবিন বলল, আমারও ভাল লাগেনি। কিছু বললাম না, আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে বলে। গাধামি তো সত্যিই করেছি আমরা।
কিশোর বলল, না, সেটা আমাদের দোষ নয়। নাহয় ধরলামই আমরা আনাড়ি, বন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই, কোথায় সাপ শুয়ে রোদ পোহায়, জানি না, কিন্তু আরিগন তো জানতেন। আর জানতেনই যদি আমাদের ওখানে যেতে বললেন কেন?
তাই তো, এভাবে তো ভাবিনি! চিবানো বন্ধ করে দিল রবিন। ক্যাপ্টেনকে খোঁজা বন্ধ হয়ে গেল…আমাদের হোলোতে না যাওয়ার পরামর্শ দিলেন…কিশোর, যা-ই বলো, ওই বাড়িটা যেমন রহস্যময়, তার মালিকও তেমনি রহস্যময়। একটা দরজা বন্ধ হতে শুনেছি আমি, অথচ রান্নাঘরে ঢুকে আর কোন দরজা চোখে পড়েনি।
ব্যাপারটা আমারও খটকা লেগেছে। একমুহূর্ত চুপ করে ভাবল কিশোর। তারপর বলল, ইচ্ছে করেই সাপের বাসায় আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। ওখানে সাপ আছে জানেন, তাই সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল নিয়ে এসেছেন, যাতে গুলি করতে পারেন। এ সব করে শেরিফকে বোঝাতে চেয়েছেন, কয়েকটা নির্বোধ, অপোগণ্ড ছেলে আমরা, আমাদের কথায়। ভবিষ্যতে কান না দেয়াই উচিত।
আচ্ছা, মুসা বলল, আমাদের খুন করতে চায়নি তো? সাপে কামড়ে আমাদের মেরে ফেললে কারও দোষ হত না। শেরিফ আর তার ডেপুটিদের চোখের সামনে ঘটত ব্যাপারটা। কোন রকম সন্দেহ জাগত না কারও মনে।
কি জানি, বুঝতে পারছি না, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কিশোর।
আরও একটা প্রশ্ন, পিচার আমাদের পাথর ছুঁড়ল কেন? সে-ও কি আরিগনের দলের লোক?
না-ও হতে পারে। সাপের গুহার দিকে এগোচ্ছি দেখেও ছুঁড়তে পারে, আমাদের ঠেকানোর জন্যে। তবে শিওর হতে পারছি না।
ভুরু কুঁচকে রবিন বলল, এই আরিগন লোকটা এক বিরাট রহস্য হয়ে দাঁড়াল! কর্নেল হুমবার সঙ্গে অবিকল মিল, এটাই বা হয় কি করে? যমজ ভাই নাকি…
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার করে উঠল মুসা, এই দাঁড়াও দাঁড়াও, একটা জিনিস দেখাব তোমাদের! ভুলেই গিয়েছিলাম! পকেট থেকে একটা ধাতব চাকতি বের করে টেবিলে ফেলল সে।
কি জিনিস? হাতে নিয়ে একবার দেখেই ভুরু কাছাকাছি হয়ে গেল কিশোরের, আরি এ তো কুকুরের গলার ট্যাগ! ডবের নাম! পটির কুকুর! কোথায় পেলে?
আরিগনের বাড়ির দরজার সামনে, ঘাসের ওপর।
তবে কি আরিগনই কুকুর চুরি করছেন? আগ্রহে বকের মত সামনে গলা বাড়িয়ে এসেছে রবিন, কিশোরের হাতের তালুতে রাখা ট্যাগটা দেখছে। কোন ধরনের অপরাধে জড়িত? নিজেই তো বললেন, এই এলাকায় একটা বেআইনী কুকুরের মার্কেট আছে।
কিছুই বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়তে নাড়তে বলল কিশোর। ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে রহস্য। তাঁর বাড়িতে কুকুরের ছায়াও তো দেখলাম না।
তার ভেড়ার খোয়াড়টা দেখে এসেছি আমি, মুসা জানাল, ভেড়া নেই, অন্য কোন প্রাণীও নেই। এমন হতে পারে, ডব গিয়ে বাড়িটার সামনে ঘুরঘুর করছিল, ওই সময় কোনভাবে তার গলা থেকে খুলে পড়ে যায় ট্যাগটা।
চুকচুক শব্দ করে দুধ খেতে লাগল ফগ। সেদিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলল, আজ রাতেই ফাঁদ পাতব।
রাখবে কোথায়?
বারান্দার নিচে, বেঁধে। দরজার কাছে লুকিয়ে থাকবে তুমি আর রবিন। আমি থাকব বাইরে, বাড়ির কোণে। যেদিক থেকেই আসুক চোর, আমাদের চোখে না পড়ে যাবে না।
রাত দশটায় আলো নিভিয়ে দেয়া হলো। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল ছোট্ট কেবিনটা। আকাশে মেঘ করেছে। বাতাস গরম। নিথর হয়ে আছে প্রকৃতি। ঝড়ের সঙ্কেত জানাচ্ছে।
নিঃশব্দে দরজা খুলে ফগকে নিয়ে বেরোল মুসা। বারান্দার রেলিঙের সঙ্গে বাঁধল কুকুরটার গলার দড়ি। ঘরে ফিরে গেল আবার। পাল্লাটা খোলা রেখে দুপাশে বসে পড়ল সে আর রবিন।
অন্ধকারে যাতে দেখা না যায়, এ জন্যে গাঢ় রঙের পোশাক পরে বেরোল কিশোর। ক্যাপ্টেনের গাড়ি আর ঘরের দেয়ালের মাঝের ফাঁকে লুকিয়ে বসল, চত্বরের কাছ থেকে কয়েক কদম দূরে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল সে। কান খাড়া। ধীরে ধীরে চোখে সয়ে এল অন্ধকার। তারপরেও বন থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এগিয়ে আসে, তাকে দেখতে পাবে না পেছনে গাছগুলো কালো হয়ে থাকায়।
ক্রমেই যেন আরও ভারি, আরও গরম হয়ে উঠছে বাতাস। দিগন্তে ঝিলিক দিতে আরম্ভ করল বিদ্যুতের সরু সরু শিখা। গুমগুম আওয়াজ বেরোতে থাকল মেঘের ভেতর থেকে। হঠাৎ পুরো আকাশটাকে চিরে দিয়ে ঝিলিক দিয়ে উঠল বিদ্যুৎ, ক্ষণিকের জন্যে সবকিছুকে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করেই নিভে গেল, অন্ধকারকে ঘন করে তুলল আরও। দশদিক কাঁপিয়ে কানফাটা শব্দে বাজ পড়ল।
ঘড়ি দেখল কিশোর। এখন মধ্যরাত।
আবার বিদ্যুৎ চমকাল। বজ্রপাতের শব্দ আগের বারের চেয়ে দীর্ঘায়িত হলো। বারান্দার নিচে ভীতকণ্ঠে কুঁই কুঁই করতে লাগল বাচ্চাটা।
ঝড়ের আর দেরি নেই, ভাবল কিশোর।
আবার বিদ্যুতের চমক, আবার বজ্রপাত…তার পর পরই বড় বড় ফোঁটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টিপাত। আচমকা গোঙানো বাদ দিয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল ফগ। কয়েকটা চিৎকার দিয়েই থেমে গেল, মুখ চেপে ধরা হয়েছে যেন, যাতে ডাকতে না পারে।
ঝড় মুহূর্তের জন্যে অমনোযোগী করে দিয়েছিল তিনজনকেই, কুকুরটার ওপর নজর রাখতে ভুলে গিয়েছিল, এই সময়টুকুতেই ঘটে গেল ঘটনাটা। ম্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠে দৌড়ে এল মুসা ও রবিন, বাড়ির পাশ থেকে ছুটে
এল কিশোর।
দেখল, ফগ নেই!
মুখ চেপে ধরলেও বাচ্চাটার গোঙানি শোনা যেত, কিন্তু ঝড়ের শব্দ ঢেকে দিল সেটা। বিদ্যুৎ চমকাল, তীব্র নীলচে আলোয় আলোকিত করে দিল বনভূমি, সেই আলোতে তিনজনেরই চোখে পড়ল হোলোতে নামার পথটা ধরে ছুটে যাচ্ছে একটা মূর্তি।
ধরো ওকে! চিৎকার করে বলল কিশোর।
টর্চ হাতে ছুটল তিনজনে।
.
১০.
কয়েক লাফে খোলা জায়গাটুকু পেরিয়ে বনে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা। টর্চের আলো থাকা সত্ত্বেও গতি কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হলো। বৃষ্টিতে ভেজা ঢালু এই পথ ধরে জোরে ছোটা ওদের পক্ষে অসম্ভব।
সামনে অন্ধকারের মধ্যেই দৌড়ে চলেছে কুত্তাচোর। তার চলা দেখেই অনুমান করা যায়, এই এলাকা তার অতিপরিচিত। ফগের চিৎকার শোনা গেল আবার, তার মুখ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গাছের পাতা থেকে টুপটাপ ঝরছে বৃষ্টি। বিদ্যুতের আলোয় প্রায় তিরিশ গজ নিচে ছুটন্ত মূর্তিটাকে দেখতে পাচ্ছে ছেলেরা।
হঠাৎ অন্ধকারে মানুষের আর্তনাদ শোনা গেল। ডান দিকে পাথরের মধ্যে একটা ভারি কিছু গড়িয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে বোধহয় থেমেছিল, আবার শোনা যেতে লাগল ছুটন্ত পায়ের শব্দ।
কিশোর, তোমরা দেখো তো কি হলো! আগে আগে ছুটতে ছুটতে বলল মুসা। আমি চোরটার পিছে যাচ্ছি!
টর্চের আলো ফেলে ঘন ঝোপের দিকে দৌড় দিল কিশোর আর রবিন। ঝোপঝাড় ভাঙার শব্দেই বোঝা গেল তার মধ্যে দিয়ে ছুটছে কেউ। কিন্তু আর গোঙানি কানে এল না। খানিক পর ঝড়বৃষ্টির শব্দ ছাড়া শোনা গেল না আর কিছুই।
পালিয়েছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন। ধরতে পারব না।
মুসা ওদিকে গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নেমে যাচ্ছে উপত্যকায়। টর্চ হাতে থাকলেও ওই আলোয় পথ দেখে দৌড়াতে অসুবিধে, কারণ দৌড়ানোর। সময় নাচানাচি করে আলো, এ জন্যে নিভিয়ে দিয়ে বিদ্যুতের আলোয় যতটা পারা যায় দেখে দৌড়াচ্ছে। পথটা তারও মোটামুটি চেনা।
বড় করে বিদ্যুৎ চমকাল। আলো রইল বেশিক্ষণ। তাতে তিরিশ গজ। দূরের ছুটন্ত মূর্তিটাকে স্পষ্ট নজরে পড়ল তার। বগলে চেপে ধরে আছে কিছু।
পিচার! চিৎকার করে ডাকল সে, দাঁড়াও!
কিন্তু দাঁড়াল না আজব ছেলেটা। হোলোর পাথুরে এলাকার দিকে দৌড় দিল। পায়ে ব্যথা পেয়েছে মনে হলো, অল্প অল্প খোঁড়াচ্ছে, কিন্তু গতি কমছে না। পাথরে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল। কিন্তু সমতল জায়গায় রয়েছে মুসা, তার সঙ্গে পারল না ছেলেটা। কয়েক লাফে কাছে পৌঁছে গেল সে। পা সই করে ঝাঁপ দিল। গোড়ালি ধরে ফেলল ছেলেটার। উপুড় হয়ে পড়ে গেল। পিচার, বগলের নিচ থেকে ছিটকে পড়ল দূরে ফগ, ব্যথা পেয়ে কেউ কেউ করতে লাগল।
চরমে পৌচেছে ঝড়। বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকে আলোকিত করে রেখেছে উপত্যকা।
ছেলেটার গায়ের ওপর চলে এল মুসা, কুস্তির কায়দায় চেপে ধরল। কিন্তু পিচারের গায়েও কম জোর না, তার ওপর ভেজা শরীর, ভেজা হাত, তাকে ধরে রাখতে পারল না মুসা। পিছলে নিচ থেকে সরে গিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। একটা বড় পাথর তুলল মারার জন্যে।
নিচ থেকে চিৎকার শোনা গেল, খবরদার, ফেলো ওটা!
চমকে ফিরে তাকাল পিচার, এই সুযোগে গড়িয়ে সরে গেল মুসা। আবার ছেলেটার পা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। আরেকবার ফেলে দিল মাটিতে।
পৌঁছে গেল রবিন আর কিশোর। তিন জনের সঙ্গে পারল না ছেলেটা, কাবু করে ফেলা হলো তাকে। তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। দু-দিক থেকে দুই হাত চেপে ধরে রেখেছে দু-জনে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে মুসা। বলল, আমার কুত্তাটা কোথায়? এই ফগ, ফগ?
ডাক শুনে কুঁই কুঁই করতে করতে এসে হাজির হলো বাচ্চাটা। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে, ভয় আর ব্যথা ভুলে গিয়ে মুসার পা ঘেষে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল। ওটার গলার দড়ি খুলে নিয়ে পিছমোড়া করে হাত বাধা হলো পিচারের। বন্দিকে নিয়ে কেবিনে ফিরে চলল তিন গোয়েন্দা।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলল বুনো ছেলেটা, পালানোর চেষ্টা করল না আর।
ভিজে গোসল করে ওরাও কেবিনে পৌঁছল, বৃষ্টিও থেমে গেল। ঝড়ো বাতাসে মেঘ উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে দিল আকাশ।
আমার খিদে পেয়েছে, ঢুকেই ঘোষণা করল মুসা। উফ, যা দৌড়ানটা দৌড়েছি!
পেয়েছে তো আর কি, রবিন বলল, খাবার বানাও, মানা করছে কে।
গা মুছে, কাপড় বদলে রান্নাঘরে চলে গেল মুসা। বিরাট এক পাত্রে স্যুপ বসাল। সেই সঙ্গে চলবে স্যামন মাছের স্যান্ডউইচ।
বন্দির বাঁধন খুলে দিয়েছে কিশোর আর রবিন। কিছু শুকনো কাপড় এনে দিয়ে ভেজাগুলো বদলে নিতে বলল।
কেবিনের উজ্জ্বল আলোয় এই প্রথম কাছে থেকে ভাল করে ছেলেটাকে দেখতে পেল গোয়েন্দারা। বয়েস চোদ্দ হবে, তবে সেই তুলনায় অনেক লম্বা, গঠনও বড়দের মত। কালো লম্বা চুল লেপ্টে রয়েছে ঘাড়ে, কপালে, কতদিন কাটে না কে জানে। টারজানের বাচ্চা সংস্করণ মনে হলো ওকে রবিনের কাছে।
কাপড় বদলে চুপ করে বসল পিচার। পায়ে একটা গভীর কাটা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এল কিশোর। কাটাটা আইয়োডিন। দিয়ে মুছে, ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। বাধা দিল না ছেলেটা। আইয়োডিন লাগানোর সময় যখন ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠল জখমটা, তখনও মুখ বিকৃত করল না। ভয় অনেকটা দূর হয়ে গেছে চোখ থেকে, বুঝে গেছে তার কোন ক্ষতি করবে না কিশোররা।
ট্রে বোঝাই খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল মুসা। হাসিমুখে কয়েকটা স্যান্ডউইচ আর একবাটি স্যুপ এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও পিচার, খেয়ে ফেলো।
দ্বিতীয়বার আর বলতে হলো না, গপ গপ করে গিলতে শুরু করল পিচার। দেখতে দেখতে শেষ করে ফেলল। আরও কিছু খাবার তার দিকে বাড়িয়ে দিল মুসা। হেসে বলল, বাহ, আমার সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মত একজনকে পাওয়া গেল।
পিচার আর মুসাকে খাওয়ায় ব্যস্ত রেখে ইশারায় রবিনকে ডেকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে এল কিশোর। নিচু স্বরে বলল, ছেলেটাকে একটুও বিপজ্জনক লাগছে না আমার কাছে। কাল নদীর ধারে আমাদের ওপর চোখ রেখেছিল। যে, সে পিচার নয়। ওই লোকটা এর মতই লম্বা, তবে চেহারা মেলে না, অন্য রকম।
একমত হয়ে মাথা কঁকাল রবিন। আমরা তো আর সন্দেহ করিনি, আরিগন বলেছেন পিচার হতে পারে।
আর কিছু বলার সুযোগ পেল না ওরা, পিচারকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। মুসা। ফগকেও খাবার দেয়া হয়েছে। তাকে আদর করতে লাগল মুসা।
স্টোভের আগুনে গরম হয়ে উঠেছে রান্নাঘর, বেশ আরাম। বৃষ্টিতে ভিজে এসে শুকনো কাপড় পরে, পেট ভরে খাওয়ার পর বুনো ভাবটা চলে গেছে পিচারের মুখ থেকে। মুসা আর ফগের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসল, বুঝিয়ে দিল কুকুর ভালবাসে সে।
কিশোর ভাবল, ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু পিচার বোবা, জবাব তো দিতে পারবে না, কি করে বলবে? শেষে বসার ঘরে চলে গেল। কিশোর, কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে এল। ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল, আমি কয়েকটা কথা জানতে চাই, জবাব দেবে?
ওদের ব্যাপারে ভীতি আর সন্দেহ চলে গেছে পিচারের। মাথা ঝাঁকাল।
বেশ, ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে বলল কিশোর, বলো, আমাদের কুকুরটা নিয়ে যেতে চেয়েছিলে কেন?
