রুডি সার্জের সঙ্গে একমাত্র তারই পরিচয় ছিল। তাছাড়া বাড়িতে কেন্দ্রীয় তাপ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কোন চুল্লী না রাখা নিজের বাড়িতে আর কার পক্ষে সম্ভব ছিল? ঘরে আগুন না রাখার পরিকল্পনাটা তারই ছিল।
গোড়াতে অবশ্য ব্যাপারটা অত সরল ছিল না। সবার মত আমাকেও ধাঁধায় পড়তে হয়েছিল। ভেবেছি, কেউ ওই লেটিসিয়া ব্ল্যাকলককেই খুন করতে চেয়েছে।
-ওই সুইস ছোকরা রুডি সার্জ থেকে শুরু কর তুমি। যা ঘটেছিল গোড়া থেকেই বল জেন মাসী। রুডি সার্জ কি ওকে চিনতে পেরেছিল?
-হ্যাঁ। ক্র্যাডকই তার পরিচয় খুঁজে বার করেছিল। বলে ইনসপেক্টরের দিকে তাকালেন মিস ব্ল্যাকল্লক।
–ও কাজ করত বের্নের ডাঃ অ্যাডলফ কথের ক্লিনিকে। বললেন ক্র্যাডক। শার্লট ব্ল্যাকলক সেখানে গিয়েছিলেন গলগণ্ড অপারেশান করাতে।
কিছু গোলমেলে কাজ করে ওই ক্লিনিক ছাড়তে হয়েছিল ছোকরাকে। সে ইংলণ্ডে এসে হোটেলে কাজ নিয়েছিল। সেখানে সে মিস ব্ল্যাকলককে দেখে চিনতে পারে। ক্লিনিকে উনি একসময়ে রুগী হিসেবে ছিলেন।
কিছু চিন্তাভাবনা না করেই ঝোঁকের মাথায় রুডি সার্জ এগিয়ে এসে তার সঙ্গে কথা বলেছিল। পরে নিশ্চয়ই ক্লিনিকের গোলমেলে কাজগুলোর কথা মনে করে সে সঙ্কুচিত হয়েছিল।
-তাহলে, সে হোটেল মালিকের ছেলে, ব্যবসা শিখতে এসেছে, এসব কথা বলেনি? বাঞ্চ বললেন।
–ওসব কিছুই বলেনি। রুডি সার্জের কথা বলার অজুহাত হিসেবে মিস ব্ল্যাকলক যা বলেছিলেন সবই ছিল তার নিজের বানানো কথা।
-ছোকরার সঙ্গে দেখা হবার পরই প্রথম ধাক্কা খেলেন মিস ব্ল্যাকলক। বললেন মিস মারপল, ব্যাপারটা তার কাছে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কেন না, তার আগে পর্যন্ত তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ বলেই ধরে নিয়েছিলেন। মিস শার্লট ব্ল্যাকলক, যিনি গলগণ্ড অপারেশনে করেছিলেন, নির্দিষ্ট ভাবে একজন তাকে চিনে ফেলবে, এ তিনি ভাবতে পারেননি।
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ওখান থেকেই–ওই গলগণ্ড রোগ। এক উজ্জ্বল হাসিখুশি তরুণী শার্ট ব্ল্যাকলকের গলায় ওই রোগ দেখা দেয়। তার জীবন ব্যর্থ হতে বসেছিল। নিজের রূপ সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিল সে। তার মা জীবিত ছিলেন না, বাবাও তেমন সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না। তাই সে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। স্বাভাবিক জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সে।
গলগণ্ড অপারেশন করার উপায় ছিল না। কেন না ডঃ ব্ল্যাকলক ছিলেন, আমার ধারণা, অত্যন্ত প্রাচীনপন্থী। তার সঙ্গে কিছুটা গোঁয়ারতুমিও ছিল। অপারেশনের ওপর তাই তার কোন আস্থা ছিল না। তিনি রোগগ্রস্ত মেয়েকে আয়োডিন ইত্যাদি ওষুধের মধ্যেই রেখেছিলেন। আর করার কিছু ছিল না ভেবে শার্লটের বোনও তাই মেনে নিয়েছিল।
