দুই বোনের চরিত্রের বিভিন্নতা সেই সময়েই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। শার্লট তার ভাগ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় নেমে পড়ল। আমার মনে হয়, সে যা করতে চলেছিল তাকে অন্যায়। বলে তার মনে হয়নি। কয়েক মাস পরে, বেল গোয়েডলারের মৃত্যুর পর সব টাকা তো লেটিসিয়ারই হত, তাই সে লেটিসিয়া আর নিজেকে বোন ভেবে নিয়েছিল।
দুই বোনের মধ্যে যথেষ্ট মিল ছিল। লোকের চোখে চট করে পার্থক্য নজরে পড়ত না। এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিল শার্লট। তাই দুই বোনের এই আকারগত মিলটাকেই সে তার কার্যোদ্ধারের কাজে ব্যবহার করতে চাইল। শালটন মারা গেছে, লেটিসিয়া বেঁচে আছে–এমনটা লোককে বলার মধ্যে দোষের কি থাকতে পারে?
একটা আবেগ থেকেই মতলবটা মাথায় এসে গেল শার্লটের। সকলে তাই জানল শার্লট মারা গেছে, লেটিসিয়া ইংলণ্ডে ফিরে এল।
কিন্তু, বোনের মৃত্যুর পর লেটিসিয়া তার কর্মক্ষেত্রে নতুন মানুষ হয়ে ফিরল। তার কর্মকুশলতা আগের মত আর সজীব রইল না। কেমন নিষ্প্রভ। কিন্তু দাপট রইল আগেরই মত। মানসিক ভাব যেমনই হোক শার্লট তার দিদির হাবভাবে এভাবে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলতে লাগল।
তবে কয়েকটা ব্যাপারে শার্লটকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছিল। পরিচিতদের চোখের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নেবার জন্য তাকে ইংলণ্ডের অখ্যাত অপরিচিত অঞ্চলে একটা বাড়ি কিনতে হল। সে বিশেষভাবে এড়িয়ে চলতে চাইছিল তার দেশ ক্যাম্বারল্যাণ্ডের লোজন আর বেল গোয়েডলার। ওরা তাকে চিনে ফেলতে পারত। হাতের লেখার অমিলকে ঢাকবার জন্য শার্টকে হাতে গেঁটে বাতের আক্রমণ আমদানি করতে হয়েছিল। খুব কম লোকই শার্লটকে ভালভাবে চিনত, তাই সহজেই সে নিজেকে নিরাপদ ধারণা করে নিয়েছিল।
–কিন্তু, জেন মাসী, বাঞ্চ প্রশ্ন করল, তার সঙ্গে যদি লেটিসিয়ার পরিচিত কারু দেখা হত, এরকমতো অনেকেই ছিল?
–সেটা এমন কিছু সমস্যা সৃষ্টি করত না। তারা এটাই ভেবে নিত যে লেটিসিয়া অনেক বদলে গেছে। দশ বছরে মানুষ অনেক বদলে যেতে পারে। সে যে লেটিসিয়া নয়, এমন সন্দেহ কারো মনেই আসত না। কেননা লেটিসিয়ার হাবভাব, চালচলন সে ভালভাবেই জানত, কার সঙ্গে তার পরিচয়, কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার সব খুঁটিনাটিই তার জানা ছিল। কাজেই সহজেই নিজেকে রপ্ত করে নিয়েছিল।
ঘটনার দ্বিতীয় পর্যায়ই বলা চলে এটাকে–লিটল প্যাডকসে লেটিসিয়া বেশি শার্লটের বসবাস। এখানে অল্পদিনেই সে পড়শীদের জেনে নিল। সে এখন পুরোদস্তুর লেটিসিয়া ব্ল্যাকক।
এর মধ্যে একদিন এল দূর সম্পর্কের এক বোনের চিঠি। দুই বোনপো বোনঝিকে পেইংগেস্ট রাখার অনুরোধ নিয়ে। তাদের কখনো আগে দেখেনি জেনেও সে দয়া দেখিয়ে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে এল।
কোথাও কোন উপদ্রবের সম্ভাবনা ছিল না। সবকিছু বেশ ভালই চলছিল। এর মধ্যে লেটিসিয়ার স্কুলের এক সহপাঠিনীকে দয়া দেখাতে গিয়ে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে নিয়ে এল। নতুন ভূমিকায় শার্লটের এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল।
অবশ্য নিজের দুঃসহ একাকীত্ব মোচনের জন্যও তাকে এটা করতে হয়েছিল, মেনেও নিতে হয়েছিল। স্কুলজীবনে ডোরা বানার ছিল লেটিসিয়ার প্রিয় বন্ধু। সেই হিসেবে দুঃস্থ অবস্থায় সাহায্যের আশায় সে চিঠি লিখেছিল লেটিসিয়াকে। আবেগের তাড়নায় সে চিঠি লিখল ডোরা বানারকে। সে বেচারী চিঠি পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যায়। কেন না, তিনি চিঠি লিখেছিলেন লেটিসিয়াকে, আর উত্তর পেয়েছিলেন শার্লটের কাছ থেকে।
এখানে আর নিজেকে গোপন রাখতে চায়নি শার্লট। সে জানত তাতে লাভ হত না। ডোরা তার সাহায্য পেলে গোটা ব্যাপারটা তার মত দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখবে, এমন একটা বিশ্বাসও তার ছিল। তাই সে সবকথা তাকে নিষ্পাপ ভঙ্গীতে খুলে জানায়। ডোরাও সবশুনে তাকে মন থেকে সমর্থন করেন। লেটিসিয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে শার্লট বঞ্চিত হবে–অজানা অচেনা কারুর হাতে সব অর্থ চলে যাবে, তার মনে হয়েছিল, এরকম হওয়া উচিত নয়।
এলোমেলো মানসিক অবস্থা হলেও ডোরা বানার এটা ভালই বুঝেছিলেন যে কোন কথা প্রকাশ হতে দেয়া যাবে না। কিন্তু সবসময় তাল ঠিক রাখা তার পক্ষে সম্ভব হত না।
ডোরা বানার লিটল প্যাডকসে চলে আসার কিছুদিনের মধ্যেই শার্লট বুঝে গেল, কি মারাত্মক ভুল সে করে ফেলেছে।
অদ্ভুত মানসিক বিপর্যয়ের জন্য ডোরা প্রায়ই কাজকর্মে গোলমাল পাকিয়ে ফেলতেন, তেমনি বেশি কথা বলার জন্য বেশ কথাও মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ত। তার মত মানুষকে নিয়ে বাস করাই ছিল এক বিড়ম্বনা। শার্লটের পক্ষে ছিল প্রাণান্তকর।
তবু ব্যাপারটা সে মেনে নিতে চেষ্টা করেছিল নিজের একজন একান্ত সঙ্গীর অভাব বোধ থেকে। দ্বিতীয়ত ডাক্তার জানিয়েছিল, সে বেশিদিন বাঁচবে না।
ডোরা বানার দুই বোনকে নাম ধরেই ডাকতেন। ছোট্ট করে সম্বোধন করতেন লেটি আর লোটি। শার্লট ছিল লোটি।
ডোরা সাবধান থেকেই শার্লটকে সম্বোধন করতেন। তবু মাঝে মাঝে লোটি ডাকতে গিয়ে আসল নাম লেটি বলে ফেলতেন। স্কুল জীবনের অভ্যাসের বশেই এই ভুলটা হয়ে যেত। ফলে শার্লটকে এব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হত। তবে ব্যাপারটা ক্রমশই তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। তার স্নায়ুর ওপর খুবই চাপ পড়তে থাকে।
তবে, ডোরার মুখের উচ্চারণে এই সামান্য ভুল কারোরই নজরে আসেনি। সেটা স্বাভাবিক বিকৃতি বলেই মেনে নিয়েছিল সকলে।