বিস্ময় ফুটল ছেলেটার চোখে। টেবিলে কাগজটা বিছিয়ে নিয়ে পেন্সিল দিয়ে স্কেচ করতে লাগল। লম্বা, চওড়া কাধ একজন মানুষের চেহারা ফুটে উঠল কাগজে। ভুরু আর গোঁফ ভারি করে দিল সে।
এ তো আরিগন! অবাক কণ্ঠে বলে উঠল রবিন। কিন্তু ছবি এঁকে কেন? লিখলেও আরও সহজ হয়ে যায়।
লিখতে জানে না বোধহয়। হাত তুলল কিশোর, দাঁড়াও, পিচারের আঁকা এখনও শেষ হয়নি।
টেবিল ঘিরে এসেছে তিন গোয়েন্দা, তাকিয়ে রয়েছে কাগজটার দিকে। লম্বা একজন মানুষ আঁকল পিচার, হাত আঁকল, ফগের চেহারার একটা বাচ্চা কুকুর ধরেছে হাতটা।
আবার চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ও বলতে চায়, আরিগন চুরি করেছেন বাচ্চাটাকে!
.
১১.
দাঁড়াও, আবার বলল কিশোর, ওর আঁকা এখনও বাকি আছে।
আরও কয়েকটা কুকুরের ছবি আঁকল পিচার–একটা ককারেল স্প্যানিয়েল, একটা জার্মান শেফার্ড, আর দুটো হাউন্ড।
ওটা আবার কি আঁকছে? পিচারের পেন্সিলের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন, একটা ধূসর কুকুর?
ধূসর কিংবা বাদামী, কিশোর বলল। দেখো, বা কানটা সাদা রেখে দিয়েছে।
খাইছে! বলে উঠল মুসা, ওটা তো পটির কুকুর! তারমানে ডবকেও চুরি করেছেন আরিগন!
বার বার আরিগন নামটা শুনেই বোধহয় মুখ তুলে একটা রাগত ভঙ্গি করল পিচার। তারপর রেখা টেনে টেনে সবগুলো কুকুরকে যোগ করে দিল মানুষটার ছবির সঙ্গে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। দৃষ্টি আর ভঙ্গি দেখে মনে হলো আরও কিছু বলতে চায়। আরিগনের ছবিতে আঙুল রাখল, তারপর ফগকে দেখাল। হঠাৎ একটা চেয়ারের নিচে চলে গিয়ে মুখ বের করে উঁকি দিল।
ও বলতে চায়, ব্যাখ্যা করল কিশোর, গাছের আড়ালে কিংবা ঝোপের। মধ্যে লুকিয়ে ছিল।
হাত টান টান করে দিল পিচার, আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে আবার বন্ধ করে বোঝাতে চাইল ভারি কিছু চেপে ধরেছে। লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল চেয়ারের নিচ থেকে। হাতের অদৃশ্য জিনিসটা দিয়ে ডোনারের ছবির মাথায় বাড়ি মারল, পরক্ষণেই হাতের কুকুরের বাচ্চাটাকে ছো মেরে কেড়ে নিয়ে ঘুরে দৌড় দেয়ার ভঙ্গি করল।
কি বোঝাতে চাইল বুঝল তিন গোয়েন্দা। সে লুকিয়ে বসে চোখ রাখছিল, আরিগন আসতেই তার মাথায় বাড়ি মেরে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিয়ে দৌড় দিয়েছে।
হু, চোরের ওপর বাটপাড়ি! মন্তব্য করল উত্তেজিত রবিন।
কিশোরের প্রশ্ন তখনও শেষ হয়নি, আজ বিকেলে আমাদেরকে পাথর ছুঁড়লে কেন?
আবার চেয়ারে বসল পিচার। কয়েক টানেই এঁকে ফেলল তিনটে ব্যাটল। সেক। ওগুলো দেখিয়ে মুসা আর রবিনের বুকে হাত রেখে ওদেরকে ঠেলে সরানোর ভঙ্গি করল।
হেসে বলল কিশোর, বলেছিলাম না, ও তোমাদের বাঁচাতে চেয়েছিল। সাপগুলো দেখেছিল। তার মানে আরিগনের দলে নয় সে।
আচমকা প্রশ্নটা জাগল রবিনের মাথায়, কুত্তাচোরের পেছন নিয়েই বিপদে পড়েননি তো ক্যাপ্টেন রিচটন?
পড়তে পারেন। তারও তো একটা কুকুর ছিল। আরিগন হয়তো চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল, ক্যাপ্টেন পিছু নিয়েছিলেন তার। তারপর গোপন এমন কিছু দেখে ফেলেছিলেন, যেটা কাল হয়েছিল তার।
তখন তাকে পথ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো! পাতায় লেগে থাকা রক্তের কথা ভেবে বলল রবিন।
নতুন সম্ভাবনাটা নিয়ে এতই মজে গেল তিনজনে, নিঃশব্দে কখন যে দরজার কাছে চলে গেল পিচার, খেয়াল করল না। করল সে বেরিয়ে যাওয়ার পর। লাফিয়ে উঠে তার পিছু নিতে গেল মুসা, ধরে ফেলল কিশোর। যাক। ও আমাদের পক্ষেই আছে।
ওর জন্যে কিছু করতে পারলে ভাল হত, রবিন বলল। ছবি আঁকার। হাত দেখেছ? ট্যালেন্ট একটা! আর্ট স্কুলে ভর্তি হলে ফাটিয়ে ফেলবে।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। সে-সব পরের ভাবনা। আগে এই রহস্যের একটা কিনারা করা দরকার। বুঝলে, কর্নেল হুমবাকে মন থেকে তাড়াতে পারছি না আমি, আরিগনের সঙ্গে চেহারার এত মিল কেন? ভাবছি, কাল আবার কার্নিভ্যালে গিয়ে হুমবার সঙ্গে কথা বলব। জিজ্ঞেস করব, তার কোন যমুজ ভাই আছে কিনা।
ফরেস্টবার্গে গেলেও তথ্য মিলতে পারে। আরিগন পরিবার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা দরকার।
রাতের ঝড়বৃষ্টির পর খুব ঝলমলে হয়ে দেখা দিল সকাল। গাছের সবুজ পাতা চকচক করছে কাঁচা রোদে। ফুরফুরে মন নিয়ে কেবিন থেকে বেরোল তিন গোয়েন্দা। কিন্তু বাইরে বেরিয়েই থমকে গেল মুসা, বলে উঠল, খাইছে! দেখো!
কনভারটিবলের টপ তুলে দিতে ভুলে গিয়েছিল ওরা, বৃষ্টির পানি জমে আছে গাড়ির মেঝেতে। সীট, সীটের কভার, সব ভেজা। পানি মুছে নিয়েও। তাতে বসে যাওয়া যাবে না।
ক্যাপ্টেনের গাড়িটাই নিয়ে যাই, রবিন বলল। এতে আরেকটা কাজ হবে। তার শত্রুরা দেখলে মনে করতে পারে তিনি পালিয়েছেন, বাধা দেয়ার জন্যে তখন সামনে বেরিয়ে আসতে পারে ওরা।
বুদ্ধিটা ভাল, পছন্দ হলো কিশোরের। এ ছাড়া আর কিছু করারও নেই, তাদের এত ভেজা গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। পানিটানিগুলো মুছে, শুকানোর জন্যে ফেলে রেখে ক্যাপ্টেনের গাড়িটা নিয়েই রওনা হলো ওরা।
রবিনই চালাল, কিশোর তার পাশে, কুকুরের বাচ্চাটাকে নিয়ে পেছনে বসল মূসা। ফরেস্টবার্গে পৌঁছে দেখা গেল সীটে এলিয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে মুসা, বাচ্চাটা কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে তার কোলে। হেসে ফেলে কিশোর বলল, কাল রাতে দু-জনের ওপরই খুব ধকল গেছে। ঘুমাক। চলো, আমরাই যাই।
কোর্টহাউসের দিকে হেঁটে এগোল ওরা। মাত্র আটটা বাজে, রাস্তায় লোকজন কম। আগের দিন ভাল করে দেখা হয়নি, আজ দেখতে দেখতে চলল ওরা। বেশির ভাগ দোকানেরই ওপরতলায় অফিস করা হয়েছে। একটা সাইনবোর্ডে দেখা গেল:
আর্নি হুগারফ
অ্যাটর্নি-অ্যাট-ল
ঢুকবে কি ঢুকবে না দ্বিধা করতে লাগল। সে কি ভেবে না ঢোকাই স্থির করল।
রাস্তা পেরিয়ে কোর্টহাউসের সামনে এসে দাঁড়াল দু-জনে। এত সকালে কেউ কাজে আসেনি।
এক কাজ করি চলো, কিশোর বলল। দোকানগুলোতে খোঁজ নিই। আরিগনদের কেউ চিনতেও পারে।
পরের একটা ঘণ্টা দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াল দুই গোয়েন্দা। দু একজনের কাছে নামটা পরিচিত হলেও কোথায় শুনেছে মনে করতে পারল। কেউ কোন তথ্য দিতে পারল না। অনেকেই এখানে নতুন, তারা চেনেই না আরিগনদের। আর পুরানো যারা, চিনতে পেরেছে, তারা চেপে গেছে; বাইরের কারও কাছে নিজেদের ঘরের কথা বলতে রাজি না ওরা।
পথের মাথার একটা দরজির দোকান দেখিয়ে কিশোর বলল, চলো, ওইটাই শেষ।
সে-ও বলবে না।
এবার অন্য বুদ্ধি করব। ভাব দেখাব, যেন কাজ করাতে এসেছি।
দরজির দোকানে আবার কি কাজ? অবাক হলো রবিন।
হেসে প্যান্টের একটা ছেঁড়া দেখাল কিশোর। কাল রাতে পাথরে টাতরে খোঁচা লেগে বোধহয় ছিঁড়েছে। রিপু করাব।
দরজা খোলার শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকাল বুড়ো দরজি। ছোটখাট মানুষ, মাথা জুড়ে টাক। কাউন্টারে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কী?
ছেঁড়াটা দেখিয়ে কিশোর অনুরোধের সুরে বলল, এটা রিপু করে দেয়া যাবে? আমরা দাঁড়াই।
হাসল বুড়ো। সোনায় বাঁধানো দুটো দাঁত দেখা গেল। খুলে দাও।
দোকানের পেছনের ড্রেসিং রুমে ঢুকে প্যান্টটা খুলে ওখানে রাখা অন্য কাপড় পরে এল কিশোর। টেবিলে বসে কাজ শুরু করল দরজি। দুটো টুলে বসে দেখতে লাগল কিশোর আর রবিন।
পুরানো কাপড় মেরামত করার জন্যে দিয়ে গেছে অনেকেই, মেঝেতে স্তূপ করে ফেলে রাখা হয়েছে সেগুলো। সুন্দর একরোল স্যুটের কাপড় দৃষ্টি আকর্ষণ করল কিশোরের। জিজ্ঞেস করল, নতুন কাপড়ের অর্ডার কেমন পান?
এখানে আর কাজ কোথায়? ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল দরজি। খালি ফুটোফাটা মেরামতের জন্যে নিয়ে আসে।
ওই যে, নতুন কাপড় রেখেছেন?
রেখেছি, যদি কেউ আসে স্যুট করাতে। কিন্তু আসে না, রেডিমেড পোশাকের দিকেই লোকের ঝোঁক, প্যান্টের ফুটোর চারপাশে সুচ চালাতে, চালাতে দুঃখ করে বলল বুড়ো, চল্লিশ বছর ধরে আছি এখানে। এখন আমার। প্রধান ব্যবসা হলো ধোপাগিরি। কিন্তু দশ বছর আগেও অবস্থা এমন ছিল না। অনেকেই আসত পোশাক বানাতে। কাজ করতে করতে একেক সময় অস্থির হয়ে যেতাম। হ্যারিসনরা আসত, মবাররা আসত, আসত আরিগনরা। কত সুন্দর সুন্দর স্যুট যে ওদের বানিয়ে দিয়েছি আমি। আজ আর সে-সব দিন। কোথায়!
আরিগন?
হ্যাঁ, আরিগন, একটা চমৎকার পরিবার। এই এলাকার অনেক পুরানো বাসিন্দা। টাকাও ছিল, বিলাসিতাও ছিল। বুড়ো আরিগন, লম্বা, সুদর্শন একজন মানুষ। আর তার স্ত্রীর কথা কি বলব, খুবই শৌখিন ছিল। সুন্দরী একটা মেয়ে ছিল তাদের, দুটো যমজ ছেলে ছিল–লমা, সুন্দর, একেবারে বাপের মত। চেহারায় এত মিল, কে যে কোনটা আলাদা করাই মুশকিল।
যমজ! উত্তেজনা দেখাতে গিয়েও তাড়াতাড়ি সেটা সামলে নিল রবিন, বুড়োকে সন্দিহান করে তোলা যাবে না, দারুণ তো? কি হলো পরিবারটার? এখন আর কাপড় বানাতে আসে না কেন?
দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়ল দরজি, থাকলে তো আসবে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কে কোথায় চলে গেছে কে জানে। মেয়েটার খবর জানি না। যমজদের একজন, নুবার আরিগন শহর ছেড়ে একেবারেই চলে গেছে। আরেকজন, ডোবার, কালেভদ্রে আসে। আবার জোরে নিঃশ্বাস ফেলল বুড়ো। তবে কাপড় আর বানাতে আসে না সে-ও। হাতে তৈরি জমকালো পোশাক পরা ছেড়েই দিয়েছে। পরে কেবল সাদাসিধা কাপড়, যেগুলো পরলে হাঁটাচলার সুবিধে হয়।…নাও, তোমার এটা হয়ে গেছে।
প্যান্টটা পরে নিল কিশোর। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, তবে রবিনের মতই সেটা চেপে রেখে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, হ্যারিজ কার্নিভ্যালটা এখন কোথায়, বলতে পারবেন? একবার দেখেছি। কিন্তু আমার বন্ধুর, রবিনকে দেখিয়ে বলল, আরেকবার দেখার ইচ্ছে।
ওয়েস্টবাস্কেট থেকে খুঁজে পেতে দোমড়ানো একটা পোস্টার বের করে আনল বুড়ো। দিল কিশোরকে। কবে কোনখানে যাবে কার্নিভ্যালটা, তার শিডিউল করা আছে। বুড়োর মজুরি মিটিয়ে দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। দুই গোয়েন্দা।
আরও চমক অপেক্ষা করছিল তাদের জন্যে। কয়েক গজ এগোতে না এগোতেই একটা ওষুধের দোকান থেকে লম্বা একজন মানুষকে বেরোতে দেখল ওরা। আরিগন! মাথায় ব্যান্ডেজ বাধা। ফিসফিস করে রবিন বলল, বাড়িটা জোরেই মেরেছে পিচার!
তাই তো মনে হচ্ছে। ইনি কোন জন, নুবার, নাকি ডোবার, জানতে পারলে ভাল হত। দেখা যাক, কার্নিভ্যালের হুমবা নতুন কিছু জানাতে পারে নাকি আমাদের।
.
১২.
তখনও ঘুমাচ্ছে মুসা, কিন্তু বাচ্চাটা জেগে গেছে। কিশোর আর রবিনের সাড়া পেয়ে খেউ খেউ শুরু করল।
জেগে গেল মুসা। লাল চোখ মেলে হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল, এখনও কি ফরেস্টবার্গেই আছি?
দুই ঘণ্টা ধরে আছি, জবাব দিল রবিন। তোমার স্বপ্ন দেখা শেষ হয়েছে?
হয়েছে। তোমাদের কি খবর?
বলতে লাগল রবিন। শুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার, ঘুম চলে গেল বহুদূরে। একটা ম্যাপের ওপর ঝুঁকে পড়েছে কিশোর।
স্টার্ট দিল রবিন। শহর থেকে বেরিয়ে কিশোরের নির্দেশে পশ্চিমে যাওয়ার একটা রাস্তা ধরল।
যাচ্ছি কোথায়? জানতে চাইল মুসা।
রিভারভিল, জবাব দিল কিশোর। ওখানেই আছে এখন কারনিভ্যালটা। মেইন রোড দিয়ে যাওয়ার চেয়ে এই রাস্তায় গেলে সময় অর্ধেক, লাগবে। আমাদের।
সরু, এবড়োখেবড়ো কাঁচা পথটার জন্যে উপযুক্ত ক্যাপ্টেনের গাড়িটা। সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে রবিন। পথের মাঝে মাঝে গর্ত, আগে থেকে খেয়াল না করলে ওগুলোতে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটাবে। দুই ধারে ঘন বন। কখনও নালা এগিয়ে যাচ্ছে পথের সমান্তরালে, কখনও শৈলশিরা। একটা বাড়িঘরও চোখে পড়ল না কোথাও।
কয় মাইল এসেছে মিটারে দেখে নিয়ে কিশোর বলল, আর বোধহয় বেশি দূরে নেই। হায় হায়, ওটার আবার কি হলো? এমন জায়গায় গাড়ি খারাপ হলে তো সর্বনাশ! নিজেদের কথাও ভাবল সে। পথের পাশে একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এই মন্তব্য করল সে। গাড়িটার বনেট ওপরে তোলা। দুপাশ থেকে ঝুঁকে তার নিচে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে দু-জন লোক, ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না একজনেরও।
কি হলো দেখা দরকার, কিশোর বলল। বিপদে পড়েছে মনে হয়। দেখি, কোন সাহায্য করতে পারি কিনা।
কিশোর, সন্দেহ জেগেছে রবিনের, ওরা আমাদের গাড়ি থামানোর। জন্যে এই বাহানা করছে না তো? ক্যাপ্টেনের গাড়ি দেখে হয়তো দেখতে এসেছে, ব্যাপারটা কি?
সেটা কথা না বললে বোঝা যাবে না। ওরা দু-জন, আমরা তিনজন, সাবধান থাকব, তাহলেই কিছু করতে পারবে না।
গাড়ি থামাল রবিন। ওরা তিনজন বেরোতে না বেরোতেই লাফ দিয়ে এগিয়ে এল বিরাট এক কুকুর। গাড়ির ওপাশে ছিল এতক্ষণ।
খাইছে! তাড়াতাড়ি মূসা বলল, এই ফগ বেরোবি না, বেরোবি না, খেয়ে ফেলবে! কিন্তু আকারের তুলনায় কুকুরটা ভদ্র, কৌতূহলী ভঙ্গিতে তার হাত শুকতে লাগল।
সোজা হয়ে দাঁড়াল একজন লোক। হালকা-পাতলা গঠন, লাল চুল। কুকুরটাকে ডাকল, এই মবি, আয় এদিকে। মুসাকে বলল, ভয় পেয়ো না। ও কামড়ায় না।
কি হয়েছে গাড়ির? জানতে চাইল কিশোর।
চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেল। বুঝতে পারছি না।
এগিয়ে গেল মুসা। ইঞ্জিনের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, আমি একবার দেখি?
গাড়ির কাজ জানো নাকি? জিজ্ঞেস করল উজ্জ্বল রঙের প্রিন্টের শার্ট পরা অন্য লোকটা।
কিছু কিছু।
তাহলে দেখো কিছু করতে পারো কিনা। কি যে বিপদে পড়লাম।
শার্টের হাতা গোটাতে লাগল মুসা, দেখি, টুলস কি আছে দেন?
টুলস বক্স বের করে দিল লালচুল লোকটা।
একটা স্প্যানার নিয়ে ইঞ্জিনের ওপর ঝুঁকল মুসা। কয়েক মিনিট পর হাসি মুখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, যান, ঠিক হয়ে গেছে। কন্ডোরে গোলমাল ছিল।
এত তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে গেছে, বিশ্বাস করতে পারল না লোকগুলো। প্রিন্টের শার্ট পরা লোকটা গিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসে ইগনিশনে মোচড় দিল। সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট হয়ে গেল গাড়ি।
বিস্ময় দেখা দিল লালচুল লোকটার চোখে। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো দেখি গাড়ির জাদুকর হে! কতক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিঃ বাঁচালে। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে।
জানা গেল, গাড়িটা একটা স্কুলের। ফরেস্টবার্গে যাওয়ার পথে ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেছে। তিন গোয়েন্দাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আবার নিজের পথে রওনা হয়ে গেল লোকগুলো।
তারমানে ওরা শত্রুপক্ষ নয় আমাদের? গাড়ি চালাতে চালাতে প্রশ্ন। তুলল রবিন।
মনে হয় না, জবাব দিল কিশোর। আচরণে তো সে-রকম মনে হলো না।
হতে পারে, পেছন থেকে মুসা বলল, ওরা ভেবেছিল, ক্যাপ্টেন রিচটন আছেন গাড়িতে। তাকে দেখলেই অন্য রকম আচরণ করত। আমাদের দেখে আর কিছু করার প্রয়োজন বোধ করেনি…
কি জানি। আমার সে-রকম মনে হয়নি।
তবে ইঞ্জিনে কিন্তু সত্যি গোলমাল হয়েছিল। ওটা বাহানা কিংবা সাজানো নয়।
রিভারভিলে পৌঁছল গাড়ি। তৃতীয়বারের মত হ্যারিজ কার্নিভ্যালে এল গোয়েন্দারা। খেলা শুরু হয়নি এখনও। একজন টিকেট কালেক্টরকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, হুমবাকে কোনখানে পাওয়া যাবে।
কর্নেল যে তাঁবুতে খেলা দেখায় তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ছোট সাদা রঙের একটা ক্যারাভান ট্রেলার। ওটাতেই থাকে অ্যানিমেল ট্রেনার। ছেলেরা কাছে এসে দাঁড়াতেই খুলে গেল দরজা। বেরিয়ে এল খেলা দেখানোর পোশাক পরা হুমবা।
এগিয়ে গেল কিশোর। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, মিস্টার আরিগন, আপনার সঙ্গে কথা আছে। একটু দাঁড়াবেন, প্লীজ।
আরিগন নামটা শুনেই থমকে গেছে হুমবা। কিশোর দাঁড়াতে মা বললেও দাঁড়াত। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, এই নাম জানলে কি করে তুমি?
আরিগন নামে আরেক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমাদের, চেহারার এত মিল, আপনার ভাই বলেই চালিয়ে দেয়া যায়। খুব ভাল করে খুঁটিয়ে না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে দু-জন দুই লোক। যখন জানলাম, ওই ভদ্রলোকের একজন ভাই আছে, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলতে অসুবিধে হলো না। একটা কথা বুঝতে পারিনি, নুবার কে, আর ডোবার কে?
দ্বিধা করল হুমবা, তারপর বলল, আমি নুবার। সঙ্কোচ বোধ করছে। লোকটা। হাসল, তাতেও সঙ্কোচ। আসলে নিজের পরিচয় দিতেই এখন লজ্জা লাগে, বিলাসিতা করে ফকির হওয়া মানুষদের কেউ দেখতে পারে না। এতে যদিও আমাদের খুব একটা দোষ ছিল না, আমাদের বাবাই দায়ী..যাই হোক, আসল নামটা রাখলে এই এলাকায় বেকায়দায় পড়ে যেতাম, কে যায় লোকের অহেতুক মন্তব্য শুনতে, তাই বদলেই ফেললাম। অনেক আগে চলে গেছি তো আমরা এই এলাকা ছেড়ে, এখন নিজে থেকে পরিচয় না দিলে সহজে কেউ আর চিনতে পারবে না। কিন্তু তোমাদেরকে এত কথা বলছি কেন? তোমরা কারা?
আমরা ইতিহাসের ছাত্র, অনেক দুরে লস অ্যাঞ্জেলেসের রকি বীচ থেকে বেড়াতে এসেছি। ভাবলাম, এসেছি যখন, এই এলাকার ইতিহাস যতটা সম্ভব জেনে যাই, পরীক্ষার সময় কাজে লাগবে। ডাচ পেনসিলভ্যানিয়া সম্পর্কে এমনিতেও আমাদের কৌতূহল আছে।
ও, কিছু সন্দেহ করল না নুবার।
আপনাদের তো শুনলাম অনেক জায়গা-সম্পত্তি আছে এখনও, ফকির বলছেন কেন? পুরো ব্ল্যাক হোলোটাই আপনাদের।
মাথা ঝাঁকাল নুবার, অনেক বড় সম্পত্তি, তা ঠিক। কিন্তু সেটা নিয়ে মারামারি করলে তো আর ভোগ করা যায় না। বাবা মারা যাওয়ার পর। জায়গাটা নিয়ে কি করব আমরা, এই একটা সামান্য ব্যাপারেই একমত হতে পারিনি এখনও তিন ভাইবোন। কেস চলছে। তর্কের পর তর্ক করে চলেছে। তিন পক্ষের উকিল। কেউ কোন সমাধানে আসতে পারেনি।
সম্পত্তি থেকে একটা কানাকড়িও পাই না। বসে থাকলে তো আর পেট চলে না, তাই এই কাজ নিয়েছি। জন্তু-জানোয়ারে আমার ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ। শখের বশে জানোয়ারকে ট্রেনিং দেয়ার কাজটাও শিখে ফেললাম। সেই শিক্ষাই এখন আমার রুটিরুজির উপায়। এই কাজকে ভাল চোখে দেখে না আমার অন্য দুই ভাইবোন। না দেখুক, আমিও তাদের কাছে যাই না… সরাসরি কিশোরের দিকে তাকাল নুবার। ডোবারের সঙ্গে তাহলে ব্ল্যাক হোলোতেই দেখা হয়েছে তোমাদের? সে যে এই এলাকায় এসেছে আবার, জানতাম না। অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ওখানে কি করছে?
তেমন কিছু না। সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করছে ব্ল্যাক হোলোর পুরানো কেবিনটায়।
সন্ন্যাসী! বিস্ময়ে কাছাকাছি হয়ে গেল নুবারের ঘন ভুরুজোড়া। অসম্ভব! ও টাকা ছাড়া চলতে পারে না! বিলাসিতা ছাড়া বাঁচতে পারে না!
দেখে তো মনে হলো, বেশ সুখেই আছে, খোঁচা দিয়ে কথা বের করার চেষ্টা করল কিশোর।
কি জানি? নাক চুলকাল মুবার। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। পাগলই হয়ে গেল না কি…সত্যি যদি তার এই পরিবর্তন হয়ে থাকে, খুশিই হব।
খাওয়া-দাওয়ায়ও বিলাসিতা তেমন আছে বলে মনে হয় না, মুসা বলল। সেদিন একটা আধমরা ভেড়া কিনে নিয়ে যেতে দেখলাম। ওই বুড়ো ভেড়ার মাংসই বোধহয় খান।
খবরটা হজম করতে সময় লাগল নুবারের। আনমনে মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, এতটা পরিবর্তন! নাহ, কিছু বুঝতে পারছি না! ভেড়ার মাংস দু-চোখে দেখতে পারে না ও। এখন সেই মাংসই খায়, তা-ও আবার বুড়ো ভেড়ার…
পুষতে-টুষতে নেননি তো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা খারাপ! জন্তু-জানোয়ার তার শত্রু। একটা কুত্তা পর্যন্ত পালতে পারল না কোনদিন।
কুত্তার কথাই যখন উঠল কি ভাবে নেবেন আপনি জানি না, মিস্টার আরিগন–তবু বলেই ফেলি, কিশোর বলল। যদি বলি আপনার ভাই কুত্তা কিডন্যাপিঙের সঙ্গে জড়িত?
কি ভাবে নিয়েছে নুবার, সেটা তার চেহারা দেখেই অনুমান করা গেল, বজ্রাহত হয়ে পড়েছে যেন। সামলে নিতে সময় লাগল। বলল, এই পরিণতিই হবে, আমি জানতাম! লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু! আর আমাদের পরিবারের পাপ হলো ভয়াবহ বিলাসিতা! এতক্ষণে বুঝতে পারছি, ওই কেবিন কেন থাকছে ও। সন্ন্যাসীর মত থাকার ছুতোয় নিশ্চয় কোন কুকাজ করে বেড়াচ্ছে। হায়রে, জমিদারের ছেলের শেষে এই পরিণতি! জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে। টিকেট কেটে লোকে বসে থাকলে বিরক্ত হয়।
তাঁবুর দিকে ধীরপায়ে হেঁটে চলে গেল অ্যানিমেল ট্রেনার।
রবিন বলল, সত্যি কথাই তো বলল বলে মনে হলো। কিশোর, কি মনে হয়, ভাইয়ের সঙ্গে সে-ও জড়িত নয় তো?
মাথা নাড়ল কিশোর। না, দেখলে না, খবর শুনে সত্যি সত্যি দুঃখ। পেয়েছে। এই লোক কোন খারাপ কাজে জড়িত নয়।
হু, চুপ হয়ে গেল রবিন।
কথা তো বলা হলো, মুসা বলল, এরপর কি কাজ? কি করব এখন? আজও ঢুকব পুমার খেলা দেখতে?
নাহ, এক খেলা কবার দেখে। আর কোন কাজ নেই এখানে। চলো, ব্ল্যাক হোলোতে ফিরে যাই।
ডোবারের ওপর কড়া নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। রাত্রে কি করে লুকিয়ে থেকে দেখবে। কেবিনে ফিরে তাই আর কোন কাজ না পেয়ে, খাওয়াদাওয়ার পর শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে নিল পুরো বিকেলটা। রাতে আবার জাগতে হবে, হয়তো সারারাতই, কে জানে?
সূর্য ডোবার পর তাকে আর রবিনকে ডেকে তুলল মুসা। ডিনার তৈরি করে ফেলেছে।
পেট ভরে খেয়ে নিল তিনজনে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখল, পরিষ্কার, ঝকঝকে আকাশে তারা জ্বলছে। আজ রাতে আর ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠতে দেরি আছে। রাতের অভিযানের জন্যে তৈরি হতে লাগল ওরা। গাঢ় রঙের পোশাক পরে নিল, যাতে অন্ধকারে ভালমত লুকিয়ে। থাকতে পারে।
বেরিয়ে পড়ল ওরা। শব্দ করে ওদের অস্তিত্ব ফাঁস করে দিতে পারে, এই ভয়ে ফগকে বেঁধে রেখে এল রান্নাঘরে। হোলোর, পথঘাট এখন মোটামুটি পরিচিত। রাতে টর্চ নিভিয়ে চলতেও আর তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। নিরাপদেই চলে এল ডোবারের কেবিনটার কাছে। ঘন অন্ধকারে আবছামত চোখে পড়ল ওটার আকৃতি। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে আসছে খুব সামান্য কমলা রঙের আলো।
পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোল ওরা।
কথা শোনা যাচ্ছে ঘরের মধ্যে। ডোবার না একা থাকে বলল, তাহলে কথা বলছে কার সঙ্গে? মনোযোগ দিয়ে শুনে অন্য কণ্ঠটা কার চিনে ফেলল কিশোর, উকিল আনি হুগারফ। অবাক হয়ে ভাবল, এই লোক এখানে কি করছে!
…বললাম না, ডরোথির সঙ্গে দেখা করেছি আমি! হুগারফ বলছে, একচুল নড়াতে পারিনি ওকে। তার সেই এক কথা।
অধৈর্য ভঙ্গিতে চেয়ার ঠেলে সরানোর শব্দ হলো। শোনা গেল ডোবারের ভারি গলা, অসহ্য! এ একটা জীবন হলো নাকি! এ ভাবে বাঁচা যায়! আর দেরি করতে পারব না, আমি আমার সম্পত্তির ভাগ এখনই চাই!
চাইলেই তো আর হলো না, মীমাংসা করতে হবে আগে..আমিও বিরক্ত হয়ে গেছি। অনেক টাকা পাওনা হয়ে গেছে তোমার কাছে, সেটা যে কবে পাব কে জানে! আসল কথা বলো এখন, এদিকের খবর কি?
জবাব শোনার আশায় কান খাড়া করে রইল দুই গোয়েন্দা। কিন্তু কথা শোনা গেল না, তার পরিবর্তে চেয়ার টানাটানি..
কথা বলছে না কেন? ভাবল কিশোর। নাকি হুগারফকে কিছু দেখাচ্ছে। ডোবার?
হঠাৎ তার কাঁধ খামচে ধরল মুসা। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, কেউ আসছে? একদম নড়বে না!
পদশব্দ শুনতে পাচ্ছে এখন কিশোর আর রবিনও। দেয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। আশা করল, এ ভাবে থাকলে, যে আসছে তার চোখে পড়বে না ওরা এই অন্ধকারে। কিন্তু যদি টর্চ জ্বালে? আর আসছেটাই বা কে? ভাইয়ের পরিস্থিতির খবর পেয়ে তাকে দেখতে এসেছে নুবার? নাকি পিচার? পিচার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ এখানে ডোবারের পিছে লেগে থাকে সে; নিশ্চয় কারা আসে কারা যায় লক্ষ করে।
হঠাৎ করেই থেমে গেল পদশব্দ। পনেরো মিনিট চুপ করে একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল গোয়েন্দারা। কিন্তু আগন্তুকের আর কোন সাড়া নেই।
.
১৩.
অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে চোখ ব্যথা করে ফেলল ওরা, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না।
কেবিনের ভেতর আবার ভারী গলায় কথা বলে উঠল ডোবার, খুব শীঘ্রি কিছু টাকা পেয়ে যাব। না পেলে আমারও চলবে না আর। কিছু একটা করতেই হবে!
হ্যাঁ, ভাল কথা, ছেলেগুলোর কি খবর? আচমকা প্রশ্ন করল হুগারফ।
যায়নি এখনও। আমার মনে হয় রিচটনের ভাবনাটা এখনও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।
ওদের কথাই আলোচনা হচ্ছে, বুঝতে পারল কিশোর।
ভাগাতে হবে তো। নইলে কখন কোন বিপদে ফেলে দেবে কে জানে! সাংঘাতিক ছোঁক ছোঁক করা স্বভাব।
বুঝতে পারছি না কি করব? দেখা যাক!
দরজা খোলার ক্যাচকোচ শব্দ হলো। দেয়ালের সঙ্গে গা চেপে ধরে মিশে রইল তিন গোয়েন্দা, পারলে পাথরের মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়।
খোলা দরজা দিয়ে আলো পড়ল ঘাসের ওপর। বেরিয়ে এল উকিল। পেছনে আবার দরজা লাগিয়ে দিল ডোবার। বনে গিয়ে ঢুকল হুগারফ, পায়ের শব্দ ঢাকার কোন চেষ্টাই করল না।
পথের ধারের একটা কালো ঝোপ নড়ে উঠল বলে মনে হলো কিশোরের, মুসারও চোখে পড়ল ব্যাপারটা। তারমানে এতক্ষণ কেউ লুকিয়ে ছিল ওখানে।
এগিয়ে গেল হুগারফের পদশব্দ। যে ঝোপটা নড়েছে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা লম্বা ছায়ামূর্তি। পিছু নিল উকিলের।
আমাদের ওপর নয়, ফিসফিস করে মুসা বলল, হুগারফের ওপর নজর রাখছিল। কোথায় যায় দেখব?
দেখো তো, জবাব দিল কিশোর। আমরা এখানেই আছি। দেখি, আর কি ঘটে, আর কেউ আসে কিনা?
কয়েক মিনিট পরই ফিরে এল মুসা। জানাল, পিচারের মতই মনে হলো। ও আসলে চোখে চোখে রাখছে লোকগুলোকে।
কেন? রবিনের প্রশ্ন।
স্বাভাবিক কৌতূহল হতে পারে। নিশ্চয় সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে।
বসে আছে তো আছেই ওরা। খুব ধীরে কাটছে একঘেয়ে সময়, স্থির হয়ে আছে যেন। কিন্তু আকাশের তারাগুলোর স্থান পরিবর্তন প্রমাণ করে দিল, না, ধীরে হলেও সময় কাটছে। পুবের আকাশে হালকা একটা আভা ফুটল। অবশেষে গাছপালার মাথার ওপর বেরিয়ে এল কাস্তের মত বাকা হলুদ চাঁদ। হালকা, কনকনে ঠাণ্ডা একঝলক বাতাস যেন লাফ দিয়ে এসে নামল বদ্ধ উপত্যকাটায়।
আবহাওয়া পরিষ্কার হলে কি হবে, পার্বত্য এলাকার ঘন শিশির ঠিকই পড়তে লাগল। ভিজিয়ে দিল ছেলেদের চুল, কাপড়। সেঁতসেঁতে কাপড় পরে। থাকাটা এমনিতেই অস্বস্তিকর, তার ওপর এই ঠাণ্ডা বাতাস কাপুনি ধরিয়ে দিল শরীরে। একভাবে বসে থেকে থেকে পায়ের পেশীতে খিল ধরে গেছে।
এতক্ষণ ডোবারের কেবিনের দরজায় যে হালকা আলোটা ছিল, সেটাও নিভে গেল। শুয়ে পড়েছে বোধহয় সে। আর বসে থাকার কোন মানে হয় না। উঠল ওরা। ফিরে চলল নিজেদের কেবিনে।
খাড়া পথ বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ কিশোরের হাত আঁকড়ে ধরল মুসা, শুনছ!
অবশ্যই শুনছে কিশোর আর রবিনও। কাঁপা কাঁপা একটা টানা তীক্ষ্ণ চিৎকার।
নিশ্চয় সেই পেঁচাটা! রবিন বলল। এল কোনখান থেকে?
হোলোর ওপার থেকে, জবাব দিল কিশোর। মনে তো হলো, ডোবারের ঘরের কাছেই ডাকল।
ভালই হয়েছে, কণ্ঠস্বর নামিয়ে বলল মুসা, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে, আমরা ওখানে থাকতে ডাকেনি। তাহলে বারোটা বাজত! ভূতের সঙ্গে
পেঁচার বড় ভাব! একসঙ্গে উড়ে চলে ওরা আকাশপথে!
হোলোর ওপর উঠে এল ওরা। কেবিনের আলোর দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অন্য এক জগৎ থেকে যেন বেরিয়ে এল পরিচিত পৃথিবীর অভ্যস্থ পরিবেশে। ভূত বিশ্বাস না করলেও, মুসার মত ভয় না পেলেও পেঁচার ডাকটা অন্য দু-জনেরও ভাল লাগেনি।
কেবিনে ঢুকে দেখল, ভালই আছে ফগ। মুসাকে দেখে আদুরে গলায় কুঁই কুঁই শুরু করল। এগিয়ে গিয়ে ওটাকে আদর করল সে।
ঘুমানোর আগে ঠাণ্ডা দূর করার জন্যে মগে গরম চকলেট ঢেলে নিয়ে বসল তিনজনে।
মগে চুমুক দিয়ে রবিন বলল, তাহলে বোঝা গেল, হুগারফ ডোবারের উকিল। এবং দু-জনেই টাকার পাগল।
কিছু টাকা আসবে বলল ডোবার, কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। কোত্থেকে আসবে বলো তো?
আর যেখান থেকেই আসুক, সম্পত্তি বিক্রি করে নয় এটা ঠিক, কিশোর বলল। এখনও জায়গাটার কোন মীমাংসাই হয়নি।
বেআইনী কিছু করছে না তো? রবিনের প্রশ্ন।
কি জানি! তবে টাকার যখন এত লোভ, করলে অবাক হব না। তার ভাইয়েরও তো সে-রকমই সন্দেহ।
কিশোর, মুসা বলল, হুগারফের পাওনা টাকা দেয়ার ভয়ে কোথাও গিয়ে লুকাননি তো ক্যাপ্টেন?
মাথা নেড়ে রবিন বলল, আমার মনে হয় না। একজন পুলিশ অফিসার, মিস্টার সাইমনের বন্ধু, হুগারফের মত একটা হেঁচড়া লোক তার কাছে টাকা। পাবে, এ কথা আমার বিশ্বাস হয় না। কিশোরের দিকে তাকাল সে, ডোরারের কথা শুনে কিন্তু মনে হলো; টাকার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিছু একটা ঘটাবে মনে হলো। কি, বলো তো?
এটা জানলে তো অনেক প্রশ্নেরই জবাব পাওয়া যেত। চলো, শুয়ে পড়ি, রাত প্রায় শেষ। এখন মাথা ঘামিয়ে কিছু করতে পারব না, কাজ করবে না মগজ। তবে একটা কথা বলে রাখি, কাল সকালে উঠেই ডরোথি আরিগনের খোঁজে বেরোব আমরা। দুই ভাইয়ের সঙ্গেই দেখা হলো, বোনকে বাদ দেয়া উচিত না। হয়তো ওখানে জরুরী কোন তথ্য পাওয়া যাবে।
পাবে কোথায় তাকে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
দেখি, সে-কথা সকালে উঠে ভাবব।
.
অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙল ওদের। কুকুরের বাচ্চাটা খুব শান্ত, ডাকাডাকি করে অহেতুক বিরক্ত করেনি বলেই ওরা ঘুমাতে পারল।
নাস্তার টেবিলে বসে ঘোষণা করল কিশোর, খেয়ে ফরেস্টবার্গে রওনা হব। প্রথমে ডরোথি আরিগনের নামটা খুঁজব টেলিফোন গাইডে। না পেলে তখন অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।
কি ব্যবস্থা? জানতে চাইল রবিন।
খোঁজখবর করব। মহিলাদের খবর মহিলারাই বেশি রাখে। মহিলারা চালায় এমন সব দোকানে ঢুকে তাদেরকে জিজ্ঞেস করব। পুরুষেরা মুখ বন্ধ রাখলেও মহিলারা অতটা রাখতে পারবে না। কিছু না কিছু ফাঁস করে দেবেই।
সুতরাং নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়ল ওরা।
ফরেস্টবার্গে এসে সহজেই পেয়ে গেল ডরোথি আরিগনের ঠিকানা। কোর্টহাউসে পাবলিক টেলিফোনের ব্যবস্থা আছে যেখানে, সেখানে একগাদা ফোনবুক পাওয়া গেল। ফরেস্টবার্গের আশেপাশে আরও যে কটা শহর আছে, সবগুলোর ফোন নম্বর আছে একটা বইতে। দেখা গেল, ডরোথি বাস করে উডে।
ম্যাপ দেখে রাস্তা বের করে ফেলল কিশোর। গাড়ি চালাল রবিন।
দুপুরের একটু আগে লাল গাড়িটা এসে ঢুকল ব্রুকউডের শান্ত, প্রায় নির্জন মেইন রোডে। দুই পাশে বড় বড় সাদা বাড়ি, সামনে সুন্দর লন আর বাগান। প্রচুর গাছপালা আছে।
সুন্দর শহর, দেখতে দেখতে বলল কিশোর। পুরানোও।
এক কাজ করলে হয় না? রবিন বলল, ডরোথির সঙ্গে দেখা করার আগে তার সম্পর্কে বাইরের লোকের কাছে একটু খোঁজখবর নিয়ে নিই। কথা বলতে সুবিধে হতে পারে।
মন্দ বলনি।
একজায়গায় বেশ কয়েকটা পুরানো বাড়ি প্রায় গায়ে গায়ে লেগে থাকতে দেখা গেল। বাণিজ্যিক এলাকা, আন্দাজ করল কিশোর। গাড়ি রাখতে বলল। রবিনকে।
সাইনবোর্ড দেখে একটা চায়ের দোকানে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। কুকুরের বাচ্চাটাকে গাড়িতে রেখে এসেছে,। দোকানের ভেতরের চেহারা দেখে দমে গেল মুসা। বলল, এখানে ঢুকে লাভটা কি হলো? খাওয়ার জিনিস পাব বলে তো মনে হয় না। সবই বুড়োবুড়ি; দেখগে, সবগুলো ডায়েট কন্ট্রোল করে।
এদের কাছেই তো খবরটা পাওয়া যাবে, হেসে বলল কিশোর। কাজ নেই কর্ম নেই, মানুষের সমালোচনা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই ওদের।
ওরা টেবিলে গিয়ে বসতেই লম্বা, মাঝবয়েসী অ্যাপ্রন পরা এক মহিলা এগিয়ে এল।
গুড মর্নিং বলল কিশোর। আমরা বহুদূর থেকে এসেছি, বেড়াতে। খিদে পেয়েছে। ভাল কিছু দিতে পারেন?
কিশোরের ভদ্রতায় খুশি হলো মহিলা। হেসে বলল, বসো, আনছি।
মুসাকে অবাক করে দিয়ে ডিমের ওমলেট, ভেজিটেবল সালাদ আর বরফ ও তাজা মিন্টের ফ্লেভার দেয়া কোল্ড টী এনে দিল মহিলা। জিজ্ঞেস করল, চলবে?
চলবে মানে! এখানে এলে এই দোকান ছাড়া আর চা খেতেই ঢুকব,তাড়াতাড়ি ডিমের প্লেটটা টেনে নিল মুসা।
আস্তে খাও, রসিকতা করে বলল রবিন। বুড়োবুড়িদের খাবার, গলায় আটকে ফেলো না।
চলে গেল মহিলা। ফিরে এল বড় এক প্লেট স্ট্রবেরি পাই নিয়ে। টেবিলে নামিয়ে রাখল।
আন্তরিক খুশি হলো মুসা। ঢোকার আগে যে অনীহাটা ছিল, একেবারে দূর হয়ে গেছে।
খেতে খেতে কিশোর জিজ্ঞেস করল, ডরোথি আরিগন নামে কাউকে চেনেন? ব্ল্যাক হোলোতে বিশাল সম্পত্তি আছে তাদের। আমার মার বান্ধবী। বলেছে দেখা করে যেতে। কিন্তু আমি চিনি না।
চিনব না কেন? অনেক বড় দরজির দোকান দিয়েছে। আশপাশের সব শহর থেকে লোকে কাপড় বানাতে আসে তার কাছে।
কাছেই থাকে?
না।
হ্যাঁ। মহিলা বেশ ভাল, তবে অহঙ্কারী। এই অহঙ্কারটা অবশ্য আরিগনদের রক্তের দোষ, ওদের সবার মধ্যেই আছে। আর এই নিয়েই তো গণ্ডগোলটা বেধেছে, কেউ কারও কথা মানতে চায় না, নিজের ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিতে চায়। পরিবারটাই ভেঙে গেল এ কারণে।
নতুন কয়েকজন ঢুকল দোকানে। তাড়াহুড়ো করে সেদিকে চলে গেল। মহিলা, আর কোন কথা জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না গোয়েন্দারা। খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এল দোকান থেকে। ডরোথির বাড়িতে যাওয়ার সময় রবিন বলল, কি ভাবে কথা শুরু করবে তার সঙ্গে? ছুতোটা কি?
দেখি, জবাব দিল কিশোর, একটা কিছু বের করেই ফেলব।
পুরানো আমলের একটা বাড়ির সামনে গাড়ি রাখল রবিন। এখানেই থাকে ডরোথি। একসঙ্গে সবাই ঢুকলে বিরক্ত হতে পারে মহিলা, সেজন্যে কিশোর একাই চলল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে কাঁচের দরজায় লাল রঙে লেখা দেখতে পেল:
ড্রেস ডিজাইনার
ডরোথি আরিগন
খোলা দরজা। ভাল রকম সাজানো গোছানো একটা সিটিং রুমে ঢুকল। কিশোর। কেউ নেই। হয়তো ভেতরে গেছে, আসবে ভেবে একটা সোফায় বসে পড়ল সে। চোখ বোলাতে লাগল সারা ঘরে। পুরু কার্পেট, চকচকে পালিশ করা আসবাবপত্র, চমৎকার ডেকোরেশন। ব্যবসা ভালই চলছে।
প্রায় নিঃশব্দে খুলে গেল একটা দরজা। ঘরে ঢুকল লম্বা, সুন্দরী এক মহিলা, বয়েস চল্লিশের কোঠায়, কালো চুল। গর্বিত ভঙ্গিই প্রমাণ করে দেয়, আরিগনদের বংশধর। তার পেছনে ছাগলছানার মত লাফাতে লাফাতে বেরোল হাসিখুশি একটা ছোট কুকুর। এগিয়ে এল কিশোরের দিকে।
ওটার মাথা চাপড়ে দিতে গিয়ে হাত থেমে গেল তার। মনে পড়ল। বাদামী রঙের কুকুর, একটা কান সাদা! গলায় কলার নেই, নাম লেখা ট্যাড নেই। পটির ডব নয় তো এটা?
উঠে দাঁড়াল কিশোর, হেসে বলল, সুন্দর কুকুর। অবিকল একই রকমের আরেকটা কুকুর দেখেছি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। মনে হয় এটার ভাইই হবে। পেলেন কোথায়, মিস আরিগন?
আমার ভাই দিয়েছে, মহিলা গোমড়ামুখো নয়, তবে ততটা আন্তরিকও নয়। বনের মধ্যে নাকি একা একা ঘুরছিল। মালিককে খুঁজে পায়নি। সে কুকুর পছন্দ করে না। তাই আমাকে দিয়ে গেছে।
ব্ল্যাক হোলোতে থাকেন যে, মিস্টার ডোবার আরিগন, তিনি নন তো?
চেনো নাকি?
পরিচয় হয়েছে। ওখানে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বনের মধ্যে দেখা হয়ে গেল, একটা পাথরের কেবিনে সন্ন্যাসী হয়ে আছেন মিস্টার আনি।
স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছে ডরোথি, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, সন্ন্যাসী!
সে-রকমই তো মনে হলো। তিনিও তাই বললেন।
কি জানি? অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ডরোথি। হ্যাঁ, বলো কি জন্যে। এসেছ?
ডিজাইন। আপনার অনেক নামটাম শুনে মা বলছিল, আপনার কাছ। থেকে পোশাকের একটা নতুন ডিজাইন নিতে পারলে ভাল হত। এদিকে একটা কাজে এসেছি, আপনার বাড়ির সামনে নেমপ্লেটটা দেখে হঠাৎ মনে পড়ল মার কথা। ঢুকে পড়লাম।
হাসল মহিলা। তুমি খুব ভাল ছেলে, কবে কি বলল ঠিক মনে রেখে দিয়েছ। মায়ের কথা শোনে নাকি আজকালকার ছেলেরা! ঠিক আছে, তোমার মাকে গিয়ে বোলো আমার কাছে চিঠি লিখতে। কি চায় বুঝে দেখি।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিলাকে লক্ষ করছে কিশোর। তাকে সন্দেহ করছে না তো? কিন্তু ডরোথির হাসিমুখ দেখে তার মনের কথা কিছুই আঁচ করতে পারল না সে। আর কোন প্রশ্ন খুঁজে না পেয়ে বলল, আচ্ছা, যাই।
চিন্তিত ভঙ্গিতে গাড়িতে এসে উঠল সে। কি জেনেছে জানার জন্যে উৎসুক হয়ে আছে দুই সহকারী গোয়েন্দা। কিশোর বলল, পটির কুকুরটাকে খুঁজে পেয়েছি। চুরি করে এনে বোধহয় বোনকে দিয়ে দিয়েছে ডোবার।
মুসা বলল, বলো কি? দান করার জন্যে চুরি করে, এমন কথা তো শুনিনি।
কি জানি, বুঝতে পারছি না!
আর কি জানলে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
আমাদের কাজে লাগার মত কিছু না। মহিলার ব্যবসা খুব গরম, এটা বুঝলাম। টাকার জন্যে সম্পত্তি বিক্রি কিংবা বেআইনী কাজ করার কোনই প্রয়োজন নেই।
তারমানে এগোনো আর গেল না, নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মুসা। রহস্যের জট থেকেই গেল!
জট ছাড়াতে হলে একটা জায়গারই খুব কাছাকাছি থাকতে হবে, ব্ল্যাক হোলো। ভাবছি, আজ রাতে কেবিনে না থেকে বনের মধ্যেই ক্যাম্প করে থাকব কিনা। রাত হলে ফিরব আমরা। ঘরেও ঢুকব না, আলোও জ্বালব না। আমরা চলে গেছি মনে করে এমন কিছু করে বসতে পারে ডোবার, যা সব রহস্যের সমাধান করে দেবে।
এতটা সময় তাহলে কি করব?
ঘুরে বেড়াব। এলাকাটা দেখব।
.
১৪.
ক্যাপ্টেনের কেবিনের কাছে গাড়ি নিল না ওরা। পথের পাশে কয়েকটা গাছের আড়ালে পার্ক করে রেখে অন্ধকারে নিঃশব্দে এসে ঢুকল কেবিনে। কুকুরটাকে বাধল রান্নাঘরে, তাকে সঙ্গে নেয়া যাবে না, কিছু দেখলে চিৎকার শুরু করবে। একা তাকে এ ভাবে ফেলে যেতে ভাল লাগছে ওদের, তবু কিছু করার নেই। স্লীপিং ব্যাগগুলো বের করে নিয়ে ঢুকে পড়ল পাশের বনে, পায়েচলা পথ ধরে নেমে এল উপত্যকায়। একটা ঘন ঝোপের ধারে শোয়ার ব্যবস্থা করল।
চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে লাগল কিশোর। কয়েকটা তারা মিটমিট করছে। পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে আকাশ খুব একটা চোখে পড়ে না; পড়লে দেখত, দিগন্তের কাছে ইতিমধ্যেই জমে গেছে একটুকরো কালো মেঘ।
ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার।
অন্ধকারে মুসার ফিসফিসে কণ্ঠ শোনা গেল, শুনছ!
হ্যাঁ, জবাব দিল রবিন, পেঁচা ডাকছে।
কয়েক মিনিট পর আবার ডাক শোনা গেল, এবার অন্য রকম। কয়েকবার ডেকে থেমে গেল।
এটা পেঁচা নয়! গলা কাঁপছে মুসার। ডাইনী!
