ক্র্যাডক বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন সিস্টার কোন ভাবেই আমি তার উত্তেজনার কারণ ঘটাব না।
-তবুও আপনাকে আমার জানিয়ে দেওয়া উচিত, মিসেস গোয়েডলারকে দেখে আপনার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলেই মনে হবে। তিনি কথাও বলবেন স্বাভাবিকভাবেই। কথা বলতে ভালও বাসেন। তবে হঠাৎ করেই শক্তি ফুরিয়ে যাবে; নির্জীব হয়ে পড়বেন। আপনি সেই মুহূর্তেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে জানাবেন।
এখন সারাক্ষণই তাকে মরফিয়া দিয়ে রাখা হয়। আপনার আসার সংবাদ পেয়েই আজকের দিনের জন্য তাকে জোরালো উত্তেজক ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। ওষুধের ক্রিয়া যতক্ষণ আছে ততক্ষণ তিনি সজীবই থাকবেন। ওষুধের ক্রিয়া শেষ হয়ে এলেই নির্জীব হয়ে পড়বেন।
–হ্যাঁ, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি, সিস্টার। বর্তমানে মিসেস গোয়েডলারের স্বাস্থ্য কেমন চলছে দয়া করে যদি জানান ।
-এককথায় বলতে পারেন, তিনি মৃত্যুপথযাত্রী। বড়জোর সপ্তাহ কয়েক বেঁচে থাকতে পারেন। বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছার বলেই এখনো টিকে রয়েছেন, নইলে অনেক আগেই তার জীবনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার কথা। অসীম জীবনীশক্তি।
সিস্টার ক্র্যাডককে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে এক শয্যায় এক বৃদ্ধা মহিলা শায়িত। ক্র্যাডককে দেখে মনে হল মিস ব্ল্যাকলকের চেয়ে বয়স বেশ কয়েক বছর বেশিই হবে। অসুস্থতার জন্য বয়স আরও বেশি বলে মনে হয়। মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন থাকলেও মিষ্ট ভাবটি অমলিন রয়েছে। ক্র্যাডককে দেখে চোখের তারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার।
-কেমন আছে লেটিসিয়া ব্ল্যাকলক, শুনলাম, ওই আক্রমণে খুব বেশি আহত হয়নি। ব্যাপারটা খুবই কৌতূহলজনক। বললেন মিসেস গোয়েডলার।
–সৌভাগ্যবশত বড় আঘাত থেকে বেঁচে গেছেন। এখন ভালই আছেন। তিনি আপনাকে তার ভালবাসা জানিয়েছেন। বললেন ক্র্যাডক।
–শেষবার দেখেছি, বহুকাল হয়ে গেল। বড়দিনে একটা করে কার্ডের মাধ্যমেই কেবল যোগাযোগটা রয়েছে। শার্লটের মৃত্যুর পর যখন ইংলণ্ডে আসে, আমি তাকে এখানে আসার কথা বলেছিলাম। চিরকালই ব্লাকির বিচারবুদ্ধি প্রখর…আমাকে জানিয়েছে, এতবছর পরে ব্যাপারটা খুব বেদনাদায়ক হবে। খুব সত্যকথা বলেছিল ও।
নিজের কথা বলার আগে ক্র্যাডক বৃদ্ধাকে তার কথা বলে যেতে দিলেন। যদি এর মধ্য দিয়ে মিঃ গোয়েডলার ও মিস ব্ল্যাকলকের সম্পর্কটা উদ্ধার করা যায়।
মিসেস গোয়েডলার বলতে লাগলেন, পুলিসের কেউ এখানে বড় একটা আসে না। টাকার ব্যাপারটাই মনে হয় আপনার কাছে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে? আমার মৃত্যুর পরে ব্ল্যাকিই সব পাবে, র্যাণ্ডাল এরকমই ব্যবস্থা করে গিয়েছিল। আমি তো চিরকালই রোগভোগা মানুষ। ডাক্তার লেগেই ছিল। তাই আমি ওর পরে বেঁচে থাকব র্যাণ্ডাল কখনই ভাবেনি। ব্ল্যাক বেশ শক্তপোক্ত চেহারার ছিল, অসুখবিসুখে কখনও ভোগেনি।
একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন, নিজের জন্য আমি কোন দুঃখবোধ করিনি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, যে কোন সময় আমার আয়ুর মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে–স্বামীর আগেই আমি বিদায় নেব। কিন্তু, দেখতেই তো পাচ্ছেন…
ক্র্যাডক এই সুযোগে নিজের কথায় এলেন।–আপনার স্বামী এই সব টাকা মিস ব্ল্যাকলককে
-হ্যাঁ, কেন দিয়ে গেলেন? আপনি পুলিসের লোক, নিশ্চয়ই ভেবেছেন, এর মধ্যে কোন গোপন ভালবাসার ব্যাপার ছিল? আসলে কিন্তু তা নয়। ব্ল্যাকি অন্য ধাতের মেয়ে। নারীসুলভ দুর্বলতা বা অনুভূতি ওর ছিল না। এরকম নারীর সঙ্গে কোন পুরুষের ভালবাসার সম্পর্ক হওয়া অসম্ভব। তাছাড়া দেখতেও সুরূপা ছিল না। নারীজীবনের অনেক কিছু থেকেই ও বঞ্চিত ছিল।
মজা কি জানেন, র্যাণ্ডাল সবসময়ই ব্ল্যাকিকে তার ছোটভাই বলেই ভাবত। তার বিচার বুদ্ধির ওপর খুব নির্ভর করত। বহুবার ব্ল্যাকি তাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে।
–শুনেছি একবার অর্থ দিয়েও সাহায্য করেছিলেন।
–হ্যাঁ, তবে সেটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। আরও বেশি কিছু তার কাছ থেকে র্যাণ্ডাল পেয়েছে। র্যাণ্ডালকে সবসময় ব্ল্যাকি সঠিক পথে রাখত। নিজেও সে কখনও অসৎ পথে হাঁটেনি। তার চরিত্র অসাধারণ। প্রশংসা না করে থাকা যায় না।
ব্ল্যাকির জীবনের শুরুটা ছিল খুবই দুঃখবহ। বাবা ছিলেন গ্রামের সাধারণ এক ডাক্তার। ও লণ্ডনে চলে এসেছিল। পড়াশোনা করে চার্টারড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়। তার বোন শার্লট ছিল পঙ্গু। মৃত্যুর পর বোনটি অসহায় হয়ে পড়লে তাকে দেখাশোনা করার জন্যও চলে যায়।
–সেটা আপনার স্বামীর মৃত্যুর কতদিন আগে?
–তা বছর কয়েক আগে। ব্ল্যাকি আমাদের প্রতিষ্ঠানে থাকার সময়েই র্যাণ্ডাল উইল করেছিল। সে উইল আর পাল্টায়নি। কোথাও দানধ্যান করার কথা মনে করেনি। বলেছিল, আমাদের আপনার জন বলতে তো কেউ নেই। ব্ল্যাকিই এসব পাক, সে বুদ্ধিমতী, তাহলে অনেকটাই বাড়াতে পারবে।
দম নেবার জন্য একটু থামলেন মিসেস গোয়েডলার। তারপর বললেন, ঝুঁকি নেয়ার ব্যাপারটা র্যাণ্ডালের কাছে ছিল নেশার মত। ব্ল্যাকির মনটাও ছিল তারই মত। আর এই পুরুষসুলভ ব্যাপারগুলো করতে গিয়ে ভালবাসা সংসার সন্তান জীবনের এই মাধুর্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
কথা শেষ করে আবেশমাখা দৃষ্টিতে তিনি ক্র্যাডকের দিকে তাকালেন। আত্মমগ্নভাবে বললেন, আজ আমি আশক্ত পঙ্গু, কিন্তু একদিন জীবনের সবকিছুই পেয়েছিলাম। যাকে ভালবাসতাম তাকেই বিয়ে করেছিলাম। সন্তানও কোলে পেয়েছিলাম দুটো বছরের জন্য। আমি সকলের ভালবাসাও পেয়েছি–আমি ভাগ্যবতী।