-তুমি এমন মিথ্যা কথা বললে মিৎসি, হাসিমুখে কোমল স্বরে বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
মিৎসি লজ্জিত ভাবে পাশে তাকিয়ে তাকে দেখল।
–রুপোর বাসনগুলো আগে ধোবে। সিঙ্কে বেশি করে জল ঢেলে নাও।
মিৎসি বাধ্যমেয়ের মত সেভাবেই সিঙ্ক জল ভর্তি করল।
–আমার ওসব কথার জন্য আপনি রাগ করবেন না মিস ব্ল্যাকলক।
–রাগ করলে কি আর মেজাজ ঠিক থাকত? বললেন মিস ব্ল্যাকলক।
–আমি তাহলে ইনসপেক্টরকে বলব যে সব মিথ্যে করে বলেছি।
–তিনি তোমার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছেন।
মিৎসি কল বন্ধ করবার জন্য নিচু হল। সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে দুটো শক্তিশালী হাত তার মাথা চেপে ধরে সিঙ্কের জলে চেপে ধরল।
-এবারই তুমি প্রথম সত্যি কথাটা বলেছিলে। হিসহিস করে বলে উঠলেন মিস ব্ল্যাকলক।
মিৎসি উন্মত্তের মত দুহাত ছুঁড়ে নিজেকে ছাড়বার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মিস ব্ল্যাকলক ছিলেন ঢের বেশি শক্তিশালী। তিনি তার মাথাটা জলে চেপে ধরেছিলেন।
সহসা বাতাসে ডোবা বানারের কাতর কণ্ঠ ভেসে এল।
–একি লোটি–লোটি–এমন কাজ করো না
ঘাড় ফিরিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন মিস ব্ল্যাকলক। দুহাত শূন্যে দুলিয়ে অদৃশ্য ভয়ানক কিছুকে যেন ঠেকাবার চেষ্টা করলেন।
মিৎসি ছাড়া পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়াল। দম টানতে কষ্ট হচ্ছিল তার। ঘর থেকে কোনমতে ছুটে বেরিয়ে গেল।
আর্তনাদ করে চলেছেন সমানে মিস ব্ল্যাকলক। রান্নাঘরে একা হয়ে গিয়ে তার ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
–আমায় মাপ কর ডোরা, ডোরা আমি নিরুপায় হয়েই একাজ করেছি
দিশা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। কোনদিকে যাচ্ছেন বুঝতে না পেরে বাসন মাজার ঘরের দিকে ছুটে গেলেন।
কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলেন না। সার্জেন্ট ফ্লেচার তার বিশাল বপু নিয়ে পথ আগলে দাঁড়ালেন।
ঠিক সেই সময় মিস মারপল মুখময় হাসি নিয়ে ঝটা বুরুশ রাখার আলমারি থেকে বেরিয়ে এলেন।
–মানুষের গলা আমি ভালই নকল করতে পারি। বললেন মিস মারপল।
মিস ব্ল্যাকলক ভয়ার্ত অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলেন।
–আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে, এই মেয়েটিকে আপনি জলে ডুবিয়ে মারতে চেষ্টা করেছিলেন। আমি তার সাক্ষী। চলুন মিস ব্ল্যাকলক।
উঁহু, শার্লট ব্ল্যাকলক, বললেন মিস মারপল, মুক্তোর মালা সরিয়ে নিলেই অপারেশনের দাগ দেখা যাবে।
–অপারেশন। বিস্মিত হলেন ফ্লেচার।
–হ্যাঁ, গলগণ্ড অপারেশন।
ততক্ষণে অনেকটা সামলে উঠেছেন মিস ব্ল্যাকলক। মিস মারপলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি সবই জেনেছেন?
-হ্যাঁ, সবই আমি জেনেছি।
শার্লট ব্ল্যাকক ডুকরে উঠলেন। অবসন্ন শরীরটাকে টেনে নিয়ে ধপ করে টেবিলের সামনে বসে পড়লেন।
–ডোরার গলা নকল করে আপনি আমাকে ব্যথা দিয়েছেন। ডোরাডোরাকে আমি ভালবাসতাম।
ইতিমধ্যে ঘরে প্রবেশ করলো ইনসপেক্টর ক্র্যাডক। তার পেছনে অন্য সকলে।
মিৎসি অনেকটা সামলে উঠেছিল। তার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। নিজের কাজের প্রশংসা সে নিজেই করতে শুরু করল।
–কী দারুণ অভিনয় আমি করলাম, করিনি? মরতে বসেছিলাম, তবু সাহস ছিল বলে না এতবড় ঝুঁকিটা নিয়েছিলাম।
ব্যাপারটা বুঝে উঠতে কয়েক মুহূর্ত দেরি করেছিলেন মিস হিনচক্লিফ। তারপরেই সকলকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মিস ব্ল্যাকলকের ওপরে।
-ওকে আমি খুন করব–আমাকে আটকাবেন না
মিস ব্ল্যাকলক সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ঠেকাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। তার হাঁপ ধরে গিয়েছিল।
-মিস হিনচক্লিফ–অমন করবেন না–আমার কথা শুনুন।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। মিস হিনচক্লিফ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে মিস ব্ল্যাকলকের গলা চেপে ধরবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
–আমি খুন করব–আমার বন্ধু মারগাটরয়েডকে ও খুন করেছে–
সকলে মিলে সামলালেন মিস হিনচক্লিফকে। রুদ্ধ আক্রোশে তিনি দাঁত কড়মত করতে লাগলেন। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে পড়তে চাইছে।
মিস ব্ল্যাকলক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। কাতর স্বরে বলে উঠলেন, আমি ওকে মারতে চাইনি। কাউকেই আমি মারতে চাইনি। তবু আমি না মেরে পারলাম না। ডোরাকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না-ওহ ডোরা–আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম–একা।
দু-হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মিস ব্ল্যাকলক ওরফে শার্লট ব্ল্যাকলক।
.
১৮.
রেভারেণ্ড জুলিয়ান হারসন, ইনপেক্টর ক্র্যাডক, জুলিয়া পাট্রিক সিমন্স, এডমণ্ড আর ফিলিপা এরা সকলেই আজ শ্রোতা। মিস মারপলের মুখ থেকে আদ্যপান্ত শোনার জন্য উৎসুক হয়ে যে যার সুবিধা মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছেন।
মিস মারপল সকলের মাঝখানে বসেছিলেন একটা আরাম কেদারায়। তার মুখোমুখি চুল্লীর সামনে বসে আছেন বাঞ্চ।
–এ কাহিনী আপনারই মিস মারপল। পাইপ টানতে টানতে বললেন ক্র্যাডক।
–ওহ, না, আমি তো একটু সাহায্য করেছি কেবল। তদন্তের সব ঝামেলা তো তুমিই সামলেছ বাছা। তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি জান। বললেন মিস মারপল।
অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন সকলেই। বাঞ্চ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ঠিক আছে আপনারা দুজন মিলেই বলবেন। শুরু কর তুমি, জেন মাসী। গোটা প্লটটাই যে মিস ব্ল্যাকলকের তুমি কখন বুঝতে পারলে?
–প্রিয় বাঞ্চ, বললেন মিস মারপল, কতগুলো ব্যাপারে গোড়া থেকেই আমার সন্দেহ হয়েছিল তার পক্ষেই এসব করা সম্ভব। অমন নিপুণ ডাকাতির দৃশ্য নিজের বাড়িতে তার পক্ষেই সাজানো সম্ভব ছিল।