হ্যাঁ, কিশোর বলল, পেঁচার মত ঠিক না, বরং মানুষের চিৎকারের সঙ্গে মিল আছে। প্রথম রাতে যেটা শুনেছিলাম, তার সঙ্গে এগুলোর একটারও মিল নেই।
সেজন্যেই তো বলছি পেঁচা, জোর দিয়ে বলল রবিন। তবে দু-রকম পেঁচা।
প্রথম দিনেরটা তাহলে কি ছিল..? অন্ধকারে গাছের আড়াল থেকে। লম্বা একটা ছায়ামূর্তিকে বেরোতে দেখে চমকে উঠে বসল মুসা, কে!
চোখের পলকে দুটো টর্চের আলো বিদ্ধ করল মূর্তিটাকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রবিন, ও, তুমি, পিচার!
কি চাও? জিজ্ঞেস করল মুসা, তারপর মনে পড়ল পিচার বোবা, জবাব দিতে পারবে না।
বসে পড়ল পিচার। কিশোর, রবিন, আর মুসার দিকে আঙুল তুলে হাত নাড়ল জোরে জোরে।
মনে হয়, তাড়াতাড়ি এখান থেকে আমাদের পালাতে বলছে, রবিন বলল। নিশ্চয় কোন বিপদ! কি বিপদ, পিচার? পকেট থেকে নোট্টবুকের পাতা ছিঁড়ে দিল সে। পেন্সিল বের করে দিল কিশোর।
টর্চের আলোয় দ্রুত একটা জানালাবিহীন কেবিন এঁকে ফেলল ছেলেটা। একমাত্র দরজা দিয়ে বেরিয়ে আছে একটা বন্দুকের নল।
ডোবারের কেবিন, উত্তেজনায় ফিসফিস করে বলল রবিন। তার কাছে। বন্দুক আছে। কি করছে…
দাঁড়াও, বাধা দিল কিশোর আরও কিছু আঁকছে।
দুটো পেঁচার মাথা আঁকল পিচার। কিন্তু একটা পেঁচার খাড়া খাড়া কান, আরেকটার কান নেই বললেই চলে। পেঁচার চেয়ে বানরের মুখের সঙ্গেই ওটার মিল বেশি।
আঁকিয়ে বটে! আবারও প্রশংসা করতে হলো রবিনকে, দারুণ হাত! দেখলে, বলেছিলাম না পেঁচার ডাক? দুটো দুরকম পেঁচা। একটার ডাকের সঙ্গে মানুষের গলার মিল বেশি, সেটাকেই ডাইনী ভাবে লোকে।
এঁকেই ক্রস চিহ্ন দিয়ে দুটোকে কেটে দিল পিচার। হাত নেড়ে আবার চলে যেতে বলল তিন গোয়েন্দাকে।
বুঝলাম না, কিশোর বলল। পেঁচাকে ভয় পাও তুমি?
উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল পিচার।
ডাইনীর সঙ্গে পেঁচার সম্পর্ক আছে বলছ? ওগুলোর কবল থেকে বাঁচাতে চাও আমাদের?
জোরে মাথা ঝাঁকাল ছেলেটা।
মনে হয়, মুসা বলল, পেঁচাগুলোকে গুলি করার কথা বলছে ডোবার।
মাথা নাড়ল পিচার, মুসার অনুমানও ঠিক না।
নাহ, কিছু বুঝতে পারছি না, রবিন বলল। তবে ডাইনীই হোক, পেঁচাই হোক, কিংবা ডোবার, কারও ভয়েই এখান থেকে যাচ্ছি না আমরা। বুঝলে?
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইল পিচার। তারপর নিরাশার ভঙ্গি করল।
কিশোর বলল, বরং একটা উপকার করতে পারো আমাদের। কুকুরের বাচ্চাটা একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। ওকে তোমার কাছে নিয়ে যাও, তাতে আমাদের কাজ করতে সুবিধে হবে। একলা ওকে ঘরের মধ্যে ফেলে রাখাটা নিষ্ঠুরতা।
মাথা ঝাঁকাল পিচার। যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, তেমনি করেই হারিয়ে। গেল গাছের আড়ালে।
আলো নিভিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। অন্ধকারে বিড়বিড় করল কিশোর, সারাক্ষণই ডোবারের পেছনে লেগে আছে! নিশ্চয় তার সঙ্গে কোন দুর্ব্যবহার করেছে লোকটা… পেঁচা এঁকে কি বোঝাতে চাইল, বুঝতে পারলে ভাল হত…
বিদ্যুৎ চমকাল এই সময়।
সর্বনাশ, বৃষ্টি আসবে নাকি? শঙ্কিত হয়ে উঠল রবিন, তাহলে তো আর বাইরে থাকা যাবে না।
মনে হচ্ছে আজ কিছু একটা ঘটবেই, কিশোর বলল। ঝড় এখনও অনেক দূরে, আসতে দেরি আছে। দেখি, যতক্ষণ থাকতে পারি থাকব।
কয়েক মিনিট পর খুট করে একটা শব্দ হলো।
কি ব্যাপার? আবার ফিরে আসছে নাকি পিচার? মুসার প্রশ্ন।
ছেলেটা যেদিকে গেছে সেদিকে তাকাল কিশোর। আরও গাঢ় হয়েছে। অন্ধকার। মেঘ জমেছে আকাশে, তারার আলোও নেই।
আবার হলো শব্দটা।
তারপরই ভারি নীরবতাকে খান খান করে দিল ভয়াবহ, তীক্ষ্ণ চিৎকার। পরক্ষণে আবার। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আরও একবার। কেমন যেন মানুষের চিৎকারের মত।
প্রথম রাতে এই চিৎকারই শুনেছি! নিশ্চয় কেউ বিপদে পড়েছে! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। জলদি ওঠো!
ডাইনীটা তো আছেই দেখা যাচ্ছে, গল্প নয়! জুতো পায়ে গলাতে গলাতে বলল মুসা। কাউকে ধরে এনে রক্ত খাওয়ার তাল করছে নাকি?
জবাব দিল না কেউ। এই সময় আবার বিদ্যুৎ চমকাল।
কিশোরের জুতো পরা শেষ। বলল, কাছেই কোথাও। চলো।
টর্চ জ্বেলে দৌড় দিল ওরা। কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়াল কিশোর, কারণ আবার শোনা গেল চিৎকার। কোনখান থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করল। উপত্যকার নিচে নয়, ওপরে, ঢালের গায়ে রয়েছে, বলল সে। বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া পায়েচলা পথটা ধরে ছুটল আবার।
ঢালের মাঝামাঝি জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে গেল আবার।
হাঁপাতে হাঁপাতে রবিন বলল, আর তো শোনা যাচ্ছে না! যাব। কোনদিকে?
আমি কিন্তু আরেকটা শব্দ শুনছি, কান পেতে আছে মুসা,। তোমার শুনছ না?
শোনাটা কঠিনই। কারণ এখন আর নীরব হয়ে নেই রাতটা। ঝড় আসার সঙ্কেত জানিয়ে শুরু হয়ে গেছে প্রবল বাতাস, দমকে দমকে ঢেউয়ের মত আসছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সেই আলোয় চোখে পড়ছে দুলন্ত গাছের মাথা, পাগল হয়ে উঠেছে যেন গাছগুলো। এদিকে মাথা নোয়াচ্ছে, ওদিকে হেলে পড়তে চাইছে, মড়মড় করে উঠছে ডাল, পাতার মধ্যে দিয়ে শিস কেটে যাচ্ছে বাতাস। কিন্তু এত কিছুর মধ্যে দিয়েও শব্দটা ঠিকই কানে আসছে মুসার। স্বর
কিসের শব্দ? জিজ্ঞেস করল রবিন।
মানুষের চিৎকার বলে মনে হলো কিন্তু বাতাস যা আরম্ভ করেছে, বুঝতে পারছি না…
বড় করে বিদ্যুৎ চমকাল, থাকল অনেকক্ষণ। হাত তুলে কাছের একটা গাছ দেখাল রবিন। চুপ করে বসে আছে একটা পেচা, বাতাসের পরোয়া করছে না, বড় বড় চোখগুলো কেমন ভূতুড়ে লাগল। ক্ষণিকের জন্যে দেখা, গেল দৃশ্যটা, আলো নিভে যেতেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।
আচমকা উপত্যকার নিচ থেকে ভেসে এল ভয়াবহ চিৎকার। ভীষণ চমকে দিল তিন গোয়েন্দাকে। মনে হলো এগিয়ে আসছে শব্দটা। তাড়াতাড়ি কাছের একটা বড় পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ওরা। নজর বাঁয়ের–একটুখানি ঘাসে ঢাকা খোলা জায়গার দিকে।
হঠাৎই চোখে পড়ল ওটাকে। কালো, ভারী একটা শরীর, বিশাল বেড়ালের মত চারপায়ে ভর করে বেড়ালের মতই হেলেদুলে বন থেকে বেরিয়ে এল খোলা জায়গাটায়। তারপর নিঃশব্দে, যেন বাতাসে ভেসে পার। হয়ে গিয়ে ঢুকল অন্য পাশের কালো বনের মধ্যে।
বনবেড়াল! ফিসফিসিয়ে বলল উত্তেজিত রবিন। এই তাহলে ডাইনী! চিৎকার ওটারই!
কিন্তু এখানে বনবেড়াল আসবে কোত্থেকে? প্রতিবাদ করল কিশোর, এই অঞ্চলে ওই জীব বাস করে না। তাছাড়া বনবেড়াল এত বড় হয় না।
চুপ! ওদের থামতে বলল মুসা, এখনও আগের ক্ষীণ শব্দটা শোনার চেষ্টা করছে।
এইবার শুনতে পেল তিনজনেই। বাতাসের গর্জন আর বজ্রের শুড়গুডুকে ছাপিয়ে শোনা গেল পাতলা, কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার, বাচ্চা ছেলের কণ্ঠ, ডব! ডঅব! ডবিইইই!
খাইছে! এ তো পটি! বলে উঠল মুসা, এত রাতে বনের মধ্যে এসেছে। কুকুর খুঁজতে!
সামনেই আছে কোথাও! কিশোর বলল।
তার কথা শেষ হতে না হতেই সেই ভীষণ চিৎকারটা আবার শোনা গেল। থেমে যেতেই কানে এল বাচ্চা ছেলের ভীত ফোপানোর শব্দ, ডব, ডবি, কোথায় তুই?…আমার ভয় লাগছে।
আর শোনার অপেক্ষা করল না তিন গোয়েন্দা। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল শব্দ লক্ষ্য করে। আবার চিৎকার করে উঠল বিশাল জন্তুটা।
পটারের কান্নার শব্দ জোরাল হচ্ছে, আমার ভয় লাগছে। আমি বাড়ি যাব! মা, মাগো, কোথায় তুমি!
চিৎকার করে মুসা বলল, পটি, যেখানে আছো দাঁড়িয়ে থাকো! নোড়ো না!
সামনে হঠাৎ পথ আটকে দিল একটা গাছের মাথা, চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ডালপাতা। নিচের উপত্যকায় গোড়া ওটার, মাথাটা উঠে এসেছে এখানে। তারমানে গর্তের কিনারে পৌঁছে গেছে গোয়েন্দারা, সামনে খাড়া হয়ে নেমেছে দেয়াল।
কিনারে এসে টর্চ জ্বেলে মরিয়া হয়ে পথ খুঁজল ওরা। প্রথমে চোখে পড়ল শুধু ঝড়ে দুলন্ত গাছপালার মাথা।
ওই যে? চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
অবশেষে সবকটা টর্চের আলোই খুঁজে পেল ছোট্ট ছেলেটাকে। জারসি আর শর্ট ট্রাউজার পরনে, ওদের নিচে বড় একটা গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে। থরথর করে কাঁপছে। একহাতে মুখ ঢেকে রেখেছে, আরেকটা হাত তুলে রেখেছে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে।
কয়েক গজ দূরে টর্চের আলোয় ঝিক করে উঠল ভয়ঙ্কর দুটো সবুজ চোখ। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে শিকারের দিকে। কেশে ওঠার মত শব্দ করল জানোয়ারটা। ধীরে ধীরে শরীরের সামনের অংশ নিচু হয়ে যাচ্ছে। লেজ নাড়ছে এপাশ ওপাশ। শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে ওটা।
বিশাল এক পুমা। হলুদ রঙ।
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল মুসা। গর্তের কিনারের একটা বড় পাথর দেখিয়ে বলল, কিশোর, ওই পাথরটা গড়িয়ে দাও আমি পটিকে তুলে আনছি!
জানোয়ারটার চোখে টর্চের আলো নাড়ছে রবিন, ওটাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়ার জন্যে। তাতে আক্রমণ চালাতে দেরি করবে, সময় পাবে মুসা। কিশোর ছুটে গেল পাথরটার দিকে।
কোন রকম দ্বিধা না করে শূন্যে ঝাঁপ দিল মুসা। পড়ল বড় গাছটার মাথায়। একটা ডাল ধরে ফেলল। তারপর এ ডাল থেকে সে-ডালে দোল খেতে খেতে নেমে চলে এল পটির মাথার ওপরের একটা নিচু ডালে।
টর্চের আলো দেখে ওপরে তাকিয়ে আছে পটি।
দড়াবাজিকরের মত হাঁটু ভাজ করে ভেতরের দিকটা ডালে আটকে দিয়ে নিচের দিকে ঝুলে পড়ল মুসা। দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, জলদি হাত ধরো!
ভয়ে, বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে পটি। মূসার কথা যেন বুঝতেই পারল না। তাকিয়ে আছে নীরবে। তারপর যেন যন্ত্রচালিতে মত ধীরে ধীরে ওপর দিকে তুলে দিতে লাগল দুই হাত।
গর্জন করে সামনে ঝাঁপ দিল পুমাটা। একই সময়ে ডাল আর ঝোপঝাড় ভেঙে ওটার ওপর নেমে আসতে লাগল পাথর। মাটি ভিজে গোড়া আলগা হয়ে ছিল, কাজেই ঠেলে ফেলতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি কিশোরের।
থমকে গেল জানোয়ারটা। এই সুযোগে পটির হাত দুটো চেপে ধরে ওপর দিকে তুলে ফেলল মুসা। তাকে নিয়ে উঠে বসল ডালের ওপর।
লাফিয়ে উঠে দুজনকেই ধরে ফেলতে পারত জানোয়ারটা। কিন্তু ওপর থেকে খসে পড়া বিরাট পাথর ঘাবড়ে দিল তাকে, একলাফে ঢুকে পড়ল ঝোপের মধ্যে। আর বেরোল না।
পটিকে নিয়ে গাছ বেয়ে ওপরে উঠে আসতে যথেষ্ট কসরত করতে হলো মুসাকে। গাছের মাথার কাছে পৌঁছে একটা ডাল বেয়ে চলে এল খাদের কিনারে। হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে টেনে নিল কিশোর আর রবিন।
মুসাও নেমে উঠে এল খাদের কিনারে। প্রচণ্ড পরিশ্রমে দরদর করে ঘামছে।
উত্তেজনা শেষ হয়ে যেতে হঠাৎ করেই যেন ক্লান্তিতে হাঁটু ভেঙে আসতে লাগল তিনজনের। খাদের কিনার থেকে সরে গিয়ে বসে পড়ল মাটিতে।
রবিন বলল, একটা খেলা দেখালে বটে তুমি, মুসা! টারজান ছবিতে হীরোর রোলটা চাইলেই তোমাকে দিয়ে দেবে পরিচালক।
মুসা বলল, কাজে লেগেছে কিশোরের পাথর ফেলাটা। ওটা না পড়লে ভয়ও পেত না, যেও না জানোয়ারটা। পটি আর আমি দুজনেই মরতাম!
ফোঁপাচ্ছে এখনও পটি। তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিল রবিন, কেঁদো না, আর ভয় নেই। বাড়ি নিয়ে যাব তোমাকে। কুকুরটাকে খুঁজতে এসেছিলে তো? ওটাকেও পেয়ে গেছি আমরা। শীঘ্রি এনে দেব।
সত্যি পেয়েছ?
হ্যাঁ।
এ ভয়ে, ক্লান্তিতে অবশ হয়ে গেছে ছেলেটা, হাঁটারও শক্তি নেই। তাকে কোলে তুলে নিল মুসা। টর্চ জেলে আগে আগে চলল কিশোর, পেছনে রইল রবিন। সতর্ক রইল, অন্য কোন দিক দিয়ে ঘুরে এসে যাতে আক্রমণ চালাতে না পারে জানোয়ারটা। ঢাল থেকে নেমে, উপত্যকা পার হয়ে কেবিনে ওঠার পথটায় পড়ল ওরা। নিরাপদেই উঠে এল ওপরে। বিদ্যুতের বিরাম নেই, থেকে থেকেই চমকাচ্ছে। বনের বাইরে বেরিয়ে এসে এখন আকাশ চোখে পড়ছে। দেখা গেল, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, একখানে জড় হতে পারছে না, তীব্র বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইতিউতি।
কেবিনের পাশের খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে দূরে হাত তুলে দেখাল রবিন, ওই দেখো, ওটা কি?
আলো! হোলোর অন্যপ্রান্তের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু কিসের আলো?
ডোবারের কেবিনটার ওপর থেকে আসছে না?
সে-রকমই লাগছে, কিশোর বলল। কিছু একটা ঘটছে ওখানে।
চলো, আগে পটিকে বাড়ি দিয়ে আসি। তারপর দেখতে যাব। সব কিছুর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব আজ 1 রহস্যের মধ্যে এ ভাবে লটকে থাকতে ভাল লাগছে না আর।
পথ বেয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এসে গাড়িতে উঠল ওরা। মিসেস ভারগনের বাড়ির সামনে এসে থামল। সব ঘরে আলো জ্বলছে। গাড়ির শব্দ শুনে পাগলের মত ছুটে বেরোলেন মহিলা। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, আমাকে সাহায্য করো! পৃটিকে খুঁজে পাচ্ছি না! নিশ্চয় বনের মধ্যে হারিয়ে গেছে! সেই ভয়ঙ্কর ডাক শুনলাম…
জানালা দিয়ে মুখ বের করে ডাকল পটি, মা, এই যে আমি!
হাঁ হয়ে গেল বিস্মিত মা।
দরজা খুলে দিতেই পটি নেমে গেল। ছুটে এসে তাকে কোলে তুলে নিল মা। বুকে চেপে ধরে চুমু খেতে লাগল।
কুত্তা খুঁজতে বনে চলে গিয়েছিল সে, মুসা জানাল মিসেস ভারগনকে। ওকে তো পেয়েছিই, ওর কুত্তাটাকেও পেয়ে গেছি আমরা। দু-একদিনে মধ্যেই এনে দেব।
ব্ল্যাক হোলোতে পেয়েছ ওকে? এই অন্ধকারে ঝড়ের মধ্যে ওই ভয়ঙ্কর জায়গায় চলে যাওয়ার মত দুঃসাহস করেছে তার ছেলে, এ কথা বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মহিলা।
হ্যাঁ, ওখানেই পেয়েছি।
কুত্তাটাকে না পেয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। আর থাকতে না পেরে আজ… ডাইনীর কথা ভেবেই বোধহয় থমকে গেল মহিলা। শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কিছু হয়নি তো তোর, পটি?
অভয় দিয়ে বলল কিশোর। না, কোন ক্ষতি হয়নি। নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিন। সকালে সব কথা ও-ই বলবে আপনাকে। ডাইনীটা আসলে কি, তা-ও জানাবে।
আবার এসে গাড়িতে চড়ল তিন গোয়েন্দা। এতটাই অবাক হয়েছে মিসেস ভারগন, ওদেরকে ধন্যবাদ জানানোর কথাও ভুলে গেল। ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল গাড়িটার দিকে।
মূসাকে নির্দেশ দিল কিশোর, ডোবারের কেবিনটা যে পাশে আছে, ঘুরে ওখানটায় চলে যাও।
রাস্তা নেই, উঁচুনিচু জমির ওপর দিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোল গাড়ি। খাদের একেবারে কিনার ঘেষে চলছে। ছোট ছোট ঝোপ মাড়িয়ে যাচ্ছে। নিচু ডাল বাড়ি লাগছে উইন্ডশীল্ডে। গতি, একেবারে কমিয়ে রেখেছে মুসা। শক্ত হাতে ধরেছে স্টিয়ারিং। সামান্য একটু এদিক ওদিক হলেই, স্টিয়ারিং ভুল। ঘোরালেই পড়বে গিয়ে খাদে।
হেডলাইটের আলো পড়ল আরেকটা গাড়ির ওপর। খাদের, একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে আছে, পুরানো একটা জেলপি। রবিন বলল, খারাপ হয়ে গেছে বোধহয়। ফেলে রেখে গেছে।
এগিয়েই চলল মুসা, রহস্যময় আলোটার সন্ধানে, খানিক আগে কেবিনের কাছে দাঁড়িয়ে যেটা দেখা গেছে।
আরও কিছুদূর এগোতেই মোটামুটি চওড়া খোলা একটুকরো জায়গায় ঢুকল গাড়ি। আরেকটু এগোলেই ডোবারের কেবিনের ওপর চলে যাবে, যেখানটায় আলো দেখেছে। থেমে গেল মুসা। কি করবে জিজ্ঞেস করল কিশোরকে।
আর এগিও না। এখানেই গাড়ি ঘুরিয়ে রেডি রাখো, কিশোর বলল। দরকার পড়লে যাতে এসেই দৌড় দিতে পারি। তখন হয়তো আর ঘোরানোর সময় থাকবে না।
বাতাসের বেগ বেড়েছে। যে কোন মুহূর্তে বনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঝড়। অনেক ডালপালা ছড়িয়ে আকাশের এমাথা ওমাথা চিরে দিয়ে গেল। বিদ্যুৎ-শিখা, সঙ্গে সঙ্গে কানফাটা শব্দে বাজ পড়ল। তারপর এত ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল, টর্চ জ্বালার আর প্রয়োজন হলো না।
সরু পথে চলতে চলতে থমকে দাঁড়াল ওরা। কথা শোনা গেল, এই যে, ধরো তো এটা।
চট করে ঝোপের আড়ালে ঢুকে গেল গোয়েন্দারা। যেদিকে কথা শোনা গেছে তাকিয়ে রইল সেদিকে। আবার বিদ্যুৎ চমকালে দেখল, একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে লম্বা একটা বাক্স নামাচ্ছে দু-জন লোক। নামিয়ে নিয়ে ঢুকে পড়ল গাছপালার মধ্যে, হোলোর কিনারের দিকে।
কোথায় গেল? ফিসফিস করে বলল রবিন, ওদিকে তো জায়গা নেই। না জেনে এগোলে পড়ে যাবে নিচে।
উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল গোয়েন্দারা, কিন্তু লোকগুলো ফিরল না।
গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে কিশোর। অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব যেন মিলতে আরম্ভ করেছে। সমাধান হয়ে আসছে ধাঁধার। বলল, শোনো, পিচার দুটো পেচা একে কেন কেটে দিয়েছিল, বুঝে গেছি। ও বোঝাতে চেয়েছে, চিৎকারগুলো পাখিতে করেনি, করেছে মানুষে। এক ঢিলে দুই পাখি মারে কেউ। যারা ট্রাক নিয়ে আসে পেঁচার ডাক ডেকে তাদেরকে সঙ্কেতও দেয়, আবার আশপাশের মানুষকে হুঁশিয়ারও করে: খবরদার, এদিকে এসো না; এখানে ডাইনী আছে! সেটাকে আরও জোরদার করার জন্যে কুকুর চুরি করে। ভয় পেয়ে কেউ এদিকে না এলে নিরাপদে মাল খালাস করতে পারে ওরা।
কুকুরগুলোকে এনে কি করে তা-ও বুঝে ফেলেছি! রবিন বলল, নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয় চোরাই মার্কেটে। পটিরটা বোধহয় তাড়াহুড়োয় বেচতে পারেনি, দিয়ে এসেছে ডরোথির কাছে।
তারমানে বেআইনী কিছু করছে ওরা এখানে? মুসার প্রশ্ন।
তাতে কোন সন্দেহ আছে কি? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
কি করছে?
আমার তো মনে হচ্ছে, হঠাৎ করে এই এলাকায় যে শুরু হয়েছে, সেটা এদেরই কাজ। ডোবারও এতে জড়িত।
ঠিক, রবিন একমত হলো। সেটা কোনভাবে জেনে গিয়েছিলেন হয়তো ক্যাপ্টেন রিচটন, ওদেরকে মাল খালাস করতে দেখে ফেলেছিলেন, সে জন্যেই তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
মেরে ফেলেনি তো? শঙ্কিত হয়ে উঠল মুসা।
কতটা বেপরোয়া ওরা, সেটা এখনও জানি না, জবাব দিল কিশোর। তবে খুনের ঝুঁকি নেয়ার চেয়ে আটকে রাখাটাই নিরাপদ মনে করবে। কিন্তু কোথায় আটকাল? আরেকটা কথা মনে আছে, সেদিন ডোবারের সঙ্গে কথা বলার সময় দরজা লাগানোর শব্দ শুনেছিলাম, কিন্তু রান্নাঘরে ঢুকে কোন দরজা দেখিনি?
আছে, জানাল দু-জনেই।
কোথায় সেই দরজাটা?
জবাব দিতে পারল না কেউ।
আমার বিশ্বাস, কিশোরই বলল, রান্নাঘরের মধ্যেই কোথাও আছে ওটা, লুকানো, গুপ্তদরজা।
আর কোন কথা হলো না। চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল তিনজনে। করতে করতে অস্থির হয়ে উঠল, কিন্তু ওরা আর আসে না।
দেখা দরকার কোথায় গেল, কিশোর বলল। তোমরা এসো আমার পেছনে। দূরে দূরে থাকবে। ধরা পড়লে যাতে একজন পড়ি, অন্য দুজন, পালাতে পারি।
ঝোপের আড়ালে আড়ালে পা টিপে টিপে এগোল সে। তার পেছনে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে রবিন, সবশেষে রইল মুসা।
লোকগুলোকে দেখা গেল না কোথাও। খাদের কিনারে গাছের সারির কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। একটু পর মুসা আর রবিনও চলে এল তার পাশে। খোলা জায়গায় না থেকে বসে পড়ল ঝোপের আড়ালে। নিচে উঁকি দিল।
তাদের সামনে কোন গাছপালা নেই, পাথরের দেয়ালটা প্রায় খাড়া হয়ে নেমে গেছে উপত্যকায়।
শাঁই শাঁই করে বইছে ঝোড়ো বাতাস। তাদের পেছনে সাংঘাতিক দুলছে গাছপালাগুলো। এই ঝোপের কাছেও বাতাসের শক্তি অনুভব করতে পারছে ছেলেরা। বিদ্যুতের আলোয় ব্ল্যাক হোলোর অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ডোবারের কেবিনটাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু লোকগুলোকে চোখে পড়ল। অবাক কাণ্ড! গেল কোথায় ওরা?
ওপরেও নেই, নিচেও নেই, বিড়বিড় করল রবিন, তাহলে গেল কোথায়? আর নিচেই যদি গিয়ে থাকে, নামল কোনখান দিয়ে? যা দেয়ালের দেয়াল, নিচে নামাই মুশকিল, সঙ্গে আছে আবার ভারী বাক্স!
ওরা যেখানে রয়েছে তার ঠিক নিচে নয় কেবিনটা, ওটার ওপরে যেতে হলে একপাশে আরও খানিকটা সরতে হবে। ওখানটায় গেলে লোকগুলোকে দেখা যেতে পারে ভেবে উঠে দাঁড়াল কিশোর। পেছনে আগের মত দূরত্ব রেখে আসতে বলল রবিন আর মুসাকে।
খাদের কিনার ধরে এগোল তিনজনে, একজনের পেছনে আরেকজন।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল কিশোর। বিদ্যুৎ চমকাল এই সময়। অবাক হয়ে রবিন আর মুসা দেখল, খানিক আগেও যেখানে ছিল গোয়েন্দাপ্রধান, সেখানে নেই সে, অদৃশ্য হয়ে গেছে!
.
১৫.
কিশোর কিশোর! বলে চিৎকার দিয়ে দৌড় মারল রবিন। মুসা ছুটল তার পেছনে। কিশোর, কোথায় তুমি?
সাড়া নেই। বিদ্যুৎ চমকাল বড় করে, দীর্ঘ একটা মুহূর্ত সবকিছু আলোকিত করে রেখে দপ করে নিভে গেল। আশপাশটা পরিষ্কার চোখে পড়ল ওদের। এবারও দেখা গেল না কিশোরকে। ওই লোকগুলোর মতই সে-ও গায়েব হয়ে গেছে।
গেল কোথায় ও! ককিয়ে উঠল রবিন। তার কথা ঢেকে দিল প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দ।
আবার চমকাল বিদ্যুৎ। আকাশটাকে যেন ফেড়ে ফেলে তার ভেতরটা দেখিয়ে দিতে চাইল। মনে হলো, এতক্ষণ মেঘগুলোকে ধরে রেখেছিল যে চাদরটা, সেটাকেও চিরে দিল বিদ্যুৎ। অঝোরে নেমে এল বৃষ্টি। গাছপালার মাথায়, পাথরের গায়ে আঘাত হানার শব্দ উঠল ঝমঝম, ঝমঝম।
কিন্তু বৃষ্টি শুরু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে আরেকটা শব্দ ঢুকল মুসার তীক্ষ্ণ শ্রবণযন্ত্রে, মনে হলো তার পায়ের নিচ থেকে এসেছে।
চিৎকার না? ওদিকে! চেঁচিয়ে উঠে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে একটা বড় ঝোপের দিকে দৌড় দিল সে। আরেকটু হলে সে-ও পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিদ্যুতের আলোয় দেখল সামনে মাটিতে গোল একটা কিছু, ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল সে।
টর্চের আলো ফেলল দুজনে। মাটিতে একটা গর্ত। ঝোপটার আড়ালে থাকায় দূর থেকে চোখে পড়ে না। উঁকি দিয়ে দেখল, একধার থেকে একটা কাঠের স্লাইড নেমে গেছে। আরেকধার থেকে উঠেছে একটা কাঠের সিঁড়ি।
নিচ থেকে ওদের নাম ধরে ডাকছে কিশোর।
তাড়াতাড়ি নামার জন্যে সাবধানে সাইডের ওপর বসে দুহাতে দু-ধার খামচে ধরল মুসা। পার্কের স্লিপারে বসলে যেমন হয়, তেমনি সড়াৎ করে নেমে চলে এল নিচে। তার পেছনে বসেছিল রবিন, সে এসে পড়ল তার গায়ের ওপর।
মাটিতে পড়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল দু-জনে।
অন্ধকারে কিশোরের গলা শোনা গেল, টর্চ জ্বালো! আমারটা হারিয়ে ফেলেছি!
হলুদ আলো পড়ল পাথরের দেয়ালে। একটা কুয়ার মধ্যে রয়েছে ওরা। সুড়ঙ্গমূর্খ দেখা গেল।
নিশ্চয় এটা চোরের আড্ডা, নিচু স্বরে বলল রবিন। ওই কাঠের সাইডে মালগুলো রাখে, পিছলে নেমে আসে ওগুলো কুয়ার নিচে। পরে অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেটাই দেখতে হবে, কিশোর বলল।
সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল ওরা। সাবধানে এগোল। কিছুদূর এগোতে সামনে দেখা গেল একটা কাঠের দরজা।
খুলব? রবিনের প্রশ্ন।
না খুললে দেখব কি করে?
এগিয়ে গিয়ে ঠেলা দিল কিশোর। ভেতরের দিকে খুলে গেল পাল্লাটা।
ওপাশে তাকিয়েই থ হয়ে গেল ওরা। পাথর কুঁদে তৈরি চারকোনা একটা ঘর, একটা প্যারাফিনের ল্যাম্প জ্বলছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাধা একজন মানুষ। পড়ে আছে একটা ক্যাম্পখাটে। এলোমেলো ধূসর চুল। শব্দ শুনে দুর্বল ভঙ্গিতে মুখটা ঘুরল এদিকে।
ক্যাপ্টেন রিচটন? ছুটে গেল রবিন।
কে তোমরা? দুর্বল কণ্ঠস্বর মানুষটার।
জানাল কিশোর, আমরা গোয়েন্দা। মিস্টার সাইমন আপনার চিঠি পেয়েছেন।
আশার আলো ঝিলিক দিল রিচটনের চোখে, সে কোথায়? মাথা তুললেন তিনি।
তিনি জরুরী কাজে ব্যস্ত। সেজন্যেই আমাদের পাঠিয়েছেন।
আলো নিভে গেল আবার চোখ থেকে। গড়িয়ে পড়ে গেল মাথাটা। একজন দক্ষ গোয়েন্দার পরিবর্তে তিনটে ছেলেকে দেখে নিরাশ হয়েছেন রিচটন, সেটা বুঝে কিশোর বলল, কদিন ধরেই এখানে আপনাকে খোঁজাখুঁজি করছি, ক্যাপ্টেন। আজকে পেলাম। এখন সাবধান থাকতে হবে আমাদের, নইলে বিপদে পড়ব। ডোবার আর তার চ্যালারা কোথায় আছে, এখনও জানি না।
আমি জানি ওরা কোথায়, কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসলেন ক্যাপ্টেন। পাথরের কেবিনটাতে। এই ঘর থেকেও যাওয়া যায়, ওই দরজা দিয়ে। কিশোররা যেদিক দিয়ে ঢুকেছে তার উল্টো দিকের আরেকটা দরজা দেখালেন তিনি।
তার শার্টের ছেঁড়া জায়গাগুলো চোখ এড়াল না কিশোরের। ঝোপের কাটায় আটকে থাকা কাপড়ের টুকরোগুলো এটা থেকেই ছিঁড়েছে, বুঝতে পারল।
তোমরা একা কিছু করতে পারবে না, গিয়ে শেরিফকে জানাও, পুলিশ নিয়ে এসো। ওরা ডাকাত, ভয়ঙ্কর লোক। দলটা লুটপাট করে বেড়ায় বাইরে বাইরে, মাল এনে লুকিয়ে রাখে এখানে। ডোবার ওদের নেতা, উকিল হুগারটাও আছে তার দলে। তোমাদেরকে এখানে দেখে ফেললে বিপদ হবে।
চলুন আপনাকে বের করে নিয়ে যাবে, মুসা বলল। কুয়াটাতে একটা সিঁড়ি আছে। সেটা বেয়ে ওপরে ওঠা যাবে। ওই পথেই ঢুকেছি আমরা, পালাতেও পারব। ওরা কিছু জানবেই না।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলল, কিন্তু ওরা যখন দেখবে, ক্যাপ্টেন নেই, বুঝবে খেল খতম। গা ঢাকা দেবে। ধরতে আর পারব না।
তুমি ঠিকই বলেছ, একমত হলেন ক্যাপ্টেন। তার চেয়ে যা বললাম, তাই করো, গিয়ে পুলিশ নিয়ে এসো…
বরং এক কাজ করো, রবিনকে বলল কিশোর। তুমি চলে যাও। শেরিফকে খবর দাও। আমি আর মুসা থাকছি এখানে।
কি ভেবে তর্ক করল না রবিন, বেরিয়ে গেল।
কিশোর আর মুসাকেও যাওয়ার জন্যে চাপাচাপি করে করে হাল ছেড়ে দিলেন ক্যাপ্টেন, যাবে না ওরা। শেষে কিশোরের প্রশ্নের জবাবে তার কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন, চিৎকারটা প্রথম যখন শুরু হলো, বিশেষ মাথা ঘামালাম না আমি। তারপর কুকুর হারাতে লাগল। মনে পড়ল ডাইনীর কিংবদন্তীর কথা। ক্যালেন্ডারে লিখে রাখতে লাগলাম ডাক কবে শোনা যায়, আর কুকুর কবে হারায়। কোনটা কি কুকুর, মালিক কে, তা-ও লিখলাম, পরে যাতে ভুলে না যাই সে-জন্যে। দুটো ঘটনার মধ্যে একটা যোগাযোগ লক্ষ করলাম। সেজন্যেই ভিকটরকে চিঠি লিখেছিলাম, জানি, এ সব উদ্ভট রহস্যগুলোতে কাজ করে আনন্দ পায় সে। শেরিফকে গিয়ে বলতে পারতাম, কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত একজন পুলিশ অফিসার এ সব গুজবে বিশ্বাস করে তদন্তের সাহায্য চাইতে গেছি দেখলে মনে মনে হাসত সে। ভাবত, বুড়োটার মাথায় দোষ পড়ে গেছে।
আপনি কি ডাইনী বিশ্বাস করেন? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল মুসা।
না। তবে ব্যাপারটা বেশ দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিল। তলে তলে সিরিয়াস কিছু একটা ঘটছে বুঝতে সময় লাগল। হাইজ্যাকারদের কথা আগেই শুনেছি, সন্দেহ করলাম, ওরাও এসে আস্তানা গেড়ে থাকতে পারে এখানে। তারপর একরাতে আমার ককার স্প্যানিয়েল কুকুরটাও চুরি হয়ে গেল। আর কারও অপেক্ষা না করে নিজেই তদন্ত করব ঠিক করলাম।
মাথা ঝাঁকাল কিপোর। এবং সেদিন বেরিয়েই ধরাটা পড়লেন।
হ্যাঁ, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন। সঙ্গে বন্দুক নিয়েছিলাম। হোলোতে নেমে খুঁজতে শুরু করলাম। ঝোপের মধ্যে একটা রহস্যজনক শব্দ শুনে এগিয়ে গেলাম সেদিকে, ভেতরে কে জিজ্ঞেস করলাম? জবাব পেলাম না। তারপর দেখি দুটো জ্বলন্ত চোখ, পরক্ষণেই ভয়ঙ্কর এক চিৎকার। একটা পুমা। এখানে ওই জানোয়ার দেখে খুব চমকে গিয়েছিলাম, কখনও শোনা যায়নি এই এলাকায় পুমা আছে। গুলি করতে দেরি করে ফেললাম। আমি নিশানা করার আগেই লাফ দিল ওটা। দুটো গুলির একটাও লাগাতে পারলাম। আমাকে ধরার জন্যেই লাফ দিয়েছিল, কিন্তু গুলির শব্দে ভয় পেয়ে পালাল। মনে হলো, পুরোপুরি বুনো নয়। তা ছাড়া কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।
গুলির খোসাগুলো পেয়েছি আমরা, মুসা বলল।
গুলির শব্দ শুনে চুপি চুপি দেখতে এল ডোবার। পেছন থেকে মাথায় বাড়ি মেরে বেহুশ করে ফেলল আমাকে। জ্ঞান ফিরলে দেখি, ডোবারের কেবিনটাতে শুয়ে আছি। রান্নাঘরের দেয়ালে পাথরের একটা গোপন দরজা খুলছে সে। আগে থেকে জানা না থাকলে দরজাটা আছে ওখানে বোঝাই যায় না।
বেহুঁশের ভান করে পড়ে রইলাম। আমাকে হিঁচড়ে হিঁচড়ে একটা গলি পার করে আনল সে, তারপর একটা ঘর–একধারে অনেকখানি জায়গায় শিক লাগিয়ে আলাদা করা, হাজতের মত; এবং সবশেষে নিচু একটা দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে এনে ফেলল এই ঘরটায়। তারপর থেকেই আছি। একটাই ভরসা ছিল আমার, ভিকটরকে চিঠি লিখেছি, সে আসবেই। কেবিনে আমাকে না পেলে খুঁজে বের করবে।
অথচ তিনি কল্পনাও করেননি আপনি এই বিপদের মধ্যে আছেন,. কিশোর বলল। তাহলে সব কাজ বাদ দিয়ে নিজেই ছুটে আসতেন।
ওরা এসে কি কি করেছে রিচটনকে বলতে লাগল সে। হুগারফ তার। কাছে টাকা পায় বলেছে শুনে রেগে উঠলেন ক্যাপ্টেন, মিথ্যে কথা! আমার কাছে কেউ টাকা পায় না। ওই বাহানা করে ও তোমাদের খোঁজ নিতে। গিয়েছিল। ওর মত একটা চোরের কাছে টাকা নিতে যাব কেন আমি?
হে আমরাও বিশ্বাস করিনি একথা। বরং বলে তার ওপর আমাদের সন্দেহ জাগিয়েছে।
পেঁচার ডাকটা যে আসলে পেঁচার নয়, মানুষই ওরকম করে ডেকে সঙ্কেত দেয়, তার এই সন্দেহের কথা জানাল কিশোর।
ঠিকই অনুমান করেছ তুমি। দুই রকম পেঁচার ডাক ডাকে সে। একভাবে ডেকে হাইজ্যাকারদের বোঝায়, রাস্তা পরিষ্কার, চলে এসো। আরেক ভাবে ডেকে বলে, বিপদ, চলে যাও। এই দ্বিতীয় ডাকটা শুরু করেছে। তোমরা আসার পর।
তারমানে আমাদের ভয় পায় সে? মুসার প্রশ্ন।
হ্যাঁ, পাই, দরজার কাছ থেকে বলে উঠল একটা পরিচিত, ভারী কণ্ঠ।
ঝট করে ঘুরে তাকাল দুই গোয়েন্দা। হাতে লম্বা নলওয়ালা সেই পিস্তলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডোবার। নিঃশব্দে দরজা খুলে কখন ঢুকে পড়েছে টেরই পায়নি কেউ। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দু-জন লোক, একজনকে চেনে গোয়েন্দারা–উকিল আর্নি হুগার। আরেকজনের বিশাল দেহ, রুক্ষ চেহারা।
স্বাগতম, রসিকতার ঢঙে বলল ডোবার, সুন্দরভাবে সমাধান করে ফেলেছ কেসটার। এমনকি পেঁচার ডাকের রহস্য ভেদ করে ফেলেছ, ভাল গোয়েন্দা তোমরা, বুদ্ধি আছে। ডাকগুলো আমিই ডেকেছি, একেবারে আসলের মত হয়েছিল, তাই না? কিন্তু বুদ্ধিটা খারাপ জায়গায় খাঁটিয়েছ, এর জন্যে খেসারত দিতে হবে তোমাদের। কিংবা পুরস্কারও বলতে পারো, জ্যান্ত ডাইনীর সাক্ষাৎ পাবে। তো, তোমাদের আরেক বন্ধু কোথায়?
চুপ করে রইল মুসা আর রবিন।
হুঁ, এরা বলবে না। হঠাৎ বদলে গেল তার কণ্ঠস্বর, হাসি হাসি ভাবটা চলে গিয়ে কঠিন হয়ে উঠল চেহারা। কর্কশ কণ্ঠে বিশালদেহী লোকটাকে বলল, ফেরেল, নিশ্চয় বাইরে কোথাও আছে। ধরে নিয়ে এসো। ও পালালে মুশকিল হয়ে যাবে আমাদের।
মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল ফেরেল।
হুগারফ রইল রিচটনের পাহারায়, আর পিস্তলের মুখে দুই গোয়েন্দাকে নিয়ে চলল ডোবার।, একটা গলিপথ পেরিয়ে আরেকটা ঘরে এসে ঢুকল, যেটাতে হাজতের দরজার মত শিক লাগানো আছে বলেছিলেন রিটন।
ডোবারের টর্চের আলোয় পাথরের ঘরটা দেখতে পাচ্ছে দুই গোয়েন্দা। পেছনের দেয়ালের কাছটায় তেরপল দিয়ে ঢাকা রয়েছে কিছু। বাতাস ভারী আর ভেজা ভেজা এখানে মাটির নিচের ঘর বলেই বোধহয়; কিন্তু তার সঙ্গে মিশে আছে কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ!
কোয়ার্টার পছন্দ হয়েছে? হেসে ছেলেদের জিজ্ঞেস করল ডোবার। প্রাকৃতিক গুহাই ছিল এগুলো, খুড়ে খুঁড়ে বড় করেছে ক্রীতদাসপ্রথার। বিরোধিতা করেছিল যারা, তারা। এখানে এসে লুকিয়েছিল। খুব চালাক ছিল ওরা স্বীকার করতেই হবে। কুত্তা চুরি আর রাতে বিকৃত চিৎকার করে করে : ডাইনীর কিংবদন্তীটাকে জাগিয়ে তুলেছিল ওরা, লোকে ভয় পেয়ে আর হোলোর কাছে ঘেঁষত না। ক্রীতদাসদের লুকিয়ে থাকার সুবিধে হত। ইতিহাসের সেই অধ্যায়টাকেই আবার কাজে লাগিয়েছি আমি এত বছর পর, প্রশংসা করবে না?
করতাম, যদি ওদের মত সৎ উদ্দেশ্য থাকত আপনার, কিশোর বলল। কিন্তু আপনি তো করছেন অপরাধ, হাইজ্যাকিঙের মত জঘন্য অপরাধ। ভাল কথা, ভব কোথায় আছে জেনে গেছি আমরা।
মুহূর্তের জন্যে বিস্ময় দেখা দিল ডোবারের চোখে, তারপর সামলে নিল, কি বলছ বুঝতে পারছি না।
বন্য মানুষের মুখোশ পরে আমাদের ফাঁকি দেয়ার ব্যাপারটাও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন না?
না, তা পারছি, হাসিমুখে স্বীকার করল ডোবার। আমিই পিচার সেজেছিলাম, রবারের মুখোশ আর কালো পরচুলা পরে। এ মহাপুরুষের কাজ করেছেন, ডোবারের এই হাসি হাসি ভাবটা সহ্য করতে না পেরে রেগে উঠল মুসা। আমাদের নিয়ে এখন কি করবেন, সেটা শুনতে চাই।
ডোবার বুঝতে পারল অসাধারণ স্নায়ুর জোর এই ছেলেগুলোর, এত সহজে ভয় ধরাতে পারবে না ওদের মনে। কঠিন পথটাই বেছে নিল সে। এগিয়ে গেল তেরপলে ঢাকা জায়গাটার দিকে।
ডাইনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হোক এবার! নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাটা বলে একটানে তেরপল সরিয়ে নিল। বেরিয়ে পড়ল একটা লোহার খাঁচা। ভেতরে শক্তিশালী একটা জানোয়ার। ম্লান আলোতে ঝিক করে উঠল ওটার সবুজ চোখ।
ডাইনীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চিৎকারগুলোর জন্যে এটাকে দায়ী করতে পারো, ডোবার বলল। যখন শুনলাম আমার ভাই নুবার একটা পুমাকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে না পেরে বিক্রি করে দিতে চায়, টরিকে পাঠালাম–ওটা কিনে নিয়ে আসতে। তবে আমি যে কিনছি জানতে দিলাম না নুবারকে। ভাবলাম, জানোয়ারটা পেলে অনেক কাজে লাগাতে পারব। আমার আন্দাজ ভুল হয়নি।
আধমরা ভেড়া কেন কিনেছিল ডোবার, এখন নিশ্চিত হলো গোয়েন্দারা। পুমাকে খাওয়ানোর জন্যেই।
মুসা বলল, আপনার ভাইই যে জানোয়ারকে কন্ট্রোল করতে পারেনি, সেটাকে আপনি করছেন কি করে?
মিটিমিটি হাসছে ডোবার। জন্তু-জানোয়ারকে কন্ট্রোল করার একটাই উপায়, পিটুনি দেয়া, নিষ্ঠুর ভাবে পেটাতে হবে। পুমাটা এখন বুঝে গেছে কে তার মনিব। আমার সঙ্গে তো কই গোলমাল করে না, ভয় পায়।
আজ রাতে ওটাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাই না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ। খাঁচার পেছনে ওই দরজাটা দেখছ না, ওটা খুলে দিই, বেরিয়ে যায়। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ আছে, ও পথে বেরোয়। তবে বেরোতে দেয়ার আগে ঘুমের বড়ি মেশানো খাবার খাইয়ে দিই, যাতে বেশি গোলমাল না করে। পালানোর বুদ্ধি না হয়। প্রতিবারেই ফিরে এসেছে ওটা।
তবে আজ রাতে ডোজ বোধহয় কম হয়ে গিয়েছিল, কিংবা অন্য কোন কারণে তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে ওষুধের ক্ষমতা, ফলে খেপে উঠেছিল। সে জন্যেই পর পর দুবার পেঁচার ডাক ডাকতে হয়েছিল, সব ঠিক আছে জানানোর পর পরই জানাতে হয়েছিল আমার লোকদের, ঠিক নেই, সাবধান হও। তবে ভাগ্য ভাল, কারও কোন ক্ষতি না করেই খাঁচায় ফিরেছে পুমাটা। হয়তো তার সামনে পড়েনি কেউ। পড়লে ছাড়ত বলে মনে হয় না।
ছাড়েন কেন? মূসার প্রশ্ন।
কে ওটার গু সাফ করবে? বাইরেই সেরে আসতে পাঠাই। আরেকটা কারণ আছে, যেদিন আমাদের কাজ থাকে সেদিন পাহারা দেয়ার কাজটাও অনেকটা ওকে দিয়ে করাই। ব্ল্যাক হোলোতে অচেনা কেউ ঢুকলে ঠেকাবে। ও বাইরে বেরোলে আরও একটা উদ্দেশ্য সফল হয় আমাদের, ওই যে বললাম, ডাইনী। চিৎকার করে। ওর ভয়াবহ ডাক শুনে লোকে ভাবে ডাইনীর। চিৎকার। ভয়ে আর এ পথ মাড়ায় না কেউ। সাধারণ একটা পুমার কাছে আর। কত কাজ চাও?
আজকে অবশ্য নতুন একটা কাজ করাব ওকে দিয়ে। রহস্যময় কণ্ঠে বলল ডোবার। খাঁচার এদিকেও একটা দরজা আছে, শেকল টেনে তুলে। নেয়া যায়। পালাতে যদি চাও, মুচকি হেসে আবার চোখ টিপল সে, সহজ একটা পথ বাতলে দিতে পারি। এদিককার দরজাটা তুলে ফেলবে, তারপর ওদিকেরটা, আর কোন বাধা থাকবে না, পুমাটাকে ডিঙিয়ে কেবল ওপাশের সুড়ঙ্গে গিয়ে ঢুকবে। ব্যস, বেরিয়ে যেতে পারবে।
ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজা লাগাল সে। বাইরে থেকে ভারি খিল তুলে দিল। চেঁচিয়ে বলল, ও, নতুন কাজটা কি, বলতে ভুলে গেছি। আরও একটা শেকল আছে আমার এখানে। এটা টেনেও খাঁচার তোমাদের দিকের দরজাটা ভোলা যায়। ভাবছি, আজই রাতে কোন একসময় সেটা তুলে নেব। গুডবাই।
টর্চ নিয়ে গেছে ডোবার। ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে। তবে নিজের টর্চটা শার্টের মধ্যে লুকিয়ে ফেলেছিল মুসা, সেটা বের করে নিয়ে আলো জ্বালল। পরীক্ষা করে দেখতে লাগল তাদের বন্দিশালাটা।
নাহ, কোন পথ নেই, দেখেটেখে নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। আমাদের একমাত্র ভরসা এখন রবিন। নিরাপদে বেরিয়ে গিয়ে পুলিশ নিয়ে যদি ফিরে আসতে পারে!
অহেতুক ব্যাটারি নষ্ট না করে আলোটা নিভিয়ে দিল মুসা। গভীর অন্ধকারে ঢেকে গেল ঘর। মাত্র কয়েক ফুট দূরে খাঁচার মধ্যে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছে পুমাটা।
অনেকক্ষণ পর বাইরের করিডরে কথা শোনা গেল। ডোবার বলছে, ছেলেটাকে পেলে না?
না, বস, জবাব দিল ফেরেলের খসখসে কণ্ঠ। কুয়ার বাইরে বেরিয়েই শুনলাম গাড়ির শব্দ। লাল কনভারটিবলটা চলে যাচ্ছে। বুঝলাম, কোন কারণে ছেলেটা পালাচ্ছে। ট্রাক নিয়ে পিছু নিলাম। কিন্তু সাংঘাতিক গাড়ি ওর, চালায়ও ভাল, কাছেই যেতে দিল না আমাকে…
আর তুমিও পরাজিত হয়ে ফিরে এলে, গর্দভ! গর্জে উঠল ডোবার। জানো, এখন আমাদের কি হবে…
কিছুই হবে না, বস, ও আর কিছু করতে পারবে না আমাদের হাসি শোনা গেল বিশালদেহী লোকটার। আমিও যতটা সম্ভব গতি বাড়ালাম। এত্তবড় ট্রাক নিয়ে কি আর ওই গাছপালার মধ্যে জোরে চলা যায়, বলুন? তবে। থামলাম না। মোড় নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল গাড়িটা। একটু পরেই শুনলাম সাংঘাতিক শব্দ। গিয়ে দেখি, নিচে পড়ে আগুন ধরে গেছে গাড়িতে। ওই গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাচবে ও? অসম্ভব!
গুড! শান্ত হয়ে এল ডোবার। একটা ঝামেলা নিজে নিজেই কমল!
অন্ধকারে যেন বরফের মত জমে গেছে কিশোর আর মুসা, অবশ হয়ে আসতে চাইছে হাত-পা।
.
১৬.
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কথা ফুটল না ওদের মুখে। তারপর বিড়বিড় করল মুসা, এ হতে পারে না, কিশোর! এটাস্পত্যি হতে পারে না!