শার্লট তার বাবার ব্যবস্থাই মেনে নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু গলগণ্ড ক্রমশ স্ফীত হয়ে উঠতে লাগল। ফলে বাইরে লোকজনের সামনে বেরনো সে বন্ধ করে দিয়েছিল।
ইনসপেক্টর ক্র্যাডক আমাকে বলেছেন, বেল গোয়েডলার তাকে বলেছিলেন, লেটিসিয়া ব্ল্যাকলক ছিলেন ব্যক্তিত্বময়ী। তার সতোর প্রশংসা তিনি বারবার করেছেন। মানুষ কিভাবে অসৎ কাজ করে তা তিনি বুঝতে পারতেন না। তিনি নিজে যেমন কোন অসৎ কাজ করেননি তেমনি রেণ্ডাল গোয়েডলারকেও সোজা পথে ধরে রেখেছিলেন।
লেটিসিয়া বোনের প্রতি খুবই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। তার জন্য অনুভব করতেন। বোনের মানসিক বিপর্যয় হাল্কা করবার জন্য তিনি যা কিছু ঘটত বোনকে বিস্তারিত লিখে জানাতেন এভাবেই দূর থেকেও তিনি হতভাগ্য বোনকে সঙ্গ দেবার চেষ্টা করতেন।
ডাঃ ব্ল্যাকলক মারা গেলে শার্লট অসহায় হয়ে পড়ল। তাকে দেখাশোনা করবার জন্য লেটিসিয়া র্যাণ্ডাল গোয়েডলারের কাজ ছেড়ে দিলেন।
অপারেশানের ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নেবার জন্য তিনি বোনকে সুইজারল্যাণ্ডে নিয়ে গেলেন। সেখানে অপারেশানের সাহায্যে সাফল্যের সঙ্গেই গলার খুঁতটা সারিয়ে ফেলা হল। গলার দাগ ঢাকা পড়ে গেল একছড়া মুক্তোর মালায়।
ইতিমধ্যে যুদ্ধ লাগল। সরাসরি ইংলণ্ডে ফেরা সম্ভব না হওয়ায় দুই বোন সুইজারল্যাণ্ডে রেডক্রশে নাম লেখালেন। তাইতো, ইনসপেক্টর?
-হ্যাঁ, মিস মারপল। আপনি বলতে থাকুন বললেন ক্র্যাডক।
ইংলণ্ডে বেল গোয়েডলারের স্বাস্থ্যের খবর ওদের কাছে পৌঁছেছিল। ওরা জেনেছিলেন তিনি বেশি দিন বাঁচবেন না। আমার ধারণা ভবিষ্যতে বিরাট সম্পদ লাভের স্বপ্ন দুই বোনের মধ্যেই ছিল। তবে সম্পদের লোভ লেটিশিয়ার চেয়ে শার্লটেরই বেশি ছিল। কেন না, জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দ সে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন তাকে বিভোর করে তুলেছিল। দেশ-বিদেশে ভ্রমণ, ছোট্ট একটা নিজস্ব বাড়ি, দাসদাসী, প্রাচুর্য এমনি এক ভোগ সুখের জীবনের স্বপ্ন দেখত সে।
এর মধ্যেই এমন এক অঘটন ঘটল যে শার্লটের ভবিষ্যতের সব রঙীন স্বপ্ন নিমেষে চুরমার হয়ে গেল।
স্বাস্থ্যবতী লেটিসিয়া অকস্মাৎ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই রোগটা নিউমোনিয়ার দিকে মোড় নিল। একসপ্তাহ ভুগেই তিনি মারা গেলেন।
শার্লটের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বেল গোয়েডলারের আগে মারা না গেলে-অন্তত আরও মাস কয়েক বেঁচে থাকলেই অঢেল অর্থের মালিক হত তারা দুই বোন। আর লেটিসিয়ার পর সেই অর্থ আসত শার্লটেরই হাতে। সব সম্ভাবনাই মিথ্যা হয়ে গেল লেটিসিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে।