Site icon BnBoi.Com

ক্যারিবিয়ান মিস্ট্রি – আগাথা ক্রিস্টি

ক্যারিবিয়ান মিস্ট্রি - আগাথা ক্রিস্টি

ক্যারিবিয়ান মিস্ট্রি

১. মিস জেন মারপল

ক্যারিবিয়ান মিস্ট্রি (১৯৬৪) – আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

০১.

মিস জেন মারপল সেন্টমেরী মিডের শান্ত গ্রামীণ পরিবেশ ছেড়ে বেড়াতে এসেছেন ক্যারিবিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপভূমি ওয়েস্ট ইণ্ডিজে।

এখন বয়স হয়েছে তাঁর। গীর্জার কাছেই জীবনের দীর্ঘ বছরগুলো কেটেছে। গত শীতে কঠিন নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ডাক্তারের উপদেশ ছিল উন্মুক্ত সূর্যালোক-স্নানের।

এর পরেই ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপভূমি ওয়েস্ট ইণ্ডিজে আসার রাজসিক ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ভাইপো রেমণ্ড ওয়েস্ট।

রেমণ্ড একজন সফল ঔপন্যাসিক। বই থেকে তার আয়ও যথেষ্ট। কর্তব্যবশেই পিসীর জীবন আনন্দময় করে তুলতে সে প্রস্তাব করেছিল ওয়েস্ট ইণ্ডিজে আসার।

গোড়ায় মৃদু আপত্তি প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মত হয়েছিলেন সেণ্টমেরী মিডের বাড়ি ছেড়ে আসতে।

রেমণ্ড ব্যবস্থার কোন ত্রুটি রাখেনি কোন দিকে। তারই এক বান্ধবীর সঙ্গে আকাশ পথে এসেছেন ত্রিনিদাদ পর্যন্ত। তারপর সেখান থেকে সমুদ্র তীরে সেন্ট অনবরাতে গোল্ডেন পাম হোটেলে।

এই হোটেলটা আগে চালাতেন স্যাণ্ডারসনরা। কিছুকাল আগে তারা ইংলণ্ডে চলে আসেন। তাদের জায়গায় হোটেল চালাচ্ছে কেণ্ডাল দম্পতি।

রেমণ্ডকে তারা নিশ্চিন্ত থাকার আশ্বাস দিয়ে জানিয়েছিল তার পিসীর জন্য কোন ভাবনা তাকে করতে হবে না।

এখানে একজন ভাল ডাক্তারও রয়েছেন। দরকার হলেই পাওয়া যাবে। আর তারা নিজেরা তো আছেনই।

মলি কেণ্ডাল খুব উদ্যমী যুবতী। বয়স কুড়ি ছুঁয়েছে। বেশ হাসিখুশি। মিস মারপলকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে যথাসময়েই তার জন্য সবরকমের আরামের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

মলির স্বামী টিম কেণ্ডাল। অত্যন্ত সদাশয় যুবক। সামান্য কৃশ দেখতে, গায়ের রঙ গাঢ়।

একেবারে নিজের মত করে একটা চমৎকার বাংলো পেয়েছেন মিস মারপল। পশ্চিম ভারতীয় মেয়েরা হাসিমুখে আদেশ পালন করতে সব সময়েই তৈরি।

এখানে আসার পর থেকে রোজই তিনি বাংলোর সামনের রাস্তা ধরে সমুদ্রের তীরের এলাকায় একটা চেয়ারে এসে বসেন, স্নানের দৃশ্য দেখেন আর অভ্যস্ত হাতে উল বোনেন। সঙ্গী হিসেবে দু-একজন বয়স্ক অতিথিকেও পেয়েছেন।

এরা হলেন বৃদ্ধ মিঃ র‍্যাফায়েল, ডাঃ গ্রাহাম, ক্যানন প্রেসকট আর তার বোন। এদের সঙ্গে আছেন মেজর প্যালগ্রেভ।

একজন বৃদ্ধার পক্ষে উন্মুক্ত সামুদ্রিক পরিবেশ, নিশ্চিন্ত আবাস আর অনর্গল গল্প করার মত সঙ্গী–এর পর আর কি চাই! অসংখ্য পামের অরণ্যে রোজকার জীবনযাত্রায় দুদিনেই বেশ অভ্যস্ত করে নিয়েছেন তিনি নিজেকে।

আপাততঃ মেজর প্যালগ্রেভ সঙ্গ দিচ্ছিলেন মিস মারপলকে। ভদ্রলোক ঘুরেছেন অনেক, দেখেছেন অনেক। তিনি নিজের অভিজ্ঞতার গল্প করেনও বেপরোয়া ভাবে।

–কেনিয়ায় না গেলে জায়গাটা সম্পর্কে কোন ধারণাই করা সম্ভব নয়। জীবনের সেরা চোদ্দটি বছর আমার কেটেছে সেখানে।

এভাবেই স্মৃতিচারণ করে চলেছিলেন মেজর। মিস মারপলের মত একজন নীরব শ্রোতা পেয়ে অতীতের আনন্দের দিনগুলোর কথা শুনিয়ে অপার আনন্দ লাভ করছিলেন তিনি।

উপজাতিদের বিচিত্র রীতির রঙ চড়ানো কাহিনী শুনতে শুনতে মিস মারপল মেজরকে উৎসাহিত করতে বললেন–আপনার অভিজ্ঞতা সত্যিই বড় বিচিত্র। অবশ্য এ জায়গাটাও চমৎকার।

মেজর প্যালগ্রেভ চারদিকে তাকিয়ে খুশির স্বরে বললেন–হ্যাঁ, সত্যিই চমৎকার।

–এমন জায়গাতেও নিশ্চয়ই অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে থাকে।

-তা ঘটে বৈকি। শুনবেন নাকি? ক বছর আগে একটা খুন হয়েছিল। লোকটির নাম হ্যারি ওয়েস্টার্ন। কাগজে এনিয়ে কদিন খুব লেখালেখিও হয়েছিল।

-হ্যারি ওয়েস্টার্ন তার স্ত্রীর প্রেমিক কাউন্ট ফেরারিকে গুলি করে হত্যা করেছিল। অবশ্য টাকার জোরে সবই পরে ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল।

মিস মারপলের পশমের গুলি গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল। কথা বলতে বলতে মেজর সেটা নিচু হয়ে তুলে দিলেন।

-আমিও একবার অদ্ভুত এক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম, বলতে লাগলেন মেজর, ঠিক নিজে নয়, ক্লাবে আড্ডা দেবার সময় এক ডাক্তার ভদ্রলোক তার জীবনের ঘটনা শুনিয়েছিলেন।

স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়েছিল বলে মাঝরাতে এক তরুণ তাকে ডেকে তুলেছিল। তরুণটি স্ত্রীর খুবই অনুগত ছিল।

কিছুদিন যাবৎ সে স্ত্রীর আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল। কেমন হতাশার ভাব তাকে জড়িয়ে থাকত সবসময়।

ডাক্তার ঠিক সময়ে পৌঁছে উপযুক্ত ব্যবস্থাদি করায় মেয়েটি সেযাত্রা বেঁচে গিয়েছিল বটে কিন্তু একমাস পরেই ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল।

খুবই দুঃখের ঘটনা, মৃদুস্বরে বললেন, মিস মারপল, খুনের ঘটনা বর্ণনায় মেজরের উৎসাহ লক্ষ্য করে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন তিনি।

এমনি আরও দু-একটা অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ শুনিয়ে মেজর একসময় বললেন, আমার এক ডাক্তার বন্ধু একবার তার এক বন্ধুর একটা ফটো বার করে দেখায়। বন্ধুটির নাম রবিনসন না কি যেন ছিল। সে তার বাড়িতেই ছিল। তার বন্ধুটি আবার সবসময় ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। অদ্ভুত কিছু দেখলেই ছবি তুলে নিত।

রবিনসনদের সদর দরজার সামনে একটা দুর্লভ হিবিসকাস গাছ দেখতে পেয়ে একটা ছবি তুলে নেয়। ঠিক যেই মুহূর্তে সাটার টেপে তখনই মহিলার স্বামী সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। ক্যামেরায় সে-ও ধরা পড়ে গেল। অবশ্য ছবিটা একটু ফোকাসের বাইরে চলে গিয়েছিল।

মেজর বললেন, সেই ছবির একটা কপি আপনাকে আমি দেখাতে পারি–ডাক্তার বন্ধু নিছক আমার কৌতূহল মেটাবার জন্য দিয়ে দেন। ছবিতে ধরা পড়া সেই লোকটি এমন এক খুনের আসামী যে ঘটনার রহস্য আজও সমাধান হয়নি। খুনী নির্বিবাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মেজর প্যালগ্রেভ তার ব্যাগ বের করে হাজারো জিনিসের মধ্যে ফটোর খোঁজ করতে লাগলেন।

মিস মারপল বুঝতে পেরেছিলেন, মেজর তার গল্পে যথেষ্ট রঙ চড়াতে অভ্যস্ত। এধরনের লোকেরা যতবার গল্প শোনায় ততবারই তাতে নতুন করে পলেস্তারা পড়ে।

–সব ঘটনা প্রায় ভুলেই গেছি। মহিলা বেশ সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু কোথায় যেন–এই তো–বলতে বলতে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট ফটো টেনে বার করলেন।

–একজন খুনীর ছবি এটা।

ছবিটা মিস মারপলের হাত চালান করবার মুহূর্তে পায়ের শব্দ পেয়ে মিস মারপলের ডান কাঁধের ওপর দিয়ে দৃষ্টি ফেললেন তিনি।

-যাচ্ছেতাই, গোল্লায় যাক।

বিরক্ত হয়ে হাত গুটিয়ে নিলেন মেজর। সবকিছু আবার মানিব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেন। এবং প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ পাল্টে হাতির দাঁতের গল্প করতে শুরু করলেন। পরক্ষণেই বলে উঠলেন–হ্যালো

মেজরের কণ্ঠ কেমন কৃত্রিম বলে বোধ হতে লাগল মিস মারপলের।

এগিয়ে আসা পদশব্দের দিকে তাকিয়ে মেজর বললেন, দেখুন কারা এসেছেন–বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ–পুষ্প ও প্রাণীসংগ্রাহক।

মিস মারপল এগিয়ে আসা চার অতিথিকে আগেই দেখেছিলেন। বিরাট চেহারার একঝাঁক খাড়া ধূসর চুলের মানুষটির নাম গ্রেগ ডাইসন আর স্বর্ণকেশী স্ত্রীলোকটি তার স্ত্রী লাকি ডাইসন।

অন্য দম্পতির একজন কৃশ চেহারার মানুষ। তিনি কর্নেল এডওয়ার্ড হিলিংডন আর তার স্ত্রী ইভিলিন হিলিংডন।

প্রথম দম্পতি প্রকৃতিবিদ, দ্বিতীয় পাখি সম্পর্কে খুব আগ্রহী।

মেজর মিস মারপলের সঙ্গে সকলের আলাপ করিয়ে দিলেন। সকলেই তাঁকে শুভেচ্ছা জানালেন।

ইভিলিন হিলিংডন মিস মারপলের পাশে বসে তার সঙ্গে গল্প করতে শুরু করলেন। মিস মারপল ঘাড়ের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। তবু আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। তার চোখে পড়ল বেশ একটু দূরে ধনকুবের মিঃ র‍্যাফায়েলের বিরাট বাংলোটা কিন্তু মানুষজন কাউকে দেখা গেল না সেখানে।

ইভিলিনের গল্প শুনতে শুনতে মিস মারপল অন্যমনস্ক ভাবে হলেও যথাযথ সায় দিয়ে যাচ্ছিলেন। পুরুষ দুজনকে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত ছিল তাঁর চোখ।

এডওয়ার্ড হিলিংডন শান্ত সুদর্শন। বেশ ভালমানুষ বলেই মনে হয়।

আর গ্রেগ ডাইসনের বিরাট চেহারা। বেশ হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল।

এর পরে মেজরের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন তিনি।

.

০২.

গোল্ডেন পাম হোটেলের সন্ধ্যা।

কোণের দিকে একটা চেয়ারে বসেছিলেন মিস মারপল। প্রকাণ্ড ডাইনিং রুমটার তিনদিক খোলা। ভেতরে হাওয়ায় ভাসছিল বেশ মিষ্টি গন্ধ। টেবিলে টেবিলে ছড়িয়ে পড়েছে হালকা রঙীন আলো।

আনন্দমুখর এই সন্ধ্যায় বেশির ভাগ মহিলারই দেহে রঙিন সান্ধ্য পোশাক। হলের আলোয় প্রকট হয়ে উঠেছে তাদের বাদামী কাঁধ আর পেলব হাত।

নানা বয়সের মানুষ চারপাশে। প্রৌঢ় ধনীদের দেখে বোঝা যাচ্ছিল তাদের সঙ্গিনীরা তৃতীয় বা চতুর্থ ঘরণী।

মধ্যবয়স্ক অনেক দম্পতি এসেছিল উত্তর ইংলণ্ড থেকে। সন্তানসহ হাসিখুশি এক দম্পতি এসেছে কারাকাস থেকে।

দক্ষিণ আমেরিকার নানা রাজ্যের মানুষও কিছু কম ছিল না। সকলের মুখের নানা ভাষার শব্দ মিলেমিশে এক বিচিত্র গুঞ্জনধ্বনি তৈরি হয়েছে হলে।

আরো ছিলেন দুই ইংরাজ যাজক। একজন ডাক্তার আর একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। একপাশে এক চীনা পরিবারকেও চোখে পড়ছিল।

দীর্ঘাঙ্গী কালো স্থানীয় যুবতীরা নিপুণ হাতে খাদ্য পরিবেশন করছিল। তাদের তদারক করছিল ইতালির প্রধান ওয়েটার আর পানীয় পরিবেশনকারী।

সকলের ওপর সতর্ক নজর রাখছিল টিম কেণ্ডাল। তাকে সহায়তা করছিল তার স্ত্রী মলি। একরাশ সোনালী চুল আর হাসিঝলমল মুখের মলিকে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছিল।

একটু পরেই শুরু হল স্টীল ব্যাণ্ড। দ্বীপে এই জোরালো বাজনা খুবই জনপ্রিয়। যদিও মিস মারপলের মোটেই ভাল লাগল না।

গান আর বাদ্যের তালে তালে নাচও শুরু হয়েছিল। মিস মারপল লক্ষ্য করলেন এ নাচে ব্যায়ামের ধাঁচে অদ্ভুতভাবে সারা শরীর বেঁকে যায়। তরুণ-তরুণীরা বেশ উপভোগ করছে।

কাছেই টেবিলে বসেছিলেন গোলগাল চেহারার ক্যানন প্রেসকট আর তার বোন। কেমন ভয় জাগানো মুখভাব মহিলার। চেহারাও কৃশ।

মিস প্রেসকট সারাদিন ধরে কোথায় কোথায় ঘুরেছেন সেই বিবরণ শোনাতে লাগলেন মিস মারপলকে। এরা দুই ভাইবোন বেশ কিছুদিন গোল্ডেন পাম হোটেলে রয়েছেন। কফি পানের ফাঁকে অতিথিদের সম্পর্কে নানা কথা বলতে লাগলেন।

বৃদ্ধ মিঃ র‍্যাফায়েল প্রতি বছরই এখানে আসেন। লোকটি টাকার পাহাড়ের মালিক। বয়স প্রায় আশি। তার সঙ্গে রয়েছে সেক্রেটারী অল্পবয়সী একটি মেয়ে। এসথার ওয়াল্টার্স। সে চিচেস্টারে থাকে, বিধবা।

মিঃ র‍্যাফায়েলের সঙ্গে তার ভ্যালেও রয়েছে। তার নাম জ্যাকসন। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মিঃ র‍্যাফায়েলের অঙ্গসংবাহন করে সে একজন নার্সের মতই।

ক্রমে সকলেই আলাদা দল করে হলঘরে ছড়িয়ে পড়ছিল। হিলিংডন-ডাইসন চারজনের দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মেজর প্যালগ্রেভ।

মিস মারপল সেই দিকে ইঙ্গিত করে তাদের সম্পর্কে কৌতূহল প্রকাশ করলেন।

ক্যানন প্রেসকট জানালেন, প্রতিবছরই তারা ওয়েস্ট ইণ্ডিজে নানা দ্বীপে ঘুরে তিনমাস কাটিয়ে যান। এখানে গত বছরও এসেছিলেন।

লম্বা লোকটি হলেন হিলিংডন, তারা স্বামী-স্ত্রী উদ্ভিদবিদ। অন্য দুজন হলেন আমেরিকান মিঃ ও মিসেস ডাইসন। ভদ্রমহিলা প্রজাপতির ওপরে লেখালেখি করে থাকেন। পাখির বিষয়েও সকলে উৎসাহী।

এই টেবিলে যাদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তাদের দিক থেকে স্টীল ব্যাণ্ডেল শব্দ ছাপিয়ে হাসির শব্দ ভেসে আসছিল।

সেদিকে তাকিয়ে মিস মারপল বললেন, মানুষের পরিচয় জানাটা বেশ আনন্দের।

–এবং মজার। গতবছর আমি ওদের দেখে তো ভেবে নিয়েছিলাম মিসেস ডাইসনই বুঝি মিসেস হিলিংডন। পরে ভুল ভেঙ্গেছিল।

মিস মারপল বললেন, মিঃ ডাইসন তার স্ত্রীকে ডাকেন লাকি বলে। ওটা কি তার ডাকনাম?

মিঃ ক্যানন বললেন, স্ত্রীর দৌলতে ভাগ্য ফিরেছিল বলে মিঃ ডাইসন ওই নামে ডাকেন বলে শুনেছি।

এমনি একে একে অন্যান্য সকলের সম্পর্কেই নানা কথা জানা হয়ে গেল মিস মারপলের।

একসময় মিঃ র‍্যাফায়েলের টেবিলে দৃষ্টি পড়ল তার। অবিশ্বাস্য ধনী এই লোকটিকে জরাগ্রস্ত শিকারী পাখি বলে মনে হল তার।

শরীর অত্যন্ত কৃশ। তবে দৃষ্টি বেশ তীক্ষ্ণ। খুবই খিটখিটে মেজাজের হলেও লোকে মানিয়ে নেয় তিনি ধনী বলে। ব্যক্তিত্ব অসাধারণ।

ভদ্রলোকের ভ্যালে সঙ্গী সুদর্শন দীর্ঘাকৃতি মিঃ জ্যাকসন দাঁড়িয়ে আছেন পাশে।

.

০৩.

শয্যায় বসেই প্রাতরাশ সারলেন মিস মারপল। চা, সেদ্ধ ডিম আর এক টুকরো পেঁপে।

প্রাতঃরাশ শেষ হলে অভ্যাস মত হোটেলের পথ ধরে এগোলেন। পথেই দেখা হয়ে গেল মলি কেণ্ডেলের সঙ্গে। তার চোখেমুখে কেমন একটা বিপর্যন্ত ভাব।

উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি জানতে চাইলেন, কি হল? অমন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে কেন?

মলি বিমর্ষভাবে জবাব দিল, খুবই দুঃসংবাদ। সকলেই জানছেন একে একে–মেজর প্যালগ্রেড পরা গেছেন।

-সেকি, কখন? গতকালও তাকে বেশ হাসিখুশি দেখেছি। বিস্মিত হলেন মিস মারপল।

–গত রাত্রিতে আকস্মিকভাবেই মৃত্যুটা হয়েছে। তিনি রক্তচাপের রোগী ছিলেন।

–কিন্তু আজকাল তো এ রোগের যথেষ্ট ভাল ওষুধ আছে।

–তা আছে। সেটা খেতেই হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন কিংবা বেশি খেয়ে ফেলেছিলেন।

–ডাক্তার কি বলছেন? উদ্বিগ্ন ভাবে জানতে চাইলেন মিস মারপল।

-অবসর নেবার পর থেকে ডাঃ গ্রাহাম তো হোটেলেই থাকেন। তিনি দেখেছেন, স্থানীয় ডাক্তারও দেখেছেন। তারাই ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন। তাদের অভিমত উচ্চ রক্তচাপ থাকলে এরকম হতে পারে। তার ওপর গতরাত্রে মদের পরিমাণটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল।

একটু থেমে মলি আবার বলল, কিন্তু আমাদের কাছে ঘটনাটা মস্ত বড় আঘাত। হোটেলের খাবার সম্বন্ধে লোকের মনে সন্দেহ দেখা দিতে পারে।

–কিন্তু চলতে চলতে বললেন মিস মারপল। তার মনে পড়ল, গতকালই হিলিংডন আর ডাইসনদের সঙ্গে বেশ হাসিখুশি মেজাজে ছিলেন। কথাটা মনে হতেই তিনি গতি পাল্টে সমুদ্রতীরে না গিয়ে বারান্দার ছায়ায় এসে বসলেন।

হাতের উলের কাটা খুব দ্রুত চলছিল। আকস্মিক দুঃসংবাদটা তাকে খুবই ছন্দহারা করে তুলেছিল।

গতকালই মেজর প্যালগ্রেভ কেনিয়ার কথা, ভারতের কথা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত তারপর খুনের ঘটনা অনেককিছুই সোৎসাহে শুনিয়েছিলেন।

পশমের গুলি পড়ে গেলে মেজর তা তুলে দিয়ে সেই খুনীর ফটোর কথাটা বলেছিলেন।

তেমন আগ্রহ নিয়ে তখন শুনতে চাননি তিনি…কোন ক্লাবে তার ডাক্তার বন্ধু শুনেছিলেন তার এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে। একজন ডাক্তার ছবি তুলেছিলেন সেই খুনী যখন সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছিল।

বিশেষ করে এই ঘটনাটাই ঘুরেফিরে মনে আসতে লাগল মিস মারপলের। ফটোটা দেখাবেন বলে মেজর পকেটব্যাগ বার করেছিলেন। সেই মুহূর্তেই তিনি পদশব্দ লক্ষ্য করে তাকিয়েছিলেন।

তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, সেই সময় মুখ লাল হয়ে উঠেছিল মেজরের। কেমন কাঁপা হাতে আচমকা সব গুটিয়ে নিয়েছিলেন। অস্বাভাবিক ভাবে হাতির দাঁতের গল্প শুরু করেছিলেন।

কয়েক মুহূর্ত পরেই হিলিংডন আর ডাইসনরা তাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। সেই সময় ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে মিস মারপল তাকিয়েছিলেন। কাউকে দেখতে পাননি। কেবল একটু দূরে হোটেলের দিকে টিম কেণ্ডাল আর তার স্ত্রীকে চোখে পড়েছিল।

মেজর প্যালগ্রেভ সেদিকে অবশ্য তাকাননি।

এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা নিয়ে মধ্যাহ্নভোেজ পর্যন্ত চিন্তায় ডুবে রইলেন মিস মারপল। বিকেলেও বেড়াতে বেরলেন না। কি মনে করে ডাঃ গ্রাহামকে তার শরীর ভাল লাগছে না বলে একটা চিরকূট পাঠালেন।

.

০৪.

ওয়েস্ট ইণ্ডিজে দীর্ঘদিন ডাক্তারী করার পর অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন ডাঃ গ্রাহাম। বয়স এখন পঁয়ষট্টির কোঠায়। বেশ সদাশয় মানুষ।

চিরকূট পেয়েই তিনি উপস্থিত হলেন এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে মিস মারপলের শরীরের অসুবিধার কথা জানতে চাইলেন।

হাঁটুর ঝামেলা মিস মারপলের নিত্যসঙ্গী। সেই কথাটাই তিনি জানালেন।

ডাক্তার যথারীতি ওষুধের কথা লিখে দিলেন। পরে মিস মারপলের একাকীত্বের কথা ভেবে কথা বলতে লাগলেন।

মিস মারপল নিজের মনে লজ্জিত বোধ করছিলেন। মিথ্যা কথা বলে ডাক্তারকে ডেকে এনেছেন বলে। এছাড়া আর কিই বা তাঁর করার ছিল।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সত্যবাদী এবং সত্যকে শ্রদ্ধা করার মানুষ। কিন্তু দরকারে নির্বিচারে মিথ্যার আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করেন না।

একসময় তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে নিলেন। সামান্য কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ডাঃ গ্রাহাম, আপনাকে আর একটা কথা বলতে চাইছিলাম। মেজর প্যালগ্রেভকে নিয়ে। সকালে তার মৃত্যু সংবাদটা পেয়ে খুবই আঘাত পাই।

–হ্যাঁ। এমন হাসিখুশি মানুষটা…

–গতকালই তিনি দুনিয়ার নানা অঞ্চলের গল্প শোনাচ্ছিলেন।

–গল্প করার সুযোগ পেলে বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠতেন। অনেকেই বিরক্ত বোধ করত অবশ্য।

–মেজর তার ছেলেবেলার কথা শুনিয়েছিলেন, মিস মারপল অকম্পিত গলায় বলতে লাগলেন, সেই সময় আমি আমার এক ভাইপোর ছবি তাঁকে দেখাই। আমার কাছে সে চিরকালই খুব আদরের।

উনি যখন ছবিটা দেখছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তেই ওই যে ফুল আর প্রজাপতি সংগ্রহ করেন..কর্নেল আর মিসেস হিলিংডন…ওরা উপস্থিত হন।

মেজর তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্কভাবে ছবিটা তার ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেন। সেই সময় আর তাকে বিরক্ত করতে চাইনি। ভেবেছিলাম সকালে চেয়ে নেব। কিন্তু সকালেই তো…

কথা শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিস মারপল।

ডাঃ গ্রাহাম সহানুভূতির স্বরে বললেন, সেই ছবিটা আপনি ফেরত চাইছেন, এই তত?

সঙ্কোচের সঙ্গে মিস মারপল বললেন, আমার ভাইপো, প্রিয় ডেনজিল পাঁচবছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

খুবই বিব্রত বোধ করছি আপনাকে বলতে–মেজরের জিনিসপত্র কে দেখাশোনা করছে জানি না তো তাই আপনাকে

-আমি বুঝতে পারছি। কাল অন্ত্যেষ্টি হবে। তার জিনিসপত্রের ব্যাপারটা কালই দেখা হবে–আচ্ছা, ফটোটার একটু বর্ণনা যদি দেন সুবিধা হয়।

মিস মারপল সহজ গলায় বললেন, ছবিটা তুলেছিল আমার আর এক ভাইপো। হিবিসকাস বা লিলিজাতীয় কোন ফুলের ছবি তুলছিল, সেই সময় ডেনজিল দরজা দিয়ে বেরচ্ছিল। খুব ভাল ওঠেনি যদিও, কিন্তু ওই ছবি দেখেই আমি তার স্মৃতিচারণ করি।

–মনে হচ্ছে ছবিটা আপনাকে ফিরিয়ে দিতে কোনো অসুবিধা হবে না।

বলে ডাঃ গ্রাহাম উঠে দাঁড়ালেন।

মিস মারপল তাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন।

.

০৫.

যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গেই পরলোকগত মেজর প্যালগ্রেভের অন্ত্যেস্টিক্রয়া সম্পন্ন হল পরদিন। কিন্তু এই স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা এখানকার সামাজিক আনন্দের জীবনে কোন দাগ কাটতে পারল না। যেন খুব তাড়াতাড়িই সকলে ভুলে গেল।

মেজরকে অবশ্য তেমন করে কেউই চিনতেন না এখানে। নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। কিন্তু অন্যেরা শুনতে চাইতেন না।

বহুবছর আগেই স্ত্রী গত হয়েছিল তার। নিঃসঙ্গ জীবন অতীত দিনের গল্প আর হাসিখুশিতে ভরিয়ে রাখতে চাইতেন।

একসপ্তাহ পরে হয়তো কেউ আর তাকে মনেও করবে না।

মিস মারপল কিন্তু এত সহজে ভুলতে পারলেন না মেজরের কথা। এতে অবশ্য ব্যক্তিগত কোন আকর্ষণের ব্যাপার নেই। আলাপচারিতার মাধ্যমেই দুজন বয়স্ক মানুষের মধ্যে একটা মানবিক আবেদনের সূত্র তৈরি হয়েছিল।

মেজরের দুঃখজনক আকস্মিক মৃত্যুর জন্য তিনি শোকসন্তপ্ত না হলেও তার অভাব বেশ বোধ করছেন।

অন্ত্যেষ্টির দিন বিকেলে মিস মারপল যথারীতি তার পছন্দের জায়গায় বসে উল বুনছিলেন। ডাঃ গ্রাহাম এসে তার সঙ্গে মিলিত হলেন। পরে তিনি দুঃখপ্রকাশ করে জানালেন, মিস মারপলের মূল্যবান ফটোটি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

হতাশকণ্ঠে মিস মারপল বললেন, কি আর করা যাবে। কিন্তু ছবিটা মেজর প্যালগ্রেভের ব্যাগেই তো ছিল।

পকেট, অন্যান্য জিনিসপত্র, সবই খুঁজে দেখা হয়েছে। কয়েকটা চিঠি, খবরের কাগজের টুকরোটাকরার সঙ্গে আরো কয়েকটা ফটোও ছিল। কিন্তু আপনি যেমন বলেছেন তেমন কোন ফটো ছিল না।

দুর্ভাগ্য। আপনি যথেষ্ট করেছেন ডাঃ গ্রাহাম। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

কথা শেষ করে একমুহূর্ত থামলেন মিস মারপল। পরে বললেন, বাড়ির বাইরে এমনভাবে মৃত্যু হওয়াটা খুবই দুঃখজনক। ফুসফুসের কোন দোষ ছিল নিশ্চয়ই

-তা মনে হয় না, বললেন ডাঃ গ্রাহাম, মনে হয় উচ্চ রক্তচাপে ভুগতেন।

–এসব ক্ষেত্রে অবশ্য মৃত্যু ঘটা স্বাভাবিক। তবে রোগের কথা তো কখনো বলতে শুনিনি।

-তার চিকিৎসা আগে আমি কখনো করিনি। ব্লাড প্রেসারও নিইনি। তবে ব্লাড প্রেসারে অ্যালকোহল খুবই ক্ষতিকর।

–এজন্য তো শুনেছি ট্যাবলেট খেতে হয়।

–হ্যাঁ। ওর ঘরেও সেরেনাইটের একটা শিশি ছিল।

-আজকাল বিজ্ঞান নানা দিকেই কত উন্নতি করেছে। আচ্ছা, বলছেন মেজরের পকেটে কোন ছবি ছিল না।

–আপনার বর্ণনা মত আপনার ভাইপোর ছবি ছিল না। মেজরের নিজের কিছু ছবি ছিল।

এরপর মিস মারপলের হাঁটুর খোঁজখবর নিয়ে ডাঃ গ্রাহাম বিদায় নেন।

মিস মারপলের মুখে গভীর চিন্তার ছাপ পড়ে তিনি উদাস ভাবে পাম সারি আর সুনীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

একটা সন্দেহের নিরসন হয়েছে। এবারে যা জেনেছেন তা নিয়ে তাঁকে ভাবতে হবে। তার সামনেই ছবিটা মেজর পকেটব্যাগে রেখেছিলেন। অথচ তার মৃত্যুর পর সেই ছবিটাই পাওয়া গেল না।

যে ছবি এত যত্ন করে রেখে দিয়েছেন, মেজর যে সেটা ফেলে দিতে পারেন না তা সহজেই অনুমান করা চলে।

ছবিটা তার মৃত্যুর পরেও ব্যাগেই থাকা উচিত ছিল। টাকা চুরি হতে পারে, কিন্তু বিশেষ উদ্দেশ্য না থাকলে কোন ফটো কেউ চুরি করবে না।

যত চিন্তার গভীরে প্রবেশ করছিলেন, মিস মারপলের মুখ ততই গম্ভীর হচ্ছিল। একটা সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হবে। রহস্যের গন্ধ নাকে লেগেছে।

একেবারেই আকস্মিকভাবে মৃত্যুটা ঘটেছে, ডাক্তারদের মত অত সরলভাবে মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। _ যদি মেজর অসুস্থ বোধ করেই থাকেন, উচ্চ রক্তচাপের ট্যাবলেট তো তার ঘরেই ছিল–সেটা কেন খাননি?

আর যদি রক্তচাপের ব্যাপারটা বানানো হয় আর মেজরের পকেট থেকে ছবিটা সরিয়ে ফেলে থাকে কেউ; তবে নিঃসন্দেহে সেই ব্যক্তির পক্ষেই ওষুধের শিশি তার ঘরে রেখে দেওয়া সম্ভব।

তবে মিস মারপল নিজে কখনো মেজরকে ওষুধ খেতে দেখেননি। উচ্চ রক্তচাপের কথাও কখনো তিনি বলেননি।

তবে তার মনে পড়ছে, মেজরের উচ্চ রক্তচাপের কথাটা কেউ যেন তাকে শুনিয়েছিল। কিন্তু কে বলেছিল মনে করতে পারছেন না।

মিস মারপল ধীরে ধীরে একেবারে গোড়ায় ফিরে গেলেন। খুন আর খুনীদের নিয়ে মেজর যে গল্প করেছিলেন সেটাই পর্যালোচনা করতে শুরু করলেন।

.

০৬.

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মিস মারপল সিদ্ধান্ত নিলেন, খুনের ঘটনার সন্দেহ নিরসন করবার জন্য খোঁজখবর নেবেন তিনি।

এতে হয়তো উপযাচক হয়ে তাকে একটু বেশিই কথা বলতে হবে। তবে বৃদ্ধাদের বেশি কথা বলাটা সকলেই প্রায় মেনে নেয়। সেই সুযোগই নিতে হবে।

কথাবার্তা আলোচনা চালিয়ে তাকে কিছু মানুষ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। মিস মারপলের চিন্তা ঘিরে এমনি কয়জন মানুষের মুখ পর্যায়ক্রমে ভেসে বেড়াচ্ছিল।

মেজর যদি খুন হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি তার জীবনের কোন গোপন রহস্যের জন্য কিংবা অর্থের জন্য অথবা প্রতিশোধের জন্য খুন হননি।

মিস মারপলের ধারণা মেজর বেশি কথা বলতেন, অনেক কথা সকলকে জানাতেন,এটাই খুনের মুখ্য উদ্দেশ্য।

ডাঃ গ্রাহামের কাছ থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর জানতে পেরেছেন তিনি। নিজেরই বেশ কিছু ছবি–পোলো খেলার পোশাকের, বাঘ শিকারীর পোশাকের এমনি ধরনের, মেজরের ওয়ালেটে ছিল। এসব ছবি রেখে দেয়ার কি কোন উদ্দেশ্য ছিল? মেজর হয়তো ওসব ছবি দেখিয়ে ঘটনার বর্ণনা শুনিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন…সন্দেহভাজন খুনী হয়তো তাতেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ভবিষ্যতে তার ফটো দেখিয়েও কোন কাহিনীর জন্ম নেবার সম্ভাবনা ছিল।

মিস মারপলের মনে পড়ল, খুনের ঘটনার প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই পকেট থেকে ব্যাগ বার করে মেজর বলেছিলেন, লোকটাকে দেখে খুনী বলে মনে হয় কিনা বলুন তো।

তিনি বুঝতে পারছেন, এভাবে সকলকে বলে বেড়ানো তার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। খুনীর কাহিনীর সঙ্গে অনিবার্য ভাবে ছবিটাও নিশ্চয় প্রদর্শিত হত। খুনের গল্প বেশ উৎসাহের সঙ্গেই বলতে লক্ষ্য করেছেন তিনি।

সম্ভবতঃ এখানে এ গল্প নিশ্চয় তিনি আগেও কাউকে শুনিয়ে থাকবেন। হয়তো কয়েকজনকেই তাহলে কাহিনীর বর্ণনার সঙ্গে ছবির খুনীরও একটা চেহারার আভাস কারো কাছ থেকে নিশ্চয়ই পাওয়া যেতে পারে।

হ্যাঁ, এটাই ঠিক পথ। ভাবলেন মিস পারপল। এভাবেই শুরু করবেন তিনি।

তার মনের সন্দেহভাজন। ব্যক্তিদের কথা মনে করতে গিয়ে মিস মারপলের স্মরণে এল মেজর যেভাবে খুনীর বর্ণনা করেছিলেন, তাতে বোঝা যায় সে একজন পুরুষ। কিন্তু এখানে পুরুষ দুজন। কর্নেল হিলিংডন এবং মিঃ ডাইসন।

আপাতদৃষ্টিতে এদের কাউকেই খুনী ভাবা যায় না। তবে বাইরের চেহারাটাই তো মানুষের সব নয়। কিন্তু আর কেউ কি থাকা সম্ভব?

আশপাশে তো সেই মুহূর্তে মাথা ঘুরিয়ে আর কাউকে চোখে পড়েনি। কেবল মিঃ র‍্যাফায়েলের বাংলোটা চোখে পড়েছিল।

কেউ বাংলো থেকে বেরিয়ে এসে আবার ভেতরে চলে যায়নি তো?

মিস মারপল ভাবলেন, যদি সত্যি এমন হয়, তাহলে নির্ঘাৎ সেই লোক ধনকুবেরের সেই সঙ্গী-জ্যাকসন। ছবির বিষয়ের মতই কি সে-ও দরজা দিয়ে বাইরে আসছে? আর সেই সময়েই নজরে পড়ে গিয়েছিল মেজরের? এবং তিনি চিনতে পেরেছিলেন?

দেখাবার জন্য ফটোটা হাতে নিয়ে মেজর মিস মারপলের ডান কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন…তখনই কি তিনি দরজা দিয়ে ছবির সেই খুনীকে বাইরে আসতে দেখে সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন?

রাতে শুতে যাবার আগে মিস মারপল তার আগামীকালের কাজের তালিকা করলেন এভাবে–হিলিংডনদের, ডাইসনদের আর আর্থার জ্যাকসন সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে।

.

মাঝরাতে ডাঃ গ্রাহামের বরাবরই ঘুম ভেঙ্গে যায়। পরে আবার ঘুমিয়ে পড়েন।

আজ রাতে ঘুম ভাঙ্গতেই কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করলেন তিনি। অস্বস্তিটা কি কারণে ঠিক বুঝতে পারলেন না। কিন্তু এমন উদ্বেগের ভাব বহুকাল তার হয়নি।

সহসা তার মনে হল, মেজরের মৃত্যু সম্পর্কে সব কি ঠিকঠাক আছে? কিন্তু তিনি তো ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন।

মেজরের ঘরে সেরেনাইট ট্যাবলেটের শিশি পাওয়া গিয়েছিল। আর মেজর নিজেও তার ব্লাডপ্রেসারের কথা সবাইকে বলেছিলেন।

না, মেজরের মৃত্যুর মধ্যে কোন রহস্য লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। নিশ্চিন্ত হয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন ডাঃ গ্রাহাম।

.

জায়গাটা হোটেলের চৌহদ্দির বাইরে খাড়ির পাশে। এখানে এলোমেলো ভাবে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট কিছু কুটির। তাদেরই একটির ভেতরে নিজের বিছানায় উঠে বসেছে ভিক্টোরিয়া জনসন।

এই অঞ্চলের অন্যতম দ্রষ্টব্য বলা যায় ভিক্টোরিয়াকে। তাকে দেখলে কষ্টিপাথরে গড়া একটি অপূর্ব ভাস্কর্য বলেই ভুল হয় সকলের।

পাশেই নিদ্রিত ছিল ভিক্টোরিয়ার সঙ্গী। কোঁকড়ানো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে সে তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলল।

-এই, ওঠ শিগগির

–কি হল, এখনও রাত শেষ হয়নি।

ঘুমজড়ানো গলায় বিশালদেহী পুরুষটি বলে উঠল। তার সাদা দাঁতের সারি যেন অন্ধকারেই ঝিকিয়ে উঠল।

-কি বলছিস?

–যে মেজর লোকটা মারা গেছে–সেই ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না। কোথাও একটা যেন গোলমাল আছে।

-বুড়ো মারা গেছে–এ নিয়ে তুই অত ভাবছিস কেন?

–পিলগুলোর কথা যে ভুলতে পারছি না।

–বেশি করে খেয়ে ফেলেছিলেন হয়তো।

ভিক্টোরিয়া রীতিমত হাঁপাচ্ছিল। সে কাছে এগিয়ে এসে বলল, শোন, সকাল হলেই আমি মিসেস কেণ্ডালকে বলব। নির্ঘাৎ কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে।

লোকটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি ভিক্টোরিয়ার। তবু তারা দুজনে স্বামীস্ত্রী হয়ে আছে। সে হাই তুলে বলল, বোকার মত গণ্ডগোল ডেকে আনিস না। এখন ঘুমো।

দুজনে আবার পাশাপাশি শুয়ে পড়ল।

.

০৭.

হোটেলের সামনে বেলাভূমিতে বেলা এগারোটার মধ্যেই বেশ ভিড় জমে ওঠে। সামাজিক মেলামেশায় জায়গাটা জমজমাট হয়ে ওঠে।

ইভিলিন হিলিংডন জল ছেড়ে তীরে উঠে স্নানের টুপি খুলে বালির ওপরে বসে পড়ল।

ইভিলিনের ডান পাশেই একটা চেয়ারে বসেছিলেন সেনোরা দ্য ক্যাসপিয়েরো। তিনি ভেনেজুয়েলা থেকে এসেছেন।

খানিক তফাতেই হুইলচেয়ারে বসেছিলেন অর্থবান ব্যক্তি মিঃ র‍্যাফায়েল। আপাতত তিনিই হোটেলের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার দেখাশোনার জন্য পাশেই উপস্থিত রয়েছে এসথার ওয়াল্টার্স।

মিস মারপলও একপাশে বসে পশম বুনে চলেছেন। তার কান ছিল বাইরের কথাবার্তার দিকে। তবে প্রয়োজনে দু-একটা মন্তব্যও যে করছিলেন না তা নয়।

ইভিলিন হিলিংডন মাঝে মাঝে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছিল মিস মারপলের দিকে।

একসময় ইভিলিনকে উদ্দেশ্য করে মিস মারপল বললেন, এমন একটা চমৎকার জায়গায় আসব আগে কখনো ভাবিনি। এখানে তো আপনি আগেও এসেছেন, তাই না মিসেস হিলিংডন।

–বার দুয়েক এসেছিলাম।

নিশ্চয়ই প্রজাপতি আর ফুলের নেশায়? সঙ্গে আপনার বন্ধুরাও ছিলেন নিশ্চয়ই?

–হ্যাঁ, স্রেফ বন্ধু। কয়েক বছর একসঙ্গেই ঘোরাঘুরি করছি।

এভাবে শুরু করা কথা একসময় মেজর প্যালগ্রেভের প্রসঙ্গে চলে এলো। দেখা গেল তার ব্লাডপ্রেসার সম্পর্কে দুরকম ধারণা প্রচারিত। হা এবং না।

মিঃ র‍্যাফায়েল তো জোর দিয়েই বললেন, তিনি নিজে আমাকে বলেছিলেন ওরকম কোন অসুবিধা তার ছিল না। বয়স অনুপাতে তার রক্তচাপ খুবই ভাল ছিল।

মিস মারপল বললেন, শুনেছি তিনি সেরেনাইট না কি-একটা ওষুধ খেতেন।

মিঃ র‍্যাফায়েল বললেন, প্রত্যেকেরই নিজের রোগভোগের বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত।

বেলা বারোটা বেজে গিয়েছিল। মিসেস এসথার ওয়ালটার্সের সাহায্য নিয়ে মিঃ র‍্যাফায়েল উঠে দাঁড়ালেন। তার স্নানের সময় হয়ে গিয়েছিল। দুজনে সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হলেন।

সেনোরা দ্য ক্যাসপিয়েরোকে উদ্দেশ্য করে মিস মারপল বললেন, মিসেস ডাইসন কোথায়। তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।

–সেই। লাকি নিশ্চয় অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথাও। সেনোরা দ্য ক্যাসপিয়েরো উত্তর করলেন।

-তাই বুঝি?

–ওর স্বভাবই ওই। ওর স্বামীরও নজর অন্য দিকে। মেয়ে দেখলেই ছোঁকছোঁক করে।

–হ্যাঁ, আপনার পক্ষে জানা সম্ভব।

.

অফিস ঘরে বসেছিল একা মিসেস কেণ্ডাল। হঠাৎ ধবধবে সাদা পোশাকে সজ্জিতা ভিক্টোরিয়া জনসন ঘরে প্রবেশ করল এবং অত্যন্ত সঙ্গোপন ভঙ্গীতে জানালো, ডাক্তারের কথায় ঘরে কি কি আছে দেখতে গিয়ে সে পরলোকগত মেজরের বাথরুমে তাকের ওপরে। দাঁতের মাজন, হজমের ওষুধ, অ্যাসপিরিনের সঙ্গে একটা পিলের শিশিও পেয়েছিল। সেরেনাইট। আগে কিন্তু সে এই শিশিটা সেখানে দেখেনি। তার সন্দেহ, কেউ গোপনে পিলগুলো সেখানে রেখেছিল আর সেগুলো খেয়ে মেজর মারা গেলেন।

মলি ভিক্টোরিয়ার কথার গুরুত্ব বুঝতে পেরে তীক্ষ্ণস্বরে বলল, আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি, তোমাকে ওসব ভাবতে হবে না। দয়া করে এধরনের বাজে গুজব ছড়িয়ে বেড়িয়ো না। তাতে আমাদের হোটেলের ক্ষতি হবে।

ভিক্টোরিয়া চলে গেলে মলি চিন্তিতভাবে কথাটা টিমকে জানালো। কিন্তু সে ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না। তবে বলল ডাঃ গ্রাহামের কাছে গেলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার জানা যাবে।

রোজ ঘর সাফাই করত বলে ঘরে জিনিসপত্র কোথায় কোনটা আছে ভিক্টোরিয়ার মনে গেঁথে গিয়েছিল। মেজরের মারা যাবার পরদিনের আগে সে বাথরুমের তাকে সেরেনাইটের শিশি কখনো দেখেনি। তার বিশ্বাস নিশ্চয়ই কেউ বিষের বড়ির শিশি সেখানে রেখে গিয়েছিল।

কেণ্ডাল দম্পতি এসবকথাই ডাঃ গ্রাহামকে জানান। তিনি ব্যাপারটা যাচাই করবার জন্য তখনই ভিক্টোরিয়াকে ডেকে পাঠালেন।

ভিক্টোরিয়া এসে বেশ জোরের সঙ্গেই একই কথা শোনালো ডাক্তারকে। ব্যাপারটা একেবারে যেন তার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।

ডাক্তার বললেন, ওটা বিষ নয় মেয়ে, খুব ভাল আর দরকারী ওষুধ। অসুখ থাকলে ওই ওষুধ মানুষকে খেতে হয়। তুমি মিছেই ভেবে হয়রান হচ্ছ।

উঃ বাঁচালেন আপনি আমাকে। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল ভিক্টোরিয়া। স্থানীয় মেয়েটি চলে গেলে ডাক্তার গ্রাহামের মনে রাতের অস্বস্তিটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তার মনের চাপটা যেন হঠাৎই বেড়ে গেল।

.

০৮.

মিঃ র‍্যাফায়েলের সেক্রেটারী এসথার ওয়াল্টার্স খুব সুন্দরী না হলেও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। সেদিন বিকেলে তার সঙ্গে বসে গল্প করছেন মিস মারপল। মেয়েটিকে একটু যাচাই করা তার উদ্দেশ্য।

কথার ফাঁকে মিস মারপল ওয়াল্টার্সের প্রসঙ্গ তুললেন।

-ও খুবই কাজের লোক। অঙ্গসংবাহক হিসেবেও যথেষ্ট দক্ষ। বলল মিস ওয়াল্টার্স।

–মনে হয় অনেক দিন আছে মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

খুব বেশি দিন নয়, আট-ন মাস হবে।

বিবাহিত নিশ্চয়ই?

–মনে হয় না।

–বেশ সুদর্শন যুবক।

–আমারও তাই মনে হয়।

খুবই নিরাসক্ত ভাবে জবাব দিল এসথার ওয়াল্টার্স। মিস মারপলের মনে হল, স্বামীহারা বলেই হয়তো এমন মানসিকতা হয়েছে।

–আপনি কি মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে অনেকদিন কাজ করছেন?

-বছর পঁচেক হবে। স্বামী মারা যাবার পর মেয়েটির জন্য একটা কাজের দরকার হয়ে পড়েছিল।

দৃষ্টিতে খানিকটা কৌতুক খানিকটা সহানুভূতির আভাস ফুটিয়ে মিস মারপল বললেন, মিঃ র‍্যাফায়েলের কাজ করা খুবই কঠিন, তাই না?

কঠিন ঠিক নয়, বুঝে চলতে হয়। মাঝে মাঝে পরস্পরবিরোধী কথা বলেন এই যা। মনে হয় খুব অল্পেই কোন মানুষ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা করে ফেলেন। তবে আমি ভালই মানিয়ে চলতে পারছি।

মিঃ জ্যাকসনকেও খুব বাধ্য বলে মনে হয়।

–ও খুব কৌশলী আর যথেষ্ট বুদ্ধিমান।

এমনি কথাবার্তার ফাঁকে নানা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে মিস মারপল এক সময় চলে এলেন চার প্রকৃতিপ্রেমিক ডাইসন আর হিলিংডনদের বিষয়ে।

এসথার ওয়াল্টার্স বলল, ওরা চার বছর ধরে এখানে আসছেন। তবে গ্রেগরী ডাইসন অনেকবার এসেছেন। সম্ভবতঃ প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম এসেছিলেন, তার শরীর তখন ভাল ছিল না।

–তিনি কি মারা যান? না বিবাহবিচ্ছেদ?

-খুব সম্ভব এদেশেই ওয়েস্ট ইণ্ডিজের কোন দ্বীপে মারা যান। মনে হয় কোন গোলমাল ঘটেছিল। তবে স্ত্রী সম্পর্কে উনি কিছু বলতে চান না। সবই অবশ্য আমার শোনা কথা।

–ও আচ্ছা, তার পরই বুঝি কি রে মহিলাকে বিয়ে করেন! নামটা খুব অদ্ভুত।

–শুনেছি আগের স্ত্রী বর্তমান স্ত্রীর আত্মীয়া।

–হিলিংডনদের সঙ্গে ওদের পরিচয় বোধহয় অনেক দিনের।

বছর তিন-চার আগে এখানেই সম্ভবত আলাপ হয়।

–হিলিংডনদের খুবই শান্ত প্রকৃতির বলে মনে হয় আমার।

–হ্যাঁ। দুজনেই খুব নম্র।

–সবার কাছে তো শুনতে পাই ওদের দুজনের মধ্যে মনের টান খুব।

–কেন, আপনার সেরকম মনে হয় না!

বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল এসথার ওয়াল্টার্স। এর পরে আসল প্রসঙ্গে মোড় নিলেন মিস মারপল। বললেন, আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, যা ব্যাপার চলছে সে বিষয়ে মিঃ ডাইসন ওয়াকিবহাল।

–আমার কোন ধারণা নেই।

স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ পেল এসথার ওয়াল্টার্সের কণ্ঠে।

-যাই বলুন, মিঃ প্যালগ্রেভের ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক। কেণ্ডালরাও বিপাকে পড়ে গেল।

-হ্যাঁ, ওদের হোটেলেই তো ঘটনাটা ঘটল। মাত্র ছ মাস হল ওরা স্যানডারসনদের কাছ থেকে হোটেলের দায়িত্ব নিয়েছে।

তবে এখানে তো আনন্দের পরিবেশ। মৃত্যুর ঘটনা অতি অল্প সময়ই মানুষের মনে স্থায়ী হয়।

–একথা আমিও মলিকে বলেছি। ও খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।

-মিসেস কেণ্ডালকে দেখে অবশ্য খুবই উদ্বেগহীন মনে হয়। আমার মনে হয় ওর স্বামীর দুশ্চিন্তাই বেশি।

–মলি জোর করেই হাসিখুশি থাকে। হোটেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আগে থেকেই ভেবে ভেবে কেমন যেন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে।

-বেচারি। খুবই দুঃখজনক। তবে মৃত্যুটা তত খাদ্যে বিষক্রিয়া বা ওই ধরনের কিছু নয় তাই রক্ষে। এসবক্ষেত্রেই মানুষের সন্দেহ জাগে। তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, মেজর প্যালগ্রেভের কাছে কখনো শুনতে পাইনি যে তার উচ্চ রক্তচাপ ছিল। আপনাকে কোনদিন বলেছিলেন?

-কেউ হয়তো মিঃ র‍্যাফায়েলকে বলে থাকতে পারে। তবে মিঃ র‍্যাফায়েল আবার উল্টো কথা বলেন। জ্যাকসন একবার আমাকে বলেছিল, মেজরের মদ খাওয়া কমিয়ে দেওয়া উচিত।

মেজর প্যালগ্রেভকে তার বকবকানি স্বভাবের জন্য দেখছি অনেকেই পছন্দ করত না। . বিরক্তিকর ভাবে তিনি বারবার একই কাহিনী শোনাতেন।

–হ্যাঁ, নানা কৌশল করে তার গল্প বন্ধ করতে হত।

–আমার অবশ্য বারবার একই গল্প শুনতে অসুবিধা হয় না। কারণ, শোনার পর তা আর আমার মনে থাকে না।

মৃদু হাসলেন মিস মারপল।

–একটা কাহিনী শোনাতে তিনি খুব ভালবাসতেন, আবার বললেন মিস মারপল, একটা খুনের কাহিনী। আপনাকেও নিশ্চয়ই সেই গল্প শুনতে হয়েছে?

মনে হয় শুনেছিলাম। স্ত্রী তার স্বামীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে গ্যাসের উনুনে তার মাথা চেপে ধরে খুন করেছিল।

-না, ওই গল্প নয়–একটা ছবি ছিল মেজরের কাছে, সবাইকে দেখাতেন

–ঠিক মনে করতে পারছি না। আপনাকে দেখিয়েছিলেন?

–দেখাতে এনেছিলেন, তখনই বাধা পড়ে যায়।

.

০৯.

অনেক চেষ্টার পর মিস প্রেসকটকে একান্তে পেয়ে মিস মারপল নানা বিষয়ে আলোচনা জুড়লেন। একসময় ডাইসনদের প্রসঙ্গ এলো।

মিস প্রেসকট বললেন, প্রথম স্ত্রীর বিষয়ে মনে হয় কিছু কুৎসা রটনা হয়েছিল। তিনি এখানেই সম্ভবত মার্টিনিক বা টোবাগো দ্বীপে মারা যান। শুনেছি ওই অদ্ভুত নামধারী লাকি প্রথমা স্ত্রীর মাসতুতো বোন। লোককে এ নিয়েও নানা কথা বলতে শুনেছি।

তাই নাকি? বললেন মিস মারপল।

–মিঃ ডাইসন তো শুনেছি প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর একমাসের মধ্যেই দ্বিতীয় বিয়েটা করেছিলেন।

–মাত্র একমাস। নিশ্চয় এর সঙ্গে টাকাপয়সার ব্যাপার ছিল।

–ঠিক জানি না। তবে মিঃ ডাইসন তো শুনতে পাই প্রায় নাকি মজা করে বলেন লাকি তার ভাগ্য ফিরিয়েছে।

-হ্যাঁ, আমিও শুনেছি কথাটা।

–দ্বিতীয়জন অবশ্য খুবই সুন্দরী। তবে যতদূর জানি প্রথমা স্ত্রী স্বামীর জন্য যথেষ্ট টাকাকড়ি রেখে যান।

হিলিংডনদের অবস্থাও বোধহয় খুব ভালো।

–আমিও সেরকমই শুনেছি। ইংলণ্ডে নিজস্ব বাড়ি আছে। সারা শীতকালটা বেড়িয়ে বেড়ায়।

এই সময় ক্যানন প্রেসকট এলেন। মিস প্রেসকট তার সঙ্গে বেড়াতে চলে গেলেন। চেয়ারে একাই বসে রইলেন মিস মারপল।

একটু পরে পাশ দিয়ে হোটেলের দিকে যেতে যেতে মিঃ গ্রেগরী ডাইসন মিস মারপলকে দেখে একগাল হেসে চলে গেলেন।

মিস মারপল ভাবতে লাগলেন, সবকিছুই কেমন খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। মিসেস ডাইসনের মৃত্যুর কাহিনী-মেজর প্যালগ্রেভও একজন স্ত্রী-হত্যাকারী পুরুষের কাহিনী বলেছিলেন।

হঠাৎ পেছনে শব্দ পেয়ে চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে গেল। তাকিয়ে দেখেন লাকি এগিয়ে আসছে।

গ্রেগকে এদিকে দেখেছেন?

–এইমাত্র তো হোটেলের দিকে গেলেন।

–আশ্চর্য, অথচ আমি—

বলতে বলতে লাকি দ্রুত হোটেলের দিকে চলে গেলেন।

–এই সময় মিস মারপল দেখতে পেলেন মিঃ জ্যাকসনের সাহায্যে হুইল চেয়ারে বসে মিঃ র‍্যাফায়েল সকালের ভ্রমণে বেড়িয়েছেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে একা কিছুক্ষণ কথা বলার ইচ্ছা তার।

হুইল চেয়ার কাছাকাছি আসতেই তিনি সরাসরি বললেন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল মিঃ র‍্যাফায়েল।

-বলুন কি দরকার। নিশ্চয় আফ্রিকার কোন মিশন কিংবা গির্জা সারাইয়ের জন্য চাঁদা চাইবেন?

-হ্যাঁ, এসব ক্ষেত্রে কিছু চাঁদা পেলে তো খুশি হওয়াই যায়। তবে আপাতত আমার জিজ্ঞাসা হল, মেজর প্যালগ্রেভ আপনাকে কি কোন খুনের গল্প বলেছিলেন?

ওহ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলেন মিঃ র‍্যাফায়েল, আপনাকেও শুনিয়েছিলেন দেখছি।

–আপনাকে ঠিক কি বলেছিলেন জানতে ইচ্ছে করছে।

-মনে হয় স্বর্ণকেশী কোন তরুণী স্বামীকে খুন করেছিল।

একটু থিতিয়ে গেলেন মিস মারপল। তবু জানতে চাইলেন, কিভাবে, বিষ খাইয়ে?

–না। খুব বুদ্ধি খাঁটিয়ে ছিলেন মহিলা। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে গ্যাসের উনুনে চেপে ধরেছিলন। তারপর রটিয়ে দিয়েছিলেন আত্মহত্যা বলে।

–মেজর কোন ফটো দেখিয়েছিলেন আপনাকে?

–কার, সেই স্ত্রীলোকটির? না–

এই সময় ডাঃ গ্রাহাম একটা বই হাতে এসে চেয়ারে বসে পড়লেন। তাকে দেখে মিস মারপল জিজ্ঞেস করলেন, টিম কোল খুব চিন্তিত দেখছি।

–হ্যাঁ। আমরা সকলেই তো চিন্তায় রয়েছি।

–নিশ্চয় মেজর প্যালগ্রেভের মৃত্যুর ব্যাপারে ভাবছেন?

–না, স্ত্রীকে নিয়েই ভাবনায় পড়েছি। মাঝে মাঝেই খুব খারাপ স্বপ্ন দেখে ভয় পায়।

–কি ধরনের স্বপ্ন দেখে?

–কারা সব ওকে তাড়া করে, তার ওপরে নজর রাখে। জেগে উঠেও সেই রেশ থেকে যায়। ইদানিং মেজর প্যালগ্রেভের মৃত্যুর পর থেকে কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে দিন দিন।

কোন ডাক্তার

–ডাক্তারের নাম একদম শুনতে পারে না। দেখি কি করা যায়। এবারে উঠি মিস মারপল–কিছু কাজ পড়ে আছে।

বিদায় নিল টিম কেণ্ডাল।

অদূরে একটা চেয়ারে বসেছিলেন ডাঃ গ্রাহাম। তার দিকে তাকিয়ে মনস্থির করে নিলেন মিস মারপল। তারপর উঠে ডাঃ গ্রাহামের মুখোমুখি চেয়ারে বসে পড়লেন।

–আপনার কাছে মাপ চাইতে এলাম ডাঃ গ্রাহাম। সেদিন ইচ্ছে করেই মিথ্যা কথা বলেছিলাম।

অবাক হয়ে তাকালেন ডাঃ গ্রাহাম। বললন, এ নিয়ে অত ভাববার কি আছে? বলুন শুনি।

–এক ভাইপোর ছবির বিষয়ে বলেছিলাম মেজর প্যালগ্রেভকে দেখিয়েছিলাম। তিনি সেটা আমাকে ফেরত দেননি।

-হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ফটোটা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

–আসলে এরকম কোন ফটো ছিল না।

–কি বলছেন? তাহলে বলেছিলেন কেন?

এরপর মিস মারপল সবকথা খুলে বললেন। মেজর প্যালগ্রেভের খুনের কাহিনী-একটা ফটো বার করা, তারপর কিভাবে দেখাতে গিয়ে ব্যর্থ হন।

সবশেষে দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, আমার মনে হয়েছিল মিথ্যা কিছু বললে হয়তো ফটোটা দেখা সম্ভব হতে পারে।

–কোন খুনীর ফটো আপনাকে মেজর দেখাতে চেয়েছিলেন?

-হ্যাঁ, ওরকমই বলেছিলেন তিনি। আশ্চর্য ব্যাপার হল তার পরদিনই তিনি মারা যান। আর ফটোটাও অদৃশ্য হয়।

ডাঃ গ্রাহাম অদ্ভুত দৃষ্টিতে মিস মারপলের দিকে তাকালেন। মিস মারপল ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, এখন আপনি আমার কথা নিশ্চয়ই অবিশ্বাস করবেন না। আমি পরে স্থির করি সবকথা আপনাকে বললে হয়তো কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।

.

১০.

সেদিনই ডাঃ গ্রাহাম জেমসটাউন অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের অফিসে তার বন্ধু ডেভেনট্রির সঙ্গে দেখা করলেন। গোড়া থেকে সব ঘটনা তাকে খুলে বললেন। সবশেষে বললেন, মেজরের মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক বলেই অন্য সকলের মত আমিও মেনে নিতে পারতাম যদি না ফটো অদৃশ্য হয়ে যেত। তাছাড়া হোটেলের পরিচারিকাটিও জোরের সঙ্গেই ওষুধের বোতলের কথাটা জানিয়েছিল।

ডেভেনট্রি বললেন, মেজর ব্লাডপ্রেসারে মারা না গিয়ে থাকলে, তুমি বলতে চাইছ আসল ওষুধের বদলে কেউ অন্য ওষুধ রেখে দিয়েছিল?

ডাঃ গ্রাহাম বললেন, ভিক্টোরিয়া ওরকমই ভেবেছে। তবে আসল ঘটনা তা নয়। মেজরকে কেউ মারার উদ্দেশ্যে পানীয় বা অন্য কিছুর সঙ্গে কিছু খাইয়ে দিয়েছিল। আর মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক রূপ দেওয়ার জন্য ব্লাডপ্রেসারের ওষুধের শিশি তার ঘরে রেখে দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে রটনা করে দেওয়া হয় মেজর উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। ব্যাপারটা অত্যন্ত বুদ্ধির সঙ্গে করা হয়েছে।

-হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, মেজরের মৃত্যুর পর সবাই তার ব্লাডপ্রেসারের ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করছে। তাহলে ব্যাপারটা আমি কি গোয়েন্দা দপ্তরকে জানাব? তাহলে মেজরের দেহ বের করে তদন্ত করা যায়।

করতে হবে খুব গোপনে।

-কিন্তু এখনো ভেবে দেখো–গোটা ব্যাপারটাই একটা কল্পনার প্রাসাদ বলে প্রমাণ হয়ে যাবে না তো?

–তেমন হলে তো আমিও স্বস্তি পাই।

২. ডাইনিং রুমে টুকিটাকি কাজ

১১.

ডাইনিং রুমে টুকিটাকি কাজ সেরে নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল মলি। পানভোজন গানবাজনা হৈ হট্টগোলের আর একটা সন্ধ্যা এগিয়ে আসছে। হোটেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা চিন্তা তার মাথায়। টিম আর মলি দুজনে মিলে অনেক স্বপ্ন দেখে চলেছে।

এই সময় মিঃ ডাইসন যেন আচমকা সেখানে উপস্থিত হলেন।

-খুব দুঃখিত, চমকে দিলাম বোধহয়?

–ওঃ মিঃ ডাইসন। সত্যিই, আপনি এসেছেন একদম টের পাইনি।

আশপাশে তখনো কেউ এসে পৌঁছায়নি। মলিকে নিভৃতে পেয়ে খুব আন্তরিক স্বরে মিঃ ডাইসন কথা বলতে লাগলেন। পরে বললেন, ভাবছি তুমি আর আমি একদিন পিকনিক করব।

-মন্দ কি করা যাবে।

বলে মিষ্টি হেসে মলি মিঃ গ্রেগরীকে এড়িয়ে বারে গিয়ে ঢুকল। টিম কাছেই ছিল। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ওখানে মনে হল কার সঙ্গে কথা বলছিলে?

–গ্রেগরী ডাইসন। একটু রঙ্গরস করতে চাইছিল।

–লোকটা মেয়েদের দেখলেই নানারকম প্রস্তাব করে। একটু কড়কে দেওয়া দরকার।

ভেবো না, সময় বুঝে আমিই ব্যবস্থা করতে পারব।

এই সময় টিম কি কাজে সেখান থেকে আবার সরে গেল। মলি রান্নাঘরে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে তীরের দিকে চলতে লাগল।

.

গ্রেগরী ডাইসন আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে নিজের বাংলোর কাছাকাছি আসতেই অন্ধকারে ঝোপের ভেতর থেকে ভূতের ছায়ার মত ভিক্টোরিয়া তার সামনে এসে দাঁড়াল।

মিঃ ডাইসন, একটা কথা বলব আপনাকে।

–অ তুমি। কি হয়েছে?

–দেখুন তো, এটা আপনারই তো?

ট্যাবলেট ভর্তি একটা শিশি সে এগিয়ে ধরল।

-ওঃ, আমার সেরেনাইটের বোতল। এটা আমারই। কোথায় পেলে তুমি?

–সেই মেজর ভদ্রলোকের ঘরে–যিনি এখন কবরে শুয়ে আছে।

–মেজর প্যালগ্রেভের বাংলোতে?

-হ্যাঁ। ওরা আমাকে ঘরের সব জিনিস ফেলে দিতে বলেছিল-টুথপেস্ট, মালিশ, এই ওষুধটাও। এটা আপনি পাচ্ছিলেন না বলে খুঁজে দেখতে বলেছিলেন, তাই নিয়ে এলাম।

–হ্যাঁ, মনে পড়েছে বলেছিলাম। কোথায় রেখেছি মনে করতে পারছিলাম না।

-আপনি কোথাও রাখেননি। আপনার বাংলো থেকে নিয়ে মেজরের বাংলোতে রাখা হয়েছিল।

-তুমি জানলে কি করে?

–আমি দেখেছি, ঝকঝকে সাদা দাঁত বার করে হাসল ভিক্টোরিয়া, একজন শিশিটা মেজরের ঘরে রেখেছিল। এবার আপনাকে বোতলটা ফিরিয়ে দিলাম।

–কি বলছ তুমি? কাকে দেখেছিলে?

একথার কোন জবাব দিল না ভিক্টোরিয়া। অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।

দাঁড়াও যেও না।

গ্রেগ দুপা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

-কার সঙ্গে কথা বলছ গ্রেগ?

মিসেস ডাইসন বাংলোর রাস্তায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

–ওই কালো মেয়েটা–ভিক্টোরিয়া না যেন কি নাম—

কি বলছিল ও?

–আমার সেরেনাইটের বোতলটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলেছিলাম না, মেয়েটা শিশিটা আমাকে দিয়ে গেল।

-ও সরিয়েছিল নাকি?

–না, কোথায় যেন পেয়েছে বলছিল।

–চল, রাতের খাওয়ার সময় হতে চলল।

.

তীরে গিয়ে মিসেস ইভিলিন হিলিংডনের সঙ্গে দেখা হল মলির। দুজনে দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসল। মলির বুকটা হুহু করছিল। চোখ ঠেলে জল আসতে চাইছিল। কিন্তু কারণ বুঝতে পারছিল না মলি।

–কি হল, মুখ অমন থমথমে কেন তোমার? জানতে চাইলেন ইভিলিন।

–না, কিছু না।

–নিশ্চয়ই টিমের সঙ্গে কিছু হয়েছে?

–না, না–সেসব নয়-

-শুনে সুখী হলাম। তোমাদের দেখলেই সুখী মনে হয়।

–তোমাদের চেয়ে নয়; যাই বলল। এডওয়ার্ড আর তোমাকে দেখে মনেই হয় না তোমাদের মধ্যে কখনো খিটিমিটি হয়।

–আমাদের কথা ভেবে লাভ নেই মলি। গত তিনবছর আমাদের মধ্যে আড়ালে কোন কথাবার্তা নেই।

–কি বলছ, আমিতো বিশ্বাসই করতে পারছি না।

–কি করে করবে। বাইরে যে আমরা মুখোশ পরে থাকি।

–গণ্ডগোলটা কি নিয়ে?

আবার কি, আর একজন–তুমিও তাকে জান—

তুমি কি মিসেস ডাইসন মানে লাকির কথা বলছ? ইভিলিন নীরবে মাথা নেড়ে সায় দিল।

-ওদের দুজনকে প্রায় সময়ই খোলাখুলি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।

–ওতেই কি আর শেষ? লাকির ব্যাপারে এডওয়ার্ড একেবারে পাগল।

–তোমাকে ছেড়ে যেতে চায় নাকি?

–দুটো বাচ্চা আছে বলে আমরা কেউই পরিবার ভেঙে দিতে চাই না। গ্রেগের প্রথম স্ত্রী প্রচুর টাকা রেখে গেছে। সে সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে। আর আমি আর এডওয়ার্ড বন্ধুর জীবন কাটাচ্ছি।

-বুঝতে পারছি না কি করে তুমি সহ্য করছ!

–অভ্যেস হয়ে গেছে। মাঝেমাঝে অবশ্য ওই নচ্ছার মেয়েমানুষটাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছা হয়। যাক ওসব বাদ দাও। তোমার কথা বল।

মলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। পরে বলল, জান আমার কেন যেন মনে হয়, কোথাও কোন গোলমাল রয়েছে। কেবলই মনে হয়, কারা যেন ঝোপের আড়াল থেকে আমাকে লক্ষ্য করছে, পায়ের শব্দ, ফিসফাস এসব যেন শুনতে পাই। কেবলই এরকম মনে হয়। আর ভয় পাই।

-কিসের ভয়? ইভিলিন জানতে চায়।

–তা বলতে পারব না।

–কতদিন এরকম হচ্ছে?

–তা জানি না। তাছাড়াও অন্য একটা ব্যাপার ঘটছে।

–কি ব্যাপার?

–অনেক সময়েই যেন জ্ঞান থাকে না আমার। সেই সময় কিছুই মনে করতে পারি না। মাঝে মাঝে যেন অচেনা কারোর সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু পরে তা আর কিছুতেই মনে করতে পারি না।

–প্রিয় মলি, অবস্থা যা বলছ, তোমার তো ডাক্তার দেখানো দরকার।

-না, না, ডাক্তার দেখাবো না। সব ডাক্তারই এক কথা বলবে-কদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে, অসহ্য।

-আচ্ছা, তোমার বাড়ির লোকজন, মানে মা, বোন বা আর কেউ এমন আছেন, এখানে তোমার কাছে আসতে পারেন?

-মায়ের সঙ্গে আমার বনে না। বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে। বললে তারা হয়তো আসবে, কিন্তু আমি ওদের চাই না। কেবল টিম আমার কাছে থাকলেই হয়।

–টিমকে সব বলেছ?

–ঠিক বলিনি। কিন্তু ও বুঝতে পারে। আমাকে লক্ষ্য করে।

–ইভিলিন একমুহূর্ত চিন্তা করে। পরে বলে, আমার মনে হয়, তোমার সবই কল্পনা।

–কল্পনা-হ্যাঁ, তোমার কথাই হয়তো ঠিক। উরেব্বাস, বড্ড দেরি হয়ে গেল। ডাইনিং রুমে এখনই আমার যাওয়া দরকার।

ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে পলকের জন্য ইভিলিনকে বিদ্ধ করে মলি দ্রুত হোটেলের দিকে চলে গেল।

.

১২.

ভিক্টোরিয়ার সেই ছোট্ট ডেরা। ভেতরে ওরা দুজন।

–একটা কিছু করব আমি, বুঝলে? বলল ভিক্টোরিয়া।

ব্যাপারটা বলো আমাকে।

–অনেক, অনেক টাকার ব্যাপার’

–দেখ মেয়ে টাকার লোভে কোন ঝামেলায় যেন জড়িয়ে পড়ো না।

কলস্বরে হেসে উঠল ভিক্টোরিয়া।

-তোমার কিছু ভাবনা নেই। তুমি শুধু দেখে যাও । প্রচুর টাকা বুঝেছ। এমন কিছু দেখেছি আমি, বাকিটা আন্দাজ করতে পারছি। মনে হচ্ছে ঠিকই ধরেছি।

-ইভিলিন, আর নয়, চল আমরা ইংলণ্ডে ফিরে যাই।

চমকে স্বামীর দিকে তাকাল ইভিলিন। বলল, আমরা এসেছি এখনো তিন সপ্তাহ পুরো হয়নি।

ইভিলিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্বামীকে বুঝবার চেষ্টা করতে লাগল।

-সত্যিই তুমি বাড়ি ফিরে যেতে চাও?

–হ্যাঁ।

–তোমার লাকিকে ছেড়ে?

–তুমি নিশ্চয়ই সব জানেনা। কিন্তু আমাকে কিছু বলনি কেন?

–কার জন্য বলব। বছর কয়েক আগেই তো আমাদের সব মিটে গেছে। সব কিছু ভেঙ্গে দিতে চাইনি বলে আমরা দুজন এখনো অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না, হঠাৎ ইংলণ্ড ফিরবার জন্য উতলা হয়ে উঠলে কেন?

–ব্যাপার কিছু নয়। আমি এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে চাই।

–অর্থাৎ আমাকে বোঝাতে চাইছ তুমি প্রেমের টান কাটিয়ে উঠতে পেরেছ? তার দিক থেকে ব্যাপারটা মিটেছে তো? গ্রেগ জানে তোমাদের এসব?

-তা জানি না। সে বরাবরই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে থাকে।

–গ্রেগ, তোমার অস্থিরতার ব্যাপার আমাকে খুলে বলো। এক মুহূর্ত এডওয়ার্ড কি ভাবল। তারপর বলল, লাকির কাছ থেকে এখনই যদি সরে না যাই তাহলে ওকে হয়তো খুন করে ফেলতে পারি।

–লাকিকে খুন করবে? কেন?

–ও একটা জঘন্য কাজ করতে আমাকে বাধ্য করেছিল–একটা খুন করতে ওকে আমি সাহায্য করেছিলাম।

–গ্রেগ, তুমি এসব কি বলছ?

–বিশ্বাস কর ইভিলিন, আমি কি করছি তখন জানতাম না। ওর কথায় কেমিস্টের দোকান থেকে একটা কিছু কিনে দিয়েছিলাম আমি। সেটা ও কি কাজে লাগাবে আমি জানতাম না। পরে ডাক্তারের একটা ব্যবস্থাপত্র আমাকে দিয়ে কপি করিয়ে নেয়।

কবে হয়েছিল এসব?

–চার বছর আগে। আমরা মার্টিনিতে ছিলাম। গ্লেগের প্রথমা স্ত্রী

–মানে? তুমি বলছ লাকি তাকে বিষ খাইয়েছিল?

–হ্যাঁ। আর আমি ওকে সাহায্য করেছিলাম। পরে বুঝতে পেরে

ইভিলিন বাধা দিয়ে বলল, কাজ শেষ হলে নিশ্চয় লাকি তোমাকে বলে তুমিই ব্যবস্থাপত্র কপি করেছ, ওষুধ এনে দিয়েছ। তুমিও তার সঙ্গে ছিলে তাই তো?

-হ্যাঁ। ও আমাকে বলেছিল, সে নাকি লাকিকে অনুরোধ করেছিল তাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে। সেই অনুকম্পার বশেই কাজটা করেছে।

–অনুকম্পার বশে খুন! আর তুমিও তাই বিশ্বাস করেছিলে?

–অত তলিয়ে ভাবিনি। আমি তখন ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।

–লাকি যখন গ্রেগকে বিয়ে করল, তখনো তোমার ভুল ভাঙ্গেনি? গ্রেগ জানতো না কিছু?

–কিছুই জানত না।

–অবিশ্বাস্য। মোটেই বিশ্বাস করতে পারছি না।

–ইভিলিন, এডওয়ার্ড হিলিংডন সহসা আর্তনাদ করে উঠল, আমি এর থেকে মুক্তি চাই। ওই নচ্ছার মেয়েটা আমি যা করেছি তার জন্য এখনো আমাকে ব্যঙ্গ করে। ও জানে ওকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। কিন্তু এমন ভাব করছে যেন আমি তার কাছে বাঁধা পড়ে আছি।

ইভিলিন চিন্তিতভাবে ঘরে পায়চারি শুরু করল। পরে এডওয়ার্ডের সামনে এসে বলল, তোমার আসল গোলমালটা আমি ধরতে পারছি এডওয়ার্ড। তুমি অতি আবেগপ্রবণ আর সরল মানুষ। সেই সুযোগ নিয়েই শয়তানী মেয়েটা তোমাকে তার ইচ্ছামত কাজে লাগিয়েছে। ব্যাভিচারের পাপবোধ তোমার মধ্যে ছিল।

তুমি লাকির সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত ছিলে। সেকারণেই খুনের মতলবে সে তোমাকে এমনভাবে কাজে লাগিয়েছে যাতে এ ব্যাপারে জড়িত বলে তুমি আরও অপরাধবোধে আচ্ছন্ন থাক। কিন্তু এডওয়ার্ড, যা বললে, সবই সত্যি না তোমার বানানো?

–সত্য না হলে এভাবে তোমাকে বলতে পারি ইভিলিন। আমি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। চলো ইভিলিন আমরা ইংলণ্ডে ফিরে যাই।

-হ্যাঁ, তাই যাবো। তবে এখনই নয়।

–কেন?

বাকিটা দেখতে হবে। আমরা যেমন চলছি তেমনই চলব। আমাদের উদ্দেশ্য কোনভাবেই যেন লাকি জানতে না পারে। বুঝতে পেরেছ এডওয়ার্ড?

.

১৩.

সন্ধ্যা উতরে গেছে। রাত নেমে আসছে শিকারী বিড়ালের মত। সমাপ্তির সুর বাজছে হোটেলের স্টিল ব্যাণ্ডে। একে একে অতিথিরা ডাইনিং হল ছেড়ে শুতে চলে যাচ্ছে।

ডাইনিং হলের পাশে খোলা চত্বরের প্রান্তে দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসে কথা বলছিল টিম আর ইভিলিন।

মলির শরীর সম্পর্কে সবকথা জানিয়ে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইভিলিন। শেষে বলল, আমার মনে হয় এখনই মলিকে ডাক্তার দেখানো দরকার।

–সেটা, জানি, বলল টিম, কিন্তু ও কিছুতেই সেটা করতে দেবে না। মনে হয় ডাক্তারের নামে অকারণ একটা ভয় আছে ওর।

-তোমাদের পারিবারিক কাউকে এসময় কাছে এনে রাখার সুবিধা নেই?

সেরকম সুযোগ নেই। কারোর সঙ্গেই, বিশেষ করে ওর মার সঙ্গে মলির বনিবনা নেই। তবে এই অবস্থাটাই ভাল বলে মনে হয় আমার।

–আমার মনে হয় এক ধরনের বাতিকে ভুগছে মলি।

–তা ঠিক নয়। স্নায়বিক কোন ব্যাপার বলেই আমার মনে হয়।

–সেক্ষেত্রে তো একজন মনস্তাত্ত্বিকের পরামর্শ নিতে পার।

–লাভ নেই। আমি ওসব আলোচনা করতে চাই না, ওর মাও মনস্তাত্ত্বিকের পেছনে কম ঘোরেনি।

–বলতে চাইছ, ওদের পরিবারে এধরনের ব্যাপার ছিল? মানে মানসিক রোগ।

-হ্যাঁ, এসব রোগ কিছুটা বংশানুক্রমিক। তবে তুলনায় মলি সুস্থই আমি বলব। ওই মেজর প্যালগ্রেভের মৃত্যুর পর থেকেই যত গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। একটা মানবিক ধাক্কা পেয়েছে।

টিম, তুমি কি আমায় অনুমতি দেবে–যদি আমি মলিকে নিউইয়র্ক বা মিয়ামিতে নিয়ে গিয়ে ভাল ডাক্তার দেখাতে চাই?

–তোমার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ ইভিলিন। মলি ক্রমেই ভাল হয়ে উঠছে–ও ঠিক আছে।

ইতিমধ্যে বেশির ভাগ অতিথিই নিজেদের বাংলোয় ফিরে গেছে। ইভিলিনও বিদায় নিয়ে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।

দেখা গেল উপকূলের দিকে থেকে সিঁড়ির কাছে হেঁটে আসছে মলি। শরীর কাঁপছিল থরথর করে। এলোমেলো হাঁটার ভঙ্গি।

মলিকে দেখে চিৎকার করে উঠে টিম ও ইভিলিন ছুটে গেল তার দিকে।

মলি ততক্ষণে সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাতদুটো পেছনে রেখে কাঁপাকাঁপা গলায় বলে উঠল-আমি ওকে দেখেছি…ওই সামনের ঝোপটাতে…আমার হাত দেখ–

ইভিলিন মলির হাত টেনে ধরেই বোবা হয়ে গেল। দুহাত ভর্তি রক্তের দাগ বুঝতে কষ্ট হল না তার।

–কি হয়েছে মলি? আর্তনাদের স্বরে বলে উঠল টিম।

কেমন টলে উঠল মলি। বলল, ওই ওখানে…ঝোপের মধ্যে।

টিম ইভিলিনের দিকে তাকালো। মলিকে তার দিকে সামান্য ঠেলে দিয়ে দ্রুত সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল। ইভিলিন দুহাতে মলিকে জড়িয়ে ধরে বলল, শান্ত হও মলি, এখানে একটু বোসো।

মলি অবসন্নের মত চেয়ারে গা এলিয়ে বসে পড়ল। হাত দুটো চোখের সামনে তুলে চিৎকার করে উঠল–ওঃ, আমার কি হয়েছে?

–সব ঠিক হয়ে যাবে মলি। ভেবো না।

টিম ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। তার মুখ থমথমে।

ইভিলিন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। টিম বলল, আমাদের একজন কাজের মেয়ে–ভিক্টোরিয়া, কেউ ওকে ছুরি মেরে খুন করেছে।

.

১৪.

মলি শুয়ে আছে বিছানায়। ওয়েস্ট ইণ্ডিজ পুলিশের দুই ডাক্তার ডাঃ রবার্টসন ও ডাঃ গ্রাহাম বিছানার একপাশে। অন্যপাশে টিম দাঁড়িয়ে আছে। ডাঃ রবার্টসন মলির নাড়ী দেখছিলেন।

কাছেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ ইনসপেক্টর ওয়েস্টন।

ডাঃ রবার্টসন পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশি সময় নেবেন না। মোটামুটি বক্তব্য শুনতে পারেন।

ইনসপেক্টর দুপা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস কেণ্ডাল, মেয়েটিকে আপনি কিভাবে দেখতে পেয়েছিলেন?

-ঝোপের মধ্যে…একটা সাদা কিছু চোখে পড়ল…আমি তুলতে চেষ্টা করলাম..দুহাত রক্তে ভরে গেল।

–উপকূলের রাস্তায় আপনি কি করছিলেন?

–সমুদ্রের বাতাসে ভাল লাগছিল

–মেয়েটিকে আপনি জানেন?

–হ্যাঁ। ভিক্টোরিয়া বড় ভাল মেয়ে। খুব হাসতো-ওঃ, আর ও হাসবে না–

ডাঃ রবার্টসন বললেন, একটা ইনজেকশন দিতে হবে। চব্বিশঘণ্টার মধ্যে ওকে দিয়ে আর কিছু বলানো ঠিক হবে না।

-ধন্যবাদ, আমি পরে খবর নেব। বলে ইনপেক্টর বিদায় নিলেন।

.

টেবিলের সামনে বসে থাকা দুজনের দিকে তাকিয়ে বিশালদেহী সুদর্শন নিগ্রোটি বলে উঠল, শপথ করে বলছি, আমি আর কিছু জানি না। সবই বলেছি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডেভেনট্রি মুখোমুখি চেয়ারে বসা গোয়েন্দা দপ্তরের ইনপেক্টর ওয়েস্টনের দিকে তাকালেন। ওয়েস্টনের ইঙ্গিতে নিগ্রোটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ওয়েস্টন বললেন, লোকটি যা জানে সবই বলেছে। মনে হয় ওরা দুজনই নির্দোষ।

–হ্যাঁ, ওদের দুজনের সম্পর্ক ভালই ছিল, বললেন ডেভেনট্টি, ওদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি। দ্বীপে এরকমই হয়ে থাকে। ওদের দুটো বাচ্চা রয়েছে।

ভিক্টোরিয়া এর মধ্যে ছিল বলে মনে হয় তোমার? ওয়েস্টন জানতে চাইলেন।

খুব সম্ভব না। তবে আমার সন্দেহ, খুনের ঘটনার কিছু মেয়েটা দেখে থাকবে। পিলের শিশি সম্পর্কে। যতদূর জেনেছি শিশিটা মিঃ ডাইসনের। তার কথাটা একবার শোনা দরকার মনে হয়।

একটু পরেই গ্রেগরি হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন।

–আপনাদের সাহায্যের জন্য কি করতে পারি বলুন।

–ভিক্টোরিয়াকে আপনি চিনতেন? ওয়েস্টন জিজ্ঞেস করলেন।

–বিলক্ষণ। তার মৃত্যুটা খুবই দুঃখজনক। আমরা দুজনেই ওকে পছন্দ করতাম। মনে হয় পুরুষ সম্পর্কিত কোন ঝগড়াঝাটি ছিল। গতরাতেই ওর সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করেছি।

–মিঃ ডাইসন, আপনি একটা ওষুধ, সেরেনাইট নাম–

-হ্যাঁ, ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী আমি ওধুষটা খেতাম। বেশি রকমের ব্লাডপ্রেসার আছে আমার।

-যতদূর মনে হয় এখানে কম লোকই তা জানে।

–হ্যাঁ। নিজের অসুস্থতা নিয়ে অনেকের মত বলে বেড়ানো আমার অভ্যাস নয়।

–কতগুলো পিল আপনি খান?

–সারাদিনে দু থেকে তিনবার। সবসময়ই কয়েক শিশি সঙ্গে রাখতে হয়।

–সেগুলো কোথায় রাখেন?

–সুটকেসে তালা দেওয়া থাকে। কেবল একটা বাইরে থাকে।

–শুনেছি, সেই বোতলটা কিছুদিন থেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না?

–ঠিকই শুনেছেন। ভিক্টোরিয়াকে খুঁজে দেখতে বলেছিলাম।

–শিশিটা সর্বশেষ কোথায় ছিল?

–আমার বাথরুমের তাকে।

–তারপর কি হল?

–ভিক্টোরিয়া শিশিটা এনে দেয়। বলে মেজর প্যালগ্রেভের ঘরে খুঁজে পেয়েছিল। জানতে চেয়েছিলাম, ওটা ওখানে গেল কি করে?

-উত্তরে ও কি বলেছিল?

-বলেছিল ও জানে না। তবে ওর হাবভাব দেখে সন্দেহ হয়েছিল, সবকথা আমাকে জানায়নি। সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। ভেবেছিলাম, ভুলবশত হয়তো কোথাও ফেলে এসেছিলাম। মেজর দেখতে পেয়ে তুলে এনেছিলেন, আমাকে পরে দেবেন বলে।

–এ ব্যাপারে আর কি জানেন আপনি?

–এটুকুই জানি। মেয়েটি ছুরির ঘায়ে মারা গেছে শুনেছি। অবশ্য রাত কটায় মারা গেছে জানি না। আর শুনেছি মিসেস কোল ওকে দেখতে পায়। বেচারি মলি, খুবই ধাক্কা খেয়েছিল অবশ্যই।

-আচ্ছা মিসেস কেণ্ডালকে শেষ কখন দেখেন?

–পোশাক বদলাতে যাবার আগে। টেবিলে ছুরি-চামচ ইত্যাদি সব গুছিয়ে রাখছিল। ঠাট্টা করার মেজাজেই ছিল ও। খুবই হাসিখুশি ভাল মেয়ে ও।

–ঠিক আছে, ধন্যবাদ মিঃ ডাইসন। ভিক্টোরিয়া জনসন পিলের শিশিটা দেবার সময় আপনাকে আর কিছু বলেনি বলছেন?

-না। কেবল জানতে চেয়েছিল, শিশিটা আমার কিনা।

এরপর মিঃ ডাইসন বিদায় নিলেন।

–খুবই বিবেচক মানুষ। নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে খুবই সচেতন। বললেন ওয়েস্টন, ওর সুযোগ কেমন মনে করেন?

ডেভেনটি কি বলতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ঘরের বাইরে হৈহট্টগোল শোনা গেল। পরক্ষণেই উর্দিপরা একজন পুলিস কর্মচারী ঘরে ঢুকে জানাল, এখানকার একজন রাঁধুনী আপনাদের সঙ্গে দেখা করবে বলে জেদ ধরেছে। জরুরী কিছু নাকি জানাতে চায়।

ওয়েস্টনের ইঙ্গিতে লোকটিকে ঘরে নিয়ে আসা হল। মাথায় রাঁধুনীর টুপি, গাঢ় রঙের লোকটিকে দেখে একজন কিউবান বলেই মনে হয়। লোকটি হড়বড় করে বলতে লাগল, স্যার, উনি রান্নাঘর দিয়ে গিয়ে বাগানে বেরিয়ে গেলেন। আমি স্পষ্ট দেখেছি স্যার, একটা ছুরি ছিল…ওর হাতে একটা ছুরি ধরা ছিল।

-শান্ত হও, ডেভেনট্রি বললেন, তুমি কার কথা বলছ?

–আমাদের মালিকের স্ত্রী স্যার…মিসেস কেণ্ডাল, হাতে একটা ছুরি ছিল। রান্নাঘর দিয়ে অন্ধকার বাগানের দিকে চলে গেলেন। ঠিক রাতের খাওয়ার আগে–আর ফিরে আসেননি–

.

১৫.

–এই হোটেলের পেছনে আমাদের সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছিলাম। আমার আর মলির অনেক স্বপ্ন ছিল। দেখছি সবই ডুবতে বসেছে। সবাই চলে যেতে চাইছে। জানি না এর পরে কি হবে। সব তাড়াতাড়ি মিটে গেলে বাঁচা যেত। বলল টিম।

বুঝতে পারছি মিঃ কেণ্ডাল, বললেন, ইনপেক্টর ওয়েস্টন, আপনাদের ওপর খুবই চাপ পড়ছে।

–বেচারি ভিক্টোরিয়া। খুবই ভাল মেয়ে ছিল। মনে হয় প্রেমঘটিত কিছু ছিল, হয়তো ওর স্বামী–আপনাদের যেমন দরকার আমাকে প্রশ্ন করুন।

–হ্যাঁ, তাই করছি। গতরাতে দশটা তিরিশ মিনিটের পর থেকে যে কোন সময় ভিক্টোরিয়া জনসন নিহত হয়। সেই সময়ে গান বাজনা নাচ নিয়ে সকলেই মেতে উঠেছে। ইচ্ছেমত ঘোরাফেরা করছে।

-হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা। অতিথিদের মধ্যেই কেউ ওকে খুন করেছে বলে মনে হয়? টিম বলল।

–সবই তদন্ত সাপেক্ষ মিঃ কেণ্ডাল। আপাতত একজন রাঁধুনী যে মন্তব্য করেছে সেসম্পর্কে আপনার কি মত?

-ওঃ এনরিকো? সে কিউবার লোক। সে কি বলেছে?

–আপনার স্ত্রী লোকজন ডাইনিং রুমে পৌঁছনোর আগে, রান্নাঘরের মধ্য দিয়ে বাগানের দিকে চলে গিয়েছিলেন। তার হাতে একটা ছুরি ছিল।

মলির হাতে ছুরি? হতবাক টিম। লোকজনরা জিনিসপত্র অগোছালো করে রাখে, তাই মলি সবসময়ই গোছগাছ করে রাখতো। কঁটাচামচ ইত্যাদি সব। বাড়তি একটা চামচ বা কাটা হয়তো ওর হাতে ছিল।

–ডাইনিং রুমে আপনার সঙ্গে তার কথা হয়েছিল?

–হ্যাঁ, হয়েছিল। কার সঙ্গে কথা বলছিল জানতে চেয়েছিলাম।

–কার সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি?

–গ্রেগরী ডাইসনের সঙ্গে।

–হ্যাঁ, উনিও সেকথা বলেছেন।

–গ্রেগরীর একটু গায়েপড়া স্বভাব আছে, বিশেষ করে মেয়েদের। মলি তাই বলেছিল। আমি বলেছিলাম লোকটাকে একটু কড়কে দেওয়া দরকার।

–ওদের মধ্যে কোন কথা কাটাকাটি হয়েছিল?

–ঠিক মনে পড়ছে না। সেরকম কিছু হয়েছিল বলে মনে হয় না।

–কিন্তু আপনার রাঁধুনী বলেছে আপনার স্ত্রী রান্নাঘর দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল–তার হাতে একটা ছুরি ছিল।

-ওসব কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। টিম অস্বস্তির সঙ্গে তাকালো, ডাইনিং রুমে খাবার সময় মলির হাতে ছুরি থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।

–আপনার স্ত্রী ডাইনিং রুমে খাওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন?

–আমি…ওঃ হ্যাঁ, আমরা দুজনেই অতিথিদের আপ্যায়ন করি।

উনি উপকূলের পথ হয়ে আসছিলেন কেন বলতে পারেন?

–ডিনারের পরিশ্রমের পর একটু ঘুরে আসতে পছন্দ করত।

–তিনি যখন ফিরে আসেন, তখন বোধহয় আপনি মিসেস হিলিংডনের সঙ্গে কথা বলছিলেন?

-হ্যাঁ। মলিকে নিয়ে হোটেল চালানো, ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলছিলাম আমরা।

–এরপর কি ঘটেছে বলুন।

মলি ফিরে এসেছিল। তার হাতে রক্ত ছিল। মেয়েটাকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকতে দেখে ও তাকে তুলবার চেষ্টা করেছিল। তাতেই ওর হাতে রক্ত লেগে গিয়েছিল। আপনারা কি কিছু ইঙ্গিত করতে চাইছেন?

ডেভেনট্রি বললেন, দয়া করে শান্ত হোন। শুনলাম আপনার স্ত্রীর শরীর ইদানীং ভাল যাচ্ছে না।

-বাজে কথা। ও ভালই আছে। মেজর প্যালগ্রেভের মৃত্যুতে স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা । বিপর্যস্ত বোধ করছিল।

মিসেস কেণ্ডাল সুস্থ হয়ে উঠলে আমরা তাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। অবশ্যই তাকে বিরক্ত করব না।

জবাবে টিম চুপ করে থাকল।

.

ইভিলিন হিলিংডন শান্ত ধীর কণ্ঠে বললেন, টিম কেণ্ডালের সঙ্গে যখন আমি কথা বলছিলাম। তখনই সিঁড়ি দিয়ে উঠে তার স্ত্রী খুনের কথা জানায়।

–টিম কেণ্ডালের সঙ্গে আপনার কি বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছিল?

–অদ্ভুত প্রশ্ন। ঠিক মনে পড়ছে না। সম্ভবত ওদের ব্যবসা সংক্রান্ত।

এর পর আর দু-একটির বেশি প্রশ্ন করার দরকার হল না। ইনপেক্টর ওয়েস্টন বললেন, ধন্যবাদ মিসেস হিলিংডন।

.

–আপনার কাছ থেকে কেবল বিষয়টা পরিষ্কার করে নিতে চাইছি মিসেস কেণ্ডাল। ডাঃ গ্রাহাম বলেছেন, আপনি কথা বলার মত সুস্থ হয়েছেন। আচ্ছা, মৃত মেয়েটিকে আপনি কিভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন? শুনেছি ডিনারের পর আপনি একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলেন?

-হ্যাঁ, প্রায়ই যাই।

–আপনি কোনদিকে হাঁটতে গিয়েছিলেন?

–তীরের দিকের রাস্তায়।

–তারপরে?

–হিবিসকাস ঝোপের মধ্যে কি যেন চোখে পড়ল হঠাৎ, আমি আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে টানতে গেলাম।…দেখতে পেলাম ভিক্টোরিয়া…রক্তে আমার হাত ভরে গেল।

–খুবই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। বেড়াতে যাওয়ার সময় হাতে কেন ছুরি নিয়ে গিয়েছিলেন?

–ছুরি? ছুরি নিতে যাব কেন?

–আপনাদের রান্নাঘরের এক অধস্তন কর্মচারী বলেছে, আপনি যখন রান্নাঘর দিয়ে বাগানে গিয়েছিলেন, আপনার হাতে একটা ছুরি ছিল।

-কিন্তু আমি তো রান্নাঘর হয়ে যাইনি। আপনি ডিনারের আগের কথা বলতে চাইছেন—

আপনি টেবিলে ছুরিকাঁটাচামচ গুছিয়ে রাখছিলেন?

মাঝে মাঝে করতে হয়। পরিচারকরা অনেক সময়েই কাঁটা অথবা ছুরি ঠিকঠিক রাখতে ভুল করে।

-ওই অবস্থাতেই সম্ভবত আপনি একটা ছুরি হাতে রান্নাঘর পার হয়ে গেছেন।

-মনে হয় তা করিনি।

–ভিক্টোরিয়া মেয়েটিকে কে মারতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

–আমার কোন ধারনাই নেই।

–ধন্যবাদ, আপাততঃ এটুকুই।

মলি বিদায় নিলে ডেভেনট্টি বলে উঠলেন, টেবিল ছুরিকে খুনের অস্ত্র হিসেবে ভেবে নেয়াটা কষ্টকল্পনা ছাড়া কিছু নয়।

–কিন্তু মিঃ ডেভেনট্টি, ছুরিটা মাংসকাটার ছুরি ছিল। রাতে মেনুতে মাংস ছিল। তাই সব ছুরিই শানানো ছিল।

-না, না, এই মাত্র যে মেয়েটির সঙ্গে কথা বললাম, তাকে একজন হত্যাকারিণী ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ওয়েস্টন?

–একথা বিশ্বাস করবার মত অবস্থা এখনো হয়নি। এমনতো হতে পারে, ডিনারের আগে বাগানে যাওয়ার সময় একখানা ছুরি তুলে নিয়েছিলেন। অন্যমনস্ক ভাবেই হয়তো ব্যাপারটা করেছিলেন। মিসেস কোল কোথাও ছুরিটা ফেলে রেখে দিতে পারেন। অন্য কেউ সেটা খুঁজে পেয়ে…তবে এটা ঠিক, আমি নিজেও ওকে খুনী বলে ভাবতে পারছি না।

ডেভেনট্রি চিন্তিত ভাবে বললেন, তবে আমার ধারণা উনি যা জানেন তার সব বলেননি।

–আমি ভাবছি অন্য কথা। ডিনারের সময় স্বামী সেখানে থাকলেও স্ত্রীকে কেউ সেখানে দেখেনি।

–কারও সঙ্গে তিনি দেখা করতে যান তুমি বলতে চাইছ?

–সম্ভবত ভিক্টোরিয়া জনসনের সঙ্গে। অথবা ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল এমন কাউকে দেখে থাকবেন।

নিশ্চয় গ্রেগরী ডাইসনের কথা ভাবছ?

.

১৬.

কিছু একটা করতেই হবে এবং নষ্ট করার মত সময় হাতে নেই–এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। মিস মারপল।

ইতিমধ্যে অনেক কথাই তিনি জানতে পেরেছেন। তবে সেটুকুই যথেষ্ট নয়।

মিঃ র‍্যাফায়েল তার নিজের বাংলোর সামনে বসেছিলেন। মিস মারপলকে তিনি খবর পাঠালেন।

তার নিজের বাংলো আর মিঃ র‍্যাফায়েলের বাংলোর দুরত্ব কয়েক কদম মাত্র। মিস মারপল ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।

–আপনি আমাকে ডাকছিলেন?

নিশ্চয়ই ডাকছিলাম; বললেন মিঃ র‍্যাফায়েল, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। দ্বীপে যা সব অদ্ভুত ব্যাপার চলছে। নানান ফিসফাস কানে আসছে। এসবের একেবারে বাইরে রয়েছেন কেবল আপনি আর ওই পাদ্রী-মিঃ প্রেসকট আর তার বোন।

–অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এরকম ফিসফাস অস্বাভাবিক নয়। বললেন মিস মারপল।

দ্বীপের মেয়েটাকে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় ঝোপের কাছে পাওয়া গেল, বললেন মিঃ র‍্যাফায়েল, সম্ভবত ঈর্ষাঘটিত কোন ব্যাপার-ওর সঙ্গী লোকটার হয়তো কোন নতুন মেয়ে জুটে ছিল। এই এলাকার যৌন জীবন এই ধরনেরই।

–আমার অবশ্য তা মনে হয় না।

কর্তৃপক্ষও তা মানেননি। মেজর প্যালগ্রেভকে মনে হয় খুন করা হয়, আপনি কি মনে করেন?

-আমার আশঙ্কা সেটাই ঠিক কথা।

-হ্যাঁ, সম্পূর্ণ ঠিক। ক্যাভেনট্রির কাছে সবই শুনলাম। আপনি ডাঃ গ্রাহামকে কিছু বলেছিলেন। সে ডেভেনট্রিকে তা জানায়। তখন যোগাযোগ করা হয় গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে। তারা বুঝতে পারে ব্যাপারটা গোলমেলে, তাই মেজরের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে পরীক্ষা করে।

–ওরা কি জানতে পেরেছে?

–ওরা জেনেছে, প্যালগ্রেভকে বেশিমাত্রায় এমন কিছু খাওয়ানো হয়েছে যার সঠিক পরিচয় ডাক্তাররাই জানে। যতদূর সম্ভব জিনিসটা ডাই-ফ্লোর, হেক্সাগোনাল বা ইথাইল কারবেনজোল জাতীয় কিছু। এসব বেশিমাত্রায় খাওয়াতে পারলে মৃত্যু নিশ্চিত। উপসর্গ দেখে বেশিরকমের ব্লাড প্রেসার বলেই মনে হবে। এক্ষেত্রে তাই সবই স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল, তাই কেউ প্রশ্ন তোলেনি। আচ্ছা মেজরের ব্লাড প্রেসার ছিল আপনাকে কখনো বলেছিল?

-না।

–আমাকেও বলেনি। অথচ সকলেই এটা মেনে নিয়েছিল।

-আমার ধারণা মেজর লোককে বলে বেড়াতেন। মিঃ ডাইসনের ব্লাডপ্রেসার আছে, ওর স্ত্রী বলেছে।

কাজেই ডাইসনের ঘরের ওষুধের শিশি মেজরের ঘরে রেখে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল অতিরিক্ত ব্লাডপ্রেসারের জন্যই তার মৃত্যু হয়েছে।

-আমারও তাই ধারণা, মিস মারপল বললেন, সেই সঙ্গে রটনা করে দেওয়া হয় যে মেজর প্রায়ই লোককে তার ব্লাড প্রেসারের কথা বলে বেড়াতেন। এ ধরনের গল্প বানানো যায় খুবই সহজে। এখানে-ওখানে কিছু কথা ছড়িয়ে দিলেই কাজ হাসিল হয়।

–অত্যন্ত ধূর্ত কেউ একজন কাজটা সাফল্যের সঙ্গে করেছে, মিঃ র‍্যাফায়েল চিন্তিত ভাবে বললেন, আমার ধারণা ওই মেয়েটা কিছু দেখেছিল কিংবা জানত আর সে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেছিল।

–তা, না-ও হতে পারে। কেউ হয়তো ওর মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল।

–এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে। এরপর আপনার অভিমত কি শোনা যাক। আপনি আমার চেয়েও বেশি কিছু জানেন বলে আমার ধারণা। ব্যাপারটা আমার আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছে। আমি লক্ষ্য করেছি, মেজর প্রায়ই আপনার সঙ্গে গল্প করে কাটাতেন। অন্যরা বিশেষ আমল দিত না তাকে। মেজর আপনাকে কি বলেছিলেন?

বেশ কিছু গল্প অনেককেই শোনাতেন মেজর। আমাকেও শুনিয়েছিলেন। বলেছিলেন তিনি একজন খুনীকে চেনেন। তার কাছে ছবি আছে। সেটা আমাকে দেখাতে চেয়েছিলেন–কিন্তু পারেন নি।

-কেন?

-কারণ আকস্মিকভাবে কাউকে চোখে পড়েছিল তার। ছবিখানা পকেট থেকে বার করে এনেও আবার ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন। পরে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছিলেন।

-প্যালগ্রেভ কাকে দেখেছিলেন?

–সঠিক বলতে পারব না। আমরা বাংলোর সামনে বসেছিলাম। আমার সামনেই মেজর বসেছিলেন। তিনি যাই দেখে থাকুন, দেখেছেন আমার বাম কাঁধের ওপর দিয়ে।

-আপনার ডানদিকের পেছনের পথ ধরে কেউ আসছিল?

–হ্যাঁ। মিঃ আর মিসেস ডাইসন আর হিলিংডন দম্পতি। ওই রেখা বরাবর আপনার বাংলোটাও চোখে পড়ে।

-ওহো, তাহলে আমার এসথার ওয়াল্টার্স আর জ্যাকসনকেও এর মধ্যে ধরা যায়। এদের দুজনের যে কোন একজনের পক্ষেই বাংলো থেকে বেরিয়ে আসা বা ঢুকে পড়া সম্ভব আপনার অজান্তেই।

-হ্যাঁ, সেটা সম্ভব ছিল। আমি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে দেখিনি।

–তাহলে দেখা যাচ্ছে–ডাইসন আর হিলিংডনরা এবং এসথার আর জ্যাকসন–এদের কেউ একজন খুনী। আবার আমিও হতে পারি।

মিস মারপল হাসলেন। বললেন, মেজর খুনীকে একজন পুরুষ বলেই উল্লেখ করেছিলেন। ফলে ইভিলিন লাকি আর এসথার ওয়াল্টার্সকে আমরা বাদ রাখতে পারি।

ব্যাপারটা এরকম ঘটেছিল বলে মনে হয়, মেজর পকেট থেকে ছবিটা বের করে লোকটির মুখে দৃষ্টি বুলিয়ে মুখ তুলেই অবিকল একই মুখ দেখতে পেয়ে যান। অতটা না হলেও হয়তো সেই মুখের আদলই তিনি দেখতে পান।

-হ্যাঁ, এটা হওয়া সম্ভব। মিঃ র‍্যাফায়েল বললেন।

নিশ্চিত চমকে গিয়েছিলেন মেজর। এবং সঙ্গে সঙ্গেই ছবিটা পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গল্প জুড়েছিলেন। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে পরে এক সময় তিনি ছবিটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতেন আর লোকটাকেও দেখে মিলিয়ে সিদ্ধান্ত করার চেষ্টা করতেন দুজনে একই ব্যক্তি কিনা।

-হ্যাঁ, এটাই সম্ভব বলে আমি মনে করি। কথা শেষ করে মিঃ র‍্যাফায়েল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মিস মারপলের দিকে। পরে আবার বললেন, যাই হোক, এবারে আপনি কি ভাবছেন তা জানতে ইচ্ছা করে।

–ঘটনাগুলোর পেছনে জোরালো কোন্ উদ্দেশ্য আছে বোঝা যাবে যদি খুব শিগগিরই আর একটা খুনের ঘটনা ঘটে যায়।

চমকে উঠলেন মিঃ র‍্যাফায়েল কথাটা শুনে। বললেন, ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে বলুন।

-বুঝিয়ে বলার ব্যাপারে আমার খুব একটা দক্ষতা নেই মিঃ র‍্যাফায়েল। তবে মেজরের গল্পটা নিশ্চয় আপনার মনে আছে, একজন স্ত্রীলোক খুন হয়েছিল। কিছু সময় পরে একই রকম পরিস্থিতিতে আরও একটা খুনের ঘটনা ঘটে। অন্য নামের একজন ভদ্রলোকের স্ত্রী একই রকম অবস্থায় মারা যান। এর থেকে আমি যা বুঝতে পারছি তা হল, খুন করা খুনীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।

আপনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন, কোন লোক একবার কোন খারাপ কাজ করে রেহাই পেয়ে গেলে স্বভাবতই তার উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। ব্যাপারটাকে সহজ বলেই সে ভাবতে থাকে। ফলে সে আবার অপরাধ করতে উৎসাহী হয়।

তবে প্রতিবারেই সে নিজের নাম আর ঘটনাস্থল বদলে নেবে। আমি ঠিক ভাবছি কিনা বুঝতে পারছি না।

মিঃ র‍্যাফায়েল কোন মতামত ব্যক্ত করলেন না। তিনি স্থির দৃষ্টিতে অপেক্ষা করতে থাকেন।

–ঘটনার স্রোত যদি এরকমই হয় তাহলে খুনী এখানেও স্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। আর যদি অল্পদিনের মধ্যেই এমন কোন খুনের ঘটনার মতলব এঁটে থাকে তাহলে সে কখনোই চাইবে না মেজর প্যালগ্রেভ, লোককে খুনের কাহিনী শোনায় কিংবা ছবি দেখিয়ে বেড়ায়।

কথা শেষ করে মিঃ র‍্যাফায়েলের দিকে কাতর ভাবে থাকালেন মিস মারপল।

-তাহলে তো দেখছি, ধীরে ধীরে বললেন মিঃ র‍্যাফায়েল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু একটা করা দরকার।

-হ্যাঁ। তবে সে ঘটনা শেষ হয়ে গেছে। এখন ভবিষ্যতের কথাই ভাবতে হবে আমাদের। কেন না মেজর প্যালগ্রেভকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, ছবিটা নষ্ট করা হয়েছে, এবারে লোকটা তার ছক মত এগিয়ে যাবে। এখন আমাদের ঠেকাতেই হবে, মিঃ র‍্যাফায়েল, আর ঠেকাতে হবে আপনাকে।

-আমাকে কেন?

-কারণ আপনি অর্থবান এবং গুরুত্বসম্পন্ন ব্যক্তি। আমাকে এখানে কেউ জানে না। আপনার কথা লোকে গুরুত্ব দেবে।

–বেশ, আপনি এখানেই থেকে সব ব্যাপার ফয়সালা করুন। হিলিংডন, ডাইসন আর আমার লোক জ্যাকসন–এই তিন জনের মধ্যে যে কোন একজনকে খুনী হতেই হবে।

.

১৭.

–এ ব্যাপারে এখনো আমি নিশ্চিত নই। বললেন মিস মারপল।

-কেন নয়–তিনজন সন্দেহভাজন আমাদের সামনে রয়েছে। তাদের একে একে যাচাই করে দেখা চলতে পারে। তাহলে হয়তো একজন কাউকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে পারবেন। বললেন মিঃ র‍্যাফায়েল।

কিন্তু এডওয়ার্ড হিলিংডন এবং জ্যাকসনকে নিয়ে বিচার করে কোন সন্তোষজনক মীমাংসায় পৌঁছনো সম্ভব হল না।

ওদের আলোচনার মধ্যেই এসথার ওয়াল্টার্স সেখানে এল। মিঃ র‍্যাফায়েল তার দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম স্বরে বললেন, এতক্ষণে এলে? কোথায় আটকা পড়েছিলে?

-সকলেই চলে যাবার জন্য তাড়াহুড়ো করছে–এসব নিয়েই। বলল এসথার।

চলে যেতে চাইছে কি ওই খুনের জন্য?

–তাই মনে হচ্ছে। টিম কেণ্ডাল বেচারা খুবই চিন্তায় পড়ে গেছে। ব্যবসাটা সবে জমে উঠতে শুরু করেছিল–

–খুবই স্বাভাবিক। আমরাও এতক্ষণ খুনের বিষয় নিয়েই আলোচনা করছিলাম।

মনে হল এসথার ওয়াল্টার্স চমকে উঠল। সে মিস মারপলের দিকে তাকাল।

মিঃ র‍্যাফায়েল বললেন, মিস মারপলকে বুঝতে আমি ভুল করেছিলাম। ইনি অন্য বয়স্ক মহিলাদের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ইনি চোখ কান যথাযথ ব্যবহার করতে জানেন।

বাংলোর বারান্দা থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে বসলো এসথার।

মিঃ র‍্যাফায়েল বললেন, আমরা মৃত মেজরের গল্পের ঝুলির বিষয়ে আলোচনা করছিলাম।

-ওহ, ওর গল্পের ভয়ে আমি এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতাম।

–তিনি কি তোমাকে কোন খুনীর বিষয়ে কিছু বলেছিলেন? প্রশ্ন করলেন মিঃ র‍্যাফায়েল।

–হ্যাঁ, অনেকবার বলেছিলেন।

–গল্পটা ঠিক কি রকম আমাদের শোনাও তো।

–আমার মনে হয় খবরের কাগজের কোন খুনের ঘটনার খবর থেকেই প্রথম প্রসঙ্গটা উঠেছিল। বলেছিলেন, একজন খুনীকে মুখোমুখি দেখেছিলেন। আর বলেছিলেন আমাকে একজন খুনীর ছবি দেখাবেন।

–কোন ছবি তিনি দেখিয়েছিলেন তোমাকে?

–না, ফটো দেখাননি। তবে আমি ধরে নিয়েছিলাম তিনি যে কাহিনী আমাকে বলেছিলেন ফটোটা সেই কাহিনীতে বলা খুনীরই।

এই সময় আর্থার জ্যাকসন নিঃশব্দে সেখানে এসে দাঁড়াল।

–আপনার মালিশের সময় হয়েছে স্যার।

মিঃ রাফায়েল বললেন, চল তাহলে।

দক্ষ হাতে জ্যাকসন হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে নিল। মিস মারপলও উঠে দাঁড়িয়ে তীরের পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন।

.

১৮.

সমুদ্রতীর আজ প্রায় ফাঁকাই ছিল। গ্রেস জলের মধ্যে আলোড়ন তুলছিলেন। লাকি বালির ওপর শুয়ে রোদ-স্নান নিচ্ছেন। হিলিংডনরা কেউ নেই।

ক্যানন প্রেসকট আর মিস প্রেসকট দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসেছিলেন। মিস মারপল এগিয়ে এসে মিস প্রেসকটের চেয়ারের পাশে বসলেন।

লোকজন নাকি সব চলে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ওঃ খুবই দুঃখজনক অবস্থা। বললেন তিনি।

মিস প্রেসকট বললেন, কেণ্ডালরা এদের সর্বস্ব হোটেলের জন্য ঢেলেছে। যাই ঘটুক এটা তাদের চালিয়ে যেতেই হবে।

–মেয়েটি খুবই মিষ্টি। বললেন মিস মারপল।

-কিন্তু ওর মায়ের মতই স্নায়বিক হয়ে পড়েছে। ওর পরিবারের সবাই আমাদের দিকেই থাকে। বললেন প্রেসকট।

মিস প্রেসকট বললেন, জানেন, একবার একটা নিতান্ত অযোগ্য লোককে বিয়ে করবে বলে মলি উতলা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাড়ির লোকের বাধায় তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে নি। এর পরেই ভাগ্যক্রমে মলির দেখা হয় টিমের সঙ্গে।

–এরকম তো কতই হয়। বললেন মিস মারপল, আপনারা তো বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে আসছেন, তাই না? নিশ্চয় হিলিংডন আর ডাইসনদের ভালই জানেন।

–তা বলতে পারেন। মিস প্রেসকট জবাব দিলেন।

–মেজর প্যালগ্রেভ একটা অস্বাভাবিক কাহিনী আমাকে শুনিয়েছিলেন। কিন্তু কানে কম শুনি বলে, সেই কাহিনী ভালভাবে বুঝতে পারিনি।

-আপনি কি বলতে চাইছেন জানি। এসম্পর্কে অনেক রটনা শোনা গিয়েছিল।

–মানে যখন

-হ্যাঁ, প্রথম মিসেস ডাইসন মারা যান। আচমকা রোগের আক্রমণে মারা যাওয়াতে লোকের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল।

-তারপর? বললেন মিস মারপল।

–সেই তরুণীর নাম ছিল মিস গ্রেটোরেক্স। মিস ডাইসনের সম্পর্কীত বোন ছিল সে। তাদের মধ্যে বনিবনা ছিল না বলেই শোনা গিয়েছিল। আরও রটনা হয়েছিল, এডওয়ার্ড হিলিংডন নাকি স্ত্রীর জন্য কেমিস্টের কাছ থেকে কিছু কিনে এনেছিলেন।

-ওঃ তিনিও এর মধ্যে ছিলেন?

-দারুণ ভাবে জড়িত ছিলেন। মিস গ্রেটোরেক্স আর নাকি–দুজনকে দুজনের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়েছিলেন। পুরুষও দুজন ছিল। গ্রেগরী ডাইসন আর এডওয়ার্ড হিলিংডন।

সেই কেমিস্টের ব্যাপার জানাজানি হল কি করে?

–ওরা সে সময়ে মার্টিনিতে ছিল। ফরাসীরা ওষুধপত্রের ব্যাপারে অনেক শিথিল। কেমিস্টই হয়তো কাউকে কিছু বলে থাকবে।

–কিন্তু এর মধ্যে কর্নেল হিলিংডন কেন জড়ালেন? বলতে চাইলেন মিস মারপল।

–আমার ধারণা তাকে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল? অদ্ভুত ব্যাপার হল, স্ত্রীর মৃত্যুর একমাসের মাথায়ই গ্রেগরী ডাইসন বিয়ে করেন।

–মেজর প্যালগ্রেভ আপনাকে এরকম কিছু বলেছিলেন?

-হ্যাঁ, একদিন ওকে দেখিয়ে বলেছিলেন, দেখুন ওই মেয়ে মানুষটি একজনকে খুন করেও কেমন বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই সময় ডাইসন আর হিলিংডনরা কাছাকাছি টেবিলেই বসেছিলেন। আমার খুব ভয় হচ্ছিল তারা না কথাগুলো শুনে ফেলে।

–মেজর কি কোন ছবির কথা বলেছিলেন?

–ঠিক মনে পড়ছে না।

এই সময় ইভিলিন হিলিংডন ওদের চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ালেন। সুপ্রভাত জানিয়ে আবার তীরের পথ ধরে এগিয়ে গেলেন।

.

১৯.

একসময় ক্যানন প্রেসকট বোনের সঙ্গে হোটেলে ফিরে গেলেন। ততক্ষণে গ্রেগরী ডাইসন জল থেকে উঠে এসেছেন। লাকি বালির ওপরেই শায়িত। ইভিলিন তার দিকে তাকিয়েছিল। তা লক্ষ্য করে মিস মারপল অকারণেই কেমন শঙ্কিত হয়ে উঠলেন।

একটু পরে তিনিও ধীর পায়ে নিজের বাংলোর দিকে হেঁটে চললেন।

পথে মিঃ র‍্যাফায়েল আর এসথার ওয়াল্টার্সের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মিঃ র‍্যাফায়েল তাকে দেখে নিঃশব্দে হাত নাড়লেন।

বাংলোয় ফিরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। নিজেকে খুবই ক্লান্ত মনে হচ্ছিল তার।

কয়েক মুহূর্তের জন্য বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। চোখের পাতা খুলতেই মনে হল কেউ যেন বাইরে থেকে জানালায় উঁকি মারবার চেষ্টা করছে। ছায়ার আভাস দেখে তার মনে হল লোকটি জ্যাকসন।

লোকটির এমন ব্যবহারের কারণ বুঝতে পারলেন না। তিনি ঘুমিয়ে রয়েছেন কিনা তাই জানতে কি?

মিস মারপল বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। বাথরুমে ঢুকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন।

পাশের বাংলোটি মিঃ র‍্যাফায়েলের। দেখা গেল জ্যাকসন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সচকিতভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, কারুর চোখে না পড়ে। নিশ্চয় কোন মতলব হাসিল করার সুযোগ খুঁজছে জ্যাকসন, অনুমান করলেন মিস মারপল।

সেই মুহূর্তে সকলেই সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত। কারোর নজরের বাইরে বাংলোয় কিছু করতে চাইলে এই তার সুযোগ। জ্যাকসন নিশ্চিত হওয়ার জন্যই তার জানালায় উঁকি দিয়েছিল।

রবারের চপ্পল পায়েই শিকারী বেড়ালের মত সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মিস মারপল। মিঃ র‍্যাফায়েলের বাংলোটা ঘুরে কোণের দিকে চলে গেলেন। খুব সন্তর্পণে জানালার নিচে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন।

বাংলোর জানালাগুলো খুব নিচু। কিছু লতা গাছের আড়াল থেকে তিনি ঘরের ভেতরে তাকালেন।

দেখা গেল ঘরের মাঝখানে একটা সুটকেসের সামনে বসে আছে জ্যাকসন। সুটকেসের ঢাকনা খোলা। মিস মারপল লক্ষ্য করলেন, বেশ কিছু কাগজপত্র সুটকেস থেকে বার করে আনল জ্যাকসন। দ্রুত চোখ বুলিয়ে কাগজগুলো দেখে চলেছে।

বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে চাইলেন না মিস মারপল। জ্যাকসন চুরি করে কাগজপত্র দেখছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই তিনি সন্তর্পণে সরে এলেন জানলা থেকে। ফিরে এলেন নিজের বাংলোয়।

একটু পরে তিনি তীরের দিকে গিয়ে একটা খালি চেয়ারে বসে পড়লেন। অদূরেই বসেছিলেন মিঃ র‍্যাফায়েল। তাঁর দিকে না ফিরেই মিস মারপল বললেন, আপনি জানেন, জ্যাকসন আপনার কাগজপত্র হাতড়ে বেড়ায়?

-একবার ধরা পড়েছিল। আপনি দেখেছেন?

–হ্যাঁ, জানালা দিয়ে দেখলাম, আপনার সুটকেস খুলে কাগজপত্র দেখছে।

-হ্যাঁ, উদ্যোগী লোক, কোনভাবে সুটকেসের চাবি হাতড়েছে। তবে ওর কাজে লাগবার মত কোন কিছু ও খুঁজে পাবে না।

আশপাশে কেউ ছিল না। এসথার ওয়াল্টার্স জলে নেমে আছে। মিঃ র‍্যাফায়েল বললেন, আপনাকে বলছি, বয়সের কথাটা ভাববেন। খুব বেশি ঝুঁকি নেবেন না। ভুলে যাবেন না, এখানে এমন একজন আছে যে বিবেকহীন নির্মম জীব।

.

২০.

স্টীলব্যাণ্ডের বাজনা অনেকক্ষণ থেমে গেছে। চারদিক নিস্তব্ধ। ঘুমিয়ে পড়েছে গোল্ডেন পাম..

সেই রাতে টিম কেণ্ডাল ছুটে গিয়ে ইভিলিনকে তার বাংলো থেকে ডেকে নিয়ে চললো। মলি কেণ্ডাল অসুস্থ হয়ে পড়েছে–

–টিম বলল, মনে হচ্ছে কিছু খেয়েছে।

ইভিলিন গিয়ে দেখল, বিছানায় শায়িত মলির পাশে টেবিলে রয়েছে অর্ধেক ভর্তি একটা জলের গ্লাস। গ্লাসের পাশেই খালি ট্যাবলেটের শিশি।

টিম বলল, ওটা ঘুমের ওষুধের শিশি। মনে হয় সবগুলোই খেয়ে নিয়েছে।

ইভিলিন বলল, আমি রয়েছি এখানে, তুমি শিগগির ডাঃ গ্রাহামকে ডেকে নিয়ে এসো। যাবার আগে কাউকে বলে যাও কড়া এক কাপ কফি বানিয়ে পাঠিয়ে দিতে।

.

ডাঃ গ্রাহাম যাবার মধ্যে টিমকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, আর ভয় নেই। সময় মতই আমরা উপস্থিত হতে পেরেছিলাম। তবে বিপদ ঘটাবার মত বেশি খাননি মিসেস কেণ্ডাল।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মলি চোখ মেলে তাকালো।

ইভিলিন পাশেই ছিল। জিজ্ঞেস করল, কেন একাজ করেছিলে মলি?

–ভয়ে। ক্ষীণকণ্ঠে বলল মলি।

–কিসের ভয়?

জবাবে চোখ বুজল মলি।

.

টিমের অফিসে বসে ডাঃ গ্রাহাম বললেন, আপনার স্ত্রীর ব্যাপারে কয়েকটা জরুরী কথা বলতে এলাম। শুনলাম উনি কিছুদিন ধরে নাকি দুঃস্বপ্ন দেখছেন?

–হ্যাঁ। প্রায় মাসখানেক ধরে এরকম চলেছে।

–আমার ধারণা মিসেস কেণ্ডাল কোন বিশেষ লোক সম্পর্কে মনে মনে খুবই ভীত। এব্যাপারে আপনাকে কিছু বলেছেন?

-হ্যাঁ জানিয়েছিল। কেউ নাকি ওকে অনুসরণ করে।

–মিসেস কেণ্ডালের কোন শত্রু আছে বলে জানেন আপনি?

–না, কোন শত্রুর কথা আমি জানি না।

–আপনার বিয়ের আগে মলি কারো বাগদত্তা ছিল কিনা, বলতে পারবেন? ওরকম কারোর পক্ষেই ঈর্ষা বশত তাকে ভয় দেখানো স্বাভাবিক।

–আমার জানা নেই। তবে আমার আসার আগে মলি একজনকে বিয়ের পাকা কথা। দিয়েছিল। কিন্তু বাড়ির সকলে এই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিল।

বুঝেছি। টিম, আপনার স্ত্রীর বিষয়ে আমার পরামর্শ হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানো। এই রকম একজন ভাল বিশেষজ্ঞ আছেন কিংসটনে। তাছাড়া নিউইয়র্কে তো রয়েইছে। কোন বিশেষ কারণে আপনার স্ত্রীর মনে ভয় জন্মেছে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলেই তা কেটে যাবে।

ডাঃ গ্রাহাম টিমকে আশ্বস্ত করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

৩. মলিকে দেখাশোনা করা

২১.

মলিকে দেখাশোনা করা, আবার হোটেল চালানো–দুই দিকের চাপে নাজেহাল হতে হতো। টিম কেণ্ডালকে, যদি না ইভিলিন তার কাজের দায়িত্ব কিছুটা হাল্কা করে দিত।

পুরো একটা বেলা মলির কাছে ছিলেন ইভিলিন। কিন্তু পরদিন পেলিক্যান পয়েন্টে পাখি দেখতে যাবার কথা ছিল সঙ্গীদের সঙ্গে। তাই মলির দেখাশোনার দায়িত্ব স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মিস মারপলই হাতে নিলেন।

–আজ তোমাকে খুব ভাল লাগছে মলি। খুব আনন্দ হল। বললেন মিস মারপল।

–আমি ভালই আছি। কেবল ঘুম পায়।

বেশতো ঘুমোবার চেষ্টা করো। আমি কথা বলব না। চুপচাপ বসে সেলাই করব।

মলি মলিন মুখে সামান্য হেসে বামদিকে পাশ ফিরে শুলো।

–আমি একটু ঘুমোই মিস মারপল।

দীর্ঘকালের সেবাব্রতের অভিজ্ঞতা রয়েছে মিস মারপলের। তাই মলির শ্বাসপ্রশ্বাস খানিক নিয়মিত হলে তিনি উঠে মলির বিছানার চাদর চারপাশ থেকে টেনে গদির নিচে গুঁজে দিলেন।

হঠাৎ গদির নিচে একটা বই হাতে ঠেকল তাঁর। একটু আশ্চর্য হলেও বইটা টেনে বার করলেন।

চকিতে একবার মলির দিকে দৃষ্টি ফেরালেন মিস মারপল। মনে হল নিদ্রিত। তিনি বইটির মলাট উল্টে দেখলেন–একটা স্নায়ুরোগ সংক্রান্ত বই। যেখানে মার্ক রাখা ছিল, সেই পাতায় মানসিক ব্যাধির নানা উপসর্গের কথা লেখা রয়েছে।

কয়েক পাতায় চোখ বোলানোর পরেই মিস মারপলের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি বই বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত কি ভাবলেন। বইখানা আবার যেখান থেকে বের করেছিলেন সেখানেই রেখে দিলেন।

কি ভেবে পেছনে ফিরে তাকালেন। তার চোখে পড়ল, মলি চোখ মেলে তাকিয়ে, তাকে লক্ষ্য করছিল, আবার চোখের পাতা বুজে গেল।

চকিতের জন্য তার সন্দেহ হল, মলি সত্যিই ঘুমিয়েছে না তার সবটাই ভান। সঠিক কিছু বোধগম্য হল না তার। তবু তার মনে হল মলির চোখে যেন ধূর্ততার ছায়া দেখতে পেলেন। তিনি তাঁর নিজের চেয়ারে ফিরে এলেন।

নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। বেশিক্ষণ চেয়ারে স্থির হয়ে বসতে পারলেন না তিনি। উঠে দাঁড়িয়ে ঘরে খানিকক্ষণ পায়চারি করলেন, দুদিকের জানালায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন।

তারপর কি ভেবে জানালার পাল্লা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর ভেতরে লক্ষ্য করে বললেন, বাংলো থেকে একটু ঘুরে আসি বুঝলে, সেলাইয়ের নক্সাটা ফেলে এসেছি। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত ঠিক থেকো।

কোন জবাব এলো না। তিনি বুঝতে পারলেন, মলি এবারে সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছে।

সামনের ফাঁকা জায়গা বরাবর এগিয়ে সিঁড়ি ধরে ডান দিকের পথ ধরলেন। পাশেই চোখে পড়ল একটা হিবিসকাস ঝোপ। তীব্র দৃষ্টিতে ঝোপের ভেতরটা একবার দেখে নিলেন।

ফুলের ঝোপ পার হয়ে বাংলোর পেছনে গিয়ে দ্বিতীয় দরজা দিয়ে আবার ভেতরে ঢুকলেন। সেখান থেকে একটা ছোট ঘর পার হয়ে মূল শোবার ঘরে পৌঁছানো যায়।

ঘরে পরদা ঝোলানো। মিস মারপল চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর পর্দার আড়ালে আত্মগোপন করলেন। মলির ঘরে কেউ ঢুকলে এখান থেকে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাবে।

মিস মারপল যা দেখতে চাইছিলেন, মিনিট পাঁচ-ছয় পরেই তা দেখতে পেলেন।

আধখোলা জানালা পথে জ্যাকসনের চেহারা ভেসে উঠল। জানালায় আঙুলের টোকা পড়ল। ভেতর থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না।

চারপাশে ধূর্ত দৃষ্টি বুলিয়ে নিল জ্যাকসন। পর মুহূর্তেই খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে মিস মারপল ঘরের লাগোয়া বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখতে পেলেন জ্যাকসন হাত ধোওয়ার বেসিনের ওপরের তাকে চোখ বোলাচ্ছে। মিস মারপলের ওপর চোখ পড়তেই হকচকিয়ে গেল।

–ওহ,…আমি…মানে…আপনি…

–মিঃ জ্যাকসন! বললেন মিস মারপল। কিছু চাইছিলেন বুঝি!

–আমি মিসেস কেণ্ডেলের মুখে মাখার ক্রিমটা দেখতে চাইছিলাম। ব্রাটা–

জ্যাকসনের হাতে ধরাও ছিল একটা মুখে মাখার ক্রিমের কৌটো। তৎপরতার সঙ্গে সে এটাই কাজে লাগিয়েছে।

কৌটোটা নাকের কাছে এনে জ্যাকসন বলল, চমৎকার গন্ধ। এই ব্রাটাই ভালো।

–এ বিষয়ে আপনার কোন জ্ঞান আছে মনে হচ্ছে। বললেন মিস মারপল।

–কিছুকাল এসব তৈরির কারখানায় কাজ করেছিলাম। প্রসাধনী বিষয়ে অনেক কিছুই জানা হয়ে গিয়েছিল।

–এটার জন্যেই আপনি

–ঠিক এজন্যে নয়…মিসেস ওয়াল্টার্স সেদিন তার লিপস্টিক মিসেস কেণ্ডালকে দিয়েছিলেন। সেটাই ওর জন্য নিয়ে যেতে এসেছিলাম।

-বুঝেছি। সেটা পেলেন

–মিসেস কেণ্ডালের হাতবাগেই রয়ে গেছে মনে হয়। যাক মিসেস ওয়াল্টার্স অবশ্য সেভাবে বলেন নি…

জ্যাকসন তাকের বাকি প্রসাধনীগুলো তাকিয়ে দেখতে লাগল।

–আজকাল বাজারে অনেক সস্তার জিনিস বেরিয়েছে। তার কোন কোনটা খুবই বিপজ্জনক। বলল জ্যাকসন।

-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, বললেন মিস মারপল, আমিও জানি সেটা।

–এসব কথা আপনাকে বোধহয় মেজর প্যালগ্রেভ বলেছিলেন, তাই না?

–হ্যাঁ, মানে তিনিই বলেন। তিনি এসব খবর রাখতেন।

–কিন্তু অনেক ব্যাপারই তো লোককে যা বলতেন তা সঠিক নয়। মেজর প্যালগ্রেভ এমনি অনেক অনাসৃষ্টি ঘটিয়েছেন।

এই সময় লাকি ডাইসনের অবয়ব ভেসে উঠল বেডরুমের জানালায়। মিস মারপল দৃষ্টি ফেরালেন তার দিকে।

–ওহ আপনি, বললেন লাকি, ভাবছিলাম মলির কাছে কিছুক্ষণ বসব কি না। মলি এখনো ঘুমিয়ে রয়েছে?

–মনে হয়। তবে ভাল আছে। আপনার তো ওদের সঙ্গে পাখি দেখতে যাবার কথা ছিল।

–তাই যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু বিশ্রী মাথা ধরল বলে শেষ মুহূর্তে আর যাইনি। তাই ভাবলাম, যদি এখানে কোন কাজে লাগতে পারি।

-খুব ভাল কথা। আমি এখানেই রয়েছি।

মিস মারপল তার চেয়ারে ফিরে গিয়ে বসলেন।

লাকি কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে চলে গেলেন। ততক্ষণে বাথরুমের পাশের অন্য দরজা দিয়ে জ্যাকসনও বেরিয়ে গেছে।

জ্যাকসন যে ক্রিমের কৌটো হাতে নিয়েছিল সেটা তাক থেকে তুলে নিয়ে মিস মারপল নিজের পকেটে পুরে ফেললেন।

.

২২.

টিম ইতিমধ্যে ফিরে এসে মলির দেখাশোনা করছিল। নৈশ ভোজের সময় মিস মারপল মলির কাছে থাকবেন এমন ব্যবস্থা হয়েছিল।

টিম মিস মারপলকে জানিয়েছিল, ওই সময়টায় মিসেস হিলিংডন ও মিসেস ডাইসনও মলির কাছে থাকতে পারে।

হোটেলের সামনের পথ ধরে নিজের বাংলোর দিকে ফিরে চলেছিলেন মিস পারপল। এই মুহূর্তে কি কর্তব্য সেকথাই মাথায় ঘুরছিল।

মেজর প্যালগ্রেভ তার বিরক্তিকর গল্প বলার সময়ে এমন হঠকারী মন্তব্য করেছিলেন যে তা অন্যের কানেও ঢুকেছিল। আর তারই পরিণতিতে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হল।

এ পর্যন্ত সবই পরিষ্কার। কিন্তু এরপর থেকেই দেখা দিয়েছে জটিলতা। কেউ যে নিহত হতে চলেছে এই ভাবনা ক্রমশই তার মধ্যে প্রবল হয়ে উঠছিল। কিন্তু সম্ভাব্য সেই ব্যক্তির পরিচয় না জানা পর্যন্ত মনের অস্বস্তি কাটবে না তার।

কে সেই লোক? যোয়ান প্রেসকট? গ্রেগরী ডাইসন? নাকি লাকির স্বামী গ্রেগরী ডাইসন? লাকি কি নতুন স্বামী লাভের জন্য লালায়িত হয়ে পড়েছে? তাহলে অবশ্য তার দুদিক থেকেই লাভ। গ্রেগরী ডাইসনের বিধবা স্ত্রী হিসেবে বিপুল অর্থ আর মুক্তি।

মিঃ র‍্যাফায়েলকে নিয়ে জ্যাকসন চলে গিয়েছিল। মিসেস এসথার ওয়াল্টার্স বারান্দায় চেয়ারে বসেছিল। মিস মারপলকে দেখে জিজ্ঞেস করল, আজ সারা বিকেল আপনাকে দেখতে পাইনি।

-মলির কাছে ছিলাম আমি। ওকে আজ অনেক সুস্থ দেখলাম। বললেন মিস মারপল।

এসথার মৃদু হেসে বলল, আমার কথা কি কেউ মানবে, আমি জানি ওর কিছু হয়নি।

কপাল কুঞ্চিত হল মিস মারপলের। বললেন, ওর আত্মহত্যার চেষ্টা বলছেন–

-আমি বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস করি না ও বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল। আমার বিশ্বাস, ডাঃ গ্রাহামেরও তাই অভিমত।

–বুঝতে পারছি না একথা কেন বলছেন?

-ওর উদ্দেশ্য হল, অন্যের নজর আকর্ষণ করা। আমি ওর সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি। ওর এসব ব্যাপারে একজন পুরুষ জড়িত আছে। একসময় সেই লোককে বিয়ে করার জন্যই উতলা হয়ে উঠেছিল মলি। বাড়ির লোকের আপত্তির জন্য অবশ্য তা সম্ভব হয়নি।

–এরকম কিছু আমিও মনে হয় শুনেছি। বললেন মিস মারপল।

-টিমকে বিয়ে করলেও সেই লোক তার পেছন ছাড়েনি। আমার কেমন মনে হয়, মলিকে অনুসরণ করে সেই লোক এখানেও হাজির হয়েছে।

-কিন্তু কে সেই লোক?

–আমি জানি কে সে। ওরা এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক।

–তাহলে মলি কি এখনো সেই লোকের অনুরক্ত?

তা না হলে, সেই লোক পেছন নেবে কেন? কিন্তু আমি জানি, লোকটা ভয়ানক বদ। এই সব মেয়েদের হাত করে কাজ করিয়ে নিতে তার জুড়ি নেই।

–লোকটা অতীতে এ ধরনের কিছু করেছে কিনা আপনি জানেন?

-রটনা কত রকমই হতে পারে–তাতে কি। লোকটি হয়তো বিবাহিত ছিল, সেকারণেই বাড়ির লোকে আপত্তি করেছিল। এমনও হতে পারে সত্যিকারের একজন বদলোক ছিল কিংবা পানাসক্ত। বেআইনী কোন কাজে লিপ্ত থাকাও অসম্ভব নয়।

তবে এটা ঠিক মলি আজও তাকে পছন্দ করে। আমি এব্যাপারে নিশ্চিত।

–আপনি কি নিজে কিছু দেখেছেন, বা শুনেছেন? এসথার বলল, আমি যতটা জানি, ততটাই বলেছি।

–ওইসব খুনের ব্যাপার?

–খুনের ব্যাপারগুলো ভুলে যাওয়াই উচিত। যা ঘটেছে, ঘটে গেছে, তা নিয়ে অত মাতামাতি করার কি আছে। আপনি মিঃ র‍্যাফায়েলকেও এর মধ্যে জড়িয়েছেন। আমি জানি যতই চেষ্টা করুন আর বিশেষ কিছু জানতে পারবেন না।

–আপনি দেখছি অনেক কিছুই জানেন। বললেন মিস মারপল, সবকিছু আপনার প্রকাশ করা উচিত।

-এতে কি লাভ হবে। আমি কিছুই প্রমাণ করতে পারব না।

–এমনও তো হতে পারে, আপনি কিছু প্রকাশ না করার জন্য আবার একটা খুন হল।

–এরকম কিছুই ঘটবে না, আমি নিশ্চিত। জোরের সঙ্গে বলল এসথার। আমার মনে হয়, মলি যদি লোকটার সঙ্গে কোথাও চলে যায় তাহলে সবদিক থেকেই ভাল হয়। আমাদের কাউকেই আর ভেবে অস্থির হতে হবে না।

কথা শেষ করে এসথার তার ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, রাতের খাওয়ার সময় হয়েছে, আমাকে এখুনি পোশাক বদলাতে হবে।

মিস মারপল এসথারের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত।

পেছন থেকে ডাঃ গ্রাহামের কণ্ঠস্বর শুনে ভাবনায় ছেদ পড়ল। ডাঃ গ্রাহামকেই খোঁজ করছিলেন তিনি। ঘুরে তাকিয়ে বললেন, বিকেলটা মলি কোলের কাছেই ছিলাম। ও খুব দ্রুত সামলে উঠেছে দেখলাম।

–এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, বললেন ডাঃ গ্রাহাম, জিনিসটা খুব বেশি মাত্রায় যায় নি।

–আমার ধারণা ছিল, আধ শিশি পিলই বুঝি খেয়ে বসে আছে। বললেন মিস মারপল।

–অতগুলো খেয়েছিল বলে মনে হয় না। ট্যাবলেটের কিছুটা শিশি থেকে আগেই সরিয়ে রাখা হয়েছিল বলে আমার ধারণা।

–এমনও হতে পারে, এ কাজটা ইচ্ছাকৃত। কিছু বোঝানোর জন্যই হয়তো…ওদের দুজনের মধ্যে যদি কোন মনোমালিন্য ঘটে থাকে–

-না, ওদের মধ্যে তেমন কিছু আছে বলে মনে হয় না। ওরা পরস্পরকে ভালবাসে। তবে এখনও কয়েকদিন ওকে নজরে রাখা দরকার।

এরপর অভিবাদন জানিয়ে ডাঃ গ্রাহাম হোটেলের দিকে পা বাড়ালেন। মিস মারপল, নিজের চেয়ারে বসেই নানা কথা ভাবতে লাগলেন। প্রেসকট যেসব কথা বলেছেন…এসথার ওয়াল্টার্সও যা বলল…আবার মেজর প্যালগ্রেভের কথাও মনে পড়ল। একে একে।

.

২৩.

ইতিমধ্যে স্টীলব্যাণ্ড পূর্ণোদ্যমে বাজতে শুরু করেছে। সেই শব্দে চিন্তার ছেদ পড়ল না। কেন না তিনি যথেষ্ট অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

মলির ধূর্তামি মাখানো দৃষ্টির কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না মিস মারপল। অথচ প্রথমে সবকিছুই তার কাছে কত স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। কারোর মধ্যেই কোন অস্বাভাবিকতা তিনি দেখতে পাননি।

মলি আর টিম কেণ্ডাল–স্বাভাবিক উৎসাহী দুই তরুণ দম্পতি। হিলিংডনদের কত উজ্জ্বল হাসি-খুশি, সুখী মনে হয়েছে।

বেপরোয়া গ্রেগ ডাইসন আর লাকি–যেন পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় পুরে নেবার জন্য ছটফট করছে, কত উজ্জ্বল তারা। চারজনের এই দলটাকে চমৎকার মানিয়েছিল।

হাসিখুশি দয়ালু এখজন যাজক ক্যানন প্রেসকট, তার বোন যোয়ান প্রেসকট চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত এক মহিলা।

তারপর মিঃ র‍্যাফায়েল-দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দৃঢ় চরিত্রের মানুষ। একবার তার সঙ্গে পরিচিত হলে সহজে ভুলতে পারা যায় না।

মিঃ র‍্যাফায়েল অশক্ত মানুষ, তিনি নিজে জানেন তাঁর দিন শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু কোন জরুরী ব্যবস্থা নিতে হলে এই প্রভাবশালী মানুষটির সাহায্যই তাকে নিতে হবে। তিনি কি এতে সম্মত হবেন?

এমনি নানান বিষয় ভাবতে ভাবতে মিস মারপল তার চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন।

নৈশবাতাস ভরপুর হয়ে উঠেছে আনন্দ কোলাহলে। সকলেই তখন খুশির জোয়ারে ভেসে চলেছে। টিম কেণ্ডালও এই হাসি-আনন্দের হাটে যোগ দিয়েছে।

মিস মারপল উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে তার বাংলোর দিকে ফিরে চললেন।

.

একটা কলগুঞ্জনের শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় উঠে বসলেন মিস মারপল। ঘড়িতে রাত দুটো। অথচ মনে হচ্ছে বাইরে অনেক লোক কথা বলছে!

ধীরে ধীরে ড্রেসিং গাউন গায়ে চাপালেন তিনি। চপ্পল পড়লেন। তারপর মাথায় একটা উলের স্কার্ফ জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

চোখে পড়ল, টর্চ হাতে অনেকে কি খুঁজে বেড়াচ্ছে। কয়েক পা এগিয়ে ক্যানন প্রেসকটকে দেখতে পেলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, কিছু ঘটেছে?

-ওহ, মিস মারপল? মিসেস কেণ্ডেলকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার স্বামী ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতে পান তিনি বিছানায় নেই–তাকেই খুঁজতে বেরিয়েছি আমরা।

বলতে বলতে দ্রুত চলে গেলেন ক্যানন প্রেসকট। মিস মারপল ধীর পায়ে তার পেছনেই চললেন।

মলি বিছানায় নেই…ও কি আগেই এরকম একটা মতলব ভেঁজে রেখেছিল? স্বামী ঘুমিয়ে পড়লেই পালাবে? কিন্তু এর উদ্দেশ্য কি?

এসথার ওয়াল্টার্স যা বলেছে তাহলে তাই কি সত্যি? এর মধ্যে অন্য একজন পুরুষ জড়িয়ে আছে?

চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে এগিয়ে চললেন মিস মারপল। কিছুটা এগুবার পর অস্পষ্ট ডাক শুনতে পেলেন তিনি।

-এই যে…এই দিকে…ওই তো…

জায়গাটা হোটেল থেকে খানিকটা দূরে। সমুদ্রমুখী খাড়ির কাছাকাছি। বেশির ভাগ লোকই হোটেলে ঘুমিয়ে রয়েছে। খাড়ির ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাত্র কয়েকজন।

একজন পেছন থেকে ছুটে এসে প্রায় তাকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে গেল সামনে। মিস মারপল চিনতে পারলেন, টিম কেণ্ডাল।

এক মিনিট পরেই তার আর্দনাদ শুনতে পেলেন।

–মলি…হায় ভগবান…মলি…

ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তিনি সকলের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাকিয়ে দেখলেন, সেখানে রয়েছে কিউবার ওয়েটার দুজন, ইভিলিন হিলিংডন আর দুজন স্থানীয় মেয়ে।

টিম সামনে মাটিতে হাঁটু মুড়ে ঝুঁকে রয়েছে। খাড়ির মধ্যে শায়িত মেয়েটির দেহ দেখতে পেলেন মিস মারপল। মুখ জলের মধ্যে ডোবানো। সোনালী চুল কাঁধ ঢেকে রাখা হাল্কা সবুজ শালের ওপর এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে।

–ওহ মলি…।

টিম হাত বাড়াল মৃতের একটা হাত স্পর্শ করবার জন্য। মিস মারপল এবারে দায়িত্ব হাতে না নিয়ে পারলেন না। তিনি কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বরে বলে উঠলেন, ওকে সরাবেন না মিঃ কেণ্ডাল। সেটা উচিত হবে না।

-কিন্তু আমাকে দেখতে হবে…ওই…মলি…

ইভিলিন এগিয়ে গিয়ে টিমের কাধ স্পর্শ করলেন। বললেন, ও মারা গেছে টিম, আমি ওর নাড়ি দেখেছি।

মারা গেছে? অবিশ্বাসের সুরে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল টিম, ও জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে…কিন্তু বোন? কি এমন ওর যন্ত্রণা…আমাকে কেন ও জানালো না?

কণ্ঠ চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে এল টিম কেণ্ডালের।

–কেউ ডাঃ গ্রাহামকে একবার ডেকে আনলে ভাল হয়। সেই সঙ্গে পুলিসে টেলিফোন করা দরকার। বললেন মিস মারপল।

–পুলিস? তিক্তস্বরে বলে উঠল টিম, ওরা এসে কি করবে?

–আত্মহত্যার ব্যাপার ঘটলে পুলিসকে জানাতেই হবে। বললেন মিস মারপল।

–আমিই ডাঃ গ্রাহামকে ডেকে আনছি। হয়তো এখনো তিনি কিছু বলতে পারেন।

একরকম টলতে টলতে হোটেলের দিকে চলে গেল টিম।

মিস মারপল আর ইভিলিন হিলিংডন মৃত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

–এখন আর কিছুই করার নেই। অন্তত একঘণ্টা আগে মারা গেছে মলি। ওঃ কী মর্মান্তিক। ওদের দুজনকে কত সুখী ভেবেছি। মলি যেন বরাবরই কেমন একটু অপ্রকৃতিস্থ ছিল।

না। ও কথা আমি মানতে পারি না।

দৃঢ়স্বরে বললেন মিস মারপল।

একটু আগেই চাঁদ ঢাকা পড়েছিল মেঘের আড়ালে। এবার মেঘ সরে গেল। মুক্ত চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ল চরাচরে। উজ্জ্বল রুপোলি আলোয় মলির ছড়িয়ে থাকা সোনালী চুল ঝকমক করে উঠল।

মিস মারপল হঠাৎ একটা অস্ফুট শব্দ করে নিচু হয়ে বসলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে সোনালী চুলে হাত রাখলেন।

–আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার। বললেন তিনি।

–কিন্তু আপনি যে টিমকে কিছু স্পর্শ না করার কথা বললেন। ইভিলিন বললেন।

–তা জানি। তখন চাঁদের আলো ছিল না, তাই আমি দেখতে পাইনি…

মিস মারপল ধীরে আঙুল চালিয়ে চুলের গোছা ফাঁক করতেই চুলের গোড়া দেখা গেল। ইভিলিন সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ বিস্ময়সূচক শব্দ করে উঠল।

–একি…এ লাকি–মলি নয়–

-হ্যাঁ। দুজনের চুলের রঙ প্রায় এক। কিন্তু মলির চুলের গোড়ার দিকটা গাঢ় রঙেরও কলপ লাগাতো

–কিন্তু লাকি মলির শাল গায়ে দিয়েছিল কেন?

–শালটা ও পছন্দ করত। লাকি বলেছিল এরকম একটা শাল কিনবে। বোঝা যাচ্ছে সেটা কিনে নিয়েছিল।

-ওটা দেখেই তো আমরা ভুল করেছিলাম…

–কেউ একজন টিম কেণ্ডেলকে খবর দিলে ভালো হত। ইভিলিন বলে উঠলেন, ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।

বলতে বলতে তিনি দ্রুত পায়ে পাম গাছের সারির মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মিস মারপল। পরে মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, তারপর বলুন কর্ণেল হিলিংডন?

পাম গাছের আড়াল ছেড়ে বাইরে আত্মপ্রকাশ করলেন এডওয়ার্ড হিলিংডন।

–আপনি জানতেন আমি ওখানে ছিলাম?

–আপনার ছায়া পড়েছিল। বললেন মিস মারপল।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর এডওয়ার্ড হিলিংডন নিজের মনে বলে উঠলেন, নিজের খেলায় ও বড় বেশি দূর চলে গিয়েছিল।

–ও মারা যাওয়ায় আপনি বোধ হয় খুশি?

–অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? অস্বীকার করব না। ও মারা যাওয়ায় সত্যিই আমি খুশি।

–হ্যাঁ, মৃত্যু অনেক সময় সমস্যার সমাধান করে দেয়। শান্ত ধীর দৃষ্টিতে তাকালেন মিস মারপল।

এবারে ভীতি প্রদর্শনের ইঙ্গিত প্রকাশ পেল এডওয়ার্ড হিলিংডনের কণ্ঠস্বরে।আপনি যদি ভেবে থাকেন

বাধা দিয়ে শান্ত স্বরে বললেন মিস মারপল, যে কোন মুহূর্তে আপনার স্ত্রী মিঃ ডাইসনকে নিয়ে এসে পড়বেন। তাছাড়া ডাঃ গ্রাহামকে নিয়ে মিঃ কোলও আসতে পারেন।

মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে গেলেন এডওয়ার্ড হিলিংডন। ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

মিস মারপল আর একটি শব্দও উচ্চারণ না করে নিঃশব্দে সরে এসে বাংলোর দিকে হেঁটে চললেন।

.

২৪.

মিঃ র‍্যাফায়েল তার বিছানায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। এত আতঙ্ক হৈ চৈ কোন কিছুই তার। কানে পৌঁছায়নি। হঠাৎ দুই কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি খেয়ে জেগে উঠলেন তিনি।

–কি…কি হয়েছে।

–আমি। হাঁপতে হাঁপাতে বললেন মিস মারপল। বালিশে উঁচু হয়ে বসবার চেষ্টা করলেন। মিঃ র‍্যাফায়েল। স্থির চোখে তাকালেন মিস মারপুলের দিকে।

–এই মাঝরাতে আমাকে এভাবে…

–আমাদের যা করবার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমি একটা অকাট–ঘটনার গতিপ্রকৃতি বুঝতে ভুল করেছিলাম। অথচ অতি সহজ ব্যাপার।

-একটু পরিষ্কার করে বলুন। কি সহজ ব্যাপার?

–আপনি গভীর ঘুমে ছিলেন বলে কিছুই জানতে পারেন নি। এদিকে একটা দেহ পাওয়া গেছে খাড়ির ধারে। প্রথমে আমরা মলির বলেই ভেবেছিলাম। পরে দেখা গেল লাকি ডাইসনের মৃতদেহ। খাড়িতে জলে ডুবেমরেছে।

লাকি–ডুবে গেছে? নিজেই ডুবেছিল না কেউ…

–কেউ ডুবিয়ে দিয়েছে। বললেন মিস মারপল।

-বুঝতে পেরেছি। এজন্যেই বললেন এত সহজ ব্যাপার। গ্রেগ ডাইসন…তাই তো? সে গা ঢাকা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন?

মিস মারপল বললেন, মিঃ র‍্যাফায়েল, যা বুঝতে পারছি, আমাদের একটা খুন ঠেকাতে হবে।

-খুনটা হয়ে গেছে বললেন যে

–এটা ভুলবশতঃ হয়ে গেছে। যে কোন মুহূর্তেই আর একটা খুন হতে পারে। যে করেই হোক আমাদের ঠেকাতে হবে। এখনই আমাদের যেতে হবে। •

-বুঝতে পারছি না কি বলতে চাইছেন। কিন্তু আমি আর আপনি খুন ঠেকাবো কি করে? আপনি প্রায় একশোতে পৌঁছেছেন আর আমি আমার ভাঙাচোরা শরীর।

-আপনি বলেছিলেন, জ্যাকসনকে যা হুকুম করবেন তাই সে করবে, তাই না? –অবশ্যই করবে, তবে তার জন্য তাকে পুষিয়ে দেবার ব্যাপার আছে।

–তাকে এক্ষুনি ডেকে পাঠান। আর বলে দিন, আমি যা বলব, তাই যেন সে করে।

কয়েক সেকেণ্ড কি ভাবলেন মিঃ র‍্যাফায়েল। তারপর হাতের নাগালের কলিংবেল টিপলেন। সেই সঙ্গে জ্যাকসনের নাম ধরে গলা তুলে হাঁক ছাড়লেন।

মাঝখানের দরজা দিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল জ্যাকসন।

–আমাকে ডেকেছেন স্যার? কোন গোলমাল কিছু? মিঃ র‍্যাফায়েল বললেন, শোন জ্যাকসন, তুমি মিস মারপলের সঙ্গে যাবে। তিনি তোমাকে যেখানে নিয়ে যেতে চাইবেন কিংবা যা করবেন বিনা আপত্তিতে তাই পালন করবে। ওতে তোমার কোন ক্ষতি হবে না। এজন্য বাড়তি পুরস্কারের ব্যবস্থা করব আমি। বুঝতে পেরেছ, এই আমার হুকুম।

-ধন্যবাদ স্যার-সব বুঝতে পেরেছি।

–তাহলে আসুন মিঃ জ্যাকসন, বললেন মিস মারপল, মিঃ র‍্যাফায়েল, মিসেস ওয়াল্টার্সকে বলে যাচ্ছি আপনাকে তুলে নিচে চলে আসতে।

-কোথায় যেতে হবে? জানতে চাইলেন মিঃ র‍্যাফায়েল।

–কেণ্ডালদের বাড়িতে। আমার ধারণা মলি সেখানেই ফিরে আসবে। বললেন মিস মারপল।

হোক আম্মাতে পারছি না জীছেছেন আক যা হুকুম কি ব্যাপার আছে যেন সে

সমুদ্র থেকে আসা পথ ধরে এগিয়ে এসে মলি হোটেলের চৌহদ্দির বাইরে নিজেদের বাংলোর কাছে এসে একমুহূর্ত দাঁড়াল। তারপর পাল্লা ঠেলে শোবার ঘরে ঢুকে পড়ল।

ঘরে আলো জ্বলছে। বিছানা খালি। মলি বিছানায় গিয়ে বসল। কয়েক মুহূর্ত পরেই কি মনে হতে বিছানার গদির তলা থেকে লুকিয়ে রাখা বইখানা টেনে বার করল।

ঠিক এই সময় বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। চমকে উঠে অপরাধীর ভঙ্গীতে বইখানা নিজের পেছনে লুকিয়ে ফেলল।

হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকল টিম।

-ওঃ তুমি এখানে। কোথায় ছিলে? আমি খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছি।

–খাড়ির কাছে গিয়েছিলাম।

–তুমি সেখানে

কি বলতে গিয়ে চেপে গেল টিম।

-খাড়ির কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারলাম না। কে যেন জলের মধ্যে মরে পড়ে আছে।

-হ্যাঁ, তোমাকে ভেবে আমি ভয় পেয়েছিলাম। এইমাত্র জানতে পারলাম খাড়িতে লাকি মারা গেছে।

–আমি ওকে মারিনি, বিশ্বাস কর টিম, আমি ওকে মারিনি। মারলে ঠিক আমার মনে থাকত

টিম এগিয়ে মলির পাশে বিছানায় বসল। বলল, না, না, তুমি ওকে মারতে পার না মলি। এ ধরনের চিন্তা একদম মাথায় আনবে না। নিশ্চয় সে নিজেই ডুবে মরেছে। হিলিংডনের সঙ্গে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিল। তাই ও জলে গিয়ে ডুবেছে

–কিন্তু…লাকি এমন করতে যাবে কেন…কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ওকে মারিনি…

–প্রিয় মলি, বলছিতো তুমি কিছু করোনি। বলতে বলতে টিম ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। মলি নিজেকে মুক্ত করে সরে গেল।

এ জায়গাটা আর আমার ভাল লাগছে না। এখানে কেবল ভয় আর আতঙ্ক…কেবল অন্ধকার…আমি তার মধ্যে জড়িয়ে আছি…কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছি না। তীক্ষ্ণ তীব্র স্বরে বলে উঠল মলি।

-চুপ মলি। দয়া করে চুপ করো।

বলে এক লাফে বাথরুমে গিয়ে টিম গ্লাসে কিছু নিয়ে এল। স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই নাও, এটা খেয়ে নাও। এতে সুস্থ বোধ করবে।

মলি নিজেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল। বলল, আমি কিছু খেতে পারব না..আমার খুব কষ্ট হচ্ছে…

-হ্যাঁ পারবে, বিছানায়, বসে এটা খেয়ে নাও।

টিম দুহাত দিয়ে মলিকে জড়িয়ে ধরল। তারপর গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে এগিয়ে ধরল।

–এই নাও, খেয়ে ফেল।

ঠিক এমনি সময়ে জানালার কাছে মিস মারপলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

জ্যাকসন, ভেতরে গিয়ে ওর হাত থেকে গ্লাসটা কেড়ে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখবে। ও কিন্তু মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। সতর্ক থাকবে।

জ্যাকসনের শরীর সুগঠিত। বিনা প্রশ্নে হুকুম পালন করার শিক্ষায় শিক্ষণপ্রাপ্ত সে। পলকের মধ্যে ঘরের ভেতরে একঝলক বিদ্যুতের মতই ঝাঁপিয়ে পড়ল সে।

এক ঝটকায় মলির ঠোঁটের কাছে ধরা টিমের হাতের গ্লাসটা এক হাতে অন্য হাতে সবলে জাপটে ধরল টিমকে।

গ্লাস ধরা হাতে একটা মোচড় দিতেই গ্লাসটা চলে এলো জ্যাকসনের হাতে।

টিম হিংস্র গর্জন তুলে উন্মত্তের মত নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু জ্যাকসনের হাতের বেষ্টনী ছাড়াতে পারল না।

বুনো পশুর মত চিৎকার করতে লাগল টিম–এসব কি হচ্ছে-আমাকে ছাড়ো–শিগগির ছাড়ো

ওকে শক্ত করে ধরে রাখো জ্যাকসন। বললেন মিস মারপল।

-এখানে কি ঘটছে সব?

বলতে বলতে এসথার ওয়াল্টার্সের সাহায্যে ঘরে ঢুকলেন মিঃ র‍্যাফায়েল।

-আপনার লোক বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। ওকে বলুন আমাকে ছেড়ে দিতে। চিৎকার করে উঠল টিম।

-না। কিছুতেই না। দৃঢ় স্বরে বললেন মিস মারপল।

মিস মারপলের দিকে তাকিয়ে মিঃ র‍্যাফায়েল বললেন, এই কাণ্ড…এবার তাহলে শোনা যাক বৃত্তান্ত

-এতদিন বোবা আর মূর্খ সেজে ছিলাম। এখন আমি আর তা নই। মিঃ র‍্যাফায়েল, ওই গ্লাসের পদার্থটুকু ও তার স্ত্রীকে জোর করে পান করাতে চাইছিল। এটা পরীক্ষা করলেই সব প্রমাণ হয়ে যাবে।

আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি এরমধ্যে রয়েছে মারাত্মক পরিমাণের মাদকদ্রব্য। মেজর প্যালগ্রেভের বলা কাহিনীর মধ্যে যে নকশা পাওয়া যেত এখানেও রয়েছে তাই। মানসিক অবসাদগ্রস্ত স্ত্রী, আত্মহত্যার হাত থেকে তার জীবন রক্ষা করেছে।

সেই স্ত্রী দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় সফল হয়। ঠিক এরকমই ছিল মেজরের গল্পের কাঠামো। তিনি এমনি গল্প শুনিয়ে আমাকে একটা ছবি দেখাতে গিয়ে মুখ তুলে তাকিয়েই…

-হ্যাঁ, আপনার ডান কাঁধের ওপর দিয়ে…বললেন মিঃ র‍্যাফায়েল।

-না, আমার ডান কাঁধের ওপর দিয়ে কিছুই দেখা সম্ভব ছিল না তার। কিছুই দেখেন নি তিনি।

তবে যে আপনি বলেছিলেন–

–আপনাকে ভুল বলেছিলাম। সেটাই ছিল আমার বোকামি। আমার ডান কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু তার বাঁ চোখটা ছিল কাচের–ওই চোখে কিছু দেখা সম্ভব ছিল না।

-হ্যাঁ, মনে পড়েছে আমার, বললেন মিঃ র‍্যাফায়েল, ব্যাপারটা আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। তার মানে তিনি কিছুই দেখেননি।

–দেখতে পেয়ে ছিলেন অবশ্যই–তবে এক চোখে। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন তার ডান চোখ দিয়ে। আর নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। সেই চোখে আমার ডান কাঁধের ওপর দিয়ে নয়। আমার বাঁ দিক থেকে।

-কেউ ছিল সেই দিকে?

–হ্যাঁ, টিম কেণ্ডাল আর তার স্ত্রী কাছাকাছি বসে ছিল। পাশেই ছিল মস্ত একটা হিবিসকাস গাছ। সম্ভবত তারা হোটেলের হিসাবপত্র নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

মেজর প্যালগ্রেভের কাচের বাঁ চোখ জ্বলজ্বল করছিল। অন্য চোখ দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলেন হিবিসকাস গাছের কাছে যে লোকটি উপবিষ্ট, তার মুখ অবিকল ছবির মুখ। সেই ছবিটাও ছিল হিবিসকাস ঝোপের পাশে।

মেজর সকলকে যে কাহিনী শোনাতে শুরু করেছিল, তা টিম কেণ্ডালও জানতে পেরেছিল। তাতেই সে বুঝে যায় মেজর তাকে চিনতে পেরেছেন। তাই তাকে খুন হতে হল। পরে ভিক্টোরিয়া মেয়েটিকেও মরতে হয়। সে টিমকে মেজরের ঘরে একটা ট্যাবলেট ভর্তি শিশি রাখতে দেখে ফেলেছিল।

বাংলোতে অতিথিদের ঘরে ঢোকার ব্যাপারটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ছিল না। নানা কারণেই টিমকে যেতে হত। তাই প্রথমে এ নিয়ে ভিক্টোরিয়ার মনে কোন সন্দেহ উপস্থিত হয়নি।

কিন্তু যে কোন কারণেই হোক সে এনিয়ে টিমকে নানা রকম প্রশ্ন করতে শুরু করে। বাধ্য হয়েই তখন তাকে শেষ করে দিতে হয়।

টিম আগাগোড়া এই খুনটার জন্যই ছক করে সব কাজ করে চলেছিল। ও একজন স্ত্রী হত্যাকারী–দাগী–

–সমস্ত মিথ্যা কথা–জঘন্য অপবাদ–উন্মত্তের মত চিৎকার করে উঠল টিম। এসথার ওয়াল্টার্স মিঃ র‍্যাফায়েলের হুইল চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আচমকা অস্ফুট আর্তনাদ করে সে ছুটে গেল টিমের দিকে। জ্যাকসনের হাত থেকে তাকে টেনে ছিনিয়ে আনার বৃথা চেষ্টা করল।

–ওকে ছেড়ে দাও–ছেড়ে দাও–এসব কোন কথাই সত্যি নয়। আমি জানি প্রিয় টিম-এসব সত্যি নয়। তুমি কাউকে খুন করতে পার না। কখনোই না-ওই শয়তানী–ওই যাকে তুমি বিয়ে করেছ, সেই এসব করেছে। ও তোমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছিল। না-না তুমি কাউকে খুন করতে পার না–আমি বিশ্বাস করি না টিম তোমাকে ভালবাসি। আমি…

এরপর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা আর সম্ভব হল না টিম কেণ্ডালের পক্ষে। সে ক্রুদ্ধ আক্রোশে চিৎকার করে উঠল–চুপচুপ কর শয়তানী–একদম, চুপ। ওই নোংরা মুখ বন্ধ কর–আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চাস

–তাহলে এইসব ব্যাপার চলছিল? নরম সুরে বলে উঠলেন মিঃ র‍্যাফায়েল।

.

২৫.

মিঃ র‍্যাফায়েল আর মিস মারপল নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেছেন।

-তাহলে আমাদের এসথার টিম কেণ্ডালের প্রেমে মজে ছিল। বললেন মিঃ র‍্যাফ্যায়েল।

–ভবিষ্যতে বিয়ের সম্ভাবনা নিয়ে ওর মধ্যে বেশ রোমান্টিকতা ছিল।

–টিম কেণ্ডালের স্ত্রী মারা গেলে বলছেন?

–আমার ধারণার কথা বলছি শুনুন। মলি মারা যাবে এমন কোন ধারণা এসথার ওয়াল্টার্সের ছিল বলে মনে হয় না। মলির সঙ্গে অন্য একজনের প্রেমঘটিত ব্যাপার রয়েছে এমন একটা ধারণা টিম এসথারকে দিয়েছিল নিশ্চয়, আর সে তা বিশ্বাসও করেছিল। সেই লোক যে মলিকে অনুসরণ করে এখানে উপস্থিত হয়েছে সম্ভবতঃ এমন কথাও টিম বলেছিল। ফলে এসথারের বিশ্বাস হয়েছিল, ওদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ অনিবার্য। এটা ওর কাছে সম্মানজনক হবে বলেই তার মনে হয়েছিল।

বুঝতে পারছি সবই। কিন্তু দুর্বোধ্য ঠেকছে টিম এসথারের প্রতি আকৃষ্ট হল কেন?

–একথা তো আপনার অজানা থাকার কথা নয়।

–ধারণা একেবারেই করতে পারছি না তা নয়। তবু আপনার ব্যাখ্যা শুনতে চাই। আপনার বুদ্ধি অসাধারণ।

আমি ব্যাখা করলে তা করব কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিয়ে। যাই হোক, নিশ্চয়ই আপনার মনে পড়বে, একবার আমি আপনাকে বলেছিলাম, জ্যাকসন আপনার কাগজপত্র সুযোগ পেলেই ঘাঁটাঘাঁটি করে।

-হ্যাঁ। তবে আমি এ বিষয়ে সতর্ক ছিলাম। ওর কিছু পাবারই সম্ভাবনা ছিল না।

–আমার ধারণা আপনার উইলের ব্যাপারটা ও জানতে পেরেছিল।

–হ্যাঁ তা সম্ভব। সুটকেসে উইলের একটা নকল রাখা ছিল।

–আপনি একবার, ওদের কানে যায় এভাবেই আমাকে বলেছিলেন, এসথার ওয়াল্টার্সের জন্য আপনার উইলে কোন ব্যবস্থা রাখেননি। এ বিষয়টা এসথার আর জ্যাকসনকে ও জানিয়ে রেখেছিলেন। এটা ঠিকই যে জ্যাকসনকে আপনি কিছুই দিয়ে যাননি। তবে এসথারকে উইলে টাকা দিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র আভাস আপনি কাউকে দেননি। তাই কি?

–ঠিক তাই। কিন্তু আপনি এসব জানলেন কি ভাবে?

–খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয়নি, হাসলেন মিস মারপল; আপনি যেভাবে জোর দিয়ে বারবার কথাটা জানাতে চেয়েছিলেন, তাতেই আসল ব্যাপারটা আমার জানা হয়ে যায়। কেউ মিথ্যা বললে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই আমি তা বুঝতে পারি।

-সত্যিই আপনি অসাধারণ মহিলা। আমি আমার উইলে এসথারের জন্য পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ডের ব্যবস্থা রেখেছি। আমি মারা যাবার পরে জানতে পেরে নিশ্চয় ও অবাক হয়ে যেত।

এবারে বুঝতে পারছি। টিম কেণ্ডাল উইলের কথা জানতে পেরেই লোভে পড়ে যায়। স্ত্রীকে বেশি মাত্রায় মাদক খাইয়ে বা অন্য উপায়ে শেষ করে পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড সেই সঙ্গে এসথারকে বিয়ে করার পরিকল্পনা ছকে নিয়েছিল।

কোন একসময়ে, টাকাটা হাতে এসে গেলে সম্ভবত তাকেও একইভাবে সরিয়ে দিত। কিন্তু ঠিক কিভাবে জানতে পারল এসথার পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড পেতে চলেছে?

মিস মারপল বললেন, জ্যাকসনই টিমকে সেকথা জানায়। ওদের দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। কোন দিন গল্পচ্ছলেই সম্ভবতঃ জ্যাকসন কোন কিছু খেয়াল না করেই প্রকাশ করে ফেলেছিল, এসথার বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পেতে চলেছে।

আমার অনুমান, নিজে সে এসথারকে বিয়ে করার চেষ্টা করে চলেছে। এমন ইঙ্গিতও করে থাকতে পারে। যদিও সে তখনো পর্যন্ত এসথারের কাছ থেকে তেমন সাড়া পায়নি।

–আপনার ব্যাখ্যায় কল্পনার প্রশ্রয় থাকলেও সবই সম্পূর্ণ যুক্তিপূর্ণ।

–সব ব্যাপারই সুন্দর ভাবে মিলে যাচ্ছে, এটা সত্যি। তবে আমি এতই মূর্খ ছিলাম যে ধূর্ত টিম কেণ্ডালের একটা মোক্ষম চাল একদম ধরতে পারিনি।

গুজব রটাবার শিল্পটা বেশ ভালরকমে রপ্ত ছিল টিমের। যা যা আমার কানে এসেছে তার অধিকাংশই মনে হয় তার রটনা করা।

এমন একটা রটনা হয়েছিল যে মলি এক অনুপযুক্ত লোককে বিয়ে করতে জেদ ধরেছিল। তার পরিবারের লোকদের আপত্তির জন্য সেই বিয়ে সম্ভব হয়নি।

আমার ধারণা সেই অনুপযুক্ত লোকটি টিম স্বয়ং। যদিও আমার ধারণা তখন সে অন্য কোন নাম ব্যবহার করেছিল।

মলির বাড়ির লোকেদের জোরালো আপত্তির কথা শুনে টিম কোল হয়তো তার কোন গোপন অপরাধ সম্পর্কে শঙ্কিত হয়েছিল। তাই সে মলির বাড়ির লোকদের সঙ্গে পরিচিত হতে চায়নি পর্যন্ত।

তবে মলির সঙ্গে ঠিক করে সে একটা গোপন মতলব নিপুণভাবে কাজে লাগায় এবং উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে। ওদের দুজনের কাছেই ব্যাপারটা খুব মজার হয়ে উঠেছিল।

মলি বাড়ির লোকেদের কাছে এমন ভাব দেখতে চেয়েছিল যে সে লোকটির জন্য পাগল। ঠিক সেই সময়েই জনৈক টিম কেণ্ডালের আবির্ভাব ঘটে। এই ক্ষেত্রে সে মলির আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের অনেকের নাম করে তাদের বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হয়। তারাও তাকে আদর অভ্যর্থনার ত্রুটি করে না। আগের অযোগ্য লোকটির বদলে একজন যোগ্য নোক পাওয়া গেছে। বলে তারা নিশ্চয় আনন্দিত হয়েছিল।

মলি আর টিম এই ব্যাপারটি নিয়ে আড়ালে যে খুবই মজা করেছিল, তা সহজেই অনুমান করা চলে।

বিয়েটা দুজনের সুসম্পূর্ণ হয়েছিল। আর মলির টাকা দিয়েই টিম এই হোটেলটা আগের মালিকের কাছ থেকে কিনে নেয়। তারপর দুজনেই এখানে চলে আসে।

টিম কেণ্ডাল যথেষ্ট যোগ্য ও করিকর্মা পুরুষ। মলির টাকা সে যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলে।

আর এমনি এক সময়েই তার পরিচয় ঘটে এসথার ওয়াল্টার্সের সঙ্গে। সে নতুন করে আবার প্রচুর টাকার সম্ভাবনার ইসারা পেয়ে যায়।

টিম কেণ্ডাল বুঝতে পেরেছিল, খুব বেশিদিন তাকে অপেক্ষা করতে হবে না। সময়টাকে সে দ্রুত প্রস্তুতির জন্য কাজে লাগালো। সে নানারকম ছলচাতুরির আশ্রয় নিল।

মলি মানসিক রোগগ্রস্ত একথাটা বিশ্বাস করাবার জন্য সে তার জাল কিভাবে বিস্তার করেছিল দেখুন। মানসিক বিপর্যয় সম্পর্কিত একটা বই সে হাতের কাছেই রেখে গিয়েছিল। তারপর মলি কিছু বুঝতে না পারে সেভাবে তাকে মাদক আর ওষুধ প্রয়োগ করে চলেছিল যাতে সে অলীক কিছু স্বপ্ন দেখে এবং উদ্ভট চিন্তা তার মাথায় আসে।

এখানে এই ব্যাপারে আপনার জ্যাকসন বেশ বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ রেখেছে। মলির কোন কোন উপসর্গ দেখে নিশ্চয় তার মনে খটকা লেগেছিল। সেসব মাদকের প্রতিক্রিয়া বলেই তার সন্দেহ হতে থাকে। এই সন্দেহ ভঞ্জনের জন্যই সেদিন সে মলির বাংলোয় ঢুকেছিল বাথরুমে রাখা প্রসাধনী পরীক্ষা করবে বলে। মলির মুখে মাখার ক্রিম পরীক্ষা করে দেখেও ছিল।

প্রাচীনকালে ডাইনীরা মলমে বেলেডোনা মিশিয়ে দিলে একই ধরনের উপসর্গ দেখা যেত–এই বিষয়টা কোনভাবে জ্যাকসনের মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে কিছু ভুলে যাওয়া, নানা রকম আতঙ্ককর স্বপ্ন–এসব থেকে মলি নিজেও বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

এইভাবে ক্রমে তার মধ্যে মানসিক রোগের সবরকম লক্ষণই দেখা দিতে শুরু করলে জ্যাকসনের সন্দেহও ঘণীভূত হয়। আমার মনে হয় মেজর প্যালগ্রেভের গল্প থেকেও জ্যাকসন এমন একটা ধারণা পেয়ে থাকতে পারে।

–মেজর সত্যিই এক অদ্ভুত লোক ছিলেন বটে। বললেন মিঃ র‍্যাফায়েল।

নিজেই নিজের মৃত্যু ডেকে এনে ছিলেন। বললেন, মিস মারপল, সেই সঙ্গে প্রাণ হারাল বেচারি ভিক্টোরিয়া। মলিও তো প্রায় শেষ হবার মুখেই চলে গিয়েছিল।

এসব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটলেও তিনি একজন খুনীকে সনাক্ত করতে আমাদের সাহায্য করে গেছেন।

–মেজর প্যালগ্রেভের কাচের চোখের কথা হঠাৎ আপার মনে পড়ে গেল কি করে?

–আমার অবাক লাগছে অমন ধূর্ত টিম কেণ্ডাল ভুল করে লাকিকে খুন করল কি ভাবে? আপনি

–নিছক ভাগ্য বলতে হবে ব্যাপারটাকে। আমার মনে হয় সে নিশ্চিত হয়েছিল যে সকলকে নিঃসন্দেহ করতে পেরেছে মলি মানসিক রোগগ্রস্ত।

একটা কাজ সমাধা হওয়ার পর পরবর্তী কাজের দিকে হাত বাড়ায় সে। মলিকে যে মাদকজাতীয় ওষুধ খাইয়ে চলেছিল, তাই খাওয়ানোর পর ওকে বলে ওরা দুজনে মিলে খুনের ব্যাপারে রহস্য ভেদ করবে।

টিম মলির সাহায্যে চায় এবং বলে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে খাড়ির কাছে একটা বিশেষ জায়গায় ওরা দুজনে মিলিত হবে।

টিম নিশ্চয় এমন আভাস দিয়েছিল যে সে জানে খুনী কে। চেষ্টা করলে তারা তাকে ফাঁদে ফেলতে পারবে।

ওষুধ খাওয়ানোর ফলে মলি তার স্বাভাবিক বিবেচনা শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। তাই স্বামীর কথায় বাধ্য মেয়ের মত সে খাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল।

কিন্তু ওষুধটা এক্ষেত্রে শাপে বর হল। মলির ঠিক যেই সময়ে খাড়ির কাছে পৌঁছনোর কথা, গতি শ্লথ হয়ে পড়ার দরুন, সেই সময় পৌঁছতে পারে না। অনেক পিছিয়ে পড়েছিল ও।

যথাসময়ে টিম নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হয়। সেখানে যাকে সে দেখতে পায় তাকে মলি বলেই ভেবে নেয়। তার মাথায় সোনালী চুল, গায়ে জড়ানো ছিল হালকা সবুজ শাল।

টিম আর বিলম্ব করে না। মেয়েটির পেছনে এসে আচমকা মুখে হাত চেপে ধরে আর সজোরে জলে টেনে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে চেপে ধরে রাখে।

–আমারও মনে হচ্ছে, ঠিক এরকমটাই করেছিল সে। কিন্তু স্ত্রীকে শেষ করে দেবার আরও সহজ পথ তো হাতেই ছিল। বেশিমাত্রায় মাদক খাইয়ে দিলেই তো কাজটা হাসিল হত।

মিস মারপল বললেন, হ্যাঁ, এই কাজটা অনেক সহজ ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এতে সন্দেহ জাগার সম্ভাবনা ছিল।

সকলেই জেনে গিয়েছিল, ডাক্তারের নির্দেশে মলির হাতের কাছ থেকে সমস্ত রকম ওষুধ ও মাদক জাতীয় জিনিস সরিয়ে রাখা হয়েছিল।

এসত্ত্বেও যদি সে অতিরিক্ত মাত্রার কিছু ওষুধ পেয়ে যেত তাহলে স্বভাবতই সন্দেহের দৃষ্টিটা পড়ত তার স্বামীর ওপরেই। কেন না, টিম ছাড়া এটা করা আর কারও পক্ষেই সম্ভব হতে পারত না।

কিন্তু হতাশাগ্রস্ত মনের চাপে মলি যদি স্বামী যখন ঘুমন্ত অবস্থায়, সেই সময়ে জলে ডুবে আত্মহত্যা করে তাহলে কারোর মনেই এসম্পর্কে কোনপ্রকার সন্দেহ জাগবে না। সকলেই একটা বিয়োগান্তক ঘটনা বলে মেনে নেবে। তাকে জোর করে জলে ডুবিয়ে মারা হয়েছে, এমন কথা কেউ বলবে না।

একটু চুপ করে কি ভাবলেন মিস মারপল। পরে বললেন, খুনীদের স্বভাবই অবশ্য এরকম। অপরাধকে একটু অসাধারণ আর জটিল করে তুলবার পক্ষপাতি।

–তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, টিম আদৌ বুঝতেই পারেনি অন্য মেয়েকে ভুল করে মেরে ফেলেছে?

–সে সুযোগই সে পায়নি, বললেন মিস মারপল, এমন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সে কাজটা করে যে মৃতের মুখটাও ভাল করে দেখার সুযোগ পায়নি।

তাছাড়া কাজ শেষ করেই সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। এক ঘণ্টা পরে কয়েকজন সঙ্গী জুটিয়ে মলির অনুসন্ধানে বেরয়। এইভাবে অতি নিপুণ ভাবে সে নিজেকে একজন বিহ্বল স্বামী বলে প্রতিপন্ন করে।

একটা বিষয়ে কিন্তু খটকা লাগছে। বুঝতে পারছি না লাকি অতরাত্রে একা খাড়ির কাছে কি উদ্দেশ্যে ঘোরাঘুরি করছিল?

আমার বিশ্বাস, লজ্জিত ভঙ্গীতে হেসে বললেন মিস মারপল, কারও জন্য অপেক্ষা করছিল।

–কে, এডওয়ার্ড হিলিংডন?

-না, সেদিকের আকর্ষণ কেটে গিয়েছিল। বরং এটা হওয়া সম্ভব, লাকি জ্যাকসনের জন্য অপেক্ষা করেছিল।

–জ্যাকসনের জন্য, বলেন কি?

মিস মারপল দৃষ্টি অবনত রেখে বললেন, লাকির ওপরে দৃষ্টি ছিল আমার। জ্যাকসনের প্রতি তার অনুরাগসিক্ত দৃষ্টিক্ষেপ আমার চোখ এড়ায়নি।

মিঃ র‍্যাফায়েলের দুচোখ নেচে উঠল। তিনি শিস দিয়ে উঠলেন।

পরে বললেন, জ্যাকসন একটা আস্ত হুলো। ওর অসম্ভব কাজ কিছু নেই। তা ভুল মানুষকে খুন করেছে বলে টিম নিশ্চয়ই প্রচণ্ডভাবে মুষড়ে পড়েছিল?

–ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মুষড়ে পড়েছিল। মলি যখন সকলকে জানাত, সেই খাড়ির কাছে ওদের মিলিত হবার কথা ছিল, তখন টিম ফাঁদে পড়ে যেত। তাছাড়া ইভিলিন যেভাবে চাপাচাপি শুরু করেছিল, যদি মলিকে কোন দক্ষ মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে হাজির করা হয়, তাহলে এতদিন তার মানসিক অবস্থা নিয়ে যে গুজব সে ছড়িয়েছে, সবই ফাঁস হয়ে যেত।

কাজেই মলিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করে ফেলাই তার বাঁচার একমাত্র উপায়।

এর ফলে পুরো ব্যাপারটা অন্য দিকে মোড় নিয়ে নিত। প্রত্যেকেই বিশ্বাস করত, মলিই লাকিকে জলে ডুবিয়ে খুন করেছে আর পরে ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।

-যথার্থ! ঠিক সময়ে আপনি যদি নিয়তির মত সেখানে উপস্থিত না হতেন তাহলে আর একটা খুনের ঘটনা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হত। আর প্রকৃত অপরাধী নিশ্চিন্তে গা-ঢাকা দেবার সুযোগ পেয়ে যেত।

বলতে বলতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন মিঃ র‍্যাফায়েল।

পরে বললেন, নিয়তি। আপনি ওরকম মাঝরাতে মাথায় গোলাপী পশম জড়িয়ে যখন আমাকে ডেকে তুললেন, তখন যদি নিজেকে দেখতে পেতেন, তাহলে আপনিও নিশ্চিত আমারই মত নিজেকে নিয়তি বলেই সনাক্ত করতেন।

.

এয়ারপোর্টে মিস মারপলকে বিদায় জানাবার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন অনেকেই।

মলি এসেছিল। সে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সাহসিকতার সঙ্গে আঘাতটা সামলে নিয়েছিল। মিঃ র‍্যাফায়েল তার জন্য তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার একজন প্রতিনিধির সহায়তার মলি তার হোটেলের কাজ চালাচ্ছিল।

মিঃ র‍্যাফায়েল রাতারাতি ইংলণ্ডে তারবার্তা পাঠিয়ে তার প্রতিনিধিকে আনিয়ে নিয়েছিলেন।

মিঃ র‍্যাফায়েল, ক্যানন আর প্রেসকট এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে অবশ্য এসথার ওয়াল্টার্স ও জ্যাকসনও ছিল।

প্লেনে ওঠার আগে পর্যন্ত সকলেই বারবার হাত নেড়ে, রুমাল নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মিস মারপলকে। অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।

Exit mobile version