গল্পটা আমিও বিশ্বাস করতে পারছি না, গলা কাঁপছে কিশোরের। বেরোতেই হবে আমাদের, যে ভাবেই হোক, সত্যিটা জানতে হবে!
বেরোনোর একমাত্র পথ, খাঁচার দরজাটার কাছে এসে দাঁড়াল ওরা।
শিকের কাছে এসে মাথা ঠেকিয়ে ভয়ঙ্কর সুরে গরগর করে উঠল পুমাটা।
মোজা, শার্ট, বেল্ট, সোয়েটার সব খুলে ফেলল, কিশোর বলল। একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়।
মুহূর্তে সব খুলে খাঁচার সামনে স্তূপ করে ফেলল দুজনে।
একটা জিনিসকে সব জানোয়ারই ভয় করে, বিড়বিড় করল কিশোর। দুটো বেল্টকে এক করে পাকিয়ে নিল সে, তার ওপর জড়াল সোয়েটার আর শাট। মোজা দিয়ে পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধল, যাতে সহজে না খোলে কাপড়গুলো।
কি করছ? বুঝতে পারছে না মুসা।
জবাব না দিয়ে পকেট থেকে লাইটার বের করল কিশোর। বুঝে গেল মুসা, আগুন!
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আগুনকে ভয় পায় না এমন জানোয়ার নেই।
লাইটার জেলে কাপড়ে তৈরি বিচিত্র মশালটার মাথায় আগুন ধরল সে। আগুন দেখেই চাপা গর্জন করতে করতে খাঁচার দরজার কাছ থেকে সরে গেল পুমাটা। টর্চ নিভিয়ে দিল মুসা। কিন্তু অন্ধকার হলো না আর ঘরটা, মশালের আলোয় আলোকিত। বিহূত ছায়া নাচছে দেয়ালে।
কি ঘটে পরীক্ষা করে দেখার জন্যে মশালটা খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে। পূমাটাকে খোঁচা মারার ভঙ্গি করল কিশোর। গর্জে উঠে একলাফে সরে গেল ওটা। মুচকি হাসল সে। বুঝল কাজ হবে। মুসাকে বলল, শেকল টেনে আস্তে আস্তে দরজাটা তোলে।
লোহায় লোহায় ঘষা লাগার শব্দ তুলে উঠে যেতে শুরু করল দরজাটা। সামনে মশাল বাড়িয়ে ধরে ঢুকে গেল কিশোর। এগোল পুমাটার দিকে। ভয়ে, রাগে হিসিয়ে উঠে খাঁচার দেয়ালে নিজেকে ঠেসে ধরল ওটা। বিশাল থাবা বাড়িয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করতে চেয়েও আবার পিছিয়ে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে ওটাকে পেছনের দরজাটার কাছে নিয়ে গেল কিশোর। জানোয়ারটার ওপর থেকে মুহূর্তের জন্যে চোখ না সরিয়ে মুসাকে বলল, এই দরজাটাও তোলো।..
সবে অর্ধেক উঠেছে দরজাটা, এই সময় চিৎকার শোনা গেল পেছনে। পুমার চিৎকার আর শেকলের শব্দ কানে গেছে ডোবারের, দেখতে এসেছে কি হয়েছে। চেপে ধরল মুসাকে।
পেছনে তাকাল না কিশোর, ঝটকা দিয়ে মশালটা বাড়িয়ে দিল পুমার দিকে। গর্জন করে পিছিয়ে গেল ওটা, খোলা দরজা দিয়ে চলে গেল সুড়ঙ্গমুখে। আগুনের ভয় ক্ষুব্ধ করে তুলেছে ওটাকে। সাহস সঞ্চয় করে থাবা তুলল কিশোরকে মারার জন্যে।
মরিয়া হয়ে ওটার হাঁ করা মুখে মশালটা ঠেসে ধরল কিশোর।
পুরোপুরি সাহস হারাল পুমাটা। আগুনের আঁচে ঝলসে গেছে মুখ। বিকট চিৎকার করে একলাফে ঘুরে দাঁড়িয়ে দিল দৌড়। হারিয়ে গেল সুড়ঙ্গের অন্ধকারে। মশাল হাতে কিশোরও ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গে। চেঁচিয়ে উঠে তার পিছু নিল ফেরেল।
বেশি লম্বা না সুড়ঙ্গটা। অল্পক্ষণেই বেরিয়ে চলে এল কিশোর। পুমাটাকে চোখে পড়ল না কোথাও। বনে ঢুকে পড়েছে।
কিশোরও ঢুকে পড়ল। হাতে যতক্ষণ আগুন আছে, জানোয়ারটাকে ভয় নেই। কিন্তু বেশিক্ষণ রাখতে পারল না ওটা। পিস্তলের গুলি ফুটল টাশশ করে। কানের পাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল বুলেট। মশালটা হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে ডাইভ দিয়ে গিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে পড়ল সে।
ছুটে আসছে পদশব্দ। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল সে। গাছের আড়ালে আড়ালে ছুটতে লাগল। আরেকবার গুলি হলো পেছনে। তার হাতখানেক তফাতে গাছের গায়ে বিধল বুলেট। গতি আরও বাড়িয়ে দিল সে। ছুটতে ছুটতে চলে এল পাথরের ঢালের কাছে। থমকে দাঁড়াল। মুহূর্ত পরেই তার পাশের দেয়াল থেকে চলটা তুলে দিয়ে বিইঙ করে চলে গেল বুলেট।
ঢাল বেয়ে উঠতে গেলে গুলি খাবে, খোলা জায়গায় তাকে মিস করবে না ফেরেল। আর কোন উপায় না দেখে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল কিশোর।
ভোর হয়ে আসছে। ধূসর আলোয় পা টিপে টিপে লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখল সে। যে রকম বিশালদেহী, খালি হাতে এলেও তার সঙ্গে পারত না সে, তার ওপর হাতে রয়েছে পিস্তল। আত্মসমর্পণ না করলে গুলি খেতে হবে।
পাথরটার কাছে চলে এসেছে ফেরেল। হাত তুলে বেরিয়ে আসবে কিনা ভাবছে কিশোর, এই সময় উড়ে এল একটা পাথর। নিখুঁত লক্ষ্যভেদ, এই অল্প আলোতেও একটু এদিক ওদিক হলো না, ঠিক এসে ফেরেলের হাতের পিস্তলে লাগল ওটা। হাত থেকে খসে পাথরে পড়ল পিস্তলটা, গড়িয়ে চলে গেল কয়েক হাত। পরমুহূর্তে ওপর থেকে উড়ে এল একটা দেহ, ফেরেলকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
পিচার! চিৎকার করে উঠল কিশোর। তুমি কোত্থেকে…
কিন্তু জবাব দিতে পারল না বোবা ছেলেটা। কিশোরের দিকে তাকানোরও সময় নেই। ধস্তাধস্তি শুরু করছে লোকটার সঙ্গে। বেশিক্ষণ যুঝতে পারবে না সে, বোঝাই যাচ্ছে। যা করার তা-ই করল কিশোর। তাড়াতাড়ি গিয়ে তুলে নিল ফেরেলের পিস্তলটা। অপেক্ষা করতে লাগল।
পিচারের বুকের ওপর উঠে এল ফেরেল। দু-হাতে গলা টিপে ধরে ছেলেটাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারার চেষ্টা করল।
তার মাথার পেছনে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে ধমকে উঠল কিশোর, খবরদার!
ফিরে তাকাল ফেরেল। থামল না। কিশোর যে গুলি করবে না এটা বুঝে হাত বাড়াল ধরার জন্যে। যা থাকে কপালে ভেবে পিস্তনটা তুলে গায়ের জোরে লোকটার চাদিতে বসিয়ে দিল কিশোর।
টুঁ শব্দ করল না ফেরেল। আস্তে ঢলে পড়ে গেল পিচারের গায়ের ওপর।
ঠিক এই সময় দুপদাপ করে একটা শব্দ শুনে ফিরে তাকাল কিশোর। অবাক হয়ে দেখল, পড়িমরি করে দৌড় দিয়েছে ডোবার, ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় পালাচ্ছে। দেয়ালের কাছে পৌঁছেও থামল না, বেয়ে উঠতে শুরু করল।
কেন পালাচ্ছে বুঝতে পারল না কিশোর। বোঝার চেষ্টাও করল না, চেঁচিয়ে বলল, পিচার, জলদি ওটাকেও পালাতে দেয়া যাবে না! বলে সে ও পিছু নিল ডোবারের।
হরিণের গতিতে কিশোরের পাশ কাটাল পিচার। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে দেয়াল বেয়ে উঠতে লাগল।
কিশোরও বসে রইল না, তবে পিচারের তুলনায় তার ওঠাটাকে শামুকের গতিই বলা চলে।
একটা শৈলশিরায় পৌঁছে পেছন ফিরে তাকাল ডোবার। দেখল, বোবা ছেলেটাও পৌঁছে গেছে। তাকে ঘুসি মারার জন্যে হাত তুলল সে।
একসঙ্গে কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল! ডোবারের পা সই করে ডাইভ দিল পিচার। তাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল চ্যাপ্টা পাথরের ওপর। অনেক ওপরে। শোনা গেল একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার। পরক্ষণেই উড়ে এল দুশো পাউন্ড ওজনের। একটা ভারী শরীর। ডোবার আর পিচারের ওপর দিয়ে পার হয়ে গেল, পড়ল গিয়ে কয়েক গজ নিচের পাথরে। উঠে দাঁড়ানোর সাধ্য হলো না আর পুটার, গড়িয়ে পড়তে লাগল নিচে। ডোবারকে সই করেই ঝাঁপ দিয়েছিল ওটা। ওই মুহূর্তে পিচার তাকে ফেলে না দিলে এতক্ষণে শেষ হয়ে যেত আরিগনদের বংশধর।
ঘটনাটা স্তব্ধ করে দিল ডোবারকে। উঠে বসল কোনমতে, থরথর করে কাঁপছে। পালানোর চেষ্টা করল না আর, ক্ষমতাই নেই যেন শরীরের।
শৈলশিরায় পৌঁছে গেল কিশোর। পিস্তল তাক করল ডোবারের দিকে। কিন্তু তার দিকে নজর নেই লোকটার, তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। পরাজিত ভঙ্গি।
এতক্ষণে হই-হট্টগোল খেয়াল করল কিশোর। ফর্সা হয়ে গেছে পুবের আকাশ। নিচে তাকিয়ে দেখল সে, অনেক পুলিশ। জাল দিয়ে আটকে ফেলেছে পুমাটাকে।
ঢাল বেয়ে উঠে আসতে লাগল কয়েকজন পুলিশ। প্রথম যে লোকটা কাছে এল তাকেই জিজ্ঞেস করল কিশোর, রবিন ঠিক আছে? আমার বন্ধু?
আছে, জবাব দিল লোকটা।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর, গাড়িতে পুড়ে মরেনি তাহলে!
অবাক হলো পুলিশম্যান, কিসের গাড়ি!
জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না কিশোর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নামতে শুরু করল ঢাল বেয়ে। নিচে নেমে দৌড় দিল ডোবারের কেবিনের দিকে।
হাঁ হয়ে খুলে আছে একমাত্র দরজাটা। একছুটে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। থমকে দাঁড়াল।
রান্নাঘরের গোপন পাথরের দরজাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মুসা, ওটা এখন খোলা। চেয়ারে বসে আছে রবিন, রিচইন আর শেরিফ ইকার।
শব্দ শুনে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন শেরিফ। হেসে বললেন, এসো কিশোর। তোমাদের পাত্তা না দিয়ে, ডোবারের কথায় গুরুত্ব দিয়ে ভুল করেছিলাম, সরি। যাই হোক, কেসটার কিনারা করার জন্যে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ।
হাঁটু ভেঙে এল যেন কিশোরের। সমস্ত উত্তেজনা শেষ হয়ে যেতে এতক্ষণে টের পেল ক্লান্তি। ধপ করে বসে পড়ল একটা চেয়ারে।
পুরো আধমিনিট কথা বলল না সে, জিরিয়ে নিয়ে মুখ তুলে তাকাল রবিনের দিকে, এত তাড়াতাড়ি পুলিশকে খবর দিলে কি করে?
হাসল রবিন, তারপর খুলে বলল সব, বেরিয়েই গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, মিসেস ভারগনের বাড়িতে টেলিফোনের তার দেখেছি। ফরেস্টবার্গে যেতে-আসতে অনেক সময় লাগবে। তাই ভাবলাম শেরিফকে একটা ফোন যদি করতে পারি অনেক সময় বাচবে।
হঠাৎ পেছনে শুনলাম চিৎকার। তারপর ট্রাকের ইঞ্জিন চালু হলো। আসতে লাগল আমার পেছন পেছন। কেন আসছে বুঝতে পারলাম। নিশ্চয় আমাকে দেখে ফেলেছে, ধরতে আসছে। ট্রাকে কয়জন আছে জানি না। আমাকে ধরার জন্যে বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালাবে ওরা। রাস্তা যতক্ষণ খারাপ থাকবে ততক্ষণ ধরতে পারবে না জানি, কিন্তু তারপর? ওরা পিছে লেগে থাকলে পুলিশকে খবর দিতে পারব না। কি করি, কি করি, ভাবছি, এই সময় চোখে পড়ল পুরানো গাড়িটা। দেখেই একটা বুদ্ধি এল মাথায়, সিনেমায় দেখা একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ল কি করে তেড়ে আসা ডাকাতদের ফাঁকি দিয়েছিল একজন লোক।
তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে গাড়িটা ঢুকিয়ে রাখলাম একটা ঝোপে। দৌড়ে ফিরে এসে পুরানো গাড়িটায় আগুন ধরিয়ে ঠেলে ফেলে দিলাম পাড়ের ওপর থেকে। পেট্রোল ছিল ওটার ট্যাঙ্কে। দাউ দাউ করে যে ভাবে জ্বলে। উঠল, ওটার মধ্যে নিজেকে কল্পনা করে শিউরে উঠলাম। রাস্তাটা ঘোরাল আর গাছপালা ছিল বলে আমাকে এ সব করতে দেখতে পায়নি লোকটা, আসতেও দেরি হয়েছে তার। ঝোপে লুকিয়ে দেখলাম, গাড়ি থেকে নামল সে, আগুন লাগা গাড়িটা দেখল, তারপর ট্রাক নিয়ে ফিরে গেল। বুঝলাম, আমার ফাঁকি কাজে লেগেছে।
সে চলে গেলে আবার রওনা হলাম মিসেস ভারগনের বাড়িতে। খুশি। হয়েই ফোন করতে দিলেন তিনি। শেরিফকে পেতেও অসুবিধে হলো না। তিনি বললেন, এখুনি আসছি। বার বার মনে হতে লাগল, কেবিনে ফিরে আসি, তোমাদের কোন সাহায্য লাগতেও পারে। কিন্তু ভয়ও হলো, সাহায্য করতে এসে না বিপদে ফেলে দিই। দ্বিধায় দ্বন্দে ভুগতে ভুগতে মিসেস ভারগনের, বাড়িতেই বসে রইলাম পুলিশ না আসা পর্যন্ত।
দারুণ একখান কাজ করেছ, হাসল মুসা। মস্ত ফাঁকি দিয়েছ ব্যাটাকে। তবে টেলিফোনটা করে সবচেয়ে ভাল করেছ। এত তাড়াতাড়ি পুলিশ না এলে আমাদের কি হত কে জানে! ডোবার ভয়ঙ্কর লোক! ও আমাকে আর ক্যাপ্টেন রিটনকে খুন করার মতলব করছিল।
কিশোর পুমাটার পেছনে বেরিয়ে যাওয়ার পর কি হলো, জানাল মুসা। তাকে ধরে ফেলল ডোবার। গায়ে অসম্ভব জোর লোকটার, তাছাড়া হাতে পিস্তল ছিল, কাবু করতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। ওকে নিয়ে গিয়ে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে একই ঘরে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখল। ফেরেল ফিরে এলে একটা ব্যবস্থা করবে বলছিল। এই সময় কেবিনের দিকের দরজা খুলে পুলিশ নিয়ে ঘরে ঢুকল রবিন।
ডোবার আর ফেরেলকে ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে ভোলা হয়েছে, এসে খবর দিল একজন পুলিশ। হুগারফকে আগেই তোলা হয়েছে। এখানে আর কোন কাজ নেই। ওঠার আগে তিন গোয়েন্দাকে একটা খবর জানালেন শেরিফ, ডাকাতদের খোঁজ কেউ দিতে পারলে পুরস্কার দেয়া হবে ঘোষণা করেছে একটা কোম্পানি। তাদের অনেক মাল লুট করেছে ডাকাতেরা। এখন একেবারে বমাল ওদের ধরে দেয়াতে নিশ্চয় ভাল একটা অঙ্কের টাকা পাবে। তিন গোয়েন্দা। শীঘ্রি সেটার ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা দিয়ে, কয়েকবার করে ওদের ধন্যবাদ দিয়ে, উঠলেন তিনি। যাওয়ার আগে বললেন, হ্যাঁ, একবার আমার অফিসে দেখা কোরো, পারলে আজই। তোমাদের কেসের রিপোর্ট লিখে নিতে হবে।
তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর রবিন বলল, যাক, একটা কাজের কাজ হলো। ওকে কি করে সাহায্য করা যায়, ভাবছিলাম। আমার ভাগের পুরস্কারের টাকাটা ওকে দিয়ে দেব। আর্ট স্কুলে যাতে ভর্তি হতে পারে।
আমারটাও, সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করল মুসা।
পুরোটাই দিয়ে দেয়া হবে। তাতেও না কুলালে অন্য ব্যবস্থা করার কথা ভাবব। চলো, ওকে খুঁজে বের করি। সুখবরটা জানাই, বলে উঠতে গেল কিশোর।
কিন্তু ওঠার আগেই দরজায় দেখা দিল পিচার। হাসিমুখে ভেতরে ঢুকল কুকুরের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে।